ভুলভুলাইয়া

শুভ্রদীপ চৌধুরী

 

 

আনন্দীকে গাঁয়ের সব্বাই ডাকে ছুঁড়ি বলে। কেউ তার নাম ধরে ডাকে না। এ নিয়ে আনন্দীর মনে বেশ দুঃখ। পচা মানে তার ভাই আনন্দ জন্মাবার আগে সব্বাই তার মা সরলাকে আনন্দীর মা বলে ডাকত। এখন ডাকে পচার মা বলে। গাঁ গঞ্জে ভালো নামের কদর নেই। যেমন, মদনমোহনকে মদনা, টিয়াকে টেপি, হলধরকে হুলা, সুখচাঁদকে শুটকু, আনন্দকে পচা।

সেই নামহারানো ছুঁড়িকে আজ সত্যিকারের নাম ধরে ডেকেছে একজন। একটা ডাকে এত আনন্দ লুকিয়ে থাকে আনন্দী জানত না। আজ সকালে সেই আনন্দের ঘটনাটা ঘটেছে। অন্যদিনের মতো সে মাঠে বাপকে জলপান খাইয়ে ফিরছিল। কানাউঁচু কড়ির থালাটা বেশ করে মণ্ডলদের পুকুরে মেজে, গামছাটা জলকাচা করে বুকে জড়িয়ে ফেরার পথে সে শুনল রাখুর শিস্ তাকে ডাকছে, আনন্দী, এই আনন্দী…। উচ্চারণে নয়, শিস্ দিয়ে। যাইহোক সে বুঝেছিল। নিজের নাম যতই অন্যরকম হোক বোঝা যায়।

রাখু লজ্জামুখে তার চোখে চোখ রেখে বলল, এই আনন্দী মেলায় যাবি? বটুনের মেলা, দুপুরবেলা যাব আর সন্ধের আগে ফিরে আসপ।

–আর কে যাবে?

–তুই আর মুই।

এইটুকু কথার মধ্যে কত কী লুকিয়ে থাকে। সব্বাই বুঝবে না। আনন্দীর বুকের ভেতরে ঝড় উঠল। তার বাপ মাঠ থেকে ফিরবে সন্ধেবেলা, মা চার বাড়ি বাসন মেজে গঞ্জ থেকে ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধে! মেলায় যাওয়াই যায়। সেই কথাটা আবার শোনার ইচ্ছে হল তার। আর কেউ যাবে না হামাঘড়ের সাথে?

রাখু উত্তর দিল, নারে, কলাম না, শুধু তুই আর মুই! আর কেউ না।

এবার আনন্দীর বুকের ভেতরে মাদল বাজাতে লাগল। যেন তাদের বাড়ির পেছনের মরা ইছামতী নদীটাতে বান এসেছে। সেই উথালপাথাল ঢেউয়ের মাঝে ভাসতে ভাসতে সে বলল, কেউ যদি কিছু রটায়?

–রটালে রটাবে। রাখু ওসব পাত্তা দেয় না।

–বাপ জানলে….!

–জানা পালে তো!

ভরদুপুরে সত্যি সত্যি ওরা দুজনে মেলায় গেল। রাখুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আনন্দীর মনে হল, সে ভাসছে। তালকানার মতো ভেসে যাচ্ছে। বাজ পড়ে মরা তালগাছটা মনে হচ্ছে সুন্দর। চিপড়ি দেওয়া খোবলানো দেয়ালগুলো যেন আলপনায় ভরে গেছে!

মেলাটা আরও সুন্দর। কত দোকান, নাগরদোলা, চিত্রহার, মিনি সার্কাস, পুতুলনাচ, মিষ্টির দোকান, মওত কা কুয়া।

রাখু আনন্দীর ঝলমলে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, চিত্রহার দেখপি? দশ টাকায় চারটা গান।

আনন্দীর লাল মুখ, মাথা নিচু।

–চিত্রহার দেখপি না নাগরদোলায় উঠপি?

–পয়সা নাই যে!

–ধ্যাত, সেটা কোনও ব্যাপার হল! দু’দিনের দিন হাজিরার দুশো চল্লিশ টাকা আছে মোর পকেটেত। যা মন চাবে তা কিনবি, মোর টাকা মানে তোর টাকা।

আনন্দী অনেক কিছু বুঝল। মেলার সমস্ত রং তার দু চোখের ভেতরে এসে হামলে পড়ল। চিত্রহারের গিজগিজ ভিড়ের মধ্যে তারা পৌঁছুতেই নাচ শুরু হল স্টেজে। একটা ছেলে একটা মেয়ে নাচছে। মনে হচ্ছে এদের গায়ে হাড়হুড্ডি নাই। কত আলো তাদের গায়ে পড়ছে। আহা, সে যদি এমনটা নাচ জানত!

চারটে গান শেষ হলে রাখু বলল, আরেকবার দেখপি?

–এক জিনিস বারবার দেখার কী আছে?

–নতুন নতুন গান হয়।

সদ্য শেষ হওয়া একটা গানের কলি আনন্দীর কানের কাছে ফিসফিস করল রাখু।

আনন্দীর খুব আনন্দ হল তবু মুখে বলল, থাক এসব কথা।

রাখু থামল না, তুই জানিস তোকে লাভ করি। ইউ আর মাই লাভ। লাভ বুঝিস ছুঁড়ি!

ছুঁড়ি না বললেই পারত। বলতে পারত আনন্দী তোকে লাভ করি রে মুই।

দ্বিতীয়বার চিত্রহার শেষ, অনেক রংচঙ আকাশে রেখে ডুবে গেছে সূর্য। চারদিকে মাউরা আলোর দল। রাখু আনন্দীকে পরিয়ে দিল হরেকমাল সাত টাকার পুঁতির মালা।

–কেউ দেখে ফেললে?

–লুকায়ে রাখপি। যখন কেউ থাকপে না তখন পড়বি।

–আর দেরি করলে বাপ ভিটাজমি থেকে ফিরে আসপে।

–তোর বাপ আজ পটলের ঝাংলা দিচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি হবে না। চিন্তা করিস না।

সন্ধে দখল নিল চারদিক। মেলার হৈ হট্টগোল থেকে শান্ত গাঁয়ের দিকে হাঁটতে লাগল দুজনে।

দুই

সুবাহু অপেক্ষা করছিল। কার জন্য…. সে জানে না। সে শুধু যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে করতে মিশে থাকবার ক্লান্তিকর কাজটি মানিয়ে নিয়েছে। বিশ্বাস করে, অপেক্ষা ছাড়া এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই। ফলস্বরূপ নীরবতা গভীর হয়ে তার কানে ধাক্কা মারে। তবু সে এই পৃথিবী ছাড়তে পারে না। সে বুঝতে পারে না, কী করবে? কোনও ধারণা নেই এই মুহূর্তে কী করছে? এই কারণে নিজেকেই সে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।

একযুগ আগে একটি মানুষকে সে জানাতে পেরেছিল তার পুরনো দিনের কিছু কথা। বলেছিল, একাদশ শতাব্দী’র কথা, ‘রামচরিত’ কাব্য লেখা কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর জন্মস্থান এই বটুন। সন্ধ্যাকর ছিলেন পালযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। আমি ছিলাম তার সহচর। এই স্থান পৃথিবী শ্রেষ্ঠ বরেন্দ্রীমণ্ডল। মনে রাখবে, বরেন্দ্রীর প্রধান অংশ হল পালরাজাদের উদ্ভবস্থল চূড়ামনি ও বৃহদ্বটু।

আকাশ থেকে তখন ভিড় করে বিকেল নেমে আসছিল। চারদিকে মিঠে আলো। লোকটা ফিসফিস করে জানতে চেয়েছিল, বৃহদ্বটু মানেটা কী?

যেমন করে জলাশয়ের গভীর থেকে বুদবুদ উঠে আসে ঠিক তেমন করে তার অনেক প্রশ্নের উত্তর ভেসে আসে। সেভাবে গম্ভীর স্বরে বলেছিল, এই স্থানে বড় বড় ব্রহ্মচারীরা বসবাস করতেন বলেই বলা হয় বৃহদ্বটু। পুণ্ড্রবর্ধন নগরের বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, পণ্ডিতকুল বসবাস করত এখানে। এরা ছিলেন সত্যবাদী, অহিংসানীতিতে বিশ্বাসী, বেদের সব বিভাগে পারদর্শী। কবির শ্লোকে পাই, পলাশ, অশোকবৃক্ষময় তপোবনের পাশে বলভী আর কালী নামের দুটি নদীর কথা।

লোকটা কিছুই শুনছিল না শুধুই হাতের দড়ির গোছার দিকে তাকিয়েছিল।

সুবাহু বিরক্ত হয়ে বলেছিল, নদীর কথা শোনো। বলভী ছিল স্রোতবাহিনী, উল্টোদিকে কালী শীর্ণকায়া। বলভী নদীতে মস্ত পাড় দিয়ে বৃহদ্বটুকে বন্যার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। রামচরিতে লেখা বলভী হল তোমাদের আত্রেয়ী, কালীনদী হল বর্তমানের ইছামতী। এখনও তাদের সম্পর্ক অটুট। আত্রেয়ী ধরে রেখেছে উচ্চপাড়, কালী ধরে রেখেছে তার পুরনো নাম, বুড়ি কালী। দিনে দিনে শীর্ণ হয়েছে এই ইছামতী।

তার কথার মাঝে লোকটা বড় পাকুড় গাছটার দিকে এগিয়ে গেল। হাতের দড়িতে ফাঁস বানিয়ে গাছে উঠতে লাগল।

–মরবে নাকি?

–হুম মরব। তাতে তোমার কী হে?

–আমার কথা যে শেষ হয়নি। যা বলছিলাম, স্কন্দগুপ্তের জন্মস্থান হওয়ার কারণে, এই অঞ্চলের নাম হয় স্কন্দনগর। নগরটির প্রধান দরজা ছিল আত্রেয়ীর পূর্ব পাড়, বর্তমানে যার নাম পতিরাম। শাক্ততন্ত্রে বিশ্বাসীদের কাছে এই অঞ্চল দেবীকোট। রামপালপূর্ব সময়কালে পুণ্ড্রবর্ধনগর বংশীহারী থেকে এই বৃহদ্বটু মানে বটুন অব্দি বিস্তৃত ছিল। বিশাল ভূমিখণ্ড ছিল বিদ্বানদের আবাসস্থল।

–অসহ্য। অযথা বকবক করে আমার মাথা ঘুরিয়ে দিও না।

–এ সামান্য জায়গা নয়, দেবীমাহাত্ম্যর উদ্ভবস্থল হল এই অঞ্চল। কালিকাপুরাণে এই দেবীকোটকে প্রথম শক্তিপীঠ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চণ্ডীমাহাত্ম্যর মতো শক্তিপীঠ কাহিনী এই অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এক প্রামাণ্য দলিল।

রামচরিতে কবি কালী নদীর গুণগান করেছেন, মহান কীর্তিভূমি বলে। প্রাচীন এই জনপদে কালীভাবনা, কালীসাধনা ও কালীতত্ত্বের উদ্ভব হয়েছিল তা নদীর নামের ভেতরেই লুকিয়ে আছে।

–ধ্যুস! বকবক না করে থামো। এসব আমি জেনে করব কী? আমি মরতে এসেছি। আমায় মরতে দিন।

–অসম্ভব আমি তা পারি না। আমার গল্প এখনও শেষ হয়নি। মৃত্যু যদিও আমার কাছে গৌণ, তবু পুরো গল্প না শুনে আমি তোমাকে অন্য জগতে যেতে দিতে পারি না। চাইলে ঝড় কিংবা বৃষ্টিতে তোমার কাজটি ভণ্ডুল করে দিতে পারি। মিথ্যেটা সুন্দর করে বেশ গুছিয়ে বলতে পারল ভেবে নিজেই অবাক হল।

লোকটা একটু মুষড়ে পড়ল। মুখে বলল, তবে গল্পটা বলুন, চটপট শুনে নিই।

সুবাহু শুরু করল, গল্পটা এইরকম, সেই সময় এই মেলায় যখন শুধুই গরু, মহিষের গাড়ি করে মেলা দেখতে আসত চারপাশের গ্রামের মানুষ সেই সময়ের গল্প। সেসব গাড়িতে থাকত বিশেষ করে মহিলাদের জন্য বাহারি টোপর। মেলার কাছে এসে গরুর কাঁধ থেকে গাড়ির জোয়াল মাটি স্পর্শ করলে আনন্দে ভাসতে ভাসতে সেই বিকেলে পুরো পরিবার নেমে মেলায় মিশে যাবার পর গাড়োয়ান উদাস চোখে তাকায় মেলার দিকে। সারা মেলা ঘুরে ক্লান্ত হয়ে তার মনিবেরা ফিরলে সামান্য সময়ের জন্য একছুটে মেলাটা ঘুরে আসবে এইটুকু কথা হয়ে আছে। সদ্য কিশোর দলের মতো তারও চাকু কেনার ইচ্ছে। কারণ আম, কাঁচামিঠে গাছের আম চকচক করা কেটে খাবার মজাই আলাদা। বাড়ির জন্য একটা কালচে সবুজ বাইরেটা আর ভেতরে চক করে কেটে দেখে লাল টকটকে দেখার পর কিনবে একখানা তরমুজ। সেই তরমুজের পিঠে খোদাই করা থাকবে তার ওজন। একখানা বাঁশিও কিনে নিতে পারে। উদাস দুপুরে পাকুড় গাছের ছায়ায় বসে বাঁশি বাজাবে। সন্ধে নেমে আসত তার নিয়ম মেনে। মেলার মানুষদের মনে হয় বড্ড ছোট দিন, গাড়োয়ান ভাবে এত দেরি হচ্ছে কেন অন্ধকার নামতে! কুপি, হ্যাজাক জ্বলে ওঠে। তার মনিবেরা ফিরে আসে এবং তাড়া দেয়। অনেক পথ ফিরতে হবে। সন্ধে গড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। অতএব এক্ষুণি রওনে দিতে হবে।

গরুর গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে গাড়োয়ান কিশোর আবার একঝলক তাকায় মেলার দিকে। খুব কাছে এসেও… সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। এবছরটা গেল। সামনের বার নিশ্চয়… নিজেকেই বোঝায়। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। গাড়ি ফেরার বাঁকা পথ ধরতেই জল নামে দু চোখ বেয়ে। রাস্তার ডানপাশে আর বাঁপাশে সেই জল ঝরে পড়ে। সে এক্কেবারে সামনে বলে কেউ দেখতে পায় না। শুধু সময় তাকে মনে রাখে, জায়গা করে দেয় মেলার দু’পাশে। তার চোখের জল পুকুর হয়ে আজ মেলা দেখে, মেলার কলরব শোনে।

লোকটা একমনে শুনছিল সুবাহুর গল্প। সে থামলে বলল, আমিই সেই গাড়োয়ান। আপনি আমার ছেলেবেলার গল্প জানলেন কী করে?

–আমি সব জানি। সব। শুধু বলতে পারি না কাউকে। বহু বছর পর তুমি আমার কথা শুনতে পেলে। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। তুমি পেলে কারণ অন্য একটা জগত তোমায় টেনে ধরেছে। কারও সাধ্য নেই তোমায় আটকে রাখে।

লোকটা গাছে উঠেছিল এবং ঝুলে পড়েছিল।

মিনিট দুয়েক পর তার মতো অদৃশ্য হয়ে এসে বলেছিল, সমস্ত জীবনে আমি কিছু স্মৃতি ফেলে এসেছি। সব্বাই তাই ফেলে আসে বুঝি!

–সব্বাই তাই করে। তুমি একে একে অনেক কিছু জানবে। খুব ভাল স্বপ্ন ভেঙে যাবার মতো অসম্ভব কষ্ট হবে। এখান থেকে কোথাও যেতে পারবে না। উপায় নেই। চুপ করে মেনে নাও যেভাবে আমি টিকে আছি।

আবার একটি মিথ্যে কথা বলে সে লোকটাকে আটকে রাখতে চেয়েছিল। পারেনি। চলে গিয়েছিল।

আজ আবার মনে হচ্ছে তেমন কিছু ঘটতে চলেছে। কথা বলবার মানুষ আসছে…

তিন

মস্ত পাকুড় গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল রাখু আর আনন্দী। আর তো মোটেই একটা মাঠ! ফুরিয়ে এল এত তাড়াতাড়ি। রাস্তা ফুরিয়ে এলে মন খারাপ হয় তা জানত না সে। ঠান্ডা বাতাস যেন এসে এই গাছের নিচে আশ্রয় নিয়ে খেলছে। অল্প কিছুক্ষণ হল আনন্দী আর তাকে তাড়া দিচ্ছে না। দুম করে দাঁড়িয়ে পড়াতেও কিছু বলছে না। রাখু খানিকটা সাহস নিয়ে বলল, হাতটা দে।

–ক্যান?

–এমনি। দে হাত দে।

আনন্দী হাত বাড়াল। দুটো ঘেমে ওঠা হাত যখন এক হল তখন কে যেন ফিসফিস করে বলল, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? শুনতে পাচ্ছ? আমি একটা গল্প বলতে চাই তোমাদের।

ভয়ে সিঁটকে গেল দুজনে। হাত দুটো আলাদা হয়ে গেল।

রাখু বলল, কে কথা বলল?

আনন্দী উত্তর দিল, ভয় লাগে, চল এখান থেকে।

যেতে পারল না ওরা। সুবাহু চারদিক দিয়ে বাতাসে মিশে ঘুরতে লাগল। যেখানে এই পৃথিবীর সমস্ত পথ মিলিয়ে গিয়ে একটা মাত্র সুড়ঙ্গ হয়েছে। তার চারদিকে ঝুরঝুর করে খসে পড়ছে এই পৃথিবীর রাস্তাঘাট, গাছপালা। রাখু ভয়ে ভয়ে উচ্চারণ করল, মোর ভুলাই ধরিচে মনে হয়। যে করেই হোক পালাতে হবে। একদৌড়ে মাঠ পার করতে হবে। পারবি?

আনন্দী মাথা ঝাঁকানোর চেষ্টা করল মাত্র। দুজনে হাত ধরল আবার। ছুটে যাবার চেষ্টা করে বুঝল একটুও এগিয়ে যেতে পারছে না। সম্পূর্ণ কাঁচের একটা ফুটবলের ভেতরে তারা আটকা পড়েছে।

এবার তারা খুক খুক করে হাসির শব্দ শুনল।

রাখু চিৎকার করে উঠল, কে?

হাসি থামিয়ে সুবাহু বলল, আমি কে জানবার আগে জেনে নাও, মানুষের জীবন অনেকটা গভীর কুয়োর মতো। তলায় কী আছে কেউ তার হদিশ জানে না। শুধু মাঝেমধ্যে ভুস করে কিছু ভেসে ওঠে তা দেখে তলায় কী আছে কল্পনা করতে পারো শুধু। হয়ত সবটা আমিও জানি না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, সুড়ঙ্গ ধরে এগিয়ে চলো, সামনেই বৃহদ্বটু। আমি নিয়ে যেতে এসেছি তোমাদের।

ওরা নিজেদের হাত এখন বেশ শক্ত করে ধরে রেখেছে। এই দৃশ্য থেকে কিছুতেই তাদের আলাদা করতে সুবাহুর মন চাইছে না। তবু বলল, একটা প্রাচীন নগর তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি জানি তোমরা মনে মনে পালাতেই চেয়েছিলে। এমন কোথাও যেতে চেয়েছিলে যেখানে কেউ নেই। এক্কেবারে নতুন একটা নগর। ঠিক সেই মতো আমার কাছে একটা নগরে যাবার দরজা আছে। দেরি না করে চলে এসো। হয়ত সবটা বুঝিয়ে বলতে পারছি না। মনে রাখবে, সব কিছু ব্যাখ্যা করতে গেলে তার অর্থ এক্কেবারে হারিয়ে যায়।

অগত্যা ভুলাইধরা দুটো মানুষের মতো ওরা দুজন ঢুকে পড়ল সুড়ঙ্গতে।

চার

রাখু আর আনন্দীর সামনে একটি স্তম্ভ। তাতে কোনও লিপি নেই। স্তম্ভের উপরে খাঁজকাটা নক্সা। অনেকটা সিংহাসনের পিঠের মতও কারুকাজ।

মস্ত একটা দীঘির মাঝখানে আরেকটি স্তম্ভ। একঝলক দেখতেই বোঝা যায় তা পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে।

সুবাহু বলতে লাগল, এই দীঘিটির নাম ধীবর। এই জলাশয়ের মাঝখানে ওই যে স্তম্ভটি দেখছ তা কৈবর্ত্ত রাজা দিব্যক, তার ভ্রাতা রুদোক ও রুদোকের পুত্র প্রখ্যাত নৃপতি ভীমের কীর্তি। দ্বিতীয় মহীপালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বরেন্দ্রভূমির অধিকাংশ অমাত্য পদচ্যুত সেনাপতি বরেন্দ্রভূমির ধীবর বংশোদ্ভূত কৃতী সন্তান দিব্যকের নেতৃত্বে পাল শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করেন। পরে দিব্যককে সর্বসম্মতিক্রমে বরেন্দ্রর অধিপতি হিসেবে নির্বাচন করা হয়।

এই জয়স্তম্ভটি কোন কৈবর্ত্ত রাজা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আজ একমাত্র আমি জানি। এটি একটি অখণ্ড পাথর কেটে তৈরি। এই স্তম্ভের নয়টি কোণ আছে। এর এক কোণ থেকে আরেক কোণের দূরত্ব ১২ ইঞ্চি। এই বিরাট স্তম্ভের উপরিভাগে পর পর তিনটি বলয়াকারে স্ফীত রেখা আছে যা স্তম্ভের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। এর মাথায় আছে একটি মুকুট।

দীঘির মূল ঘাটে প্রবেশ করার সময় ওরা দেখল দু’পাশে দেবদারু গাছ দিয়ে ঘেরা রাস্তা তাদের ডাকছে। ওই যে দেখছ এই দীঘির পাশে একটা খাঁড়ি তা আত্রেয়ীতে গিয়ে মিলেছে।

বর্ষার সময় বনের ভেতর দিয়ে খাঁড়ির প্রবাহে একবার নাও ভাসিয়ে আত্রেয়ী অব্দি পৌঁছুতে পারলে সাত জন্ম একসাথে থাকবে।

–তাই? বহুক্ষণ পর এটুকুই উচ্চারণ করতে পারল আনন্দী।

বরেন্দ্রভূমির ঢেউখেলানো বিস্তীর্ণ মাঠে যুগ যুগ ধরে কালের সাক্ষী হয়ে থাকা বাতাসে তাই শব্দটি ঘুরতে লাগল।

ওরা দুজন অনেকটা এগিয়ে গিয়ে পৌঁছছে নগরটার কাছাকাছি, এত সুন্দর একটা শহর দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। যেন সামনে মেলায় দেখা ক্যালেন্ডারগুলো মস্ত হয়ে ঝুলছে। এই সুন্দর তাদের ভয় দেখাতে লাগল। তারা অন্য কোথাও যাবে ঠিক করেছিল কিন্তু এই সুন্দর আশা করেনি।

সুবাহু চিৎকার করে উঠল, দাঁড়িয়ে পড়লে চলবে না, তোমাদের নগরের প্রধান ফটক পার করে দিয়ে আমি আবার সেই পাকুড় গাছে অপেক্ষার করার জন্য ফিরে যাব। তাড়াতাড়ি করো।

–আর আমরা! রাখু জানতে চাইল।

–তোমরা থেকে যাবে এই নগরে। এর বেশি আমি কিছু জানি না।

একটার পর একটা প্রশ্ন করল রাখু। উত্তর এল না।

আনন্দী ফিসফিস করে বলল, থাকবা! থাকে যাবা।

রাখু হিসহিসিয়ে উঠল, না, কক্ষনো না। আমি ঘরে ফিরব।

–ঘর করবা না।

–এইখানে না। ফিরে চল গাঁয়ে।

–এত বড় একটা দেশ ছাড়ে চলে যাবা।

–কলাম তো যাব। এইখানে আর নয়।

হেঁচকা টান দিয়ে আনন্দীকে টেনে আনল নিজের কাছে, ফিরে চল।

দুজনে ফিরতে লাগল। আনন্দীর মন পড়ে রইল বৃহদ্বটু নগরে।

পাঁচ

ফেরার সময় চিত্রহারের টিকিট দুটো রাখু কুচিকুচি করে পাকুড় গাছের নিচে ফেলে দিল। যতটা সহজ করে ফেলল তত সহজে একটু আগের স্বপ্নের ছবিগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে না। সে কি ভুল করল ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে! ঘুরে দাঁড়াল, আনন্দীর চোখে চোখ রেখে বলল, তোর মন খারাপ হইচে না?

–না।

–সত্যি?

–হুম।

–তবে পা চালা, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।

ওরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ফিরছিল তাদের গাঁয়ের দিকে। মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে একটু দাঁড়ালেই রাখু জিজ্ঞেস করছিল, তোর মন খারাপ হল না? ফিরে আসাতে—

প্রতিবার আনন্দী বলছিল, না। না। না।

এতটাই তীব্র না যে রাখু ভয় পেয়ে যাচ্ছিল। তবু কথাটা এসেই যাচ্ছিল। থামানো যাচ্ছিল না। অন্যদিকে বিষয় ঘুরিয়ে দেবার অনেক চেষ্টা করেও বারবার এসে যাচ্ছিল সেই নগর।

রঙিন প্রজাপতির মতো রক্তে আলোড়ন তোলা মেয়েটির হাত ধরার পর তার মন কেমন করছে একটা নগরের জন্য!

তাদের গ্রাম চলে এল। দু’জনের রাস্তা এবার আলাদা হবে। এমন সময় রাখুর সমস্ত শিরা স্নায়ু চিৎকার করে উঠল, কেউ মেনে নেবে না তোদের। পালিয়ে যা। পালিয়ে যা। সে শুধু শুনল, বলতে পারল না কিছু।

আনন্দী অবাক হল না। অনেকটা এগিয়ে গিয়ে ফিরে এল, আমি সেই দেশে যাবার চাই। খবর দিও।

রাখু মাটির মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে থাকল শুধু।

ছয়

বর্ষা এল, বন্যা হল। শরত এল, পুজোর পরে একদিন রাতে মস্ত একটা চাঁদ উঠলে সেই নগরটা ভুস করে মজা পুকুরের ভুটভুটির মতো উঠে এসেছিল আনন্দীর চোখের সামনে। এর মাঝে রাখুর সঙ্গে কতবার দেখা হয়েছে শুধু সাহস করে সেই নগরটার কথা বলতে পারেনি। রাগ করেই বলেনি। সে তো যেতেই চায়। বারবার কেন বলবে!

সে এখন অনেকটা বড় হয়ে গেছে। এই বয়সে মেয়েরা কলুম লতার মতো বাড়ে। এসময় মেয়েদের ছ’মাস মানে পুরুষের ছ’বছর। দুমদাম সব বলা যায় না।

বলবেই বা কেন?

একদিন মুখ ফসকে রাখু বলে ফেলল, সেই মেলা থেকে ফেরার দিনে ভুলাই ধরেছিল আমাদের তোমার মনে পড়ে? রাখু আজকাল তাকে তুমি করে ডাকে। ভালোই লাগে। শুধু এই কথাটা শুনে মনে হল কোথাও লণ্ঠনের কাচ ঝন ঝন করে ভেঙে গেল। সে বলল, ওটা ভুলাই ছিল?

–তা নয়ত কী? ওটা কখনও সত্যি হয়! ভুলাই, ভুলাই, ভুলভুলাইয়া ধরেছিল সেদিন।

সুবাহু সব শুনছিল। পাক্কা কয়েক মাস ওদের কাছাকাছি থাকে, মনে করায়। আজ সে অবাক হল। মেয়েটির চোখে জল। ছেলেটি হাসছে।

আশ্চর্য মেয়েটির চোখের জলে একটা নগর ফুটে উঠছে। ঝলমলে নগর।

সুবাহু বহুদিন বাদে নিজের নগর দেখতে লাগল।

যেখানে কপালে কাজলের টিপ, হাতে চাঁদের আলোর মতো শুভ্র বালা, কানে রিঠাফুলের দুল, স্নিগ্ধ চুলের খোঁপায় তিলের পল্লবে সেজে বসে আছে আনন্দী। অস্তগামী সূর্যের মতো দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলছে, আমার মানুষ চাই সুবাহু, পুরুষ মানুষ। এনে দাও।

সুবাহুর মনে হতে লাগল সে মস্ত একটা সাঁকোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে যেটা ভয়ঙ্কর কাঁপছে। মনে হচ্ছে এখানেই তার সীমানা শেষ। তবু মেয়েটা বলেই যাচ্ছে, এনে দাও, পুরুষ মানুষ এনে দাও।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...