বার্তা ছড়িয়ে যাক ট্রাকের গতিতে

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

ব্যস্ত শহরে বা ঝকঝকে লং ড্রাইভে দানবাকৃতি ট্রাকের পিছনে আটকে থাকা বোরডম এড়িয়ে নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছে বহু চিত্তাকর্ষক স্লোগান ও শিল্পকর্মের মেলবন্ধন। অসাধারণ তার রেঞ্জ, কোথাও বা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে ‘আর কত রাত একা থাকব’র আকুতি, বা ‘বুরে নজরবালে তেরা মুহ কালে’ জাতীয় হিংসুটেদের প্রতি চেতাবনি ভয়ঙ্কর রাক্ষসের ছবি সহ কিংবা অযান্ত্রিক স্পিরিটে যানের প্রতি আবেদন, ‘বেশি খেও না (তেল) বাবু বকবে’, কোথাও প্রতিটি ট্রাকচালকের অন্তরবেদনা যেন মূর্ত, এক হাঁটুতে মুখ ঢাকা নারীর পায়ের নিচে ফুটে ওঠা ‘ঘর কব আয়োগে’র বিধুর লেখায়, কোথাও আবার দেশদ্রোহী বক্তব্য, ‘১০০ মে ৯৯ বেইমান, ফিরভি মেরা ভারত মহান’। এরকমই অজস্র লেখালিখি রঙের বাহার নিয়ে প্রতি দিন রাত অসংখ্য ট্রাক এফোঁড় ওফোঁড় করে চলেছে এই ভারতের বিস্তীর্ণ হাইওয়ে। উত্তর থেকে দক্ষিণ পূর্ব থেকে পশ্চিম এই ট্রাকচিত্র সর্বত্রই সুলভ, পার্থক্য শুধু বিষয়ে আর রঙে। সীমানা পেরিয়ে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রেও সেই প্রভাব স্পষ্ট এবং ছবি আঁকার মুন্সিয়ানায় বেশ এগিয়ে। এমনকি আপনাদের নিশ্চয় মনে থাকতে পারে বছর পাঁচেক আগেই উত্তর কলকাতায় এক পুজো মণ্ডপে এই ‘ট্রাক শিল্প’ থিম হয়েছিল, যা আঁকার জন্য পাকিস্তান থেকে হাজির হয়েছিলেন অভিজ্ঞ শিল্পী, এবং বাংলার এক বহু বিজ্ঞাপিত সংবাদপত্রের রিপোর্টকে বিশ্বাস করলে তারপরেই তাঁর যে কন্যাসন্তানের জন্ম তাকে দেবীর আশীর্বাদ বলে স্বীকার করেছিলেন সেই শিল্পী। সে যাই হোক, এই ট্রাকশিল্প যে ভারতের গ্রামাঞ্চলে অন্যতম গতিমান মাধ্যম, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যেমন উত্তর সিকিমের এক প্রত্যন্ত গ্রামে যাবার পথে এক বরফ ঢেকে যাওয়া ট্রাকে লেখা রাধার প্রতি কাতর আকুতি, ‘কৃষ্ণ বলো সঙ্গে চলো’র অমোঘ লাইন আমাকে এক লহমায় নিয়ে গেছিল বাংলার গ্রামে।

পেশোয়ারে বর্তমানে এই ট্রাকশিল্প কিন্তু ব্যবহৃত হচ্ছে এক সম্পূর্ণ নতুন অবতারে, সামাজিক পরিবর্তন আনতে। সেখানে এখন লাস্যময়ী নায়িকা বা বন্দুক সজ্জিত ভিলেনের বদলে নারীসমাজের উন্নতির বিশাল বিজ্ঞাপন ট্রাক থেকে ট্রাকে। তা সে বাল্যবিবাহ রদ বা সম্পত্তিতে অধিকার বা নারীশিক্ষা, যাই হোক না কেন।

হাজি খান নামের এক ট্রাকচালক ওয়ার্কশপে প্রথম একজন কারিগরের কাছে এই আইডিয়া পান, তারপর থেকে তাঁর ট্রাকে এখন এক নাবালিকার ছবি, কাঁধে স্কুল ব্যাগ মুখে হাসি। সেখানে লেখা, ‘শিক্ষা প্রতিটি মেয়ের মৌলিক অধিকার, আপনার মেয়েকে স্কুলে পাঠান’।

সামার মিনালা— বিখ্যাত পাক সমাজকর্মী ও নৃতত্ত্ববিদ— যাঁর মাথা থেকে এই অভিনব কর্মসূচির শুরু, তিনি জানাচ্ছেন, ট্রাকশিল্প সামাজিক প্রচারের একটা বড় হাতিয়ার, কারণ খাইবার থেকে করাচি যেখানেই ট্রাক যাক না কেন, এই বক্তব্য গ্রামের লোকজনের নজরে আসে আর গ্রামেই এই সব প্রথার অত্যাচার বেশি। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, ইউনেস্কো, এদের নজরেও এসেছে এই কাজ, আর প্রয়োজনীয় ফান্ডিংও পাওয়া যাচ্ছে কিছু তাদের থেকে।

হায়াৎ খান এইরকমই এক ট্রাক ওয়ার্কশপের মালিক যেখানে নারীশিক্ষা বিষয়ক ছবি আঁকা হয়, এবং তাঁর সক্রিয় সহযোগিতায় এই শিল্প অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুততার সাথে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, ইউনেস্কো দু পক্ষই মৌ স্বাক্ষর করেছে তাঁর সাথে। সুতরাং আশা করা যেতেই পারে খুব শীঘ্রই গ্রামে গ্রামে এই বার্তা পৌঁছে যাবে ট্রাকের গতিতে। ভারতের মতো বহুভাষাভাষী দেশে যদিও কাজটা এত সহজ নয়। তবুও আমরাও আশা করতেই পারি, এই অভিনব উদ্যোগ আমাদের দেশেও চালু হবে, যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সামাজিক অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে পড়বে মেগা সিটি থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে। আর ট্রাক ছাড়া এমন অবাধ গতিবিধি আর কারই বা আছে।

 

ঋণস্বীকার :

https://www.pakistantoday.com.pk/

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...