আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা বনাম উত্তর-ঔপনিবেশিকতা

মনির ইউসুফ

 


বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে, সরকার পতন হয়েছে। তখনই যে-কোনও দেশে অভ্যন্তরীণ মানবিক উন্নয়ন, মানসিক উন্নয়নের জন্য নব্য বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় তৈরি হয়, তা বাংলাদেশেও হয়েছে। তবে তারা নিজেরাই ব্যক্তিসম্পদের লোভে জেরবার হয়ে পড়ে; ব্যক্তিগত খ্যাতি তাদের বুদ্ধিজীবীদের অন্ধ করে দেয়। তারা তাদের শ্রেণির সমস্যাকে জনগণের সমস্যা বলে চালিয়ে দেয়। জনবিচ্ছিন্ন মধ্যবিত্ত জীবন-যাপন করা বুদ্ধিজীবীরা বুঝতেই পারে না জনগণের মৌলিক সমস্যা কী, জনতা কে? ফলে গণজনকে তারা সর্বজন বানিয়ে ফেলে। এতেই ঘটে বিপদ

 

তার সমস্ত তত্ত্ব, ধর্ম, নৈতিকতা, ন্যায় ও সংবিধান নিয়ে পৃথিবী আবারও এসে দাঁড়াল খাদের কিনারে। কারণ মুনাফাই হয়ে উঠল পৃথিবীর প্রধান প্রণোদনা। লগ্নি পুঁজি থেকে লাভ তুলতেই হবে। এই যে লাভের ধারণা মানুষের মস্তিষ্ক, মনন ও শিরার রক্তে গেঁথে গেল— তা থেকে সে আর কখনও মুক্ত হতে পারল না। মুনাফার লোভ মানুষকে ক্রমান্বয়ে নিষ্ঠুর ও লালসাপ্রবণ প্রাণীতে রূপান্তরিত করল।

জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে। ইতিহাস তাকে কোথায় স্থান দেবে জানি না। কিন্তু বর্তমান তাকে মাথায় তুলে নাচছে, তার কারণও আছে। জুলাই অভ্যুত্থানে যারা অংশ নিয়েছে— তারা কিশোর, টোকাই, পথশিশু, তরুণ, যুবক এবং গণমানুষ, পার্টিজান— এক কথায় বাংলাদেশ। তারা রক্ত দিয়েছে, আহত হয়েছে, জুলুমের শিকার হয়েছে। আমি এই ঘটনাকে শনাক্ত করতে চাই এইভাবে যে, জুলাই অভ্যুত্থানে যারা অংশ নিয়েছে তারা সবাই সময়ের প্রহরী (আঁভা-গার্দ)।[1]

বাংলাদেশে হঠাৎ-ই আঠারো আসেনি; স্বাধীনতার পর থেকেই তৈরি হয়েছে পথ। দীর্ঘ বছর ধরে নিপীড়িত ও নির্যাতিত হতে হতে তৈরি হয়েছে মন ও মনন। বাঙালির ইতিহাসের ভাবাদর্শ কী? মিথ্যার উপর দিয়েই তার অধিষ্ঠান। সেটাকেই মেনে নিয়েছে সর্বজন-গণজন। যেমন: গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ, গোলাভরা ধান। তাহলে প্রশ্ন আসে— চর্যাপদ যখন রচিত হচ্ছে, সেই সময়ে ‘হাড়িতে ভাত নেহি নিত্য আবেশি’ কারা ছিল? তাহলে বোঝা যায়, আমরা সম্পূর্ণ বানোয়াট ভাবাদর্শের সন্তান।

তাই বলছি, আধুনিকতা ইউরোপীয় দেশগুলিতে হয়ে উঠেছে রোমান ও পেগান অতীত থেকে স্বতন্ত্র এক রাষ্ট্রীয় অনুষঙ্গে খ্রিস্টীয় ‘বর্তমান’।[2] আমাদের মতো দেশে আধুনিকতা বলতে বোঝাতে হয় এই যে, মুসলমানদের পনেরোশো বছরের অতীতই আজকের ‘বর্তমান’। ইহুদিদের বর্তমান আরও কঠিন— প্রায় তিন হাজার বছরের অতীত। তাই পর্যবেক্ষণে আমাদের সঙ্গে ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্লেষণ একসঙ্গে হাত মেলাতে পারে না, মনও মেলাতে পারে না। আমাদের মুসলমানদের ‘বর্তমান’ ইসলামের অতীতের পনেরোশো বছর, অর্থাৎ মুহাম্মদ (সঃ), খোলাফায়ে রাশেদীন বা উমাইয়া হয়ে আজকের দিন পর্যন্ত সেই অতীতই বর্তমান। আমাদের ভারতীয় হিন্দুদের ‘বর্তমান’ হাজার হাজার বছরের বৈদিক অতীত থেকে আজকের বর্তমান পর্যন্ত। বৌদ্ধদের ক্ষেত্রেও একই কথা। আমরা আধুনিকতাকে কী দিয়ে পরিমাপ করি— আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে শনাক্ত করতে পারলে বিষয়টি বোঝা যাবে।

সুতরাং চিন্তা ও দর্শনের জায়গা যে কতটা ভিন্ন ও সূক্ষ্ম, তা সনাক্ত করতে হবে। সভ্যতার সময়প্রবাহ কত বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। সময়, সত্তা ও অদৃশ্য স্রষ্টা, আর মানুষের গোপন সত্তা— তারা কত কথা বলেছে! আন্দালুসিয়ার মুসলিম দার্শনিক ইবনে আরাবি সত্তার ঐক্যকে সামনে এনেছেন সুফিবাদের স্বর্ণযুগে। কিন্তু আন্দালুসিয়া বলেন, ইউরোপীয় বলেন, ইহুদি ও খ্রিস্টান চিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা— তাঁরা কি সেই ঐক্যকে নিজেদের চিন্তার জগতে স্থান দিয়েছেন? তাঁরাও সত্তা নিয়ে কারবার করেছেন— বিশ্লেষণের পর বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ, অন্বেষণ, ধ্যান, সূক্ষ্ম সাধনা। সভ্যতার মানব-চিন্তার জগতকে তাঁরা উলটে-পালটে একাকার করে ফেলেছেন; এবং তাঁরা এগিয়ে গেছেন।

কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানরা সভ্যতার চিন্তার জগতকে নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারেনি। এত গভীরভাবে শুরু করেও থেমে গেছে। কেন থেমে গেছে? হিন্দু-মুসলমানদের কাছে চিন্তার ভাঙনের চেয়ে বেদ-শরিয়তের আইন রক্ষা বড় হয়ে গেছে। আইন মানে কিছু নিয়ম-বিধি; নিয়মের নিগড়ে আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় এত নিষ্ঠুর হয়েছি যে অলৌকিকতার নামে জাগতিকতাই বড় হয়ে ধরা দিয়েছে। ‘স্বর্গের জন্য আমরা রক্তপাত করি, স্বর্গ তার কিছুই জানে না।’

কোনও সূক্ষ্ম, সৃষ্টিশীল অনুভূতিকেই আমরা মেনে নিতে পারিনি। শরিয়তের বিধি-বিধান যা বলেছে, তাকেও ভালোভাবে, গভীরভাবে ভেঙেচুরে দেখার সাহস অর্জন করতে পারিনি। যারা সাহস দেখিয়েছে, তারা এগিয়েছে। হিন্দু ও মুসলমান অতীত নিয়ে ‘বর্তমান’ গর্ব করে। আর ইহুদি ও খ্রিস্টানরা বর্তমানকে ভেঙে ভবিষ্যৎ তৈরি করে। ইউরোপ গির্জা তিনশো বছরের যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে তা মীমাংসা করেছে, কিন্তু আমরা এ-বিষয়ে এখনও অজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছি।

আমাদের চিন্তার এই যে নিয়তি তাকে কীভাবে আমরা দেখি? ধরুন, বাংলাদেশে আসি। শতকরা ৯৫ ভাগ মুসলমানের দেশে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই অভ্যুত্থান কত বড় ঘটনা, তা কল্পনা করা যায়! সেখানে সুযোগ পেয়ে আমরা ইসলামি শরিয়া আইন চালু করতে চাইছি। কারা করতে চাইছে— নাগরিকরা, কিন্তু সব নাগরিক নয়। রাষ্ট্র কিন্তু ইসলামি নয়, গণপ্রজাতন্ত্রী। অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে সরকার সবে গঠিত হয়েছে। যেহেতু আমরা খ্রিস্টানিটির উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে বেছে নিয়েছি, সেহেতু কি আমরা সবাই খ্রিস্টান নাগরিক? গভীরভাবে ভাবলে দেখবেন আমরা রাষ্ট্রকে বাইবেলীয় চিন্তার হাতে তুলে দিয়েছি— না দিয়ে উপায়ও নেই। আমাদের নিজেদের তৈরি উদারনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কী? পারিনি তৈরি করতে। আমরা উপনিবেশের সন্তান। ইউরোপীয়দের কিল, লাথি-ঘুষি, ধমক খেতে হয়েছে, তাও শত শত বছর ধরে। এ লজ্জা রাখব কোথায়? এ কি লজ্জা নয়? যদি লজ্জা হয়, তাহলে আমাদের ভাবতে হবে।

আমাদের জগতসভ্যতায় দাঁড়াতে হলে, সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে যুঝতে হলে এসব বিষয় ভুলে গেলে চলবে না। ইউরোপ আর ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। তারা ভাববাদীয় ধর্মরাষ্ট্রের মধ্যে থেকে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে মেনে নিয়েছে। তাদের চরম ডানপন্থীরাও এ-বিষয়ে আর কোনও ঝুঁকি নেয় না। রাষ্ট্রের দিক থেকে তারা এ-বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এ-জন্য তারা জাতি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আর ধর্মরাষ্ট্র বানানোর জন্য হানাহিনিতে নামে না। বরং আমাদের দেশকে ধর্মরাষ্ট্র বানানোর ভয়ে তারা আতঙ্কিত। তার জন্য তারা নির্দয়ভাবে আমাদের জাতিসত্তাকে ধ্বংস করতেও পিছপা হচ্ছে না।

ইউরোপ ব্যক্তিগত বর্ণবাদের ক্ষেত্রে এখনও উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। রেসিজম তাদের এখনও প্রবলভাবে বিদ্যমান। জাতি হিসেবে তারা জগতসংসারে নিজের অবস্থানকে লিবারেল করে নিতে পেরেছে— এটাই তাদের অর্জন।

কিন্তু আমাদের সমস্যা অনেক বড়। আমরা বেদ, উপনিষদ, কোরানে বর্ণিত ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার থেকে এক বিন্দুও সরে আসিনি। সেক্ষেত্রে আমরা চরম ডানপন্থী। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে আমরা মেনে নিতে পারিনি। যে-কারণে আমাদের কোনও তত্ত্বই কার্যকর হচ্ছে না। ধর্ম বা বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটি আমার। মানুষ হিসেবে আমরা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছি। মানুষ হিসেবে এটি এক বড় উলম্ফন। কিন্তু জাতি হিসেবে আমাদের কত ভাঙন হয়েছে! আরও ভাঙনে আমরা জেরবার। রাজক্ষমতা এক দেবপুত্রের হাত থেকে আরেক দেবপুত্রের কাছে হস্তান্তর হয়েছে। তাই জাতি হিসেবে আমরা দাঁড়াতে পারিনি। মহাত্মা গান্ধির নেশন ভাবনা শুধুই হিন্দু নেশন নিয়ে— সেখানে সর্বজন স্থান পায়নি। যদি সর্বজন-গণজন স্থান পেত, তাহলে ভারত জাতি হিসেবে ইউরোপের চেয়ে শক্তিশালীভাবে দাঁড়াত।

পুঁজিবাদের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বৃহৎ বিপ্লব যেতে না পারার যে কষ্ট, তা থেকে জন্ম নিয়েছে আরেকটি ইজম। এটি ফ্যাশনেবল, প্রযুক্তিগত, আধুনিক এবং প্রকরণগত; আঙ্গিক প্রদান, সাহিত্যিক, আর্টিস্টিক, নারীবাদ, সমকামীবাদ, তৃতীয় লিঙ্গ-সহ বহু বিচিত্র অধিকার নিয়ে কথা বলে। মডার্ন থেকে আল্ট্রা-মডার্ন, সাম্প্রতিক থেকে সাম্প্রতিক, প্রযুক্তিগত।

এখানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের প্রতিবাদের, প্রতিরোধের দাবি আদায়ের মিছিলে সিক্ত, ফ্যাশন হিসেবে উচ্চবিত্ত সন্তানও মাঝে মাঝে এই বিপ্লবে অংশ নেন। কাজ নাই তো খই ভাজ। সরকারি ধর-পাকড়, জেল-জুলুম, কয়েকটি খুন— সবই ঘটে। তারপরও আগের নিয়মে, আগের জায়গায় ফিরে যাওয়া। এটি পুরোটাই পশ্চিমি ফ্যাশন। এই ইজম তাৎক্ষণিক একটি প্রলেপ দিতে পারে, কিন্তু বৃহৎ কোনও সমাধান দিতে পারে না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে এটি ইউরোপে ব্যাপক সাড়া ফেলে। মানুষের মননেও ব্যাপক জায়গা করে নেয়। অনেক তাত্ত্বিক বলেন— পৃথিবীর বড় বড় শিল্পীরা এই ইজমের ফাঁদে পড়ে প্রগতির সর্বনাশ করেছে। আমাদের দেশেও এটি সর্বনাশের কারণ হয়ে পড়েছে।

কিন্তু এর পজিটিভ দিক হচ্ছে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ। বিশিষ্ট মার্কসবাদী পণ্ডিত ক্যালিনিকোস ও এজাজ আহমদ উত্তরাধুনিকতা নিয়ে বলেছেন— “এটি পুঁজিবাদের বৌদ্ধিক অস্ত্র।” উত্তরাধুনিকতায় যথেষ্ট আগ্রহী মার্কসবাদী চিন্তাবিদ জেমিসন বলেছেন, এটি হল “Cultural Logic of Late Capitalism.” মার্কসবাদী সাহিত্য-সমালোচক টেরি ইগলটন উত্তর-আধুনিকতাবাদকে কড়া ভাষায় পুঁজিবাদী তত্ত্ব বলে আক্রমণ করেছেন। বামপন্থী পণ্ডিত হার্ভে তাঁর বিশিষ্ট গ্রন্থ The Condition of Postmodernity-তে দেখিয়েছেন, অতি উন্নত ধনতন্ত্রের সঙ্গে এর সম্পর্ক।

শেয়ারবাজারের ফটকা, অনুৎপাদক সম্পদের প্রসার, আর তার সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির অকল্পনীয় অগ্রগতি— কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা— এগুলিও উত্তর-আধুনিক সমাজ-পরিস্থিতির উদ্ভবের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ, এক কথায়, ধনতন্ত্রের একটি বিশেষ পর্যায়ে এর জন্ম। উত্তরাধুনিকতা তত্ত্বকে উৎসাহ জুগিয়েছে পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়। এই তত্ত্ব হতাশা ছড়ায়, শ্রেণিসংগ্রামে আস্থা রাখে না, নৈরাজ্যবাদী।

উত্তর-আধুনিক তত্ত্বের প্রবক্তা মিশেল ফুকো, জাক দেরিদা, রলাঁ বার্থ, লিওতার, বদ্রিলার, লাকাঁ, দ্যলুজ, গুয়াত্তারি, ক্রিস্টেভা, ইরিগারে, সিকসু প্রমুখ। আমি এই উত্তর-আধুনিক তত্ত্বের ফেরি করছি না। আমি আমাদের দেশের জুলাই বিপ্লবকে যদি এই তত্ত্ব দিয়ে বিচার করি— তাহলে দেখব, বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা ও প্রাপ্য আদায়ের জন্য একটি আন্দোলন অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে।

এই আন্দোলনের দর্শন কী? কোনও দর্শন নেই। ভাগবাঁটোয়ারায় মেলেনি, তাই নিজের প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার জন্য দা-কুড়াল নিয়ে প্রতিবাদ করা। প্রাপ্য পেলে এ আন্দোলনের বা অভ্যুত্থানের আর কোনও অর্থ থাকে না। এখন যা দেখছি, এই আন্দোলন বা অভ্যুত্থানের কোনও অর্থ নেই। কেন নেই? যারা এই আন্দোলন-প্রতিবাদ করেছে, তাদের বড় কোনও লক্ষ্য নেই, মানবমুক্তির দর্শন নেই। গণজনের কল্যাণের নামে এই আন্দোলনগুলি ক্রমশ ফিকে হয়ে যায়। এত রক্ত দানের পরও মানুষের মুক্তি আসে না। যারা আন্দোলন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আবার আন্দোলনে নামতে হয়। উত্তরাধুনিকতার লক্ষণাযুক্ত ফ্যাশনেবল এই আন্দোলনে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের দায় শুধু খাঁটি থেকে যায়।

এবার আসা যাক সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজির বেড়ে উঠা, সমাজতান্ত্রিক জীবনবোধ, বিপ্লব, মানুষের মুক্তি।

এই বাণিজ্যের প্রসারের যুগে, মুনাফা যাদের প্রধান বাণিজ্য হিসেবে ভর করেছে— তাদের কাছে সভ্যতা, সংস্কৃতি বা মানুষের মূল্য কী? মুনাফাই সব। সুতরাং পৃথিবী তার সমস্ত তত্ত্ব, ধর্ম, নৈতিকতা, ন্যায়, বিধি নিয়ে পড়ে গেল আবারও খাদের কিনারে। যেহেতু মুনাফাই হয়ে গেছে পৃথিবীর প্রধান প্রণোদনা, লগ্নি পুঁজি থেকে লাভ বের করতে হবে। এই যে লাভের ধারণা মানুষের মস্তিষ্কে ও মননে গেঁথে গেছে, তা থেকে সে আর কখনও বের হতে পারেনি। মুনাফার লোভ মানুষকে ক্রমশ নিষ্ঠুর ও লালসার প্রাণী করে তুলেছে।

প্রাচীন বা সামন্তযুগেও উৎপাদনমুখী বিনিময় প্রথার সাধারণ সমাজে মানুষ কতটা সরল ছিল, তা আদিম সমাজব্যবস্থার দিকে গভীরভাবে দৃষ্টি ফেরালে বোঝা যায়। কিন্তু পুঁজির সমাজে তা হয়ে গেছে এক শয়তানি সমাজ— পুঁজির সমস্ত কদর্যতা নিয়ে মানুষ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হল।

উপনিবেশের কালে লড়াই-সংগ্রামে সমাজের গুটিকয় মানুষ ছাড়া সর্বস্তরের মানুষ নিজেদের একটি সমাজ নির্মাণ করার জন্য রক্ত দিয়েছে, সংগ্রাম করেছে, স্বপ্ন ও কল্পনার মানবিক আধেয় নিয়ে লড়েছে। সে লড়াই চলছে এখনও। কোনও কোনও জাতি তাদের আরাধ্য স্বাধীনতাও লাভ করেছে। সেই জাতির জাতীয়তাবাদী সন্তানগণ শাসনভারও হাতে নিয়েছে।

উত্তর-ঔপনিবেশিকতা বলতে আমি যে-কোনও জাতির উপনিবেশ থেকে মুক্তি, স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার ধরনকে বোঝাচ্ছি। যে-সব দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের জাতীয়তা, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নিয়ে নিজেদের দেশ পরিচালনা করছে। এই উত্তর-ঔপনিবেশিক বিশ্বকে ইউরোপীয়রা ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নাম দিয়ে একটি গ্লানির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই হীন দৃষ্টিতেই তারা আমাদের দেশসমূহ, জাতিসমূহকে বিচার করে। তাদের কবি, দার্শনিক, লেখক, রাজনৈতিকবৃন্দ থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ— সবাই। যে-কারণে তারা কখনও এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিনো দেশগুলো, তাদের জনগণ ও নাগরিককে সুবিচার করতে পারেনি— না রাজনীতি, না বুদ্ধিবৃত্তিতে। আর এই অবিচারকেই মেনে নিয়ে আমরাও নিজেদের তৃতীয় বিশ্বের লোক হিসেবে সাব্যস্ত করেছি।

আমি স্পষ্ট করে দিতে চাই, ‘তৃতীয় বিশ্ব’ বলে কোনও কিছু নেই, যেমন ‘প্রথম বিশ্ব’ও কোনও সত্য নয়। এই তত্ত্ব যারা দিয়েছে, তারা কীসের বিধায়ক, কীসের বিচারক! তারা বর্ণবাদী, রেসিস্ট। আমরা সবাই পৃথিবীর মানুষ। আমাদের এশিয়া মহাদেশ, তাদের ইউরোপ মহাদেশ বা অন্য মহাদেশ— সবাই মানুষ। এসব তত্ত্ব কেবল কিছু ধারণা মাত্র।

উত্তর-ঔপনিবেশিকতা কী? আগে এটি পরিষ্কার করতে হবে।

দুনিয়ার যে সব ভূখণ্ড ইউরোপীয়রা উপনিবেশ বানিয়েছিল এবং এক সময় পাততাড়ি গুটিয়ে বাধ্য হয়ে চলে গেছে, সেই সময়ের স্বাধীন হওয়া ও সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোই উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্র বা সমাজব্যবস্থা, যাকে আবার ‘তৃতীয় বিশ্ব’ও বলা হয়। দর্শনের ভাষায়, এটি পুঁজিবাদী সময়ে নিজের সার্বভৌমত্ব, জাতিসত্তা, ধর্ম-অধর্ম নিয়ে সাবজেক্ট হয়ে ওঠা।

এই রাষ্ট্রগুলির জীবন-যাপন, আন্দোলন, প্রতিবাদ, পার্লামেন্ট, বিবাহ-প্রথা, ব্যাঙ্ক, বিমা, বিনোদন, কর্পোরেটোক্রাসি, লৌকিকতা-অলৌকিকতা— মানসিকতাই উত্তর-ঔপনিবেশিকতা। এ যে কত জটিল, কত কুটিল, উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ের মানুষ তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করছে। কারণ, আমাদের দেশের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ— সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বিদ্বেষ-সহ— উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে নিজেদের আত্মপরিচয়, অধিকার-সচেতনতা, ঔপনিবেশিক সময়ের অপ্রাপ্তি, শোষণ, আবার উপনিবেশ-উত্তর সময়েও একই ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যবহার ও সামাজিক ঘৃণার কারণে, দর্শনের ভাষায় নিজেদের সাবজেক্ট হয়ে উঠার যে তোড়জোড়, লৌকিকভাবে বললে— ‘মুই কী হনুরে’ হয়ে ওঠার যে অধিকারবোধ, তা অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়েছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশের সঙ্কট অনেক বড়। বিশিষ্ট দার্শনিক একবাল আহমদের ভাষায়, ‘আলুর বস্তা থেকে আলুর ভর্তা’ পর্যন্ত। মার্কসই প্রথম এ-বিষয়ে প্রখর পর্যবেক্ষণ দিয়ে বিষয়টি সামনে এনেছিলেন।

বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলন অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে, সরকার পতন হয়েছে। তখনই যে-কোনও দেশে অভ্যন্তরীণ মানবিক উন্নয়ন, মানসিক উন্নয়নের জন্য নব্য বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় তৈরি হয়, তা বাংলাদেশেও হয়েছে। তবে তারা নিজেরাই ব্যক্তিসম্পদের লোভে জেরবার হয়ে পড়ে; ব্যক্তিগত খ্যাতি তাদের বুদ্ধিজীবীদের অন্ধ করে দেয়। তারা তাদের শ্রেণির সমস্যাকে জনগণের সমস্যা বলে চালিয়ে দেয়। জনবিচ্ছিন্ন মধ্যবিত্ত জীবন-যাপন করা বুদ্ধিজীবীরা বুঝতেই পারে না জনগণের মৌলিক সমস্যা কী, জনতা কে? ফলে গণজনকে তারা সর্বজন বানিয়ে ফেলে। এতেই ঘটে বিপদ।

ক্ষমতার দেমাগ ধরে রাখা সহজ কোনও বিষয় নয়। অভ্যুত্থানকে তারা ব্যক্তিগত লাভালাভে পরিণত করে। গণিমতের দেশ ও মালামাল ভোগ করার প্রতিযোগিতা চলে, ভাগাভাগি করা হয়। এখানেই বিপদের শঙ্কা।

তৃতীয় বিশ্ব বা উত্তর-ঔপনিবেশিক পটভূমি নিয়ে আলোচনা সহজ নয়। এখানে নানা জটিলতা— ধর্ম, সমাজ, সম্প্রদায়, ভূখণ্ড, মুনাফা, প্রতিশোধ, বঞ্চনা, গণনা, শোষণ-শাসন, জাতিসত্তা, জাতীয়তাবাদ, প্রকৃতিধ্বংস, এনজিও, উন্নয়ন, সহিংস উন্নয়ন, ভাগাভাগি, রোগ-প্রতিরোধ, ব্যবস্থাপনা, হীনম্মন্যতা, অপমান ইত্যাদি। বিশিষ্ট দার্শনিক ইকবাল আহমদের একটি কথা ধরে বলা যায়— উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো নিয়ে কথা বলার বিপদ অনেক, কারণ এরা চিন্তা করতে জানে না, করতে চায় না। যারা চিন্তা করে, তাদেরকে তারা অকার্যকর করে রাখে; “ইতিহাসকে অনেকদূর দেখার কল্পনা শক্তি তাদের নেই।” আহমদ ছফাও বাঙালি জাতির এই সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করেছেন।

আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-ঔপনিবেশিকতা ভবিষ্যতের জন্য পথ খুলতে পারে না; বর্তমান অতীতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে এবং লেপ্টে থাকে। এই সঙ্কট থেকে উদ্ধার হতে হবে। উত্তর-ঔপনিবেশিক কাল বা তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের সঙ্কট নয়— এটি সমগ্র পৃথিবী, সমগ্র জগতের সঙ্কট।

মাঁরী জাঁ কনডরসেট[3] ছিলেন আলোকিতকরণের একজন ফরাসি দার্শনিক এবং শিক্ষাগত সংস্কার ও নারী অধিকারের প্রবক্তা। তিনি বলেছেন—

শিল্পকলা এবং বিজ্ঞান বিভিন্ন শাখা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের নিয়ন্ত্রণকেই উন্নত করবে না, সেই সঙ্গে জগৎ বোঝার ও আত্ম-উন্নয়নের জন্যও সহায়ক হবে, সহায়ক হবে নৈতিক অগ্রগতিতে, প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায়ের বিকাশে এবং এমনকি মানুষের সুখ ও সমৃদ্ধিতেও।

বিংশ শতাব্দী এই আশাবাদ চুরমার করে দিয়েছে। এখন বিজ্ঞান, নৈতিকতা এবং শিল্পকলার পৃথকীকরণ বলতে বোঝায় বিশেষজ্ঞ-চর্চার অধীন পৃথকীকৃত অংশগুলোর স্বশাসন এবং সেইসঙ্গে প্রাত্যহিক ভাব আদানপ্রদানের বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ তত্ত্ব থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া।

এই বিচ্ছিন্ন হওয়াটাই সেই সমস্যা, যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে বিশেষজ্ঞ নৈপূণ্যের সংস্কৃতিকে ‘অস্বীকার’ করার প্রচেষ্টা। সমস্যাটা সহজে দূর হবে না। জ্ঞানদীপ্তির অভিপ্রায়গুলি দূর হয়ে গেলেও, আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করব, না আধুনিকতার পুরো প্রকল্পকেই একটি ব্যর্থ প্রয়াস বলে ঘোষণা করে দেব? উত্তর-ঔপনিবেশিক মানুষকে তার জায়গা খুঁজে নিতে হবে, বুঝে নিতে হবে। আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক সময়ে বাস করা মানুষের সমস্যা থেকে পৃথক উত্তর-ঔপনিবেশিক কালে বা সময়ে বসবাস করা মানুষের সমস্যাকে সনাক্ত করতে হবে। তবেই জুলাই বিপ্লব বা শিশু-কিশোর-তরুণদের রক্তদান কার্যকর হয়ে উঠতে পারে।

 

উৎস-সূত্র:

  • রায়, তীর্থংকর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতের অর্থনেতিক ইতিহাস। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর, ২০১৩।
  • আহমদ, একবাল। পাঠ ও বিবেচনা। ভূমিকা ও সম্পাদনা: শরীফ আতিক-উজ-জামান। ঢাকা: সংবেদ। ২০০৯।
  • নাগরিক সমাজ। অনুবাদ: খালেদুর রহমান সাগর। ঢাকা: এডুসেন্ট্রিক। ২০২৪।
  • লুকাচ, গেঅর্গ। একটি অন্তর্লীন বিশ্বদর্শন। সম্পাদনা: রবীন ঘোষ। কলকাতা: বিজ্ঞাপনপর্ব। ২০১৩।
  • প্রসঙ্গ পশ্চিমী মার্কসবাদ, গ্রামশি থেকে হাবেরমান বক্তৃতামালা। শোভন লাল দাশগুপ্ত। বাখারহাট, দক্ষিণ ২৪ পরগনা: সেরিবানের পক্ষে ইলা মিত্র। দ্বিতীয় পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ। অক্টোবর, ২০২২।

[1] ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল, চিরঞ্জীব শূর সঙ্কলিত। প্রকাশক: আলোচনা চক্র। প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৩, কলকাতা, ভারত।
[2] ইউরোপীয় আধুনিকতার উৎস প্রসঙ্গে: রোমান ও পেগান অতীত থেকে খ্রিস্টীয় রাষ্ট্রীয় অনুষঙ্গ— মূল গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত বিশ্লেষণ।
[3] জন্ম ১৭ সেপ্টেম্বর ১৭৪৩, রিবেমন্ট, ফ্রান্স—মৃত্যু ২৯ মার্চ ১৭৯৪, বুর্গ-লা-রেইন।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5187 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...