ভোটের গ্যালারিদর্শন

শিমূল সেন

 



প্রাবন্ধিক, গবেষক

 

 

 

শিবসেনার সঞ্জয় রাউত তো বলেই দিয়েছেন: গত দশ বছরে এমন চিত্তাকর্ষক বিধানসভা ভোট ভূভারত এর আগে দেখেনি! হতভাগ্য পশ্চিমবঙ্গ তো দেখেইনি! শীতের গ্যালারিতে কানে পেনসিল এঁটে কাক্কেশ্বর মনে মনে আঁক কষছিল।

অতঃপর, রুদ্ধশ্বাস মল্লযুদ্ধের তাৎক্ষণিক আপাত-বিভ্রম কাটিয়ে, নির্বাচনের ভেতরের দীর্ঘস্থায়ী লড়াইগুলোয় যৎকিঞ্চিৎ আলো ফেলা দরকার।

***

 

এ বারের ভোটের সব চেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য দুটো। এক: তাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কার্যত নেই, এবং দুই: তাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ সব চেয়ে বেশি। হেঁয়ালির মত শোনালেও, এক দিকে এই ভোট রাজায়-রাজায় ওপরমহলের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে যুযুধান যেমন রয়েছে, তেমনই ভেতর ভেতর ‘সন্ধি’র তাগিদও দিব্য বহাল৷ এক দিকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার বালি, কয়লা ও গরু-ঘটিত সাঁড়াশি তদন্ত তৃণমূলের ওপর চাপ বাড়াতে উদ্যত, তার পাশাপাশিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক মাসে দু-বার ছুটে গেছেন রাজভবনে। নেতাজির জন্মদিনে তিনি প্রধানমন্ত্রী-সঙ্গে ভিক্টোরিয়ায় আমন্ত্রিত কেন্দ্রের তরফে। এবং, গেছেন। বিগত ক-বছরের শীতলতা ভেঙে ঈষৎ ‘নরম’ কেন্দ্র-ও ফিরতি প্রজাতন্ত্র দিবসের বার্ষিক কুচকাওয়াজে বাংলার ট্যাবলোকে জায়গা করে দিয়েছে। সেই ট্যাবলোর বিষয়বস্তু: রাজ্য সরকারের জনকল্যাণমূলক প্রকল্প। রাজ্য সরকারও অমনি দু বছরের গোঁসা ভেঙে ফিরতি ছাড়পত্র দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কৃষক সম্মান প্রকল্পের বার্ষিক ছ হাজার টাকা অঙ্কের সহায়ক ভাতাকে। এ সবের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের নিত্য আসা-যাওয়ার কার্যক্রমও বহাল। এ হেন বিচ্ছিন্ন কোলাজকে জুড়লে এমন প্রতীতি হওয়া অসম্ভব নয়, যে:

এক: এই নির্বাচন, যাকে বলে, ‘রিয়েলপলিটিক’-এর আদর্শ নমুনা। স্বার্থের খেওয়াখেওয়ি, শর্ট টার্ম লাভক্ষতির নিরিখে নির্ণীত হবে গোটা নির্বাচন। ঘোড়া সামলাতে অধিক দড় যে পক্ষ, যার ম্যানেজমেন্ট কুশলতা বেশি— নির্বাচন তার-ই। এক কথায়, কাঁচা ক্ষমতার জন্য এমন রুদ্ধশ্বাস ঘোড়দৌড়, এমন তুঙ্গ টাকা-ওড়ানো আর এমন সেয়ানে-সেয়ানে বিজ্ঞাপনী প্রচারণা এ রাজ্য অতীতে দেখেনি।

এরই সঙ্গে, দুই: এ থেকে এমন অনুসিদ্ধান্তও টানা যায়, যে, আসন্ন নির্বাচনী প্রকল্পে ‘আদর্শ’ বস্তুটি তিরোহিত, অতএব, আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্রের রাজনীতিতে জনগণেশের ‘হক’-ও কার্যত শূন্য। যে হেন অ-ভূতপূর্ব তরিকায় ভোটকুশলীরা ঘুঁটি সাজাচ্ছেন, অঙ্ক কষছেন দু তরফে— তাতে এই নির্বাচন মোটামুটিভাবে মস্তিষ্কভিত্তিক ক্ষমতা-ক্রীড়ায় পরিণত। এরই সূত্রে, গণতান্ত্রিক ভাবে দায়বদ্ধ জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচন-নামক সামাজিক চুক্তিটি বেমালুম খেলাপ করে ঘর পাল্টে নিচ্ছেন রাতারাতি।

মোদ্দা কথা, এই নির্বাচন যদি আদতেই প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার ভোট হয়ে থাকে (যেমনটা হয়েছে ২০১১ বা ১৯৭৭ সালে)— তাহলে তার চরিত্র বেশ খানিকটা ভিন্ন। এ যুদ্ধ কোনও নিরবচ্ছিন্ন ধর্মযুদ্ধ নয়— বরং শীতল কূটযুদ্ধ— ডিপ্লোম্যাসিও যার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সার্বিকভাবে তৃণমূলকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে কি হবে না, সুনীতি বা বৃহত্তর আদর্শ কী হবে, তার থেকেও (এই শেষ জানুয়ারি অব্দি) গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে স্থানীয় স্বার্থ। এখানেই ওঠে বহুমাত্রিক জনগণেশের অধিকারের কথা। নিৎশে, তাঁর বাস্তববাদী রাজনীতি-আখ্যানে এনেছিলেন ‘রিষ’ বা ‘মাৎসর্যে’র ধারণা, বা রিসন্তিমেন্ত। নিৎশীয় সমীকরণে, এই আড়চোখে-তাকিয়ে-দেখা কূট হিংসের বোধই রাজনীতির আসল জিয়নকাঠি! এই মাৎসর্যবোধই, আসলে, যে কোনও রাজনীতির কুশীলব-নাট্য— যা কোনও প্লেটোনিক পরম মঙ্গলময় আদর্শকে খোঁজে না; যা একান্তই ব্যক্তিক স্বার্থ থেকে উৎসারিত, লাভক্ষতি-নির্ভর, ক্ষমতা বাঁটোয়ারার নিতান্ত পলিটিক। এই ফর্মুলায়, আসন্ন ভোটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে স্থানীয় ক্ষমতা-সম্পর্কের বিন্যাস। আর, শাসক দলের বিরুদ্ধে ঘনিয়ে ওঠা লাগাতার দুর্নীতির অভিযোগ, বিভিন্ন শ্রেণি বা বর্গের হররোজ পরখ-করা আর্থিক নয়ছয়ের অভিজ্ঞতাগুলো এখানেই নির্বাচনের ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই ক্ষমতাবুনোটের এক দিকে (নাগরিকের ‘অধিকার’ নয়–) বরঞ্চ গণতান্ত্রিক ‘পরিষেবা’র প্রশ্ন। দু’ দলেরই দাবি, তারা বিরোধী পক্ষের চেয়ে আপেক্ষিকভাবে ‘উন্নত’ ও ‘উপযোগী’ কোনও ‘পরিষেবা’ দিতে সক্ষম। যে সমস্ত জনকল্যাণমূলক প্রকল্প নিয়ে দড়ি টানাটানি, তার নির্যাস: জনগণ এই রাজনীতির অঙ্গনে কোনও সার্বভৌম, সক্রিয় বৈধ কর্তা নয়। তার ‘অধিকার’ নেই সে-অর্থে। সে নিছকই পরোক্ষ গ্রাহক, যে তার স্বার্থ মেটাতে বাইরে থেকে কিছু উপঢৌকন হাত পেতে নিয়ে চেটেপুটে খায়।

এই বিন্দুতেই, সম্ভবত, ২০২১ নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে চলেছে ‘প্রশাসন’। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যে ধরনের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া উঠেছে কিছু জায়গায়, তার মূল অক্ষ: এই ‘কার্যকরী’, ‘দক্ষ’ প্রশাসনের চাহিদা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বে গত সাত বছরের যে সরকার, আর, তার বিপ্রতীপে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার, উভয়ের কাজকর্মে রয়েছে যোজনখানেক ফারাক৷ দু’ ক্ষেত্রে প্রশাসন খানিক ব্যক্তিনির্ভর এবং ক্ষেত্রবিশেষে কিঞ্চিৎ পপুলিস্ট। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার গত আড়াই বছরের মেয়াদে এমন চেহারায় ধরা দিচ্ছে, যা অতীতে দেয়নি৷ তাদের কাশ্মির বা এনআরসি-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে বাদ রেখেই বলা যায়, অর্থনৈতিক উদারীকরণের নিরিখে এমন বল্গারথ কার্যত অ-ভূতপূর্ব। কোভিড-আক্রান্ত সময়ে প্রধানমন্ত্রী সামনে এনেছেন ‘আত্মনির্ভরতা’র তাস। ওপর থেকে দেখলে, নেহাতই এক ধরনের সঙ্ঘ-সুলভ অর্থনৈতিক স্বাজাত্যবোধ মনে হতে পারে তাকে। কিন্তু এরই মধ্যে কৃষিক্ষেত্রে ঢালাও উদারবাদের ছাড়পত্র, শ্রম আইনে বিস্তর ‘সংস্কার’। বিপর্যয়কে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করতে সিদ্ধহস্ত, মোদিও করেছেন।

আত্মনির্ভরতার মূল নির্যাস: আত্মনির্ভর ব্যক্তি, মিনিমালিস্ট (ন্যূনতম) রাষ্ট্র। বিরোধীদের কটাক্ষ, এ আত্মনির্ভরতা নেহাতই গরিবের জন্য, আর বড়লোককে ঢালাও পৃষ্ঠপোষণার বন্দোবস্ত। পাঁচটি ভারতীয় কর্পোরেটকে গ্লোবাল কর্পোরেটে পরিণত করার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত আড়ালে থাকেনি। প্রধানমন্ত্রীর সচিব অরবিন্দ কান্ত তো এ-ধরনের প্রস্তাবকে খুল্লমখুল্লা সমর্থন করতে গিয়ে সটান বলেই বসলেন: এই অতি-গণতান্ত্রিকতাটাই ভারতের পক্ষে কাল হয়েছে। কান্তের এ হেন মেধাবাদী (মেরিটোক্র্যাটিক) দৃষ্টিকোণই মোদি সরকারের পুঁজি। নীতি আয়োগের ‘দৌরাত্ম্যে’ মন্ত্রিসভা কার্যত নাচার, খোদ নীতিন গড়কড়ির সঙ্গে তাদের ঝামেলাও লেগেছিল বলে শোনা যায়। এ হেন ‘নীতি’-প্রণয়নই আত্মনির্ভরতার বুলিটিকে জপে সরাসরি আক্রমণ করেছে নেহরুবাদী রাষ্ট্রভাবনাকে। নেহরুর বস্তুবাদী আখ্যানে, ব্যক্তিক আত্মশক্তি-জাগরণের ‘অতীন্দ্রিয়’ দর্শনটির লেশ মাত্র ছিল না। তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার: জাতিকে সমতার ভিত্তিতে দাঁড় করাতে হলে রাষ্ট্রকে ‘পিতৃসম’ উপায়ে থাকতে হবে পিছিয়ে-পড়ার সঙ্গে। মোদি সরকার সেসব মানে না। তাদের ‘ঘোষিত’ আদর্শ ন্যূনতম ও শক্তিশালী সরকার। খোলা বাজারের হাতে একটু একটু করে দেশকে ছেড়ে দেওয়ার সংকল্পে মোদি-রাজ অটল (যার সাম্প্রতিক প্রতিফলন কৃষি আইনের ক্ষেত্রে, এবং, অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে সরকারের ‘ঔদাসীন্যে’)। নোট-বাতিলের মত ঘটনাও সরকারি নীতিপ্রণেতারা বাজারের ‘ঝুঁকি’র সঙ্গে নাগরিককে অভ্যস্ত করানোর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ হিসেবে দাখিল করেছেন।

এর বিকল্প হিসেবে, মমতা তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার পেয়েছেন নেহরুবাদী কংগ্রেসি ঘরানা মারফত। আদশর্গত হিসেবমাফিক, এই ভোট দুই বিপরীতধর্মী আদর্শেরও লড়াই৷ দুর্নীতি যদি শাসক মমতা-বিরোধিতার একটা দিক হয়, অন্য দিকটা হল অ-সরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে আর্থিকভাবে ‘সুরক্ষা’ দেওয়ার নীতি। মমতাও মোদির মত আমলাভিত্তিক সরকার চালান। কিন্তু তার মূলে রয়েছে পপুলিজম: গণ-অধিকার প্রতিনিধিত্বের দাবি। কর্মসংস্থান নিয়ে মমতার নীতি বহুবার সমালোচিত। তাঁর আমলে বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি, ভারী শিল্পেরও খুব একটা উদ্যোগ চোখে পড়েনি। মমতা গ্রামীণ অর্থনীতির রক্তসঞ্চার ঘটাতে বেশি উদ্যোগী। কর্মসংস্থান তৈরি না করে, বহুবিধ সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে নাগরিকের ‘দায়িত্ব’ নেওয়ার একটা উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন। সিপিএমের বক্তব্য, তাদেরই চালু করা সরকারি চাকরির বার্ষিক পরীক্ষাগুলো মমতার আমলে এসে থমকে আছে। আর সদ্য-প্রাক্তন তৃণমূল তথা অধুনা-বিজেপি নেতারা সরাসরি বলছেন: সিঙ্গুর আন্দোলন তাদের ভুল ছিল। ইনফোসিস বা টাটা গেল কেন, বৃহৎ লগ্নি পশ্চিমবঙ্গে কোথায়, এসএসসি টেট ইত্যাদি প্রশ্নে রোজই বিজেপি নেতারা সরকারকে বিঁধছেন। নন্দীগ্রাম আন্দোলনে, ‘সূর্যোদয়ে’র পর সেখানে এসেছিলেন (শোনা যায়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর প্রতি একদা-প্রীত) লালকৃষ্ণ আডবানি স্বয়ং। তারও আগে, মমতার মেট্রো চ্যানেলস্থিত ধর্নামঞ্চ পরিদর্শনে ছিলেন রাজনাথ সিংহ। স্বপন দাশগুপ্তর মত নেতারা অবশ্য তখন সিঙ্গুরে মমতার কার্যকলাপের বিরোধিতাই করেছিলেন। কালক্রমে, এ-ও ইতিহাসের কূট রসিকতা বই কী, মমতার বিরোধিতায় গত দশকের শেষে সানন্দে সরে যায় ন্যানোর কারখানা। কর্পোরেট মহলের সঙ্গে গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর সখ্যের সেই সূচনা।

এখানেই প্রশ্ন: মেধার-ভিত্তিতে-বর্ণবাদী বাঙালি ভদ্রলোকের কাছে কি বিজেপি গ্রহণযোগ্য বিকল্প হতে পারবে, অন্তত চাকরির ইস্যুতে? লোকসভা ভোটে বিদ্যাসাগর-মূর্তিকাণ্ডের পর বিজেপির বিজয়রথ থমকে গিয়েছিল শহরাঞ্চলে, শেষ দফায়। বিজেপি অবশ্য চেষ্টার অন্ত রাখেনি। বাংলাবাদের নিশান তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রচার শুরু করে দিয়েছেন। বিজেপি চেষ্টা করছে বাঙালি আইকনদের আত্মসাৎ করার। টলিপাড়ার মুখদের বেছে নিচ্ছে বিজেপি, বিশিষ্টদের সঙ্গে চা-চক্রে সেলফি তুলছেন মোদি (এর উল্টো দিকেই, ভোটের সম্ভাব্য ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ হিসেবে সান্ধ্য সিরিয়ালের কুশীলবরা যোগ দিচ্ছেন তৃণমূলে)। বৌদ্ধিকভাবে বিজেপির বক্তব্য: হিন্দুত্ব বিষয়টা পুরোদস্তুর বাংলার অবদান, যা পরবর্তীকালে পল্লবিত হয় সাভারকরদের হাতে। বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, অরবিন্দের মত প্রত্যাশিত নামের পাশাপাশি উনিশ শতকের বহু সাধারণ্যে-কম-চেনা বাঙালি চিন্তকের হিন্দুত্ব-বিষয়ক লেখাপত্রও তাদের অস্ত্র। মনোমোহন বসুর কবিতা আউড়ে আত্মনির্ভরতার বীজ প্রোথিত করেছেন খোদ নরেন্দ্র মোদি। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে দেবপ্রসাদ ঘোষ— সাংস্কৃতিক সম্প্রসারণে বিশ্বাসী বিজেপি বহু বাঙালি জনসঙ্ঘ-হিন্দু মহাসভা নেতার নামও উল্লেখ করছে ইদানীং। কখনও মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে জনচিত্তে ভাসানো হচ্ছে রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীর নাম। অমিত শাহ ক-দিন বাদেই বৈঠক করবেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সঙ্গে, ঘুরে দেখবেন মায়াপুর মন্দির। জেপি নড্ডা-বিজয়বর্গীদের মত কেন্দ্রীয় নেতাও নিত্য মন্দিরে যাচ্ছেন, ঢাক বাজাচ্ছেন। নেতাজি ভবন ছুঁয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবেকানন্দের বাড়িতে শিবপুজো করছেন।

এখন প্রশ্ন হল, শহুরে খান সত্তর আসন ঠিক কতখানি গুরুত্ববহ? শুভেন্দু অধিকারী প্রায় ধর্মযুদ্ধে নেমেছেন, মমতার ক্যাবিনেট কেন দক্ষিণ কলকাতা-ময়, এই মর্মে। উত্তরবঙ্গের হয়েও রোজই সওয়াল করছেন শুভেন্দু। এবড়োখেবড়ো পিচ, বল ঘুরছে, জীবনের কঠিনতম লড়াইয়ে মমতা খেলতে নেমে খাপ খুলেছেন নন্দীগ্রামে। লক্ষ্য: গোটা মেদিনীপুর (যে মেদিনীপুরীয় সত্তাকে রোজই প্রকাশ্যে লালন করছেন শুভেন্দু)। হাওড়ায় পাঁচ হেভিওয়েট তৃণমূল ছাড়ছেন, বা ছাড়বেন। পশ্চিমবঙ্গকে যদি দৃশ্যমান মানচিত্র হিসেবে কল্পনা করা যায়, তা হলে তার ফ্রন্টিয়ারগুলিতে বিজেপি প্রভাব বাড়িয়েছে উত্তরোত্তর। এর অন্যতম কারণ: গাঙ্গেয় উপত্যকার শহুরে বর্ণহিন্দুর বদলে, জনজাতি ও আদিবাসীদের মধ্যে সঙ্ঘ পরিবারের ধারাবাহিক ও নিবিড় সাংগঠনিক কার্যক্রম। সম্প্রতি বিজেপি যে অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা করেছে বলে খবর, সেখানেও একই ছবি। তাদের গবেষণা বলছে, রাজ্যের পাঁচটি জোন-এর মধ্যে তারা যথেষ্ট সমস্যায় রয়েছে কলকাতা ও দুই চব্বিশ পরগনার মিলিত বিস্তীর্ণ অববাহিকা-অঞ্চলে।

অন্য দিকে, রাজ্যে তিরিশ শতাংশ মুসলমান ভোট। বিজেপি খেলছে যথারীতি ‘রাষ্ট্রবাদী’ লাইনেই৷ ‘রাষ্ট্রহীন’ উদ্বাস্তু রোহিঙ্গারা পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি গাড়ছে কেন, অবৈধ অনুপ্রবেশ বা সীমান্ত সুরক্ষার প্রশ্নে মমতা ‘ব্যর্থ’— এমন একটা ধারণা তৈরি করতে চাইছে বিজেপি। এরই সঙ্গে রয়েছে এনআরসি-র জুজু। ‘ক্রোনোলজি’ বাতলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাফ বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে ধাপে ধাপে এনআরসি হবেই৷ মমতার শাসনে ‘তোষণে’র অভিযোগ তুলে বাঙালি হিন্দুর ‘বিপন্ন’ ডেমোগ্রাফিক অস্তিত্বকে পুঁজি করছে বিজেপি। মজার বিষয়, এই ‘তোষণ’ এবং ‘সাচ্চা ধর্মনিরপেক্ষতা’র ধুয়ো তুলে ময়দানে নেমেছে পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি এবং মিম-এর জোটও। বিজেপির লক্ষ্য থাকবে: ধর্মীয় পরিচিতির ভিত্তিতে ভোটের আড়াআড়ি মেরুকরণ।

এ-বিষয়টা কবুল করেছেন তৃণমূলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ নির্বাচন-কুশলী প্রশান্ত কিশোরও। ওঁর যুক্তি: ৭০ শতাংশ ভোট তাক করেছে বিজেপি। তৃণমূলের ‘টার্গেট অডিয়েন্স’ ১০০ শতাংশই। ফলে, সরল পাটিগণিতের হিসেবেই বিজেপিকে লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করতে হলে ‘চালিয়ে’ খেলতে হবে। মমতা অবশ্য সুযোগ হাতছাড়া করেননি। ভিক্টোরিয়ার মঞ্চে জয় শ্রীরাম-মর্মে স্লোগানবাজি, অথবা নাড্ডার কনভয়ে হামলা— তাঁর মতো করে প্রতিটি বিষয়ের ‘সদ্ব্যবহার’-ও করেছেন। লক্ষণীয়, এর বাইরে, মুখ্যমন্ত্রী প্রতিটি সভায় আলাদাভাবে সম্বোধন করছেন মহিলা ও তরুণ ভোটারদের। মহিলা বিল বা ২০১৪ লোকসভায় প্রায় ৫০ শতাংশ মহিলা প্রার্থীর মনোনয়ন— মমতা বরাবরই মহিলা ভোটব্যাঙ্ককে ‘তোমাদেরই লোক’-মর্মে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন। দেশে জনবিস্ফোরণের হার কমে ভারতের গড় বয়স বেড়ে গেছে ঠিকই। তবু, মোদির আমলে বেকারিত্ব নিয়েও তাঁর পরিচিত ‘ছাত্র-যৌবন’কে প্রতি জনসভায় নিয়ম করে আহ্বান করছেন মমতা।

এখানেই গোল বেঁধেছে মমতা এবং বিজেপির। মমতা এনেছেন যে আর এক মেরুকরণ: বাঙালি বনাম বহিরাগত। যে বাঙালিরা এই ‘বহিরাগত’-র অংশী হচ্ছেন, তাঁরা তৃণমূলের মতে ‘মীরজাফর’। মমতার বক্তব্য: যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্তিতে বাংলার হাতে আত্মনির্ধারণ (অটোনমি)-এর অধিকার থাকা প্রয়োজন। ভারতের মত সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের দেশে স্রেফ দিল্লিই কেন দেশ শাসন করবে, এ প্রশ্ন তুলে হঠাৎই চারটি রাজধানীর পক্ষে সওয়াল সাজিয়েছেন ভরা মঞ্চে। বিজেপির পাল্টা যুক্তি: গত পঞ্চাশ বছরের ইতিবৃত্তে বাংলা বাকি ভারত থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন৷ কোনও কেন্দ্রীয় সরকারি দল (জোটসঙ্গী নয়) সরাসরি বাংলার মসনদে বসেনি। উত্তুঙ্গ চলেছে কেন্দ্রবিরোধী ‘বঞ্চনা’র নিত্যপ্রচার। এখন, বিজেপিই একমাত্র আনতে পারে এই জোড়া ‘ইঞ্জিনে’র সরকার— এমন দাবি চড়ছে। বিজেপির দাবি, উদারীকরণের রথে আসীন অবশিষ্ট ভারত যে যুগমুহূর্তে ‘স্বর্গারোহণ’ করেছে, বাংলা তখন পরিখা কেটে পৃষ্ঠকণ্ডূয়নে মত্ত। যে বঙ্গভূম তামাম ভারতকে দীক্ষা দিয়েছে স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের, সেই বাংলায় এক নাগাড়ে ‘বিশ্ববাংলা’ ও ‘বিশ্ববিপ্লব’ (বিজেপির শব্দবন্ধ) তাকে চ্যুত করেছে স্বার্থ থেকে৷ কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার আগে যেমন ষাট বছরের দীর্ঘ ইতিহাস ‘খুঁড়ে’ মোদি অচ্ছে দিন-এর দীর্ঘমেয়াদি ‘কাঠামোগত’ (স্ট্রাকচারাল) নিদান হেঁকেছিলেন, অমিত শাহ ‘সোনার বাংলা’-র গর্জন ছেড়ে এবং পঞ্চাশ বছরের সুতো টেনে তেমনটারই মহরত ঘটিয়ে দিয়েছেন এ-বাংলায়। ভোট এলে এই প্রচারের ঘনত্ব আরও বাড়বে হয়তো।

তবে শেষ পর্যন্ত সব পথ এসে মিলে যাবে— সব মেরুকরণ গিয়ে ঠেকবে দুই মুখে: নরেন্দ্র মোদি বনাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘ট্র্যাডিশন’ অব্যাহত রেখে মোদিকেই বিধানসভা ভোটেও ‘মুখ’ হিসেবে তুলে ধরতে চায় বিজেপি। মর ও জড় এই দুই মুখেই বিম্বিত হবে বহু ভোটারের অনেকান্ত স্বপ্ন ও মূল্যবোধ। একটা বিষয় অবশ্য পরিষ্কার। এ-ভোট হবে ২০১৯-এর নিয়মেই, ২০১৬-র যুক্তিতে নয়। এবং এ এমন এক নিয়ম: যা এই রাজ্যে কার্যত অদৃষ্টপূর্ব। একটি নতুন রাজনৈতিক দল (আব্বাস সিদ্দিকি) এবং দুটি জাতীয় রাজনৈতিক দল (বিজেপি ও মিম) এই প্রথম এভাবে আদৌ ঝাঁপাচ্ছে বাংলায়। আনাগোনা বাড়ছে ‘জাতীয়’ সংবাদমাধ্যমেরও, বাংলাতেও বাণিজ্যিক স্বার্থে পা রাখছে তারা। রোজই দিল্লি-মিডিয়ার সান্ধ্য প্রাইম টাইম উতরোল করছে বাংলা।

২০১৯-এর হিসেবে, ক্ষীণ এক সংখ্যাতাত্ত্বিক ব্যবধানে ঈষৎ এগিয়ে তৃণমূল। রাজনীতিতে পূর্ণযতি বা ‘ইকুলিব্রিয়াম’ খাটে না। ক্ষমতা, সেখানে, ওঠে অথবা পড়ে। দু পক্ষেরই তাদের দাবিকে সাকার করতে হলে খেলা ঘোরাতে হবে, ভোট টানতে হবে নিজের দিকে। দেখার: এ-ভোট দ্বিমেরুকৃত, বা, বাইপোলার হয় কি। এ-ও দেখার: এই সম্ভাব্য মেরুকরণ কোনও একপেশে মেরুকরণের চেহারা নেয় কি। কারও ক্ষতি মানেই কারও লাভ— থুকিসিডিস-কথিত রাজনীতির এই সরল সূত্রটি এ বারের নির্বাচন প্রমাণ করবে। এ যেন এক অন্তহীন ‘প্রিজনার্স ডিলেমা’— যেখানে বিরোধীর অস্তিত্ব পুঁজি করেই জিতবে বিজেতা। এ-লেখার প্রথম বিন্দুটিতে আবার ফিরে আসা যায়। নির্বাচনের গাণিতিক অভিব্যক্তি কীরকমটা হবে? তা কি হবে নিউটনীয় পাটিগণিত, যেখানে দুয়ে দুয়ে চার হয়? না কি, সেই চার হবে অগুনতি ২ক, ২খ, ২গ-র সম্ভাব্য যোগফল— যেখানে চলরাশির ধ্রুব মান এখনও অব্দি অজানা? না কি, কোনও অনিশ্চিত অ্যালকেমির বিপর্যাস চকিতে পাল্টে দেবে ভোটের প্রাক্-নির্ধারিত ও প্রত্যাশিত সমীকরণ?

সবে তো জানুয়ারি গড়াল। নসীবাবুর কুঞ্জবনে এখনও ফুল ধরেনি, বসন্ত বহু দেরি! আম আদমি-র চিরায়ত প্রতীক কমলাকান্ত আনমনে এ সব ঘ্যানঘেনে সাতপাঁচই ভেবে যায়। আসছে বোশেখ মাস, ফুলের বিবাহ না-হয় তখনই পরখ করা যাবে— আফিম-মুদগর ছেড়ে আড়মোড়া-ভাঙা বেচারি কমলাকান্ত ধুত্তোর-রবে, ইত্যবসরে, মজে যায় প্রসন্নর সঙ্গে কুঁদুলে আলাপে।

কোথাও যেন ইতস্তত ডেকে ওঠে একটি উটকো বেড়াল— ‘মেও!’

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4658 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...