বুকুন কোতির কথা

বুকুন কোতির কথা -- ভবানী ঘটক

ভবানী ঘটক 

 

প্রথমে ভেবেছিলাম, এও এক কড়িকর। কিন্তু নাহ। লোকটাকে বোঝা মুশকিল। তবে চিসসা। এমন একজনকে পারিক করে রাখলে লাইফটা কাটানো যায়। কাল আমার হাত ধরেছিল। ঝটিতে শরীরে বিদ্যুৎ…

তা কেন অমন ধরলে গো! হাত যখন ধরলে, আবার ছেড়েই বা দিলে কেন লা! বোঝো না, ওই স্পর্শটুকু আমাকে কেমন এলোমেলো করে দেয়।

ও মা, লোকটার যেন বিকার নেই। বলে, নাকি লেখক। মনের হদিশ পেতে চায়। গপপো করতে চায়। ইল্লিঃ, আমার হাত ধরলে— আমি বুঝি মেয়ে না?… ই-ইঃ, মন! কত মন বোঝনেওয়ালা! জানো, আমার মনে কী হচ্ছিল? ইচ্ছে করছিল— তুমি আমাকে আদর করবে। করো-না গো! খুব করে আদর করো। আদর খেতে খেতে তোমার বুকের মধ্যে আমি ঘুমিয়ে পড়ব। তোমার লিকামটাকে… ইসস, এসব কী ভাবছি আমি, একটা ভদ্র ছেলেকে নিয়ে—

আরে ছোঃ, ভদ্দর! কত ভদ্দরনোক দেখলাম! দিলুকা— আমার দিলীপকাকা কীঈ ভদ্দরনোক। আমাকে খু-উ-ব ভালোবাসত। তখন আমার এগারো কি বারো। একটু নাদুস নুদুস ছিলাম। দিলুকা কলেজে পড়ত। যখন তখন আমাকে আদর করত। আমাকে চুমু খেত। আমার জামাটা খুলে বুকে মুখ ঘষত। আমার ভালো লাগত। কিন্তু শুধু ওই ভালোলাগাটুকু, আর কিছু বুঝিনি। একদিন…

একদিন দিলুকা কলেজ থেকে ফিরেছে। আমাকে সাইকেলে নিয়ে সারা বিকেলবেলা ঘুরল। সন্ধ্যা হব হব সময়ে ফিরলাম আমরা। দিলুকা আমাকে আইসক্রিম খাইয়েছিল। ট্রপি কিনে দিয়েছিল। তারপর ছাতে নিয়ে গিয়ে আমাকে সে কী আদর! আমার জামা প্যান্ট খুলে ফরকানি লিকামটা যেই না… উফস সে কী রক্ত গো! আমি কঁকিয়ে উঠেছিলাম। ছোটবেলা থেকে আমার অর্শ আছে। রক্ত, আর রক্ত। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। একসময় দেখি, আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। আর আমার নিম্নাঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা।

সে যন্ত্রণা এখন আর অনুভব করতে পারি না গো। ভুলে গেছি। কিন্তু দিলুকাকে ভুলতে পারলাম কই! ও-ই তো আমার সব। আমার দিলরুবা। আমার মনপ্রাণ সবকিছু দিলুকা কেমন অধিকার করে নিল। রাতদিন আমি ওর কথা ভাবতাম। হ্যাঁ গো। মনে হত, আমি তো শুধু ওর— শুধু ওরই। আমার এই শরীর মন সব দিলুকার।

সেই দিলুকা বদলে গেল, জানো! কিছুদিন পর থেকে আমাকে আর চিনতেই পারে না। পাক্কি বাটলিবাজ। তা হোক, তবু ওকে আমি দেখতাম। আহা, যৌবনের খোমর! আমার যে কী ভালো লাগত ওকে। লুকিয়ে লুকিয়েও দিলুকাকে দেখতাম। মাঝে মাঝে যখন কথা বলতে যেতাম, দিলুকা কথাই বলত না। কী যে কষ্ট হত। আমি কেঁদে ফেলেছি কতবার। আমার পড়াশোনা খেলাধুলো নষ্ট হয়ে গেল। পাড়ার মেয়েরা আমার বন্ধু হতে লাগল। কেন, কে জানে!

একদিন দেখি, দিলুকার বিয়ে। বউটা সুন্দরী। বছর ঘুরতেই আবার ফুটফুটে একটা বাচ্চা বিয়ান দিল। কী চমৎকার সুখের সুমসার ওদের। হাসিখুশিতে ভরা। আমার খুব হিংসে হয়, জানো! কেন আমার সঙ্গে অমন করল দিলুকা? আমার নিলকী নেই, তাই? চিপটি নেই, তাই?… বুঝি গো, বুঝি— সব বুঝি। ‘কিসে আর কিসে/সোনায় আর সিসে।’

হ্যাঁ গো, তুমি আমাকে জানতে চাও— আমি এমন কেন? তা কেমন দেখছ আমায়, মেয়েদের মতো নই? বলো? এই যে আমি নেলপালিশ পরেছি। ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছি। ভুরু প্ল্যাক করেছি। মাথায় বেবি হেয়ার কাট, ব্রাউনিশ… দ্যাখো দ্যাখো আমার ফটোখানা! সত্যি বলো তো, পুরুষ বলে মনে হচ্ছে আমাকে? নাহ, কক্ষনও না। সেদিন সাঁ করে রেসিং সাইকেলে একটা ছেলে চাকলুস চোখ মারল। আমি স্রেফ স্মাইল দিয়েছিলাম। বাই করে ছেলেটা সাইকেল ঘুরিয়ে চলে এল। বলল, জায়গা আছে?

আমার বুক ঢিপঢিপ করছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভালোও লাগছিল। জব্বর ঠকিয়েছি শালা বারখান্সিকে। আমার পাশে সাইকেল চালাতে চালাতে ছেলেটা বলল, ধুসস, ছক্কা কোথাকার। যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল।

এরকম কত শুনতে চাও!

জানো, পাড়াতে বেরুতে পারি না। ছোট্ট থেকে বড় হলাম যে পাড়াতে, সেখানে এই। পাড়ার কত ছেলে রাস্তাতে টোন্ট করে— এই লেডিস! এই হোমো!… রাস্তার লোকের আর কী দোষ গো! আমার বাড়ি— বাড়িটাও যেন তপ্ত কড়াই। মারধর বিলতালের কি শেষ আছে! দেখবে আমার পিঠ? কাটা কাটা রুলের দাগ। এই তো কদিন আগে, আমি বারান্দায় বসে কুটনো কুটছিলাম। বাবা কোথায় যেন ছিল, দেখে ফেলল— ওঠো। এটা তোমার কাজ না। মা করবে। আমি বললাম, কুটি না! মাকে সাহায্য করছি তো। কী হয়েছে! বাবা অমনি প্রচন্ড ফুঁসে উঠল— হারামজাদা, ওঠ। বলে আমার চুলের মুঠি ধরে হিঁচড়ে তুলেছে।

আর গত পরশুর কথা শুনবে? আমি লাইনে দাঁড়াতে যাব বলে চুড়িদার পরেছি। ঘরের ভিতরে আড়ালে দাঁড়িয়ে মায়ের লিপস্টিক মাখছি। হঠাৎ বাবা। দানবের মতো এক থাবায় আমার হাত থেকে কেড়ে নিল। লিপস্টিকটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর রুল দিয়ে মারতে মারতে বার করে দিল। তোর মতো সন্তান না থাকাই ভালো। বেরিয়ে যা শুয়ার। আমি জানব আমার ছেলে নেই।

আর মা? মায়েরা তো চিরকালই কাঁদে। মা হাউহাউ করে বুক ভাসাল— বুকুন রে, তোর এ কী হল—

মায়ের কান্না আমার সহ্য হয় না। কিন্তু কী করব, বলো! মা বোঝে না, আমার কিছু হয়নি। আমি পাগল নই। চুরি তো করিনি। আমার কোনও রোগ নেই। আমি পঙ্গু নই। হলাম না হয় কিছু অন্যরকম। যেমন যেমন দেখালে তোমরা মেয়েদের মেয়েলি বলো, ছেলেদের পুরুষালি বলে এসেছ, আমি না হয় তেমন কিছু হলাম না। তাতে ক্ষতি কী, বলো? আমার অন্যরকম হওয়ার ইচ্ছা করতে নেই? আমার ভালোলাগা, আমার সুখ আরাম আনন্দ— সব আমার মতো করে হবে তো। এই শরীর মন, আমার জীবনটা আমারই। মনে করো না, এটাই আমার ধরন। তাতে কার কী অসুবিধা! কাউকে আমার দায় নিতে বলছি না তো। তাই বলে তোমরা অমন করবে? ঘরে-বাইরে, ট্রেনে-বাসে, হাটে-বাজারে ঘৃণা করবে! তাচ্ছিল্য অপমান করবে! কুকুর বেড়ালের মতো খেপিয়ে ন্যালাবে! উফসস, শালা বারখান্সি— কেন, কেন?

হ্যাঁ, আমার পরিচয় এখন ‘লাইনের ছেলে’। আমি কোতি, পুরুষ ছেনাল— ছিবরি। বুঝেছ? যা খুশি ভাবো আমাকে, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আজকাল শুনছি, আমাদের নিয়ে গপপো লেখা হচ্ছে। নাকি গবেষণা হচ্ছে। নাটক সিনেমা ছবি হচ্ছে, বাপরে! আমাদের নিয়ে ব্লু হয় জানি। কিন্তু প্রাইজ পাওয়া সিনেমা— ভাবা যায়! তা কারা বানাচ্ছে ছবি, আর কারা প্রাইজটা দিচ্ছে লো?… ইল্লিঃ, শালা মজা লুটছে। ধুরানী বেটাদের আর কত্ত ছেনালিপনা যে দেখব।

ও মা, এ কী লা! বেশি ঢ্যামনামি কোরো না। শোনো, আমাকে তোমাদের খারাপ লাগবেই। আমাদের দেখে দেখে যৌবনের পাক্কি হয়ে গেল যে। কিন্তু যদি বলি, এই তোমাদের জন্যেই আমি কোতি হয়েছি। হ্যাঁ, তোমরাই আমাদের কোতি বানিয়েছ— এই ভদ্দরলোকেরা। আর এই যেসব লাইনের ছেলে দেখছ, এদের ছেনাল বানিয়েছে কোনও কাকা, কোনও দাদা, কিম্বা মাস্টারমশায়। হয়তো তুমি, বা তোমার মতো লেখক-কবি-ভদ্দরবাবু। লিকামে লিকামে ডান্ডিয়া খেলেছ। আর তোমাদের চোখে আমাদের খারাপ, বিকৃত রান্ডি বানিয়েছ। শালা বাটলিবাজের দল, ছোঃ!

অমন অবাক চোখে তাকাচ্ছ কেন? আমার কথা শুনে? কী হবে গো এইসব কথা বলে। আমি যেকোনও দিন মরে যেতে পারি। হ্যাঁ গো। শুধু আমি না, লাইনের যেকোনও কোতিই মরে যেতে পারে। এটাই আমাদের লিখন। হঠাৎ করে পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে যাবে। বাবা মা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে যাবে। এই তুমি, বন্ধু, বান্ধব সবার মাঝখান থেকে টুপুস করে ঝরে যাব। লাইনে থাকতে থাকতে কখন যে মৃত্যু ধীরে ধীরে খাচ্ছে আমাকে। দাঁত নখ জিব দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে, ওঃ। ওই যে গতকাল জয়ন্তকে দেখলে না— নাচনীতে যাচ্ছে, কালো ড্রেস পরেছে— ওর কিন্তু পজিটিভ, জানো! এইচআইভি। আমিও গোপনে ব্লাড করতে দিয়েছি। যদি তেমন কিছু… জয়ন্ত রে, কতদিন তোর সঙ্গে নেচেছি, বল? তুই আমাদের ছেড়ে… উফস, ভাল্লাগছে না। পুড়বে ধুরী উড়বে ছাই/ধুরানীর আর কলঙ্ক নাই। মরে গেলে কে আর আমাকে কলঙ্ক দেবে লো!

নাহ, মনটা খারাপ করে দিলে তুমি। (দীর্ঘশ্বাস) আজকে যাও, আমার লেখকসোনা! বাড়িতে গিয়ে বসে বসে মনের কথা ভেবো। মন বোঝো গে। এখন আমি লাইনে যাব, সময় হয়েছে। অ্যাই অ্যাই, একটুখানি দাঁড়াও প্লিজ। তোমাকে একটা চুমু খাই! কিছু মনে করবে না তো?… এই তো বাঃ, আমার চিসসা। তোমার নামটা যেন… ও। আর একটা দাবি তোমার কাছে করব। বলো রাখবে?

আমাকে একবার ‘লেডিস’ বলে ডাকো— ডাকো না গো। বলো না ‘দিদি’, কিংবা ‘বোন’, অথবা…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...