বিহারের ভোট, তেজস্বীর উত্থান এবং কংগ্রেস-সিপিএমের সহমরণের উদ্যোগ

শুভাশিস মৈত্র

 


লেখক সাংবাদিক, গদ্যকার, প্রাবন্ধিক

 

 

 

২০১৯-এর লোকসভা ভোটের পর জম্মু-কাশ্মির থেকে সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করা হয়েছে। জম্মু-কাশ্মিরকে ভেঙে দুটি রাজ্য করা হয়েছে। দুটি রাজ্যকেই আনা হয়েছে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে। আর্বান নকশাল নাম দিয়ে বেশ কয়েক জন প্রথম সারির বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাম মন্দিরের শিলান্যাস করা হয়েছে। বিতর্কিত কৃষিবিল ধ্বনি ভোটে রাজ্যসভায় পাশ করানো হয়েছে। এত কিছুর পর দেখা যাচ্ছে, বিহার বিধানসভা ভোটে, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের থেকে এনডিএ-র ভোট প্রায় ১০ শতাংশ কমে গিয়েছে।

এই কথা বললেই বিজেপি সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, লোকসভা ভোটের থেকে বিধানসভায় এই ভোট কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক ঘটনা। দু-একটা ছোট রাজ্য বাদ দিলে সব রাজ্য-নির্বাচনেই এমন হয়।

কিন্তু তাঁদের যখন প্রশ্ন করা হচ্ছে, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা ভোটে বিজেপি যে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছে, ২০২১-এর বিধানসভা ভোটে সেটা কমে কত হতে পারে? ৩০-৩৫ শতাংশ হতে পারে? দ্বিমুখী লড়াইয়ে কিন্তু ৩০-৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসা যায় না। তখন কিন্তু তাঁরা দাবি করছেন, পশ্চিমবঙ্গে নাকি উল্টো ঘটনা ঘটবে। কী করে সেটা হবে, তার অবশ্য কোনও স্পষ্ট জবাব নেই। তাঁরা এক ধরনের স্বতস্ফূর্ততা বা ওয়েভের আশায় আছেন।

মনে রাখতে হবে বিহার বিধানসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রী একটানা প্রচার করেছেন। তার পরই এই ফল। ভোটে প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান, চিন, রাম মন্দির, পুলওয়ামা সবই বলেছেন। হিন্দুত্ববাদকে সামনে রেখে টানা প্রচার করেছেন যোগী আদিত্যনাথ। এত কিছুর পরেও এনডিএ-র ভোট কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ (একটু বেশিও হতে পারে)। অন্যদিকে সদ্য রাজনীতিতে আসা ৩১ বছরের তেজস্বী যাদবের একক নেতৃত্বে একটি আঞ্চলিক দল আরজেডি নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের নেতৃত্বে থাকা অতি সংগঠিত রাজনৈতিক দল বিজেপির সঙ্গে একটানা সমানে সমানে পাল্লা দিয়ে অবশেষে বিজেপিকে বিহারে জনপ্রিয়তার নিরিখে দুনম্বরে ঠেলে দিয়েছে। এমনটা যে হল তার কারণ, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সমীক্ষা বলছে, এই ভোটে উন্নয়ন, বেকারি এবং মূল্যবৃদ্ধি ছিল প্রথম তিনটি ইস্যু। রাম মন্দির পুলওয়ামা নয়। এর সঙ্গে আরও দুটি তথ্য জরুরি। কম বয়সীদের ভোট এনডিএ-র সঙ্গে সমানভাবে ভাগ করে নিয়েছে মহাজোট। ৬০-এর উপরে যাদের বয়স, তাদের ভোট এনডিএ-র থেকে মহাজোট ৫ শতাংশ বেশি পেয়েছে।

এই ভোটে আসলে হেরেছেন নীতীশ কুমার। নীতীশ কুমারকে হারানোর একটা পরিকল্পনা প্রথম থেকেই ছিল। চিরাগ পাসোয়ানের দল এলজেপি বিজেপির বিরুদ্ধে কোনও প্রার্থী দেয়নি, শুধু নীতীশের দল জেডিইউয়ের বিরুদ্ধে প্রর্থী দিয়েছিল। নিজের দলে টিকিট না পেয়ে, এলজেপির টিকিটে বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতাও প্রার্থী হয়েছিলেন। নীতীশ বার বার অনুরোধ করলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ তাঁদের নির্বাচনী প্রচারে এলজেপির খুব একটা সমালোচনা করেননি। বোঝাই যাচ্ছিল চিরাগ পাসোয়ানের পিছনে বিজেপির কৌশলগত সমর্থন আছে। অন্য দিকে আসাদুদ্দিন ওয়েসির মিম বেশ কিছু আসনে আরজেডি প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছে ভোট কেটে। চিরাগ এবং মিম, দু পক্ষের ভূমিকাতেই উপকৃত হয়েছে বিজেপি। নাহলে এমন হতেও পারত যে, দেখা যেত বিজেপি বিহারে তিন নম্বর দলে পরিণত হয়েছে। সেরকম হলে একটা হাওয়া উঠত যে রাম মন্দির, ৩৭০, কৃষিবিল এসবের পিছনে মানুষের সমর্থন নেই। সেটা বিজেপির পক্ষে অস্বস্তিকর হত। যদিও বাস্তবে ব্যাপারটা তেমনই ঘটেছে। বিহারের ভোট অনেকটাই রুটি, কাপড়, জীবিকার ভোট হয়েছে। আরও একটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত রয়েছে এই ভোটে। কিছুটা হলেও জাত-পাতের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছে বিহারের এই ভোট। হিন্দু-মুসলমান, উগ্র জাতীয়তাবাদ, পাকিস্তান, যুদ্ধের হুঙ্কার, বিজেপির এইসব চিরপরিচিত তাসের ধার যে কিছুটা কমছে, তারও ইঙ্গিত আছে বিহারের এই ভোটে। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যে যে আসনে বিজেপির সঙ্গে আরজেডির সরাসরি লড়াই হয়েছে, তার ৫০ শতাংশের অনেক বেশি আসন দখল করেছে আরজেডি।

বিহারে ভোট কংগ্রেসের রক্তশূন্যতাকে আবার চোখে আঙুল দিয়ে দিখিয়ে দিল। ৭০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ১৯ আসনে জয়। সাফল্যের হার খুবই করুণ। স্থায়ীনেতাহীন ১৩৫ বছরের পুরোনো দলটার অবস্থা এখন জলসাঘরের নায়কের মতো। একথা সবাই বুঝতে পারছেন, শুধু নেহরু-গান্ধি পরিবারের লোকজনেরা বুঝতে পারছেন না। তাঁরা নিজেরাও দায়িত্ব পালন করছেন না, কাউকে জায়গাও ছাড়ছেন না। আর নেহরু পরিবারের পঞ্চম প্রজন্মের নেতা রাহুল নিজে পদ ছাড়তে চাইলেও, দলের স্তাবক-সংস্কৃতি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কংগ্রেস যদি অথর্ব হয়ে যায়, যে অবস্থায় কংগ্রেস প্রায় পৌঁছেই গিয়েছে, তাহলে জাতীয় স্তরে বিজেপির কোনও বিকল্প থাকবে না। সফল হবে বিজেপির কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের স্বপ্ন। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে দেশের প্রায় ৮৯ কোটি ভোটারের মধ্যে ২০১৯-এ বিজেপি ভোট পেয়েছে প্রায় ২৩ কোটি। বিরাট অংশ ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিকমনস্ক ভারতবাসীর কাছে কংগ্রেসের কোমা-প্রাপ্তি মোটেই সুখকর হবে না। জাতীয়স্তরে বিজেপি বিকল্প হিসেবে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ জোট হয়েছে ২০০৪ থেকে। কংগ্রেস যেখানে পৌঁছে গিয়েছে, নেহাত কোনও অলৌকিক ঘটনা না ঘটলে কংগ্রেস সম্ভবত আর কোনও বিকল্প জোটের নেতৃত্ব দেওয়া জায়গায় থাকবে না। জ্যোতি বসু, ভিপি সিংরা প্রয়াত। লালু উজ্জ্বলতা হারিয়েছেন। নীতীশ উল্টো শিবিরে। ফলে ভবিষ্যতে এমন সমস্যা হতে পারে যখন দেখা যাবে, এমন কোনও নেতা নেই যাঁকে ঘিরে জোট হতে পারে। এই রাজনৈতিক সঙ্কট কিন্তু আসছে। প্রায় কোনও আঞ্চলিক দলেরই সর্বভারতীয় পরিচয় নেই। বিজেপির দাপটে আঞ্চলিক দলের নেতারা নিজেদের রাজ্য সামলাতে এত ব্যস্ত যে সর্বভারতীয় ভাবনা আপাতত তাঁদের মাথায়।  আবার এই শূন্যতা পূরণ করতে সুযোগসন্ধানী নীতীশ যে আগামী দিনে ঘর বদলাবেন না, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। এক সময় তো নীতীশকে প্রাইমমিনিস্টারিয়াল ক্যান্ডিডেট ভাবা হয়েছিল। বামপন্থীরা বিহারের ভোটে আগের থেকে ভালো ফল করেছে। মোট ১৬ আসন। তার জন্য অবশ্য তাদের, বিশেষ করে সিপিআই এবং সিপিএমের, তেজস্বী যাদবকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। এর আগে তারা বিহারে একা চলার চেষ্টা করে দেখেছে। তাতে কোনও সুবিধা হয়নি। তবে সিপিআই (এম-এল)-এর সাফল্য আনেকটাই তাদের নিজেদের শক্তিতে। বহু বছর ধরে বিহারে সিপিআই (এম-এল) একটু একটু করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। বিহারের ভোটে দেখা যাচ্ছে সিপিআই ভোট পেয়েছে ০.৮৩ শতাংশ। সিপিএম ০.৬৫ শতাংশ। অন্য দিকে নোটায় ভোট পড়েছে ১.৬৮ শতাংশ।

সিপিএমের সমস্যাটা আরও বড়। তারা বিহারে আরজেডিকে প্রগতিশীল মনে করেন, উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদবের দলকে প্রগতিশীল মনে করেন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেসকে বিজেপির থেকেও বড় প্রতিক্রিয়াশীল দল মনে করেন। যদিও আরজেডি, জেডিউ এই দুটো দলই আসলে সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা যাদব এবং কুর্মি জমিদারদের দল। যে কারণে এই দুই দল কখনও ভূমিসংস্কারের কথা বলে না। ভূমিসংস্কার নীতীশ একবার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেই চেষ্টা শুরু হতেই, ২০০৯ সালের অক্টোবরে, ১৮টি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে ১২টিতে হেরে যায় নীতীশের দল। ভয়ে ভূমিসংস্কার থেকে তিনি পিছিয়ে যান নীতীশ। ভূমিসংস্কার নিয়ে তাঁর সরকারের বন্দ্যোপাধ্যায় কমিটির রিপোর্টে ধুলো পড়ছে।

ভূমিসংস্কারের ফলে পশ্চিমবঙ্গে জমিদারি ব্যবস্থা নেই। ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে জমিদারদের দল বলা যাবে না। টাটা-তাড়ানো মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে প্রায় কোনও বড় শিল্পই আসেনি। মমতাকে শিল্পপতিদের দলও বলা যাবে না। খুব বেশি হলে বলা যেতে পারে মধ্য এবং নিম্নবিত্ত বাঙালি এবং গরিব কৃষকদের দল। মমতা সরকারের দোষ-ত্রুটি নিয়ে এখানে আলোচনা করছি না। সেসব সবার জানা। কিন্তু সিপিএম নেতারা যে বলছেন, তৃণমূল কংগ্রেসই তাদের প্রধান শত্রু, তৃণমূলকেই তাঁরা হারাতে চান, সঙ্গে বিজেপিকেও, এই কথাটা দুর্বল রাজনৈতিক কৌশল। শেষ উপনির্বাচনগুলির ফল দেখলে বোঝা যায়, বিজেপিকে দিয়ে-থুয়ে সিপিএমে হাতে এখন ৫-৭ শতাংশ ভোট পড়ে আছে। ২০২১-এর নির্বাচনে সেটাও রক্ষা করা বেশ চ্যালেঞ্জিং কাজ হয়ে উঠতে পারে। বিজেপিকে ঠেকাতে সিপিএম তৃণমূলের সঙ্গে জোট বেঁধে মহাজোট তৈরি করুক, যেমন বিহারে ২০১৫-তে হয়েছিল, এমন প্রস্তাব আসছে। এই প্রস্তাবে পত্রপাঠ না করেছে আলিমুদ্দিন। এই না-এর পিছনে ততটা রাজনীতি নেই যতটা অপমানের জ্বালা আছে। গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের ভোট কমেনি, বেড়েছিল। কিন্তু বিজেপির যে বিপুল ভোট বৃদ্ধি, মূলত হিন্দু-বামদের ভোটেই সেটা হয়েছিল। সিপিএমের মত একটা সংগঠিত দলকে তৃণমূলনেত্রী যেভাবে প্রায় একক প্রচেষ্টায় ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করেছিল ২০১১তে, সম্ভবত তার একটা বদলা দেখতে চান এই পদ্মমুখী বামেরা। এটা অনেকটা কামারকে দিয়ে চোরের সিঁধকাঠি তৈরি করানোর মতো। গল্পে আছে, চোর নাকি কামারের বাড়ির সামনে লোহা আর টাকা রেখে চলে যায়। দেখা করে না। কামারও সিঁধকাঠি বানিয়ে রেখে আসে। চোর লুকিয়ে এসে সেটা নিয়ে চলে যায়। অলিখিত বোঝাপড়া। অনেকে একটা অন্য যুক্তি দিচ্ছেন। তৃণমূলের হাতে ‘বাম কর্মী’দের মৃত্যুর খতিয়ান দিয়ে তাঁরা বলছেন, এর পর কীভাবে সমর্থন সম্ভব? পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য যে এখানে ঘোষিতভাবে বা অঘোষিতভাবে হিংসার রাজনীতির চর্চা চলছে বহুদিন ধরে। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের পকেটে ওইরকম দীর্ঘ শহিদ-তালিকা রয়েছে, যা বেড়েই চলেছে। সেই যুক্তিতে তো কংগ্রেস-বাম জোটও হয় না!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...