গ্রিন হান্ট

গ্রিন হান্ট -- সাত্যকি হালদার

সাত্যকি হালদার

 

বিজ্ঞাপনের সঙ্গে টিভিটা যে এভাবে মিলে যাবে অরিত্র কখনও তা ভাবেনি।

ভাবেনি তার কারণ বিজ্ঞাপনের ভাষার সঙ্গে প্রোডাক্ট সেভাবে কখনও মেলে না। যে সাবানের ফেনায় নদী ও ঝর্ণা বয়ে যাওয়ার কথা, স্নান-ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে তা আর পাঁচটা আটপৌরে সাবানেরই মতো। বারবার ঘষেও যেন ফেনা হতে চায় না। যে পানীয়র গ্লাস শেষ করা মাত্র চনমনে বাচ্চারা প্রায় চুম্বকের টানে লম্বা হয়ে যায়, কোনও শিশুই কি মাসের পর মাস গ্লাস শেষ করে শেষ পর্যন্ত ওই উচ্চতা পায়। পায় না তার কারণ বিজ্ঞাপনের ভাষা বিজ্ঞাপনের জন্য। একঘেয়ে দেখা বা শুনে যাওয়ার মাঝে হঠাৎই চমক লাগানো। তার জন্য ওই পরিদর্শন। ব্যাপারটা সবাই জানে ও বোঝে— স্বাভাবিকভাবে অরিত্রও।

শহর ছেড়ে লোকাল ট্রেনের প্রায় এক ঘণ্টার পথে অরিত্রর যাতায়াত। রবিবার ছাড়া অন্য সব দিন একরকম। মফস্‌সলের কলেজে ও পড়াতে যায়। সকাল আটটায় বেরিয়ে বাড়ি ফিরতে সন্ধে পার। কোনও দিন দুটো ক্লাস নিতে হয়, কোনও দিন বা তিনটে। ওর কাছাকাছি সময়ে আরও দুজন যোগ দিয়েছে চাকরিটায়। এক জন মৌসুমী, অন্য জন দেবাংশু। মৌসুমী ইংরাজি পড়ায়, দেবাংশু ইতিহাস। ওরাও যেহেতু এ দিক থেকে যায় তাই লোকাল ট্রেনের যাতায়াতটা এক সঙ্গেই করা হয়।

দেবাংশুর মতামত নিয়েই টিভিটা কিনেছিল অরিত্র। দেবাংশু জানে ও খোঁজ রাখে অনেক। আরও অনেক ব্যাপারেই ওর মত নেওয়া যায়। কোথায় কী অফারে মেলে, নতুন কোন বেড়ানোর জায়গা তৈরি হল, এসব তথ্য ধারাবাহিকভাবে ও দিয়ে যায়।  যেমন মাঝখানে একদিন ট্রেনে মুখোমুখি যেতে যেতে বলেছিল, পিয়ারডোবা যাবে অরিত্রদা! হঠাৎ করেই খবর পেলাম জায়গাটার।

সিটে বসে সামনে কোলের ওপর রেখে কাগজ পড়ছিল অরিত্র। দেবাংশু ও মৌসুমী দুজনেই ওর মাস কয় পরে কাজে যোগ দিয়েছে। তাই হয়ত অরিত্রদা বলে। সেদিন ওর ডান পাশে অপরিচিত একজন। তার ওপাশে মৌসুমী। কাগজ থেকে মুখ তুলে সরু চশমাটা আঙুলের ছোঁয়ায় উঠিয়ে নিয়ে অরিত্র বলল, হঠাৎ করে পিয়ারডোবা কেন!

দেবাংশুর ছটফটে গলা। এই গলা খানিকটা ওর স্বভাব। ছাত্রজীবন বেশিদিন আগে চলে যায়নি বলেই হয়ত এরকম। ও বলল, ওখানে আমাদের চেনাজানা একজন টেন্ট-রেসর্ট করেছেন। একেবারে জঙ্গলের মাঝে। আর যেটা মজার, ভদ্রলোক বিদ্যুৎ ব্যবহার করেননি, ট্র্যাডিশনাল উনুনে রান্না। এভাবেই উনি রাখতে চান জায়গাটাকে।

খবরের কাগজের পাতা উল্টে ফেলে অরিত্র। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। বাইরের রোদ দৌড়ে পালাচ্ছে পেছনে। অরিত্র পিয়ারডোবা বা ট্রাডিশনাল রান্নায় তেমন যে আগ্রহ দেখায় তা নয়। তবু বলে, কে কে যাবে সেখানে?

খানিকটা চুপ হয়ে থাকে দেবাংশু। অরিত্র ওর মুখে তাকিয়ে। মৌসুমী জানালা দিয়ে বাইরে। গলার ছটফটে ভাবটা একটু কমিয়ে ফেলে দেবাংশু। বলে, এই ধরো আমরা তিন জন। সঙ্গে তুমি বউদিকেও নেবে। যাও যদি তো ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলি।

মৌসুমী তখনও বাইরে দেখছে। ঠোঁটের কোণে অল্প একটু হাসি। ওদের নামার স্টেশনটা এগিয়ে আসছে। গতি কমছে ট্রেনের। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অরিত্র বলল, ঠিক আছে, ভেবে দেখি। ভিড় ঠেলে নামার মুখে মৌসুমী ঠোঁটের কোণে হাসি ধরে রাখে।

এই আলোচনা, মৌসুমী জানে, ট্রেনে যাতায়াতে শুরু, নেমে যাওয়া এবং ভেবে দেখাতেই শেষ। এমন অনেক বেড়ানোর জায়গা, রবিবার গঙ্গার ধারে গড়চুমুক কিংবা দু দিনের ছুটিতে সুবর্ণরেখা বা কুলিক এসেছে গেছে অনেকবার। ভবিষ্যতেও আসবে। কাছাকাছি আরও একদিন হয়তো পিয়ারডোবা নিয়ে কথা হবে। বৃষ্টি, জঙ্গল, শুকনো পাতা জ্বেলে ট্র্যাডিশনাল রান্না। তারপর সেসবও হারিয়ে যাবে কোথাও। কথা বলার নতুন উপলক্ষ্য এসে যাবে রেলের কামরায়।

তবে বাড়িতেও তো কথা বলার বিষয় চাই কিছু। অরিত্র তাই ঘরে মাঝেমাঝ বার করে আনে পথের এই মজাগুলো। সুচেতাকে ট্রেনে যাওয়ার টুকরো গল্পগুলো শোনায়। যেমন সেদিন ও বলে, নতুন আর একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছে দেবাংশু। আগামী মাসে ও আর মৌসুমী যাবে। আমাদেরও নিতে চাইছে সঙ্গে।

না চিনলেও অরিত্রর মুখে শুনে শুনে যাতায়াতের বা কলেজের অনেকেরই নাম জেনে ফেলেছে সুচেতা। আবারও একটা নতুন বেড়ানোর জায়গা শুনে ও বলে, তোমাদের মৌসুমী আর দেবাংশু বিয়ে করছে কবে? তারপরে তো যাওয়া। না কি!

—বিয়ে করলে কী আর না করলেই বা কী! তার সঙ্গে বেড়ানোর যোগ কোথায়! খানিকটা উদাসীভাবে কথা বলে অরিত্র। যদিও সুচেতা তখন আর বেড়ানোতে থাকে না। টিভিটা অন্‌ করার পর ছবিগুলো লাফাতে শুরু করেছে। সুচেতা সেদিকে চোখ রেখে বলে, কিন্তু দেবাংশুর কাছ থেকে যা জানার সেটা কি জেনেছ?

একটু থেমে থাকে অরিত্র। তারপরেই জিভে ভুলে যাওয়ার শব্দ করে বলে, কাল একদম পাক্কা। জানবই। তবে বেরোনোর মুখে সকালে অবশ্যই মনে করিও।

ট্রেনে যাতায়াতের জীবনে এক দিনের সঙ্গে অন্য দিনে ফারাক নেই। সকালবেলা পরিপাটি হয়ে বেরোনো। প্রতিদিনই ট্রেন না-পাওয়ার দুশ্চিন্তা। ছুট। বিকেলবেলা ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসা। সকালে অনেকরকম কথা। ফেরার সময় কথা তেমন নেই।

তবে সেদিন যাওয়ার সময়ই অরিত্র দেবাংশুর কাছে বউয়ের মনে করানো ব্যাপারটা বলে। পুরনো টিভিটা বেশ জ্বালাচ্ছে। যে কোনও দামে ছেড়ে দিয়ে নতুন একটা টিভি নিতে হবে। শুনে দেবাংশু আবারও একটা কথা বলার বিষয় পেয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে সেদিন আর জঙ্গল দেখতে যাওয়ার কথা ওঠে না। অন্য কোথাও বেড়ানোর গল্পও নয়।

—তোমাকে কী বলব অরিত্রদা, টিভি ব্যাপারটা তো অনেক দিনের পুরনো। তবে এখন যদি কিনতে হয় তা হলে যে মডেল আর কোম্পানি বললাম একদম সেটা এবং অবশ্যই বড় পর্দার কিনবে। ঘরে বসে আছ না প্রোগ্রামের মাঝখানে বুঝতেই পারবে না।

কোম্পানির নাম শোনা অরিত্রর। তবে মডেলটা নয়। শনিবার সন্ধেতেই সুচেতাকে সঙ্গে নিয়ে দোকানে গিয়ে দাম জানা, পরে এটিএম থেকে টাকা তোলা সব সেরে রেখেছিল। পুরনো টিভিটা ওই দোকানেই নিয়ে নেবে। তার জন্য মূল দাম থেকে সামান্য কিছু বাদ। একটুখানি ভেবেছিল ওরা। মাত্র ওইটুকু বাদ? অরিত্র একবার ভাবল দেবাংশুকে ফোন করে। যদিও সুচেতা বলল, অত ভেবে লাভ নেই। ছেড়ে দাও। পুরনো জিনিস ঘরে রাখার নানা অসুবিধা।

যদিও রবিবার দুপুরের পর সেসব ভাবনা কোথায় চলে গেল। পাড়ার কেবল্ লাইনটা ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে উঁকি দেওয়ানো ছিল। সেটাই নতুন দিনের মডেলের পেছনে সেঁটে গেল। প্রথম প্রথম রিমোটে একটু অসুবিধা হচ্ছিল। আধ ঘণ্টার মধ্যে সেটাও সড়গড়। তারপর ছবি যখন জেগে উঠল তা দেখে দুজনেই থ। এত বড় পর্দা জুড়ে এমন ঝকঝকে ছবি! সমস্ত ঘর জুড়ে বিস্তার। বসার ঘরটাই যেন বদলে গেল মুহূর্তে। পাশাপাশি বসে ছবির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে অরিত্র বিড়বিড় করে বলল, প্লাজমা টেকনোলজি না কী যেন বলছিল দেবাংশু। একেবারে হালের ব্যাপার।

সুচেতা বলল, সত্যিই অদ্ভুত। মনে হচ্ছে যেন ঘরের মধ্যেই খবর পড়ছে। এই ঘরেই বিজ্ঞাপন।

অরিত্র হালকা হাসল। বলল, অথবা আমরাই পৌঁছে গেছি ওসবের কাছাকাছি…

পরদিন দেবাংশুই জানতে চাইল নতুন টিভির কথা। অরিত্র মুখে কিছু বলল না। শুধু ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা ওপরে তুলে সামান্য ঝাঁকিয়ে গর্বিত হাসি। তাতে যা বোঝার বুঝল দেবাংশু। সেদিনও আবার কথা হয় পিয়ারডোবা নিয়ে। সেই জঙ্গলের মাঝে টেন্ট ক্যাম্প। দেবাংশু বলল, ভদ্রলোক আবার ফোন করেছিলেন। জানতে চাইলেন কাছাকাছি কোনও প্ল্যান করছি কি না।

অরিত্র বলল, জায়গাটা ঠিক কোথায় বল তো?

দেবাংশুর গলায় যথারীতি উৎসাহ।

—খড়গপুর হয়ে যাওয়া যায়। আবার বাসে বা গাড়িতে বিষ্ণুপুর গিয়ে সেখান থেকেও পথ আছে। মোটামুটি বাঁকুড়া মেদিনীপুরের সীমানায়। পিয়ারডোবার কটা স্টেশান পরে শালবনি, তার ওপাশে গোদাপিয়াশাল।

নামগুলো চেনা মনে হল অরিত্রর। সেদিন ট্রেনে মৌসুমী ওদের মুখোমুখি বসেছে। জায়গাগুলোর নাম শুনে জানালা থেকে চোখ এনে ভেতরে তাকায় মৌসুমী, সরাসরি দেবাংশু মুখে।

—ওই জায়গাগুলোতে এখন নানা রকম ঝঞ্ঝাট চলছে না?
—চলছে এবং চলবে। তাতে আমাদের কী? তুষার ঝড় হয় বলে তো এভারেস্ট অভিযান বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া যাদের কথা বলছ তারা টুরিস্টদের কখনওই কিছু বলে না।

ট্রেনে দেবাংশুর পরিকল্পনা অনুযায়ী কোথাও কখনও যাওয়া হবে কিনা তার ঠিক নেই। দেবাংশু নিজেও হয়ত তা জানে। পিয়ারডোবার আগে ছিল বিরতিগঞ্জ। তার আগে এসেছিল কুসুমপুর। দেবাংশুর কথায় জ্যোৎস্না রাতে ওসব জায়গার সৌন্দর্য অসাধারণ। কুসুমপুরে মাঝরাতে চিতল হরিণ জল খেতে আসে। কিন্তু সেসব গল্প এখন আর নেই। এখন উঠে এসেছে পিয়ারডোবা। সেখানে বর্ষার ঘন বন, ক্যাম্পে থাকা আর রাতে খোলা উনুনে আকাশের নীচে রান্না। মৌসুমী আর অরিত্র জানে কিছু দিনের মধ্যে পিয়ারডোবাও সরে যাবে। তখন অন্য কোনও নাম উঠে আসবে। যে ভদ্রলোক ফোন করে ডাকছেন তাঁর পরিবর্তে ফোন করবেন আর কেউ।

মৌসুমীর মাঝেমাঝে মনে হয় কুসুমপুর বা পিয়ারডোবা কি সত্যিই কোথাও আছে! ফোন করে কি আদৌ কেউ খবর দেয়!

তবে অরিত্রর মন কিছু দিনের জন্য নতুন টিভিতেই পড়ে। ওই যে বড় রঙিন পর্দা, ঝকঝকে ছবি। বসার ঘরটা সত্যিই যেন মাঝেমাঝে ঢুকে পড়ে টিভির মধ্যে। কলেজ থেকে হোক বা অন্য কোও কাজে বেরিয়ে ঘরে ফেরা, কিছুদিন অরিত্র যেন টিভির টানেই তড়িঘড়ি ঘরে চলে আসছে।

এর মধ্যে একদিন সন্ধেবেলা ও খেলা দেখছে টিভিতে। ফুটবল। বিদেশি খেলা, তবে বিশ্বকাপ নয়। ইউরো কাপ বা কোপা আমেরিকা হলে অরিত্র রিমোটে আর হাত দিতে চায় না। সোফায় গা এলিয়ে চেয়ে থাকে চোখধাঁধানো জাদুতে। সেদিনও তাই। ছোটখাটো কী দরকারে সুচেতা পাড়ার গলির মুখটায় গেছে। লন্ড্রি হয়ে তেলেভাজার দোকানে হতে পারে। অরিত্র ওর সমস্ত মন দিয়ে খেলা দেখে যাচ্ছে। ঠিক তখনই কাণ্ড ঘটল একটা। অরিত্র বিশ্বাস করেনি প্রথমে। কিন্তু ঘোর ভাঙার পরে তো বিশ্বাস করতেই হল।

ওর পছন্দের এক খেলোয়াড় মাঝমাঠে হেড করেছিল। হেডের বলটা হঠাৎই অন্য কোথাও না গিয়ে ছিটকে এল টিভি বরাবর। তারপর টিভি থেকে বেরিয়ে সোজা অরিত্রর বসার ঘরের দেওয়ালে। যেখানে সোফায় বসে খেলা দেখছে তার ডান দিকে। দেওয়ালে লেগেই বলটা আবার ছিটকে টিভিতে। মাঠে ঢুকে পড়ল। দর্শক বা খেলোয়াড়রা কিছু বোঝার আগেই খেলা চালু হয়ে গেল।

প্রথমে অরিত্র ভেবেছিল স্বপ্ন দেখছে। খেলা দেখতে দেখতে হয়ত ঝিম এসেছিল। কিন্তু সোফায় সোজা হয়ে বসেই ও বোঝে স্বপ্ন নয়, বন্ধ ঘরে সজোরে বড় ড্রপ হলে যেমন হয় ওর কানে তেমন শব্দের রেশ। শব্দের দমকে ঝিমঝিম করছে মাথাটা। অরিত্র তবু উঠে এদিক ওদিক দেখে। জানালা দরজা বন্ধ। বাইরে থেকেও কিছু আসার সম্ভাবনা নেই। তখনই আরও খেয়াল করে, সোফার পাশে দেওয়ালে বলের একটা ছাপ পড়ে রয়েছে।

অরিত্র ঘাবড়ে যায় একটু। কীভাবে এমন হয়! বিজ্ঞাপনে এমন টিভির কথাই দেখায় আজকাল, কিন্তু বাস্তবে তা কি সম্ভব। প্লাজমা টেকনোলজি কি এত দূর নিয়ে গেছে। দেবাংশুকে কি এখনই ফোন করে দেবে একটা! টিভি কোম্পানিকে জানাবে। কোম্পানি থেকে এসে যদি এই সেটটা বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়।

অরিত্রর কথা শুনে আর বলের ছাপ দেখে সুচেতা ধপ করে বসে পড়ে সোফায়। খানিকটা ঘাম জমেছে ওর গলার ভাঁজে। অনেকক্ষণ শুনেও কিছুর সঙ্গে কিছু মেলাতে পারে না। চাপা স্বরে বলে, দেওয়ালে দাগটার তবে কী হবে!

সেটাই কি বড় কথা হল? অরিত্র বলে— কীভাবে দাগটা এল ভেবে দেখেছ তা!

—কেন, টিভি থেকে। সুচেতার সহজ জবাব।
—টিভি থেকে বলটা ছিটকে ঘরে ঢুকবে কেন?
—হয়ত দাম দিয়ে টিভি কিনেছ তাই।
—দাম দিয়ে আর কেউ টিভি কেনে না!
—যারা কেনে তাদেরও হয়ত এরকম হয়। তুমি কি সবার কাছে খোঁজ করে দেখেছ?

কথার মাঝেই সুচেতা বাথরুমের দিকে যায়। একটা মগে সামান্য সার্ফ-জল আর সঙ্গে একফালি কাপড়। কাপড় ভিজিয়ে অরিত্রর চোখের সামনে ডলতে থাকে দেওয়াল, দেওয়ালে বলের ছোপ। বারবার ডলে। কাপড় ভেজায় আর ডলে। অরিত্রও চেয়ে থাকে সেদিকে। কিন্তু কিছুতে দাগটা ফিকে হয় না। শেষ দিকে অরিত্রও একটু ঘষে। কিন্তু ছোপটায় তেমন পরিবর্তন হয় না।

রাতে ভালো ঘুম হয় না অরিত্রর। অদ্ভুত এক অবস্থা। সকালে উঠেও বারবার দাগটা দেখে। একইরকম রয়ে গেছে। ট্রেনে দেবাংশুকে বলবে ভাবে। কয়েকবার বলার জন্য উসখুস করে। শেষ পর্যন্ত যদিও বলে ওঠা হয় না। দেবাংশুকে বললে অতি আগ্রহে ও যদি কোম্পানিতে খবর দিয়ে দেয়, তারা এসে যদি তুলে নিয়ে যায় সেট্‌টা!

সুচেতা বরং কিছুটা নির্বিকার। দাম দিয়ে টিভি কেনা হয়েছে ফলে এসব হয়ে যেতেই পারে, এই যেন তার ভাব। বলের দাগটা সে মাঝেমাঝে দেখে। ওইরকম দাগে বসার ঘরে সোফার পাশটা খুব যে বেমানান হয়েছে তেমন নয়। নিজেদের চোখে তো মানিয়েই গেছে। তা ছাড়া অরিত্র যেরকম ফুটবল ভালোবাসে তাতে বলের অতটুকু দাগ থাকলে অসুবিধা কী!

কিন্তু ব্যাপারটা শুধু ফুটবলেই আটকে থাকে না। আর একটু এগোয়। মাঝখানে এক দিন অরিত্র অফিস থেকে ফেরার পর সুচেতার চোখেমুখে উত্তেজনা। অরিত্রকে ডেকে ও সোজা বসার ঘরে নিয়ে যায়। সোফার পাশে দেওয়ালে হালকা হলদেটে একটা দাগ দেখিয়ে বলে, আজ দুপুরের ঘটনা। এ বারে কীসের ছাপ বলো তো?

অরিত্র চিনতে পারে না। শুধু দেখে ফুটবলের দাগের কাছাকাছি আর একটি ছোপ। সুচেতা বলে যায়, একটা বেড়ানোর চ্যানেলে আফ্রিকা দেখাচ্ছিল। হুডখোলা জিপে ঘাসবনের মাঝখান দিয়ে যাওয়া। পথের মাঝে হঠাৎই একটা জিরাফ দেখে দাঁড়ায় গাড়িটা। সবাই ক্যামেরা বার করে ছবি তুলছে। তখনই জিরাফটা টিভির ভেতর থেকে গলা লম্বা করে দেওয়ালটা চেটে দিয়ে গেল।

—অবিশ্বাস্য! এরকম কখনও হয় নাকি! কেউ শুনলে বিশ্বাস করবে? আফ্রিকার জিরাফ চেটে দিয়ে গেছে আমাদের দেওয়াল! অরিত্র এসব বলবে ভাবে, কিন্তু বলে না। তার কারণ এর চাইতেও বড় প্রমাণ সে তো নিজেও পেয়েছে। সেই চিহ্ন এখনও দেওয়ালের গায়ে স্পষ্ট। সে বরং নিচু স্বরে সুচেতাকে বলে, জিরাফটা আর কিছু করেনি? দেওয়ালে চেটে দিয়েই চলে গেল!
—কয়েক সেকেন্ডের তো ব্যাপার। সুচেতা বলে। তবে টিভিতে ফেরার আগে সামান্য সময় আমাকে আর ঘরের ভেতরটা দেখে গেছে।

অরিত্র ব্যাগ রাখে। জামাকাপড় বদলায়। হাত-মুখ ধোয়। ফুটবলের ছাপের পাশে পাকাপাকি আর একটা ছাপ। এটা খানিকটা হলদেটে। যেন চওড়া ব্রাশে একবার মাত্র স্ট্রোক করা। সেদিন সন্ধেতেও অরিত্র টিভির সামনে বসে। চ্যানেল ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখে। নানারকম নাচগানের অনুষ্ঠান। অন্যদিনের মতোই হুড়মুড় করে খবর পড়ে যাওয়া। দেবাংশুকে ঘটনা দুটো জানালে কী করবে ও! নিশ্চয়ই চলে আসতে চাইবে একদিন। এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে। পরদিনই ট্রেন থেকে শুরু করে সব জায়গায় রাষ্ট্র হয়ে যাবে ব্যাপারটা।

মাঝখানে সকালের দিকে বৃষ্টি হয় এক দিন। খানিকটা ভিজতে ভিজতে সবাই ট্রেন ধরে। সেদিন আবার পিয়ারডোবার কথা হয়। জঙ্গলের মাঝে সেই তাঁবুতে থাকা আর খোলা উনুনে রান্না। দেবাংশু বলে, অরিত্রদা তুমি প্রথমে উৎসাহ দেখাও, পরে আর কিছুই বলো না। বাড়ি গিয়ে আজই কথা বলবে বউদির সঙ্গে। বর্ষা চলে গেলে ওখানে যাওয়ার আর মানে থাকে না।

মৌসুমী সেদিনও মুচকি হাসে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। দূরে ঘরবাড়ির মাথায় আবারও মেঘ জমে আসছে। খানিকটা দেরি করে হলেও বর্ষাকালটা শেষ পর্যন্ত চলে এল।

পরের শনিবারটা খানিক আগে ফেরে অরিত্র। সুচেতাকে নিয়ে কোথাও বেরোবে ভেবেছিল। কিন্তু সেদিনও বেরোনো হল না। আলস্য আর টিভির আকর্ষণেই আটকে গেল শেষ পর্যন্ত। কতরকম নাচগানের অনুষ্ঠান চ্যানেলে চ্যানেলে। কত উজ্জ্বল বিজ্ঞাপন। দেশ-বিদেশের খেলাই তো কতরকম।

বিকেলবেলা ওরা দুজন সেদিন টিভির সামনে। অরিত্রর হাতে রিমোট। এদিক ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে জঙ্গলের ছবি এসে গেল হঠাৎ। সবুজ গাছপালা, ওখানেও হয়তো বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাঝে লাল মাটির পথ। দু একটা ছড়ানো ঘরদোর। ছবির ওপাশ থেকে কাদের যেন হেঁটে আসার শব্দ।

চ্যানেল না বদলে ওরা ছবি দেখে যায়। হেঁটে আসার শব্দ খানিকটা বাড়ে। ওরা দেখে ভারি বুট, জলপাই রঙের টুপি ও পোশাক, সেনা জওয়ানদের মতো লোকগুলো বেরিয়ে আসছে জঙ্গল থেকে। তারপরের দৃশ্যে প্রায় আঁতকে ওঠে সুচেতা। অরিত্রর গা ঘেঁষে আসে। এসব কী দেখাচ্ছে তাদের টিভিটা!

সামনের দুই জওয়ানের কাঁধে একটি বাঁশ। সেই বাঁশে ঝুলছে দুপাশে হাত পা বাঁধা একটি মেয়ের মৃতদেহ। পেছনের দুই জওয়ানের কাঁধে একইভাবে ঝোলানো একটি যুবক। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ বয়স হবে এদের। দুজনেরই মাথা নিচের দিকে ঝুলছে। মেয়েটির রক্তাক্ত হলুদ সালোয়ার কামিজ মাটির দিকে নামানো।

খবরে অনেক কথা বলছিল। কিন্তু সেগুলো ঠিক কানে ঢুকল না ওদের। বরং ওরা দেখল যেভাবে একদিন মাঠ থেকে বল আর জঙ্গল থেকে জিরাফ ওদের আশ্চর্য টিভি বেয়ে ঘরে এসেছিল সেভাবেই কাঁধে ঝোলানো ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে চার জন জওয়ান বিজ্ঞাপনের টিভির বড় পর্দা ছেড়ে ঢুকতে শুরু করল ঘরে। পুরনো ছবিতে দেখা শিকারের পর যেভাবে কাঁধে ঝুলিয়ে মৃত জন্তু আনা হত সেইরকম। টিভি ছেড়ে সুচেতা আর অরিত্রর বসার ঘরে ঢুকে জওয়ানরা কাঁধ থেকে বাঁশ নামিয়ে মেঝেতে রাখল। তারপর ছোট চোখে দেখতে থাকল চারপাশ।

এত কাছাকাছি দুটি মৃতদেহ যেন ভ্যাপসা গন্ধ লাগছে নাকে। ঘরের বাতাস যেন পাথর। মেয়েটির মাথার কাছে রক্তের দাগ, ছেলেটির বুকের কাছে মালার মতো পরপর বুলেটের ক্ষত। যেন খুব কাছ থেকে মারা হয়েছে এদের। অরিত্রকে প্রায় জড়িয়ে থাকা সুচেতা বিড়বিড় করে বলল, দেখে মনে হয় যেন ঘুমের মধ্যে মেরেছে!

চার জওয়ানের অবশ্য অরিত্র বা সুচেতাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। মৃতদেহ রেখে দাঁড়ানোর পর চোখের সঙ্কেতে ওরা আবার নিজেদের মধ্যে কথা বলে। দূরে কোথাও হুইসলের শব্দ। বাঁশ সমেত মৃতদেহ কাঁধে ফেলে ওরা আবার ঢুকে যায় টিভির পর্দায়। তখন ওদিকে বিজ্ঞাপন বিরতি শুরু হয়ে গেছে। সাবানের উচ্ছল ফেনা আর পেটখোলা পোশাকে বাচ্চা মেয়েদের গা দুলিয়ে দেশ-খ্যাত হওয়ার চেষ্টা চলছে।

অরিত্র আর সুচেতা নড়েচড়ে বসে। খানিকটা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেও। ভাবে টিভিটা বন্ধ করে কিছুক্ষণের জন্য চলে যাবে। হাঁটাহাঁটি করে আসবে বাইরে থেকে। কিন্তু সোফা থেকে নামতে গিয়ে অরিত্র দেখে মেঝেয় যেখানে মেয়েটিকে শোয়ানো ছিল সেখানে এক জায়গায় রক্তের দাগ। গোল হয়ে লেগে থাকা রক্ত।

সুচেতা ঘাবড়ে যায়। আবারও সোফায় উঠে পড়ে। কিন্তু অরিত্র দাগের ওপর জল ঢালে, সার্ফ এনে ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু দাগ কিছুতে ওঠে না। সামান্য ফিকেও হয় না।

অরিত্র চিৎকার করে ওঠে, গরম জল আনো সুচেতা। বাথরুম থেকে ফিনাইলের বোতলটা নিয়ে এসো।

সুচেতা সোফার ওপর কাঠ হয়ে বসে বলে, আমাকে বোলো না প্লিজ। আমি কিচ্ছু পারব না।

তখন সেই অরিত্র যে প্রতিদিন পড়ানোর জন্য কলেজে যায়, সে ফিনাইল আনে, গরম জল বানায়, বাথরুম থেকে মেঝে ঘষার ব্রাশ আনে। এবং উবু হয়ে বসে সজোরে মেঝে ডলতে শুরু করে দেয়।

কিন্তু সে সবে কিছু হয় না। তাদের মধ্যবিত্ত দেওয়ালে যেভাবে এক দিন ফুটবল আর জিরাফের ছোপ লেগেছিল, এই দাগও তেমন পাকা হয়ে লেগে থাকে। সময়ের সঙ্গে কিছুটা ফিকে হয় হয়ত। কিন্তু পুরোপুরি মিলিয়ে যায় না।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4821 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. সীমারেখাহীন বাস্তব আর কল্পনার জগৎ। এক কথায় দুর্দান্ত।

  2. লেখাটা বড় ভালো লাগলো। আমাদের ভবিতব্য যেন আঁকা হয়ে আছে।

আপনার মতামত...