![siddhartha](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2022/09/siddhartha.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
তখন ছিল ছ্যাচড়া-র স্বর্ণযুগ।
যেকোনও পালা-পার্বণ, বিয়ে-বৌভাত, সাধভক্ষণ-মুখেভাত-পৈতে মায় নিয়মভঙ্গের দিনে দুপুরের মেনুতে স্বমহিমায় স্থান পেত সে!
কলাপাতায় গরমভাতের পাশে সোনামুগ ডালের আগে-পড়ে।
সেইসময় অনুষ্ঠানবাড়িতে বাড়ির লোকেরাই কোমরে গামছা বেঁধে পেতলের হাতা-বালতি হাতে খাবার পরিবেশন করত… ফোল্ডিং পায়া লাগানো কাঠের টেবিলের ওপর ইয়াব্বড় রোলের হালকা হলুদ কাগজ, এমাথা থেকে ওমাথা টেনে লাগিয়ে ফড়াৎ করে ছিঁড়ে দেওয়ার টেকনিক রপ্ত করতে হত! আর ছ্যাচড়া পরিবেশিত হত কিপটেমি করে নয়— হাত খুলে।
যাক সে সব কথা, নামে ছ্যাচড়া হলেও ওঁর মধ্যে ছ্যাঁচড়ামির কোনও লক্ষণই ছিল না; বরং পুষ্টিগুণের বিচারে বেশ একটা কৌলিন্য লক্ষ করা যেত।
তাছাড়া, এই পদটির ব্যাপারে বাঙাল-ঘটির বিন্দুমাত্র বিপ্রতীপতা ছিল না।
বাঙালের লাবড়া যেমন ঘটিবাড়িতে নামফেরতা হত ঘ্যাঁট শুভনামে— ছ্যাচড়ার নাম নিয়ে এমন ছ্যাচড়পনি জন্মান্তরেও ছিল না। ভদ্রস্বাদের এক নাম।
দশদিশি সাঁচা নাম তেহরো!
আমার পিসিমার কাছে শুনেছিলাম এই ছ্যাচড়ার মঙ্গলকাব্য। তার ঠাকুমা (আমার প্রপিতামহী) নাকি অতি আদরের নাতনি শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে রেসিপিটি যত্ন করে শিখিয়ে দিয়েছিলেন।
ব্যঞ্জনের মাঝে মিশিয়ে দিয়েছিলেন সুখী সংসারের সকল ব্যঞ্জনা। পাকঘরে অনন্য পদ সৃষ্টির সঙ্গে জীবনের পাকদণ্ডীর পদাবলিটিও মনের পাতায় উঠে গিয়েছিল সেই নববিবাহিতার।
–ছ্যাচড়া বানাইতে দেখসোনি কখনও? কিছুই তো শিখলা না। শাউড়ি কইব কী?
তবে শোনো।
প্রথমে একটা আস্ত মাছের মাথা নিবা। ভাইঙ্গা দুভাগ করো।
এক ভাগ হইলা তুমি আর এক ভাগ হল আমাগো সোন্দর নাতজামাই।
এইবারে গরম তেলে কড়া কইরা ভাজ দেখি। সংসারে কতরকম ঝড়ঝাপটা আসব, কত্ত উথালপাথাল। যত খারাপ সময়… তত একে অপরের সঙ্গে আরও একসাথে, আরও পাশাপাশি কাটাইবা। দেখবা সম্পর্ক আরও মুচমুইচ্যা হইতাসে… স্বাদে য্যান তুলনা নাই!
যেই মাছের মাথা দুইভাগ কড়কইড়্যা ভাজা হইল— খুন্তি দিয়া দাও তো ব্যাবাক ভাইঙ্গা! মিলামিশা একাকার হয়ে যাউক দুইয়োজনের মন দুইখান।
এইবারে মাছের মাথার টুকরাগুলি ভাল কইর্যা ভাজো… তুইল্যা রাখো।
এইবার জড়ো কইরা আনো পাকঘরের ফেলাছড়ানো কুটি কুটি সব্জি। সংসারের ছোট ছোট দুঃখ হাসি হইল এইগুলান।
কুটি কুটি করে কাট একটু আলু, খানিক বেগুন, কুমড়া, ঝিঙা, গাঁটিকচু, শাক… যা পাও হাতের কাছে।
এইবার ওই মাছভাজার তেলেই আরও খানিক তেল দাও দেখি মন খুইলা।
তেল গরম হইলে উয়াতে দাও পাঁচফোড়ন, শুকনা লঙ্কা আর আধাগন্ডা তেজপাতা। তারপর ঢাইলা দাও কাটা সবজিগুলান।
এখন শুধু খুন্তি ধইরা উলটপালট করো আর মাঝেমাঝে সময় দিয়া একটু কষতে দাও… মজাইতে দাও।
বুঝলা কিছু নাতনিসুন্দরী?
সুন্দরী না বান্দরি!
রোগা হওয়ার দোহাই দিয়া তেল ঢালতে কসুর করছ কি— গেছ!
ওই তেলটুক-ই হইল ভালবাসা… সংসারের যত হাসিকান্না… ঝগড়াঝাঁটি… ডুবাইয়া রাখো ওই ভালবাসাটুকুতে।
যত ইচ্ছে ওলটপালট খাও না ক্যান— জীবনের খুন্তি নাড়ায় দেখবা রস মরব না, শুধু জইম্যা আসব।
আর শোনো বান্দরি, তারই মাঝে খানিকডা চমকের ঠাঁই নিশ্চয় রাখবা— ওই ফোড়ন দেওয়ার মতো। ওতে পিরিত আরও জমে।
এবারে দাও দেখি চাট্টি মশলা… হলুদ, জিরাগুঁড়া, ধইন্যাগুঁড়া, শুকনা লঙ্কাগুঁড়া।
কও তো, আর কী দিবা?
নুন আর চিনি। অল্প অল্প কইরা স্বাদ বুইঝা।
আর দিও একটু জিভ সুলানো বিক্রমপুরের কাসুন্দি কিংবা কালা সরিষবাটা।
এবারে ওই তুইলা রাখা মাছের কাঁটা চোকড়াগুলান মিশাইয়া দাও দেখি।
আমাগো রান্নার ব্রতকথায় কয়—
ছ্যাচড়া মজে তেলে-কষে
ভালবাসা জমে ধৈর্যের বশে!
জানি না, প্রগাঢ় পিতামহীর রেসিপিগুণেই কিনা, আমার পরম গম্ভীর পিসেমশাই প্রতিবার পিসিমার হাতের রান্না ছ্যাচড়া চেটেপুটে খেয়ে একটু অবগুণ্ঠিত হেসে বলেই ফেলেন: এনকোর!
আর পিসিমাও লজ্জাটজ্জা পেয়ে কেমন যেন ভেবলে যায় প্রতিবার।
ভাবা যায়?
*অ-পার বাংলার অতি পুরনো এক রন্ধনশৈলীকে সামান্য শ্রদ্ধার্ঘ