সুরো কোত্থাও যাবে না…

সুরজিৎ সেনগুপ্ত | ফুটবলার

অর্পণ গুপ্ত

 



ক্রীড়াপ্রেমী, গদ্যকার

 

 

 

সত্যজিৎ পারলেন না আর। কিউবার গোপন গুহামুখ থেকে যেভাবে রাইফেল কাঁধে বেরিয়ে আসতেন চে গুয়েভারা, সেভাবেই সময়ের জ্বালামুখ দিয়ে ছিটকে এলেন ধৃতিমান চ্যাটার্জি। আসতেই হত। প্রতিদ্বন্দ্বী-র ভাষ্য গড়ে নিল সময় নিজেই। সুরজিৎ-ও তেমন। ছিটকে বেরোলেন। বাঙালির সাদাকালো সময়ের ভেতর তিরতিরে জোনাকির মত। পায়ে ফুটবল। মগজে কার্ফিউ। বিনোদন নয়। শিল্প-ই হাতিয়ার। সত্যজিৎ দেখাচ্ছেন। সুরজিৎ সেনগুপ্ত দেখাচ্ছেন। গণনাট্য দেখাচ্ছে।  সাতের দশকে কৈশোর পেরোনো আমার বড়জেঠু মাঝেমাঝেই সুর টানেন— “সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে কলকাতা!” সাতষট্টির নির্বাচনে সরকার পড়ে গেল কংগ্রেসের। কলকাতার অলিতে গলিতে গুঞ্জন। যেন বারুদের গন্ধ আসে নাকে। অথচ নকশালবাড়ির আগুন তখনও জ্বলে উঠতে দেরি আছে কিছু। বিরোধী সরকারও টিকতে পারল না। প্রফুল্ল ঘোষের সরকারের মেয়াদ তিনমাস। বাংলায় শুরু রাষ্ট্রপতিশাসন। যুক্তফ্রন্ট সরকারের ভেঙে পড়াটা ছিল অবশ্যম্ভাবী। অজয় মুখোপাধ্যায় বললেন— “জঙ্গলের সরকার”। সত্তরের মার্চ মাসে অবশেষে পড়ে গেল যুক্তফ্রন্ট। বেজে উঠেছে নকশালবাড়ির দামামা। কংগ্রেসের জাতীয় নেতৃত্ব বাংলাকে পাকাপাকিভাবে শান্ত করার ফন্দি আঁটতে ব্যস্ত। বাংলা জুড়ে ফুটছে রক্তপলাশ। ঊনষাটের খাদ্য আন্দোলনের স্মৃতি দগদগে। ছেলের লাশসুদ্ধ বৃদ্ধা মা-কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কমিউনিস্ট পার্টি টুকরো হওয়ার পর পঁয়ষট্টি-ছেষট্টিতে ফের উত্তাপের শুরু। নুরুল ইসলামের লাশ কাঁধে লাল পতাকার মিছিল ছুটল গ্রাম থেকে গ্রামে। আন্দোলন, আন্দোলন, আন্দোলন। সন্ধ্যায় লোডশেডিং, কার্ফিউ, একশো চুয়াল্লিশ। রেডিও-তে সাতটার সংবাদে কান পাতছে বাংলা। প্রতি সন্ধ্যায় জোড়া ছাদে, কলোনিতে, মধ্যবিত্তপাড়ায় মাদুরের ওপর শুয়ে তারাগোনার দশকে বাঙালি জানে তার সব চলে যাওয়া বসন্তের হাহাকারের মধ্যেও ফুটবল আছে, ‘দূর শাখে পিক ডাকে বিরামহীন’-এ হাতছানি দেয় ময়দান। ময়দানি কিসসায় সাতের দশকের গোড়া থেকেই সুধীর-সুভাষ-সুরজিৎ। সত্তর এশিয়াডে সুধীর আর সুভাষ পদক পেলেও সুরজিতের জাতীয় দলের বড় সাফল্য আসেনি তখনও। অথচ বাঙালি ঐ একাত্তরের দিনগুলোয় অপাপবিদ্ধ চোখে দেখছে সুরো-কে, তিয়াত্তরে মোহনবাগানের সুরো-র সামনে খড়কুটোর মত উড়ে গেল মহামেডান। গোষ্ঠ পাল সরণীর তাঁবু থেকে সন্ধ্যায় পুলিশি নজর ডিঙিয়ে ঘরে ফেরা জনতা, বেকার-আবালবৃদ্ধবণিতার মুখে সুরো-র ড্রিবলিং, সুরো-র দৌড়। ‘ঘরের কোণে একটি মাত্র মোমের আলো’-র নাম সুরজিৎ। আটের দশকের নায়ক কৃশাণু দে-র জার্সি তখনও দেখেনি ময়দান, দেখেছে তাঁর গুরুকে। সুরজিতের ফুটবলে মুগ্ধ হয়ে কৃশাণু তাঁকেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন গুরু রূপে। একথা ময়দান জানে। জানে তিয়াত্তরের সেই প্রবঞ্চনাও। ঘটনার শুরু ১৯৭৩ মরসুমে। সেই ১৯৫৯ সাল থেকে মারদেকায় খেলে আসছে ভারত। প্রতি বছরই মালয়েশিয়ায় এই টুর্নামেন্ট হত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে, যখন জোরকদমে চলত কলকাতা লিগ। কলকাতা থেকে নির্বাচিত ফুটবলাররা চলে যেতেন দেশের হয়ে খেলতে, ফিরতেন সপ্তাহ দু-তিন বাদে, ততদিন ঢিমেতালে চলত কলকাতার লিগ, তারকা ফুটবলাররা ফিরে এলে আবার জমে উঠত ময়দান। দীর্ঘকাল ধরে এই প্রথা চলে এলেও ১৯৭৩ সালে হঠাৎ বেঁকে বসলেন একদল কর্মকর্তা, তাঁদের ইন্ধন দিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ইন্দিরা গান্ধির চিঠিতে তিনি বুঝেছিলেন বাংলার ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক প্রতিরোধ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে সরকারের। কেন্দ্রীয় বাহিনির সঙ্গে আঁতাতে রাজ্যপুলিশ নির্মম হাতে দমন করছে নকশালদের৷ যুবসমাজকে যেনতেনপ্রকারেণ সরিয়ে রাখতে হবে রাজনীতির মঞ্চ থেকে, আর তার জন্য প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠল ফুটবল। রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী, যিনি আবার একটি বৃহৎ সংবাদপত্র গোষ্ঠীর মালিকও, প্রকাশ্যে বললেন, ফুটবল মরসুমে কলকাতার আইনশৃঙ্খলার প্রভূত উন্নতি হয় প্রতি বছর। তাঁর নিজস্ব সংবাদপত্রে প্রতিদিন লেখা হতে লাগল জাতীয় দল পাঠানো শুধু সময় নষ্ট, ছোট টুর্নামেনেটে খেলার চেয়ে ময়দানে খেলা ভালো। দুই বড় ক্লাবের অগণিত সমর্থক ময়দানে টেনে আনল আরও আরও জনতার স্রোত। চুয়াত্তর থেকে সুরজিৎ ইস্টবেঙ্গলে। ইস্ট-জনতার বল্গাহীন আবেগের চিৎকার— ‘সুরো কোত্থাও যাবে না…’

মোহনবাগানের দুই কর্তাকে কিডন্যাপিং-এর কাণ্ডারী সাজিয়ে সুরজিৎকে রাতারাতি দলে এনেছিলেন জীবন-পল্টু। একেবারে রুদ্ধশ্বাস চিত্রনাট্য। সুরজিতের ড্রিবলের মত নিটোল। সাতের অন্য সমস্ত তারকাদের মাঝে সুরজিৎ স্বতন্ত্র। আর্জেন্টিনার গড়জনতার মাঝখান থেকে মারাদোনা বেরিয়ে এসে যেমন চাকু দিয়ে এফোঁড়ওফোঁড় করে দেন পুঁজিবাদের স্থূল অবয়ব, সুরজিৎ-ই একমাত্র বাংলার সেই শিল্পী ফুটবলার যাকে বিস্ময়ে দেখেছে বাঙালি, সাতের দশকের গোড়া থেকে, সে প্রতিদিন তরুণ লাশ, কাঁচা রক্তের ক্যাকোফনি পেরিয়ে দেখেছে এক অনন্ত আকাশ, শিল্পীর আকাশ। সুভাষ ভৌমিক, প্রসূন ব্যানার্জিদের সূচক জয়-পরাজয়ের দিকে বেঁকে গেছে বারবার। সাফল্যের বিচার থেকে বাঙালি সুরজিৎকে দূরে রাখতে চেয়েছে যেন। সুভাষ ভৌমিকের অবিশ্বাস্য সাফল্যের পাশে সুরজিৎ কিছুটা হলেও তো সাদামাটা। তবু, সুরজিৎ বাঙালির অন্ধকার দিনে, থমথমে আকাশে জ্বলে ওঠা  আকাশপ্রদীপ। তাই যেন একান্ত আপন। জাতীয় দলে ডাক, চোটের ভ্রূকুটি, বিলিতি ক্লাবে খেলার প্রস্তাবের সামনে বাঙালি তার যখের ধনকে আগলে চিৎকার করেছে—

“সুরো কোত্থাও যাবে না…”

সুরজিৎ কী পেলেন? জাতীয় দলের হয়ে একটা প্রচণ্ড সাদামাটা স্ট্যাটিস্টিক্স; জাতীয় ফুটবলের প্রশাসক, বাস্তুঘুঘু, স্ট্যাটমোদী, ফুটবলবিমুখ, পণ্যায়িত জনতা জাতীয় ফুটবলে সুরজিতের নামও নিলেন না তেমনভাবে। চুয়াত্তর মারডেকায় সেই স্বপ্নের ফুটবল খেলার পরেও এশিয়ান গেমসে ঠাঁই হল না। ময়দান জানে সব। সুরজিৎ তখন সেই প্রলোভন, যাঁর মাঠের পাশে ওয়ার্মআপটুকুই হাউসফুল করে দেয় লিগের ম্যাড়ম্যাড়ে ম্যাচ।

সুরজিৎ সেনগুপ্ত ফাইনালি চলে গেলেন। ভুগতে ভুগতে। ডাক্তার নিদান দিয়ে দিয়েছিলেন আগেই। সুরজিৎকে আঁকড়ে বাঙালি আজ আর বলছে না— ‘সুরো কোত্থাও যাবে না’, সে দিব্যি মজে আছে নিত্যনতুন বিনোদনে। এ ও একপ্রকার সময়ের দাবী। সুরজিৎ একা গেলেন না, একটা গোটা দশকের ছায়া ছায়া ছবি কাঁধে নিয়ে চলে গেলেন, বাঙালি বুঝলও না বোধহয়, খুব একটা…

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4665 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...