গন্ধবাজার

গন্ধবাজার -- উপল মুখোপাধ্যায়

উপল মুখোপাধ্যায়

 

গন্ধবাজারের খোলা কপাট দেখে যেই বিদ্যুৎ পিক আপ বাড়াল, সজোরে বেঁকে গেল চাকা আর বাইক আছাড় দিয়ে লাফিয়ে উঠল। তার সঙ্গে লাফিয়ে উঠল বিদ্যুৎ। ওর পেছনে যারা ছিল সেই দুইজন পরে বাড়িতে ফিরে দু রকমের ন্যারেটিভ বানিয়েছে।

একটা ন্যারেটিভে গন্ধবাজারের বন্ধ দরজায় বিদ্যুতের বাইক ধাক্কা মারার খবর আছে। খুবই জোর সে ধাক্কা। এমন জোর যে গন্ধবাজারের দরজা কেঁপে উঠেছিল। এমন জোর যে ওই দরজায় খোদাই করা প্রাচীন সব মূর্তি ও ইঙ্গিত নাকি জ্যান্ত পুতুলের মতো টপাটপ লাফিয়ে নেমে প্রবল নড়াচড়া করে আবার টেনশন কমে এলে যে যার জায়গায় ফিরে ওই দরজার কারুকার্য হয়েছে, আগের মতোই হয়ে গেছে। ওই ন্যারেটার বিদ্যুতের বন্ধু হওয়ায় বিদ্যুতকে কোন দোষারোপ করেনি বরং সব কিছুর জন্য যে দরজা দায়ী এমন একটা ভাব তার লেখার ছত্রে ছত্রে আছে। পড়ার সময় সে সব ছত্রগুলো এমনই জলজ্যান্ত হচ্ছিল যে বাধ্য হয়ে কেউ কেউ বলে ওঠে, “একটু মডিউলেশনটা কম কর বাবা। লেখাটা বুঝতে দে।” তখন সেই ন্যারেটার যে মন দিয়ে লেখা পড়ছিল একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলে উঠল, “মানে, মডিউলেশন কোথায় করছিলাম। আমি তো শুধু পড়ছিলাম। তা হল কি পড়ব না?” এই দূর দেশে ফিরে এসে যখন গন্ধবাজার নিয়ে কথা হয়, যখন তার ওপর পরত পরত লেখার মালমশলা দিয়ে ন্যারেটিভ বানানো চলে, তখন গন্ধবাজার বা তার বন্ধ দরজা আলাদা মানে বহন করে না। কখন যে সে লেখার অঙ্গ হয়ে যায় বোঝাই যায় না। তাই বার বার বলে ওই ন্যারেটারকে পড়তে রাজি করানো গেছে। হ্যাঁ, পড়েছে বটে সেই ন্যারেটার যে বাইকে বিদ্যুতের ঠিক পেছনে বসেছিল। তার সামনে বিদ্যুৎ আর পেছনে আর এক ইয়ার দোস্ত চেপে ঠেসে আছে। সেই চাপ খেতে খেতে গন্ধবাজারের কিস্যাকে দরজার  নামে চালিয়ে দেওয়ার যোগ্য লোকটি ছিল ওই ন্যারেটার যে বিদ্যুতের বাইকের ঠিক মধ্যিখানে বসে ছিল। সে ন্যারেটিভে প্রমাণ করে ছেড়েছিল অনড় অটল এক বন্ধ দরজা ভাঙাটা কত জরুরি যার জন্য বিদ্যুতের মতো কুশলী বাইকদারকেও প্রচুর ঝুঁকি নিয়ে সামনে বাধা আছে জেনেও ধাক্কা মারতে হয়। অথচ বর্ণনায় দরজা খোলার কোনও গল্প শোনায়নি সে।

এইভাবে প্রাথমিক ধাক্কার পর অন্য কোনও বার বা বার বার ধাক্কা দিয়ে ওই দরজাকে পেড়ে ফেলতে বলতে পারেনি ন্যারেটার যে বিদ্যুতের বন্ধু। একটু লাজুক প্রকৃতির, তাই মধ্যিখানে বসতে চায়, অথচ কেউ বুঝতেই পারে না যে সে মধ্যিখানেই বসবে বলে ঠিক করে, ওঁত পেতে আছে। এই ন্যারেটারের বর্ণনায় গন্ধবাজারের কারুকার্যখচিত দরজার সব কার্যকারিতা অটুট থাকে ও সে নিজেও অটুট।

দ্বিতীয় ন্যারেটর পতন ও মূর্ছা নিয়ে এক গল্প ফেঁদে বসবে কি? সে কিন্তু একটা কিছু করতে পারে এমন আন্দাজ সকলেই করতে পারে। ওই বর্ণনায় প্রথম ন্যারেটিভের থেকে নিজেকে আলাদা করার তাগিদও থাকবে আর থাকবে গল্প। হ্যাঁ, গল্পের পরত পরত চড়ালে থমকে যাওয়া ও পড়া নিয়ে কতক্ষণ আর টানা যায়। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম করে বর্ণনা করেছিল দ্বিতীয়জন, বিদ্যুতের দ্বিতীয় বন্ধু, বাইক রাস্তায় গতি সামলাতে না পেরে পড়ায় যার সবচেয়ে বেশি আঘাত লেগেছিল তার কারণ সে ছিল একদম শেষে। বাইকের একদম শেষে বসে সে পড়ে যাওয়া বাইকের আর অন্য দু সওয়ারির চাপ অনুভব করে হাঁসফাঁস করছিল আর ন্যারেটিভে লিখেছিল গন্ধবাজার খুলে যাওয়ার সব গল্প। হ্যাঁ, খুলে যাওয়ার পর আর গন্ধবাজারের কোনও আগল থাকেনি। কী না দেখা গেল সেখানে। প্রথমে দেখা গেল রাস্তা, তারপর দেখা গেল ঘরবাড়ি, তারপর দেখা গেল মানুষজন, তারপর দেখা গেল পুজো হচ্ছে। তারপর দেখা গেল এরকম সেরকম না করে ভালো করে গুছিয়ে খোঁপা বেঁধে রাস্তা দিয়ে চলেছে মেয়েরা আর ছেলেদের দল সেই মেয়েদের দলেদের দেখে দেখে দেখিয়ে দেখিয়ে হাঁটছে। এই সব প্রবল হাঁটাহাঁটির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে সব কিছু। কিছুই স্থাণু থাকছে না। কেন পড়ছে জিজ্ঞেস করাতে সবাই বলছে, “পুজো পুজো।”

–পুজোর সঙ্গে পড়ার কী সম্পর্ক আছে?
–আছে আছে।
—এর কোনও ব্যাখ্যা চেও না শুধু তাকিয়ে দেখো দেখো দেখো।
—দেখাদেখির পর কী হবে?
—দেখাদেখির পর দেখাদেখি হবে হবে।

এইভাবে বর্ণনা দিতে দিতে চলতে ফিরতে গল্প এগোতে থাকে। দুঃখ দুঃখ ভাব করে পুজোর আনন্দকে প্রকাশ করা হয়। এমন এক ঠাকুর কল্পনা করা হয় যে সামনে ট্যাঁকে এক ছেলে ও পথে এক ছেলে নিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তার অন্য মেয়েরা হাঁটছে তো হাঁটছে কারও হাতে লক্ষী পেঁচা কারও হাতে সঙ্গীতের অস্ত্রশস্ত্র আর হাঁস উড়ব উড়ব করে গন্ধবাজারের চাঁদের কোল দিয়ে ভরপুর সন্ধেবেলা সিল্যুট তৈরি করতে করতে গেল। দেখা গেল অনড় ঠাকুরটি কিন্তু চেয়ে আছে ও তার হাতে দশটি অস্ত্র। গন্ধবাজারের আসল ঠাকুরজান পেছনের হ্যালো হয়ে বিদ্যমান থেকেছেন দ্বিতীয় ন্যারেটারের দ্বিতীয় ন্যারেটিভে যে বিদ্যুতের আরেক বন্ধু। সে বাইকের পেছনে বসায় সবচেয়ে জোর চোট পেয়ে পেয়ে আসছে দীর্ঘকাল আর সে জন্য ঠিকই করেছে এমন এক ঠাকুরের ছবি আঁকবে যার সামনে দুঃখীর মূর্তির আড়ালে আসলে ঠাকুর থেকে যাবে চিরকাল।

বাইক থেকে কেন পড়েছিল ভাই বিদ্যুৎ। এতবড় বাইকবাজ— অনায়াসে দশজনকে বসিয়ে দুমকার ঢেউখেলানো পথে যে যান ছোটাতে পারে সে আসলে পড়েছিল কেন? গন্ধবাজারের দরজাকে প্রণাম করে সেই কাহিনি এবার শোনাবে বিদ্যুৎ যার মাথাও থাকবে না, মুণ্ডুও থাকবে না, হাতও থাকবে না, পাও থাকবে না। ভয়ও থাকবে না, ভক্তিও থাকবে না। এক কাহিনি যার হ্রস্বই থাকবে না দীর্ঘই থাকবে না। কী জন্য থাকবে না, কারু থাকবে না, কিছু থাকবে না সেটাই জানতে প্রশ্ন করা হল তাকে—

—বিদ্যুৎ।
—হুম।
—গন্ধবাজারের দরজার সামনে তুমি পড়েছিলে?
—পড়েছিলাম সে তো সবাই দেখেছে।
—তুমি দেখেছ কি?
—আমার পড়া আমি দেখিনি।
—ভাই।
—ভাই বিদ্যুৎ।
—বলো।
—গন্ধবাজারের রাস্তায় তুমি যেতে পেরেছিলে?
—না।
—তবে কোথায় পড়লে তুমি?
—কেন গন্ধবাজারের দরজার সামনে— দেখোনি?
—দেখেছি।
—তবে?
—তবু মনে হল যেন তুমি ঢুকে পড়ে পুজোর মধ্যে ছিলে। হাঁটছিলে হাঁটছিলে তুমি— মেয়েদের পিছু পিছু। পুজোর মধ্যে— দুঃখ দুঃখ
—কাঁদছিলাম।
—কখন?
—সারাদিন। সারারাত।
—কত দিন? কত রাত?
—নয় দিন দশ রাত। দশ দিন এগারো রাত কাঁদছিলাম আমি। তাতে রাস্তা চটচটে হয়ে উঠেছিল।
—রাস্তা কি চটচটে হয়?
—হয়। চোখ যদি ফুলে ওঠে। পড়তে পড়তে পড়তে যদি চোখের ভেতর থেকে চটচট করে কান্না বেরোয়— তবে হয়।
—অদ্ভুত! তাই না!
—আমার ন্যারেটিভও অদ্ভুত।
—কী তোমার ন্যারেটিভ?
—কেন? পড়ে যাওয়াটাই। দরজার সামনে যান নিয়ে, বন্ধু নিয়ে পড়ে যাওয়াটাই।

বিদ্যুতের তৃতীয় ন্যারেটিভ শোনার পর বোঝা গেল— এ এক যন্ত্রের কথা বলছে। এক বিশিষ্ট পুজোর যন্ত্র। আগের দুই ন্যারেটিভের মতো নয় যার শেষে অবধারিত এক ঠাকুরাইন আছেন, প্রবল প্রতাপ তেনাতে আরোপিত। ওর ন্যারেটিভ তৃতীয় হলেও তার চতুর্থ ও পঞ্চম ও ষষ্ঠ হতে হতে এমন এক যার আপাত শেষ হচ্ছে না। আর প্রত্যেকটা পুজোর দিনই ও কেবল কাঁদছে কারণ এক অলক্ষ্য ঠাকুরকে বদনাম দিয়ে দিয়ে সেই কবে মারা হয়েছে। এখন অসুর নাম দিয়ে দিয়ে তাকে রোজ মারতে মারতে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে দুঃখ দুঃখ দুঃখ মুখ করে থাকা পুজোর দল যাদের পেছনে এক অলঙ্ঘ্য ঠাকুরাইনজির প্রতাপ আছে। আরোপিত ঠাকুরাইনজির সেই প্রতাপে বিদ্যুৎ ও তার ন্যারেটিভকে এইভাবে থমকে যেতে দেখে বলা যায়— জয় হুদুর দুর্গা। জয় অসুর। দেখা যাবে বিদ্যুতের চোখ থেকে চটচটে অশ্রু রাস্তা ভরিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে। সে অনায়াসে বাইক চালিয়ে পেছনের দু বন্ধুকে নিয়ে ওই রকম সকমের পথ দিয়েই চলে গেল। আর গন্ধবাজারে প্রাচীন দরজা যার সারা গায় মূর্তি ও ইঙ্গিতরা রয়েছে তারা থেকে যাচ্ছে, মরচে পড়ছে না—  হ্যাঁ, তা ষোলোশো বছর তো হবেই। এ এক এক এক অসুরের লোহা তৈরির গল্পই বটে যাতে আর যাই হোক মরচে পড়ে না।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...