না-ই বা ভালোবাসলে…

না-ই বা ভালোবাসলে… -- ঋতব্রত ঘোষ

ঋতব্রত ঘোষ

 

লেখার প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো নোলান জকোভিচের, যাকে বলে ফ্যান, আমি নই। জকোভিচকে নিয়ে লিখতে বসতে হবে এমন ভাবনা বছর দুয়েক আগেও মাথাতেই আসেনি। আমরা ফেডেরার-নাদাল, মিডিয়া ভালোবেসে ডেকেছিল ‘ফেডাল’, তাদের দ্বৈরথ নিয়ে এক দশক দিব্যি কাটিয়ে দিয়েছি, পুরুষদের টেনিস ততদিন ছিল আমাদের পছন্দসই বাইনারি ন্যারেটিভের চেনা ছকে বাঁধা। সমস্যার সূত্রপাত তখনই, যখন এই ছক ভেঙে ২০১৮ সালের উইম্বলডনে অবতীর্ণ হন ‘বহিরাগত’ নোভাক এবং এক অচেনা অথচ অনিবার্য আশঙ্কার চোরাস্রোত বইয়ে দেন ফেডাল-অনুরাগীদের হৃদয়ে।

ধারাবাহিক অফ ফর্ম এবং চোটের কবলে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা প্রায় হারিয়ে ফেলা রজার ফেডেরার যখন ২০১৭ সিজনে স্বমহিমায় ফিরে এলেন আর অষ্ট্রেলিয়ান ওপেন ফাইনালে নাদালকে হারিয়ে গ্র‍্যান্ড স্ল্যাম ট্রফি তুললেন প্রায় সাড়ে চার বছর পর, টেনিসপ্রেমীরা আশ্বস্ত হন এই ভেবে যে সর্বকালের সেরার তকমা প্রাপ্তির লড়াই এই দুজনের মধ্যেই হচ্ছে, তার আগের দু-বছরে আটটা মেজর টুর্নামেন্টের পাঁচটাই জিতে নেওয়া সার্বিয়ান জকোভিচের দাপট নেহাতই চেনা ফর্মের ফেডেরারের অনুপস্থিতির কারণে এক অঘটন মাত্র। মেলবোর্ন জয়ের পরে উইম্বলডন এবং পরের বছরের অষ্ট্রেলিয়ান ওপেনে ফেডেরারের জয় এবং মাঝে প্যারিস আর নিউ ইয়র্কে নাদালের দাপট এই বিশ্বাসকেই মান্যতা দিয়ে দেয় মোটামুটি। গণ্ডগোলের শুরু হয় ২০১৮-র উইম্বলডনে। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, ঘাসের কোর্টে ফেভারিট রজার নিজস্ব নিয়মেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন চ্যাম্পিয়নশিপের দিকে যতক্ষণ না সেমিফাইনালে এক অখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকান কেভিন অ্যান্ডারসনের বিগ সার্ভিসের সামনে সেই রথের চাকা বসে যায়। এটুকুই, এইটুকু সুযোগই দরকার ছিল অন্য সেমিফাইনালে ওঁত পেতে থাকা জকোভিচের, ফাইনালে কেভিনকে প্রায় উড়িয়ে দিয়ে নিজের চতুর্থ উইম্বলডন জিতে নেন তিনি।

এখন প্রশ্ন হল, অন্তত একবার উইম্বলডন জেতার স্বপ্ন নিয়ে প্রায় সব খেলোয়াড় যেখানে প্রো-কেরিয়ার শুরু করেন এবং নিরানব্বই শতাংশের বেশি খেলোয়াড়ই তা পূরণে ব্যর্থ হন, সেখানে জকোভিচ চার-চারটে উইম্বলডন জিতে ফেলার পরেও, অন্য মেজর তো ছেড়েই দিলাম, তাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনের দাবিদার হিসেবে স্বীকার করতে আমাদের এত অনীহা কেন? হ্যাঁ, ফেডেরারের মত ব্যালে ডান্সার-সুলভ মুভমেন্ট বা ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন কব্জির মোচড় নোলানের নেই, নেই নাদালের উত্তুঙ্গ প্যাশনেট টেনিসের ছিটেফোঁটাও। শুধুমাত্র ফিটনেস, দুর্ভেদ্য ডিফেন্স, শক্তিশালী রিটার্ন আর শেষ মুহূর্ত অবধি হার না মানা মনোভাব যার টেনিসের সম্বল, তাকে দর্শক হিসেবে ফেডেরার-নাদালের সঙ্গে একাসনে বসানো সত্যিই মুশকিল। কিন্তু স্ট্যাটিসটিক্স এসবের ধার ধারে না, শচীন বা লারার চেয়ে জ্যাক কালিসের টেস্টে রানের গড় বেশি, সে আপনার তার ব্যাটিং দেখতে বাকি দুজনের তুলনায় ভালো লাগুক বা না লাগুক, সেটাই সত্যি। কিন্তু এখানে ২০১৮-র উইম্বলডন অবধিও স্ট্যাটিসটিক্স ছিল ফেডালবাদীদের পক্ষে। প্যারিসে মাটির কোর্টে তখনও নাদাল নিজের গড় রক্ষা করে যাচ্ছিলেন, ফেডেরারের ওপর দায়িত্ব বর্তায় ঘাসের জমিতে নোভাক-তাণ্ডব রোখার। বাঘ বুড়ো হলেও বাঘ, আটতিরিশ বছরের ফেডেরার কোয়ার্টার ফাইনালে নিশিকোরি, সেমিফাইনালে নাদালকে হারিয়ে পৌঁছলেন ফাইনালে। অন্যদিকে শীর্ষবাছাই হওয়ার সূত্রে তুলনামূলক সহজ ড্র পেয়ে জকোভিচও ফাইনালে। সেই খেলায় প্রথম সেটে জকোভিচ, পরের সেটে ফেডেরারের কামব্যাক, এভাবে চলতে চলতে ফিফথ সেটে কী যে ভয়ানক লড়াই হল, শুনলে আপনার গায়ে দেবে কাঁটা। ফেডেরারের ডাবল ম্যাচ পয়েন্ট অন সার্ভ, ৪০-১৫ এগিয়ে, মাঠে উপস্থিত ব্রিটিশ জনতার সমর্থন রজারের পক্ষে, সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ালেন নোভাক। পিছিয়ে থাকা সেই গেম তো বটেই, সেই সেট টাইব্রেকারে নিয়ে গিয়ে জিতে নিলেন ১৩-১২, এবং বলাই বাহুল্য, ম্যাচটাও। এভাবেই চোদ্দই জুলাই, দু হাজার উনিশ টেমস নদীর তীরে চার ঘন্টা সাতান্ন মিনিট তীব্র লড়াইয়ের পর ফেডাল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয়েছিল।

বাকিটা ইতিহাস। তার মধ্যে আরও দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে নোলান— বিজয়রথ, টেনিসদর্শককুল তাকে এতদিনেও ভালোবেসে কাছে টেনে নেয়নি, বরং জকোভিচই শ্রেষ্ঠতম, এই পরিসংখ্যানগত সত্যের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। দুহাজার উনিশের জুলাইতে জকোভিচের গ্র‍্যান্ড স্ল্যাম ছিল ষোলোটা, আজ সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কুড়িতে, যা ফেডেরার আর নাদালের সমান৷ এমনকী রোলাঁ গারো, যেখানে নাদাল আপাত-অপরাজেয়, সেখানেও আজকের তারিখে জ্বলজ্বল করছে নোলান-নিশান৷ এর মধ্যে টোকিও অলিম্পিকের সেমিফাইনালে জার্মান টেনিস তারকা আলেকজান্ডার জেরেভ স্বদেশীয় স্টেফি গ্রাফের গোল্ডেন স্ল্যামের (এক বছরে প্রতিটা গ্র‍্যান্ড স্ল্যাম এবং অলিম্পিকে সোনা) রেকর্ড বাঁচিয়ে দিলেও নোভাকের অন্যথায় সোনায় মোড়া কেরিয়ারে একটা মেডেলের অনুপস্থিতি বিশেষ তারতম্য ঘটাবে বলে মনে হয় না।

নোভাক কোনওদিনই দর্শকদের, মিডিয়ার ভালোবাসা পাননি। পেতে খুব আগ্রহী ছিলেন বলেও মনে হয় না। চেয়ার আম্পায়ারের সঙ্গে তর্কাতর্কি, বলবয়দের সঙ্গে অভব্যতা, কোভিডের সঙ্কটকালে টিকাবিরোধী অবস্থান— নানা কারণে তাঁকে অধুনিক টেনিসের ব্যাড বয় হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। বরং সমসাময়িক খেলোয়াড়দের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রজার এবং রাফার প্রতি যথেষ্ট সম্ভ্রম তাঁর প্রায় প্রত্যেক ইন্টারভিউতেই প্রকাশ পেয়েছে। এক ইন্টারভিউতে নোভাক বলছেন, “রজার আর রাফার সান্নিধ্যে যত উষ্ণতা পেয়েছি, তার ছিটেফোঁটাও তাঁদের ভক্তরা আমায় দেয়নি, অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না কারণ ওরাই আমার বিরুদ্ধে চিৎকার করে কোর্টে আমার সেরাটা বের করে আনে।” অবসরের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রজার এবং প্রায় অস্তমিত রাফায়েল নাদালকে টপকে নোভাক জকোভিচকেই যে একদিন একবাক্যে সবাই G.O.A.T. হিসেবে স্বীকার করে নেবেন, বুকে পাথর চাপা দিয়ে হলেও, তাতে আমার অন্তত কোনও সংশয় নেই… এবং সব গোট কিন্তু ছাগল নয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...