উপন্যাসের ভাষা

উপন্যাসের ভাষা -- অমিয়ভূষণ মজুমদার

অমিয়ভূষণ মজুমদার

 

বিষয়, উপন্যাসের গদ্য। তা আর একটু বিশেষ হয়ে এখন দাঁড়িয়েছে, দেশ-বিভাগের পরবর্তী আধুনিক উপন্যাসের গদ্যরীতি।

এ অবস্থায় আমার মনে হচ্ছে, আমার পক্ষে মিথ্যার ভান করা উচিত নয়। যেহেতু জীবন স্বল্প ও আর্ট সময়সাপেক্ষ, প্রকৃতপক্ষে আমরা যাকে উপন্যাস বলে থাকি, তার যে অধিকাংশই আমার পড়া হয়নি, এটা স্বীকার করে নেওয়া ভালো। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পর যা পড়েছি (অথবা পড়তে পেরেছি) তা যদি বলি, আমি বাঙালি কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ দেখা দেবে। উদাহরণেই আপনারা অনুশীলিত দল থেকে বাদ দিতে পারবেন। অনুরূপা দেবীর একখানি উপন্যাস ছাড়া অন্য কোনও মহিলা লেখকের (এ দেশের) লেখা আমি পড়তে পারিনি…।

সুতরাং চিঠিটা এখানেই শেষ করা ভালো ছিল। কিন্তু একটা অসুবিধা থেকে যাচ্ছে। মানিক বন্দ্যো-র পুতুলনাচের ইতিকথা, তারাশঙ্করের কালিন্দী, সতীনাথের ঢোঁড়াই চরিতমানস (আংশিক) পড়া থাকায় উপন্যাস এবং তার ভাষা সম্বন্ধে কিছু বলতে ইচ্ছা থেকে যায়।

এখন এই এক যুক্তি আছে; বিপ্লব ভালো, কেননা তা বিপ্লব এবং বিপ্লব হয় বিপ্লব। তা সত্ত্বেও, আমাদের দেশেও, সন্দেহ করি, উপন্যাস সম্বন্ধে এমনকি, এযুগেও এমন উদার মহৎ দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো নেয়া যায় না যে বিমল কর, গজেন্দ্র মিত্র এবং মনোজ বসুকে একই সঙ্গে ঔপন্যাসিক বলা যাবে; অথবা কী বলি, ঈশ্বর, ইহারা কী লিখিতেছে, ইহারা জানে না। কিংবা বয়স মনে না রেখে বলি: রাজা মহাশয় প্রকৃতপক্ষে উলঙ্গই এবং দরজিরাও পালায়নি।

প্রকৃতপক্ষে উপন্যাস পোর্টম্যান্টো নয় যে তার মধ্যে একই সঙ্গে মায়ের চিঠি, ফুটো মোজা ও ইশতেহার পুরে আধুনিকতার গাড়িতে চড়া যাবে। উপন্যাস আমাদের কৌতূহল নিবারণ করে না এবং আমাদের অ্যাডোলেসেন্ট যৌনপ্রবৃত্তির পরিতৃপ্তির উপায়ও নয়। ভেরিআর এলউইনে নেফা সম্বন্ধে জানা ভালো। নাগাদের সম্বন্ধে উপন্যাস লিখতে নাগা হতে হয়। এবং তখন তা নাগাদের সম্বন্ধে উপন্যাস হবে না, উপন্যাসই হবে। হোটেলের ওয়েট্রেস ও রিসেপশনিস্টদের জীবনে যে কেচ্ছা (প্রেম বলে নাকি?), তা জানার জন্য যা পড়ব, তাকে উপন্যাস বলে না। এবং হ্যাভলক এলিস পড়লে জানা যাবে, যৌনপ্রবৃত্তি মানুষকে নানা অবস্থায় নিতে পারে। তার জন্য বাংলাদেশে কোনও ঘোষ বা বোসের চেষ্টা করা বৃথা, কেননা আমরা হ্যাভলক এলিসের মতো পরিশ্রম করতে পারব না।

এলউইন ও হ্যাভলক এলিসের ভাষা সম্বন্ধে কেউ প্রশ্ন করে না। কোন ভাষায় কেমিস্ট্রি বই লেখা হল তা যেমন ভাবি না, রাজনৈতিকরা কী ভাষায় বকছেন, কী তার স্টাইল, এ নিয়েও তেমন আমরা মাথা ঘামাই না। কিন্তু একজন চার্চিল যখন পার্লামেন্টে ডানকার্কের ব্যাপারে সাহিত্যিক হন অথবা একজন জওহরলাল যখন রাজনীতির ব্যাপারে কবির ভাষা ব্যবহার করেন, তখন বুঝতে পারি, গোপন করার কিছু আছে। এটা খুব সহজ সত্য যে, তত্ত্ব যখন আমাদের বিষয়, তখন ভাষাকে বর্ণনানিষ্ঠ হতে হবে, বাড়িয়ে বলবে না, এদিক-ওদিক চাইবে না, কাঠ-কাঠ হবে, নিরুত্তাপ হবে, ইটের উপরে ইট সাজানোর মতো নীরস হবে।

উপন্যাস তত্ত্ব নয়। এবং সেইজন্যই বোধহয় উপন্যাসের ভাষাও বাক্যের পর বাক্য বসানো নয়। উপন্যাস গল্প নয় যে, গল্পটা পাঠকের মাথায় ঢুকছে কিনা তা জানলেই ভাষা সম্বন্ধে সব জানা হল। উপন্যাস ইনসেস্ট ইত্যাদির বর্ণনা নয় যে সাংবাদিক মাত্রেই ঔপন্যাসিক হয়ে যাবেন। ওদিকে আবার উপন্যাস ভাষাচর্চাও নয় যে, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন বলেই শেষের কবিতা উপন্যাস হয়ে উঠবে। অন্যদিকে উপন্যাস বড় করে বলা গল্প নয় যে, কেউ এ বিষয়েও চালাকি করে বলবে উপন্যাস বড়ও বটে, গল্পও বটে।  উপন্যাসে, একজন বিলেতি রসিকের কথা মনে এনে বলা যায়, গল্প থাকায় আমরা দুঃখিত এবং গল্প যে রাখা হয়, তা গল্প বলার উদ্দেশ্যে নয়, কোনটা আগে, কোনটা পরে ঘটছে তা ধরিয়ে দিতে।

উপন্যাস প্রকৃতপক্ষে একটা থিম যা আমাদের চোখের নীচে ফুটে ওঠে, একটা থিম যা হয়ে ওঠে। অর্থাৎ থিম নামে এক জীবন্ত বিষয়ের ভাব। পোস্ট-পার্টিশন বাংলাদেশে আমরা যা করেছি, তা যখন কৌতূহল বা যৌনপ্রবৃত্তি ইত্যাদির তৃপ্তিবিধান নয়, এবং যখন একটা থিমকে ধরতে পেরেছে, তা একটা থিমের বর্ণনা, থিমের অংশগুলির ঘটনা দ্বারা ব্যাখ্যা, এবং থিমকে বিস্মৃত হয়ে এলোপাথাড়ি বকে যাওয়া। (যাঁরা গল্প বলেই উপন্যাস লিখলুম ভেবেছেন, তাঁদের কথা বিচারে আনা হচ্ছে না। এবং তাঁদের কথাও ভাবছি না, যাঁরা মার্কস-লেনিনকে মনে রেখে লিখতে বসেন উপন্যাস।)

থিমকে হতে দেওয়া আর থিমকে বর্ণনা করা এক বিষয় নয়। এবং এটা হয় গদ্যের অযোগ্যতায়। আমরা সবাই জানি, শব্দগুলি, শব্দমাত্রই, বাক্যে বসে যখন পদ হয় তখনই মাত্র জীবন পায়। তেমনি বলা যায় বাক্যগুলি বাক্যমাত্রই, যখন তারা পরস্পরকে আকর্ষণ করছে তখনই তারা এক মুহূর্তের বেশি জীবন্ত থাকে। এবং বাক্যগুলি যখন একের পর এক জন্মেই মরতে থাকে, তখন সন্দেহ হয় শব্দগুলিই মরা ব্যাঙ। আপনাদের হয়েছে কিনা জানি না, বাক্যে বাক্যে হোঁচট খেতে খেতে ইদানীং অনেক উপন্যাসকে প্রথম পরিচ্ছেদের পরেই ছেড়ে দিতে হয়েছে। অর্থাৎ অনুভব করছি আমাদের উপন্যাসে আমরা যে ভাষা ব্যবহার করে থাকি তা অন্তর্মুখী না হয়ে সংবাদপত্র এবং আরজির ভাষা হয়ে যাচ্ছে। আমার এমন বলা উদ্দেশ্য নয় যে, আমাদের নামকরা ঔপন্যাসিকরা সবাই সংবাদপত্রে যুক্ত। ভাবখানা এই, যেন আমরা যে ভাষায় কথা বলি তাই গদ্য! আমার ঠিক মনে পড়ছে না গদ্য নিয়ে এই মর্মান্তিক ঠাট্টা কে করেছিলেন। মর্মান্তিক এই জন্য যে, অনেকেই মনে করে নিয়েছি কলকাতার রকবাজদের ভাষা বসিয়ে গেলেই তা বাংলা গদ্য হয় কিংবা প্রত্যহ খবরের কাগজ পড়লে এবং/অথবা সম্পাদকী/কলম ইত্যাদি লিখলেই বাংলা গদ্যে পারদর্শিতা জন্মে।

ভাষার অযোগ্যতা জটিল হয়েছে অন্য একটি সূত্রেও। উনবিংশ শতকের সমালোচকরা আবিষ্কার করেন, শেক্সপীয়র চরিত্রস্রষ্টা হিসেবেই সর্বাধিক প্রশংসাযোগ্য। এবং যে যেরকম শ্রেণির চরিত্র, তার মুখের ভাষাও তেমন দেখো অবিকল। উনবিংশ শতকের উপন্যাসে চরিত্রগুলোর মুখের ভাষাকে শ্রেণিভিত্তিক, স্থানভিত্তিক ইত্যাদি করার চেষ্টা দেখা দেয়। এবং আমরাও ইদানীং, যেমন হাঁসুলি বাঁকের উপকথায় এবং অন্যত্র গ্রাম্য ভাষাকে এনেছি, এবং আরও অধুনা কলকেতার রক থেকে প্রচুর গালাগালি ও স্ল্যাং আমদানি করা হচ্ছে। যেন অন্যভাবে যা কাঠের পুতুল, তার মধ্যে সাঁওতালি ভাষার টানটোন অথবা রকবাজদের ভাষার রেকর্ড বসিয়ে দিলে তারা হেঁটে বেড়াবে, প্রেম করবে, গান গাইবে, উপন্যাসে বলার মতো মানুষ হবে।

আসলে উপন্যাস আর নাটক এক নয়, এটা মনে রাখতে পারলে (এবং এখানে লেখকের আত্মগোপন আবশ্যিক নয়) এ ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা নেই। জানতে হবে, কি উপন্যাসে, কি নাটকে, চরিত্রগুলোর মুখের ভাষা হুবহু এই পৃথিবীর হওয়া চাই। এ বিষয়ে বেশি বিশ্বাস থাকলে ঠকতে হয়। উদাহরণ মানিক বন্দ্যো-র পদ্মানদীর মাঝি। মনে রাখতে হবে, গভীরভাবে ভাবা কিংবা অনুভব করা ডিমোক্র‍্যাটিক রাইটের মধ্যে পড়ে না, গরিব (এমনকী, তর্কস্থলে শোষিত) হলেই উপন্যাসে আসবার প্রবেশপত্র পায় না। এই গভীর করে ভাবা কাজটা ঔপন্যাসিকের এবং তার ভাবনাগুলো তরঙ্গে তরঙ্গে থিমটাকে জীবন্ত করে। সে কাজে ডায়ালগেও যে গদ্য সে ব্যবহার করবে, তা বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য (যার অন্য নাম অসামঞ্জস্য এড়ানো), তা কতকটা যেন মাঝিদের ভাষার মতোই হবে — কিন্তু আসলে তা হওয়া উচিত ছিল মানিক বন্দ্যো-র গদ্য, যে ভাষায় দু-কোটি মাঝির একজনও কথা বলে না। পুতুলনাচের ইতিকথার ডায়ালগের ভাষা অবশ্যই বীরবলী ভাষার তুলনায় গ্রাম্য, এমনকি, রবীন্দ্রনাথের সেই শেষের কবিতার চাইতে তো বটেই। অথচ সে ভাষা মানিক বন্দ্যো-রই গদ্য। সেজন্যই ইতিকথাটা উপন্যাস হয়ে উঠেছে। পদ্মানদীর মাঝিকে মাত্র রাজনৈতিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্যই উপন্যাস বলা যায়। তেমনি যাঁরা বারবার স্ল্যাং প্রয়োগ করে ভাবছেন তাঁরা কলকেতার আধুনিক কোনও সমাজের ছবি আঁকছেন, তাঁরা আদৌ তা আঁকছেন না। কারণ খুব কঠিন স্ল্যাং প্রয়োগ করলেই সে যে খুব ফ্রাস্ট্রেটেড এবং/অথবা গভীরভাবে জীবনের কোনও দিককেই এক মুহূর্তও ধরতে পেরেছে, তা প্রমাণ হয় না। বরং গভীরভাবে ভাবিত নয় এমন কোনও চরিত্রের সাহায্যে উপন্যাসের থিমকে ফোটানো যায় যদি, তবে আমি তেমন নজির দেখিনি। আমাদের উপন্যাসে এমনটা প্রায়ই ঘটছে, এই সমস্ত বীরভূমি, ঢাকাই ও কলকেতার টানটোনের বাড়াবাড়ি দেখে মনে হয়, আমরা ভুলে গেছি উপন্যাসের বনে যে পাতাটাতা থাকে সোনার তৈরি, ছাগলে খেলে উপকার হবে এমন ক্লোরোফিলযুক্ত কিছু নয়, এমনকি, সবুজ মীনা করা হলেও। এ বিষয়ে আপনাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে ওয়েসেকসের চাষি ইত্যাদির ভাষা একেবারেই টমাস হার্ডির স্বকপোলকল্পিত।

আসল কথা, উপন্যাস একটা কলা-পরিণতি। তার গদ্যকে তার থেকে আলাদা করা প্রকৃতপক্ষে যায় না। কোনও স্ত্রীলোকের চামড়া আলাদা করা তখনই যায়, যখন সে মৃত। অন্যদিকে এই আদিম শাড়িকে ইচ্ছামতো পালটানোও যায় না। এইখানেই দারুণ মার যে, এই শাড়ি বাইরে পাওয়া যায় না, ঠিকঠাক বয়স-মতো মানানসই করে কেউ যেন নিজের মধ্যেই নিজেই বানায়, আর পরে। উপন্যাসের গল্পও কি থিম থেকে উঠে এসে ঠিক থিমের মাপ-মতো হয়? আমার তো ধারণা, ওটা থিমের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য, স্ত্রীলোকের আদিম শাড়ির মতোই। আমরা উপন্যাসের গদ্য নিয়ে যখন চালাকি করতে যাই, তখন বুঝতে হবে আসলে থিমটাও একটা চালাকি মাত্র। অবশ্য এমন কল্পনা করা যায় যে, কারও মাথায় থিম এসেছে, গদ্য আসছে না। আসলে এটা কল্পনাই। কেউ যেমন চামড়া ছাড়া স্ত্রীলোককে চলতে দেখেনি, তেমনি গদ্য ছাড়া থিমও কারও মাথায় আসে না। অবশ্য চামড়ায় যেমন উলকি কাটা যায়, থাবা-থাবা পাউডার বসানো যায়, তেমন উপন্যাসে গদ্যকেও যাচ্ছেতাই করা যেতে পারে, যদি থিমটাকে আমরা সস্তা দামের কিছু বুঝতে পারি।

আমি উপন্যাসগুলোর নাম করিনি কারণ, কেউ ভাববেন যে, আমি তাঁর উপন্যাসকে লক্ষ করে কটু কথা বলেছি। সে সুযোগ আমি দিতে চাইনে। রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দ্যো, তারাশঙ্করের কথা বলেছি এই ভরসায় যে আমি তাঁদের বাজার নষ্ট করতে পারব না, এটা সকলেই বিশ্বাস করবেন।

উপন্যাসের ভাষা সম্বন্ধে আমার নিজের বক্তব্য, কিংবা ভাষা নিয়ে, অন্য কথায়, আমি কী অসুবিধা ভোগ করে চলেছি, তা আগে বলেছি। আমার ধারণা উপন্যাসকে তার ভাষা থেকে পৃথক করা যায় না। যেমন কোনও এক ব্র‍্যান্ডের চা থেকে তার আস্বাদকে। আমি ভাবতেই পারি না আমার প্রিয়তমার শরীর থেকে চামড়া খুলে নিলেও সে আমার প্রিয়তমাই থাকবে, যদিও সেই চামড়া, এমনকি, তার শরীর, আমার প্রিয়তমা নয়। প্রিয়তমা এসব তো বটেই, উপরন্তু কখনও বোকা বোকা কথা বলে, কখনও ধমকায় আমার বোকামিতে, কখনও আমার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে শেষ কথা উচ্চারণ করার অসীম দুঃসাহস ও ভবিষ্যৎ-দৃষ্টি প্রকাশ করে — ইত্যাদি ইত্যাদি — এক কথায় নড়ে কথা বলে।

কিন্তু এই চামড়া (গ্রাফটিং করে মেরামত করা যায় প্রয়োজনে, শুনেছি) বাইরে থেকে লাগানো যায় না। ভাষাটা (শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, হার্টের পেশী, গ্ল্যান্ড ইত্যাদির সঙ্গে চামড়া যেমন) উপন্যাসের সঙ্গে জন্মায়। কিংবা উপন্যাস ভাষা নিয়ে (গায়ে নিয়ে বলব কি?) জন্মায়। তাকে বদলানো যায় না। সুতরাং, কথাটা খুব কড়া হয়ে যাচ্ছে (কিন্তু ঘটনা গোপন করার বয়স পার হয়ে এসেছি), অনেক ঘোষ-বোস-গাঙ্গুলি-মুখোটির উপন্যাস পড়তে শুরু করে এই ভাষাকে মাটির মতো থাবড়ে-থুবড়ে, মরা চামড়ার মতো সেলাই করে বসাতে দেখে বইটাকে মুড়ে ফেলা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

অর্থাৎ অন্য কথায়, উপন্যাসের ভাষাতে তার প্রতিটা শব্দকে ম জুসৎ (Mot Juste) হতে তো হবেই, আর একটু এগিয়ে গিয়ে বলতে চাই ইনেভিটেবল। তার সিচ্যুয়েশনকে যেমন ইনেভিটেবল হতে হবে, ভাষাকেও তাই। এখানে একটা তুলনা দেয়া যায়: যামিনী রায় মশায়ের তুলির টান আর নন্দলাল বোসের তুলির টান — দুই কি এক? অথচ দুটোই, দুজনের ছবির বেলায় মনে হতে থাকে ইনেভিটেবল। অন্য কিছু দিয়ে, (ওখানে রেমব্রাঁ কিংবা সেজান কারও টানই চলবে না) ওই ছবিকে ফোটানো যেত না। আপনি নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বহুনিন্দিত (কারণ রাজনীতি) উপন্যাস (যদিও আমি তাকে রোমান্স বলি) আনন্দমঠে এই ভাষা ব্যবহারের বেলায় কী দক্ষতা দেখিয়েছেন। আগাগোড়া ভাষা এসেছে কবিপ্রসিদ্ধি থেকে। বাস্তবে আমরা যা প্রত্যক্ষ করি আর কবিপ্রসিদ্ধিতে যা থাকে, তা নিশ্চয় পৃথক। যদি বঙ্কিমচন্দ্র এই রোমান্সের জন্য কবিপ্রসিদ্ধিতে যা পাওয়া যায় বা যেতে পারে, তার বাইরে অর্থাৎ বাস্তব থেকে, ভাষা সংগ্রহ করতেন তাহলে বইটা একটা চমৎকার ব্যর্থতা হয়ে থাকতে পারত। যেমন বিষবৃক্ষ। পদ্মপলাশলোচনে দিয়ে শুরু করে হীরা দেবেন্দ্রর পর্যায়ে এসে আমার গা গুলিয়ে ওঠে।

অন্য দিক দিয়ে দেখা যাক, পাথর, প্রস্তর, নুড়ি — এ সবই সমার্থক, কিন্তু ব্যবহার? ব্যবহার করতে গিয়ে দেখা যাবে, প্রত্যেকটা যেন আলাদা ব্যাপার, আলাদা ব্যবহার। দুঃখে প্রস্তর হয় না, পাথর হয়ে যায়, নুড়ি ছোঁড়া যায়, কিন্তু নুড়িতে ক্ষুর ঘষে না নাপিত। আমাদের মনে হয়েছে, আমাদের আধুনিক উপন্যাসে আধুনিক ভাষা লিখতে গিয়ে আমরা সব কিছুকে নুড়িবৎ করে চলেছি। মৃন্ময়ী আর মেটে এক নয়। এটুকু বুঝতেও যেন আমাদের অসুবিধা হয়। একই উপন্যাসে মৃন্ময়ী আর মেটে দুই-ই দরকার হতে পারে অবস্থাভেদে। এই অবস্থাভেদ আমরা বুঝতে চাই নে। মনে করা যাক, ‘অহহ’ শব্দটাকে। অতি প্রাচীন সংস্কৃত শব্দ। এমনকি, ব্যাকরণের বাইরে সংস্কৃতেও ওটার প্রয়োগ আমি খুব কমই দেখেছি, কিন্তু হঠাৎ একদিন কলমে এসে গেল — রামচন্দ্রের কান্নাপ্রকাশের জন্য ওই শব্দটা ছাড়া আর কোনও শব্দই যথার্থ মনে হল না। তখন সেই মুহূর্তে আমি নিশ্চয়ই আমি, কিন্তু রামচন্দ্রও বটে। সুতরাং একের কান্নার শব্দ অন্যের কলমে এসে গেল। রামচন্দ্র তার গোঁফ মুচড়ে আকাশের দিকে চেয়েছে, সে তো হাহাকার করার অবস্থা, কিন্তু আমার (অর্থাৎ যার কলম) মনে হচ্ছে তা, অর্থাৎ হাহাকার, কান্না, ইত্যাদি শব্দ কী হাস্যকর কিংবা ভাবাবেগ ক্লিন্ন হবে, তখন রামচন্দ্রের মুখে ওই ক্লাসিক হাহাকারের অহহ শব্দটা শুনতে পেলুম। একে আমি ইনেভিটেবল মনে করি।

অন্যদিকে দেখুন, ভাষা সম্বন্ধে স্টাইলিস্ট এই অ্যাখ্যা পাওয়া এবং ঔপন্যাসিক হওয়া এক নয়। পেটার, রাসকিন, কার্লাইল, ল্যাম, স্ট্র‍্যাচি (ঐতিহাসিকভাবে সাজানো নয়) এঁরা কেউ ঔপন্যাসিক নন। পক্ষান্তরে ডিকেন্স, জর্জ এলিয়ট, হার্ডি ইত্যাদির ভাষাকে স্টাইলিস্ট প্রোজ বলা যায় না। এ জন্যই, পেটার বলুন, ল্যাম কিংবা স্ট্র‍্যাচি — সবই একজনের কথা, কিন্তু উপন্যাসে যত চরিত্র তাদের সম্বন্ধে যত লাইন ততটাই বিভিন্ন বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব ঔপন্যাসিকের। এটা বুঝতে না পেরেই কি আমরা কম ভুল করি?

আমরা দূরের কথা, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ? আমি কিছুতেই ভাবতে পারি না, রবীন্দ্রনাথ এসথেটিকসের তাগিদেই শেষের কবিতা প্রকাশ করতে রাজি হয়েছিলেন। অবশ্য এমন সেন্টিমেন্টাল বাঙালি আছে যারা বইটার দুঃসহ প্রেম-সেন্টিমেন্টকে (শেক্সপীয়র যাকে টুয়েলফথ নাইটে ফ্যান্সি বলেছেন) প্রেম বলে মনে করেছে। একজন ধনী ব্যারিস্টার এক গরীব বা মধ্যবিত্ত গৃহশিক্ষিকাকে বিপথে নিতে ফ্যান্সি ব্যবহার করছে — তা বেশ ঝকঝকে, প্রায়-বীরবলী গদ্যে লেখা হল। কিন্তু যখন আমরা তাকে উপন্যাস বললুম, রবীন্দ্রনাথ নিজে কেন সকলের আগে প্রতিবাদ করলেন না? আমার মনে হয়, এই একবার বাংলা গদ্যের স্টাইলের ভূত তাঁকে বেমওকায় পেয়েছিল। আমার ভাষাও কি নিবারণ চক্রবর্তীর মতো হচ্ছে? তা হলেও দোষ নেই, কারণ এটা উপন্যাস লিখছি না। বলতে চাইছি, এটা উপন্যাসের বদ দোষ যে তার ভাষাকে চামড়ার মতো শরীরের অংশ হতে হবে। আমার ঘোড়ার বালামচি আমার গর্বের বিষয় হতে পারে। আমার ময়ূর (হায় ঘোড়া এখন স্বপ্ন, ময়ূর মৃত ইলেক্ট্রিক তারে বসতে গিয়ে) আমার চটির শুঁড়োর সঙ্গে যুদ্ধ করতে সুদৃশ্য পেখম মেলত, কিন্তু হঠাৎ যদি আমার ছেলে বালামচিগ্রস্ত হয় কিংবা আমার মেয়ের সারা গায়ে ময়ূরকণ্ঠী পাখা দেখা দেয়?

আমার মনে পড়ছে সমতটের কোনও এক সংখ্যায় এই শেষের কবিতা নিয়ে নীতিভ্রষ্ট কথাবার্তা পড়ে কে একজন খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এবং উপন্যাসকে ডিফাইন করতে বলেছিলেন নীতিহীন লেখককে।

এখানে তা করা ভালো। ‘উপন্যাস সেই মহাকাব্য যা গদ্যে লেখা হয়।’ আমি ভাবছি এ বিষয়ে কখনও পৃথক প্রবন্ধ লেখা যাবে। তাতে যদি উপন্যাসের সংখ্যা কমে যায় তাতে লোকসান বইওয়ালাদের, পাঠকদের নয়। কারণ, পাঠক শুনে বলবেন, কী আশ্চর্য, আমি অন্য অনেক বইয়ের মধ্যে দু-চারখানা উপন্যাসও তো পড়ে ফেলেছি দেখছি।

এখন উপন্যাস একরকম মহাকাব্য হওয়াতে তাকে বিচার করার জন্য তার মাপ ওজন ইত্যাদি না দেখে আমাদের একটা রীতি থাকতে হবে। এ বিষয়ে অন্য কারও কাছে না গিয়ে সেই বুড়ো অ্যারিস্টটলের কাছে যেতে চাই। বলতে চাইছি, উপন্যাস বিচার করতে কী কী দেখতে হবে, তা এরকমভাবে সাজানো যেতে পারে — ১) আর্গুমেন্ট, ২) প্রপার নেম, ৩) মিথ ইত্যাদি। এ বিষয়ে এখন বিশদ করে বলতে গেলে সেই প্রবন্ধই লেখা হবে, যা পরে লিখব বলেছি। এখন শুধু দেখুন, শুধু আর্গুমেন্ট নিয়ে অগ্রসর হলে আমাদের পৃথিবীতে কতগুলো উপন্যাস বেছে নিতে পারি। মবি ডিক, ব্রাদার্স কারামাজভ, ওয়র অ্য্যান্ড পীস, রেজারেকশন, ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, দি পসেসড, ম্যাজিক মাউন্টেন, চার্টারহাউস আর পারমা ইত্যাদি। একথা বলে নিয়ে বলাতে চাইছি, আর আর্গুমেন্ট নেই, আর্গুমেন্টে যা ধরা দেয় না, তা দুশো পৃষ্ঠা হোক আর দু হাজার, তা পড়ুন, কিন্তু তা উপন্যাস হয়নি। এবং এই নিরিখে শেষের কবিতা যতই সুখপাঠ্য হোক, আদৌ উপন্যাস নয়।

১৪।৯।১৯৭৫

বাংলা গদ্যজিজ্ঞাসা বৈশাখ ১৩৮৮

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...