কাব্যের ক্যানভাসে ‘বর্ষা’র বুনন

কাব্যের ক্যানভাসে ‘বর্ষা’র বুনন -- মীম মিজান

মীম মিজান

 

বৈচিত্র্য আর শ্যামলিমার এ দেশ। খা খা রোদ্দুর। সাদা মেঘের কর্ষিত আকাশ জমিন। মধুরসে মুখ ও মন ভরার মাস। হলদে ফুলে দিগন্ত বিস্তৃত দৃশ্য। কিংবা কুল-উপকুল ছাপিয়ে যাওয়ার বরিষণ। আরও কত বৈচিত্র্যময় রূপের রানি মাতৃকা আমাদের। তার বৈচিত্রের প্রধানতম কারণটি হচ্ছে বারো মাসে বিচিত্র ছয়টি ঋতু। এদেশের বৈচিত্র্যময় আবহে লালিত কবিদের মনও উন্মুখ হয়েছে মার রূপ-লাবণ্যের মনোহারী উপস্থাপনে। বসন্ত ও বর্ষা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের কবি-সাহিত্যিকগণ যত রূপে লিখেছেন আর কোনও ঋতু নিয়ে ততটা লেখেননি তাঁরা। তার মধ্যে বর্ষা-ঋতু বাংলার কবিদের মন ও মননকে আন্দোলিত করেছে অনন্য এক আলোড়নে। সব যুগে সব সময়ে বর্ষা তার অপরূপ রূপের বিচ্ছুরণে হানা দিয়েছে প্রেমিক কবির মনে। কবিরাও অপরূপ রূপের রানি বর্ষার বিচ্ছুরণ ও ছপছপ ঝরে যাওয়ার শব্দে মোহিত হতে চেয়েছেন বারবার। এ কথা অত্যুক্তি নয় যে, বাংলা কবিতায় বর্ষা ঋতুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বর্ষার চরিত্র বা সৌন্দর্যের যে বহুমুখী বৈচিত্র্য তা অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে স্বতন্ত্র।

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ খুঁজলে স্বরূপে বর্ষা ঋতুর উল্লেখ পাই না। তবে বর্ষার মরসুমে এ অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের জীবনচিত্রের ক্যানভাস ফুটে ওঠে। চর্যায় নদী ও নৌকো সংক্রান্ত রূপকের সংখ্যাধিক্য, গুণ টানা, দাঁড় টানা, পাল তোলা, উজান বাওয়া প্রভৃতি বারংবার আচরিত হয়েছে। যার বহুরৈখিক বিশ্লেষণ ও অনুভব দাবী করে যে, বর্ষাকালে কূলছাপানো প্রমত্তা তটিনী ও কৃষকদের দৈনন্দিন জীবন প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ৩৮নং পদে দেখা যায়— “কাঅ ণাবডহি খান্টি মন কেডুয়াল।/সদগুরুবঅণে ধর পতবাল।” অর্থাৎ কায় [হইল] ছোট নৌকাখানি, মন [হইল] কেরোয়াল। সদ্গুরু-বচনে পতবাল (পাল) ধর। (সুকুমার সেন কর্তৃক অনূদিত)।

বাংলা কাব্যসাহিত্যের দ্বিতীয় যুগ বা মধ্যযুগের অনেক কবির কবিতায় বর্ষার বর্ণনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এঁদের মধ্যে কবি কালিদাস, জয়দেবের কবিতায় বর্ষার সন্ধান মেলে। তা ছাড়া কবি বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, কবি বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, রায়শেখর, মনোহরদাস, বাসুদেব ঘোষ এঁদের প্রত্যেকের বৈষ্ণব পদাবলিতেও বর্ষার অল্পবিস্তর বর্ণনা রয়েছে। যেখানে দেখা যায় যে, তাঁরা প্রত্যেকেই রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের যে অনুরাগ সেই অনুরাগের গভীরতাকে প্রকাশ করেছেন বর্ষার বিভিন্ন রূপবৈচিত্র্যের বর্ণনার মধ্য দিয়ে। এছাড়াও মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, খনার বচন, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, স্বর্ণকুমারী দেবী, অক্ষয়কুমার বড়াল, প্রমথনাথ রায়চৌধুরী প্রমুখের কবিতায় বর্ষার উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এঁদের হাত ধরেই বাংলা কবিতায় বর্ষার বিচিত্ররূপ বা সৌন্দর্য উঠে এসেছিল। এ প্রসঙ্গে মেঘদূতের কবি কালিদাস বর্ষাকে কীভাবে অনুভব করেছেন তা দেখা যেতে পারে। কালিদাস বর্ষাকে অনুভব করেছেন সংরাগের গভীরতায়। কালিদাসের দৃষ্টিতে বর্ষার সৌন্দর্য-সখা যে মেঘ, সেই মেঘকে কবি লোভনীয় সম্ভোগের আভাস দিয়ে যক্ষের সহচররূপে যক্ষপ্রেমিকার কাছে পাঠান। সেখানে মেঘ সঙ্গত কারণেই প্রেমের বার্তাবহ দূতরূপে চিহ্নিত হয়। মেঘের সঙ্গে মিলন আর বিরহের একটা অনড় সম্বন্ধ পাতিয়ে কালিদাস তাঁর কবিতায় এক অনবদ্য চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। কালিদাসের কবিতার তর্জমা থেকে খানিক পড়লেই আমরা তাঁর বর্ষা নিয়ে কবি হৃদয়ের অভিব্যক্তি বুঝতে পারব:

কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে
যদি-না জলধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গলবার্তা?
যক্ষ অতএব কুরচিফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য
স্বাগত-স্বভাষ জানালে মেঘবরে মোহন, প্রীতিময় বচনে।

মধ্যযুগের অন্যতম কবি কবিকঙ্কণ উপাধিখ্যাত মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘কালকেতু উপাখ্যানে’ কালকেতুর সহধর্মিণী ফুল্লরার বারোমাসের দুঃখের উপস্থাপনায় বর্ষাকাল সম্পর্কে বলেছেন:

আষাঢ়ে পুরিল মহী নবমেঘে জল।
বড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বর॥
মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরে।
কিছু খুদকুঁড়া মিলে উদর না পুড়ে॥
শ্রাবণে বরিষে মেঘ দিবস রজনী।
সিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি॥

বাংলা সাহিত্যের ভানুখ্যাত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাব্যজমিনে বর্ষাকে উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। তাঁর হাত ধরেই ছন্দোবদ্ধ মাধ্যম কবিতায় বর্ষা যেন পূর্ণতা পেয়েছে। তাঁর কবিতায় বর্ষার বিচিত্র রূপ প্রকাশ পায় বর্ষাবন্দনা রূপে। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বাদ দিলেও বহু জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে আমরা বর্ষার অনুষঙ্গ খুঁজে পাই। তাঁর ‘আষাঢ়’, ‘সোনার তরী’, ‘বাঁশি’ সহ বহু কবিতায় বর্ষা এসেছে বিভিন্ন রূপ নিয়ে।

‘আষাঢ়’ কবিতায় তিনি মানুষকে ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। তবে আষাঢ় মাসের একটি নিটোল বর্ণনা তাঁর কবিতার দৃশ্যপটে ভেসে উঠেছে। আউশের খেত, কালিমাখা মেঘ, ধেনু ও ধবলীর বর্ণনায় সত্যিই গ্রামবাংলার অপরূপ দৃশ্য প্রস্ফুটিত হয়েছে। যা পাঠকহৃদে চিরজাগরুক হয়ে থাকবে।

‘সোনার তরী’ কবিতার দৃশ্যকল্প এরকম— আকাশে মেঘ গর্জন করছে। চারিদিকে বরষার পানি থৈথৈ করছে। সঙ্গে খরস্রোত বয়ে চলছে। জমির ধান কেটে একটি ছোট খেতে কৃষক একা বসে আছেন, পার হওয়ার কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। ধান কাটতে কাটতে নদীর জল বেড়ে গেছে। খেতের চারিদিকে নদীর বাঁকা জল খেলা করছে। যদিও জীবনদর্শন এখানে প্রোথিত তবুও তা বর্ষাকালীন আবহের উপমায়।

প্রেম কিংবা দ্রোহ যাঁকে করেছে মহান ও অবিস্মরণীয় তিনিই আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কবিতায় বর্ষা এসেছে প্রেমের জারক হিসাবে। প্রেয়সীর বিয়োগ ব্যথা কয়েকগুণ রূপ দিয়েছে ঝরঝর আষাঢ় দিনের অম্বর। আষাঢ় ঢল প্রেয়সীর প্রত্যাগমণ সুরকে প্রস্থানের সুরে পরিণত করেছে। বাদল রাতের বর্ষণ সিক্ত বিহঙ্গ হয়ে ওঠে কবির বেদনা বিজয়ী মানসলোকের চিত্রল প্রতীক। বিরহকাতর খককে কবি তাই বলছেন, তুমি যার জন্যে কাঁদছ সে তো তোমার জন্যে কাঁদে না। যেমনটি ‘চক্রবাক’ গ্রন্থের ‘বাদল রাতের পাখী’ কবিতায় কবির উপদেশ:

বাদল রাতের পাখী।
উড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল, নাহিক ফুলের ফাঁকি।

কবি বর্ষার এই রাতে পাখিকে বন্ধু ভেবেছেন। পাখির বিরহের সঙ্গে নিজের বিরহ একাকার করেছেন। প্রকৃত বিষয় হচ্ছে যে, সব আড়ম্বরতা ত্যাগ করে কবি বাদলের নির্জনতায় অনুরাগের মূর্তি গড়েন। অন্যদিকে নজরুল ইসলাম বর্ষার বিদায় মুহূর্তে ব্যথিত হয়েছেন। কবি বর্ষাকে বলেছেন, তোমার বিদায়ের কথা শুনে কেয়া রেণু পাণ্ডুর হয়েছে, প্রণয় অশ্রুসম শিশিরভেজা শেফালি ঝরছে আজ। ঝরে কদমের কেশর। ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ষা-বিদায়’ কবিতায় কবি তাই বলেছেন:‘সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নুপূর খুলি’

চলিতে চলিতে চমকি’ উঠ না কবরী উঠে না দুলি’!
সেথা রবে তুমি ধেয়ান-মগ্ন তাপসিদী অচপল,
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি ‘ফটিক-জল’!

পল্লীকবি জসিম উদ্দীন বর্ষায় দেখেছেন গাঁয়ের কৃষক-মুঠেরা কি করে তাদের এ আলস্য সময়ে। দাওয়ায় বসে গল্প, গান কিংবা গৃহস্থালি কিছু উপকরণ তৈরির দৃশ্য। যেমনটি ‘পল্লী-বর্ষা’ কবিতায় গাঁয়ের চিত্র বর্ণনায় লিখেছেন:

গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়,
গল্পের গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে বাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি,
কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধে কসি কসি।

প্রাচীনযুগ থেকেই বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় বর্ষাঋতুর মুখরতা নিয়ে রয়েছে উচ্ছ্বসিত বন্দনা, অনুরাগ ও স্তুতি। রহস্যময়ী এ বর্ষার রূপ, বৈচিত্র্য, চমক, বর্ণচ্ছটা এবং আকাশ-প্রকৃতির গভীর বন্ধুত্ব শিল্প-সাহিত্যের সরস উপকরণ হিসেবে আবহমানকাল থেকেই অনুপ্রাণিত ও স্পন্দিত করছে শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকদের।

তার-ই ধারাবাহিকতায় কবি আহসান হাবীব বৃষ্টিকে ঘিরে আমাদের দারিদ্র্য, হতাশা আর স্বপ্নকে বুনেছেন নিজস্ব স্বপ্নময়তাকে অবলম্বন করে। তিনি যেন প্রবল কোনও ঘোরের মধ্যে থেকে পার করছেন অপেক্ষার নিরন্তর প্রহর। তাঁর ‘রেনকোট’ কবিতায় লিখেছেন:

পঁচিশটি বর্ষা ত পেরিয়ে এলাম
দেখে এলাম
কত অন্ধকার অরণ্যশীর্ষ
কালো মেঘের অন্ধকারে ছাওয়া,
দেখলাম
কত ঝরঝর বর্ষা
আর কত নিঃসঙ্গ জানালার
ইতিহাস পড়লাম
আমার নির্বিকার জানালায়।

আমরা যদি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার জনক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার দিকে দৃষ্টি ফেরাই, তাহলে দেখতে পাই তিনি বর্ষাকে কল্পনা করেছেন প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসাবে। তাঁর কবিতায় বর্ষার প্রকৃতি ও মানবপ্রকৃতি মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। যার সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করেছেন দেবতাগণও। মধুসূদন দত্তের ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার রূপকল্প বর্ণনা হয়েছে এভাবেই:

গভীর গর্জন করে সদা জলধর
উথলিল নদ-নদী ধরণীর উপর
রমণীর মন লয়ে
সুখে কেলি করে
দানবাদি দেবযক্ষ সুখিত অন্দরে।

‘বিপ্লবী’ ও ‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ ফররুখ আহমদ অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণায় ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তাঁর কবিতায়ও বর্ষার দোল লেগেছে। বৃষ্টির ছন্দ তাঁকে নাচিয়েছে। মনে আনন্দের ঢেউ খেলিয়েছে। তিনি আনন্দে তবলার ছন্দের মতো শিশুতোষ কাব্য ‘বৃষ্টির গান’-এ গেঁথেছেন:

বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথায় রে
লুকিয়ে গেলো বাঁশবনে।
নদীতে নাই খেয়া যে
ডাকলো দূরে দেয়া যে
কোন সে বনের আড়ালে
ফুটলো আবার কেয়া যে।

বাংলা সাহিত্যের মহিলা প্রতিনিধিত্বকারী কবি সুফিয়া কামালের সৃজন মানসে বর্ষার আগমন ও স্তুতি এক বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। পোয়েট অ্যান্ড পেইন্টার খ্যাত ইংলিশ কবি উইলিয়াম ব্লেক যেমন ‘ল্যাম্ব’ ও ‘টাইগার’ দুটি কবিতা দিয়ে স্রষ্টার সৃষ্টির দুটি বিপরীত কিন্তু অনিবার্য মহিমা তুলে ধরেন সুফিয়া কামালও তাই। বৈশাখের তপ্ত খরতাপের পরে আসে বর্ষা। বর্ষার নতুন জল ধারায় প্রাণে জাগে স্পন্দন। সজীবতায় প্রাণ ফিরে পায় বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড। ঝড়ের রুদ্রমূর্তির পরে সরস বর্ষার যে রূপের সন্ধান মেলে, তা কবির ‘ঝড়ের শেষে’ কবিতায় উঠে এসেছে:

মধুর মমতা ধারা বিথারিয়া আর্দ্র সমীরণে
ভুলিয়া বেদনা জ্বালা শুচিস্মিতা প্রশান্ত আননে
চাহিয়াছে ঊর্ধ্বমুখী সুকল্যাণী ঝঞ্ঝা বিশেষে
যত ক্ষতি যত ব্যথা ভুলাইয়া ভুলিয়া নিঃশেষে।

বর্ষাকাল মানেই আকাশ কালো করা ঘন মেঘের আনাগোনা, যখন তখন ঝমঝমিয়ে পড়ে বৃষ্টি। পথে ঘাটে কাদাপানি। ঘরে স্যাঁতসেঁতে ভাব। তাই তো কবি শামসুর রাহমান বর্ষার বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন:

হঠাৎ আকাশ সাদা মুখটি কালো করে,
কালো মেঘে বুকটি ফুঁড়ে পানি পড়ে।
ঝর ঝর ঝর একটানা বৃষ্টি ঝরে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি ঝরে।

এছাড়া কেতকীর মনমাতানো সুগন্ধ, কদমফুলের চোখ জুড়ানো শোভা ও পেখম খোলা ময়ূরের উচ্ছ্বল নৃত্যের আবাহন থাকে এই আষাঢ়েই। তাই প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন— ‘ধ্যানমগ্ন বাউল— সুখের বাঁশি’।

অত্যন্ত ছন্দ সচেতন কবি, নাগরিক জীবনের আখ্যানকার আমাদের শামসুর রাহমান। প্রিয়ার স্বভাব আঁকতে যেয়ে কবি আশ্রয় নিয়েছেন তুমুল বৃষ্টির। কবি তাঁর এমন বর্ষার দিনে কবিতায় লিখছেন:

মনে হয়, আষাঢ় তোমার মন আর
হৃদয় শ্রাবণ।

বর্তমান সময়ের বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আল মাহমুদ বর্ষাকে দেখেছেন অন্য এক দৃষ্টিতে। তাঁর কবিতায় বর্ষা-প্রকৃতি অন্যমাত্রার এক কথা বলে। ‘আষাঢ়ের রাত্রে’ কবিতায় তিনি ব্যক্ত করেছেন:

শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়, শেওলা পিছল
আমাদের গরিয়ান গ্রহটির গায়।

সদ্যপ্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ বৃষ্টির দিনে নস্টালজিয়ায় ভেসেছেন। আবার মৃত্যুর কথার স্মরণে এসেছে টুপটাপ জলের ধারায়। কবি লিখছেন:

আমার দুঃখের দিন তথাগত
আমার সুখের দিন ভাসমান
এমন বৃষ্টির দিন পথে পথে
আমার মৃত্যুর দিন মনে পড়ে।
আবার সুখের মাঠ জলভরা
আবার দুঃখের ধান ভরে যায়
এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে
আমার জন্মের কোনো শেষ নেই।

(বৃষ্টি: শঙ্খ ঘোষ)

স্বল্পপ্রজ কবি শহীদ কাদরীর বর্ষামুখর ছন্দময় সৃজন মানেই একাকিত্ব আর হতাশাবোধ। সৈয়দ হকের কাছে এ কদম-কেয়ার কালে মুষলধারে বৃষ্টি মানেই প্রেয়সীর জন্য উচাটন মন। মহাদেব সাহার কাছে বৃষ্টি বা বর্ষা বহুরৈখিক ভাবনার উদগাতা। রফিক আজাদ ছড়াময় বুননে বৃষ্টিকে তাঁর হারানো ছেলের ঘরে ফেরার সঙ্গে উপমা দিয়েছেন। সিকদার আমিনুল হক বৃষ্টির ফোঁটাকে প্রিয়ার কাজলমাখা অশ্রুপাত করে কাব্য বুনেছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের কাছে বরষার রূপ মান-অভিমানের, অসময়ের উদয়ন-প্রস্থান। আসাদ চৌধুরীর দেশজতা আর গ্রামীণ আবহের কাব্যমালায় বৃষ্টি এতটাই বাঙময় যে খোদ বৃষ্টি নিয়েই তাঁর একখানা কাব্যগ্রন্থের নামকরণ করেছেন। কী দারুণ উপমা না সৃষ্টি করেছেন জাত কবি আবুল হাসান! স্বল্পপ্রজ কাব্য লিখিয়ের খাতায় বৃষ্টি বন্দনার উপমাময় কাব্য পাঠে হৃদয় শীতল হয়ে যায়। এছাড়াও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, কায়কোবাদ, ইসমাঈল হোসেন শিরাজী, শেখ ফজলল করীম, কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, আবিদ আজাদ সহ অন্যান্য কবিগণের কাব্য ক্যানভাসও বৃষ্টিময়, বাদলের ধারায় ঝরঝর। আষাঢ়ের ঢলে টইটম্বুর।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...