বিশ্বের করুণ হাল

প্রদীপ দত্ত

 



প্রদীপ দত্ত-র জলবায়ু বদলে যাচ্ছে: পৃথিবী বিপন্ন বইটির পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হতে চলেছে। বর্তমান নিবন্ধটি বইটির একটি অধ্যায়

 

 

মোটামুটি ১৮৫০ সাল থেকে বিশ্বজোড়া তাপমাত্রার রেকর্ড পাওয়া যায়। সেই সময় থেকে ২০২৩ সালের শেষ অবধি, ২০২৩ সাল-ই ছিল রেকর্ড অনুযায়ী সবচেয়ে গরম বছর। গড় তাপমাত্রা ছিল প্রাক-শিল্পায়ন সময়ের চেয়ে ১.৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এই লাইন যখন লেখা হচ্ছে, ২০২৪ তখনও শেষ হয়নি। কিন্তু কোপার্নিকাস উপগ্রহের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন যে বছরশেষে খুব অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে ২০২৪ সালের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি আরও বেশি হবে।

তিন দশকেরও বেশি আগে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে পৃথিবীর কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়েছিল, অথচ নিঃসরণ না কমে বেড়েই চলেছে। ১৯৯২ সালে নিঃসরণ হয়েছিল ২,২৫৬ কোটি টন, এরপর তা বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালে হয় ৩,৬৮০ কোটি টন। ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে (প্যারিস শীর্ষ সম্মেলন) বলা হয়েছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে নিঃসরণ এতটাই কমিয়ে ফেলা হবে যেন উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকে, চেষ্টা করা হবে ১.৫ ডিগ্রির নিচে রাখার। অথচ ২০২৩ সালে নিঃসরণ বেড়ে হয়েছে ৩,৭৪০ কোটি টন।[1] প্যারিস চুক্তির পর থেকে, একমাত্র কোভিডের সময় (২০২০ সাল) ছাড়া প্রতি বছরই নিঃসরণ বেড়েছে।

২০১৯ সালে ওয়ার্ল্ড মিটিওরলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (WMO) জানিয়েছিল, গত শতকের গড়ের চেয়ে এখন তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা আরও বেড়ে যেত, কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানির দূষণে বায়ুমণ্ডলে ভাসমান সূক্ষ্ম কণার (এরোসল-এর) ঠান্ডা প্রভাবের দরুন ততটা বাড়েনি।[2]

আইইএ জানিয়েছিল: প্রায় তিন দশক ধরে নিঃসরণ কমানোর জন্য বিপুল উদ্যোগ এবং অতিমারির দরুন ২০২০ সালে নিঃসরণ কমার পরও, ২০২১ সালে দেখা গেল ওই এক বছরে কার্বন নিঃসরণ শতকরা ৬ ভাগ বেড়েছে। ওই বছর কয়লা ও গ্যাস থেকে নিঃসরণ হয়েছে যথাক্রমে ১,৫৩০ ও ৭৫০ কোটি টন, তেল থেকে হয়েছে ১,০৭০ কোটি টন। একই বছর নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে উৎপাদন হয়েছে ৮,০০০ টেরাওয়াট-আওয়ার[3]। এতৎসত্ত্বেও, বিশ্বজুড়ে শক্তি দক্ষতার প্রচেষ্টা মোটের উপর অনেক পিছিয়েই আছে।

অর্থাৎ, প্রতি বছর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ার মোকাবিলায় শুধু নবায়নযোগ্য শক্তির বৃদ্ধিতেই নিঃসরণ কমবে না। সাম্প্রতিক স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষণা থেকে জানা গেছে: গ্রিনহাউস গ্যাস যতই কমুক তিরিশের দশকের প্রথম ভাগের মধ্যে শিল্পসভ্যতা-পূর্ব সময়ের চেয়ে বিশ্বের তাপপমাত্রা নিশ্চিতভাবেই ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে যাবে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে, পর পর দু-বছর তাপমাত্রা প্রায় ১.৫ ডিগ্রি ছুঁয়ে ফেলেছে। আগামী দিনে নিঃসরণ যতই কমুক, ২ ডিগ্রিতে পৌঁছে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। ২০৫০ কিংবা ২০৬০ সালের মধ্যে নিঃসরণ-শূন্য হয়ে গেলেও তার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ।

মানুষের ক্রিয়াকলাপের ফলে নিঃসরিত গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রায় ৮০ শতাংশই কার্বন ডাইঅক্সাইড। আবার কার্বন নিঃসরণের ৬৫ শতাংশের জন্য দায়ী কয়লা। ২০ শতাংশের জন্য দায়ী পরিবহণ। অতীতের বায়ুমণ্ডলের বাতাস বহু প্রাচীন বরফের স্তরে ধরা পড়ে শত সহস্র লক্ষ বছর থেকে যায়। প্রধানত সুমেরু ও কুমেরুর বরফের অন্তঃস্থলে বিজ্ঞানীরা এমন পুরনো দিনের আটকে থাকা বাতাসের নমুনার হদিশ পেয়েছেন। সেই নমুনা পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে যে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা যেখানে পৌঁছেছে, তা নিশ্চিতভাবে গত ৮ লক্ষ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং সম্ভবত ৩০ লক্ষ বছরের মধ্যেও তাই। মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণও এখনই সবচেয়ে বেশি। মানুষ ব্যাপকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো শুরু করার আগে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের অনুপাত ছিল দশ লক্ষ ভাগের ২৮০ ভাগ (পার্টস পার মিলিয়ন)। ২০২৩ সালে তা হয়েছে বার্ষিক ৪২১.০৮ ভাগ। প্রাক-শিল্পায়ন সময়ের থেকে ৫০.৪ শতাংশ বেশি। এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বছরের মধ্যে গত দশকই ছিল সবচেয়ে উষ্ণ। ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের গড়ের চেয়ে তাপমাত্রা এখনই বেড়েছে ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই প্যারিসের অঙ্গীকার ব্যর্থ হতে চলেছে।

আইপিসিসি[4] জানিয়েছিল, ১.৫ ডিগ্রিই হল চূড়ান্ত সীমা। তার বেশি হলে চরম আবহাওয়ার ঘটনা অনেক বেড়ে যাবে, জলবায়ু বদলে আবহাওয়ার অপরিবর্তনীয় বদল হবে। জানা গিয়েছিল, বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে বেঁধে রাখার লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে নিঃসরণ প্রায় অর্ধেক করে ফেলতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে।

বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড বৃদ্ধির কিলিং রেখা (Keeling Curve)— ১৯৫৮ থেকে ২০২৩।  সূত্র: Dr. Pieter Tans, NOAA/ESRL and Dr. Ralph Keeling, Scripps Institution of Oceanography, Uploaded: 15 December 2023 (Creative Commons License, Attribution-ShareAlike 4 International.)

২ ডিগ্রিকে মনে করা হয় টিপিং পয়েন্ট, অর্থাৎ যে তাপমাত্রায় মেরুর বরফের পাটাতন একেবারে গলে যাবে, অথবা বিপুল বনাঞ্চল একেবারে ধবংস হয়ে যাবে, যেমন আমাজন অরণ্য,‌ যার ফল এই গ্রহের জন্য অতি ভয়ানক হবে। তাই তাপমাত্রার অতটা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই দুশ্চিন্তার কথা। তবে আইইএ-র মতে পৃথিবী এখন কয়লা-সহ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে শীর্ষের কাছাকাছি রয়েছে।[5]

এখনই জলবায়ু বদল তীব্র ও ব্যাপক হয়ে বাস্তুতন্ত্র এবং মানুষের চরম সর্বনাশ ডেকে আনছে। বিশ্বে ঘন ঘন তাপপ্রবাহ, দাবানল, ঝড়-বৃষ্টি-বন্যার বিপর্যয় মারাত্মক আকার নিচ্ছে। ২০২৩ সালে ইউরোপে গরমে মারা গেছে ৪৭,৬৯০ জন। ওই বছর কানাডায় চরম দাবানলের মরশুমে নিঃসরণ গড়ের তুলনায় ছয় থেকে আট গুণ বেশি হয়েছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মনে করা খরা বন্যা উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা। এখন উন্নত বিশ্বকে তার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ইউরোপের বন্যায় আজ অনেক মানুষ মারা যায়, যা কয়েক বছর আগেও ভাবা যেত না। কিছুদিন আগেও বিজ্ঞানীরা এত কম উষ্ণতা (১.৩ ডিগ্রি) বৃদ্ধিতে যে চরম বিপর্যয় অসম্ভব বলে মনে করতেন, এখন তাই ঘটছে। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে পর্বতের চূড়া, আর্কটিক, আন্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডের বরফ কমে যাওয়া এবং ক্রমাগত অরণ্য ধবংসের ফলে আবহাওয়ার চরম ঘটনা বিরামহীনভাবেই ঘটতে থাকবে।

 

কয়লার ব্যবহার চিনে সবচেয়ে বেশি

বিশ্ব চিনের কয়লার উপর নির্ভরতা কমানোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও চিন ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি নতুন কয়লা-চালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র যোগ করেছে। ২০২১ এবং ২০২২-এ খরার জন্য চিন চরম বিদ্যুৎ ঘাটতির মুখোমুখি হয়েছিল। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি মেটাতে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়ে বেইজিং তা মেটাতে চায়। দুবাই শীর্ষ সম্মেলনের (সিওপি২৮) প্রতিশ্রুতি এবং সবুজ শক্তিতে বিপুল বিনিয়োগের পরও বাড়তি চাহিদা মেটাতে কয়লার ব্যবহার বাড়িয়েছে।

গ্লোবাল এনার্জি মনিটর (৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪) প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী নতুন কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের ৯৬ শতাংশই ছিল চিনের অবদান। গত পাঁচ বছরে ১৯১ গিগাওয়াট ক্ষমতার তাপবিদ্যুৎ যোগ করেছে, যা ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী নতুন তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের ৬৪ শতাংশ। মনে রাখতে হবে, ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, তাপবিদ্যুৎ চিনের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৪০ শতাংশ।[6] তবে, আগে এই অনুপাত আরও বেশি ছিল— ২০২৩ সালে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদিত বিদ্যুতের ৬০ শতাংশের বেশি ছিল।

বার্ষিক নিঃসরণের তুলনায় বিশ্বের বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের অনুপাত বৃদ্ধি সূত্র: https://climateportal.ccdbbd.org/data/global-atmospheric-carbon-di-oxide-compared-to-annual-emissions-1751-2022/

চিনে প্রতি বছরই বায়ু ও সৌরশক্তির তুমুল বৃদ্ধি না হলে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য নিঃসরণ আরও বেশি হত। তাছাড়া ভ্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ পরিবহণ বৃদ্ধির ফলে সে-দেশে তেলের ব্যবহার বেড়েছে। আজ নিঃসরণের শতকরা প্রায় ৩৩ ভাগ করে চিন।[7] চিন জানিয়েছে, তাদের নিঃসরণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে ২০২৬ সালে। অবশ্য আইইএ মনে করে, ২০২৪ সালের পর থেকেই চিনের নিঃসরণ কমতে শুরু করবে।

২০২১ সালে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাপবিদ্যুতের উপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ওই বছর রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, চিন সবুজ এবং কম কার্বন-ভিত্তিক শক্তির উন্নয়নে অন্য উন্নয়নশীল দেশের জন্য সমর্থন বাড়াবে এবং বিদেশে নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করবে না।[8] নবায়নযোগ্য শক্তি দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও প্রযুক্তিগত বাধা, বড় আকারের শক্তি সঞ্চয়স্থান এবং স্মার্ট গ্রিডের ঘাটতির জন্য চিন অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে। চিন তাই এখন সেই কাজে জোর দিয়েছে।

 

জীবাশ্ম জ্বালানি আর নয়

অনেক দেশই নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন ক্ষমতা অনেকটা বাড়িয়েছে। কিন্তু পাশপাশি সারা বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন ক্ষমতাও বেড়েছে। যে-কোনও একটি বছরে, চিন বা ভারতের শক্তি চাহিদা বৃদ্ধির অনেকটা সেই বছর মোতায়েন করা নতুন নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে এলেও, বাকিটা নতুন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেই আসে। তাই আমেরিকা এবং ইউরোপে কয়লার ব্যবহার কমা সত্ত্বেও, বিশ্বের নিঃসরণ বেড়েছে। গত বছর চিনের নিঃসরণ ৪ শতাংশ বেড়েছে, ভারতের বেড়েছে ৮.২ শতাংশ।

আমেরিকায় একে একে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হচ্ছে। নতুন গ্যাসবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও নবায়নযোগ্য শক্তি বাড়ছে। গ্যাস থেকে নিঃসরণ কয়লার অর্ধেক হয়। তাই নিঃসরণ কমছে, গত বছর কমেছে ৩ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নেও (ইইউ) তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হওয়া এবং নবায়নযোগ্য শক্তি বাড়ার জন্য গত বছর নিঃসরণ কমেছে ৭.৪ শতাংশ। ইংল্যান্ডে শেষ কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সম্প্রতি বন্ধ হয়েছে। ওদিকে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ার জন্য ভারতের নিঃসরণ বাড়ছে, নবায়নযোগ্য শক্তির বৃদ্ধি তা মেটাতে পারছে না। একই কারণে জাপানেও বাড়ছে। বড় দেশ হিসাবে রাশিয়ায় নবায়নযোগ্য শক্তির অংশ খুবই কম, সর্বসাকুল্যে ৬.০৪ গিগাওয়াট। তাই রাশিয়ার নিঃসরণও কমছে না।

একদিকে যখন বায়ু থেকে কার্বন শোষণের জন্য গাছ লাগানো বা বন বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে অনেক অঞ্চলে বনাঞ্চল উজাড় করা চলছে, দাবানলও বাড়ছে। ২০২৩ সালে কানাডার চরম দাবানলের মরসুমে গড়ের তুলনায় ছয় থেকে আট গুণ বেশি নিঃসরণ হয়েছে। উষ্ণতা বৃদ্ধি সীমিত করতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং বনাঞ্চল ধ্বংস থেকে নিঃসরণ যত দ্রুত সম্ভব শূন্যে নামাতে হবে। বনভূমি ধ্বংস থেকে কার্বন নিঃসরণ যত হয় তা জীবাশ্ম থেকে নিঃসরণের প্রায় ৮ শতাংশ।

বিশ্বব্যাপী তথ্য দেখায় যে, নিঃসরণকে নেট শূন্যর[9] পথে রাখার জন্য বর্তমান প্রচেষ্টা অপ্রতুল। বায়ুমণ্ডলে কার্বনের অনুপাত দ্রুত বাড়ছে। তা আরও বেশি জলবায়ু পরিবর্তন এবং উষ্ণায়ন ডেকে আনছে। সবচেয়ে খারাপ প্রভাব এড়াতে হলে সমস্ত দেশের অর্থনীতিকে বর্তমানের চেয়ে অনেক দ্রুত কার্বন নিঃসরণহীন করতে হবে।

আইপিসিসি বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রিতে বেঁধে রাখতে গেলে ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ সর্বোচ্চ সীমায় এনে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৩ শতাংশ কমিয়ে ফেলতে হবে। মিথেন নিঃসরণ কমাতে হবে তিনভাগের একভাগ। তারপর ২০৪০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিঃসরণ কমলেও বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব কমতে সময় লাগবে পাঁচ থেকে দশ বছর। আর তাপমাত্রা কমতে কুড়ি থেকে তিরিশ বছর। তাই এখনই নিঃসরণ কমিয়ে ফেলা জরুরি। ২০২১ সালের মে মাসে আইইএ জানিয়েছিল যে, মানুষের জন্য এই জরুরি অবস্থার সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব ঠেকাতে গেলে জীবাশ্ম জ্বালানিকে মাটির নিচেই রেখে দিতে হবে। ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং শক্তির চাহিদা বৃদ্ধির জন্য চিন ও ভারত এখনও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়াচ্ছে। আরও বিপদ হল সৌদি আরব এবং কুয়েতের মতো মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ আগামী দিনে তেল উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে।

মুশকিল হল বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে জীবাশ্ম জ্বালানি এখনও গুরুত্বপূর্ণ। তাতে ভর্তুকি দেওয়াকে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার উপায় হিসেবে দেখা হয়। বিশ্বব্যাপী এই ভর্তুকি অনুমিত পরিমাণ বছরে ১০.৫ ট্রিলিয়ন ডলার (১০.৫ লক্ষ কোটি ডলার)। বিশ্ব যখন ক্রমবর্ধমান জলবায়ু সঙ্কটের মোকাবিলা করছে, জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তবে ভর্তুকি একবার দেওয়া হলে প্রত্যাহার করা রাজনৈতিকভাবে কঠিন। ইন্দোনেশিয়ায় জ্বালানি ভর্তুকি দেশের জিডিপির ২ শতাংশ। সরকার তা তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে দাঙ্গা বেধেছিল। কিন্তু তারপরও ভর্তুকি বন্ধ না করলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ হবে না।

এর পালটা হিসাবে নানা দেশের সরকার নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশে ভর্তুকি এবং কর প্রণোদনা দেয়, যার মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি হ্রাস আইন (ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট বা আইআরএ) অনুযায়ী ৫০ হাজার কোটি ডলার ভর্তুকি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের গ্রিন ডিল এবং চিনের সৌর প্যানেল, বায়বিদ্যুৎ যন্ত্র ও বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো সবুজ প্রযুক্তিতে বড় ভর্তুকি। লক্ষ্য হল নবায়নযোগ্য শক্তি এবং বিদ্যুতায়িত পরিবহণকে ক্রমাগত আরও সাশ্রয়ী এবং প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা। নবায়নযোগ্য শক্তিতে ভর্তুকি আরও বাড়ানো দরকার, যাতে দ্রুত বাড়ে।

তাপবিদ্যুৎ ও পরমাণুবিদ্যুৎ টিকিয়ে রাখতে নানা রাষ্ট্র যে বিপুল ব্যয় করে তা দিয়ে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আরও বেশি সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন করে পৃথিবীর হাল কিছুটা ফেরানো যেত। জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসাবে পরমাণুবিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা যে কোনও কাজের কথা নয়, তা আমরা এই বইয়ের পরিশিষ্টে আলোচনা করেছি।

জলবায়ু বদল ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আজ পর্যন্ত যেসব কথা হয়েছে তা যেন অর্থহীন। ২০০৯ সালে শক্তি ব্যবহারের ৮০.৩ শতাংশ আসত জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে, দশ বছর পর ২০১৯ সালে মাত্র ০.১ শতাংশ কমে তা হয়েছিল ৮০.২ শতাংশ। অথচ একই সময়ে সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ ৮.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছিল মাত্র ১১.২ শতাংশ। তার মানে বিদ্যুতের চাহিদা যে বাড়ছে নবায়নযোগ্য শক্তি তারই জোগান দিতে পারছে না। জীবনধারণে এত বেশি বিদ্যুৎনির্ভরতা কমাতে বিশ্বে কোনও প্রচার নেই বা মানুষকে বোঝানোর কোনও উদ্যোগ নেই।

উষ্ণায়নের ফলে বিশ্বে ঘন ঘন তাপপ্রবাহ, ঝড়, বন্যা, দাবানল ও অন্য্যান্য চরম বিপর্যয় ঘটেই চলেছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মনে করা হত বন্যা ও খরা উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা। আজ উন্নত বিশ্বকে তার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ইউরোপে বন্যায় ব্যাপক মানুষ মারা যায়, যা কয়েক বছর আগেও ভাবা যেত না। ২০২২ সালে শুধু ইউরোপেই গরমে মারা গেছে ৬২,৮৬২ জন, ২০২৩ সালে ৪৭,৬৯০ জন।

এই গ্রহের লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাসে এখনই বায়ুমণ্ডলে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো ছাড়া কৃষিক্ষেত্রে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণের জন্য মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৮ লক্ষ বছরের মধ্যে এখনই সবচেয়ে বেশি। এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বছরের মধ্যে গত দশকই ছিল সবচেয়ে উষ্ণ।

 

জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মত

জলবায়ুর সংবেদনশীলতা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন আরও নিশ্চিতভাবে বলছেন। আদিমকালের জলবায়ু নিয়ে গবেষণার সঙ্গে উন্নত উপগ্রহ প্রযুক্তির সাহায্যে মেঘ ও নিঃসরণ নিয়ে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে নতুন মডেলের সাহায্যে বায়ুমণ্ডলে তার সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে আরও সুস্পষ্টভাবে বলা যাচ্ছে।

জলবায়ু বদলে যাওয়া ও তার ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আইপিসিসি ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ২০২১: দ্য ফিজিক্যাল সায়েন্স বেসিস’ রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। রিপোর্টে ১৯৫টি দেশের অনুমোদন ছিল। সাড়ে তিন হাজার পৃষ্ঠার ওই রিপোর্ট আসলে চোদ্দ হাজার গবেষণাপত্রের নির্যাস। রিপোর্টটি শুরুতে বলা হয়েছে: মানুষের প্রভাবেই যে বায়ুমণ্ডল, সমুদ্র ও স্থলভাগ উষ্ণ হয়েছে তা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা দরকার। বলা হয়েছে, রক্ষা পাবে না কোনও দেশ এবং কোনও সরকারই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। আইপিসিসি জানিয়েছিল, প্রাক-শিল্প সভ্যতা সময়ের দ্বিগুণ নিঃসরণ হলে তাপমাত্রা বাড়বে ২.৫ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়বে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

আইপিসিসি আরও জানিয়েছে, ১৯৫০ সালের পর থেকে স্থলভাগে বাতাসের উষ্ণ স্রোত আরও ঘন ঘন বইছে, ওদিকে শৈত্যপ্রবাহ কমছে। ১৯০১ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ছিল বছরে ১.৩ মিলিমিটার, ২০০৬ থেকে ২০১৮-র মধ্যে বেড়েছে ৩.৭ মিলিমিটার হারে। তাই এরই মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা বেড়ে গেছে ০.২০ মিটার বা প্রায় ৮ ইঞ্চি।

উপরের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক অতীতের দাবানল ও বন্যা দেখিয়ে দিচ্ছে, কীভাবে আমরা জলবায়ু ব্যবস্থাকে বদলে দিচ্ছি। জলবায়ুর কয়েকটি প্রভাব অপরিবর্তনীয়। মানবজাতি এই গ্রহকে স্থায়ীভাবে বদলে দিচ্ছে। প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য যদি স্থির রাখতে হয়, তাহলে ২০৩০-এর মধ্যে নিঃসরণ অর্ধেক কমিয়ে ফেলতে হবে এবং  নিঃসরণ দ্রুত শূন্যে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করতে হবে।

নিঃসরণ বন্ধ হলে তাপমাত্রা কয়েক দশকের মধ্যে থিতু হবে। তবে অন্য কয়েকটি প্রভাব, যেমন সমুদ্রস্তর বেড়ে যাওয়া, অনেক শতক ধরে চলবে। রিপোর্টে নিঃসরণ শূন্য হলে কী ঘটবে তাও বলা হয়েছে। যেমন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমলে এয়ারোসল কমবে বলে কুলিং এফেক্টও কম হবে। তখন তাপমাত্রা আরও বাড়বে। তার মোকাবিলা করতে হলে ব্যাপকভাবে মিথেন নিঃসরণ কমাতে হবে। কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড ছাড়াও আরও কয়েকটি গ্রিনহাউস গ্যাস, যথা ওজোন ও সালফার হেক্সাফ্লোরাইড এবং হাইড্রোফ্লুরোকার্বন ও পারফ্লুরোকার্বন গোত্রের গ্যাসের নিঃসরণ বন্ধ করলে উষ্ণায়নের গতি কমবে।

বিশ্বের অন্য অংশের তুলনায় আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে তাপমাত্রা বাড়ছে বেশি দ্রুত। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র। সমুদ্রস্তর উঁচু হওয়ার জন্য ভারতের ৭,৫১৭ কিলোমিটার সমুদ্রতট বিপন্ন হতে চলেছে। এর ফলে বর্তমান উপকূল ক্রমেই সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। আইপিসিসি একটি গবেষণাপত্রের কথা উল্লেখ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে, সমুদ্র ৫০ সেন্টিমিটার (২০ ইঞ্চি) উঁচু হলে ভারতের ছ-টি বন্দর শহর— চেন্নাই, কোচি, কলকাতা, মুম্বাই, সুরাট ও বিশাখাপত্তনমের ২.৮৬ কোটি মানুষ উপকূলের বন্যায় আক্রান্ত হবে। ডুবে যাবে ৪ হাজার কোটি ডলার মূল্যের সম্পত্তি।

এভাবে চললে বছরে ৯০ থেকে ১০০ দিন এশিয়ায় সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা হবে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। দাবানলের সংখ্যাও বাড়বে। ভারতে যখন স্থলভাগ সমুদ্রের জল গ্রাস করছে, ওদিকে হিমালয়ের বরফ তুমুলভাবে গলছে। হিমবাহ পাতলা হচ্ছে, আকার ও ব্যাপ্তিতে ছোট হচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো চিরস্থায়ী। সমুদ্রের জলস্তর আর নামবেই না, বেড়েই চলবে। নতুন হিমবাহও তৈরি হবে না। হিমবাহ গলা জলে তৈরি হ্রদের জলস্তর বেড়ে গিয়ে বন্যা হবে, পাহাড়ি এলাকায় ধস নামবে। বায়ুদূষণ বাড়ার ফলে বাতাসে ভাসমান এয়ারোসল সূর্যরশ্মি শুষে নিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে যে, একদিন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বর্ষা রাজত্ব করবে।

দক্ষিণ ভারতে বৃষ্টিপাত বাড়বে। তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি বাড়লে ভারতে বার্ষিক বৃষ্টিপাত বাড়বে ৪০ শতাংশ। ওইদিকে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, তিব্বত, চিনের অসংখ্য মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজনের জল পায় হিমালয় থেকে। পশ্চিম হিমালয়ের লাহুল-স্পিতি অঞ্চলের হিমবাহ এই শতাব্দীর শুরু থেকেই প্রবলভাবে গলছে। নিঃসরণ যদি না কমে, হিন্দুকুশ হিমালয়ের হিমবাহের দুই-তৃতীয়াংশই গলে যাবে। ভারতে বৃষ্টি যেমন বাড়বে, চরম উষ্ণতাও বাড়বে। তাই খরা, দাবানলও বাড়বে। কৃষকের জীবন ও জীবিকা অসহনীয় হয়ে উঠবে। আগে দশ বা পঞ্চাশ বছরে যত মারাত্মক গরম, অত্যধিক বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা ইত্যাদি হয়েছে ভবিষ্যতে তা আরও ঘন ঘন দেখা দেবে, আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে। নতুন নতুন অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শীতকালে রাতের তাপমাত্রা বেশি থাকবে, বৃষ্টিপাত হবে খামখেয়ালি। বিধ্বংসী বন্যা ও ঝড়বিদ্যুৎ ও জল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে। কৃষির ফলনেও তার প্রভাব পড়বে।

২০২১-এর রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে, ২০১৯ সালে বায়ুদূষণের জন্য ভারতে ১৬.৭ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। গরিব মানুষের উপর দূষণের প্রভাব বেশি। বিশ্বের দশটি সবচেয়ে দূষিত শহরের ৬টিই রয়েছে এদেশে (ওই বছরের পরে অনেক বেড়েছে)। চরম আবহাওয়া এবং বায়ুদূষণ গরিব কৃষক, মজুরের জীবনে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছে।

কুড়ি বছর আগে কোনও বিশেষ ঝড় বা হঠাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে উষ্ণায়নের সম্পর্ক নির্ধারণ করা যেত না। ২০১৩ সালের পর থেকে বিজ্ঞানীরা তা নির্ধারণ করছেন। আবহাওয়ার চরম ঘটনার সঙ্গে জলবায়ু বদলের সম্পর্ক চলমান বিপর্যয়ের সময়ই বলে দেওয়া যাচ্ছে। ২০২১ সালের জুন মাসে উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে অস্বাভাবিক গরম পড়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন’ জানিয়েছিল, জলবায়ু বদল ছাড়া ওই তাপমাত্রা বাড়া সম্ভবই ছিল না। ২০২৪-এর সেপ্টেম্বরের শেষে আমেরিকার ফ্লোরিডায় বিধ্বংসী হারিকেনের পর একইভাবে বিজ্ঞানীর দল জানিয়েছে, ওই ঝড়ে উষ্ণায়নের প্রভাব ছিল।

উষ্ণায়ন পৃথিবীকে এমন এক প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে, এমন এক জলবায়ুতে, যেখানে বায়ুমণ্ডলীয় নদীর[10] সংখ্যা ও প্রকোপ বাড়বে এবং দাবানল, তাপপ্রবাহ, চরম বৃষ্টিপাত এবং খরা অতি সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠবে৷ বিশ্বের সমুদ্রের উপকূলের কাছে বসবাসকারী ১০০ কোটি মানুষ উঁচু হতে থাকা সমুদ্রের জলে ভেসে যাবে। কুমেরু মহাদেশের বরফের চাদর এবং বরফের পাটাতন আর থাকবে না। জলবায়ুর মডেল দেখায় যে, গ্রিনহাউস এফেক্টের ফলে মেরু অঞ্চল আরও বেশি উষ্ণ হবে। কার্যত, ঠিক তাই হচ্ছে। মেরু অঞ্চলের জলবায়ুর এই ত্বরান্বিত উষ্ণায়ন মেরু পরিবর্ধন (polar amplification) নামে পরিচিত। সুমেরুতে এর প্রভাব এখনই অনেক বেশি প্রকট। সুমেরু বিশ্বের গড় তাপমাত্রার থেকে ২-৩ গুণ বেশি হারে উষ্ণ হচ্ছে, সমুদ্রের বরফ স্থায়ীভাবে কমে যাচ্ছে। গ্রিনল্যান্ডের বরফও দ্রুত গলছে। কুমেরুর ভবিষ্যৎও করুণ। নিঃসরণের গতিপথ পরিবর্তন না করলে ২০৭০ সালের মধ্যে কুমেরুর জলবায়ু প্রাকশিল্প সময়ের চেয়ে ৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি উষ্ণ হবে। দক্ষিণ মহাসাগরও উষ্ণ হবে। তার ফলে, গ্রীষ্মকালে সেখানকার সমুদ্রের বরফের ৪৫ শতাংশের বেশি হারিয়ে যাবে, কুমেরুর উপরদিকের সমুদ্র এবং বায়ুমণ্ডল আরও দ্রুত উষ্ণ হবে, কারণ সমুদ্রের জল সাদা বরফের তুলনায় সৌর বিকিরণ বেশি শোষণ করে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল থেকে বায়ুমণ্ডলীয় নদীগুলো উষ্ণ আর্দ্র বাতাসকে আরও দক্ষিণে নিয়ে যাবে।

বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। যদি পঞ্চাশ সালের মধ্যে উষ্ণায়ন ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা যায় তাহলেও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি এবং আরও ঘন ঘন চরম আবহাওয়ার ঘটনা ঘটবে। আমরা ২১০০ সালের মধ্যে গড় উষ্ণতা ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ার পথে রয়েছি। শেষবার বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা আজকের মতো ৪২১.০৮ পিপিএম ছিল ৩০ লক্ষ বছর আগে। তখন পৃথিবীপৃষ্ঠ ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণ ছিল এবং বিশ্বসমুদ্রের স্তর ২০ মিটার বেশি উঁচু ছিল। কুমেরুর বরফের চাদর একেবারে গলে গিয়েছিল।

যে-সময়ের কথা বলছি, তখন আদি মানবেরও উদ্ভব ঘটেনি। প্রায় ২৭ লক্ষ বছর আগে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা ৩০০ পিপিএম-এর নিচে নেমে যায়। লক্ষণীয়, এই সময়েই, বর্তমান মানবপ্রজাতি যে জেনাস (genus)-এর অন্তর্ভুক্ত সেই হোমো জেনাসের উদ্ভব হয়েছিল। তারপর, ছাব্বিশ লক্ষ বছর আগে, শুরু হল প্লাইস্টোসিন— বরফের যুগ। এই সময়টি মোটের উপর এখনকার তুলনায় অনেক ঠান্ডা। জলবায়ুর স্থিরতা ছিল না। প্রায় বারো হাজার বছর আগে, প্লাইস্টোসিন যুগ শেষ হয়ে শুরু হয় হলোসিন যুগ। এর পর থেকে ক্রমে জলবায়ুর অস্থিরতা কমল। হাজার আটেক বছর আগে জলবায়ুর স্থিরতা সভ্যতার অনুকূল হয়ে উঠল। এই হলোসিন যুগেই কৃষির উদ্ভব ও প্রসার এবং সভ্যতার বিকাশ হয়েছে। আজ আমরা সভ্যতার ভিত্তি জলবায়ুর যে স্থিরতা, তাকে শুধু বিপন্ন করছি তাই নয়, বেশ খানিকটা করেও ফেলেছি।

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের এক রিপোর্টে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দেশ ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে নির্ধারিত নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে নেই। রিপোর্টে বলা হয়েছে: যদি বিশ্বকে প্রাক-শিল্পস্তরের চেয়ে উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম রাখতে হয়, আরও কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে।

বর্তমানে খুব কম দেশই সেই কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে। অতি সম্প্রতি রাষ্ট্রসঙ্ঘের বার্ষিক নিঃসরণ ঘাটতি প্রতিবেদনে[11] যা প্রয়োজন তার সাপেক্ষে উষ্ণায়নের মোকাবিলায় নানা দেশের প্রতিশ্রুতির হিসাব করে বলেছে: নানা দেশের সরকার নিঃসরণ কমাতে আরও বেশি পদক্ষেপ না নিলে ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়বে প্রাকশিল্প মাত্রার চেয়ে ৩.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। বিশ্ব এখনই ১.৩ ডিগ্রি উষ্ণ হয়েছে। ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা রোধ করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বর্তমানের ৪২ শতাংশ করতে হবে। ২০৩৫ সালের মধ্যে কমাতে হবে ৫৭ শতাংশ। উপস্থিত, এই লক্ষ্য নাগালের বাইরে। কারণ, কোপার্নিকাস উপগ্রহ যে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে ২০২৪-এর গড় খুব সম্ভবত প্রাকশিল্পায়ন তাপমাত্রার থেকে ১.৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হবে।

 

নির্বাচিত সূত্রপঞ্জি


[1] ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি বা আইইএ-র হিসাবে।
[2] জলবায়ুর উপর বায়ুমণ্ডলে ভাসমান ধূলিকণার প্রভাব জোরদার বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়। খুব সংক্ষেপে বললে, ব্যাপারটা এইরকম: ধূলিকণার কিছু কিছু (যেমন কালো বা কালচে ধূলিকণা) সূর্যরশ্মি বেশি করে শুষে নিয়ে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বাড়াতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ভাসমান ধূলিকণাই ঠিক উলটোটা করে— বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এটা দু-ভাবে হয়। প্রথমত, সাদাটে বা চকচকে ধূলিকণায় সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে বায়ুমণ্ডলের বাইরে বেরিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, মাটি থেকে বহু উপরে উঠে যাওয়া ভাসমান ধুলো খুব ঠান্ডা হয়ে যায়। এই ধূলিকণার সংস্পর্শে এসে অদৃশ্য জলীয় বাস্প জমে গিয়ে জলকণা বা হিমকণায় রূপান্তরিত হয়। এইসব কণায় প্রতিফলিত হয়ে আগত সূর্যরশ্মি বাইরে চলে গিয়ে বায়ুমণ্ডলকে ঠান্ডা করতে সাহায্য করে।
[3] ৮,০০০টি ১,০০০ ওয়াটের বাতি ১০০ কোটি ঘণ্টা ধরে জ্বললে যে বিদ্যুৎ খরচ হয়।
[4] আইপিসিসি হল জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিজ্ঞানের মূল্যায়নের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের আন্তঃসরকারি সংস্থা। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পরিবেশ কর্মসূচি এবং বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা জলবায়ু পরবর্তনের প্রভাব ও তার ঝুঁকির মূল্যায়ন এবং তার সঙ্গে অভিযোজন (অ্যাডাপ্টেশন) ও প্রশমন (মিটিগেশন) কৌশল নিয়ে সঠিক পদক্ষেপে পথ দেখানোর জন্য আইপিসিসি প্রতিষ্ঠিা করেছিল। আইপিসিসিকে জলবায়ু বিজ্ঞানের প্রামাণিক সংস্থা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তার প্রতিবেদন বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের কাছেও অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
[5] অর্থাৎ, এর পরে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমার কথা। কিন্তু মুশকিল হল, তাতে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা শিগ্‌গিরি কমবে না। বরং দাবানল প্রভৃতি যে হারে বাড়ছে, তাতে মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
[6] চিনের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৯.২ লক্ষ গিগাওয়াট, আমেরিকার প্রায় দু-গুণ, ভারতের সাতগুণ।
[7] আমেরিকা নিঃসরণ করে ১২.৭ শতাংশ, ভারত প্রায় ৭, রাশিয়া ৫, জাপান ২.৮ শতাংশ।
[8] UN News, 21 September 2021.
[9] নেট শূন্য— ইংরেজি হল Net Zero। ধারণাটি জলবায়ু সংক্রান্ত আলোচনায় ফিরে ফিরে আসে। ধারণাটি এইরকম: জলবায়ু সমস্যা সমাধান প্রয়াসের মূল লক্ষ্য বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্য গ্রিনহাউস গ্যাসের অনুপাত কমানো। এটা দু-ভাবে হতে পারে। প্রধান উপায়: সরাসরি নিঃসরণ কমানো। কিন্তু আরেকটি উপায়ও আছে, যদিও সেটি এখনও তত জোরদার নয় এবং সময়সাপেক্ষ। সেটি হল, বায়ুমণ্ডলের কার্বন শুষে নেওয়া। তা প্রচুর গাছ লাগিয়ে বা জলাভূমির পরিমাণ বাড়িয়ে হতে পারে (গাছপালা ও জলাশয়ের ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন প্রচুর কার্বন শুষে নেয়)। কোনও কৃত্রিম প্রযুক্তির মাধ্যমেও হতে পারে। অর্থাৎ, নিঃসরণ যদি যথষ্ট নাও কমে, তাহলেও নিঃসরিত কার্বনের সমপরিমাণ কার্বন শুষে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যদি তা করা যায় তাহলে, নিঃসরিত কার্বন থেকে শোষিত কার্বনের পরিমাণ বিয়োগ করে আমরা বায়ুমণ্ডলে মোট সংযোজিত বাড়তি কার্বনের পরিমাণ শূন্য পাব। একেই বলে, ‘নেট জিরো’।
[10] বায়ুমণ্ডলীয় নদী সম্পর্কে প্রকাশিতব্য বইটির তৃতীয় অধ্যায়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
[11] Emissions Gap Report.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...