সৃজন ছন্দে— জাকির আল্লারাখা কুরেশি (৯.৩.৫১-১৫.১২.২৪)

ইন্দ্রনীল মজুমদার

 


ধ্বনি ও নাদই সেই পরম সিদ্ধি যেখানে নির্বাণ আসে। Music where music stops. তবলায় সেই ধ্বনির সাধনা করেছিলেন জাকির হুসেন। ওই ছ-ইঞ্চি তবলার মুখের আবরণের (ছাউনি) এমন এক মিলিমিটার জায়গা ছিল না যেটা তিনি ধ্বনির আবাহনে ব্যবহার করেননি। সেই ধ্বনির মোহে আচ্ছন্ন হয়ে কত তবলিয়া যে তাঁকে আজ অনুসরণ করেন তার হিসেব নেই। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হওয়ার নয়

 

আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বলা হয় আরাধনার কথা, আবাহনের কথা। “আমার যে গান তোমার পায়ে নাবে”। আরাধ্যকে ভগবান, আল্লা, রামরহিম যাই বলে ডাকি না কেন। সেই সঙ্গীত শুধু ঊর্ধ্বপানে যেতে চায়। প্রথাগত ধর্মবিভাজন আমাদের গানে তাই কাজ করেনি কোনওদিনই। ‘চিল্লা’ সেই আরাধনা ও আবাহনের কঠিন পরীক্ষা। ধর্মের আচার থেকেই তার সঙ্গীতের প্রাঙ্গণে আবির্ভাব। সঙ্গীত ও ধর্মসাধনার মধ্যে ফারাক ধূসর— দুটিই অতীন্দ্রিয়ের সন্ধান। চিল্লা চল্লিশ দিনব্যাপী নির্জন সাধনা— তাঁকে ডাকার। পারস্যে এর জন্ম, সুফি সাধকদের সাধনপথে। সমস্ত পার্থিব সংসর্গ ও শারীরিক প্রয়োজন সরিয়ে শুধুই আত্মনিবেদনের নিদান। প্রাণধারণের জন্য যতটুকু দরকার সেটুকু ছাড়া। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সাধনায়, শিক্ষায় এটি একটি অপরিহার্য পর্যায় ছিল। পিতার বা গুরুগৃহে। বাইজিরাও পালন করতেন চল্লিশ দিনের এই আহারনিদ্রাবিহীন নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলন। একবার চিল্লার পরে শিক্ষার্থী নিজেই বুঝতে পারতেন তাঁর সিদ্ধি কতদুর, কখন। অভীষ্ট না পেলে দ্বিতীয় চিল্লাতেও বসতেন কেউ কেউ। সে উদাহরণ খুবই কম।

পাঁচ বছর বয়সে তবলার শিক্ষা শুরু হয়েছিল পিতা আল্লারাখার কাছে। প্রায় বারো বছর শিক্ষার পরে বাবার কথায় চিল্লায় বসল ছেলে। চিল্লার শেষে মনে হল তার উত্তর সে পায়নি। ছ-মাস বাদে সেই কিশোর গেল দ্বিতীয় চিল্লার নির্জনবাসে। দ্বিতীয় চিল্লা শেষ করে তার মনে হল বাইরে যেতে হবে। আমেরিকায় চলে গেল। পরেরটা ইতিহাস। সেই ইতিহাস আরও বড় করে তৈরি করছেন তখন পণ্ডিত রবিশঙ্কর— তার বাবাকে নিয়েই। এর আগেও একবার গিয়েছিল সে বাবার সঙ্গে। স্মৃতিটা সুখের ছিল না। ধনীদের বিশাল সব বাড়িতে বাবার সঙ্গে গেছে অনেক মজলিশে। সামনে না থেকে একটু দূরে কিচেন থেকেই দেখত, শুনত। দেখেছে কোথায় আদর কোথায় অবহেলা। অন্তত তবলা বাজিয়েদের। দেখেছে পারিশ্রমিক না পাওয়া, দেখেছে ভোজসভার উদ্বৃত্ত খাবার প্যাকেট করে নিয়ে আসা। এবার যে জাকির আমেরিকা এলেন তিনি কিন্তু অন্য কেউ। নিজের পথ নিজেই কাটবেন, নিজের সম্মান, নিজের প্রাপ্য নিজেই তুলে নিতে মরিয়া। শুধু বাবাকেই অনুসরণ করাও ভাল মনে করলেন না। পরেও বলেছেন কাউকে অনুসরণ করে কিছু হয় না। বিখ্যাত সব শিল্পীদের পুত্রদের বাবাকে অনুসরণ করতে গিয়ে কী ঘটেছৈ সেটা আমেরিকায় বসে দেখেছিলেন। নাম করে করে উদাহরণ দিয়েছেন। বিদেশে বসে ফিউশান করা একজন ঘরানাদার শিল্পীর লক্ষ্য হতে পারে না। নিজে দারুণ সফল ফিউশান ব্যান্ডের দল আর রেকর্ড করেছেন— শক্তি আর রিমেম্বারিং শক্তি। পরপর গ্রামিও পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটাই তাঁর অন্বিষ্ট ছিল না। এক কথা— বাবার জুতোয় পা গলাব না। খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, জনপ্রিয়তা স্বাভাবিকভাবেই এনেছিল অনেক সমালোচনা, জনমনমোহনের অভিযোগ। কিন্তু তাঁর সমালোচকেরা, অন্য ঘরের প্রতিদ্বন্দ্বী তবলিয়ারাও আড়ালে মেনে নিয়েছিলেন তবলা নিয়ে তিনি কী করেছিলেন। সদ্যোজাত পুত্রের কানে বাবা শুনিয়েছিলেন তবলার বোল, ধর্মপ্রাণ বাড়ির প্রথানুযায়ী কোরান আবৃত্তির বদলে। সেই কথা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। কিন্তু তবলার বোলই যে ধর্ম হয়ে উঠতে পারে তা অনেকেই বোঝেননি। আমাদের সঙ্গীত তো তাই। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত পারিবারিক, বন্ধুবৎসল ও প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িয়ে পড়া মানুষ। বলতেন পোস্টার বয়ের দরকার নেই। কত শিল্পী যে পোস্টার বয়দের আড়ালেই হারিয়ে যাচ্ছেন তা দেখেছিলেন জাকির। তাই দুঃখীর পাশে দাঁড়িয়েছেন সবসময়। বোম্বেতে অনুষ্ঠানের সময়ে খবর এল ভীষণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রায় হাজার মৃত্যুর। সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলেন কোনও টাকা তিনি নেবেন না, সব টাকা যেন পরদিন ঘটনাস্থলে যায়। দুদিন আগেই তাঁর স্মরণসভায় জাভেদ আখতার বললেন, ভাল শিল্পী আর ভাল মানুষ কমই পাওয়া যায় একসঙ্গে। জাকিরভাই তাই ছিলেন।

ধ্বনি ও নাদই সেই পরম সিদ্ধি যেখানে নির্বাণ আসে। Music where music stops. তবলায় সেই ধ্বনির সাধনা করেছিলেন জাকির হুসেন। ওই ছ-ইঞ্চি তবলার মুখের আবরণের (ছাউনি) এমন এক মিলিমিটার জায়গা ছিল না যেটা তিনি ধ্বনির আবাহনে ব্যবহার করেননি। সেই ধ্বনির মোহে আচ্ছন্ন হয়ে কত তবলিয়া যে তাঁকে আজ অনুসরণ করেন তার হিসেব নেই। সেই চেষ্টা সফল হওয়ার নয়। সাথসঙ্গতের জাকির ও একক তবলাবাদনের (সোলো) জাকির আলাদা। একার বাজনায় যেভাবে তবলার ছককে সাজাতেন সেটা একটা ফর্ম হয়ে গেল। আবার প্রবাদপ্রতিম গুরুজনদের সঙ্গে সঙ্গতের সময়ে সেই জাকির শান্ত শ্রোতা, বুঝতে চেষ্টা করছেন শিল্পীর মন ও রাগের চলন। তারপরেই শুরু করতেন সঙ্গে চলা— মেজাজ ও চলন বুঝেই। বলেছিলেন পঁয়তাল্লিশ মিনিট তো লেগেই যায় যিনি বসেছেন তাঁকে বুঝতে। উদাহরণ হিসাবে শুনুন তরুণ জাকিরের সাথসঙ্গত— কিশোরীতাঈ বা আলি আকবর খান, আমজাদ আলির সঙ্গে। পুরনো লাইভ তো এখন সহজলভ্য। সঙ্গতের চরম স্ফুর্তি পেত যখন তাল ও ছন্দের খেলা মিলে যেত। বিরজু মহারাজৃর নাচ (গানও) বা শিবকুমারজির বাজনার সঙ্গতে জাকির হুসেনকে শুনুন। বিশ্বাস হবে না একই শিল্পী। ‘সৃজন ছন্দে’ গানটা মনে পড়বেই।

আলি আকবরের সঙ্গে জাকির

বিরজু মহারাজের সঙ্গে জাকির

 

সব পেয়েছিলেন। পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ। সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির ফেলো। চার-চারটে গ্র্যামি। বাইশ বছরে জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে অ্যালবাম; রবিশঙ্করজি ও হ্যারিসনের যুগান্তকারী বাংলাদেশ অ্যালবামের ঠিক পরে। হোয়াইট হাউসে কনসার্টে ডাকছেন ওবামা। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন একাধিক ফিল্মে। অভিনয় করেছেন জুলি ক্রিস্টির বিপরীতে। ছবি ‘হিট অ্যান্ড ডাস্ট’। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, Blur of his fingers rivals the beat of a hummingbird’s wing.

ওরা শুধু সেই প্রায় অদৃশ্য আঙুলই দেখেছিল। আঙুলে ধ্বনির জন্ম ওরা বোঝেনি। সেই ধ্বনির জন্য দুবার চিল্লা লাগে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...