ত্রুটি

ত্রুটি | জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

 

গলিতে একটা চাপাকল আছে দেখে, স্কুটারটা গলির একপাশে দাঁড় করিয়ে নামল দুজন। অল্পবয়সী ছেলেটা হাতলে ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে দু-তিনবার চাপ দিতেই জল বেরিয়ে এল শব্দ করে। অন্য লোকটির বয়স চল্লিশের বেশি, মাথা থেকে ফেজটুপিটা খুলে ভাঁজ করে পাঞ্জাবির পকেটে ঢোকাল। পাঞ্জাবির বুক-পিঠ ঘামে ভিজে আছে। কলের মুখের কাছে মাথাটা ঝুঁকিয়ে প্রথমে চোখে-মুখে জল দিল, মাথাটা ভিজিয়ে নিল। তারপর দু-হাতের অঞ্জলি ভরে জল খেতে শুরু করল। অল্পবয়সী ছেলেটার বার বার ঢোক গেলা দেখে মনে হচ্ছে— এর হলে আমিও একটু গলাটা ভেজাব। তখনই গলির এক প্রান্ত থেকে দুজন আরোহী নিয়ে একটা বাইক সশব্দে এগিয়ে এল দ্রুত। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পেছনে বসে থাকা লোকটা নামল। স্ক্রু ড্রাইভারটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে গেল চাপাকলের দিকে। যে জল খাচ্ছিল, সে মাথা তোলার আগেই বাঁ হাত দিয়ে তার ঘাড়টা শক্ত করে ধরে পর পর চার-পাঁচ বার তার গলায় স্ক্রু ড্রাইভারের ফলাটা বসিয়ে দিল। আততায়ী আর শিকার দুজনের মুখ দিয়ে চাপা পাশবিক শব্দ বেরোল— হু-উ-প, হু-উ-প… স্ক্রু ড্রাইভারের প্রতিটা আঘাতের সঙ্গে। শিকার দেখতেও পেল না পেছন থেকে আসা শিকারিকে, গাছের কাটা ডালের মত মুখ থুবড়ে পড়ে গেল চাপাকলের গোড়ায় শান-বাঁধানো জায়গায়। আর, যে চাপাকলের হাতলে চাপছিল, সেই অল্পবয়সী ছেলেটার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চাপাকলের হাতল ছেড়ে এক ছুটে গলির অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে গেল… দু-একবার হোঁচট খেয়ে সামলাতে সামলাতে ছুটে চলে গেল অন্য রাস্তায়… হারিয়ে গেল অন্য এক গলির ভেতর। রক্তাক্ত স্ক্রু ড্রাইভার সমেত ডানহাতটা পিছমোড়া করে নিজের পিঠের আড়ালে নিয়ে আততায়ী এসে আবার বাইকে বসে পড়ল। বাইকটা চলে গেল একই রকম শব্দ করে… সেই দিকে, যেদিক দিয়ে অল্পবয়সী ছেলেটা পালিয়েছিল।

আজ মহরম, ছেলেটা দুটো গলি পার করে বড় রাস্তার দিকে গেলে আর ওকে চট করে ধরতে পারবে না। সেখানে অনেক লোকের ভিড়। এখনও একদল লোক ইয়া হুসেইন, ইয়া হুসেইন করে যাচ্ছে। তাজিয়া বেরিয়েছে ওই রাস্তায়। একজনের গায়ে হাত তুললে, ওরাও বেঁচে ফিরবে না। এমনিতেই আজ রক্ত দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায় কিছু মানুষ।

গলির দুটো মাথায় যে হলুদ টাংস্টেন ফিলামেন্টের বাল্ব জ্বলছে লাইটপোস্টে, সেই আলো রাস্তার মাঝামাঝি অবধি যতটা আলো পৌঁছে দিতে পারে… ততটাই। সেই হলুদ আলো ক্ষীণ হয়ে অন্ধকার কোণগুলোতে বাদামী আভা ছড়িয়ে দেয়। খোলা নর্দমাগুলোকে মনে হয়ে ছায়ার চোরা স্রোত। উপুর হয়ে পড়ে থাকা লাশের গলা থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্ত, চাপাকলের গোড়ায় জমে থাকা জলে মিশে একটা ধারা বয়ে গেল পাশের নর্দমার দিকে। কেউ জানলা খোলেনি। বরং দু-তিনটে জানলা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। বারান্দা বা সদর দরজার আলোগুলো নিভে গেল… যে কটা জ্বলছিল।

যে দুটো কুকুর খুব ডাকছিল, তাদের একজন এসে পায়ের পাতা, পা থেকে খুলে বেরিয়ে আসা চটির একটা পাটি— কয়েকবার শুঁকে চলে গেল। ঘাড়ের কাছাকাছি এগোনোর সাহস পেল না। শরীরে উষ্ণতা কিছুক্ষণ থাকে… কিন্তু দেহ নিথর, চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, পিউপিল ডাইলেট করে গেছে। যে হারে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে, তাতে…

***

 

–সবসময়ে এমন সালোয়ার পরিস কেন? শাড়ি পরতে পারিস না?
–কেন? কী অসুবিধে?
–বুঝিস না তুই… একটা ব্যাপার থাকে।
–তুই-ই বা লুঙ্গি পরে থাকিস কেন? বারমুডা পরতে পারিস না?
–ওটারও একটা ব্যাপার আছে… ওটাও তুই বুঝবি না।

আসলে এগুলো একরকম ফালতু কথা। যাকে বলে ‘স্মল টক’। সঙ্গমের আগে যেমন অনেকে ফোর প্লে করতে করতে পারদ চড়াতে চায় নিজের মত করে… দ্রুত নিষ্পত্তি পছন্দ করে না। তেমন সঙ্গমের পরেও অনেকে কাজ হাসিল বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়তে পারে না, উঠে চলে যেতে পারে না। শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ স্মল টক করে। মাঝে মাঝে এমন ‘স্মল টক’ থেকেই দ্বিতীয় ইনিংস-এর খেলা শুরু হয়ে যায়… বিরতির পর।

ঝিলিক এমন স্বল্প প্রাসঙ্গিক বা ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তার মাঝে ইউসুফের রোমশ বুকে সুড়সুড়ি দিতে থাকে। টিকটিকির মত মাঝে মাঝে সামান্য জিভ বার করে পুরুষ-স্তনের স্বাদ নেয়। ইউসুফ নড়েচড়ে একটা হাত বারিয়ে মোবাইল ফোনটা টেনে বলল, এই দেখ… বুঝবি কী সুবিধে। ঝিলিক ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল ‘কী সুবিধে’ তা বোঝার জন্য—

একজন নারী, বোঝা যায় গৃহবধূ। রান্নাঘরে রান্না করতে ব্যস্ত। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। শুধু বোঝা যাচ্ছে, হলুদ শাড়ি আর খয়েরী ব্লাউজ পরে… কোমরের কিছুটা অংশ অনাবৃত। এবার রান্নাঘরে একজন পুরুষ প্রবেশ করল। তারও কাঁধ অবধিই দেখা যাচ্ছে। সাদা হাফশার্ট আর চেক চেক নীল লুঙ্গি। নারীকে পেছন থেকে এসে চমকে দিল। তারপর শাড়িটা পেছন থেকে তুলে পাছায় চাপ দিতে শুরু করল হাত দিয়ে। নারী রান্নার তাকে ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে। আর পুরুষ নিজের লুঙ্গি তুলে সকেটে প্লাগ ঢোকানোর মত নিজেকে তার ভেতরে ঢুকিয়ে নিল নিপুণ কৌশলে এবং দ্রুত। দ্রুত দুলতে থাকল নারী শরীর, আর পুরুষ শরীর। পেছন থেকে নারীকে আঁকড়ে ধরে, তার পিঠে আর ঘাড়ে মুখ ঘষতে ঘষতে, ব্লাউজের ভেতর হাত ঢুকিয়ে হাতের মুঠোয় চাপ দিতে দিতে নারীকে পেছন থেকে ধাক্কা দিতে থাকল পুরুষ শরীর। নারীর মুখ থেকে প্রথমে চাপা গোঙানি, তারপর শীৎকার। পুরুষের হাত স্তন ছেড়ে চেপে ধরল তার মুখ… যাতে আওয়াজ রান্নাঘরের বাইরে না যায়। পাঁচ মিনিটের ভিডিওতেই এত কিছু হয়ে গেল। শীৎকার আর সুখ নিয়ে লতানে গাছের মত তাকের ওপর নুইয়ে পড়ল নারী-শরীর। যেমন এক পুরুষ চিতাবাঘ পিঠে উঠে পড়ে সঙ্গমের শিখরে পোঁছলে, নারী চিতাবাঘ চোখ বন্ধ করে সুখ পেতে পেতে দুটো থাবা সামনে বাড়িয়ে মাটিতে মাথা পেতে দেয়।

দেখতে দেখতে ঝিলিকের মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠল, দাঁত দিয়ে অধর কামড়ে দেখছিল ভিডিওটা শেষ অবধি। বাঁ হাতটা বুকে সুড়সুড়ি দেওয়া থামিয়ে নামতে নামতে চলে গেছে ইউসুফের পৌরুষ পর্যন্ত। আঙুল বুলিয়ে, হাতের মুঠোয়ে নিয়ে আবার তাকে জাগিয়ে তুলছে। শক্ত করছে, প্রস্তুত করছে স্তম্ভ। ইউসুফের শিশ্ন তার খুব পছন্দের, তার বর চয়নেরটা এত দীর্ঘ নয়, বরং একটু ছোটই। ভিডিওর শেষে হঠাৎ লুঙ্গি নামিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল পুরুষটি। আর নারী নিজের কাপড় নামিয়ে দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠল। যেন বাইরে থেকে কারও কণ্ঠস্বর… কেউ ডাকছে কারও নাম ধরে। ভিডিও শেষ হতেই ঝিলিকের বাঁ হাতও থেমে গেল। ইউসুফ ভুরু কুঁচকে বলল— ক্যা হুয়া?

ঝিলিক উঠে বসে মাথার চুল সামলে একটা আলগা খোঁপা করে নেমে পড়ল খাট থেকে… বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল, হুক্কা হুয়া… পাঁচ মিনিটেরই মামলা হলে তো চয়নই ঠিক আছে!

ইউসুফ উঠে পড়ল, মোবাইলে দেখল প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে। পৌরুষ চাইছিল আর একবার তেষ্টা-মেটাতে। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। ঝিলিকের বর সন্ধের আগে আসবে না, কিন্তু পাড়ার লোকজন বিকেল হতেই জাগতে শুরু করে… এবারে বেরিয়ে পড়াই দরকার। আজ জুম্মাবার, ভাইজান নামাজের জন্য যাবে, তার আগে দোকানেও ফিরতে হবে। এখানে এলে সেদিন আর মসজিদে যেতে ইচ্ছে করে না… কোথাও একটা ইমানে খোঁচা দেয়। কাউকে বলতে পারে না, আর ঝিলিকের কাছে আসা বন্ধও করতে পারে না। আলাদাই অঙ্গার এই মেয়ে… গায়ের রং চাপা হলে কী হবে! ডাকে সাড়া না দিয়ে পারা যায় না।

ইতস্তত করে খাট থেকে বাথরুমের দিকে গিয়ে উঁকি দিল একবার। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল না। ঝিলিক মগ থেকে জল নিয়ে নিজের তলপেট আর যোনিমুখ ধুচ্ছে। ইউসুফকে উঁকি দিতে দেখে ফিক করে হেসে ফেলল। ইউসুফ বাথরুমের ভেতর ঢুকে ভেতর থেকে ঠেলে বন্ধ করে দিল দরজাটা।

***

 

বাবা যখন মারা যায়, চয়ন তখন ক্লাস এইটে পড়ে। বড়দিদি কলেজের সেকন্ড ইয়ার। মা নিজের গয়না আর বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলে দিদির বিয়ে দিয়ে দিলেন দিদি কলেজ পাশ করতেই। দিদির অবশ্য লেখাপড়ার বিশেষ ইচ্ছেও ছিল না, বিয়ে দিয়ে ভালোই করেছিল। কিন্তু চয়নের লেখাপড়ার পুঁজি বলে তেমন কিছু আর থাকল না। ব্লাউজ সেলাই, শাড়ির পিকো, পর্দা সেলাইয়ের অর্ডার নিয়ে… তিন-চারটে ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে, তারপর আরও কী সব— চয়ন অত খোঁজও রাখত না, বুঝতেও পারত না। সংসারটা চলে যেত। কিন্তু নিজের জন্য বিশেষ কিছু যে আর চাওয়া যাবে না, সেটা বিকম পড়তে পড়তেই বুঝতে পেরে গেছিল চয়ন। এমন কিছু মেধাবি নয়, যে গরিবের ঘরের উজ্জ্বল ছাত্র হয়ে লড়াই চালিয়ে যাবে। আর বাবা আচমকা মারা যাওয়ার পর, মনের জোর আর মনোযোগ দুটোই কমে গেছিল। লোকে বলত— মাথার ওপর গার্জেন না থাকলে যা হয়। তাও বিকম পাশ করে নিজের চেষ্টায় একে-তাকে ধরে সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজটা জুটিয়েছিল। মাকে দেখে মনে হল, মায়ের সুবিধেই হল। অবশ্য চয়নের থেকে মায়ের খুব বেশি কিছু চাহিদা বা প্রত্যাশা ছিল না… থাকলেও, মনের মধ্যে রাখতেন। প্রকাশ করতেন না। করতে পারতেন না।

চয়নের বাবার পথ-দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবরটা একটা শকের মত ছিল। দেহটা দেখার মত অবস্থাতেও ছিল না। যারা দেহ রাস্তা থেকে তুলতে গেছিল… দেহ থেকে বেরিয়ে আসা অন্ত্র-জাল সামলাতে পারছিল না। মর্গে শনাক্ত করতে গেছিলেন বড়জ্যাঠা আর মামা। মাকে বারণ করেছিলেন দেহ দেখতে। চয়নের মা দেখেছিলেন, ওঁদের কথা শোনেননি। বাবার মুখাগ্নি ছাড়া আর কিছু চয়নকে করতে হল না। তখন বডির মাথা থেকে চোয়াল ব্যান্ডেজ করা। শরীর নীল পলিথিন শিটে ঢাকা। ভয় পাওয়ার কারণগুলো সব আড়ালে। তাও… বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। মৃতদেহর মুখটা দেখেইনি ঠিক করে চয়ন, গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল… মাথা ঝিমঝিম করছিল। তার ওপর ক্রমাগত একটা করে লরি ঢুকছে ‘বলো হরি’ করতে করতে। মৃতদের পরিবারের লোকজন সুর করে কেঁদে উঠছে হঠাৎ। নানারকম ধূপের গন্ধ মিশে একটা অন্যরকম গন্ধ। অন্তিম সৎকার করা পুরোহিতের বিজবিজ করে মন্ত্র বলে যাওয়ার শব্দ। মামা কাঁধে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে বসেছিলেন। জেঠু সব কাগজপত্রের কাজ করছিলেন। একে দিয়ে সই করানো, তাকে দিয়ে সার্টিফিকেট বার করা। এখন সেদিনটার কথা মনে পড়লে কেমন একটা লাগে। মনে হয়— একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেছিল দিনটা। অস্থির মালসাটাও নিজে ভাসিয়েছিল, না মামা ভাসিয়ে দিয়েছিল… মনে নেই। সেইদিন প্রথম জেনেছিল… শ্মশানেও লাইন পড়ে। মড়া-পোড়ানোর লম্বা লাইন। পরে নিজেও বলেছে, লোকজনকেও বলতে শুনেছে— লাক ভালো ছিল, দুজনের পরেই আমরা; লাক ভালো ছিল… আমরাই ফার্স্ট; সক্কাল সক্কাল গেছি বলে একদম ফাঁকা ছিল।

চয়নের মা প্রমিলা দেবী যে খুব একটা দুর্বল মনের বা হতাশাগ্রস্ত মানুষ ছিলেন, এমন না। দু-সপ্তাহ যেতে নিজেই চয়নের দিদিকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাঙ্ক, প্রভিডেন্ট ফান্ড, স্বামীর অফিস… সব কাগজপত্রের কাজ মিটিয়েছিলেন। শোকের বাইরেও একটা স্পষ্ট কৌশল ছিল। বিধবা স্ত্রী আর শোকগ্রস্ত কন্যাকে দেখে একটা সহানুভূতি আসে… এসেওছিল। কাজগুলো সব দু-তিন মাসের মধ্যেই মিটে গেল। মাসিক সংসার খরচের ব্যবস্থা হল। মাকে প্রথম প্রথম শাখা-সিঁদুর ছাড়া দেখতে অন্যরকম লাগত, তারপর ক্রমে চোখ সয়ে গেল। প্রমিলা দেবী বিধবার পোশাক পরবেন না বলেই ঠিক করেছিলেন। আত্মীয় বা প্রতিবেশীরাও মুখে সহমত প্রকাশ করল— কীই বা এমন বয়স, এই বয়সে কি কেউ বিধবা হওয়ার কথা ভাবতে পারে? আর কী… নিয়তি! মানুষের যতটুকু আয়ু! কপালের লিখন খণ্ডাবে কে? সম্মতি থাকে শব্দে, মনে মনে অদ্ভুত রকম স্যাডিস্টিক হয়ে ওঠে মানুষ। পরিস্থিতি যেমনই হোক, প্যাঁচে পড়ে মানুষ চাপে থাকবে… এই দেখেই আনন্দ। মানুষকে অস্বস্তি বা অসুবিধের মধ্যে কষ্টে-সৃষ্টে মানিয়ে চলতে দেখলে সুখ। এই কমাসও হয়নি সোয়ামি মারা গেছে… তার আবার সাধ-আহ্লাদ কীসের? নিরামিষ যে খাবেন না, এই ব্যাপারে শুরু থেকেই কোনও রাখ-ঢাক করেননি প্রমিলা দেবী। আসতে আসতে চোখ সইয়ে সইয়ে সব কিছু বদলে ফেললেন… ধীরে ধীরে শাড়ির রং গাঢ় হল, সাজ-প্রসাধনীও স্বাভাবিক করলেন। দিনক্ষণ বুঝে চুড়িটা-হারটাও পরতেন। শুধু সিথির সিঁদুরটার আর দরকার হত না। দেখতে দেখতে সেটাও চয়নের গা সওয়া হয়ে গেল। নিয়মভঙ্গ অবধিও অপেক্ষা করেনি, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের দিনই বিকেলে এগরোল খেয়েছিল চয়ন। তাহলে মার কী দোষ?

চয়নের দিদি প্রথম সন্তান। দিদির যখন বিয়ে হল… তখন প্রমিলা দেবীর বয়স পঁয়তাল্লিশ। দেখলে মনে হবে চল্লিশের কাছাকাছি, বিগতযৌবনা… কিন্তু মধ্যবয়স্কা কোনওমতেই নন। দিদির বিয়ের পর পরিবারের অবস্থা যেন একটু বেশিই স্বচ্ছল হয়ে গেল। বিয়ের পর সব তত্ত্বর জিনিস সময়মতই গেল প্রথম বছর। দিদি-জামাইবাবু এলেও খাতিরের ত্রুটি হত না। সত্যি বলতে, বিয়ের পর দিদির বাঁদরামো বেড়ে গেল একটু… ফোন করে ইনিয়েবিনিয়ে কিছু একটা চাওয়ার কথা বলেই দিত। মা কখনও শুনতেন, কখনও তিনিও বুদ্ধি খাটিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতেন। চয়ন বুঝতে পারত না… হঠাৎ হলটা কী! এদিকে টিউশন পড়ার টাকা নেই বলে দিদির বিয়ের আগেই সব টিউশনগুলো ছেড়ে দিতে হল। বন্ধুদের নোটের ভিক্ষেতে দিন গুজরান হয়।

এই হঠাৎ আসা স্বাচ্ছন্দ্যের কারণও হঠাৎই জানতে পারল চয়ন, যেদিন স্কুলের একজন শিক্ষক মারা গেলেন। শিক্ষকের আকস্মিক মৃত্যুতে স্কুল ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল, চয়নও ফিরে এল দুপুর থাকতে থাকতে। বাড়ির দরজাটা আলগা ভেজানো, ভেবেছিল চুপিচুপি ব্যাগটা রেখেই, জামা-কাপড় বদলে চলে যাবে মাঠে… মা-কে জাগাবে না। কিন্তু ঘরের দিকে এগোতেই থমকে গেল। অসাবধানে সরে আসা জানলার পর্দার ফাঁক থেকে দেখল— মায়ের বিছানায় মায়ের ওপর জ্যাঠা শুয়ে আছে। ক্রমাগত নড়ছে, খাটটাও নড়ছে তালে তালে। মায়ের মুখটা সামান্য ফাঁক করা, চোখদুটো বন্ধ। হাতের নখগুলো জ্যাঠার পিঠে বসে আছে। চয়নের কাছে সঙ্গমের দৃশ্য কোনও বিস্ময় নয়, ব্লু ফিল্ম দেখায় হাতেখড়ি হয়ে গেছিল। কিন্তু মাকে এভাবে দেখাটা ছিল অপ্রত্যাশিত। ইডিপাস কমপ্লেক্স সম্পর্কে কিচ্ছু না জানা সতেরো-আঠেরো বছরের চয়নের ইচ্ছে করছিল আর একটু সময় নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার… এর পর কী হয়। কিন্তু দুজন পরমাত্মীয়ের ল্যাংটো শরীরের দিকে ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি তাকিয়ে থাকতে পারল না। ছিটকে সরে এল দেওয়ালের আড়ালে। তারপর, যাতে কোনও শব্দ না হয়, বাইরের দরজাটা ওভাবেই বন্ধ করে পিঠে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। তখন মাথাটা অল্প অল্প ঝিমঝিম করছে… কাছাকাছি একটা পুকুরপাড়ে বসে ফোঁকার থেকে ভালো ওষুধ জানা নেই।

সিনেমায় ধারাবাহিকে এমন দেখেছে, মা-কে অন্য কারও সঙ্গে যৌনাচার করতে দেখে মাথার ঠিক রাখতে না পেরে হয় মাকে না হলে সেই ব্যক্তিকে না হলে দুজনকেই একসঙ্গে খুন করে ফেলছে ছেলে। মাথায় পাথর বসিয়ে মেরে ফেলছে দুজনকে। মুখ চেনা যাচ্ছে না লাশের। কিন্তু চয়নের এইসব ভাবলেও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। মা না থাকলে কে দেখবে চয়নকে? ঐ ধান্দাবাজ জামাইবাবু? আত্মীয়-প্রতিবেশী সবাই দু-এক দিনের দরদী… দায়িত্ব কেউ নেয় না। মা চলে গেলে, কী করে কী চলবে, তাই জানে না চয়ন।

এখন ভাবে… এইসব চিন্তা করত— মানে কোথাও একটা দশ শতাংশ হলেও চাপা ইচ্ছে ছিল মা আর জ্যাঠাকে সরিয়ে ফেলার। একটা চাপা আক্রোশ ছিল। তখন ভাবত— ওই জ্যাঠাই আসল শয়তান, মা-কে পরিস্থিতির শিকার করে এক্সপ্লয়েট করছে। কষ্ট হত মায়ের কথা ভাবলে। কিন্তু মায়ের শীৎকার আর তৃপ্তিতে ভরা শরীরী ভাষাগুলো মনে পড়ে… সেই একদিন না, এর পরেও তো বেশ কয়েকবার আড়াল থেকে দেখেছে চয়ন! বুঝতে পারত, বাবা হঠাৎ চলে গিয়ে মায়েরও কষ্ট হয়। মায়ের শরীরের কষ্ট হয়। জ্যাঠা সুযোগ নিচ্ছে ঠিকই, বাবা বেঁচে থাকলে এত সহজে এসব হত না… কিন্তু মা নিতান্তই ভিক্টিম নয়। শরীর বৈধব্য বোঝে না। মা তো আর সত্তর-আশি বছরের বিধবা বুড়ি নয়! শুধু কিছু দৃষ্টিভঙ্গি চিরকালের মত বদলে গেল চয়নের… আগে মনে হত—

মায়ের মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়, তাই বাইরে না বেরোলেও ঘরেই একটু সাজ-গোজ করে বসে থাকতে ভালোবাসে। মাঝে মাঝে মন ভালো থাকলে বিনুনি বেঁধে গুনগুন করে গান গায়। ভালো-মন্দ রান্না করে। মাঝে মাঝে হঠাৎ মন খারাপ করে বলেই, একা চলে যায় সকাল সকাল… গুরুদেবের আশ্রমে; রাত করে ফেরে।

সেই ‘মন খারাপ’ আর ‘মন ভালো’-র ভ্রান্তিটা আর রাখল না চয়ন। রাগও করত না, প্রশ্নও করত না। শুধু নিজের যখন টাকার দরকার হত সরাসরি চেয়ে নিত চোখের দিকে তাকিয়ে। আগের মত ইতস্তত করত না। মা-ও কোনও কথা না বাড়িয়ে দিত টাকা, যতক্ষণ সে দাবীর একটা মাত্রা থাকে।

তারপর দিদির মেয়ে হল, চয়নের চাকরি হল… বিয়ে করল চয়ন। জ্যাঠার আসা-যাওয়া অনেকটা কমে এল চয়নের বিয়ে হতেই। মাঝে মাঝে চয়নের মা-ই ‘ওবাড়ি’ ঘুরে আসতেন জেঠিমার সঙ্গে দুটো সুখ-দুঃখর গল্প করতে। তারপর হঠাৎই একদিন সকালবেলা মা ঘুম থেকে উঠলেন না, মাত্র একষট্টি বছর বয়স। ঘুমের মধ্যেই চলে গেলেন প্রমিলা দেবী। চয়নকে আবার একবার মুখাগ্নি করতে যেতে হল। বাবার মত পরিস্থিতি নয়, মায়ের মুখের দিকে তাকাতে অসুবিধে হচ্ছিল না। অসুবিধে হল মুখাগ্নি করতে গিয়ে, মনে হল মায়ের ছ্যাঁকা লাগবে। ইলেকট্রিক চুল্লিতে সঙ্গে থাকা বন্ধুরা ঠেলে দিল প্রমিলা দেবীর দেহ। চয়ন মুখ ফিরিয়ে বেরিয়ে এল বাইরের দিকে। এতদিনের জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ… দাহ হয়ে গেল।

***

 

চয়ন আজকাল বুঝতে পারে না, মাকে ক্ষমা করা উচিত না নিজেকে। নিজের ক্ষমা চাওয়ার দরকারটাই যেন জীবনে অনেক বেশি জরুরি মানুষের। একসময়ে মাকে দেখেছে জ্যাঠার লিঙ্গ চুষতে, এখন নিজের বউ ঝিলিককে দেখে একটা দাড়িওলা ইলেকট্রিকের মিস্তিরির লিঙ্গ মুখের ভেতর গলা অবধি ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে। ওরা ভাবে কেউ জানে না… কিন্তু চয়ন জানে। যতটা জানার, সবটাই। মায়ের জন্য সংসারে টাকা আসত। নিশ্চিত বাড়তি টাকা ঢুকত ঘরে, নাহলে হঠাৎ করে এত স্বচ্ছল হয়ে ওঠে না সংসার। কিন্তু ঝিলিক… ও কী পায়? শুধু ওই মোল্লার ছ ইঞ্চির ঠাপ?

খাটের তলায় ঝাঁট দিতে গিয়ে কন্ডোমের স্যাশে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। এই ব্র্যান্ড চয়নের কেনা নয়। তারপর একটু নজর রাখতেই বুঝতে পারল— কে আসে, কখন আসে। কে যায়, কবে যায়। কোথায় যায়।

একইরকম লিপ্সার আশ্লেষ, বরং একটু বেশিই। ঝিলিকের শরীরে অস্থিরভাবে প্রবেশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যেত চয়ন, কিন্তু এমন তৃপ্তি তার চোখে দেখেনি কখনও। এমন চরম তৃপ্তি তার চোখে কোনওদিনও দেখেনি, যতটা দেখেছে এই মুসলমান মিস্ত্রির জন্য। ছিঃ, একটা ভদ্রলোকের মেয়ে… বাপটা নিতান্তই ভিজে বেড়াল… তার মেয়ের পছন্দের এই ছিরি? এই স্ট্যান্ডার্ড? শেষে একটা মিস্তিরি?

তাও যদি একটা ছেলে-মেয়ে হত… বিয়ের পাঁচ বছর পার করেও কোনও ছেলেমেয়ে নেই! সেই দোষটাও এখন চয়নের ঘাড়েই ফেলা যায়। কিন্তু পারবে না, কারণ চয়ন বলেছিল একসঙ্গে দুজনেরই চিকিৎসার কথা, যার যেমন সমস্যা, তার সেই মত মেডিকেশন হবে। রাজি হয়নি ঝিলিক। প্রথমে জেদ, পরে কান্নাকাটি, শেষে অশান্তি করেছে। ঝিলিকের বাপ-মাও মেয়ের নাটককে মদত দিল!

ঝিলিকের ইচ্ছে নেই মা হওয়ার। সত্যিই তো… একটা মেয়ের ইচ্ছে না থাকলে, তাকে জোর করাও তো একরকম সামাজিক অপরাধ!

আবার গুলিয়ে ফেলে চয়ন। আগে ক্ষমা চাওয়া উচিত না ক্ষমা করা। কানে ইয়ারফোন দিয়ে স্মার্টফোনের পর্দায় সিরিয়াল কিলার, ক্রাইম অফ প্যাশন… এই ধর্মী ধারাবাহিক দেখতে দেখতে হাত নিশপিশ করে। কিন্তু সে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ। সামান্য পদোন্নতি হলেও এখন এরিয়া সেলস-এর কাজই সামলায়। পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গেও গলা তুলে কথা বলতে পারে না। তারপর এই ছেলেটা যেখানে কাজ করে, যেখানে থাকে… তাদের কিছু বলতে গেলে পালটা মার খাবে। আর পাড়ায় বললে জুটবে খিল্লি— বউকে ঘরে ঢুকে কাটার বাচ্চা ঠাপ দিয়ে যায়— বর এসেছে মিউ মিউ করে হেল্প চাইতে! মাঝে মাঝে মনে হয়, ভগবান সবাইকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেন না, আমাকে দিয়েছেন। মাকে মারতে পারেনি, সামর্থ্য ছিল না… ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু এরা এইভাবেই চালিয়ে যাবে? চয়নের থাকা শুধু টাকা জুটিয়ে যাওয়ার জন্য?

এত রস তো মোল্লাটার সঙ্গে চলে যা… তাও যায় না! সেদিকে সেয়ানা!

আচ্ছা… গল্পে যেমন দেখায়… এরা তো আমাকেই সরিয়ে ফেলতে পারে! এই মোল্লাগুলো তো সব পারে! যদি…

আজকাল রাতে ভালো ঘুম হয় না। ঘুম হলেও দুঃস্বপ্ন ঘুম ভেঙে যায়।

গর্তে পড়ে আছে, হাত-পা নড়াতে পারছে না। মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছে না। কিন্তু সব দেখতে পাচ্ছে। ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা দাড়িওয়ালা লোকগুলো মুঠো মুঠো মাটি নিয়ে গর্তে ফেলে দিচ্ছে। ওই মোল্লা মিস্তিরিটাও মাটি ফেলছে। বেলচা দিয়ে দিয়ে অনেকটা করে মাটি ঠেলে গর্ত বুজিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে তাড়াতাড়ি। আর ঝিলিক তখন ওর শক্ত হয়ে থাকা শিশ্নটায় জিভ বুলিয়ে বুলিয়ে টানটান করে রাখছে। শিশ্ন চুষতেই চুষতেই মাঝে মাঝে চোখ ফিরিয়ে দেখছে, মাটি কতটা ভরাট হল, এখনও চয়ন দেখতে পাচ্ছে কি না।

এক পুরুষ, রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসছে, দুহাতে একটা মস্ত পাথর তুলে। বিছানার পাশে এসে বলল— বাবাই, তুই এখান থেকে পালিয়ে যা! বাবার গলা। এত বছর পরেও শুনে চেনা যায়! বলতে বলতেই বিছানার ওপর সজোরে সেই পাথর বসিয়ে দিল। ঝিলিকের মাথা লক্ষ করে। তারপর দুহাতে সেই রক্তাক্ত পাথর তুলে আবার বসিয়ে দিল… নারকেল ফাটার মত আওয়াজ। মা-ও শুয়েছিল ঝিলিকের পাশে। সব দেখেও চয়ন কিছু বলতে পারল না, কিছু করতে পারল না। বোবায় ধরেছে ওকে। বাবা রক্তাক্ত পাথরটা মেঝের ওপর নামিয়ে রেখে চলে যাচ্ছে। যেতে যেতে বলল— পাথরটা রেখে গেলাম, একজন এখনও বাকি… কাজ শেষ করে পুকুরে ফেলে দিস।

চয়নের গোঙানি শুনে ঝিলিকের সুখস্বপ্ন ভেঙে যায়। মানুষটা কিছু করতেও পারে না ঠিক করে, ঘুমোতেও দেয় না শান্তিতে। কাকে যে বাবা ঘাড়ে চাপিয়ে দিল… কী দেখে যে মরতে রাজি হয়েছিল তখন! ঘুমের ঘোরেই হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে চয়নকে ফিরিয়ে আনে ঝিলিক। তারপর ওপাশ ফিরে শোয় নিজের স্বপ্নে ফিরে যেওয়ার চেষ্টায়। চয়ন রাত আড়াইটের সময়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে। নিশাচর প্রাণী এবং মানুষরা যাওয়া-আসা করে গলি দিয়ে… সশব্দে, নিঃশব্দে। বাবার রেখে যাওয়ার রক্তাক্ত ঘাতক পাথরটার কথা মনে পড়ে। পাথরটা বুকে ওপর ভারী হয়ে বসে জগদ্দল হয়ে।

***

 

–তোদের জাতে তালাক থাকলে ভালো হত… স্যাটা স্যাট তালাক দিয়ে বেরিয়ে আসতি।
–হ্যাঁ… আর তোদের ওই পর্দা, হিজাব… হাবিজাবি ওইসব মেনে বস্তার মত বোর্খা চাপিয়ে ঘরে বসে থাকতাম! পাগল!
–তোকে কে বলেছে যে মুসলমান বিয়ে করলেই ঘরে বোর্খা পরে বসে থাকতে হয়?
–জানি জানি… শুরুতে এইসব বলে, তারপর গিয়ে দেখা যায় পুরো জিন্দেগি ঝন্ড। দেখেছি আমি টিভিতে… হেবি চাপের ব্যাপার। আ-আমি ওসবের মধ্যে হরগিস যাচ্ছি না।
–হা হা হা… হ্যাঁ, টিভির লোকরা সব জানে। চ আমাদের পাড়ায়… দেখা আমার আম্মি, ভাবি কে বোরখা পরে। বাইরে বেরোলে মাঝে মাঝে পর্দা করে। সব ফ্যামিলি একরকম না রে!
–আমি একেবারেই পারব না। সরি!
–বাদ দে… মজা করছিলাম না। চাকরি করা বর ছেড়ে কেউ ইলেকট্রিকের মিস্তিরিকে বিয়ে করে না। সে হিন্দু হলেও তুই করতিস না। আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি, পারবি না তুই।
–বাপ রে… জয়েন্ট! আমি ওই এক শাশুড়িকে নিয়েই চাপে ছিলাম… যেতে হাত-পা ছড়িয়ে বেঁচেছি। রক্ষে করো!
–হা হা হা…
–তার চেয়ে, আমাদের জাতে একসাথে দুটো-তিনটে বর রাখা গেলে আরও ভাল হত। তোকে আর ওকে দুজনকেই রেখে দিতাম।
–…
–কী হল? তোদের দু-তিনটে বিবি থাকতে পারে, আর আমার দুটো বর থাকলে দোষ?
–হ্যাট! মাথা-ফাথা খারাপ! ইসলামে কেন আবার বিয়ে করার কথা আছে জানিস?
–অত জেনে কাজ নেই, চারটে বউ থাকলে… চারটে বরও থাকবে। নয়ত কোনওটাই না। ঘরে একজন বউ থাকতে এত নোলা কীসের?
–ওহ তাই?! আর তুই যে বরকে লুকিয়ে…
–ও-ও-ও… তোর বউ নেই, বউকে লুকনোর ব্যাপার নেই… আমার বর আছে, আমি বরকে লুকোচ্ছি… ঠিক হ্যায়… যা বেরো… আর আসবি না!

ঝিলিক সত্যিই এক ঝটকায় ইউসুফের হাত সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে নিজের পোশাক ঠিক করে নিতে লাগল দ্রুত। আর বলতে থাকল— কিচ্ছু লুকিয়ে করতে হবে না… চল বেরো এবার। আর আসবি না। যা বলে, ঠিকই বলে… সালা জাতটাই এমন! ইউসুফ এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। প্রায় ছ-সাত মাসের সম্পর্ক, সুযোগ পেলেই শরীরে শরীরে মাখামাখি… ঝগড়া, কথা-কাটাকাটিও হয়। তবে এমন জাতের কথা এর আগে কখনও আসেনি। আজ কেমন কথার পিঠে অদ্ভুত বেসুরো কথা বলছিল ঝিলিক। মুসলমান পরিবার নিয়ে সমস্যা, একাধিক বউ নিয়ে সমস্যা, নিজেও একাধিক খসম রাখবে… শেষে ‘জাতটাই এমন’ শুনে খাট থেকে নেমে ঠাস করে একটা চড় মেরে দিল ঝিলিকের গালে। চড়টা খেয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল ঝিলিক। চোখে বিস্ময় নিয়ে। চয়ন কোনওদিনও তার গায়ে হাত তোলেনি। ঝিলিকের মা মেরেছিল শেষ কোন ছোটবেলায়। বিস্ময় ভাঙতে একটাও কথা বলল না, ছুটে গিয়ে বাইরে যাওয়ার দরজাটা হাট করে খুলে দিল। ইউসুফ তখনও উলঙ্গ। এভাবে হঠাৎ দরজা খুলে দেবে বুঝতে পারেনি। দ্রুত আড়ালে চলে গিয়ে প্যান্টটা গলিয়ে নিল, তারপর জামা। চোখটা রাগে সরু হয়ে গেছে। একই সঙ্গে অপমান আর প্রত্যাখ্যান যেভাবে পুরুষত্বের সর্পকে কূপিত করে। জামায় হাতা গলাতে গলাতেই দাঁতে দাঁত চিপে শেষ কটা কথা বলল ইউসুফ— ইস জাত কি লন্ড চুসনে মে তো বড়া মজা আতা হ্যায় তেরে কো! নেহি?

তারপর ঝড়ের বেগে চলে গেল। ঝিলিকও সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে সশব্দে বন্ধ করে দিল দরজাটা।

***

 

ঝিলিক আজকাল খুব অন্যমনস্ক থাকে। চোখের তলায় কালি। আগের মত সাজগোজ করেও বসে থাকে না সন্ধেবেলা। কথা কম বলে, চুপচাপ বসে থাকে টিভির দিকে তাকিয়ে, রিমোট দিয়ে চ্যানেল বদলে যায়।

সেদিন অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই চয়ন দেখছে ঝিলিক এমন গুম খেয়ে আছে। রাতে শুয়ে হঠাৎ কেঁদে উঠল চয়নের বুকে মাথা রেখে, কী হয়েছিল কে জানে! চয়ন দু-একবার জিজ্ঞেস করল… কী হয়েছে, শরীর খারাপ কি না, বাড়িতে বাবা বা অন্য কারও শরীর খারাপ কি না, কেউ কিছু বলেছে কি না। জিজ্ঞেস করল, কিন্তু অনেকটাই নিয়ম মেনে জিজ্ঞেস করার মত। কাউকে কাঁদতে দেখলে এমনিই মানুষের মধ্যে যতটা সহানুভূতি অঙ্কুরিত হয়ে থাকে, ততটাই। স্ত্রীয়ের প্রতি স্বামীর উষ্ণতা ছিল না। বরং, একটু শীতল আর সংযতই ছিল প্রশ্নগুলো। ঝিলিক কিছু একটা চাইছিল, কিছু একটা খুঁজছিল। চয়ন তা বুঝতেও চাইল না, দিতেও পারল না। অসাবধানে ঝিলিকের পিঠ থেকে কোমরের দিকে নেমে এসেছিল চয়নের বা হাতটা, ঝিলিকও আরও কাছে চলে এসেছিল নিজের বুকটা চয়নের বুকে চেপে। তখনই মনে পড়ে গেল—

ল্যাংটো ঝিলিককে এই ঘরের মেঝেতেই চার হাত-পায়ে কুকুরের মত থাকতে দেখেছে চয়ন। আর পেছনে তার চুলের মুটি ধরে ট্রেনের মত তালে তালে ঠাপ দিচ্ছিল ল্যাংটো ‘কাটোয়া মিস্তিরি’-টা। ট্রেনের দুলুনির তালে দুলছিল ঝিলিকের এই স্তন দুটো। হাসতে হাসতে কুৎসিৎভাবে জিভ বার করছিল মোল্লার বাচ্চাটা। চয়ন দেখেছে… দেখে চুপচাপ বেরিয়ে গেছে। কানের কাছে যেন বাবার মত গলায় কেউ বলে উঠেছিল— সঙ্গমের সময়ে পশু-পাখি এমন কি কীট-পতঙ্গকেও বিব্রত করা পাপ।

চোখের সামনে সেই দৃশ্য ভেসে উঠতেই ঝিলিককে ঠেলে সরিয়ে দিল চয়ন। উঠে বসে বলল, কিছুই হয়নি যখন, শুধু শুধু কাঁদছ কেন? মন খারাপ লাগে কাল সকালে ও-বাড়ি চলে যাও। কদিন থেকে এসো। আমাকে কাল চিত্তরঞ্জন যেতে হবে… ভোরবেলা ট্রেন।

ধাক্কা খেয়ে সরে যাওয়ার পর ঝিলিকের অভিব্যক্তি কেমন ছিল, তাও দেখেনি আর চয়ন। তবে শুনতে পাচ্ছিল, ওপাশ ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়েছে… পরাজিত ক্লান্ত মানুষ অনেক সময়ে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে।

চিত্তরঞ্জন থেকে ফিরেও চয়ন লক্ষ করেছে ঝিলিকের হাব-ভাব, কিন্তু ‘কী হয়েছে’ জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না। কী আর হবে, মোল্লার বাচ্চাটা আসা বন্ধ করে দিয়েছে হয়ত, বা যোগাযোগ করছে না। দিন সাতেক হয়ে গেছে, এই গুম হয়ে থাকাটাও আসতে আসতে অভ্যেস করে নিতে চাইছে চয়ন। সমস্যা থাকলে কদিন বাপের বাড়ি গিয়ে থেকে আসুক। যা পারে করুক। প্রতিবার এসব ভেবে ভাবনাটা তাড়িয়ে দিতে চায় চয়ন, কিন্তু ভাবনাগুলো যায় না… বিরক্তিকর মাছির মত ফিরে ফিরে আসে। বিয়ের পর তো ঝিলিককে ভালই বাসত। কোনও বান্ধবীর ভালবাসা পায়নি, ঝিলিকের শরীরী চাহিদা আর গৃহিণীভাবকে ভালবাসা ভাবতে সমস্যা হয়নি। এই মিস্তিরির সঙ্গে নোংরামোটার ব্যাপারে না জানতে পারলে… ধারণাটা কি বিশেষ বদলাত? তখন তো এভাবে কাঁদতে দেখলে, বা এমন মেঘ-কালো মুখ দেখলে সত্যিই মনের মধ্যে অস্থির করত চয়নের। ঝিলিকের মুড ঠিক করার জন্য এটা-সেটা সস্তা চেষ্টা করে নিজের সীমিত বুদ্ধি আর সামর্থ্যের প্রদর্শনী চালিয়েই যেত। ভাবনারা ফিরে ফিরে আসে, আর মাছি তাড়ানোর মত চয়ন বার বার মনে মনে বলে— যাক না, কদিন বাপের বাড়ি চলে যাক। কদিনের ব্যাপার… আবার ঠিক কুত্তাটা আসবে শরীরের গন্ধে ছোঁকছোঁক করতে করতে।

ঝিলিকের মনে কষ্টটা হচ্ছে ঠিকই, রাগও হচ্ছে। আর সব থেকে অসহায় লাগছে, কারণগুলো কাউকে বলতে না পেরে। ইউসুফের কথা কেউ জানে না। যে বান্ধবীর সঙ্গে সবরকম গোপন কথার কানাকানি চলে, সেও না। ঝিলিক বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা এরকম দিকে ঘুরতে পারে। সত্যিই সালাদের জাতের দোষ। বেশ করেছি বলেছি… একশোবার জাতের দোষ! একটা কথা বলেছি বলে সঙ্গে সঙ্গে গায়ে হাত… একদম ঠিক জায়গায় লেগেছে। প্রথম কদিন রাগ থাকলেও, ঝিলিকের রাগটা পড়ে গেছিল… হোয়াটসঅ্যাপ থেকে মেসেজ করে ‘সরি’ বলেছিল। হোয়াটসঅ্যাপে ইউসুফের নম্বরটা দোলন ২ বলে সেভ করা… ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে মেয়েলি কথাবার্তা আর ছবি চালাচালি করে। আর দরকারি ম্যাসেজ করলে, লুকিয়ে ফোন বা ভিডিওকল করলে সেসব এন্ট্রি ডিলিট করে দেয়। কিন্তু সেই নম্বরে মেসেজই দেখল না ইউসুফ। দিন সাতেক হয়ে গেল। তারপর হঠাৎই একদিন একটা অচেনা নম্বর থেকে একটা ছোট্ট ভিডিও এল– ঝিলিক ইউসুফের লিঙ্গ নিয়ে খেলা করতে করতে তাকে জাগিয়ে তুলছে, জিভ দিয়ে ললিপপের মত চাটছে… আর হেসে লুটোপুটি যাচ্ছে।

ইউসুফের মুখ বা হাত দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ঝিলিকের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঘরের যেটুকু উঁকি দিচ্ছে… বোঝাই যাচ্ছে চয়ন-ঝিলিকের ঘর। কখন কোথায় ক্যামেরা-মোবাইল রেখে এই ছবি বুঝতে পারল না… ভাবেইনি কখনও যে ইউসুফ এমন লুকিয়ে ভিডিও করতে পারে। কখনও আহ্লাদ করেও বলেনি, আজ আমাদের একটা ভিডিও করি। কখনও না। লোকটার প্রতি এতদিনে যে একটা সফট-কর্নার তৈরি হয়েছিল, সেই কোণটা থেকে পাবলিক টয়লেটের গন্ধ ভেসে আসতে লাগল ঝিলিকের নাকে। নিয়মিত সংসার-খরচ থেকে টাকা সরিয়ে দিয়েছে এই ছেলেটাকে, বরের কাছে বান্ধবীর বাবা অসুস্থ, মামাতো দাদার ছেলের জ্বর… এই সব মিথ্যে বলে থোক টাকা চেয়ে ওকে দিয়েছে। রিস্ট ওয়াচ, মোবাইল ফোন… কিছু না কিছু জুগিয়েই গেছে। সবটা পারিশ্রমিক নয়, মনের কোণে কিছু একটা জন্মেছিল বলেই তো! একটা দু-তিন মিনিটের ভিডিও ঝুপ করে চারদিকে কেমন নৈঃশব্দ্য ডেকে আনল। একটা নিঝুম অন্ধকার!

ঝিলিক নেহাৎ অল্পবয়সের ভুল করার মত যুবতী নয়। সত্যি বলতে চয়নের থেকেও দু বছরের বড়… বাবা বয়সটা কায়দা করে কমিয়ে রেখেছে জায়গামত। চন্দনের সঙ্গে বিয়ের আগেও বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে বোলপুর, বকখালি, দীঘার… কোনও না কোনও লজে রাত কাটিয়েছে। একরকম দুঃখই হত, বিয়ের পর সেই সময়গুলো আর ফিরে আসবে না বলে। সেই রোমাঞ্চ, এক একটা অভিযানের মত। ছেলেগুলোর চোখ দেখে বোঝা যেত বিয়ে করার ইচ্ছে নেই, যা পাওয়ার পেয়ে গেছে। ঝিলিকও নিজের হিসেবে স্পষ্ট থাকত। সতী সাজত না, মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে প্রত্যাশার ভিখিরিও হত না। গর্ভনিরোধক, কন্ডোম আর কোনওরকম চালাকির ব্যাপারে একটা আলাদাই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করত। হাসিখুশি মুখে সেই হিসেবের রেখা আনতে না দিলেও… নিজেকে ঠিক সাবধানে রাখত। কাঁদো কাঁদো মুখ করে গাধাগুলোকে দিয়ে যখন যা করার করিয়েও নিত। এখনও ফোন করে কিছু ফেভার চাইলে ঠিক ব্যবস্থা করে দেবে… বিনিময়ে কিছুই লাগবে না। ‘গুড উইল’ এমন এক জিনিস, সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সেই গুডউইলের কোনও দাম দিল না ইউসুফ। এমন ভিডিওর একটাই মানে… ইঙ্গিত যে এমন আরও আছে, আরও লম্বা আছে— শরীর চাইলে শরীর, টাকা চাইলে টাকা, অন্য কিছু ধান্দা থাকলে অন্য কিছু… না বলা যাবে না। ব্ল্যাকমেইল।

মনের কোণে লুকনো একটা কথা, আর একটা চড়— কত কিছু বদলে দেয়!

ভিডিওটা আর মেসেজের স্ক্রিনশট মেমরি কার্ডে তুলে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ডিলিট করে দিল ঝিলিক। হোয়াটসঅ্যাপের নম্বরটা বদলে অন্য নম্বর করে নিল। ও জানে, এই সব ছেলে মেসেজে কিছু বলবে না, নোংরামো করাবে অন্য কাউকে দিয়ে। যা দাবি, যা ব্ল্যাকমেইল… ফোনে করবে, তাও অন্য নম্বর বা ল্যান্ডলাইন থেকে… প্রমাণ কমই রাখবে।

আর কোনওভাবেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করল না ঝিলিক। মনের মধ্যে অস্বস্তিটা কাটানোর চেষ্টা করতে করতেই ব্যাগ গুছাল, চয়নকে একটা ফোন করে চলে গেল বাপের বাড়ি। নতুন হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে কোনও ছবি বা ভিডিও এল না। তবে অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল প্রত্যাশামতই। ইউসুফ না, অন্য কারও গলা… বউদি… ও বউদি… দাদা বাড়ি আছে? সুর করে করে বলে কেটে দিল। ছেলেটা রাতারাতি এতটা শত্রুতা কেন করছে? ভাবলেও কেমন গা ঘিনঘিন করছে। নিজে কীভাবে এই ছেলের প্রতি দুর্বল হয়ে উঠেছিল… সেই ভেবে নিজের গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারতে ইচ্ছে করে ঝিলিকের। একটা সামান্য ইলেকট্রিকের মিস্তিরি, তিন-চারবার কাজ করতে এসেছিল বাড়িতে, চয়নকে দাদা দাদা করত। নিজের চেনা-জানা ছেলেদের দিয়ে গ্রিলের কাজ, কেবল টিভির লাইন, এটা-সেটা কাজে সুবিধে করে দিত। হালকা বাদামি চোখের তারা, টিয়াপাখির মতো নাক, গায়ের রং খোলতাই বলে কপাল অবধি নেমে আসা চুলটাও হাল্কা লাল রং করা। চয়নের থেকে ঝিলিককেই দেখত বেশি… চা খাওয়ার আবদার বাড়তে বাড়তে অন্য মাত্রায় চলে গেল। এখন ঝিলিকের মনে হচ্ছে, এই ছেলেটা ওর বিয়ের আগে পরিচিত ছেলেগুলোর মত না। সস্তা ছোটলোক টাইপ… ভালমানুষির মুখোশ পরে থাকত। জাতের দোষ!

অন্য কারও হাতে ফোন দিতেও ভরসা পায় না। এইসব ফোন অন্য কেউ তুললে কেলেঙ্কারি হবে। এমনিতেই ঝিলিকের আগের কিছু কথা বাড়ির লোকের কানে কিছু মিচকে হারামজাদা কানা-ঘুষো পৌঁছে দিত। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর বাবা-মার মনে যে শান্তিটা এসেছে… একেবারে জাহান্নমে যাবে। দু-কূলই বিষ হয়ে যাবে ঝিলিকের।

দুদিন পর আবার বউদির খোঁজ করে ফোন এল, কথার মাঝে ঝিলিক একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে একটানা বলে দিল— জানোয়ারটাকে ফোন দে, না হলে জানোয়ারটাকে ফোন করতে বল। এরপর ফোন করে এসব বললে পুলিশে যাব।

ফোনটা কেটে গেল ওপাশ থেকে।

***

 

বাপের বাড়িতে দিন পনেরো ছিল ঝিলিক, বাকি কটা দিন কেউ আর বউদির খোঁজ করেনি। ইউসুফও কোনও ফোন করেনি। এমনকি চয়নও খুব একটা খোঁজখবর নিত না, ঝিলিক দুদিন ফোন করলে, চয়ন একবার ফোন করত। ওই পনেরোদিন মাত্র চারবার ফোন করেছে চয়ন, তাও দু-একটা কথা বলে রেখে দিয়েছে। চয়ন কেন হঠাৎ করে ঝিলিকের ব্যাপারে এত নিঃস্পৃহ হয়ে গেল, বুঝতে পারল না ঝিলিক। আগে তো রোজ ফোন করত কাছে না থাকলে… রাতে আপ্রাণ চেষ্টা করত নতুনভাবে খুশি করার। কী হল হঠাৎ চয়নের? অফিসের কোনও সমস্যা… চেপে যাচ্ছে? নাকি একটা ছোট্ট ভিডিও ওর কাছেও পৌঁছে দিয়েছে ইউসুফ? ভাবতেই মাথাটা অজানা আশঙ্কায় ঝিমঝিম করে উঠল ঝিলিকের। কানে চিঁ-ই-ই করে একটা লম্বা ঝিঁঝিঁ ডাকা শুরু হয়ে গেল। ইউসুফ নিজে তো ফাঁসবে না, ভিডিওতে পুরুষকে চেনা যাচ্ছে না… শুধু ঝিলিকের হাসি আর শরীর ঝিলিক দিচ্ছে। ঠিক যেমন দেখা যায়… পুরুষ দর্শক পুরুষকে নিয়ে আগ্রহী হয় না।

এইভাবে চড়ের বদলা নিল ইউসুফ? ঝিলিককে বেশ্যা সাজিয়ে দিল চয়নের কাছে? কী করবে চয়ন? জানতে পারলেই বা কী করার ক্ষমতা আছে ওর? কাকে বলবে? শ্বশুরকে বলবে? আপনার মেয়ে মিস্তিরির সঙ্গে শোয়? দমই নেই! নিজেই তো লজ্জায় ডুবে যাবে। দুর্বল মধ্যবিত্ত ভদ্দরলোক… তার ওপর ঝাঁটের আত্মসম্মানবোধ। প্রতিবেশীদের কাছে বউয়ের থেকে বেশি নিজের মুখ-কালি হওয়ার ভয় বেশি থাকে এদের। কেউ দেয় এদের? লোকলজ্জার ভয়ে মরমে মরে থাকবে… পাড়া ছেড়ে পালাবে অন্য কোথাও। তাতেও ঝিলিকেরই সুবিধে। কিন্তু যদি হুট করে কিছু একটা করে বসে? বলা তো যায় না, কিছু খেয়ে নিল, বা কোথাও ঝাঁপ দিল… স্যুইসাইড নোট-ফোট…

ঝিলিক একটু একটু করে নিজেকে বোঝাতে বোঝাতে স্বাভাবিক হত, কিন্তু স্যুইসাইড বা হঠাৎ কিছু আকস্মিক ঘটে যাওয়ার কথা ভাবলে আবার কান-মাথার ভেতর চিঁ-ই-ই করে উঠত ঝিঁঝিঁর ডাক। চয়ন স্পষ্ট করে কিছু বলে না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকভাবে সমস্যার কথা জানতে চেয়েছে, স্বাভাবিক হতে চেয়েছে… চয়ন হালকা হাসে, স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে… কিন্তু একটা প্রচ্ছন্ন দূরত্ব থেকেই যায়। পছন্দের খাবার, সোহাগের চুমু, পুরনো কথা— চিঁড়ে ভেজেনি কিছুতেই। কোনও কথাও বার করতে পারেনি। লুকিয়ে চয়নের মোবাইল-ফোন ঘাঁটে, জিনিসপত্র, কাগজপত্র ঘাঁটে। বোঝার চেষ্টা করে— চয়ন মনে মনে ঘৃণা করছে কি না, ঝিলিককে প্যাঁচে ফেলার ফন্দি আঁটছে কি না।

দেখতে মেনিমুখো, কিন্তু ভিডিও পেয়ে সাজিয়ে রেখে দেবে… এত বোকাও না। এইসব ছেলেরা মিটমিটে শয়তান হয়।

এত কিছুর পরেও মায়ের উপদেশগুলো মাঝে মাঝে মনে পড়ে—

–সোয়ামির ঘর, বিয়ের পর মাথার ছাদ। ভেতরে যা-ই থাকুক, বাইরে কিছু কিছু জিনিস সাজিয়ে-গুছিয়ে ঠিক রাখতে হয়। বাইরের ঘরটা অতিথি দেখবে, শোওয়ার ঘরে যা-ই ঘটুক… যেন বাইরের ঘরে না আসে।

ঝিলিক বাইরের ঘরটা সামলে রাখার চেষ্টা করে। শোওয়ার ঘরটাও উষ্ণ রাখার চেষ্টা করে… যাকে বলে ‘পেসিফাই’ করার চেষ্টা। হঠাৎ করেই, বাপের বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকে ঝিলিকের সব কিছুই চয়নের পছন্দমত হয়ে গেছে। যা এত বছরেও ছিল না… থাকলেও আংশিক এবং সাময়িকভাবে। চয়ন মনে মনে হাসে, নিজের চোখে দেখা দৃশ্যগুলো ভুলতেও পারে না। আবার সরাসরি বোঝাতেও চায় না— তোমাদের চুরি আমি ধরে ফেলেছি অনেক আগেই।

শনিবার চয়নের ছুটি থাকে। ঝিলিক ওর পছন্দমত ফ্রায়েড রাইস আর মটন কষা করল। যতটা মাংস থেকে গেল, তার সঙ্গে রাতে হল ধবধবে সাদা ময়দার লুচি। মুখে হাতে সুগন্ধী ময়েশ্চারাইজার মেখে, ইচ্ছে করেই একটা হালকা সুতির শাড়ি পরে শুল ঝিলিক। পাশ ফিরে শুয়ে থাকা তন্দ্রাগ্রস্ত চয়নকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে জড়ানো জড়ানো আবদারের গলায় বলল— এবার আমার একটা বেবি চাই। আর একা থাকতে ভালো লাগে না!

এও একপ্রকার পছন্দের খাবার সাজিয়ে দেওয়া, নতুন করে রান্না… সুন্দর করে পরিবেশন। চয়ন খেতে খেতে তারিফ করল, খাওয়া শেষে মাথার পেছনে হাত রেখে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বলল— চার ইঞ্চি মানে খুব ছোটও নয়… বলো?

***

 

ঘরটা দেখেই বোঝা যায় একটা ঝড় বয়ে গেছে। জামা, কাপড়, অন্তর্বাস… সব ছড়িয়ে। যেভাবে নির্মোক হওয়ার আগে একে একে খসে পড়ে। অথচ ঝড় না… রীতিমত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হওয়ার কথা। লাল ধুলো উড়ছিল প্রাঙ্গণে, জমে ছিল লাল মেঘ। কিন্তু শেষমেশ ধস্তাধস্তি হলেও… খুনোখুনিটা হল না। প্রায় দেড় মাস পর ইউসুফকে এভাবে সোজা দরজার সামনে দেখে চমকে উঠেছিল ঝিলিক। রাগে, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছিল। এই সময়তেই আসত আগে… ইউসুফ জানে কোন সময়, কোন দিন নিরাপদ। কিন্তু এত কিছু করার পর স্পর্ধা হয় কী করে? ভয় করল না? লজ্জা করল না?

সোজা মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল ঝিলিক। কিন্তু ইউসুফ ইচ্ছে করেই এমন জোর-গলায় কাকুতিমিনতির নাটক করল… পাশের বাড়ির লোক শুনিয়ে। ঝিলিক জানলা দিয়ে দেখল এক বাড়ির মাসিমা, আর এক বাড়ির বউদি… কেউ জানলায়, কেউ বারান্দায়… বেরিয়ে আসছে এক এক করে। দরজা খুলে ঢুকিয়ে নিল ইউসুফকে। প্রতিবেশীরা কান পেতে কিছু হয়ত শুনতে পেয়েছে ঘরের ভেতর থেকেও… বা তেমন কিছু পায়নি। ইউসুফের হাতে তো সবসময়েই একটা ব্যাগ থাকে, তার যন্ত্রপাতি উঁকি দেয়। দুপুর করে ইলেকট্রিকের মিস্তিরি আসে মাঝে মাঝে… একেবারেই কি কারও চোখে পড়েনি এতদিনে?

কিন্তু তুমুল কিছু হল না। ঝাপসা কথাকাটাকাটির পর কেমন চুপ হয়ে গেল। মিউজিক সিস্টেমে গানের শব্দ ছাড়া আর কিছ শোনা গেল না। চয়নের বউয়ের এই এক স্বভাব, মাঝে মাঝেই দুপুরের বেলা জোরে টিভি, না হলে মিউজিক সিস্টেম চালিয়ে দেয়। অথচ বর বাড়ি থাকলে এসব করার সাহস পায় না— এটাও অনেকে লক্ষ করেছে।

–চোরের মতো ভিডিও করে… তার আবার লেকচার… ছিঃ!
–…
–আর কটা বানিয়ে রেখেছিস? দোস্তদের দেখাস, তাই না? আপলোড করে দিয়েছিস তো? গায়ের জ্বালা মিটেছে?
–আল্লাহ কসম, জিভ খসে যাবে যদি কোনও ভিডিও আপলোড করে থাকি। তিনদিনে মরে যাব বাঁড়া। তোর গা ছুঁয়ে বলছি… কোনওদিন একটা ভিডিও কাউকে দেখাইনি।
–আবার এই মুখে আল্লার কসম খাচ্ছিস? আল্লার আর কিছু জানতে বাকি আছে?
–…
–অন্য ছেলেদের দিয়ে ফোন করিয়ে অপমান করলি? তোর কী ক্ষতি করেছি আমি? কী দিইনি তোকে? এভাবে লাইনের মেয়ে বানিয়ে ছাড়লি সবার কাছে? এত খারাপ আমি?
–তোর গা ছুঁয়ে বলছি… মা কসম… আম্মি মরে যাবে আমার… আমি কোনও ছেলেকে তোর নম্বর দিইনি। তোকে ফোন করতে বলিনি! কী করে ইয়াকিন করাই… কোন নম্বর দিয়ে ফোন এসেছে… দিখা তুই, কোন নম্বর?
–মিথ্যেবাদী তো তুই… নম্বর দেখে বলবি চিনিস না। নাটক করছিস কেন? ফোন ভর্তি ভিডিও করেছিস চোরের মত… জিজ্ঞেস করেছিলি? জানিস না এভাবে চোরের মত ভিডিও করা ক্রাইম?
–সির্ফ দু-তিনটে আছে, তাও শুরুর দিকের। সব ডিলিট করে দিচ্ছি… এই দেখ তোর সামনেই ডিলিট করে দিচ্ছি।
–কর… এখনই ডিলিট কর। আর কী আছে দেখি?

ইউসুফ মাথা নিচু করে ফোনটা এগিয়ে দিল ঝিলিকের দিকে। এক কথাতেই স্বীকার করেছিল, রাগের মাথায় ইচ্ছে করে অন্য নম্বর থেকে ভিডিওটা পাঠিয়েছিল, যাতে ঝিলিক ভয় পায়, ইউসুফকে হালকাভাবে না নেয়… একরকম প্রতিশোধের ইচ্ছে থেকেই করেছিল… তাও নেশার ঘোরে। এর কতটা ঝিলিক বিশ্বাস করেছে, তা ঝিলিকের মনই জানে। কিন্তু নিজেকে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। কী যেন একটা হয়ে গেল— ইউসুফ দুটো রুক্ষ হাতের আঙুল কাঁধে চেপে ধরে হঠাৎ এতদিন পর জোর করে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চুমু খেতেই। ইউসুফের মত জোর করতে, গায়ের জোর খাটাতে কোনও পুরুষকেই দেখেনি ঝিলিক। দুটো থাই হাত দিয়ে চেপে ফাঁক করে যখন মুখ ঢুকিয়ে জিভে ঝড় তোলে… পাগল করে দেয়! জঙ্ঘায় আঙুলের দাগ পড়ে যায়, ব্যথা থাকে। তবে মনের সুখ মুখে প্রকাশ করে না ঝিলিক। অকৃতজ্ঞের মতই ভর্ৎসনা করে। প্রচ্ছন্নভাবে বুঝিয়েও দেয়… ইউসুফের জায়গাটা অতটাও ওপরে নয়।

ইউসুফ অপরাধীর মতই মাথা নীচু করে ফোনটা দিয়ে দিল। ঝিলিক নিজে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব ছবি ডিলিট করল। যেগুলো ডিলিট না করলেও চলে, সেগুলোও ছাড়ল না। কিন্তু ইউসুফ ফোন করে বিরক্ত করার ব্যাপারটা কিছুতেই স্বীকার করল না। একইভাবে প্রবল আপত্তির সঙ্গে অস্বীকার করে গেল… কখনও আম্মি, কখনও আল্লাহ, কখনও নিজের জুবান আর জানের কসম খেয়ে। বলল, ঐ ঝামেলার পর ও শহরে ছিলই না,  বেগুসরাইতে কে একজন চাচার খানদানের মারা গেছে। বিমারির ইলাজে টাকা গেছে অনেক, লোকজন কান্নাকাটি করছে। সেই সব সামলাতে এতদিন ওখানেই ছিল। সামলানো মানে একসঙ্গে রিশতেদারের দুখ-দরদ ভাগ করা… আর্থিক সামর্থ্য আর কতটা? এইসব শুনে ঝিলিকের কখনও মনে হয় সবটাই সাজানো… কখনও মনে হয় কিছুটা সত্যি। শেষমেশ ঝিলিককে কোনওভাবেই ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেনি ইউসুফ। ঠিক কী হল ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না, ইউসুফের আদর খেতে খেতেও অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল ঝিলিক। ইউসুফ বুঝতে পারছিল না, অন্যদিনের মত কেন সাড়া আসছে না। যৌনদাসের মত চেষ্টা করছিল সন্তুষ্ট করার, যাতে গোলামের কসুর মাফ করে দেয় ঝিলিক।

ইউসুফ চলে যাওয়ার পর ঝিলিকের এই প্রথম মনে হল, কোনওভাবে জড়িয়ে পড়েছে ও। আর এটা ওর জন্য ঠিক নয়। ঝিলিকের অপমানিত হওয়ার কথা। এভাবে লুকিয়ে যে ভিডিও করে, সে ছোটলোকের বাচ্চাই থাকে। সেই ছোটলোককেই আবার এতটা প্রশ্রয় দিল। কেমন ভেসে গেল মিনিট পনেরো সামান্য ডিফেন্ড করার পরেই। কামের নেশা কি এমনই হয়? লাস্ট ফর প্যাশন?

–চয়ন কেন… কোনও স্বামীই পারবে না, যদি এইরকমই আত্মমর্যাদাহীন চাহিদা থাকে।

কথাগুলো শুনে চমকে উঠল ঝিলিক। ঘরে একা আছে। টিভিও চলছে না, অথচ ওরই মত গলায় আয়নার সামনে দাঁড়ানো উলঙ্গ ঝিলিক যেন কথাগুলো শুনিয়ে দিল।

নিজেকে আয়নায় উলঙ্গ দেখে চমকে উঠে বুকের ওপর তোয়ালেটা নিল, তারপর বাথরুমের দিকে পা বাড়াল ঝিলিক। কিন্তু বাথরুমে ঢুকে কলটা খুলেও স্নান করা হল না। ফোনটা বেজে যাচ্ছে। একবার-দু-বার তিনবার কেউ লাগাতার ফোন করে গেল। শেষে বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করে ঝিলিক জানতে পারল—

অফিসে, ফোনে কথা বলতে বলতে চয়ন সেন্সলেস হয়ে গেছিল। এখন সেন্স এলেও খুব দুর্বল, ঠিক করে কথাও বলতে পারছে না। ব্লাড প্রেসার ফল করেছে, না মাইল্ড স্ট্রোক বোঝা যাচ্ছে না। অজ্ঞান হয়ে পড়ার সময়ে মাথাটা টেবিলের কোণে ঠোকা লেগেছে, ডাক্তার বলেছে একটা সিটি স্ক্যান করে নিতে। ঝিলিকের পারমিশন নিয়ে কলিগরাই নিয়ে যাবে সিটি স্ক্যান করাতে, না ঝিলিক আসবে… সেটা জানার জন্যই ফোন করা।

ঝিলিকের মুখ আর কান হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠল ফোনে কথাগুলো শুনতে শুনতে। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে শুরু করল। কানের ভেতর ওই চিঁ-ই-ই শব্দটা ঝিঁঝিঁ ডাকের মত আবার শুরু হয়ে গেল। আশঙ্কাটা ঠিক কার জন্য, বুঝতে পারছিল না ঝিলিক। চয়নের ফোন প্যাটার্ন লক করা, অফিসের কেউ জানতে পারবে না কিছু। কিন্তু চয়ন আবার দেখার আগে ঝিলিককে তো জানতে হবে!

বাথরুমের কলটা বন্ধ করে চটপট পোশাক পরে বেরিয়ে গেল ঝিলিক। যেভাবে পারে, যত দ্রুত সম্ভব… চয়নের কাছে যেতে হবে।

চয়নের প্যাটার্ন লক ঝিলিকের চেনা। ফোনটা সকলের চোখের আড়ালে খুলতেও সমস্যা হল না। লাস্ট কল রিসিভডের নম্বর অচেনা। কিন্ত সেই নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ভিডিও দুটো অচেনা নয়। একেবারে অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে নেওয়া ইউসুফ আর ঝিলিকের ভিডিও। দুজনেই খুব স্পষ্ট, দুজনের কামকেলি আরও রসালো লাগছে। অথচ এই ভিডিও দুটো ইউসুফের ফোনে ছিল না। ইউসুফ তাহলে ডাহা মিথ্যে কথা বলল? আরও ভিডিও আছে? গেম খেলছে আমার সঙ্গে?

এখন ডিলিট করে আর লাভ নেই, অন্যভাবে ব্যাপারটা সামলাতে হবে। চুপচাপ ফোনটা লক করে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল ঝিলিক। আবার চোখের জল রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে নাকের জল টেনে বলল— সিরিয়াস কিছু হয়নি বলুন… ভয়ের কিছু নেই… তাই না?

***

 

ঠিক কী হয়েছিল, কেন ওভাবে ব্ল্যাক আউট হয়ে গেল… বোঝা গেল না। রিপোর্টগুলো নর্মাল। কিন্তু চয়নের কথাবার্তা স্বাভাবিক হচ্ছে না। হাঁটতে গিয়ে পা টলে যাচ্ছে। ডাক্তাররা বলল কদিন বিশ্রাম নিতে, আর নিয়ম মেনে চলতে… আরও কিছু টেস্ট করানো দরকার। লক্ষণগুলো অনেকটা মাইল্ড স্ট্রোকের মত। বাঁ হাতটা খুব একটা সচল না, বাঁ-পাটাই সমস্যা করছে চলার সময়ে… তবে একেবারে অসাড় নয়।

শক? আকস্মিক কোনও ঘটনার প্রভাব? নাকি অনেকদিন ধরে মনে মনে গুমড়ে…

চারপাশের লোকজনের মধ্যে কিছু না কিছু কথা, কিছু না কিছু চিন্তা থাকেই। অসঙ্গতি দেখলে, তার নেপথ্যে থাকা কারণ খোঁজা মানুষের এক সহজাত প্রবণতা। প্রিকনসিভড কিছু ব্যাপার, ধারণা… সেখানে দুইয়ে দুইয়ে চার করিয়ে নেয় নিজের মত।

চব্বিশ ঘন্টা অবজার্ভেশনে থাকার পর চয়নকে ডিসচার্জ করে দিল নার্সিংহোম। ঝিলিক একরকম জোর করেই ডিসচার্জ করিয়ে নিল চয়নের সহকর্মীদের সাহায্যে। নার্সিংহোমে রাখা মানে টাকার শ্রাদ্ধ। আপাতত ঘরে ফেরা বেশি জরুরি।

নার্সিংহোম থেকে ফেরার পর ফোন বা ভিডিও প্রসঙ্গে কীভাবে চয়নের সঙ্গে কথা বলবে বুঝতে পারত না ঝিলিক। ও তো সবই জেনে গেছে! কী বলব? ক্ষমা চাইব? এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলব? ডিভোর্স দিতে বলব আমাকে? শাস্তি দিতে বলব?— ভয়ে না, একরকম অনিশ্চয়তায় বুক কাঁপত। হিসেব থেকে বেরোতে পারত না।

হুইলচেয়ার বা ওয়াকার আনার আর দরকার হয়নি, প্রথম দু-তিনদিনের প্রতিকূলতা কাটিয়ে চয়ন নিজে নিজেই দেওয়াল আর টেবিল ধরে যাওয়া-আসা করতে শুরু করল। খেতে দিলে খেত, কিন্তু কথা বলতে গেলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকত। বাড়ির বাইরেও বেরোতে চাইত না। হাঁটাচলাটা ছন্দে ফিরে আসার পর একদিন রাতে বিছানা করার সময়ে নিজেই বলে উঠল— আমি বাইরের ঘরটায় শুচ্ছি।

–কেন?
–এই ঘরটায় দমবন্ধ লাগছে।
–এতদিন তো লাগেনি দমবন্ধ?
–এতদিন…
–কী? এতদিন কী?
–এতদিন… এটা একটা সংসার মনে হত।

ঝিলিক প্রথমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। তারপর ইউসুফের ব্যাপারে সরাসরি স্বীকার করে নিল সব দোষ। পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইল। যেমন যেমনভাবে নিজেকে দোষী বলে শাস্তির যাচ্ঞা করা যায়… এক এক করে করতে থাকল—

–ছেড়ে দাও… আমরা অন্য কোথাও চলে যাই, ভিডিওগুলো জালি… আজকাল সব কম্পিউটারে করা যায়, ইউসুফ বা ওদের কেউ আমাদের ফাঁসাতে চাইছে… ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছে, আমি চলে যাব বাপির কাছে, ডিভোর্স দিয়ে দাও, ইউসুফ একটা ক্রিমিনাল… বুঝতে পারিনি, আমাকে বশ করে ফেলেছিল, ওরা সব পারে… আমি ভয়ে ‘না’ করতে পারিনি, তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছিল… সাংঘাতিক ক্ষতি!

চয়ন সবই শুনল, পালটা যুক্তিও দিল না। তর্ক বা দোষারোপও করল না। নিজেকে ঠিক প্রমাণের তো কোনও চেষ্টাই না। শুধু বলল— সব ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি, ইউসুফকেও কেউ না কেউ আসতে দেখেছে, এখন এইসব আলোচনাও শুনছে। এগুলো কি সত্যিই আমি ডিজার্ভ করি?

ঝিলিক মাঝে মাঝে গুম খেয়ে একেবারে চুপ করে যাচ্ছিল… মাঝে মাঝে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল… যতটা বলে হালকা হওয়া যায়। চয়ন একটা চাদর আর একটা বালিশ নিয়ে বাঁ-পাটা সামান্য টেনে টেনে বাইরের ঘরে চলে গেল। তারপর আলোটা নিভিয়ে দিল। ঝিলিক তখনও শোয়ার ঘরের আলো জ্বালিয়ে বসে রইল। কিছু না কিছু বলে যাচ্ছে, চুপ করছে না দেখে অনেকক্ষণ পরে চয়ন আবার বলল— ঘরটা দেখে তো চেনাই যাচ্ছে… এর চেয়ে শুরুতেই বলে দিতে, এত লুকোচুরি করতে হত না। অবশ্য ইউসুফের মত ছেলের ভরসায় কি আর নিজের ফিউচার প্ল্যান করা যায়?

শেষের কথাগুলোর শ্লেষের সঙ্গে একটা হাসি বেরিয়ে এল নাক দিয়ে। তারপর পাশ ফিরে চোখটা বন্ধ করে নিল চয়ন। একটা হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধ রাতে খেতে হয়, তার একটা প্রভাব আছে।

***

 

–ভিডিওটা আমি পাঠাইনি…
–কাউকে দিয়ে পাঠিয়েছিস, একই ব্যাপার। আর কত ক্ষতি করবি? কেন করছিস এগুলো?
–আরে বাঁড়া… এই ভিডিওটা আমি তুলিইনি! আমার কাছে এটা ছিলই না… কী করে পাঠাব!
–তাহলে কে তুলল? কে পাঠাল… অ্যাঁ! কোথায় সেট করে রাখতি ফোনটা… কী ঠান্ডা মাথায় করে গেছিস এইসব! এখন বুঝতে পারছি… যারা এগুলো করে, কী কায়দায় করে!
–তোর বোঝা, তোর জানা… তোর কাছে। আমি করিনি— যতবার জিজ্ঞেস করবি… এটাই বলে যাব।
–ফাঁসিয়ে দিয়েছিস আমাকে। চিরকালের মত বাঁশ দিয়ে দিয়েছিস! মিউচুয়াল ডিভোর্স ছাড়া কোনও রাস্তা খোলা রাখিসনি আর!
–আমি নিজে ফাঁসলাম না? আমাকেও তো দেখা যাচ্ছে!
–তোর আর কী! রেপ তো নয়, আমি ডেকেছি… তুই এসেছিস। কনসেনসুয়াল।
–কী?
–অত বুঝতে হবে না… কী করে যে কেটে বেরোব সেই ভাবছি।
–ওকে ছেড়ে দে না… মাহরুফ ভাইকে বলে ভালো অ্যারেঞ্জমেন্ট করে দেব, বাগুইআটির ওদিকে টু-বিএইচকে ফ্ল্যাট।
–ফ্ল্যাটের টাকা কে দেবে? তোর আব্বা?
–…
–তোর মত থার্ড ক্লাস ছেলেকে মাথায় তুলেই ভুল করেছিলাম… এখন টের পাচ্ছি।
–…
–কিন্তু এই মিচকে লোকটাকেও আর নেওয়া যাচ্ছে না। রুগী সেজে সেজে সাতদিন ঘরে পড়ে রইল, এখন ইচ্ছে করে দেরি করে বেরোয়। একদিন যায় তো দুদিন যায় না। আর খালি ঠুকে ঠুকে কথা! সব কথায় বাঁকা বাঁকা উত্তর! সুযোগ পেয়েছে না? জন্মলাথখোর সুযোগ পেলে সেটা আর ছাড়ে না। কচলেই যাবে। বার করছি কচলানো!
–সব কিছু বুঝেই যখন গেছে…
–বুঝেই যখন গেছে… মালটা গেম খেলছে বুঝলি?
–মানে?
–এসব অসুখ-টসুখ সব ঢপ। কিছু একটা চলছে ওর মাথায়।
–ডাক্তার-টাক্তার দেখছে বললি তো। দাওয়াইগুলোও কি ঢপ নাকি?
–অত জানি না, কিছু একটা ঘাপলা আছে। জানে তো কিছু করতে পারবে না… অন্যভাবে বাঁশ দিতে চাইছে। ওয়েব সিরিজ দেখা বুদ্ধি মারাচ্ছে মিচকেচোদা।
–ওয়েব সিরিজ?… হ্যাট, চয়নদা বোকাচোদা মার্কা লোক। অনেকদিন ধরে চিনি। এত প্যাঁচ ওর আসবে না। হেগে দেবে।
–আমিও তাই ভাবতাম, কিন্তু কেন জানি না অন্যরকম লাগছে…
–ওখানে তাহলে আর থাকিস না, বুঝলি। রিস্ক হয়ে যাবে।
–রিস্কটাই কাজে লাগাতে হবে, ঘুরিয়ে দিতে হবে ওর দিকে… হাতটা ওখান থেকে সরা, যেটা বলছি শোন…

চয়ন অনিয়মিতভাবে অফিস যায়, বেরোয়ও দেরিতে। হয়ত ছেড়েও দিতে পারে এই কাজ। ইউসুফকে আর বাড়িতে আসতে বলা সম্ভবই না, চয়নের সঙ্গে কয়েকদিন লাগাতার চাপানউতোর চলার পর বাপের বাড়ি গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে ঝিলিক। বাপের বাড়ি জানে অসুখ করেছিল, এখন ঠিক আছে। এর বেশি কিছু জানে না। সেই বাপের বাড়ি থেকেই ইউসুফের সঙ্গে পার্ক সার্কাসের একটা হোটেলে দেখা করতে আসা। ইউসুফের পরিচিত, অসুবিধে হয়নি। ইউসুফের থেকেও ঝিলিকের দায়টা বেশি। নিজেকে এইসব কিছু থেকে মুক্ত করার দায়… বদনাম, সন্দেহ আর শেকল। চয়নের সঙ্গে থাকতে এমনিতেই ভাল লাগত না, বাচ্চা নিতেও ভাল লাগত না… এই মধ্যবিত্ত জীবনের ঘষটানিও ভাল লাগত না। কিন্তু ইউসুফ বিকল্প নয়, অন্য কেউ একটু হাই স্ট্যান্ডার্ডের হলে হয়ত সেইরকম কিছু ভাবা যেত। চয়নকে এক কথায় ছেড়ে চলেও যেতে পারছে না… চয়ন চায় ও সবার সামনে দোষ স্বীকার করুক। আজ নয় কাল চয়নই হয়ত বাড়িতে জানিয়ে প্রতিশোধ নেবে। একেবারে জানিয়ে দিলে একটা বড়সড় অশান্তি করে ব্যাপারটা মিটে যায়, চলে যাবে অন্য কোথাও। কিন্তু তা করবে না… এই জানিয়ে দেওয়ার ভয়টাকে ব্যবহার করে দগ্ধাবে, মজা নেবে। ঝিলিকও চলে যাবে বলেই ঠিক করে নিয়েছে, তবে এমনি এমনি না।

হোটেলের বিছানায় ইউসুফের পৌরুষে আঙুল বোলাতে বোলাতে ইউসুফের কীসে ভালো হয়, কীসে লাভ হয়… আর দুজনের জন্যই কোনটা দারুণ ব্যবস্থা হতে পারে… বুঝিয়ে দিল ঝিলিক। ইন্সিওরেন্স, প্রভিডেন্ট ফান্ড আর ব্যাঙ্কের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের ব্যাপারটা একটু কম কম করে বলল… যাতে ইউসুফের লোভ বেড়ে না যায়। আত্মহত্যা হলে হবে না… ঝামেলা বেড়ে যাবে। কিন্তু আকস্মিকভাবে ন্যচারাল ডেথ বা দুর্ঘটনায় চয়ন মারা গেলে যে একটা লটারি লাগার মত ব্যাপার… এই হিসেবটা স্পষ্ট করে দিল। শুধু চয়ন না, তিনজনেই মুক্তি পেয়ে যাবে। মরা মানুষ তো টাকা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না!

ইউসুফ বোকার মত তাকিয়ে ছিল ঝিলিকের দিকে। বুঝতে পারছিল না ঠিক শুনছে কি না। ছিনাল মনে মনে খসমকেই হালাল করার প্ল্যান করে রেখেছে?

মাসুদচাচাকে চোখের সামনে মেরে দিয়ে চলে গেছিল প্রোমোটারের পোষা গুন্ডারা। দাড়িতে মেহন্দি লাগাচ্ছিল চাচা, পেছন থেকে এসে ক্ষুর দিয়ে এক টানে…

প্রোমোটারের মিস্ত্রিরা মার খেল, কাজ বন্ধ হয়ে গেল। পুলিশ এল, এমএলএ এল, মাইনরিটি ফোরামের লোকজন এল। স্রেফ সাক্ষী হয়ে গেছিল বলে ভয়ে ইউসুফ বেগুসরাই পালিয়ে গেল, তিন মাস ওখানে ছিল… তারপর এল, তাও অন্য এরিয়ায় থাকত এক দোস্তের মেসে।

কারও জান নিয়ে নেওয়া ডাল-ভাত না। ঝিলিকের সম্ভাবনাময় পরিকল্পনা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল ইউসুফ। ঝিলিক হঠাৎ ইউসুফের অণ্ডকোষে জোরে টোকা মেরে বলল— কী? পারবি তো?

কী পারতে বলছে ইউসুফ শোনেনি ঠিক করে। ব্যথায় সামনে ঝুঁকে গিয়ে বলল— ডালভাত না হ্যায় কিসিকো হটা দেনা!

ঝিলিক কিছুক্ষণ ভেবে বলল— ডেথ সার্টিফিকেটে ন্যাচারাল ডেথ লিখে দেবে, এমন একটা ডাক্তার জোটাতে পারবি তো? নাকি সেটাও পারবি না?! কী বালের পার্টি করিস তোরা?

***

 

বেতাল পঞ্চবিংশতির একটা গল্প ছিল, তার শেষটা এমন—

–দেবী কাত্যায়নীর বরে মৃত স্বামী আর তার বন্ধু পুনরায় জীবন ফিরে পাবে জেনে বউয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল… সে বন্ধুর মাথা স্বামী দীনদাসের কাঁধে আর দীনদাসের মাথা বন্ধুর কাঁধে বসিয়ে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে দিল।

ব্যাপারটা ছোটোবেলা বুঝতে পারেনি চয়ন, পরে বুঝেছিল। এখন হঠাৎই বাইকে করে যেতে যেতে কথাগুলো মনে পড়ে হাসি পেয়ে গেল। যে কাজটা করতে এসেছে, সেটা চটপট করে এখান থেকে চলে যেতে হবে। যেমন বাইকের পেছনে বসে আসছে, সেভাবেই। যাতে হেলমেট খুলতে না হয়, তাই নিজস্ব হেলমেটেরও ব্যবস্থা করে রাখতে হয়েছে। এখন শুধু সকলের নজর বাঁচিয়ে পাঁচিলের ওপারে বাক্সটা ফেলা আর এখান থেকে দ্রুত সরে পড়া। শ্বশুরবাড়ির লোকজন ইমপ্রেসড হয়ে যাবে গিফট দেখে!

ঝিলিক আর ইউসুফকে ওভাবে দেখার পর থেকেই একটা মানসিক আর শারীরিক কষ্ট হত। তাও একবার না! চয়ন যেন চুতিয়া, এমন চালিয়ে যাওয়াই যায়! আজকাল পাবলিক বুথ কম… নেই বললেই চলে। লোকজনের থেকে ফোন চেয়ে জরুরি ফোন করার বাহানায় ফার্মাসি বা ডিলারদের ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করত। মুখে চিউইং গাম নিয়ে গলা বদলে দু-একবার ‘বউদি বউদি’ করতে অসুবিধে হয়নি। কদিন করে আর মজা পাচ্ছিল না, বন্ধ করে দিল। ঘরে আলমারির মাথায় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসিয়েছিল, যখন ঝিলিক বাপের বাড়ি গেছিল। কাজ হয়ে যেতেই সরিয়ে নিয়েছিল— ঝিলিক টেরই পায়নি। যা দেখার, যা শোনার সব জানা হয়ে গেছে দু-তিন দিনেই। বাক্সের ভেতরে সেসবও দিয়েছে পেনড্রাইভে। সারপ্রাইজ গিফট।

হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিওটা নিজেই নিজেকে পাঠিয়েছিল, একটা অন্য নম্বর থেকে। ইউসুফ করেছে বলেই ভাবল ঝিলিক। কিন্তু পাকা ঘুঁটি নষ্ট হল… বাহানা করতে পারল না। রুগী সেজে পড়ে রইল চয়ন, অকারণে ওষুধ খেয়ে শরীরের ওপর চাপ গেল… সে যাক। রোজ খেত না, অর্ধেক দিন হাতসাফাই করে দিত। ঝিলিক অত খেয়ালও রাখত না। বাকি, একটু সচেতন থাকলে আর একটু কায়দা করলেই পারা যায়। ধরা পড়ার পর ঘরে খুবই সাবধান হয়ে গেছিল ঝিলিক, তাই কায়দা করে বাপের বাড়ি পালাল। চয়ন জানত, ঝিলিককে শুধু ভয়ই দেখাতে পারবে, বিশেষ কিছু করতে পারবে না… যাকে বলে শিক্ষা দেওয়া। আর ইউসুফকে তো কিছুই করতে পারবে না। আইনের নিয়মে কোনও শাস্তি হবে না, বাড়ির লোকজনও নরম গরম কথার পর একসময়ে কাটিয়ে দেবে চয়নকে। বড় জোর ডিভোর্স। তাও এই গ্রাউন্ডে কিছু করতে গেলে আরও কেচ্ছা। বরং নিজেকেই খুব ভালনারেবল মনে হত মাঝে মাঝে। পালাতে ইচ্ছে করত সব ছেড়ে। বাইরে না ভাঙলেও, ভেতর ভেতর আর এই চাপ নেওয়া যাচ্ছিল না!

ঝিলিক একটু বেশি খাতির করলে বা মিষ্টি করে কথা বললেও ভয় হত। খুব সঙ্গত কারণেই ভয় হত। মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল চয়ন… এই ভয়ের কারণগুলোকে এক এক করে মেরামত করার।

এতদিন ধরে ফার্মাসি কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছে, ওষুধের ব্যাপার অল্পবিস্তর নিজেও জানে চয়ন। ঝিলিক নিজে থেকে কোনও ওষুধ দিতে এলে ইদানিং চয়ন আর খেত না। বলত— রেখে দাও, খেয়ে নিচ্ছি। ঝিলিক কখনও বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থাকত, কখনও মুখ ঘুরিয়ে চলে যেত। বরং নিজেই দিন বুঝে… খুব সাবধানে বাছাই করা অ্যানাস্থেটিক জোগাড় করে ঠিক বেকায়দায় ইনজেক্ট করে দিল ঝিলিকের ঘাড়ে। ঝিলিক বুঝতে পারল, কিন্তু কিছু করতে পারল না। চোখে অবিশ্বাস আর ভয় নিয়ে চয়নের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধপাস করে পড়ে গেল। দেখতে-শুনতে ঠিকই পারছিল, শুধু নড়তে পারছিল না।

–কী করতাম বলো? আমি না করলে, তুমি করতে… করতেই। তবে আর কিছুই পেতে না… একটা টাকাও পেতে না। সরিয়ে দিয়েছি সব— বলতে বলতে চয়ন আর একটা অ্যাম্পুলের দিকে হাত বাড়াল। অবিশ্বাসটা ক্রমে হতাশার দৃষ্টি হয়ে গেল, বোকার মতো ঠোঁটটা অল্প ফাঁক করে তাকিয়ে রইল ঝিলিক… অসহায়।

একটু দম নিয়ে আবার একটা সেডাটিভ পুশ করল চয়ন… যাতে দ্রুত জ্ঞান হারায়। তার পরেও শ্বাস-প্রশ্বাস চলছিল। একটু পরেই কলিংবেল, ইউসুফ ঢুকল। দরজার পাল্লাটা আড়াল থেকে কায়দা করে খুলে দাঁড়িয়েছিল চয়ন। ঝিলিক খাটে শুয়ে আছে, বুকের ওপর থেকে শাড়ির আঁচল সরানো। দরজা দিয়ে ঢুকেই সেই টোপ খেয়ে ইউসুফ শোওয়ার ঘরের দিকে এক পা এগোতেই দরজার পেছন থেকে এসে ঘাড়ে সিরিঞ্জটা বসিয়ে দিল চয়ন।

গোটা ব্যাপারটা ঘটানোর পর নিজের বুকে হাত দিয়ে আধঘন্টা বসেছিল। হাত-পা কাঁপছিল। মাথার ভেতর কেমন একটা কষ্ট হচ্ছিল, গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এবারে নিজেও হার্টফেল করে মরে যাবে। তারপর আসতে আসতে নিজেকে সামলে ঘরর দরজা বন্ধ করে, পেছনদিকের জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল চয়ন। জানলার গরাদ কেটে আলগা করে রেখেছিল, আগে থেকে। আর ইউসুফের তো আসারই ছিল। ঝিলিকের ফোন থেকে ঝিলিকেরই পুরনো সেমি-ন্যুড সেলফি পাঠিয়ে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল— চলে এসো, দরকারি কথা আছে। ও ট্যুরে গেছে।

চয়নকে সকলেই আন্ডারএস্টিমেট করেছে চিরকাল, অসম্মানের থেকেও বেশি করেছে অবজ্ঞা। ঝিলিক আর ইউসুফ আন্ডারএস্টিমেট না করলেই পারত।

আজ মহরম, শহর আর শহরতলির বিভিন্ন অঞ্চলে শিয়া মুসলমানরা ‘ইয়া হুসেইন ইয়া হুসেইন’ করতে করতে জুলুস বের করে, তাজিয়া বের করে। নিজেদের আহত করে রক্ত ঝরায়। কেউ এক হাত দিয়ে, কেউ দু-হাত দিয়ে বুক চাপড়ায়। কারও কারও হাতে থাকে নানারকম ধারালো অস্ত্র… বুকে-পিঠে আছড়ে পড়ে। ঝনাৎ ঝনাৎ করে শব্দ হয়। আজকাল তো আবার সব কিছুতেই ‘ঝুম্পা চিকুম ঝুম্পা চিকুম’ করে ডিজে বাজে। ‘ইয়া হুসেইন’-এর সন্তাপও এমন ডিজের তালে বাজতে শুনেছে চয়ন। পারে কী করে?! কী খেয়ে করে? কোন অ্যানালজেসিক বা অ্যানাস্থেটিক নিয়ে নিজেদের অসাড় করে এরা? এই ব্যথা সহ্য করে সারাদিন চালিয়ে যায়? সম্ভব?!… ভেবে পায় না চয়ন। ব্যথা সহ্য করতে করতে ব্যথা পাওয়াটাই নেশা হয়ে যায় মানুষের কাছে। ব্যথার মধ্যে দিয়ে মোক্ষকে দেখতে পায় মানুষ। ব্যথা পেতে পেতে যৌন-কামনাও ক্রমে যৌন-তাড়না হয়ে ওঠে। চয়ন এত কিছু ভাবার অবকাশ পায়নি। নিজেই জীবনের কাছে এমন এক বেচারা হয়ে থেকেছে, যার ব্যথাও অন্যের কাছে বাড়তি চিন্তা। বরং মহরমের সময়ে বেপরোয়া আঘাত হানা দেখে ওর মনে হয়, ভাগ্যিস ওকে দায় পড়ে এইসব করতে হয় না।

আর একটা বাইক বুক করে শ্বশুরবাড়ির এলাকা থেকে খানিকটা দূরে এসে যেখানে নামল, সেটি শিয়াদের অঞ্চল। এরা নিজেদের চাবকাতে শুরু করলে যেন আর হুঁশ থাকে না। বাইকটা চলে যাওয়ার পর, ইউসুফের যে ফোনটা থেকে বাইক বুক করেছিল, সেই ফোনটা থেকে সিম বার করে ভেঙে গাটারের ঝাঁজরিতে ফেলে দিল। কিছুদূর এ-রাস্তা ও-রাস্তা দিয়ে হেঁটে একটা ফাঁকা জায়গা বুঝে ফোনটাও ফেলে দিল আর একটা গাটারের ঝাঁঝরিতে। তারপর দুটো গলি পেরিয়ে দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা একটা বাইকের হাতলে হেলমেটটা সন্তর্পণে ঝুলিয়ে দিল চয়ন। কেউ খেয়াল করল না।

সেখানেও একটা মহরমের জুলুস। প্রবল শক্তিতে ‘ইয়া হুসেইন ইয়া হুসেইন’ রবে বুক চাপড়নো চলছে। পিঠে টিউবলাইট ভাঙা চলছে। লোহার চেন-এ ছুড়ি ঝুলিয়ে চাবুকের মত মারছে নিজের পিঠে… একটা অর্কেস্ট্রার মত শোনা যাচ্ছে নানারকম ঝনাৎ-ঝন। কোরাসের মত শোনা যাচ্ছে ‘ইয়া হুসেইন’ ধ্বনি।

এমনই এক মহরমের দিন, তখন বিকম ফাইনাল ইয়ার। দলের সিনিয়ার কর্মী আনোয়ার হোসেনকে অন্য পার্টির ছেলেরা স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে কুপিয়ে চলে গেল। চয়ন সেদিন তাজিয়ার জুলুসে মিশে যেতে না পারলে ওকেও ছাড়ত না। শিয়াদের ভিড়ে ‘ইয়া হুসেইন ইয়া হুসেইন’ করছিল মরিয়া হয়ে। তখন পার্টি ক্ষমতায় থাকা সরকারের শরিক। পুলিশ তড়িঘড়ি কাজে নেমে পড়েছিল। কিন্তু চয়ন অনেক দিন অবধি দিনের বেলাও একা বেরনোর সাহস পেত না। বাড়িতেও কিছু বলতে পারত না। দল থেকেও কাঁধে হাত রেখে বলে দিয়েছিল— যাদের ধরা পড়ার পড়েছে, কিন্তু তুই আইডেন্টিফাই করার রিস্ক নিস না। সেই থেকে মহরমের জুলুসে ‘ইয়া হুসেইন’ বলে বুক চাপড়ানো দেখলেই আনোয়ার হোসেনের কথা মনে পড়ে যায়—

গলা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে, মুখ থুবড়ে রাস্তার কলতলায় পড়ে গেল অত বড় মানুষটা। চয়ন কোনদিকে ছুটছে জানে না, জান বাঁচাতে ছুটছে হোঁচট সামলে… পেছনে তাড়া করছে মোটরবাইকের শব্দ। দূর থেকে কোরাসটা ক্রমশ কাছে চলে আসছে— ইয়া হুসেইন ইয়া হুসেইন ইয়া হুসেইন।

শ্বশুরবাড়ির কেউ বাক্সটা খুললেই পুলিশ ডাকবে। ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে গেলে দেখা যাবে একজন উলঙ্গ নারী, আর একজন উলঙ্গ পুরুষ, একে অপরের সঙ্গে ৬৯ পোজে রয়েছে। অথচ কারও মাথা নেই!

কিচেন নাইফের সেট যতই দামী হোক, মানুষের মাথা কাটা খুব হুজ্জুতের কাজ। এই ‘ইয়া হুসেইন’ বলে রক্ত ঝরানোর থেকেও কঠিন। তারপর সুন্দর আইস-প্যাক করে গুছিয়ে পার্সেল করা। সাবধানে কিচেন নাইফ, সিরিঞ্জ, অ্যাম্পুল… এই সবকিছু থেকে আঙুলের ছাপ পরিষ্কার করে নেওয়া; তারপর সেগুলো তিনটে আলাদা পাড়ার আলাদা আলাদা ভ্যাটে ময়লা ফেলার কালো প্যাকেটে করে ফেলে দিয়ে আসা। এই সব কিছু করতে হয়েছে ইউসুফের ফোন থেকে বাইক বুক করার আগে।

অফিসে ইস্তফা দিয়ে পাওয়া টাকাটা নিয়ে নিয়েছে চার দিন আগে। পলিসির টাকাও ভেঙে দিয়েছে দু সপ্তাহ আগে, তারও প্রাপ্য টাকা এসে গেছে। নাম-মাত্র কিছু অ্যাকাউণ্টে রেখে বাকি সবটাই ক্যাশ করে তুলে নিয়েছিল চয়ন, তারপর দিয়ে দিয়েছে এক পরিচিত দালালের বেনামি অ্যাকাউন্টে। সেলসের কাজ করতে করতে অনেক রকমের লোকের সঙ্গে গা-ঘষতে হয়। একসময়ের বদ লোক, অন্যসময়ের উপকারী হয়ে ওঠে। দালাল কালো টাকা সাদা করার পুরনো খেলোয়াড়। অন্য রাজ্যের একটা ব্যাঙ্কে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট করিয়ে নিয়ে তার ডিটেলস সব চয়নকে দিয়ে দিয়েছে। নিজের কমিশন নিয়ে বাকিটা রেডি রাখবে, গিয়ে নিয়ে নিতে হবে শুধু। কিন্তু তারপর?

সিরিজে যে দেখায় নতুন নাম, নতুন পরিচয় নিয়ে অন্য কোথাও নতুনভাবে জীবন শুরু করার কথা! চয়ন ঘোষ বলে তো আর কেউ থাকলে চলবে না। পুলিশ খুঁজবে চয়ন ঘোষকে। নতুন নাম, নতুন পরিচয়পত্রগুলোর ব্যবস্থা কে করবে এখন? দালালটা বলেছিল— কোনও ব্যাপার না… কিন্তু মুখের কথাকে বিশ্বাস?

ভিড় থেকে সরে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে, এত দিন ধরে সামলে রাখা মায়ের নামে রেজিস্টারড সিমটা থেকে, একটা ফোন করল চয়ন। রিং হয়ে যাচ্ছে, তিনবারের বার দালালটা ফোন তুলল… স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না, চারপাশে শুধু— ইয়া হুসেইন, ইয়া হুসেইন, ইয়া হুসেইন! চয়নের মনে পড়ল, জ্যাকেটের ভেতরে ওর নিজের জামাতেও ছিটকে আসা রক্ত লেগে। ওরও মুখে এতদিনের অযত্নে দাড়ি গজিয়ে গেছে… যা এদের অনেকের মাঝে মিশে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। জ্যাকেটের চেনটা খুলে বুকের দুটো বোতাম খুলে ফেলল চয়ন… তারপর ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল বুক চাপড়ে বলতে বলতে… ইয়া হুসেইন, ইয়া হুসেইন, ইয়া হুসেইন!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...