
রামানুজ মুখোপাধ্যায়
…গোধূলির আলোয় উদ্ভাসিত হল একটি প্রদীপ, আমার মায়ের হাতে। সকালবেলা পথের ধারে কতরকম শাক বেচছেন দিদি। সঙ্গে মানকচুর লতি আর শামুক-গুগলি। সরষেক্ষেতের পাশে খেজুর রসে জ্বাল দিচ্ছেন এক বিধবা। ছোট ছেলেটি পড়ে-পড়ে কাঁদছে মাঠের আলে। এক-একজন মানুষ আমার কাছে এক-একটি বই। কেউ নাটকীয়, কেউ কাব্যিক, কারও-বা গল্পটি অকথিত, ‘চিত্ররূপময়’। আমি পড়ি, পড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। বারবার।
এক.
জন্মেছিলাম অজয়ের কোলে একটি গ্রামে। জঙ্গলের অন্ধকারে। চারদিকে গাছপালা, নদীনালা, ধানমাঠ। রুক্ষ লাল মাটি। কাঁকুড়ে। উঁচু-নিচু টিলা। কত মানুষ। কেউ সুঠাম শালের মতো। কারও পিঠ-হাত-পা ও পেশি যেন কালো পাথরে কোঁদা। খোঁপায় জংলিফুল কারও। জ্যোৎস্না রাতে মাদল বাজে। ময়ূর নাচে মনে। বনে ডাকে বালিহাঁস। কোন সুদূর থেকে তারা উড়ে এসেছে কয়েক দিনের জন্যে। বনের ছায়ায় বসে শালপাতা বুনছে একদল মেয়ে-বউ। অদূরে পথের ধারে গ্রামদেবতার থান। ঝোড়ো হাওয়ায় নড়ে উঠছে পোড়ামাটির ঘোড়া। অজয়ের হাঁটুজলে চিকচিক করছে বালি। ধূসর সাইকেল ঠেলে নদী পার হচ্ছেন বোষ্টম-বোষ্টুমি। জলে তার ছায়া, তিরতির করে কাঁপছে। বেলা পড়ে এল। শেষ মাধুকরী। এইসব দৃশ্যের ভিতরে নেচে উঠেছিল আমাদের শৈশব। এ যেন আমার প্রিয় বই। যা আমি আজীবন ফিরে-ফিরে পড়ব ভেবেছিলাম। পারলাম না। অন্নের টানে উপড়ে এল শিকড়। কোথায় তার ঘ্রাণ, কোথায় তার স্পর্শ। যেন কোন দূরের প্রেমিকা, মনে আছে শুধু তার স্নিগ্ধ করুণ স্মৃতিটুকু।
দুই.
আমাদের জোতজমি চাষ করতেন আহম্মদ চাচা। ধান উঠত গরুর গাড়িতে। নিকোনো উঠোন আলো করে থাকত ধানের পালুই। তারপর ছই ফেলা হত গরুর গাড়িতে। যাওয়া হত মেলায়। ঘরের সবাই মিলে। তখন গাড়োয়ান হতেন হারু বাগদি। চলো কেঁদুলি। কাঁচা মাটির পথে, হেলেদুলে। চেনা হয়ে যেত আশেপাশের গ্রামগুলিও। ঘাট-মাঠ-খিড়কি-উঠোন। দেখা হত গ্রামে গ্রামে ধর্মঠাকুরের আটন। গ্রীষ্ম এলে গাজন হবে। তেমনই একটি পুরনো গ্রাম সুগড়। ছায়া সুনিবিড়, কুঞ্জকুটির শোভিত। তেরোই বৈশাখ সেখানে পুজো পান কালু ডোম। ধর্মমঙ্গলের এই অনার্য সেনাপতিকে আপনারা চেনেন। শৈশবে আমরা কি চিনতাম? দেখতাম ইছাই ঘোষের দেউল। আগাছায় ঘেরা, অনাদরে দাঁড়িয়ে আছে অতীতের আর্তি নিয়ে। কৈশোরে পড়লাম ধর্মমঙ্গলের আখ্যান। মঙ্গলকাব্যের সব গ্রাম। রক্ষিতপুর, লোহাগুড়ি, কোটালপুকুর, বসুধা, সুগড়। সাইকেলে ঘুরে ঘুরে দেখতাম সেইসব স্মৃতিসাক্ষ্যগুলি। একদিন স্বপ্নে ভেসে এল একটি বই। পুথির আকারে লেখা, ধুলোমাখা পড়ে আছে জঙ্গলের অন্ধকারে, একা। কালু ডোমের আত্মকথা। স্বপ্নে সে-বই পড়তে-পড়তে আমি যেন আত্মহারা।
তিন.
জঙ্গলের আলো-অন্ধকার থেকে একদিন গিয়ে পড়লাম নগর কলকাতার কোলাহলে। যাদবপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসঘর জুড়ে রবীন্দ্রনাথ আর আমাদের সেই অদ্বিতীয় মাস্টারমশায়। অথৈ সমুদ্রে আমার ডিঙিনৌকো টলমল করে উঠল। এই ডোবে কি সেই ডোবে। নতুন তথ্য আর অকল্পনীয়, বিস্ময়কর দৃষ্টিভঙ্গির বিভায় সে-ক্লাসকে সবসময় শিল্পিত করে রাখতেন অধ্যাপক তপোব্রত ঘোষ। তিনিই প্রথম রবীন্দ্রনাথের পড়া বইয়ের নানা সূত্র ধরিয়ে দিতেন ক্লাসে। সেইসূত্রে রবীন্দ্রনাথেরই কোনও লেখাকে দেখা হত নতুন আলোকে। সেইসব দিনেই যাতায়াত শুরু হয়েছিল নতুন নতুন লাইব্রেরিঘরে। পড়ার পিপাসা নিয়ে এলাম বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে। হঠাৎ বিশেষ কোনও প্রয়োজনে একদিন হাতে উঠে এল রবীন্দ্রনাথের পড়া বই। মার্জিন মন্তব্যে ভরা। দুইদিকের পুস্তানি তাঁর হাতের লেখায় পূর্ণ। যদি পড়তে পারতাম তেমন সব বই, দীর্ঘদিন ধরে, একান্ত নির্জনে? মন ভরে উঠত বিস্ময়ে আর আলোয়।
চার.
বাঁশি বাজাতে-বাজাতে দিগন্তের দিকে হেঁটে গেল এক কিশোর। দীঘিজলে টলটল করছে কার মুখ? পড়ন্ত বিকেলে সে নাইতে নেমেছে। তাকে আগে কখনও দেখিনি। গোধূলির আলোয় উদ্ভাসিত হল একটি প্রদীপ, আমার মায়ের হাতে। সকালবেলা পথের ধারে কতরকম শাক বেচছেন দিদি। সঙ্গে মানকচুর লতি আর শামুক-গুগলি। সরষেক্ষেতের পাশে খেজুর রসে জ্বাল দিচ্ছেন এক বিধবা। ছোট ছেলেটি পড়ে-পড়ে কাঁদছে মাঠের আলে। এক-একজন মানুষ আমার কাছে এক-একটি বই। কেউ নাটকীয়, কেউ কাব্যিক, কারও-বা গল্পটি অকথিত, ‘চিত্ররূপময়’। আমি পড়ি, পড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। বারবার।
গদ্য যেন ছন্দ দিয়ে গাঁথা!