শৌচাগার ব্যবহার করতে চাইলে আজও কাজ থেকে বরখাস্ত হতে হয় মহিলাদের

খালিদা খানুম

 


এইরকম ঘটনা লিখতে গেলে পাতার পর পাতা শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু ঘটনা শেষ হবে না। অতি প্রয়োজনীয় একটি শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য কত অসুবিধার সম্মুখীন হন মহিলারা তার হিসেব নেই। প্রকৃতিগতভাবে শরীর আলাদা হওয়ার জন্য, মেয়েরা ইউরিনেশন সব স্থানে করতে পারে না। তাদের জন্য একটা ঘেরাটোপের প্রয়োজন হয়। পিরিয়ডের দিনগুলোতে সমস্যা বাড়ে। পিরিয়ডটাও মহিলাদের ইচ্ছাকৃত বিলাস নয়। তবু ওই দিনগুলো নিয়ে মেয়েদের একটা টেনশনে কাটাতে হয়

 

গত ১৯ জুন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ দৃষ্টি জৈনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। দিল্লির মহিলা নির্মাণশ্রমিকদের শৌচকার্য করতে কী চরম অসুবিধা এবং অমানবিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়, সে-নিয়েই লিখেছেন দৃষ্টি। এক গৃহপরিচারকার কথা উল্লেখ করেছেন দৃষ্টি। তিনি যে বহুতলের ফ্ল্যাটে কাজ করতেন সেই টয়লেট ব্যবহার করতে চাওয়ায় তাঁকে তো তা করতে দেওয়াই হয়নি, বরং কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। নিজের হাতের কবজি বাড়িয়ে দৃষ্টকে ভদ্রমহিলা সখেদে প্রশ্ন করেছে—“শিরা কাটলে আমাদের হাত থেকে তো একই রক্ত বের হবে, তাই না?”

পড়তে পড়তে নিজেরও কিছু ঘটনা, কিছু ভাবনা মনে এল।

ঘটনা ১

অনিন্দিতা, কলেজ থেকে বেরিয়েই চাকরি। সরকারি কর্মচারী। চাকরির আনন্দ প্রথম দিন এসেই নিভে গেল। অফিস চত্বরে কোনও টয়লেট নেই। অফিস বলতে ভেঙে পরা একতলা একটি বাড়ি, সরকারের নিজস্ব নয়, ভাড়া। যেখানে সম্ভব চিঠি লেখা হল, কিন্তু সরকারি নিয়মের জালে টয়লেটের ব্যবস্থা হল না। অগত্যা চেপে রাখা ইউরিন আর অস্বস্তি নিয়ে অফিসের কাজ। বিশেষ দিনগুলোতে স্থানীয় লোকের বাড়ি।

ঘটনা ২

সবিতা, কন্যাশ্রীর ফর্ম জমা করতে বিডিও অফিস এসে অথৈ জলে পড়ল। শরীর জানান দিল পিরিয়ড হয়েছে। কাছে প্যাড নেই, প্যাড আনতে যেতে হবে মিনিট দশেক দূরে। তাও যদি আনা যায়, সেটা ব্যবহার করবে কোথায়! বিডিও অফিসে টয়লেট আছে, কিন্তু লেডিজ টয়লেট তালা বন্ধ, চাবি কার কাছে কে জানে! আর চাবি কার কাছে আছে, সেটা যদি জানাও যায়, কী বলবে তাকে? পিরিয়ডের কথা? আঠারো বছরের মেয়ে পারবে?

ঘটনা ৩

চন্দনা, ট্রাফিক পুলিশ। একটানা রোদে দাঁড়িয়ে কাজ করলেও পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খেতে পারে না। কারণ বড় কিছু নয়— কাছাকাছি শৌচাগার নেই। পাঁচ মিনিট দূরে যেটি আছে সেটির পাশে ঝুপড়িবাসীদের বসবাস। তারা শৌচাগারটি কেবল নোংরা করে রাখে তাই নয়, ঢোকার মুখে উঠতি ছেলেছোকরারা ভিড় করে থাকে। তাদের টপকে টয়লেটে যাওয়া সুরক্ষার প্রশ্ন এনে দেয়।

ঘটনা ৪

সুলেখা, কাকভোরে লোকাল ট্রেন ধরে সুন্দরবনের কাঁকড়া নিয়ে কলকাতার বাজারে আসে। ভরপেট মূত্র নিয়ে আবার বাড়ি ফেরে। মনে মনে ভাবে, লোকাল ট্রেনে একটা শৌচাগার থাকত!

ঘটনা ৫

রেশমাকে ভোটের ডিউটি থেকে বাড়িতে এসে প্রচণ্ড পেটে ব্যথা নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হতে হল, কারণ ইউরিনারি ইনফেকশন। ভোটের আগের দিন রিপোর্টিং থেকে ব্যালট জমা দেওয়া পর্যন্ত মাত্র দু-লিটার জল খেয়েছে, এই ভেবে যে, কোথায় ইউরিন করবে।

এইরকম ঘটনা লিখতে গেলে পাতার পর পাতা শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু ঘটনা শেষ হবে না। অতি প্রয়োজনীয় একটি শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য কত অসুবিধার সম্মুখীন হন মহিলারা তার হিসেব নেই। প্রকৃতিগতভাবে শরীর আলাদা হওয়ার জন্য, মেয়েরা ইউরিনেশন সব স্থানে করতে পারে না। তাদের জন্য একটা ঘেরাটোপের প্রয়োজন হয়। পিরিয়ডের দিনগুলোতে সমস্যা বাড়ে। পিরিয়ডটাও মহিলাদের ইচ্ছাকৃত বিলাস নয়। তবু ওই দিনগুলো নিয়ে মেয়েদের একটা টেনশনে কাটাতে হয়।

এখন মহিলা শ্রমিক, তা সে যেরকম হোক না কেন (মাঠে বা যুদ্ধক্ষেত্রে বা অপারেশন টেবিলে ছুরি-কাঁচি হাতে) বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়েছে। কিন্তু তাদের জন্য ন্যূনতম সুযোগসুবিধা-টুকু তৈরি হয়নি কর্মক্ষেত্রে।

অনেকে ভাববেন শহরে তো সুবিধা রয়েছে, এত সুলভ শৌচাগার। কর্মক্ষেত্র কেবল শহরকেন্দ্রিক হয় না এবং শহরের মেয়েরাই কেবল কাজ করে না। মহারাষ্ট্রে আখক্ষেতে কাজ করা মেয়েরা নিজের জরায়ু বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের পিরিয়ডের দিনগুলোর সমস্যা এড়াতে।

সংবিধানের ধারা ১২ অনুসারে, স্বাস্থ্যের অধিকার মানবাধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বলতে কেবল রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি নয়, স্বাস্থ্য বলতে সম্পুর্ণ শারীরিক মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতার একটি অবস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বয়স, লিঙ্গ, আর্থসামাজিক, জাতি-নির্বিশেষে মানুষের স্বাস্থ্যকে মৌলিক ও অপরিহার্য সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করলেও তা পূরণ করার জন্য পরিকাঠামোর যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তো দূরের কথা, অনেক সময় মিনিমাম সুবিধাটুকুও উপলব্ধ থাকে না। আমি মনে করি এটাকে যদি শুধু মহিলাকেন্দ্রিক সমস্যা বলে মনে করা হয়, তাহলে এর সমাধান কোনওদিন হবে না। কারণ যে কাজ মহিলারা করতে পিছপা হবে বা যে কর্মক্ষেত্রে কোনও কারণে তারা নিজেদের সবটুকু দিয়ে করতে পারবে না, সেক্ষেত্রে পুরুষরা ওই শূন্যস্থানটুকু পূরণ করে দেবে। সরকার হোক বা বেসরকারি মালিক, তাদের জন্য কাজ শেষ হলেই হল, কে করছে সেটা বড় ব্যপার না। সুতরাং এই সমস্যা নিয়ে চলতে থাকা মেয়েরা সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে না। বরং এটি পুরুষ ও মহিলা নির্বিশেষে জ্বলন্ত সমস্যা হিসেবে দেখা হোক। পুরুষদেরও ভাবতে শেখা দরকার, তাদের ক্ষেত্রেও যত্রতত্র প্রাকৃতিক ডাকে দাঁড়িয়ে যাওয়াটা শোভনীয় যেমন নয়, তেমনি অস্বাস্থ্যকরও বটে। হয়তো পুরুষরা এই সুবিধা নেয় এবং মেল ইগো স্যাটিসফাই হয় যে তারা কর্মক্ষেত্রে বেশি ফিট। কিন্তু পুরুষদেরও ভাবা দরকার যে ওপেন স্থানে দাঁড়িয়ে পড়াটা কোনও বাহাদুরি নয়, সেটার জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত।

যেখানে ভারত এবং পশ্চিমবাংলায় এত উৎসাহের সঙ্গে স্বচ্ছতার অভিযান চালানো হচ্ছে এবং ওপেন এয়ারে শৌচ বন্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেখানে কর্মক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাটুকু থাকা দরকার। কেবল কিছু ‘পে অ্যান্ড ইউজ’ টয়লেট রাখলেই হবে না, তার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রাখা জরুরি। যেমন পেট্রল পাম্পের টয়লেটগুলো পাবলিট টয়লেট হিসেবে বলা হয়েছে, তেমনি হোটেল, শপিংমল বা অন্য কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাবলিক টয়লেট রাখা বাধ্যতামূলক করা জরুরি।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. খুব জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন
    হীরক সেনগুপ্ত

Leave a Reply to Hirak Sengupta Cancel reply