ভালো সাংবাদিক মন্দ সাংবাদিক

চার্বাক মিত্র

 

রাজনৈতিক নিবন্ধকার

মজার ব্যাপার, এই হপ্তাকয়েক আগেই এক মহান দেশব্রতী সাংবাদিকের বিস্ফোরক হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট প্রকাশ্যে এসেছিল। সেই চ্যাটে জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস করার মতো গুরুতর অপরাধ ঘটিয়েছেন ‘ড্রাগ দো’-খ্যাত অর্ণব গোস্বামী। পুলওয়ামার আক্রমণ দেখে উল্লাসে জিভ বের করেছেন বেহায়ার মতো, যেহেতু সেই হামলার দরুন বিজেপির ডোবা তরীর ভেসে ওঠা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ২০১৯-এ। যে দেশবাসী পুলওয়ামার পরে সামান্য ফেসবুক পোস্টের জন্য লোকজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কান ধরে ওঠবোস করিয়েছে, যে দেশবাসী সেই মর্মান্তিক ঘটনার পর কাশ্মিরি শালওলাদের নিগ্রহ করে নির্লজ্জের মতো দাঁত বের করে সে কীর্তির কথা সদর্পে ঘোষণা করেছে ফেসবুক লাইভে— সেই দেশবাসী অন্ধ এবং বধির হয়ে গেছে গোস্বামীমহাশয়ের এই ভয়াবহ দেশদ্রোহিতার নিদর্শন দেখে। যে অপরাধে তাঁর জেলে যাওয়ার কথা, সেই অপরাধ সপ্রমাণ দাখিল হওয়া সত্ত্বেও তাঁর নিজের জায়গির, অর্থাৎ তাঁর চ্যানেলের স্টুডিওতে বসে নিরন্তর অসভ্যতা তিনি চালিয়েই যাচ্ছেন। বাংলার ভোটের আগে বাংলায় লঞ্চ করাচ্ছেন তাঁর চ্যানেল, অবশ্য যে বাংলায় তা ঘোষণা করেছেন তিনি, সেই বাংলা আদৌ বাংলা কিনা বলা মুশকিল। কৃষক আন্দোলন লালকেল্লায় পৌঁছে যাওয়ার পর সাংবাদিকতায় সীমাবদ্ধ না থেকে প্রায় একটি জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী সংগঠিত করার কথা ঘোষণা করেছিলেন তিনি, রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি দিয়ে। তাঁর টিআরপি দুর্নীতির জালও ফাঁস হয়ে গেছে। যে কাজের জন্য পশ্চাদ্দেশে লাথি খাওয়ার কথা, সেই কাজের পরেও বহু মানুষের প্রাতঃপ্রণাম তিনি আদায় করে চলেছেন নির্বিঘ্নে, বলা ভালো সরকারি আনুকূল্যে।

কেন এই বিশেষ তথাকথিত ‘সাংবাদিক’-টির কথা দিয়ে এই লেখা শুরু করলাম? এঁর স্বরূপ যাঁরা জানার, তাঁরা ভালোভাবেই জানেন। অন্তত একথা বলাই যায়, যতজন পাঠক এই লেখা পড়বেন, তাঁদের সিংহভাগেরই তো এঁর কথা জানা! তাহলে? এই জানা গল্পটা দিয়ে শুরু করার একটাই কারণ। এরপর যে কিঞ্চিৎ অজানা গল্পটা বলতে চলেছি, তার পূর্বসূত্র হিসেবে উপরিউক্ত দৃষ্টান্তটি প্রয়োজন। এতে বৈপরীত্যের রেখাটা স্পষ্ট হবে। আর এই রাষ্ট্রের প্রবণতা পরিষ্কার হবে সুধীজনের কাছে।

২৬ জানুয়ারি কৃষকদের মিছিল লালকেল্লায় পৌঁছে যাওয়া রাজনৈতিক বিচ্যুতি কিনা, কোনও বিশেষ চক্রান্তের কারণে সেই মিছিল বেপথু হয়ে লালকেল্লায় ঢুকে গিয়েছিল কিনা— এসব নিয়ে শহুরে লিবারালরা বহু চর্চা করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র যে সেদিনকার ঘটনায় একেবারে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় খেয়েছে, এ নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকতে পারে না। দীপ সিধু মোদি সরকারের চর হতে পারেন, কিন্তু লালকেল্লার সেই মিছিলে বহু কৃষকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। বাবরি মসজিদের চূড়োয় উঠে যে ভক্ত হনুমানরা গত শতাব্দীর নিকৃষ্টতম বর্বরতাগুলোর একটি সংঘটিত করেছিল, তারা চারটে মেটাল ডিটেক্টর ভাঙা নিয়ে আতুপুতু নাকিকান্না কাঁদছে দেখলে হাসিও পায়, রাগও হয়। জাতীয় পতাকা অক্ষুণ্ণ রেখে দুটি ধর্মীয় পতাকা টাঙানোর ঘটনাকে যে দালাল মিডিয়া জাতীয় পতাকার অপমান বলে গলা ফাটিয়েছে, তাদের সম্বন্ধে কোনও ভদ্র বিশেষণ উপযুক্ত নয়। সেই ঘটনায় কৃষক আন্দোলনের ক্ষতি হয়েছে কিনা, তা তো কৃষক নেতারা ঠিক করবেন। কিন্তু জাতীয় পতাকা বা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কোনও চিহ্নের বিন্দুমাত্র অসম্মান হয়নি, একফোঁটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বরং সেদিন তিরঙ্গা ছেয়ে গিয়েছিল মিছিলজুড়ে। বিদ্বেষী দেশ বেচা সরকারের বিরুদ্ধে দেশের আসল ভিত্তিমূল যে কৃষকরা, তাঁরা তিরঙ্গা হাতে নামলে উগ্র জাতীয়তার নেশাখোরদের গা তো চিড়বিড় করবেই! তাই সেই তিরঙ্গা ঢেকে দেশদ্রোহের কিসসা সামনে আনতেই হয়।

আর এই দেশদ্রোহিতার গল্প ফাঁদতে গিয়ে মজা হয়েছে একটা। যোগেন্দ্র যাদব বা শশী থারুর— এঁদের ধর্মই হচ্ছে, যে কোনও আন্দোলন তার তুঙ্গে পৌঁছলে তৎক্ষণাৎ সেই আন্দোলনের ন্যায়-নীতি-নৈতিকতা নিয়ে ফুট কাটা। সিএএ আন্দোলনের সময় যোগেন্দ্র যাদব যেমন হঠাৎ করে আন্দোলনকারীদের রাষ্ট্রীয় সংহতি বজায় রাখা নিয়ে জ্ঞান ঝেড়েছিলেন, শশী থারুর তেমন লালকেল্লার দিন বেদনার বালুচরে লুটোপুটি খেয়ে টুইট করে বসেছিলেন, তিনি এই কৃষক আন্দোলনকে আর সমর্থন করতে পারছেন না। কিন্তু, মোদি সরকারকে ধন্যবাদ। সেই সরকার দেখিয়ে দিয়েছে, লিবারাল সেজে রাষ্ট্রের মৃদু দালালি ছদ্ম-দ্রোহের ঢঙে করে কোনও লাভ নেই। বাম্বু যখন দেওয়া হবে, তখন রাডিকাল যেমন সেই বাম্বু খাবে, তুতুভুতু লিবুরাও খাবে। তাই কৃষক নেতাদের পাশাপাশি একধারসে এসব লিবারালদের নামেও সিডিশনের মামলা ঠুকে দিয়েছিল অমিত শাহর গেস্টাপোবাহিনী, অর্থাৎ দিল্লি পুলিশ। যারা গত বছর এই সময় দিল্লিতে নির্বিচারে মুসলিম-হত্যালীলায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল।

কিন্তু চাঞ্চল্যকর বিষয় হল, এই সিডিশনের মামলার আওতায় পড়েছেন বেশ কিছু সাংবাদিক। মনদীপ পুনিয়ার গ্রেফতারি নিয়ে অনেকেই অবহিত। কিন্তু রিহানা আর গ্রেটাদের টুইট-বিপ্লব এবং এদেশের লেজনাড়া সেলেবদের আনুগত্যের কার্নিভালে একটা খবর ঢাকা পড়ে গিয়েছিল, তা হল ব্রিটিশ লেবার পার্টি ভারতে প্রেস ফ্রিডমে সরকারি হস্তক্ষেপ নিয়ে একটি পিটিশন ইস্যু করেছিল, যা প্রয়োজনীয় সই পেয়ে গিয়ে এখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আলোচনার জন্য পেশ হওয়ার অপেক্ষা। যদিও বরিস জনসন মোদির বন্ধু; কিন্তু আন্তর্জাতিক সেলেবদের মোদি-বিরোধিতা, বাইডেন সরকারের সমর্থন ও বিরোধিতার মেঘরোদ্দুর খেলা— এসবের মাঝে হালকা চাপে পড়েই হয়তো বা মনদীপ পুনিয়াকে জেলে ধরে রাখার সাহস মোদি সরকার দেখাতে পারেনি। রাজদীপ সরদেশাই একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছিলেন। ট্রাক্টর উলটে কৃষক-মৃত্যুর মতো যে একটি দুঃখজনক দুর্ঘটনার কাহিনি ফাঁদা হচ্ছে, সেই আখ্যানের বাইরের আখ্যান, অর্থাৎ সরাসরি পুলিশের গুলিতে কৃষক খুনের ন্যারেটিভ তিনি তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু ফেক নিউজের ওপর ভর করে যে সরকার জনসমর্থন আদায় করে, সেই সরকার রাজদীপের নামে ফেক নিউজ ছড়ানোর অভিযোগ এনে ফোঁস করে ওঠায় ‘ইন্ডিয়া টুডে’ তড়িঘড়ি রাজদীপকে দু সপ্তাহের জন্য অফ এয়ার করে দিয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যের ছ জন সাংবাদিকের নামে এফআইআর হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল ‘নিউজক্লিক’ পোর্টালের সাংবাদিকরাও। সুপ্রিম কোর্ট সেই ছ জন সাংবাদিকের গ্রেফতারির ওপর স্টে অর্ডার দিতেই সরকার তার অনুগত টাট্টু ঘোড়া, অর্থাৎ ইডি-কে লেলিয়ে দিয়েছে এই বিশেষ হাউসটির পিছনে। ইডি রেড করতে চলে গেছে সোজা ‘নিউজক্লিক’-এর অফিসে, এবং এই পোর্টালটির এডিটর ইন চিফ প্রবীর পুরকায়স্থর বাড়িতে। যে অভিযোগ এই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ছিল, অর্থাৎ, ‘মিসলিডিং’ (পড়ুন সরকারবিরোধী) খবর প্রচার, তাতে যখন শিকে ছিঁড়ল না, তক্ষুনি ইডি-কে রেড করতে হল? মিডিয়া ফ্র্যাটারনিটি শুধু নয়, যে কোনও সুস্থ বোধসম্পন্ন মানুষ বুঝবে, এর পিছনের আসল ছকটা কী!

এর মধ্যে ইডি-র আবার হাস্যকর দাবি— ‘নিউজক্লিক’ নাকি ৩০ কোটি টাকা দিয়েছে গৌতম নভলাখাকে। এই লেনদেন নাকি রহস্যময়। কে গৌতম নভলাখা? ইডি-র বক্তব্য তিনি নাকি ‘সিপিএম আইটি সেল’-এর সদস্য। আর কইয়েন না কত্তা, ঘুড়ায় হাসব তো এবার! ভীমা কোরেগাঁও মামলার মূল অভিযুক্তদের একজন এই গৌতম নভলাখা। যিনি আদতে একজন কার্টুনিস্ট এবং অ্যাক্টিভিস্ট। রাষ্ট্রের পক্ষে তিনি অস্বস্তিকর বলাই বাহুল্য। তাই ভীমা কোরেগাঁও-এর মামলায় তাকে ফাঁসানো। ওয়াকিবহাল মানুষমাত্রই জানেন, কীভাবে এই ভীমা কোরেগাঁও মামলাকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক কর্মীদের জেলে পোরা হয়েছে। ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, আনন্দ তেলতুম্বডে— সকলেই রয়েছেন সেই তালিকায়। বিনা বিচারে, এমনকী সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্সের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা পর্যন্ত না করে এই অ্যাক্টিভিস্টদের শুধু জেলে পুরে রাখাই হয়নি, এঁদের অসুস্থতা সত্ত্বেও সঠিক স্বাস্থ্য-পরিষেবা পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি গৌতম নভলাখাকে সামান্য চশমা পরার অনুমোদন দিতে মহামান্য আদালত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় নিয়েছে।

এখন ২৬ জানুয়ারির ঘটনায় ‘নিউজক্লিক’-এর ভূমিকা নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে কেঁচো খুড়তে কেউটের মতো যদি ভীমা কোরেগাঁও বা এজাতীয় তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহের সাজানো ষড়যন্ত্রের চালচিত্র সাজিয়ে পলিটিকাল থ্রিলারের কনটেন্ট তুলে দেওয়া যায় দেশের লোকের ফাঁকা মগজে, তাহলে তো রাষ্ট্রেরই সুবিধে। এই তো বছরদুয়েক আগে ‘কুইন্ট’-এর রাঘব বহেলের বাড়িতে রেড হয়েছিল। সকলেই কমবেশি জানে, সরকারকে স্বস্তি দেয়, এমন খবর ‘কুইন্ট’ বিশেষ করে না। তখনও করত না। সরকারের প্রিয় শিল্পপতি আদানিভাই ‘দ্য ওয়্যার’-এর নামে মানহানির মামলা ঠুকেছিল। যদিও  সে মামলা তারা হেরে গেছে বলেই খবর। পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার নামে ইতিমধ্যে অজস্র মামলা ঝুলছেই। এদেশে সত্যিকারের সাংবাদিকদের পরিণতি এটাই। হয় এই মামলা এবং গ্রেফতারির চক্কর, নয়তো গৌরী লঙ্কেশের চূড়ান্ত পরিণতি। সাংবাদিক খুন এদেশের নয়া বাস্তবতা এখন। যেজন্য গণতন্ত্রের সূচক চড়চড় করে নামছে, তবে তাতে আর সরকারবাহাদুরের কী যায় আসে! আইটি সেল আছে, ভক্ত ব্রিগেড আছে। সমানতালে ইতরামি তারা চালিয়ে যাবেই।

এবারে প্রথম দৃষ্টান্তে ফিরে যান। টাকা দিয়ে টিআরপি কেনা, দেশকে ভুয়ো জাতীয়তার ড্রাগ দেওয়া, মিথ্যেবাদী ক্রিমিনাল সাংবাদিকদের এদেশে অবস্থান কী, আর সত্যি কথা বলার পুরস্কার এদেশে কী— সেটা একবার মিলিয়ে দেখুন বন্ধুরা!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...