মনোজ মিত্রের নাটক: পুঁজির বিরুদ্ধে মূল্যবোধের খড়কুটো

জয়রাজ ভট্টাচার্য

 


মনোজ মিত্র উৎপলের মতো প্রোপাগান্ডিস্ট ছিলেন না। বাদলের মতো নাটকের বিকেন্দ্রীকরণ করার দায়িত্ব নেননি। গিরিশ কারনাডের মতো মিথোলজির রিইন্টারপ্রিটেশান ওঁর নাটকে অত সচেতন প্রয়াস হয়ে ওঠেনি। তেন্ডুলকরের মতো কনফেশনাল মডার্নিজমও মনোজ মিত্রর মাঠ নয়। মনোজ মিত্র সহজ নাটক লিখতে চেয়েছেন। সহজ কিন্তু খেলো নয়। কোনও তীব্র মতাদর্শের তাড়না নয়, কোনও দারুণ আভাগাঁর্দ এক্সিপেরিমেন্ট নয়, সোশাল রিফর্মেশনের গুরুদায়িত্ব নয়, মনোজ মিত্র মঞ্চে বাংলার রূপ রস গন্ধ মাখা চেনা গল্প বলতে চেয়েছেন। চেনা গল্প আমাদের আকর্ষণ করেছে, কারণ মনোজ মিত্র সেই চেনাকে যতটা মমতায় চিনেছেন, আমরা ততটা ভাল করে তাকে দেখিনি

 

দিশি নাটকের শেষ লেখক নির্দেশক অভিনেতা ছিলেন মনোজ মিত্র। ওঁর সঙ্গে সঙ্গেই দিশি নাটকও প্রায় চলে গেল বলা যায়। খুব সচেতনভাবেই দেশজ-র মতো ভারি শব্দের বদলে আমি দিশি শব্দটাই মনোজ মিত্রকে বুঝতে সাহায্য করবে মনে করছি। দিশি এবং বাঙালি। বাঙলা ভাষাতে রচিত হলেই তা এসেনশিয়ালি বাঙালি নাটক নাও হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয়নি। মনোজবাবু দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন, আমার ধারণা সেই কারণেই, ওয়েস্টার্ন ফিলোজফির ভাষ্যকেও স্টেজে আনতে ওঁকে কোনও কিছু আরোপ করতে হয়নি। প্রক্ষিপ্ত মনে হয়নি। মনে হয়েছে, এ আমাদেরই কথা, আমাদেরই চেনা মানুষ, আমাদের মতো করেই বলছে।

শীতের দুপুরবেলা বটতলায় বসে ‘টুয়েন্টিনাইন’ খেলতে খেলতে বা সন্ধের দিকে মফস্বলের স্টেশন রোডে, সায়া-ব্লাউজের দোকানে, বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আড্ডা দেয় যারা, তাদের গল্পগাছাই মনোজবাবুর নাটকে উঠে আসে সাবলীল। গিরিশ কারনাডের নাটকে মিথোলজিকাল ন্যারেটিভ একটা ব্যাপার। বেশ ভারি ব্যাপার। কিন্তু মনোজবাবুর নাটকে সেসব চরিত্রও হাল্কাপুল্কা, তাদের নিয়ে মজা করা যায়। আর সে-মজা দিব্যি বোঝা যায়, বলে দিতে হয় না, “এটা কিন্তু হিউমার, ওটা কিন্তু সার্কাজম।”

মনোজবাবুর লেখা নাটকের মুখ্য চরিত্ররা অনেক সময়ই আমাদের মতো সাধারণ, শুধু তফাত— কোনও একটা বিষয়ে তারা গোঁয়ার। গোঁয়ার হিসেবেই তারা কিঞ্চিত আমাদের থেকে আলাদা, কিঞ্চিত অসাধারণ। কিছু একটা তারা আঁকড়ে ধরে আছে, যা কিছুতেই ছাড়বে না। সে একটা বাগান হোক, একটা ঘর হোক, বা একটা অভ্যাস হোক। একটু তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারব, আসলে যা আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইছে চরিত্রগুলো তা একটা ভ্যালুজ, যা ক্যাপিটালিজম অচল প্রতিপন্ন করেছে। ক্যাপিটালিজমের বৈশিষ্ট্য, সেখানে ক্যাপিটাল ছাড়া আর কিছুরই ভ্যাল্যু নেই। তাই মনোজবাবুর চরিত্ররা যখন একটু ফন্দি করে, একটু সেয়ানা হয়েও টিকে থাকতে চায়, তখন আমরা বুঝতে পারি, আমরা একেবারে ওই স্টেশন রোডে বিড়ি খেয়ে সন্ধেগুলো উতরে দেওয়া পাবলিকও আসলে এমন করেই টিকে থাকি।

 

মনোজ মিত্র নিজেই বলেছেন বুড়ো মানুষ ওঁর নাটকে মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠেছে বারবার। খুব তরুণ বয়সে লেখা নাটকেও মূল চরিত্র হয়েছে বৃদ্ধ। আর সেই চরিত্রে অভিনয় করেছেন মনোজ মিত্র নিজে। এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন— এই যে বেঁচে থাকার জন্য কত বিচিত্র লড়াই করতে হয়, কত ফন্দি খাটাতে হয়, কত পন্থা, স্ট্র‍্যাটেজি, আর সেই থেকে কত কত অভিজ্ঞতা, এইটা ওঁকে আকর্ষণ করেছে চিরকাল। ভেঙে পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়াচ্ছে একটা মানুষ, এটা শুধু একটা ব্যক্তিমানুষে সীমাবদ্ধ থাকে না। আর সে-মানুষ যদি অনেকটা পথ পেরিয়ে আসে, তার শরীরে পরে কালের দাগ। মানুষটাকে রক্তে মাংসে আলোতে আর অন্ধকারে জীবন্ত করে তুলতে পারলে, ওই মুমূর্ষু অথচ জীবন্তকালটাই মূর্ত হয়। মনোজ মিত্র ওঁর নাটকে, কলম আর অভিনয়, দুই দিয়েই ওই ভাঙাচোরা স্যাঁতসেঁতে সময়টাকে ধরে ফেলতে পেরেছেন।

 

উনি উৎপলের মতো প্রোপাগান্ডিস্ট ছিলেন না। বাদলের মতো নাটকের বিকেন্দ্রীকরণ করার দায়িত্ব নেননি। গিরিশ কারনাডের মতো মিথোলজির রিইন্টারপ্রিটেশান ওঁর নাটকে অত সচেতন প্রয়াস হয়ে ওঠেনি। তেন্ডুলকরের মতো কনফেশনাল মডার্নিজমও মনোজ মিত্রর মাঠ নয়। মনোজ মিত্র সহজ নাটক লিখতে চেয়েছেন। সহজ কিন্তু খেলো নয়। কোনও তীব্র মতাদর্শের তাড়না নয়, কোনও দারুণ আভাগাঁর্দ এক্সিপেরিমেন্ট নয়, সোশাল রিফর্মেশনের গুরুদায়িত্ব নয়, মনোজ মিত্র মঞ্চে বাংলার রূপ রস গন্ধ মাখা চেনা গল্প বলতে চেয়েছেন। চেনা গল্প আমাদের আকর্ষণ করেছে, কারণ মনোজ মিত্র সেই চেনাকে যতটা মমতায় চিনেছেন, আমরা ততটা ভাল করে তাকে দেখিনি। দেখিয়ে দেওয়ার পর মনে হয়েছে, আরে এ তো আমিও রোজ দেখছি। যেমন অকিঞ্চিৎকর হিজলগাছটাকে জীবনানন্দ চিনিয়ে দেন, সে-রকমই। আলগোছে চেনান মনোজ, খুব কসরত করেন না। অভিনয়ের ক্ষেত্রে একটা কথা চালু আছে— এফোর্টলেস। মনোজের লেখা এবং অভিনয় দুইই ছিল এফোর্টলেস। সেটা হতে পেরেছিল, সম্ভবত মনোজ মিত্র দর্শনশাস্ত্রর অধ্যাপক ছিলেন বলেই বোধহয়। দর্শন তো আসলে ভাল করে দেখাই। উনি খুব ভাল করে দেখতেন, তাই সেই দেখাকে সহজে বলতে পারতেন। আমরা অকিঞ্চিৎকর ভেবে যা ফেলে দিই, সেটাই দার্শনিক আর বিজ্ঞানীর মনোযোগ পায়। না হলে নিউটনের আগে কি আর গাছ থেকে আপেল আকাশের দিকে উঠে যেত? উনি দেখেছেন, ভেবেছেন, আমরা ভেবেছি, এতে আর কী দেখার আছে!

মনোজ মিত্র দেখেছেন নোনা ধরা দেওয়াল, স্যাঁতসেঁতে পুকুরঘাট, আটচালার মজলিস। মনোজ আজীবন তা দেখেছেন মনোযোগ দিয়ে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...