এমন যদি সত্যি হয়…

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 


পৃথিবীর হিমবাহরা আজ গভীর সংকটের সম্মুখীন। মনে রাখতে হবে, হিমবাহগুলো হল পৃথিবীর সমস্ত আবাসিকের পানীয় জলের প্রধান উৎস। হিমবাহের গলন নিকট-ভবিষ্যতে আমাদের পানীয় জলের সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। অতি ব্যবহারের ফলে পৃথিবীর ভৌমজলের ভাণ্ডার নিঃশেষ হওয়ার মুখে। তাই দুই মেরু অঞ্চলের বরফের গলন আমাদের মনোজগতে আলোড়ন ফেলে। অস্তিত্বের সংকটের ছায়া এসে পড়ে আমাদের আঙিনায়

 

মাত্র বছর কয়েক আগের কথা। তখনও ছোটাছুটি করে স্কুলে যাই, দোতলা, তিনতলা, চারতলা দৌড়োদৌড়ি করে ক্লাস নিয়ে ফিরি। একটু উঁচু ক্লাসে ধরিত্রীবিদ্যার নানান বিষয় নিয়ে কথোপকথনে মজে থাকি। পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় বাতাবরণের কথা বলতে গিয়ে উঠে আসে নানান অঞ্চলের কথা। এই প্রসঙ্গে দুই মেরু অঞ্চলের কথা বলতে গেলেই বলতে হত সাদা বরফের চাদরে ঢাকা বিস্তীর্ণ শীতল মেরুর জনবিরলতার কথা।

উত্তর মেরু বা আর্কটিক অঞ্চলে যদিও বেশ কয়েকটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ— যেমন এস্কিমো, ল্যাপ, সামোয়েদ বা ইয়াকুতদের— বসবাস, দক্ষিণ মেরু বা আন্টার্কটিকা মহাদেশে কোনও স্থায়ী আবাসিক নেই। গোটা মহাদেশ পাহারা দিচ্ছে নানান ধরনের পেঙ্গুইন পাখি আর নানান দেশের মরশুমি বিজ্ঞানীরা। আর্কটিক অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠী ও প্রাণীকুল একান্তই ওই হিমশীতল পরিবেশের অনুকূল।

এই মুহূর্তে অবশ্য ওই দুই এলাকার কথা বলতে গেলে প্রথমেই ধাক্কা খেতে হবে। ভাবছেন, কেন?

তাহলে একটু খুলেই না হয় বলি। আসলে, বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর দুই মেরু অঞ্চলের বরফের আস্তরণ দ্রুতগতিতে গলছে। অবস্থাটা এমন যে, এই সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে বলতে হয়— মেরু অঞ্চল বরফহীন অবস্থার প্রান্তসীমায় এসে হাজির হয়েছে। বিষয়টি যে অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিণতির দিকে পৃথিবীকে নিয়ে চলেছে, তা বুঝে উঠতে খুব বেশি সময় নিশ্চয়ই লাগবে না।

পাঠকদের মধ্যে কেউ কেউ এর মধ্যেই ভাবতে শুরু করেছেন হয়তো— মেরু অঞ্চলের বরফের আস্তরণ যদি একেবারে লোপাট হয়ে যায়, তা হলে ক্রান্তীয় মণ্ডলের ভারতবর্ষের কী এমন ক্ষতি হবে? আসুন, সবাই মিলে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির একটা খোঁজখবর নেওয়া যাক। আমাদের আন্টার্কটিকা মহাদেশ নিয়ে খোঁজ শুরু হোক একেবারে গোড়ার কথা দিয়ে— কতটা বরফ জমা আছে এই সুবিশাল হিমেল মহাদেশে?

বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, আন্টার্কটিকা মহাদেশে জমে থাকা বরফের পরিমাণ প্রায় ২৫,৪০০,০০০ ঘন কিলোমিটার বা ৬,০৯০,০০০ ঘন মাইল। বিষয়টিকে আরও একটু খোলাসা করে বললে বলতে হয়— পৃথিবীতে সঞ্চিত মোট পেয় জলের ৬০ শতাংশ এবং জমে থাকা বরফের ৯০ শতাংশ এখানেই মজুত রয়েছে। এই হিসাব এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে— এমনটা কখনওই নয়। কারণ, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে, আর তার জেরে ক্রমশই পিছু হটছে দুনিয়ার তাবৎ হিমবাহ আর বরফের চলমান চাঙড়। আর আমাদের আশঙ্কার স্তূপ গলছে এখানেই।

বিজ্ঞানীদের মতে, যদি আন্টার্কটিকা মহাদেশে সুদূর অতীত থেকে জমে থাকা বরফের সবটাই গলে যায়, তাহলে পৃথিবীর সমুদ্রজলের গড় উচ্চতা বাড়বে ৭০ মিটার বা ২৩০ ফুট। ভাবতে পারছেন, অবস্থাটা কেমন হবে? পৃথিবীর এই সময়ের চেনা-পরিচিত মানচিত্রটাই বিলকুল বদলে যাবে।

এখনকার হিসেব অনুযায়ী, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৭ শতাংশ মানুষ একেবারে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে বসবাস করেন। উপকূলের খুব কাছাকাছি থাকা এলাকায় বাস করেন আরও প্রায় ৮ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ, বরফ গলনের ফলে পৃথিবীর কমবেশি ৪৫ শতাংশ মানুষের সলিলসমাধির আশঙ্কা রয়েছে।

জলের তলায় তলিয়ে যাবে উপকূলীয় অঞ্চলে গড়ে ওঠা অসংখ্য শহর, নগর, জনবহুল জনপদ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা উপদ্বীপ সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে যাবে, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, বাংলাদেশ-সহ অনেক অনেক ছোট ছোট দ্বীপরাষ্ট্রের হাল হবে তথৈবচ। ইউনাইটেড কিংডম, শ্রীলঙ্কার মতো দ্বীপরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ যে মোটেই নিরাপদ নয়, তা বুঝে উঠতে বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই।

কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন— আমাদের দেশের হাল কী হবে?

CSTEP প্রকাশিত Sea Level Rise Scenarios and Inundation Maps for Selected Indian Coastal Cities শীর্ষক গবেষণাপত্রে অতীত ও ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রজলতলের ওঠানামার একটি সম্ভাব্য চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

পশ্চিমে গুজরাত রাজ্য থেকে শুরু করে পূর্বপ্রান্তের পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত এ-দেশের মূল ভূখণ্ডের উপকূলভাগের আনুমানিক দৈর্ঘ্য ৫১০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। এই দীর্ঘ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় ভূখণ্ড বেড়ে যাওয়া সমুদ্রজলতলের দ্বারা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

তবে, তাঁরা তাঁদের গবেষণার কাজ সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন উপকূলবর্তী ৯টি রাজ্য এবং ২টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে অবস্থিত ১৫টি সমুদ্রতীরবর্তী শহর ও নগরের ওপর। এই শহর বা নগরগুলো হল— চেন্নাই, মুম্বই, তিরুবনন্তপুরম, কোচি, কোঝিকোড, ম্যাঙ্গালোর, বিশাখাপত্তনম, কন্যাকুমারী, পানাজি, উদূপি, থুতুকোডি, পুরী, পারাদীপ, ইয়ানাম (পুদুচেরি), এবং পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া।

এমন কথায় রক্তচাপ বেড়ে গেল নাকি? তথ্য বলছে— পৃথিবীর ৪০ শতাংশ মানুষ তাঁদের বর্তমান বাসভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন।

বিপদের তো এখানেই শেষ নয়। আন্টার্কটিকার ৯৮ শতাংশ এলাকা এখনও পুরু বরফের আস্তরণে ঢাকা। এই বরফ গলে গেলে চাদরের তলায় ঢাকা ভূপৃষ্ঠের পাথুরে কাঠামো কঙ্কালের মতো বাইরে বেরিয়ে পড়বে। আন্টার্কটিকার বরফ গলে গেলে আর্কটিকই বা বাদ থাকবে কেন? তার ওপরে বিছানো বরফের সাদা চাদরটাও ধীরে ধীরে গলে গিয়ে গ্রিনল্যান্ড নতুন ভূখণ্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। বরফগলা জল গিয়ে মিশবে লাগোয়া নোনাজলের দরিয়ায়, সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যাবে বিপুল পরিমাণ পানীয় জলের মজুত ভাণ্ডার।

ট্রাম্পসাহেব তো ওৎ পেতে রয়েছেন— গ্রিনল্যান্ডকে পকেটে পুরবেন বলে!

অবশ্য, এই বিপুল পরিমাণ বরফগলা মিঠা জল সমুদ্রে মিশলে সমুদ্রজলের লবণতার পরিমাণ খানিকটা হয়তো কমে যাবে— তবে তার ফলে সমুদ্রের জল পেয় হয়ে উঠবে, এমনটা কিন্তু নয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, বিপুল পরিমাণ মিঠে পেয় জলের জোগানে সমুদ্রজলের রাসায়নিক ধর্ম— বিশেষ করে pH মানে— রদবদলের সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিবর্তন সমুদ্রে বসবাসকারী প্রাণীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

জলের উষ্ণতা ও লবণতার পরিমাণে এই পরিবর্তনের ফলে এতদিনের পরিচিত সমুদ্রস্রোতগুলোর চলাচলের পথ যাবে বিলকুল বদলে। এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত দেশগুলির জলবায়ুর ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে যাবে।

তবে, জলের জোগানে পরিবর্তন ধীরে ধীরে ঘটলে, তার প্রভাব অবশ্যই বিলম্বিত হবে।

মেরু অঞ্চলের বরফের গলন পৃথিবীর ভূ-সংস্থানিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও বড় রকমের রদবদল ঘটাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভূবিজ্ঞানীরা। আমরা জানি, পৃথিবীর মহাদেশীয় ও মহাসাগরীয় অংশগুলো কয়েকটি ভাসমান পাত বা প্লেটের আকারে উর্ধ্ব-গুরুমণ্ডলের তরল শিলার ওপরে ভাসছে। মহাদেশগুলো গঠিত হয়েছে অপেক্ষাকৃত হালকা গ্রানাইট জাতীয় শিলায়, আর মহাসাগরের গঠন হয়েছে তুলনায় ভারী ব্যাসল্ট শিলায়। আন্টার্কটিকা মহাদেশের অবস্থা অনেকটাই মালবোঝাই ভাসমান জাহাজের মতো। মালের বোঝা কমে গেলে জাহাজ যেমন ওপরে উঠে আসে, ঠিক সেভাবেই মহাদেশের ওপরে থাকা বরফের স্তর যদি সম্পূর্ণভাবে গলে যায়, তাহলে isostasy বা সমস্থিতির শর্ত মেনে গোটা আন্টার্কটিকা মহাদেশ তার এখনকার অবস্থান থেকে খানিকটা ওপরে উঠে আসবে। এর ফলে ঘটতে পারে প্রবল ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা।

তবে, এমন উত্থান ঘটে অত্যন্ত ধীরে— কখনও কখনও কয়েক হাজার বছর ধরে। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রথম ২০০০ বছরে এই উত্থানের হার থাকে সর্বাধিক— বছর-পিছু ৭.৫ সেন্টিমিটার। পরবর্তী ১০,০০০ বছর ধরে এই হার বছর-পিছু ২.৫ সেন্টিমিটার থেকে কমে এসে দাঁড়ায় ১ সেন্টিমিটারে, এবং এভাবে এই প্রক্রিয়াটি প্রায় ২০,০০০ বছর ধরে চলতে পারে।

সব জায়গায় অবশ্য স্থলভাগের এই উঠে আসার পরিমাণ সমান হয় না, এবং তা সর্বাধিক ৪০০ মিটার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। আন্টার্কটিকা মহাদেশের ওপরে থাকা বরফের স্তর সম্পূর্ণভাবে গলে গেলে, এমনটা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

আন্টার্কটিকা সম্পূর্ণভাবে বরফমুক্ত হওয়ার অর্থ হল পৃথিবীর তাপমাত্রা এক অকল্পনীয় মাত্রায় বেড়ে যাওয়া। এর মধ্যেই উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর বাতাবরণের তাপমাত্রা প্রায় অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তাপমাত্রা আরও বেড়ে গেলে, পৃথিবীর ক্রান্তীয় মণ্ডলের মানুষজন বাধ্য হবেন নিজেদের বর্তমান বসতি অঞ্চল ছেড়ে শীতলতার খোঁজে মেরু অঞ্চলের দিকে পাড়ি জমাতে। আজকের পৃথিবীর জনবহুল এলাকাগুলো পরিবর্তিত হবে বিরল বসতির অঞ্চলে। মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজবে বসবাসের উপযোগী এলাকা।

আশঙ্কার এখানেই শেষ নয়। অনুমান করা হচ্ছে— পৃথিবীর প্রচল কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়বে। ভেঙে যাবে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা। এই সময়ের বুকে দাপিয়ে বেড়ানো উদ্ভিদ ও পশুপাখিরা হারিয়ে যাবে চিরকালের জন্য। এক গণবিলুপ্তির সম্মুখীন হবে গোটা জীবজগৎ।

বিজ্ঞানের পরিভাষায়— এক মহাবিপর্যয়, এক apocalyptic পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চলেছি আমরা?

বিজ্ঞানীরা অবশ্য জানিয়েছেন— আন্টার্কটিকার এমন পরিণতি এই প্রথমবারের জন্য ঘটতে চলেছে, এমনটা কখনওই নয়। অতীতেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে আজকের এই হিমেল মহাদেশে।

অতীত-পৃথিবীর ঘটনাক্রম জানতে বিজ্ঞানীরা জীবাশ্মের ওপর নির্ভর করেন। তাঁরাই জানিয়েছেন— আজ থেকে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন বছর আগে আন্টার্কটিকা মহাদেশের ওপরে বরফের আস্তরণ জমা হতে শুরু করে, যদিও তখন পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা আজকের তুলনায় প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।

আসলে, আন্টার্কটিকা মহাদেশের অবস্থান তখনকার দক্ষিণ মেরুর তুলনায় খানিকটা উত্তরে ছিল, এবং আজকের দক্ষিণ আমেরিকার মহাদেশীয় ভূখণ্ডটি ক্রমশ শক্তিশালী সারকামপোলার কারেন্টের প্রভাবে দূরে সরে যেতে থাকে। এর ফলে আন্টার্কটিকার জলবায়ু পৃথিবীর অপরাপর অংশের তুলনায় ক্রমশ শীতল হতে শুরু করে।

বিজ্ঞানীরা আরও জানিয়েছেন— ক্রিটেশাস যুগের শেষভাগে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৯০ মিলিয়ন বছর আগে, এই মহাদেশীয় ভূখণ্ডটি নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের বৃষ্টিবন আর বিস্তীর্ণ জলাভূমির দ্বারা ঢাকা ছিল। বিজ্ঞানীদের অনুমান, এই বনাঞ্চলের একটি বড় অংশ কয়েক সপ্তাহ থেকে শুরু করে কয়েক মাস পর্যন্ত ঢাকা থাকত মেরু অঞ্চলের দীর্ঘ রাতের অন্ধকারে। সেই সময়কার বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণও আজকের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে বায়ুমণ্ডলের গঠনে পরিবর্তন এসেছে এবং আন্টার্কটিকা পরিণত হয়েছে এক হিমশীতল বরফের রাজ্যে।

একদম হালফিলের কিছু সমীক্ষা থেকে জানা গেছে— আন্টার্কটিকা মহাদেশের ওপরে থাকা প্রকাণ্ড বরফের আস্তরণে ফাঁক তৈরি হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে মহাদেশের পশ্চিম প্রান্তভাগের Thwaites হিমস্তূপের সঙ্কোচন লক্ষ করেছেন গবেষকেরা। তাঁদের আশঙ্কা— এই হিমবাহটি যদি সম্পূর্ণ বিগলিত হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর সমুদ্রজলতলের উচ্চতা প্রায় ৬৫ সেন্টিমিটার বা দুই ফুট বেড়ে যাবে। খুব কাছাকাছি থেকে গোটা প্রক্রিয়াটিকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাচ্ছেন তাঁরা। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে আগামী দিনে কাজে লাগিয়ে হিমবাহের গলন সম্পর্কে হয়তো নতুন পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হবেন তাঁরা। যার ফলে উপকৃত হবে তামাম বিশ্ববাসী।

আন্টার্কটিকার উপকূলীয় এলাকায় জমে থাকা বরফের পরিমাণ অনেকটাই কমে গেছে যা বিগত অর্ধশতকের মধ্যে সর্বাধিক। বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন, এমন ঘটনা কি নিছক সাময়িক, নাকি জলবায়ুর দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী?

উপগ্রহ থেকে পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন— উপকূল অঞ্চলের বরফ বেশ খানিকটা দূরে সরে গিয়েছে। আন্টার্কটিকায় গবেষণার জন্য রয়েছেন যেসব ভারতীয় গবেষক-বিজ্ঞানী, তাঁরাও এই প্রবণতা লক্ষ করেছেন। আর্কটিক অঞ্চলেও শীতকালীন বরফের পরিমাণ পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় অনেকটাই কমেছে। দুই মেরুতেই একই প্রবণতা দেখা যাওয়ার বিষয়টি যে যথেষ্ট উদ্বেগজনক তা স্বীকার করে নিয়ে, এই ঘটনাটিকে synchronized climate destabilization হিসেবে মান্যতা দিয়েছেন গবেষকেরা। সুতরাং, উদ্বেগ কিছু কমছে না।

এক মহাসন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে পৃথিবী। দীর্ঘ পরিবর্তনের পথ বেয়ে পৃথিবী আজকের অবস্থায় এসে হাজির হয়েছে। পূর্ববর্তী পরিবর্তনের পেছনে হোমো স্যাপিয়েন্সদের কোনও ভূমিকাই ছিল না— কেননা পৃথিবী তখন আপন ভাঙা-গড়ার খেলায় মেতে ছিল।

আর আজ? আজ মানুষ এসে সঙ্গী হয়েছে এই পালাবদলের পালায়। আজকের পৃথিবীর তাবৎ ঘটনায় জড়িত মানুষ এবং তাঁদের সক্রিয়তা। আমরা এই পরম সত্যকে বিস্মৃত হয়েছি যে— সমস্ত পরিবর্তন আমাদের সাজানো-গোছানো জীবনকে পাল্টে দেবে এক ঝটকায়।

পৃথিবীর হিমবাহরা আজ গভীর সংকটের সম্মুখীন। মনে রাখতে হবে, হিমবাহগুলো হল পৃথিবীর সমস্ত আবাসিকের পানীয় জলের প্রধান উৎস। হিমবাহের গলন নিকট-ভবিষ্যতে আমাদের পানীয় জলের সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। অতি ব্যবহারের ফলে পৃথিবীর ভৌমজলের ভাণ্ডার নিঃশেষ হওয়ার মুখে। তাই দুই মেরু অঞ্চলের বরফের গলন আমাদের মনোজগতে আলোড়ন ফেলে। অস্তিত্বের সংকটের ছায়া এসে পড়ে আমাদের আঙিনায়।

আমরা কি একটুও ভাবনার অবকাশ পেলাম? কে জানে?

নিবন্ধটি পড়ে পাঠকদের মধ্যে কেউ কি সামান্য বিচলিত হয়ে পড়লেন? ভাবতে বসলেন— এসব হলে আমার কী হবে? তাঁদের সামান্য স্বস্তি দিতে বলি— একদম কালকেই আন্টার্কটিকা বরফশূন্য হয়ে যাবে, তা হয়তো নয়। তবে, সাইরেন যখন বেজেই গেছে, তখন সাবধান হতে দোষ কী!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

4 Comments

  1. আগামী প্রজন্মের নাগরিকদের জন্য আমরা কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছি? হিমালয়ের হিমবাহের পিছু হটে যাওয়ার খবর শুনেছিলাম, আর এখন গোটা বিশ্বের বিশেষ করে আন্টার্কটিকার হিমবাহের অবক্ষয়ের কথা পড়লাম। বিচলন বাড়লো।

  2. খুব প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা। হিমবাহের গলনের অর্থ হলো বিপুল পরিমাণ পেয় জলের জোগানে টান পড়া। তাছাড়া রয়েছে আনুষাঙ্গিক অন্যান্য জটিলতা। জলবায়ুর পরিবর্তন অনিবার্য। তার সঙ্গে যুঝবার জন্য আমাদের যাপন শৈলীর বদল দরকার। সে সব কথা তো কিছুই শুনিনা।

  3. লেখকের লেখার সঙ্গে আমাদের পরিচয় দীর্ঘদিন ধরে। আমরা অনেকেই অপেক্ষায় থাকি তাঁর কাছ থেকে নতুন কিছু পড়ার জন্য। আন্টার্কটিকার ভবিষ্যৎ যে সংকটাপন্ন সে কথা ঠারেঠোরে জানলেও এই লেখায় তা বিস্তারিত জানতে পারলাম। হিমবাহের গলন একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ মিঠা জলের জোগানকে কমিয়ে দেবে, অন্যদিকে বাড়বে সমুদ্র জলতলের উচ্চতা। ঘটবে মহাপ্লাবন। সবকিছুর জন্য মানুষ দায়ি তার হয়তো নয়। তবে ভুগতে হবে সবাইকেই । অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

  4. ভূগোলের শিক্ষকের থেকে এমন লেখা পাওয়া সত্যি ভাগ্যের!

    তবে সোমনাথ দা কে একটা প্রশ্ন, যে দাদা, আমরা পৃথিবীর ভৌগোলিক ইতিহাস থেকে জানি যে পৃথিবীতে হিম যুগ পর্যায় ক্রমে আসে যায়। এখনো অব্দি ৪ বার এমন হয়েছে।

    আবার আন্তর্তিকাও বিভিন্ন উষ্ণ জায়গা থেকে উত্তরে সরে আজকের রূপ নিয়েছে।

    তো বর্তমানের এই সব বিপর্যয় কি পুরোটাই মানুষের কার্যকলাপ এর জন্য নাকি পৃথিবীর নিজস্ব গাঠনিক প্রক্রিয়ার ফল।
    । নাকি মানুষ এর কার্যকলাপ এর জন্য স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া অস্বাভাবিক ছন্দে দ্রুত হচ্ছে?

    আপনার মতামত পেলে ভালো লাগবে 😇

Leave a Reply to পলি মুখার্জি Cancel reply