চলচ্চিত্রের সামাজিকতা ও সমাজের চলচ্চিত্র

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

 

এটা কৌতুকের বিষয় নয়, বরং ভেবে দেখার বিষয় যে কবিতার ক্ষেত্রে বা চিত্রকলার ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু প্রাথমিকভাবে প্রশ্ন করি না যে একজন কবি বা শিল্পী সামাজিকভাবে কতখানি দায়বদ্ধ। হয়তো এ কারণেই বলি না যে একজন জীবনানন্দ দাশ বা একজন স্তেফানো মালার্মে কখনওই সরাসরি সমাজের পরিবর্তন করতে পারেন না। তাছাড়া কবিতা বা চিত্রকলা উভয়েই অতি প্রাচীন ও প্রমাণিত শিল্প। তবে সিনেমার ক্ষেত্রে আমরা যে দায়বদ্ধতার কথা বলি এবং এর কাছ থেকে যে সতত আমাদের প্রত্যাশা অনেক তার একটা কারণ, আদিতে সিনেমার জন্ম শিল্প হিসেবে নয়। তার বয়সও বেশি নয়। সিনেমা এমন একটি অংশের মাধ্যম যে নিজে উত্তর শিল্পবিপ্লব শ্রমজীবী অংশের জায়গা থেকে জাত এবং পাশাপাশি স্বভাবতই ওই সমাজের জন্য কিছু লঘু চিত্তবিনোদনের আয়োজন করেছিল। তার ফলে চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছিল নিতান্তই অবসরের বিনোদনকর্ম। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পার হয়ে যখন মূলত রুশ চলচ্চিত্রবিদরা চলচ্চিত্রকে সমাজের পরিবর্তনের আকাঙ্খায় বা উচ্চতর সামাজিক নিরিখে বিচার করতে শুরু করলেন, ঠিক তখন থেকে আমাদের মনে হল, সিনেমা যেহেতু শ্রেষ্ঠ গণমাধ্যম, সে যেহেতু সাক্ষরতার পাহারা এড়িয়ে সমাজে ছড়িয়ে পড়তে পারে, তাকে ব্যবহার্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ কথা বলা যেতেই পারে যে এ ভাবনা প্রথম এসেছিল বামপন্থী ও কমিউনিস্ট নেতা লেনিনের মাথায়। এটাও খেয়াল করে দেখার যে চলচ্চিত্রের প্রথম শিক্ষায়তন লেনিন বিপ্লবের অনতিকাল পরেই সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠা করেন যা ভিজিআইকে নামে আজ বিশ্ববিখ্যাত। এবং রাজনীতিবিদেরা যে সিনেমাকে প্রচারমাধ্যম হিসেবে অন্য চোখে দেখেন তা লেনিনের একদম বিপরীতে যে চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী ও ফ্যাসিবাদী রাজনীতিবিদ, বেনিটো মুসোলিনি, তাঁকে দেখলেও বোঝা যায়। পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্র উৎসব ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব, বেনিটো মুসোলিনির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে উদ্বোধিত হয়েছিল ১৯৩২ সালে।

এখন এই যে পরিপ্রেক্ষিত, তার ভিত্তিতে আমাদের বুঝতে হবে যে চলচ্চিত্রের কোনও নিঃসঙ্গ মুহূর্ত নেই, তাকে সমাজের প্রত্যক্ষ প্রয়োজনে নিযুক্ত থেকে নিজের কথা বলার গোপনীয়তা নির্মাণ করে নিতে হয়। ভুললে চলবে না, ‘পথের পাঁচালি’র মতো শিল্পকর্মও প্রেক্ষাগৃহে অজস্র চোখের দ্বারা পরীক্ষিত হয়। চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারী বা মৌলিক নিষাদের মতো ক্রোধের বশবর্তী হলেও চলচ্চিত্রের স্রষ্টা মেনে নিতে বাধ্য যে তার প্রয়াসে সক্রিয় হয়ে থাকছে বাণিজ্যের পাহারা। কোটি কোটি টাকা! মুক্তি নেই! এই রৌদ্রে, ক্ষমাহীন অ্যাসফল্টে, নক্ষত্র ও নারীতে তাকে ভিড়ের হৃদয় পেতে হবেই। এই শাস্তির অসামান্য প্রতিপ্রস্তাব হল সেই নিবিড় চুম্বন যা সমাজ তাকে ফিরিয়ে দেয়। সার্কাসের তাঁবুতে তার জন্ম, ভ্রাম্যমান প্রদর্শনী বা লঘু তামাশার হীন পরিবেশে বড় হয়েও চলচ্চিত্র যে আজ নিজেকে সঙ্গীত, কাব্য, স্থাপত্যের সমকক্ষ বলে দাবি করছে, এবং সে দাবি স্বীকৃতও হচ্ছে, তার মুখ্য কারণ চলচ্ছবিও বিষয়ের মোহ ত্যাগ করে বক্তব্যের গভীরে প্রবেশ করেছে।

এটুকু যদি সত্যি হয়, তাহলে আজকে, এই একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ভারতীয় ছবির দিকে তাকালে, আমাদের মনে হওয়াটা কীরকম? এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে ভারতীয় ছবিও প্রয়োজনের তাগিদেই উঠে এসেছিল। যখন দাদাসাহেব ফালকে ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ করছেন, তখন এই ছবিটির গুণাগুণ পরীক্ষা না করলেও দেখা যায় যে এটি একধরনের হিন্দু পুনরুত্থানবাদের উৎপাদন। বাল গঙ্গাধর তিলক মহারাষ্ট্রে যে আন্দোলন করছিলেন, বা হিন্দু পুনরুত্থানবাদ যেভাবে তৎকালীন উপন্যাসে ও আখ্যানে ছড়িয়েছিল, সেই একই মতবাদ আমাদের পৌরাণিক আখ্যানের নবব্যাখ্যায় প্রবেশ করে। পূর্বাঞ্চলে, পশ্চিমাঞ্চলে করে, এমনকি দক্ষিণাঞ্চলেও করে। আমরা মনে করতে শুরু করি যে চলচ্চিত্রের কিছু বাণী, কিছু গহন উপদেশ থাকবেই। অর্থাৎ সে প্রাচীন কথকতার আধুনিক সমাজের প্রেক্ষিতে একধরনের নবনির্মাণ, যেখানে কারিগরি প্রয়োগ কুশলতা আছে এবং যা এক নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে জনসাধারণকে তার সাংস্কৃতিক মান থেকে আরও এক বড় স্তরে উত্তীর্ণ করতে পারে।

বেশি কথা না বললেও বলা যায়, যখন পঞ্চাশের দশকে আমাদের চলচ্চিত্রের একধরনের স্বাধীনতাবোধ এল, তার আগে অবধি, দেবকীকুমার বসুরা যখন ‘Flames of Flesh’ করেছিলেন বা ১৯১৭ সালে ম্যাডানরা ‘সত্যবাদী রাজা হরিশচন্দ্র’ করেছিলেন, আমাদের সেই সমস্ত ছবিতেই সামাজিক বাণী এবং পুরাণের নব-উচ্চারণ ছিল। এমনকি তিরিশের দশকে যখন শব্দ সংযোজিত হল, বম্বেতে ও কলকাতায়– কলকাতার ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে সেসব ছবিতেও এক ধরনের কথকতা আছে যা মূলত মধ্যবিত্ত মানুষের প্রতি একটা দায়ভার বহন করে। সেই দায়ভার বহন করার পন্থাটা সঠিক না বেঠিক– এই নিয়ে তর্কবিতর্কের  সুযোগ আছে। কিন্তু বিমল রায়ের ‘উদয়ের পথে‘ (১৯৪৪) যে প্রথমবার এই সামাজিক বাতাবরণকে উন্মুক্ত আঙিনায় ছড়িয়ে দিয়েছিল, তা নিয়ে এখন আর কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। স্বাধীনতার পরে আমাদের চলচ্চিত্র যখন প্রথম ডানা মেলল, সেই সময় যদি আমরা ‘ছিন্নমূল‘ (১৯৫১) সিনেমাটিকে দেখি, নিমাই ঘোষের এই ছবি দেশভাগের প্রত্যক্ষ বাস্তবতাকে যেভাবে বর্ণনা করে, তাতে আমরা ইতিহাসের দুর্ভাগ্য এবং অশ্রুপাতকে দেখতে পাই। এমনকি সত্যজিৎ রায় যখন ‘পথের পাঁচালি‘ (১৯৫৫) বানালেন, যা আমাদের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, বা তার দু’বছর বাদে ঋত্বিক ঘটক যখন ‘অযান্ত্রিক‘ নির্মাণ করলেন, সেই সমস্ত ছবি থেকেই আমরা দেখতে পাই যে সামান্য বিনোদন যা ছিল অনভিজাতদের জন্য অপেরা– তাকে এঁরা ক্রমশ এক ধরনের শিল্পকর্মে নিয়ে যাচ্ছেন, যা উন্নত রুচি, উন্নত সাংস্কৃতিক খাদ্য, ও উন্নত চিন্তা পরিসরের যে আয়োজন তার দিকেই ইঙ্গিত করছে। সত্যজিতের অপূর্ব কলকাতায় আসে এবং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায়, এই দৃশ্য দেখিয়ে সত্যজিৎ আসলে ঐতিহাসিক আধুনিকতার একটা দায়ভাগ বহন করছেন। এসব কথা মার্ক্স তাঁর ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’তে লিখেছিলেন, এমন নয় যে সত্যজিৎ সেই ইস্তেহার অনুযায়ী ছবি করেছেন, কিন্তু ইতিহাসের চলাচলের ছন্দ তাঁর ছবিতে ধরা পড়ে। এটা পরবর্তীকালেও ধরা পড়েছিল তাঁর শহর ত্রয়ীতে বা তাঁর অন্যান্য ছবিতেও। ঋত্বিক ঘটক তো সরাসরি বামপন্থী ছিলেন, এমন নয় যে তিনিও প্রচারকের মতো কথা বলেছেন, কিন্তু তাঁর ছবি কখনই সমাজবিচ্ছিন্ন নয়। একই কথা মৃণাল সেন বা রাজেন তরফদার সম্পর্কেও প্রয়োগ করা যায়। এমনকি উত্তমকুমারের এত জনঅভিনন্দনের অন্যতম কারণ তিনি পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে তাঁর অভিনীত মেলোড্রামাগুলির সূত্রে সাধারণ মানুষের রুদ্ধ আবেগকে এক ধরনের মুক্তি দিতে পেরেছিলেন। আমার এই কথাগুলি আরও জোরালোভাবে প্রমাণিত হবে যদি আমরা বম্বেতে দেবানন্দ ও রাজ কাপুরের উত্থানের কথা ভাবি। এঁরাও উত্তমকুমারের সমসাময়িক। এই যে গ্রাম থেকে শহরে আসা, বস্তুত পল্লীবাসীর হঠাৎ করে শিল্পায়ন বা শহরায়নের সমস্যায় জড়িয়ে পড়া এবং এর ফলে মানসিক যে বিপর্যয়, ট্রমা, একে একমাত্র মেলোড্রামাই রূপ দিতে পারে– এ বিষয়ে পণ্ডিতরা একমত হয়েছেন এই সময় ভারতের প্রতিটি প্রান্তে যেসব নায়কেরা অভিনয় করছিলেন ও জনপ্রিয় হচ্ছিলেন, তা শুধু নটদের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের কারণে নয়, ইতিহাসও তাঁদের আলো-রেখা বুনে দিচ্ছিল।

সমস্যা হল, যখন আমাদের গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেল, ১৯৯১ সালে, যখন আমরা সীমানা পেরোনোর ছাড়পত্র পেলাম, যখন আমরা বুঝলাম আমাদের আন্তর্জাতিকতাবোধ আর বিশ্বায়ন এক জিনিস নয়; বিশ্বায়ন প্রকৃত প্রস্তাবে বাণিজ্যের স্বাধীনতা, তখন থেকে চলচ্চিত্র ক্রমশ বাণিজ্যিক বিপণনের অর্থে চূড়ান্ত রূপ পেল। এই যে ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’, বা ধরা যাক মাধুরী দীক্ষিতের উত্থানের ছবিগুলি, অথবা ‘দিল চাহতা হ্যায়’, এই ছবিগুলির সঙ্গে আমাদের আগেকার ছবিগুলির তফাত হচ্ছে, আগের ছবিগুলিতে ভারতবর্ষ বা দেশপ্রেম বা তেরঙ্গা ঝাণ্ডা, সুভাষ বসু বা মহাত্মা গান্ধি এসবের একধরনের বিনিয়োগ ছিল, সেই বিনিয়োগ দূরে সরে গেল। প্রকাশ্যেই আমরা বুঝতে পারলাম যে আমাদের জাতিগত পরিচয় বা আমাদের নাগরিকতার ছাড়পত্রের চেয়েও অনেক বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে আমাদের ক্রেডিট কার্ড এবং আমাদের কেনার স্বাধীনতা। এই কেনার স্বাধীনতা যদি একমাত্র স্বাধীনতা হয় সেক্ষেত্রে তার যথার্থ প্রচারপত্র বা দেওয়াললিপি সিনেমা ছাড়া আর কেই বা হতে পারে? এক্ষেত্রে সিনেমার একটা বড় ভূমিকা হল, হয় সেই বাজারের কথা বলা অথবা সেই বাজারকে যারা উপভোগ করবে সেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন মধ্যবিত্তকে সুনিয়ন্ত্রিত গণ্ডির মধ্যে আনা।

চলচ্চিত্রের এই পরিবর্তিত ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে যেখানে এসে আমরা সবচেয়ে হতাশ হই, তা হচ্ছে আমাদের সাম্প্রতিক বাংলা চলচ্চিত্র। এখানে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের মতো গুণী শিল্পীরা কাজ করেছেন, এমনকি যদি জনপ্রিয় ধারার বাণিজ্য শিল্পীদের কথা ভাবি, তাহলেও নির্মল দে, অজয় কর, তপন সিংহ এঁদের মতো গুণী মানুষ কাজ করেছেন। সেই জায়গা থেকে আজ সমস্ত আখ্যানটাই চলে গেল, হয় কুৎসিত নৃত্যগীতাদিতে, যেখানে নৃত্যের দক্ষতা নেই, গানেরও সৌকর্য নেই। যারা গায়ক, তাদের কারও না মান্না দে না হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গুণ আছে। যারা নাচছেন তারা কেউই উদয়শঙ্কর, বৈজয়ন্তীমালা বা নিদেনপক্ষে রেখার মতোও গুণান্বিত নন। কিন্তু তারা একধরনের নকলনবিশি করেন এবং ধরেই নেন যে শুধুমাত্র নিম্নমানের দর্শকের জন্য তাদের নৃত্যগীত পরিবেশন করতে হবে। এর বিপক্ষে তথাকথিত একধরনের শিল্প সিনেমার উদ্ভব হয়, যা অনেক সময় সরকারপোষিত অভয়ারণ্য এবং পরের দিকে তা এক ধরনের মিডিয়াসমর্থিত হাতুড়ের উপনিবেশ। ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেন এইসব শিল্পীদের আমরা এই ধরনের সিনেমায় কাজ করতে দেখেছি। এইসব ছবির মধ্যে পরিবার আছে কিন্তু কোনও রাজনীতি নেই। আশ্চর্য ব্যাপার, সমাজ-রাজনীতির ছাপ নেই এমন বাংলা সিনেমা অনেকদিন ধরেই বাজারে চলছে। এটা আমাদের ভেবে দেখার, যে আন্দোলনের ফলে রাজ্যে ৩৪ বছরব্যাপী তথাকথিত বাম শাসনের অবসান হল, সেই আন্দোলনগুলির ছাপ সাধারণভাবে বাংলা ছবিতে নেই। বাংলা মেগাসিরিয়ালে নেই। তাহলে তারা আছে কোথায়?

যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে বলব যে ব্যাপক বিপ্লবটি ঘটেছে খুব গোপনে এবং অন্তর্ঘাতের মতো… ভারতের অন্যান্য কিছু প্রদেশের আঞ্চলিক সিনেমায়, মোটামুটিভাবে বলিউডেও, আজ হিন্দি সিনেমার দিকে তাকালে যা স্পষ্ট। যেমন একদিকে কয়েক কোটি বা কয়েকশো কোটি টাকা ব্যয়ে মেগাচলচ্চিত্রগুলি তৈরি হয়, খানসন্ততিরা যেখানে অভিনয় করে থাকেন, তার বাইরেও মহানগরী মুম্বইতেই আমাদের লিটল ম্যাগাজিনের মতো কিছু ছবি তৈরি হচ্ছে যেগুলো পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের তরুণ শিল্পীরা তৈরি করছেন। সেখানে ক্যামেরার কাজ, সেখানে একটা ছোট্ট গল্প বলা, দৃষ্টিকোণ– এতটাই উল্লেখযোগ্য এবং জরুরি যে আমাদের গর্ব হয় এখন বোধহয় পশ্চিম সীমান্ত থেকে সূর্য উদিত হবে। আমরা দাক্ষিণাত্যে যাব। ছবির নাম ‘সেক্সি দুর্গা’। আমরা যদি নাম শুনে ভয় পেয়ে না যাই, তাহলেই দেখতে পাব যে এটি কোনও উসকানিমূলক ছবি নয়। এটার বিষয় একটা ভয়, মৌলিক নিষাদের মতো, যা নারীকে আক্রান্ত করে, এমনকি সমস্ত নাগরিকদের আক্রান্ত করে। তারা কী স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক বর্ণনায় এবং কত কম বাজেটে ছবিটি করেছেন। এইরকম ছোট ছবি আমরা এই মুহূর্তে শুধু পশ্চিম কেন, ভারতবর্ষের নানা জায়গায় তৈরি হতে দেখছি, যা নানা উৎসবে দেখানো হয়, ছোট ছোট জায়গায় দেখানো হয়, যদিও এখনও এই ছবিগুলির বন্টনের ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। এটা সত্যি যে উদারীকরণের ফলে আজ ছবি দেখার জন্য ভারতবর্ষে যে সম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে, তারা সাধারণভাবে মিনার বিজলি ছবিঘর বা ভারত মন্দির ইত্যাদি সিনেমা হলে যান না। তারা একটু আরামে পপকর্ন খেতে খেতে সিনেমার বিলাসিতাটুকু উপভোগ করেন। কিন্তু এই বিলাসিতা উপভোগ করার জন্য যেমন বড় বড় ছবি আছে, তেমনি ছোট ছবিও আছে যা নির্দিষ্ট দর্শকের কাছে যায়। এবং আরও বড় কথা যে আজকে যে ছবির এই বিপণন তা শুধু হলকেন্দ্রিক বিপণন নয়, আজকাল ওয়েব সার্কুলেশনেও ছোট ছবির মুক্তি, বণ্টন ও বাজার তৈরি হচ্ছে যা ক্রমপ্রসারমান। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখি আঞ্চলিক ছবিতে যেমন দক্ষিণে মালয়ালি ছবি, কিছু তেলুগু ছবি, মারাঠি ছবি, এমনকি বলিউডেও তরুণ সম্প্রদায় যথেষ্ট পরীক্ষানিরীক্ষা করছেন! তারা যে সবাই সত্যজিৎ রায় বা ঋত্বিক ঘটক হয়ে গেছেন তা নয়। কিন্তু ঋত্বিক ঘটক যে এক সময় পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে পা দিয়েছিলেন তার প্রমাণ আজকের বাংলা ছবিতে কোথাও নেই, আছে হিন্দি ছবির আনাচেকানাচে। এই ছবিগুলিতে অভিনয়ের দক্ষতাই সাধারণভাবে বেশি যদিও এরা কেউ নক্ষত্র হননি। এরা কেউ শাহরুখ খান, অমিতাভ বচ্চন বা আমির খানের জায়গায় যাননি, কিন্তু এরা বাচনভঙ্গি, চরিত্রায়ণ, ছবি নির্বাচন সব মিলিয়ে এক ভিন্নতর সফলতা পাচ্ছেন। হ্যাঁ, ত্রুটি অবশ্যই আছে এবং ত্রুটি এই যে আজ আমরা আর দেখতে পাচ্ছি না যে ভারতবর্ষে গ্রাম আছে। ভারতবর্ষের দশটা স্যাটেলাইট শহরই যে ভারতবর্ষের একমাত্র পরিচয় নয়, প্রদেশগুলোর রাজধানীই যে প্রদেশের একমাত্র পরিচয় নয়, এবং মধ্যবিত্তরাই যে একমাত্র নাগরিক নয়, তার বাইরে যে বিপুল সংখ্যক কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ, আদিবাসী, উপজাতি এবং অন্যান্য সন্ততি আছেন, এই সিনেমাগুলিতে সাধারণত তাঁদের কোনও অস্তিত্ব নেই।

অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ১৯২৯ সালে মুরারী ভাদুড়িকে বলেছিলেন যে এত সহজে সিনেমা শিল্প বা আর্ট হয়ে উঠবে না কারণ তাতে বিনিয়োগের প্রশ্ন আছে। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস লেখার সঙ্গে একটি ছবি তৈরির তফাত হচ্ছে একটি নিকৃষ্ট ছবি করতে গেলেও তাতে কয়েক কোটি টাকা খরচ হবে এবং সেই খরচাটা তুলে আনতে হবে। যদিও ডিজিটাল মাধ্যম আসার পর ছবি তৈরির খরচ বেশ কিছুটা কমেছে, তাও। সেই খরচটা নিশ্চয়ই দরিদ্র জনতা দর্শক হিসেবে এসে ফিরিয়ে দেবেন না। তাঁদের জন্য টিভি আছে। আর তাই সিনেমা এখন মধ্যবিত্তদের জন্য, মধ্যবিত্তদের উদ্দেশ্য পূরণের স্বার্থে ও মধ্যবিত্তদের দ্বারা তৈরি হয়৷ কিন্তু এই মুহূর্তে এই ছবিগুলির মধ্যেও আলো-রেখা খুঁজে পেতে হলে আমাদের আঞ্চলিক ছবির দিকেই তাকাতে হবে।

আঞ্চলিক ছবির মধ্যে আমরা সচেতনভাবে বাংলা ছবিকে বাদ রাখব। কারণ বাংলা ছবি বলতেই যে এক সময় আমরা সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, রাজেন তরফদার, পার্থপ্রতিম চৌধুরী, বারীন সাহা বুঝতাম, বাঙালির সেই গর্ব আজ চলে গেছে। অথবা যে অজয় করের মতো একজন গুণী ক্যামেরাম্যান যিনি এখানে ‘হারানো সুর’ বা ‘সপ্তপদী’ বা ‘সাত পাকে বাঁধা’ তৈরি করতেন, সেরকম গুণী ক্যামেরাম্যান গত পঁচিশ-তিরিশ বছরে বাংলা ছবির ধারেকাছে আসেনি। টেকনিকাল এক্সেলেন্স হয়তো বেড়েছে, কারণ ক্যামেরা যন্ত্রটি আজ অনেক সহজ হয়ে গেছে, আজকে যে কেউ ছবি করতে পারেন। আমি যখন একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলাম, সেখানে প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক সৌমেন্দু রায় পড়াতেন। তিনি একদিন বলেছিলেন যে ডিজিটাল ক্যামেরা আসায় কে সুব্রত মিত্র আর কে তুমি, কিছু বোঝা যাচ্ছে না! ডিজিটাল এডিটিং এসে বিষয়টি আরও সহজ করে দিয়েছে। ক্যামেরা এখন লেখনীর মতো ব্যবহার হচ্ছে, তার বহুল প্রচার ও প্রসার হচ্ছে, অনেক তরুণ-তরুণী এতে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারছেন। তার সুফলও ফলছে, তার কুফলও ফলছে। কিন্তু কুফলটা বোধহয় সবচেয়ে বেশি এই বাংলায়। বাংলা সিনেমার দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখব বাঙালির উচ্চাশা বলতে আমেরিকায় রসগোল্লা বিক্রি করা, বাঙালির প্রেম মানেই মধ্যবয়সী পুরুষের নস্টালজিয়া। বাঙালি মধ্যবিত্তের বিপর্যয় তাকে একেবারে অধঃপাতের শেষ সীমানায় টেনে এনেছে। সে যখনই গল্প বলে শুধু অতীতেরই গল্প বলে। আমাদের বন্ধু শ্রী অনীক দত্ত একসময় ভূতের ভবিষ্যৎ নামে একখানি ছবি করেছিলেন। ভারি চমৎকার সে ছবি। কিন্তু আজকের বাংলা ছবি ভূতের ভবিষ্যৎ-ই হচ্ছে৷ তার কোনও সামাজিকতা নেই কারণ সে সমাজের সঙ্গে সংরক্ত হতে ভয় পায়। আজকে সবচেয়ে ভীত যে চলচ্চিত্র সমাজ তা পশ্চিমবাংলা– মহারাষ্ট্র নয়, তামিলনাড়ু, উড়িষ্যা, কেরালা কোনওটাই নয়। তাদের দিকে তাকালেই বুঝবেন, তাদের সকাল অনেক দেরিতে এসেছে, কিন্তু এখন আলো অনেক জোরালো পড়ছে। তাদের হয়তো এই মুহূর্তে মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত, আর আমাদের এখন রাজপুত জীবন সন্ধ্যা।

অবশ্য আমার বন্ধুরা মাঝেমধ্যে বলেন যে তুমি যে এমন নির্বিকল্প নিরাশার কথা শোনাও, এটা হতে পারে যে তোমার মধ্যে একজন হতাশ চলচ্চিত্রকার বাসা বেঁধেছে। সে হতে পারে৷ আমি আমার নিজস্ব হতাশা বা আনন্দের কথা বলছি না। আমি এখনও ছবি দেখি এবং ছবি দেখে আনন্দ পাই। আব্বাস কিয়ারোস্তামির মতো মানুষ কী ধরনের ছবি করছেন একটা ইসলামিক সমাজে, এটা ভাবলেও আমার আনন্দ হয়। যে পারে সে পারে। আমাদের চেষ্টাটাই নেই, পারব কি পারব না তা তো পরের ব্যাপার। আমরা অনেক তুচ্ছ যন্ত্রপাতি নিয়ে, অত্যন্ত সামান্য পয়সা নিয়ে ‘পথের পাঁচালি’ তৈরি করেছিলাম। পেরেছিলাম আমরা। যিনি তৈরি করেছিলেন, তাঁর কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। ঋত্বিক ঘটক পেরেছিলেন, এবং তাও এর থেকে অনেক অনেক খারাপ ক্যামেরা নিয়ে, স্বপ্নের অনেক কম যান্ত্রিক সহায়তা নিয়ে। তাঁদের অদম্য মনোবল ছিল, এবং আর যা ছিল তা হল প্রতিভা, মাথার কাজ। এখনও যেমন কিছু কিছু ছবি হয়, কোনও কোনও ছবি বেশ ভালো ছবি, যেমন আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্তের ‘আসা যাওয়ার মাঝে’। এই ছবিটা নিয়ে খুব হইচই হল।  কিন্তু ছবিটা যদি আমরা ভালো করে দেখি, দেখতে পাব তা হল মধ্যবিত্তের বিবাহবার্ষিকীর চকোলেট। ওয়েল ক্রাফটেড। যেমন আমরা ঘরটর সাজাই তেমনি খুব সুন্দরভাবে সাজানো, যাকে বিলেতের লোকেরা হাউস ওয়ার্মিং বলে। ওই ছবিটা তেমনি সাজগোজের দিক থেকে সুন্দর, দেখতে ভালো লাগে, কিন্তু তার মধ্যে জীবনের ছোঁয়াচ কোথায়? আমি প্রভাবের কথা, কোথা থেকে এ ছবি এসেছে, কার সঙ্গে তার মিল আছে– সেসব প্রসঙ্গে যাচ্ছিই না। আমি শুধু বলছি যে এই ছেলেটি ছবি বানাতে জানেন, কিন্তু তিনি কী তৈরি করছেন? তিনি তো জীবনানন্দ দাশের কবিতা তৈরি করছেন না, তিনি এক চঞ্চল লিরিক তৈরি করছেন, যা ক্ষণস্থায়ী আবৃত্তির রজনী। যেমন আমার আরেকটি ছবিকে বেশ সম্ভাবনাময় মনে হয়েছিল– ‘সহজ পাঠের গপ্পো’। এটা মৌলিক ছবি নয়, কিন্তু এটা একটু ব্যতিক্রম, এটা আমাদের পঞ্চাশ দশকের ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়৷ সেটা একদিক থেকে দেখলে আরও মারাত্মক। কারণ আমাদের যদি রেফারেন্স হিসেবে সবসময় পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে যেতে হয়, তাহলে এই পঞ্চাশ বছরে বাঙালি কী করল? আমাদের লেখক বলতে আমরা যদি সবসময় মানিকবাবু ও তারাশঙ্করবাবুকে রেফার করি, সমরেশ বসু বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ে ফিরে যাই, তাহলে আমরা এতদিন কী করলাম? এই উত্তরটার সামনে আজ আমাদের দাঁড়াতেই হবে, এই উত্তরটাকে আমরা যত পরিহার করছি, ততই কিন্তু আমরা চোরাবালিতে জড়িয়ে যাচ্ছি। আমরা আজ যদি খোলা খাতা থেকে শুরু করি, তাহলে অনেক ভালো হয়। আরেকটি ভালো ছবি, পাভেলের প্রথম ছবি ‘বাবার নাম গান্ধীজি’, এর ভাবনাটা আমার ভালো লেগেছে। কী করেছে না করেছে সেটা বড় ব্যাপার নয়, কারণ একটা ছেলে যার বয়েস তিরিশ হয়নি সে এটা করেছে। এই সাহসকে আমি অভিনন্দন জানাই। আর যেসব বাণিজ্যসফল ছবিকে ভালো ছবি বলা হচ্ছে, তার বেশিরভাগই অবহেলা, অযত্ন ও ওপরচালাকির ফসল। ‘বেলাশেষে’ ছবিটিকেও ভালো ছবি বলা হচ্ছে, তার মধ্যে নাকি মেসেজ আছে। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম একটা ছবি যেখানে বাবা-মায়ের প্রেমকাহিনী সন্তান উঁকি মেরে দেখছে সেই ছবি মানুষকে কী ধরনের বার্তা দিতে পারে? জীবনটা কত লঘু হয়ে গেছে যে পাবদা মাছের ঝাল খেতে পারেনি বলে বিবাহবিচ্ছেদ অবধি ঘটে গেল? বাঙালি দর্শকের মান কি এতটাই নিচে নেমে গেছে যে যারা একদিন সুবর্ণরেখা, অযান্ত্রিক, ভুবন সোম, গল্প হলেও সত্যি দেখত তাকে এখন এই ধরনের ছবি দেখতে হচ্ছে? অপ্রিয় শোনালেও চূড়ান্ত অযত্ন আর অবহেলা বাংলা ছবির এখনকার মানচিত্র। ছবির এডিটিং চলছে, পরিচালক বিদেশে– এমন ঘটনা আকচার ঘটছে। অতএব এই রক্তশূন্য ইন্ডাস্ট্রির কাছে থেকে আমরা কী আশা করব? গোবরে পদ্মফুল উপন্যাসে ফোটে, বাস্তবে সম্ভাবনা বড় কম।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4877 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. আহা! এই আঘাতগুলোর জন্যই এই লেখাগুলো পড়তে হয়। অনেক ধন্যবাদ…

  2. “…এইসব ছবির মধ্যে পরিবার আছে কিন্তু কোনও রাজনীতি নেই।” রাজনীতি কেন উবে গেছে বর্তমানের বাংলা সিনেমাগুলো থেকে – এ সম্পর্কে জানার ইচ্ছে পূরণ হলো না। খানিকটা লেখা যেত হয়ত।
    **
    “আশ্চর্য ব্যাপার, সমাজ-রাজনীতির ছাপ নেই এমন বাংলা সিনেমা অনেকদিন ধরেই বাজারে চলছে।” চলছে, কারণ দর্শক (নিশ্চয়) সেসব সিনেমা উপভোগ করছেন। এভাবে বর্তমানের বাংলা চলচ্চিত্র থেকে সমাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতাবোধের বিলুপ্তিতে এক শ্রেণির দর্শক অভ্যস্তও হয়ে যাচ্ছেন- ভয় টা সেখানেই। সমাজ-রাজনীতি সচেতন যে দর্শক শ্রেণি, তারা হয়ত অভিমান বশত হলমুখি হচ্ছেন না তেমন..এতে ক্ষতিটা কার হচ্ছে?
    **
    “আব্বাস কিয়ারোস্তামির মতো মানুষ কী ধরনের ছবি করছেন একটা ইসলামিক সমাজে, এটা ভাবলেও আমার আনন্দ হয়। যে পারে সে পারে। আমাদের চেষ্টাটাই নেই, পারব কি পারব না তা তো পরের ব্যাপার।”
    অদ্ভূত ভাবে শিহরিত হলেম! বাংলা সিনেমার দৈন্যদশা নিয়ে ঠিক এমন আফসোস চুনোপুটি এই মস্তিষ্কেও খেলেছিল দেশীয় এক সিনেমা দেখবার পর।
    **
    পাঠক মনে ভাবনা উস্কে দেবার মতো সুলেখিত নিবন্ধের জন্য লেখককে আন্তরিক সাধুবাদ।

আপনার মতামত...