বিশ্বনাথ উদিত
আমরা সংবিধান রচেছি, অনেক প্রতিষ্ঠান গড়েছি, যেমন বিদ্যালয়, হাসপাতাল, পুরসভা, নির্বাচন কমিশন, ইত্যাদি; তাদের কাজ পরিচালনার জন্য সরকার গড়েছি, গড়েছি শিক্ষাপর্ষদ, পুলিশ-তন্ত্র। কিন্তু এ কি অপরসায়ান! প্রাতিষ্ঠানিক পশ্চাৎগতি নিয়ে এল এক ব্যাপক নেটওয়ার্ক। মন্ত্রী, আমলা, কাকু আর ভাইপোর দল। জাল বিস্তার করা মদমত্ত তোলাবাজ। একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনা, সব হিসাবের বাইরে চলে যায়। সরকার দ্বারা প্রাণিত বিস্তীর্ণ মিথ্যা ও দুর্নীতির চক্র, যা আরজিকরের ঘটনাকেও ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চায়, তা আজ এক দুষ্ট প্রতিষ্ঠানের মতো বাঙালির মনকে পীড়িত করছে। চাকরিহারা শিক্ষকেরা রাজপথে হাহাকার করে। কিছুদিন আগেও একটা সুপ্ত গর্ব বাঙালির মনে কাজ করত নিজেদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে, অন্য রাজ্যেও এই উন্নত মানের একটা স্বীকৃতি ছিল; এখন বাঙালি সেই উচ্চাসন থেকেও স্খলিত
ক্ষমতাসীন কোনও মন্ত্রী মদমত্ত তোলাবাজ হলে কী হয়? বিরাট কিছু ক্ষতি হয় না যদি দুষ্কর্ম প্রকাশ হওয়ার পর অবিলম্বে দুষ্কৃতিকে পদচ্যুত করে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়। এরকম ঘটলে বুঝতে হবে, রাজ্যের প্রশাসন যথেষ্ট সজাগ নয় ঠিকই, তবে ক্ষমতার রাজনীতির চাপে ন্যুব্জ নয়। প্রশাসন সজাগ হলে তো রাজ্যব্যাপী দুষ্কর্ম ঘটতেই পারত না, আর একইসঙ্গে তারা ন্যুব্জ, অকর্মণ্য বলেই তো রাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশ সম্বন্ধে জনসাধারণের এত হতাশা! রাজ্যের প্রশাসনে বহু কৃতি আধিকারিক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের সন্তুষ্টি অর্জন করে টিকে থাকেন, নিজেদের পদোন্নতি ঘটান। একজন দার্শনিক যেমন বলেছিলেন: “দুর্বৃত্তায়নের বৃত্তের প্রসার ঘটাবার জন্য শুধু দরকার সুধীজনের নির্বিকার দর্শক হয়ে থাকা।” অন্যায়ের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনও কথা না বলে মৌনব্রত অবলম্বন করলে, নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলে আদপে অন্যায়কারীর কালো হাতই শক্ত হয়।
পার্থেনিয়াম একটা বিষাক্ত আগাছা। যাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সমূলে উৎপাটন করতে পারলে তা থেকে সহজে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। তা নাহলে এ আগাছা দ্রুত মাটির নিচে শিকড়ের জাল বিস্তার করে, তখন ওপর থেকে কেটে ফেললেও এর বিনাশ ঘটানো কঠিন। সুপ্রিম কোর্টও হিমশিম খেয়ে যায়। সমাজকে যখন এই অপরাধের জাল ছেয়ে ফেলে, তখন কোর্ট কয়েকজন কুলাঙ্গার আগাছাকে শাস্তি দিতে পারে মাত্র, কিন্তু জালকে সমূলে উৎপাটন করতে পারে না। সে কাজ পুলিশ-প্রশাসনের।
সমাজকে জড়িয়ে বেঁধে রাখে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, জাতির উন্নতি বা আধোগতি হয় এইসব প্রতিষ্ঠান গড়ে বা ভেঙে। মানুষের মনন, প্রতিক্রিয়া, উদ্যোগ, সবের উপরই থাকে প্রতিষ্ঠানের প্রভাব। রাজ্য প্রশাসন এমনই একটা সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যার নিষ্ঠা রাজ্যের সার্বিক নৈতিক মানের নির্দেশক হয়ে ওঠে। এখানে মানুষ কি নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে? সে কি মাথা উঁচু করে প্রাপ্য পরিষেবা দাবি করতে পারে, তার অভিযোগ আর প্রতিবাদ কি প্রতিকার এনে দেয়? না কি প্রতিবাদ নিষ্ফল, দুর্বল মানুষ অনুদাননির্ভর এবং নিরুত্তাপ ব্যক্তিত্বনাশী আনুগত্য তার নিত্যকার জীবন একটু সহজ করে দেয়? এ-সব প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলির চরিত্র বলে দেয়। পুলিশ যখন শাসকের হাতের অস্ত্র, তার আইন বলবৎ বা লঙ্ঘন করার ক্ষমতাও শাসকের হতে নিয়ন্ত্রিত, তখন দুরাচারী শাসকের কাছে মানুষ নিতান্তই অসহায়। ন্যায়বিচারের জন্য বিচারালয় পর্যন্ত যাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই খুব সহজ নয়।
গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের অধিষ্ঠানের বিচারে নরওয়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রগুলির অন্যতম বলে পরিচিত। সেখানকার একজন বিদ্বান ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আপনাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি মিথ্যা বলে ধরা পড়ে যান তাঁর কী হবে? ভদ্রলোক কিছুমাত্র দ্বিধা না করে উত্তর দিলেন “যদি মন্ত্রীবর দুই-এক ঘন্টার মধ্যে ভুল স্বীকার করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন তাহলে বেঁচে যেতেও পারেন, নতুবা দুই-এক দিনের মধ্যে সংসদের অধিবেশন ডেকে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে আর এই উদ্যোগে তাঁর নিজের দলের লোকেরাও নিশ্চয় থাকবেন।” রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সততার প্রতি এই অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি সংসদীয় প্রতিষ্ঠানটিকে মহান করে তোলে। যখন মিথ্যাটা প্রকট এবং তা সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানকে কলুষিত করে তখন বিচারালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হওয়াই উচিত নয়। ঠিক এর বিপরীত চিত্রটা দেখতে পাই আমাদের দেশে, বিশেষত আমাদের রাজ্যে। সর্বোচ্চ আদালতের নিরন্তর ভর্ৎসনাও মামুলি ঘটনার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
শিক্ষামন্ত্রী তো একা নন, তিনি একটি শৃঙ্খলের আলঙ্কারিক মুখ মাত্র। যখন তিনি উচ্চপদস্থ সহযোগীদের নিয়ে তোলাবাজি চক্রকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন তখন বিষটা সমাজের শরীরে প্রবেশ করে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিছানো জাল থেকে সহযোগীরা মাথা তুলতে থাকে, শুধু প্রশাসন নয়, শাসকদলের সর্বোচ্চ স্তরেও। দুর্নীতির সাঙ্গে ধূর্ততার সাযুজ্য স্বীকৃত, তারা দেখায় এমনতর ঘটনা দেশের আন্যান্য পিছিয়ে থাকা রাজ্যেও ঘটে। সব দেখেশুনে এই ক্লেদের তুলনা খুঁজতে বিহ্বল হয়ে তাকাতে হয় বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা আফ্রিকার দেশগুলির দিকে, যেমন সুদান, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, ইত্যাদি, যেখানে গণতন্ত্র এখনও শিকড় খুঁজে পায়নি।
সাধারণ মানুষ সংঘবদ্ধ নয়, বিরোধী দল নানা দ্বন্দ্বে দীর্ণ, আর পুলিশ নিষ্ক্রিয়। বিরাট পুলিশি ব্যবস্থা তো আইনের পথে মানুষকে সাহায্য করার জন্য, মানুষকে কেন সারাক্ষণ সংঘবদ্ধ হতে হবে? মানুষ তো নিজের কাজ, নিজের উদ্যোগ, চিন্তাভাবনা নিয়ে থাকবে। মুক্ত পরিবেশে নিজের সামর্থ্য ও উদ্যোগে এগিয়ে যেতে পারলেই তো একটা উজ্জ্বল মুক্ত সমাজ তৈরি হয়। বদমাশ সর্বত্রই থাকে, বদমায়েশির উর্বর ক্ষেত্র পেলে তা আগাছার মতো বাড়তে থাকে। দুটি উদাহরণ নেওয়া যাক।
সমু একটা নামী আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত। দেশে আসবে বলে দু-মাস সময় থাকতে একজন এজেন্টকে টিকিটের জন্য টাকা দিয়েছে (উদাহরণটা প্রায় তিন দশক আগের, কিন্তু বর্তমান আলোচনার জন্য সঠিক)। এজেন্ট আজ না কাল করে দু-সপ্তাহ কাটিয়ে দিয়েছে। সমু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছের একটি থানায় গিয়ে আভিযোগ করে ও টাকা দেওয়ার প্রমাণ দেখায়। পুলিশ অফিসার যত্নের সঙ্গে ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে তখনই এজেন্টকে ফোন করে। পুলিশের ফোন পেয়ে এজেন্ট টাকা প্রাপ্তিস্বীকার করে এবং বলে সেদিনই সন্ধ্যায় সে টিকিট পৌঁছে দেবে। অফিসার তাকে দু-ঘণ্টা সময় দিয়ে বেলা বারোটার মধ্যে টিকিট পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। বেলা বারোটার সময় একটা ধর্মীয় বাধ্যতার কারণে এজেন্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় চাইলেও অফিসার অনড়। তারপর সমুকে বলে নির্ভাবনায় নিজের গবেষণায় ফিরে যেতে, শুধু বারোটার মধ্যে টিকিট না পেলে একবার জানাতে। তারপর বেঁধে দেওয়া সময়ের আগেই টিকিট হাতে পেয়ে সমু অফিসারকে ধন্যবাদ জানায়। থানা নামক প্রতিষ্ঠানটার একটা আদর্শ চিত্রের পাশে পরের উদাহরণটা কলকাতার এক শহরতলির।
সাতবছর আগেকার কথা। তাপস একজন প্রাক্তন পুলিশকর্মী, ইস্তফা দিয়ে অন্য কাজ করছে। সে দু-দিন আগে নিজের চুরি যাওয়া সাইকেলটা পাশের কলোনির এক ছিঁচকে মস্তান বুলেটের হাতে দেখতে পায়। তাপসের বয়স হয়েছে, বাস্তববোধ আছে, তাই সরাসরি বুলেটকে বলার সাহস তার ছিল না। সে থানায় গিয়ে নিজের পরিচয় দেয় ও ডায়েরি করে। অফিসার তাকে অনুরোধ করে “মিউনিসিপ্যালিটির কাউন্সিলরকে দিয়ে আমাকে একটা ফোন করান না! তাপস জানায় বুলেট তো কাউন্সিলরেরই লোক। অফিসার তখন মৃদু হেসে ভঙ্গিমায় অসহায়তা ফুটিয়ে বলে “সে তো জানিই, সেখানেই তো সমস্যা।” চুরি যাওয়া বস্তুর হদিশ পেয়েও তাপস বা পুলিশ অফিসার সেটা ফিরিয়ে নেওয়ার সাহস পেল না; ভয়ে। চুরি বা তোলাবাজির আদর্শ ক্ষেত্র এই ভয়ের পরিবেশ যা নির্বাচনে জিততেও সূক্ষভাবে সাহায্য করে, কোনওরকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে।
বুলেটের বড়দা মাপের একজন, সেন্টু, দুর্গাপূজা করে, অনুরোধের ভঙ্গিতে চাঁদা বেঁধে দেয় পড়শিদের। সেন্টু আগে কখনও রাজনীতি করত না, কোনওমতে স্কুল পার হয়েছে। যদিও বুদ্ধি যথেষ্ট। ছোট থেকে শুরু করে মাঝারি মাপের বিল্ডিং প্রোমোটার হয়ে ওঠে এবং পরিস্থিতির দাবিতে অনেকটা বাধ্য হয়েই বেআইনি নির্মাণের কাজে হাত পাকায়, তারপর কাউন্সিলর। একটি অবসানের বাসিন্দারা ওর বেঁধে দেওয়া চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় ওর দলের বাইশ বছরের এক যুবক ষাট বছরের এক প্রৌঢ়কে সপাটে এক থাপ্পড় কষায়, সবাই হতবাক হয়ে দেখে। পুলিশে ডায়েরি হয়, থানা থেকে একবার এসে ঘুরে যায়, কিন্তু সেখানেই শেষ। মনে হয় থানা শুধু আদেশ মেনে কাজ করে, আইনরক্ষার তাগিদে নয়। প্রতিবাদে মানুষ ফেটে পড়তে পারত, কিন্তু তার জন্যও থানার ন্যূনতম সুরক্ষা দরকার। এক্ষেত্রে মানুষ প্রায় গুটিয়ে গেল আবারও আত্মসম্মান হারানোর ভয়ে। আর ভয় কায়েম করাটাই তো সন্ত্রাসের জয়।
দু-বছর পর বিধানসভা নির্বাচনে ওই আবাসনের গেটের পাশে একটা টুলে বছর পনেরোর দুর্বল চেহারার একটা ছেলেকে বসিয়ে দেওয়া হল, হাতে একটা মোবাইল। ছেলেটিকে চিনিয়ে দেওয়া হয় চার-পাঁচটি পরিবারকে যাঁরা বাম-মনোভাবাপন্ন বলে পরিচিত; তাঁরা আবাসন থেকে বের হতে গেলে ছেলেটি সতর্ক করে দেয় দুটি রাস্তার মোড়ে তাঁদের আটকাবার জন্য লোক দাঁড়িয়ে আছে, ওরা খারাপ লোক। শুধু দুজন প্রৌঢ় ছেলেটিকে অগ্রাহ্য করে ভোট দিয়েছে, বাকিরা ভোট দিতে যায়নি। তা বলে তাদের ভোট কি পড়েনি? কেউ ছেলেটিকে বলেনি তুমি এখানে কী করছ, চলে যাও। চাপা সন্ত্রাস। শহর কলকাতায়, গ্রামের কথা পরে।
এখন থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা-পত্রে লেখা হয়েছিল: সকল মানুষ সমান অধিকার নিয়ে জন্মেছে। এই অধিকারগুলির মধ্যে পড়ে জীবনধারণের ও ব্যক্তির স্বাধীনতার অধিকার এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সন্ধানে কর্মের অধিকার। এইসব অবিচ্ছেদ্য অধিকারগুলিকে রক্ষা করা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার গঠন করা দরকার কিন্তু সরকার যদি সেই কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে সেই সরকারকে ফেলে দেওয়াটা মানুষের অধিকার।
এই কথাগুলো ছিল আমাদের প্রেরণা দেশকে স্বাধীন করার এবং তারপর এগিয়ে যাওয়ার। আমরা সংবিধান রচেছি, অনেক প্রতিষ্ঠান গড়েছি, যেমন বিদ্যালয়, হাসপাতাল, পুরসভা, নির্বাচন কমিশন, ইত্যাদি; তাদের কাজ পরিচালনার জন্য সরকার গড়েছি, গড়েছি শিক্ষাপর্ষদ, পুলিশ-তন্ত্র। কিন্তু এ কি অপরসায়ান (alchemy)! প্রাতিষ্ঠানিক পশ্চাৎগতি নিয়ে এল এক ব্যাপক নেটওয়ার্ক। মন্ত্রী, আমলা, কাকু আর ভাইপোর দল। জাল বিস্তার করা মদমত্ত তোলাবাজ। একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনা, সব হিসাবের বাইরে চলে যায়। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের হিসাব কে নিচ্ছে? সরকার দ্বারা প্রাণিত বিস্তীর্ণ মিথ্যা ও দুর্নীতির চক্র, যা আরজিকরের ঘটনাকেও ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চায়, তা আজ এক দুষ্ট প্রতিষ্ঠানের মতো বাঙালির মনকে পীড়িত করছে। চাকরিহারা শিক্ষকেরা রাজপথে হাহাকার করে। কিছুদিন আগেও একটা সুপ্ত গর্ব বাঙালির মনে কাজ করত নিজেদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে, অন্য রাজ্যেও এই উন্নত মানের একটা স্বীকৃতি ছিল; এখন বাঙালি সেই উচ্চাসন থেকেও স্খলিত।
মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক ক্লড স্টিল প্রচলিত ধারণার বিপদ (stereotype threat) সম্বন্ধে অনেক গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে প্রতিকূল ধারণাগুলি সংশ্লিষ্ট সামাজিক শ্রেণির উপর সাধারণভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেমন মেয়েরা অঙ্কে সাধারণত দুর্বল হয়— এমন সুপ্ত ধারণাকে জাগিয়ে দিয়ে শক্ত অঙ্কের পরীক্ষায় বসিয়ে দেখা গেছে মেয়েদের প্রাপ্ত মান কমে গেছে অন্যথায় যা হয় তার তুলনায়। এমন আরও নানা পরীক্ষা তিনি ও তাঁর সহযোগীরা করেছেন যা দেখিয়ে দেয় মানুষের কর্মক্ষমতায় মনস্তত্ত্বের গভীর প্রভাব। সাধারণভাবে আত্মসম্মান ও আত্মপ্রত্যায়ে জাগরিত থাকলে কাজের উপর তার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই বুঝতে বাকি থাকে না একজন শিশু যখন আনন্দে উৎসাহে শেখার সুযোগ পায় তখন সে দ্রুত শিখতে পারে। বিদ্যালয় শিক্ষা উন্নয়নের গবেষণায় ব্রতী বেসরকারি সংস্থা ‘প্রথম শিক্ষা ফাউন্ডেশন’ শিশুদের সঙ্গে কাজ করে এটা দেখিয়ে দিয়েছে। তাই বিদ্যালয়ে যখন শিক্ষকের অভাব বা শিক্ষকেরা যখন শিশুদের প্রতি অযত্নবান, যখন বিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতি হীন রাজনীতিবিদের কব্জায়, তাদের হাতে শিক্ষকের সম্মান ভূলুণ্ঠিত, তখন সেখানে শিক্ষার প্রসার চরম বাধার সম্মুখীন। বুনিয়াদি শিক্ষায় বাঙালির পশ্চাদপসরণ তার স্খলনকে চিত্রায়িত করে।
এ রাজ্যে শাসকেরা কথায় কথায় উত্তরপ্রদেশের উল্লেখ করেন পশ্চাদপদতার উদাহরণ হিসাবে নিজেদের কুকর্মকে লঘু করে দেখাবার জন্য। এ-কথা ঠিক সে রাজ্য দীর্ঘদিন দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলির অন্যতম ছিল এবং বর্তমানে সেখানকার আধিদৈবিক হিন্দু-মৌলবাদী রাজনীতি আমদের চেতনাকে পীড়া দেয় এবং শঙ্কা জাগায়। রাজ্যটা বিরাট, জনসংখ্যা আমাদের রাজ্যের দ্বিগুণের বেশি। কিন্তু এই পশ্চাদপদ রাজ্যে বিরাট কিছু ঘটে চলেছে যা লক্ষ করলে নিজেদের রাজ্যের জন্যে আমাদের লজ্জিত হওয়ার কারণ থাকে। বুনিয়দি শিক্ষার প্রসার যে-কোনও জাতির উন্নতির সোপান। এই মূল কাজে গত দশকে সে রাজ্য এগিয়েছে আর আমরা পিছিয়েছি। এভাবে, আবাক হওয়ার নেই, বর্তমানে তাদের চেয়েও পিছিয়ে গেছি।
শিক্ষাপ্রসারের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডটার আনেক দিক আছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফলেন পরিচীয়তে। আমরা এখানে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে শুধু ফলের দিকে, অর্থাৎ পড়ুয়াদের অর্জিত শিক্ষার দিকে তাকাব। এই বিচারটা অত্যন্ত যত্ন নিয়ে সুনামের সঙ্গে করে চলেছে “প্রথম শিক্ষা ফাউন্ডেশন”। তারা বিচার করে পড়ুয়ার মাতৃভাষায় লেখা কোনও পাঠ্য পড়ার পারদর্শিতা এবং সাধারণ বিয়োগ বা ভাগ অঙ্ক কষার শিক্ষা। তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়াদের দ্বিতীয় শ্রেণির সাধারণ মানে ও অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের তৃতীয় শ্রেণির সাধারণ মানে বিচার করা হয়। শতাংশের হারে কতজন পড়ুয়া এই মান অর্জন করতে পেরেছে সেটাই হল রাজ্যের বুনিয়াদি শিক্ষার অবস্থানের একটা গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
প্রথম শিক্ষা ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক গ্রামাঞ্চলভিত্তিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে ২০১৪ সালে আমাদের গ্রাম-বাংলার তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়ারা উত্তরপ্রদেশের তুলনায় আনেকটাই এগিয়ে ছিল। পাঠ্য পড়ার ক্ষেত্রে সে-রাজ্যের ২২ শতাংশের তুলনায় আমাদের ৩৬ শতাংশ, শিক্ষার মান হিসাবে যথেষ্ট খারাপ হলেও তুলনয় একটু বেশি বৈকি। অঙ্কের ক্ষেত্রেও তুলনাটা একইরকম ছিল। আমাদের রাজ্যে প্রাথমিক শিক্ষার মান উদ্বেগজনক— এটাই ছিল পত্র-পত্রিকায় আলোচনার বিষয়, উত্তরপ্রদেশের তো কথাই নেই। চার বছর পরে, ২০১৮ সালে পাঠের মান আমাদের বেড়ে হয় ৪০, আর উত্তরপ্রদেশের হয় ২৮। অঙ্কের ক্ষেত্রেও তুলনাটা প্রায় একইরকম ছিল। কিন্তু পরের ছয় বছরে চিত্রটা পাল্টে যায়। ২০২৪ সালের পাঠের মান উত্তরপ্রদেশের বেড়ে হয় ৩৪ আর আমাদের কমে হয় ৩৬। অঙ্কের ক্ষেত্রে দুই রাজ্যেই সমান, ৪১। মানেটা দাঁড়ায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাদানে উত্তরপ্রদেশ আমাদের চেয়ে আর পিছিয়ে নেই। তারা অনেক এগিয়েছে গত দশকে আমাদের তুলনায়।
গ্রামাঞ্চলের অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়াদের মানের বিচারে ২০১৪ সালেও উত্তরপ্রদেশ আমাদের থেকে পিছিয়ে ছিল না, কিন্তু ২০১৮ সালে সে-রাজ্য চোখে পড়ার মতো এগিয়ে যায়, তারপর ২০২৪ সালে ফারাকটা আরও বাড়িয়ে মাথা উঁচু করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে— পাঠের ক্ষেত্রে ওদের ৪৫, আমাদের ২৯; অঙ্কে ওদের ৫৫, আমাদের ৩৪। ২০১৪ সালের পর আমাদের মান নেমেছে, আর ওদের বেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা এই যে আমাদের অবনতি মূলত সরকারি বিদ্যালয়ে যা আমাদের গ্রামাঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের মূল ভরসা; আর উত্তরপ্রদেশের উন্নতিও পুরোপুরি সরকারি বিদ্যালয়ে যার দৈন্যদশা ওদের অতীতে পিছিয়ে রেখেছিল। আমাদের অবক্ষয় আর ওদের প্রগতি, বুনিয়াদি শিক্ষায়।
এখন বাঙালির মনে গেঁথেছে নিজের জাতি সম্বন্ধে একটা নেতিবাচক ধারণা— বাঙালি পিছিয়ে পড়ছে। আর তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, আরও বাঙালি মনীষীদের ছবি নিয়ে স্লোগান দেওয়ার— “বাংলা এগিয়ে”। ক্লড স্টিল-অনুসারী মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা বলতে পারবে এতে বাঙালি কতটা উজ্জীবিত হয়।
বাঙালির পরীক্ষা আজ, এই অধোগতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে।

