চার নম্বর নিউজডেস্ক
সম্প্রতি ২২ জুলাই একটি অনলাইন ডোনেট সাইটে একটি পোস্ট করেছিলেন এক বৃদ্ধা, যার বাংলা মর্মার্থ করলে দাঁড়ায়— আপনাদের ধন্যবাদ। আপনারা আমার ডাকে সাড়া দিয়ে যা যা পাঠিয়েছেন তাতে আমাদের পরবর্তী ১৫ দিনে ১০০০ থেকে ১৫০০টি মুখের গ্রাস সম্ভব হবে। ডোনেশনে পাওয়া যে যে প্রোডাক্ট পাওয়া গেছে, তার তালিকায় আছে— আটা (১৫০০ কেজি), চাল (১৫০০ কেজি), অড়হড় ডাল (৩০০ কেজি), ছানার ডাল (৩০০ কেজি), নুন (১ কেজি) এবং সর্ষের তেল (৫১০ লিটার)।
বক্তার নাম বিপিন দেবী। উত্তরপ্রদেশের শোনভদ্র জেলার রাজপুর গ্রাম। প্রথমে শোনভদ্রের কথায় আসা যাক। উত্তর ভারতের এই জেলা দারিদ্রের এক পরাকাষ্ঠা বলা চলে। দুবেলা খাওয়া? অধিকাংশ মানুষের কাছে বিলাসিতা। মোটামুটি অধিকাংশই মাইগ্র্যান্ট লেবারার। অনেকেই একটা সময় ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর মতো কাজে নিযুক্ত ছিলেন। স্থানীয় ইটভাটা, টুকটাক দিনমজুরি— এইভাবে দিনের পর দিন লড়া শোনভদ্রে খাবার শব্দটাই লাখ টাকার স্বপ্ন। তা সে যেকোনও খাবারই হোক না কেন। ভাতের গন্ধ, রুটির তাপ। স্বপ্ন…
এই শোনভদ্রেরই এক মহিলা বিপিন দেবী। এবং তাঁর স্বামী কাল্লু যাদব। দুজনের রেশনের দোকান চালান। নিজে অসম্ভব অর্থকষ্টে কোনওরকমে সংসারকে দাঁড় করানো বিপিন দেবী জানেন খিদে কী জিনিস। জানেন ছোট ছোট ভুখা ছেলেমেয়েগুলো হাত পেতে চাইলে না করে থাকা যায় না। কিন্তু দারিদ্রে বড় হয়ে একটা সময় এসে সেই শিকড় ভুলে যাওয়ার লেগ্যাসি নতুন না। বিপিন দেবী অবশ্য এই দলে পড়েন না। ভাগ্যিস পড়েন না।
বছর দুয়েক আগে তাঁর রেশনের দোকান এক অন্য গল্প শুরু করল। অতিমারি। নুন আনতে পান্তা ফুরনো শোনভদ্রে অতিমারি সাংঘাতিক বিষধর এক সাপের মতো ছোবল মারল। অতিমারির দাপটে না, কাজ হারানোর কষ্টে ক্রমশ শূন্য, নির্বাক হয়ে থাকল রাজপুর সহ শোনভদ্রের রাস্তা, ঘর, খেলার মাঠ। আর তখন থেকেই বিপিন এবং কাল্লু শুরু করলেন ‘চাচি কি রসোই’। দোকান থেকে যেটুকু সঞ্চয় হল তাঁর প্রায় সবটুকু দিয়েই শুরু করলেন আশেপাশের গরিব বাচ্চাদের জন্য রান্না করা। নিজস্ব সঞ্চয় থেকে চাহিদা বাড়তে বাড়তে বাধ্য হয়ে হাত পাতলেন স্থানীয় একটু অবস্থাসম্পন্ন পড়শিদের কাছ থেকে। একসময় ক্রাউডফান্ডিং। ওয়েবসাইট। রেশন জমতে থাকল। বিপিনের রান্নায় জেলার গ্রামে গ্রামে খাবার পৌঁছতে থাকল। ভুখাশুখা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মুখে। অবশ্যই বিনামূল্যে।
অতিমারি শুরু থেকে আজ অবধি একদিনও চাচি কি রসোইয়ের দরজা বন্ধ হয়নি। অসুস্থ হয়েছেন, ঝড়ঝঞ্ঝা এসেছে, অসম্ভব গরমে পুড়ছে গ্রামীণ ভারতের খোলা মাঠ, রাস্তা— তবু বিপিন-কাল্লু ঘাম মুছে রান্নায় ব্যস্ত থেকেছেন। রান্না করতে করতে মুহূর্তের অসাবধানতায় একটা সময় বীভৎস পর্যায়ে পুড়িয়ে ফেলেছেন হাত। তবু অবিচল বিপিন। কখনও হাত লাগিয়েছেন স্থানীয় অন্যান্য মহিলারাও। ক্লান্ত শরীরে শেষে এসে একটু জিরিয়েছেন বিপিন। তদারকিতে একইরকম অক্লান্ত তখনও। জেলার অন্তত ৬-৭টি জেলায় পৌঁছে যায় বিপিনের খাবারের গাড়ি। প্রতিদিন গড়ে ৮০ থেকে ১০০ জনকে খাওয়ানোর কাজ করে যাচ্ছেন অন্নদাত্রী।
সমস্ত দিনের শেষে হাসিমুখে বিপিন বলেন, সবচেয়ে সুখের মুহূর্তটির কথা। বড় বড় ডেকচিভর্তি, হাঁড়িভর্তি গরম ভাত, খিচুড়ি, রুটির গন্ধে ছুটে আসে বাচ্চাগুলো। ‘এসে গেছে, আমাদের চাচি এসে গেছে। আমাদের খাবার এসে গেছে।’ নিজে গাড়ি থেকে সমস্ত খাবার বের করেন বিপিন। পাত পেড়ে বসে ওরা। বিপিন পরিবেশন করেন। ম ম গন্ধে ভরে ওঠে ভুখা ভারতবর্ষ।
‘মরে যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত যেন ওদের খাওয়াতে পারি’— বিপিন দেবীর স্বপ্ন বলতে এটুকুই।