অরুণদা

প্রদীপ ভট্টাচার্য

 


জিজ্ঞেস করেছিলাম “তুমি এত সহজে লেখো কী করে?” উত্তরে বলেছিলেন, “সহজভাবে দেখলে সহজেই লেখা যায়। সব সহজ হয়ে যায়। চোখ খুলেও দেখা যায় চোখ বুজেও দেখা যায়। দেখার ওপারে আরও অনেক কিছু দেখা যায়। যত দেখবি তত সহজ হবে লেখা। কসরত করতে হবে না।”

 

শান্তিনিকেতনে পৌষমেলার মাঠ। সেদিন ২৫ ডিসেম্বর। আকাশে এক থালা চাঁদ একা। ইতিউতি সাদা হালকা মেঘ উদাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। ১৪০০ সাহিত্যের মঞ্চে মাটির উপর বিছানো খড়ের বিছানায় সবাই একটু জিরিয়ে নিচ্ছে কবিতা, গানের ফাঁকে ফাঁকে। আসরের মধ্যমণি বাউল কবি আশানন্দন চট্টরাজ, অরুণ চক্রবর্তী, অগ্রদ্বীপ থেকে আসা বাঁশিবিক্রেতা শঙ্কর মালো, দুমকা থেকে আসা বাদামওয়ালা ইয়াসিন, নাম-না-জানা দূর থেকে আসা বাউল ফকির আর লিটল ম্যাগাজিন কর্মীরা। অরুণদা বললেন, ‘চল্ বুড়ো একটু এদিক ওদিক ঘুরে আসি।’ আশাদা বললেন, ‘আমিও যাব।’ রাত তখন বারোটা পেরিয়ে গেছে।

তিনজনে হাঁটতে থাকি পূর্বপল্লীর মেলার মাঠ ছাড়িয়ে উত্তরদিকে।

অনেকক্ষণ পর আমি বললাম, ‘রাত অনেক হয়েছে, চলো এবার ফিরে যাই…’ কথাটা শেষ হয়েছে কি হয়নি অরুণদা বললেন,

“হাওয়ার কাঁধে মেঘের পালকি, চাঁদ হয়েছে যাত্রী—
কেন তুমি প্রশ্ন করছ, এখন কত রাত্রি!
দিন কাটে না, রাত কাটে না,
শিকড়বাকর কাঁপছে।
ঘরের ভেতর চারটে দেয়াল উল্টো দিকে হাঁটছে।
বরগা-কড়ি, সিলিং-টিলিং উড়তে উড়তে আকাশ হয়ে যাচ্ছে…”

আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আকাশে সাদা মেঘের ভেলা— উল্টোদিকে ভেসে যাচ্ছে পৌর্ণমাসি চাঁদ।

ফিরতে ফিরতে রাত আরও গভীর। মোবাইল ফোন ছিল না। ঘড়িতে দেখলাম রাত দেড়টার বেশি। পূর্বপল্লীর রাস্তায় এসে থামল পুলিশের পেট্রোল গাড়ি।

ভিতর থেকে একজন বললেন, “এত রাতে কী আছে এখানে?” আরেকজন বলল, “মাল টাল খেয়েছে বোধহয়।”

অরুণদা বলে উঠলেন,

“আমি কোনও ঝঞ্ঝাটে নেই,
নেশা আমার চাকরবাকর।
আমি আকাশ থেকে মদ পেড়ে খাই।
বাতাস থেকে মদ ছিনে খাই,
আমি কোনও ঝঞ্ঝাটে নেই।
নেশা আমার চাকরবাকর।…”

গাড়ি থেকে একজন নেমে এলেন— সম্ভবত এসআই। আমি বললাম, “এঁকে চেনেন? ইনি লালপাহাড়ির দেশে গানের স্রষ্টা অরুণ চক্রবর্তী আর উনি ‘দেশ বিদেশের মানুষ গো যাও এ বীরভূম ঘুরে’ গানের গীতিকার আশানন্দন চট্টরাজ।”

পরিবেশ হঠাৎ বদলে গেল। পুলিশের গাড়ি থেকে সবাই নেমে এসে আশাদাকে, অরুণদাকে প্রণাম করতে গেলেন। অরুণদা সবাইকে স্বভাবসিদ্ধভাবে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর হাতে হাতে ধরিয়ে দিলেন একটি করে লজেন্স-যা তার ঝুলিতেই ছিল, বা থাকে। দরাজ গলায় বলে উঠলেন, গেয়ে উঠলেন, “হেই গো, হিথাক তুকে মানাইছে না রে…”। আমাদের সবাইকে পুলিশ থেকে আমন্ত্রণ করা হল গাড়িতে উঠে ফিরতে। আশাদা বললেন, “ও একটা বাউল। ওকে হাঁটতে দাও।”

তার হাঁটার গল্প অনেক শুনেছি।

ঘাটশিলায় সুবর্ণরেখার হাঁটু জলে পা ভেজাতে ভেজাতে হঠাৎ বলে ওঠা, “চল পাগলি তুই কোথা থেকে আসছিস দেখে আসি” বলে উৎসমুখে হাঁটা। শুনেছি ফিরতে দু-সপ্তাহ লেগেছিল। মশানজোরে টিলার উপরে একটিমাত্র কৌপিন পরে, হাত ছড়িয়ে পাখি হতে যাওয়ার ইচ্ছে সেদিন সত্যি হলে আমরা অরুণদাকে আর পেতাম না।

অরুণ চক্রবর্তীর সঙ্গে লেখক (ছবির বাঁদিকে)

 

জিজ্ঞেস করেছিলাম “তুমি এত সহজে লেখো কী করে?” উত্তরে বলেছিলেন, “সহজভাবে দেখলে সহজেই লেখা যায়। সব সহজ হয়ে যায়। চোখ খুলেও দেখা যায় চোখ বুজেও দেখা যায়। দেখার ওপারে আরও অনেক কিছু দেখা যায়। যত দেখবি তত সহজ হবে লেখা। কসরত করতে হবে না।”

দেখেছি শীতের রাতে শিশিরের শুয়ে থাকা ঘাস। সেখানে সৃষ্টি হচ্ছে একটা আলোর ফোয়ারা, চাঁদের ঢালা দূধ থেকে।

তোমার মতো সেভাবে দেখলাম কই অরুণদা!

তোমার হাত ধরেই ‘১৪০০ সাহিত্য’ মঞ্চে মনসুর ফকির, সনাতন দাস বাউলদের আসা।

আর বলেছিলেন সবার বন্ধু হতে মানুষ আর প্রকৃতির।

লিখে দিয়েছিলেন একটি কবিতা।

 

বন্ধু

অরুণ কুমার চক্রবর্তী

এসো হে বন্ধু, বন্ধু হই
করো হৃদয়ে বাস
দূরেতে সরিয়ে
যত সব্বোনাশ

মাথায় একই আকাশ
জড়িয়ে রাখে। বাতাস।
নিয়ত নিয়ে যাই একই শ্বাস
তবে আর কেনও দূরেতে রই
এসো হে বন্ধু, বন্ধু হই

আমরা রয়েছি কাছে কাছে
রক্তে একই রং মিশে আছে
একই আনন্দে হৃদি নাছে
দুজনের কথা দুজনে কই
এসো হে বন্ধু, বন্ধু হই

যা কিছু মেলামেশা
রয়েছে ভালবাসা।
এই তো যাওয়া আসা
মনে মনে শুধু জড়িয়ে রই
এসো হে বন্ধু, বন্ধু হই…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...