চলুন বিজেপিকে এনে বাংলাকে দাঙ্গা-অনার কিলিং-দলিত হত্যা-জাতপাত-নারী স্বাধীনতাহীনতা-কন্যাভ্রূণ হত্যার স্বর্গভূমি গুজরাট বানাই

শৈলেন সরকার   

 


গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

লকডাউনের মধ্যে অর্থাৎ ২০২০-র ২০ জুন ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহের একটি টুইট ঘিরে ভারত জুড়ে তুমুল উত্তেজনা তৈরি হয়। এই উত্তেজনার অভিঘাত বাংলায় এসে তেমনভাবে না পোঁছালেও পুরো উত্তর ও পশ্চিম ভারত কিছুদিনের জন্য প্রিন্ট ও টিভি মিডিয়া আর সামাজিক মাধ্যমগুলিতে একেবারে টগবগ করে ফুটছিল। মজার বিষয়টি হল বাংলায় সেই টুইটের উত্তেজনা এসে না পৌঁছালেও টুইটের বিষয় ছিল কিন্তু বাংলা। আরও ভাল করে বললে, বাংলা ও গুজরাটের তুলনা। হ্যাঁ, বাংলার সঙ্গে যে রাজ্যের তুলনা এনে বিজেপি-র দিলীপ ঘোষেরা ইদানীং দাবি করছেন, যে একবার তাদের জিতিয়ে দিলে তারা বাংলাকে স্বর্গরাজ্য গুজরাটে রূপান্তরিত করবেন।

ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহের সেই বাংলা আর গুজরাটের তুলনা এখানকার বিজেপি-র নেতানেত্রীরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিলেন, কিন্তু লক্ষ করেও চোখ বুঁজে থাকা ছাড়া তাদের কোনও উপায় ছিল না। কেউ বাঙালিদের নিয়ে ভাল কিছু বললে তাদের গোঁসা হয়, তাদের চোখে শুধু গুজরাট। অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদি, আদানি, আম্বানি, হ্যাঁ আর আছেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। তাঁর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মূর্তি বানিয়ে আনা হবে চিন থেকে। বিশাল জায়গা থেকে আদিবাসী উৎখাত করে বসানো হবে সেই মূর্তি।  তারা তো এক বাঙালির নোবেল বিজয়ে আনন্দ না পেয়ে বরং খুব দুঃখিতই হয়েছিলেন। বললেন, ওই পুরস্কার নাকি অভিজিৎবাবুর অর্থনীতির উপর কাজের জন্য নয়, পেয়েছেন তাঁর বিদেশি স্ত্রীর জন্য। আর অমর্ত্য সেনকে নিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মন্তব্য মনে আছে? হ্যাঁ, দিলীপ ঘোষের কথায় উনি ‘মেরুদণ্ডহীন, তাঁকে বেচা যায় আবার কেনাও যায়।’ ওদের কেন্দ্রীয় নেতাদেরও অমর্ত্য সেন বা অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে বাঘা বাঘা সব মন্তব্য আছে। ওরা এমনকী নেতাজী সুভাষচন্দ্রের মাথার উপরে রেখেছেন বিজেপি-র পূর্বসূরী জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদকে। বাঙালির যা কিছু গৌরবের যা কিছু সুখের তা সবই তাদের অপছন্দের। যেমন বিজেপি-র নেতা মেঘালয়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বলে বসলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে বাস করে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে সমর্থন করা কেন?’ সবচেয়ে বড় কথা পশ্চিমবঙ্গে তাদের অভিযানের সূচনাই হয়েছিল বাঙালির ভালবাসা ও গর্বের মানুষ বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে।

এবার আসা যাক রামচন্দ্র গুহের সেই টুইট প্রসঙ্গে। কী ছিল সেই টুইটে, যে টুইট নিয়ে কুখ্যাত ‘গোদি’ চ্যানেলগুলিকে দিনের পর দিন ‘করোনা’র খবর পাশে সরিয়ে রেখে একেবারে প্রাইম টাইমে টক-শো বসিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা খরচ করতে হচ্ছিল। এবং সবাই মিলে একটা বিষয়ে একমতও হচ্ছিলেন যে, শুধুমাত্র এই কথাটি বলার জন্যই রামচন্দ্র গুহ একজন অ্যান্টি ন্যাশনাল অর্থাৎ দেশবিরোধী।

কী ছিল রামচন্দ্র গুহের সেই টুইটে যে জন্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানি থেকে কংগ্রেসের আহমেদভাই প্যাটেল বা অভিনেতা পরেশ রাওয়াল সবাইকে গলা ফাটাতে হয়েছিল? রামচন্দ্র গুহ সেই টুইটে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ফিলিপ স্প্র্যাটের ১৯৩৯ সালে করা একটি উক্তি উদ্ধৃত করেন। যেখানে ঐতিহাসিক ফিলিপ স্প্র্যাট বলেছিলেন, ‘গুজরাট যদিও অর্থনৈতিক দিক থেকে এগিয়ে আছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে।… বিপরীত দিকে বাংলা অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকলেও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এগিয়ে।’ হ্যাঁ, শুধু এই উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করার জন্য রামচন্দ্র গুহকে একেবারে ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’ বা দেশবিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়া হল। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানি বললেন, ‘আগে ব্রিটিশরা বিভেদের রাজনীতি ব্যবহার করত, এখন একশ্রেণির ‘এলিট’ তাই করছেন।’ তবে একটি সংবাদ চ্যানেলের মন্তব্যের জায়গায় এক মহিলা (বাঙালি নয়) লিখলেন, ‘আপনারা সবাই মিলে বছরের পর বছর যখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলা গুজরাটের চেয়ে পিছিয়ে বলে উল্লাস প্রকাশ করেন সেটা অ্যান্টিন্যাশনাল হয় না, আর এখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলা গুজরাটের চেয়ে পিছিয়ে বলার পর সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বাংলা গুজরাটের চেয়ে এগিয়ে— এ কথা বলা মাত্র যিনি বললেন তিনি অ্যান্টিন্যাশনাল হয়ে গেলেন?’ মন্তব্যে ভদ্রমহিলা এরপর যোগ করলেন, ‘অর্থাৎ আপনাদের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা গেল, অর্থনীতি নয়, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল সংস্কৃতি।’

অর্থাৎ চ্যানেলের মন্তব্যের জায়গায় সেই ভদ্রমহিলার করা মন্তব্য ধরলে, সংস্কৃতি। অর্থনৈতিক উন্নতি হয়তো একটা অঞ্চল চেষ্টা করে করতে পারে, কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রের এই উন্নয়ন খুব সহজে হওয়ার নয়। এর সবকিছুই নির্ভর করছে একটি অঞ্চলের ইতিহাসের উপর, দীর্ঘদিনের লালন করা সংস্কৃতির উপর।

আসা যাক ধর্মীয় বিদ্বেষ জনিত কারণে দাঙ্গা নিয়ে আলোচনায়। ধর্মীয় বিদ্বেষজনিত কারণে দাঙ্গায় প্রথম স্থানে অবশ্যই থাকবে উত্তরপ্রদেশ। কিন্তু দিলীপ ঘোষদের স্বর্গধাম গুজরাট থাকবে একেবারে দ্বিতীয় স্থানে, উত্তরপ্রদেশের গায়ে গায়ে। প্রসঙ্গত এই গুজরাটে শুধু যে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা হয়েছে তা নয়, হয়েছে হিন্দু উচ্চবর্ণ পাতিদারদের (প্যাটেল) সঙ্গে কায়স্থ (উচ্চবর্ণ হিন্দু নয়), হরিজন এমনকী আদিবাসীদের সঙ্গেও। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে গুজরাটে দাঙ্গা হয়েছে ৭৮৯টি। তার মধ্যে শহরাঞ্চলে হয়েছে ৬৮৫টি ও গ্রাম অঞ্চলে ১১৪টি। ’৬১ থেকে ’৭১ পর্যন্ত দশ বছরে হওয়া শহুরে অঞ্চলের ৬৮৫টি দাঙ্গার মধ্যে ৫৭৮টিই হয়েছে ১৯৬৯ সালে। আহমেদাবাদ থেকে শুরু হয়ে ছড়িয়েছে চারপাশে ছড়িয়েছে একেবারে বরোদা পর্যন্ত। (কনসার্নড সিটিজেনস ট্রাইবিউনাল ২০০২)। ‘বিজেপি-র পূর্বসূরি জনসঙ্ঘীদের স্লোগানে রাস্তা কেঁপে উঠেছিল। এই স্লোগান ও মিছিলের দল দাবী করেছিল, এই হত্যাকাণ্ড ১৯৪৬ সালের প্রতিশোধ। প্রসঙ্গত এই ১৯৬৯-এর দাঙ্গায় নিহত হয়েছিল অন্তত ১১০০ জন।’ (কনসার্নড সিটিজেনস ট্রাইবিউনাল ২০০২)। এরপর ১৯৮১ সালে শুরু হল সংরক্ষণ বিরোধী দাঙ্গা। এটি ছিল কায়স্থ (উচ্চবর্ণ হিন্দু নয়), হরিজন, আদিবাসী ও মুসলিমদের সরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণের বিরোধিতা করে। আহমেদাবাদ শহরে নিহত হন ১১ জন। (ইন্ডিয়া টুডে ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১)। উচ্চবর্ণের মানুষদের প্ররোচনায় এই দাঙ্গায় মোট নিহত হন অন্তত ৫০ জন, নিহতরা প্রধানত নিম্নবর্ণের মানুষ (উইকিপিডিয়া)। এরপর ফের ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট। এবারও উচ্চবর্ণের মানুষদের প্ররোচনায় ঘটা দাঙ্গায় নিহত হন অন্তত ২২০ থেকে ২৭৫ জন। ‘আক্রান্ত হন প্রধানত আদিবাসীরা। তখনকার সরকার নিয়োজিত তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে দাঙ্গার হিংসা ছড়ানোর মূলে ভূমিকা নিয়েছিল অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও রাজনৈতিক দল বিজেপি।’ (উইকিপিডিয়া)। এমনকী পুলিশ বিদ্রোহ করে সরাসরি এই দাঙ্গায় অংশ নিয়ে নেয়। পুলিশ নিজেই আহমেদাবাদে গুজরাট সমাচার নামের একটি পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয় (কনসার্নড সিটিজেনস ট্রাইবিউনাল ২০০২)। এরপর ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই গুজরাটে দাঙ্গার সংখ্যা ১০৬ (কনসার্নড সিটিজেনস ট্রাইবিউনাল ২০০২)। এই গুজরাট থেকেই এল কে আদবানি ১৯৯০ সালে তাঁর বিখ্যাত রথযাত্রা শুরু করেন। আর এই ১৯৯০ সালেই গণেশ বিসর্জন নিয়ে বরোদাতে হল এই শহরের ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম দাঙ্গা। এরপরই এল কে আদবানির রথযাত্রা ও ১৯৯২ সালের কুখ্যাত সুরাট দাঙ্গা, যাতে মারা যায় অন্তত ২০০ জন। এবং সর্বোপরি ২০০২-এর যাতে মারা যায় অন্তত ২০০০ জন। না, সেই কুখ্যাত দাঙ্গার পরও গুজরাটের দাঙ্গা শেষ হয়নি। এবার ২০০৬, স্থান ভদোদরা। এরপর ভরোচ, সন ২০১৫।

এখন কথা হল, একটি রাজ্য সামগ্রিকভাবে ভয়ঙ্কর দাঙ্গাপ্রবণ রাজ্যে পরিণত হল কীভাবে। ২০০২ সালের ২২ নভেম্বর তারিখের ‘আউটলুক’ পত্রিকায় ‘হিস্টরি অব কমিউনাল ভায়োলেন্স ইন গুজরাট’ প্রবন্ধে ‘কনসার্ন সিটিজেন্স ট্রাইবিউনাল— গুজরাট ২০০২’ এর রিপোর্ট উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ৯০-এর দশকে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের প্রচারে প্রচারে গুজরাটি সমাজের অন্তঃস্তলে ঘৃণ্য বিদ্বেষের বীজ একেবারে স্থায়ীভাবে বপন করে দেয়। আদিবাসীদের মধ্যে তৈরি করে দেয় হিন্দু ও খ্রিশ্চানদের মধ্যে বিদ্বেষের বীজ। প্রতিবেদনে আরও লেখা হয়েছে, আদিবাসী এলাকায় আগে বিজেপি-র ক্ষমতা ছিল সীমিত, কিন্তু এবার বিজেপি আদিবাসীদের বিভিন্ন উৎসবে ওদের তলোয়ার বা ত্রিশূল দেওয়া শুরু করল। মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ওদের বিরুদ্ধে ঘৃণার প্রচার শুরু করল।

খুবই মজার বিষয় আমাদের পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বা তাদের শাখা সংগঠনগুলিকে এভাবেই কিন্তু বছরের পর বছর মানুষের মনে ঘৃণার বীজ বপন করতে দেখছি। ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গার পর ফের পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গার উল্লেখ পাই ১৯৯২ সালে। রাম জন্মভূমি নিয়ে। আমাদের সিপিএম-তৃণমূলের সুবিধাবাদের প্রশ্রয়ে বিজেপি তখন বাংলায় বলতে গেলে আশ্রয় পেয়ে গেছে। আর এবার ২০১১-র সিপিএমের পরাজয় ও হাল ছেড়ে দেওয়ার পরপরই আমরা দেখব হতাশ বামবাহিনী একেবারে রে-রে করে ত্রিশূল নিয়ে রামের হয়ে আসরে নেমে পড়েছে। আর খুব ছোট আকারের হলেও ২০১৩ থেকে ২০২০-এর মধ্যে ক্যানিং, কালিয়াচক, বসিরহাট বা নদিয়ায় সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘর্ষ (পূর্বে উল্লেখিত দাঙ্গাগুলির তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে, ও ক্ষয়ক্ষতিও নগণ্য)। এই বাংলায় বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের ছক সেই একই। মুসলিমদের বিরুদ্ধে বানিয়ে বানিয়ে হাজার মিথ্যা গল্প, এবং ঘৃণা, ঘৃণা শুধু ঘৃণা। এবং সুযোগ পেলেই দাঙ্গার স্ফুলিঙ্গ। ৯০-এর দশকে ইন্টারনেট, গুগল, ইউটিউব বা ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ ছিল না। আর এত টাকাও ছিল না। এখন এই দলের হাতে হাজার-হাজার কোটি টাকা। এই টাকা ও সামাজিক মাধ্যমের মিথ্যার বেসাতি নিয়ে দলটা বাংলা জয়ের জন্য দরকারে নোংরামির পাতালে প্রবেশ করবে। আর সবচেয়ে বড় কথা ভাষা আর যে সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালির গর্ব, সেই ভাষা আর সংস্কৃতিকে দলটা একেবারে গোমূত্র দিয়ে ধুয়ে দেবে।

এবার বিজেপিলালিত সংস্কৃতির আর এক চিহ্ন ‘অনার কিলিং’ প্রসঙ্গে আসা যাক। বিজেপিলালিত অর্থে বিজেপি যে সংস্কৃতির ভরণপোষণ করে। হ্যাঁ, জাতপাত। সেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্রের গল্প। না, জাতপাতের প্রশ্ন ঠিক এতটাও সহজ নয় আর। প্রত্যেক জাতের মধ্যে এতদিনে তৈরি হয়েছে আরও যাকে বলে উপ-জাত। অর্থাৎ শুধু জাতগুলির মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা নয়, ঘৃণা আছে জাতের উপ-জাতগুলির মধ্যেও। তবে হ্যাঁ, দলিতদের প্রতি ঘৃণার কমতি থাকবে না কারও। এই সংস্কৃতিতে জাতপাতের প্রশ্নে ভিন্ন জাত বা উপ-জাতের বিবাহেচ্ছু পুরুষ-নারীর দুজনকেই তাদের পরিবার নিজেদের সম্মান রক্ষার জন্য নিজেরাই বা লোক লাগিয়ে হত্যা করবে। এটি উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, হরিয়ানায় একেবারে সামাজিকভাবে সমর্থিত। এই ২০২০ সালেও উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট বা হরিয়ানায় নেহাত চাপে না পড়লে থানা-পুলিশও নির্যাতিতের অভিযোগ নেবে না। দিলীপ ঘোষদের সোনার রাজ্য গুজরাটে গত ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই অনার কিলিং-এ ৩ নম্বর অবস্থানে ছিল। হ্যাঁ, পুলিশ রিপোর্ট অনুসারে, শুধু ২০১৪ থেকে ২০১৬-এর মধ্যে ভিনজাতের ছেলেমেয়ের প্রেমের জন্য নিজেদের পরিবারের হাতে খুন হয়েছে ৩০ জন। প্রথম স্থানে যথারীতি আরেক সোনার রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। যোগীরাজ আদিত্যনাথের রাজ্যে মাত্র তিন বছরেই সেখানে নিহতের সংখ্যা ১৪৮। দ্বিতীয় স্থানে আর এক সোনার রাজ্য মধ্যপ্রদেশ। সেখানে খুনের সংখ্যা ৩৪। যে বামমার্গীরা তৃণমূলের উপর রাগ দেখিয়ে বা নিজের দলের প্রতি হতাশায় বিজেপিকে সমর্থণ করতে যাচ্ছেন, তারা কিন্তু বিজেপি-সমর্থিত সংস্কৃতির এই দাঙ্গা বা ‘অনার কিলিং’-এর সংস্কৃতিকেও নিজের ঘরের এনে ঢোকাচ্ছেন।

এবার আসা যাক বিজেপিওয়ালাদের আর এক সংস্কৃতি লিঙ্গবৈষম্য বিষয়ে। এশিয়া ডট আইটি-র ২৭ জুলাই ২০১৩-তে নির্মলা কার্ভালহো দিলীপ ঘোষদের স্বর্গরাজ্য গুজরাটের লিঙ্গবৈষম্য ও কন্যাভ্রূণ হত্যা প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিবেদনের হেডিং দিয়েছেন ‘১২০০০ শিশুকন্যাকে হত্যা করা হয়েছে শুধু গুজরাটের শহরাঞ্চলে’। মূল প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, অশিক্ষা, দারিদ্র বা স্বাস্থ্যব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা— এদের কোনও কিছু দিয়েই গত তিনবছরে শুধুমাত্র শহরাঞ্চলে ০ থেকে ১ বছরের আয়ুসীমায় এই বিপুল সংখ্যক শিশুকন্যার মৃত্যুর ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। তাঁর মতে, সমস্যাটা আসলে সংস্কৃতির, এখানকার সমাজে নারীরা বিপুল বৈষম্যের শিকার।  গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরকেন্দ্রিক এক জেশুইট মিশনের মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত ফাদার সেড্রিক প্রকাশ এশিয়া নিউজকে জানান, ‘সমস্যাটা আসলে এখানকার মানুষজনের পালন করা নীতি ও আদর্শের প্রতিফলন মাত্র। এখানকার সমাজে মেয়েদের চাওয়া হয় না, মেয়েদের এখানে অত্যন্ত খাটোভাবে দেখা হয়। পুরো গুজরাট জুড়েই মেয়েদেরকে রীতিমতো পরিশ্রমের কাজগুলি করতে হয়, অত্যন্ত কম ক্ষেত্রেই মেয়েরা পড়াশুনো করে কর্মক্ষেত্রে আসে, কোনও কর্মক্ষেত্রের উচ্চপদে মেয়েদের খুঁজে পাওয়াই ভার। তাঁর মতে রাজনীতিতেও একই অবস্থা, বর্তমান মন্ত্রীসভায় মহিলা মন্ত্রীর সংখ্যা মাত্র ২।’

গত ২০১৯ সালের মার্চ মাসে নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের উচ্চবর্ণ শ্রেণি পাতিদারদের এক সম্মেলনে কন্যাভ্রূণ হত্যা বন্ধে আবেদন জানান। ভাবুন একবার পাতিদারদের এক সম্মেলনে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে কী নিয়ে আবেদন করতে হচ্ছে? না, কন্যভ্রূণ হত্যা বন্ধ করা নিয়ে। কিন্তু কন্যাভ্রূণ হত্যা হচ্ছে কীভাবে? মাতৃগর্ভে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের পরীক্ষা আইনত নিষিদ্ধ না? হ্যাঁ, নিষিদ্ধ, কিন্তু একথা খোদ প্রধানমন্ত্রীরও জানা যে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পাতিদার সমাজ তা মানছে না। বা, এই সমাজের এতটাই প্রতাপ যে এই নিয়ম মানতে বাধ্যও করা যাচ্ছে না। আর এত যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ মোদি-অমিত শাহ জুটি— তাঁরাও এই ক্ষেত্রে কোনও আইনি পদক্ষেপের কথা না বলে কাকুতি-মিনতির রাস্তায় হাঁটছেন। অর্থাৎ পাদ্রি ফাদার সেড্রিক তাহলে ঠিকই বলেছিলেন, সমস্যাটা সংস্কৃতির।

এবার একেবারে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আয়োগের একটি রিপোর্ট দেখা যাক। ২০১০ থেকে ২০১২-র মধ্যে গুজরাটের ০ থেকে ৬ বছরের মধ্যে প্রতি ১০০০ শিশুপুত্র পিছু কন্য সন্তান ছিল ৯০৯, ২০১১ থেকে ২০১৩-র মধ্যে সংখ্যা প্রায় একই রইল অর্থাৎ শিশুকন্যার সংখ্যা হল ৯১১, কিন্তু ২০১২ থেকে ২০১৪-র মধ্যে তা কমে গিয়ে দাঁড়াল ৯০৭, এরপর ২০১৩ থেকে ২০১৫-র মধ্যে অর্থাৎ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন আরও শক্তিশালী হয়ে একেবারে গোটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন তখন প্রতি হাজার ০ থেকে ৬ বছর বয়সের শিশুপুত্র পিছু শিশুকন্যার সংখ্যা একেবারে ধপাস করে নেমে দাঁড়াল ৮৫৪-তে। হ্যাঁ, দিলীপ ঘোষদের চোখে অনুন্নত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের পরিসংখ্যান তো অবশ্যই জানার ইচ্ছা হবে। সংখ্যাগুলি যথাক্রমে ৯৪৪, ৯৪৩, ৯৫২, ৯৫১।

এখানে দাঙ্গা, অনার কিলিং, দলিত হত্যা বা কন্যাভ্রূণ হত্যার বছরওয়ারি পরিসংখ্যান দেখলে পরিস্কার দেখা যাবে, দাঙ্গা, অনার কিলিং, জাতপাতের হিংসা, দলিত হত্যা বা কন্যাভ্রূণ হত্যা ভারতের উত্তর বা পশ্চিম অঞ্চলের কিছু রাজ্যের একেবারে সংস্কৃতির অন্তর্গত। কিন্তু অবাক হয়ে দেখার, এই সব কিছুই আবার সেই সব রাজ্যে বিজেপি সরকারে আসার পর বা জাঁকিয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে উপরে উল্লেখ করা দাঙ্গা, অনার কিলিং, জাতপাতের হিংসা, দলিত হত্যা বা কন্যাভ্রূণ হত্যা একেবারে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। আমরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অবশ্যই হতভাগ্য, গুজরাটের মতো সৌভাগ্য করে আসিনি আমরা, তবে দিলীপ ঘোষ যখন পশ্চিমবঙ্গকে গুজরাটের স্বর্গে উন্নীত করবেন বলেছেন, আমরাও বাদ যাব না। ওদের ক্ষমতা লাভের সঙ্গে সঙ্গেই কোনও সন্দেহ নেই পশ্চিমবঙ্গও দাঙ্গা, অনার কিলিং, জাতপাতের হিংসা, দলিত হত্যা বা কন্যাভ্রূণ হত্যার মতো সৎ (?) কাজের স্বর্গভূমিতে পরিণত হবে।

সামনে ২০২১-এর নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী মোদি শুরুর সেই বিদ্যাসাগরের মুর্তি ভাঙার কথা ভুলে বাংলার গুণী মানুষজনদের নাম কীর্তন শুরু করেছেন। বিবেকানন্দ বা নেতাজি সুভাষ তো ছিলেনই, এবার ছেলেভুলানোদের মতো করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ এবং এমনকী বাঙালির ভুলে যাওয়া কবি মনোমোহন বসুও। শোনা যাচ্ছে তারা আনবেন, রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর বা অক্ষয়চন্দ্র দত্তকেও। ধর্ম আর জাতপাতের বিভাজনে বিশ্বাসী বিজেপি-ওয়ালাদের মুখে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়চন্দ্র দত্ত, রবীন্দ্রনাথ। মূর্খের কী বা দিন কী বা রাত।

হাতে আছে হাজার হাজার কোটি টাকা, আছে আদানি-আম্বানিরা। আছে কুক্ষিগত করা সবকটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। আর আছে ‘শরীর ও মনে জং ধরা’ হতাশ বামপন্থীরা। তারা চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খেতে চাইছেন। যেন মাটিতে ভাত খেলেই চোরের উৎপাতের হাত থেকে বাঁচবেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে এই বামপন্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে ঝাঁপ দেবেন না।’ বাম নেতারা ৩৫ বছর ধরে টানা রাজ্য শাসনের পর মাত্র ১০ বছর সিংহাসনের বাইরে থেকেই হা-হুতাশ শুরু করেছেন। যে বামেরা সেই ৪০-৫০-৬০-৭০-এর দশকে শ্রমিক-কৃষকের জন্য লড়ে গিয়েছিলেন, তারা আজ ফের কত দ্রুত সিংহাসন ফেরত পাবেন সেই দিবাস্বপ্ন দেখছেন। অথচ আজকের এই সিপিএম-সিপিআই-এর পূর্বসূরি মুজফফর আমেদ, জ্যোতি বসু, বিনয় চৌধুরী, প্রমোদ দাশগুপ্ত বা হরেকৃষ্ণ কোঙাররা ১৯৪৮-এর এমন সময়েও কাজ করেছেন, যখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ। ১৯৬২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির মাথায় দেশদ্রোহীর তকমা। সাতের দশকে এঁরা সুভাষ চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসুদের মতো তরুণদের নিয়ে লড়েছেন পুলিশ, কংগ্রেস, নকশালের মিলিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। লড়েছেন কেননা তাঁরা স্বপ্ন দেখতেন এক বৈষম্যহীন সমাজের। ভারতের যেখানেই শ্রমিক-কৃষক স্বার্থ বিপন্ন সেখানেই কমিউনিস্টরা। বাংলার বাইরে যাদের পরিচয় ছিল লাল পার্টি। ভারতের যে কোনও মানুষ— তা ডান-বাম যে মানসিকতারই হোন না কেন, সবার কাছেই লাল পার্টির কর্মীরা ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। লাল পার্টি ক্ষমতায় থাকুক আর নাই থাকুক লাল পার্টির কর্মীরাই ছিলেন সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা।

এই ভয়ঙ্কর সময়েও বিহারে সিপিআই (এম-এল)-এর সাফল্যের কারণ বোঝার চেষ্টা করুন। না, যতই বিহারে বামেরা সফল বলা হোক, আসলে সফল হয়েছে সিপিআই (এম-এল)। সফল হয়েছে আদিবাসী শ্রমিক কৃষক শ্রেণির পাশে থেকে ওদের জীবনের ভাগীদার হওয়ার জন্য। আর বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ঘরে বসে ফের গদি দখলের, ফের সেই মানুষের ওপর ছড়ি ঘোরানোর খোয়াব দেখছেন, আর ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপ বা ইউটিউবে মমতাকে গাল দিচ্ছেন। গাল দিচ্ছেন আর শাপ-শাপান্ত করছেন। ভাবছেন একবার কোনও মতে বিজেপি যদি মমতাকে ধাক্কা দিয়ে সিংহাসনের বাইরে ফেলে দিতে পারে, তার পরেই আমরা। সুতরাং ছাপ দাও পদ্মে। কী অবাকের ভাবুন, দেবলীনা হেমব্রমের মতো কমরেডকে ওরা স্রেফ বসিয়ে রাখলেন। হ্যাঁ, এই মুহূর্তেও প্রত্যন্ত গ্রামের আদিবাসী কন্যা দেবলীনার মতো কমরেডকে সামনের সারিতে আনলে সিপিএম রাজ্য-রাজনীতির অনেক হিসাবই পালটে দিতে পারে।

একেবারে নীচের স্তর থেকে ধরলেও অর্থাৎ সাধারণ কর্মী থেকে উপরের নেতারা— বামপন্থীদের পড়াশোনা অন্য সবকটি রাজনৈতিক দলের চেয়ে বেশি। একমাত্র বামপন্থীরাই বিজেপি-র আধা-ফ্যাসিস্ট রূপ সম্পর্কে বেশি ওয়াকিবহাল।  হ্যাঁ, আমি সেই নীচের দিকের ক্যাডারদের কথা ধরেই বলছি। বলছি অন্য দলগুলির নীচের সারির কর্মীদের রাজনৈতিক পড়াশোনার মানের কথা মনে রেখে। শুধু মমতা ব্যানার্জির উপর রাগ করে যদি বিজেপি-কে ভোট দিতে হয়, তবে তো নিজের উপর রাগ করে একমাত্র আত্মহত্যাই করতে হয়। কিন্তু ইতিহাস কি ক্ষমা করবে? বিজেপি-র স্বর্গরাজ্য মানে দাঙ্গা, অনার কিলিং, জাতপাতের হিংসা, দলিত হত্যা বা কন্যাভ্রূণ হত্যা, নারীস্বাধীনতাহীনতার গুজরাট। বাংলার পরিবর্তে যে কোনও কারণেই হোক আপনি একদিন নিজের রাজ্যটাকে অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদি-দিলীপ ঘোষদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন— উত্তরসূরিদের ক্ষমা পাবেন তো? হিটলার বা মুসোলিনির সঙ্গীসাথীদের উত্তরসূরিরা কিন্তু তাদের বাপ-ঠাকুর্দাদের ক্ষমা করেনি। ক্ষমা পায়নি পাশের দেশ বাংলাদেশের রাজাকাররা। পঞ্চাশ বছর আগে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত হানা বহিরাগত পাক বাহিনীকে সাথ দেওয়া বিশ্বাসঘাতক সেই বাঙালি রাজাকাররা পঞ্চাশ বছর পর আজও কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের অভিশাপ কুড়ায়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...