তিনটি অণুগল্প

সাধন দাস

 

ঝাউগাছ

বলো, কোন গাছের প্রাণের শ্বাসে
হাতে হাতে শিল্পী হাসে,
কোন কোন শাখে
ভাস্কর্য জাগে?

ক্লান্ত নাবিকের দূরচোখে ভেসে ওঠে শহরের শীর্ষ স্পন্দিত ঝাউ। শ্রমদীপ্ত জাহাজের স্পর্ধা, কম্পাসে সবুজ রেখে এগিয়ে আসে। জলমরু নাবিকেরা ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত।

–পরিশ্রান্ত নাবিকেরা অরণ্য শহরে স্বাগত।

ঝাউগাছ মাতৃস্নেহে ঝিরি ঝিরি সুরে সন্ধ্যায় ঘুম দেয়, ঝোড়োস্বরে সকালে শ্রমস্পর্ধা দেয়।

অনেক দিন আগের কথা, শিল্পীরা তখন ডুবুরি। তাঁদের পূর্বপুরুষেরা সমুদ্রের অতলে রত্ন খুঁজতে এসে শিল্পী হয়ে ফিরেছেন।

শহরের শিল্পী এক মূর্তি বানাবেন। তিনি ওই ঝাউগাছের আদিম ঋজু ঊর্দ্ধগামী কাণ্ডকেই বেছে নিলেন।

দিগন্তজোরা উত্তেজনা। সমুদ্র, বালুচর, শহর ঝুঁকে পড়েছে। কৌতূহলে উপচে উঠেছে ঊর্ম্মিমালা, ঝাঁক ঝাঁক বালুকণা, মানুষে মানুষ।

–কার মূর্তি? কী মূর্তি? কেন বানাবেন?

দিন নেই, রাত নেই, কুড়ুলে, বাটালে, হাতুড়িতে  ঠকাস ঠকাস… স্থলে জলে রাত্রি নিশিথে ঘুমের ভিতরে মানুষ চমকে, চমকে ওঠে। বৃক্ষের প্রতিমালয় রুদ্ধ। মূর্তি সম্পূর্ণ হওয়ার আগে দেখার অনুমতি নেই। তবু উঁকিঝুঁকি তবু উল্লম্ফন।

হাতুড়ির শব্দ ম্লান হয়ে এল। কাল ভোরে মূর্তি উন্মোচন হবে। সারারাত নির্মাণের সুর আর সমুদ্রের উল্লাসে শহরে ঘুম এল না।

ঝাউকাণ্ডে ফুটে উঠেছে এক মানব। শিল্পীর তরুপুত্র। তার এক হাতে হাতুড়ি। অন্যহাতে বাটালি, কুঁদে চলেছে এক ঝাউ শাখাকাণ্ড। সে কাণ্ডে তরুশিল্পীর তরুপুত্র, তার এক হাতে হাতুড়ি আর হাতে বাটালি… সে কুঁদে চলেছে আর এক তরুপুত্র এবং সে এবং সে…

কৌতূহলীরা যেমন ঝাউয়ের ভূমিতে দেখেছিলেন খোদাইকর শিল্পীকে, সে জীবন্ত মূর্তির অনন্ত ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা।

জীবন্ত গাছের প্রাণ প্রবাহে শিল্প প্রাণিত হয়ে চলেছে, ঠকাস… ঠকাস… গাছ থেকে গাছে, অরণ্য থেকে অরণ্যে। মুখরিত শব্দ মাখামাখি মানুষের ভীড়ে ভীড়াক্কার। চাষি চাষিনী এসেছেন সন্তানের হাত ধরে। শিক্ষক এসেছেন হাতে-কলমে ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে, শ্রমিকনেতৃত্ব হাত তুলে সংগঠিত মিছিলের আগে।

সবাই মুগ্ধ। সকলেই একবার দেখে তরুপুত্র একবার দেখেন আপন সন্তান!

কেউ কেউ খুঁজলেন শিল্পীকে। কোথায়! তিনি নেই। হতেই পারে না। জনসমুদ্রেই আছেন। খোঁজ খোঁজ। সকলেই পরষ্পরের মুখে চেয়ে ভাবছেন তিনি কোথায়?

 

দাঙ্গা

গঞ্জের হাটে খাইছে মিঞার লগে গিলছা হিঁদুর লড়াই লাগছে।

–কতোডি অসোগোল্লা খাইতে পারবি?
–তুই যা খাইবি আমি একখান বেশি গিলব।
–যা যা, তুই যা গিলবি আমি একখান বেশি খাইব।

খাওয়া আর গেলা, দুই পক্ষে ভীড়ে ভীড়াক্কার। দাঙ্গা বাঁধল।

দুইজনে একসঙ্গে শুরু করলো খাওয়া আর গেলা। যে হারবে হেই বিটাই হগ্‌গল পয়সা দিবে।

হুলিয়া দিয়া খাওন আর গেলন চলছে। একজন শুরু করে,

–আল্লায় এক, আল্লায় দুই, আল্লায় তিন….

আর একজন শুরু করে,

— সয়ারাম, সয়াদুই, সয়াতিন…. খাওয়া, গেলা চলছে।

খাইছে মিঞা যহন আল্লায় শ, গিলছা হিদু কইল,
–না। তুর নিরেনব্বই হইছে।
–না, শ হইছে। আল্লার কিরা।
–না। নিরেনব্বই। রামের দিব্বি।
–না। শ।
–না। নিরেনব্বই।
–দুত্তোর, শ না নিরেনব্বই! গুলি মারো।
–তুই ফির গুন।

আল্লায় রাম, আল্লায় দুই, আল্লায় তিন….

পড়ুয়াগণ মাপ করিবেন। গল্পের শেষ না জানিয়া শুরু করিয়াছি, অতঃপর…

গিলছা হিদু খালি বইয়া আর কী আকাম করে। সেও ফিরে ফিরতে শুরু করে,

রামে রাম, রামে দুই রামে তিন….

কেউ হারে না। শেষে হার মানল ময়রা। অসগোল্লার কড়াই ফুড়ুত। গাঁয়ে নেংটি-গরিব ছাড়া ধনীব্যক্তি কেহ নাই। ময়রারে তো মারণ যায় না! এহন বাবু লোকেরা মজা কইরা তো দাঙ্গা দ্যাখলেন। এহন কন দাম দিবে কে?

(বাবার কাছে শোনা গল্প )

 

বিড়ির আগুন

বাড়ির জঙ্গলে একটা জুঁইগাছ ছিল, শুকিয়ে গেছে।

গাছটি মার সই ছিল। ডালপালা ভর্তি সবুজ পাতাদের সঙ্গে মা অজস্র কথা বলতেন। কথার ফাঁকে ফুরসত পেলেই ফুলেদের সঙ্গে হাসতেন। বাবা জুঁইগাছের ছায়ায় বসে বিড়ি খেতেন।

সূর্য ডুবে গেলে, মা গা ধুয়ে, চুল ঝেড়ে, সূর্যের মতো বড়ো টিপ পরে তুলসি তলায় প্রদীপ দিতেন, শঙ্খ বাজাতেন, গোয়ালে সাঁজাল দিতেন। প্রতিবেশি, গাছগাছালি, পাখপাখি আর আমাদের সঙ্গে সবুজ পাতাদের মতো অজস্র কথা বলতেন। ফুল ফোটার শব্দে হেসে উঠতেন। আপন মনে গান গাইতেন। জুঁইফুল আর বাবার বিড়ির মিষ্টি গন্ধের রাগ-অভিমান বাড়িময় ম ম করত।

বাবার খুব কাশি হয়েছে। কাশতে কাশতে নাজেহাল। মশারির মধ্যে উঠে বসে থাকেন। বুকের হাপর ওঠা নামা করে। ঘুম আসে না। অন্ধকারে বিড়ি খান আর কাশেন। বিড়ির আগুন আমার পড়ার টেবিল থেকে দেখা যায়। আগুন জ্বলছে নিভছে।

দিদি বকে— অত কাশি! তোমার বিড়ি খাবার দরকার কি?

বাবা চুপচাপ বিড়িতে টান দেন। আগুন চাগিয়ে ওঠে। কাশির দমক ঠেকাতে পারেন না। দিদি আবার বকে। তখন বাবা চেঁচিয়ে ওঠেন— মোদোমাতালটাকে বে করলি বিড়ি খাব না তো কী করব?

রাত বাড়ে। বাবা কাশেন। কিছু বলি না। মশারির পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। ছায়ার মতন। বাবার হাতে আগুন জ্বলতেই থাকে।

–তোর একটা চাকরি হলেই দেখিস খোকা, বিড়ি খাওয়াটা ছেড়ে দেব।

রাত ফুরোয় না। বিড়ির আগুন জ্বলতেই থাকে। বাবা পাশের ঘরের দুয়োর ধরে দাঁড়ান। ও ঘরে মা শয্যাশায়ী। অস্থিচর্মসার। চোখ দুটো সম্বল শুকনো জুঁইয়ের মতো। ও ঘরে আলো নেই। বাবার ছায়া পড়ে না।

কণ্ঠস্বর শোনা যায়— জুঁইকাঠে তোমার সম্পূর্ণ দাহ হবে না। তবে শেষ বিড়িটা ধরানো যাবে। দেখো, তারপর আর খাব না। দেখে নিও।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...