সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব সমীকরণ বদলের নয়া ইঙ্গিত— ডলার থেকে রুবল-ইউয়ান?

সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব সমীকরণ বদলের নয়া ইঙ্গিত— ডলার থেকে রুবল-ইউয়ান? | বর্ণালী মুখার্জী

বর্ণালী মুখার্জী

 



রাজনৈতিক কর্মী, প্রাবন্ধিক

 

 

 

হাওয়া মোরগ?

স্বদেশ থেকেই শুরু করি। নরেন্দ্র মোদি যে আসলে নির্ভেজাল ভীরু সেটা আবার প্রমাণিত হল। পর পর দুবার রাষ্ট্রসঙ্ঘে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকল তাঁর প্রতিনিধি। ইংরেজদের পা চেটেই যাদের জন্ম তাদের এই অভ্যেস হবেই। রাশিয়ার বিরুদ্ধেও তারা ভোট দেয়নি, এখন চিনের বিরুদ্ধেও দিল না। আমেরিকা চটে যেতে পারে জেনেও। যদিও হাওয়া মোরগ তিনি। তাই এখন যখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়েছে যে সাতমাসের উপর যুদ্ধ করার পরও পুতিন কোনও জয়ের স্বাদ পাচ্ছেন না, বরং, দিন দিন ইউক্রেনের পায়ের তলার মাটি শক্ত হচ্ছে, আর একনায়ক পুতিন বাধ্য হচ্ছেন দেশের মানুষের উপর আংশিকভাবে হলেও যুদ্ধে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে, তখন সমরখন্দে গিয়ে মোদি বললেন যে এই যুগ নাকি যুদ্ধের নয়। এদিকে নিজের যুদ্ধের ট্যাঙ্কগুলোর উপর লাল পতাকা লাগিয়ে পুতিন যুদ্ধে মেতেছেন। এভাবে বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন পুতিন। ওদিকে অনেক হম্বিতম্বি করেও চিন তাইওয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে সমর্থ হল না। দেখে মনে হচ্ছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার বিপর্যয় দেখার পর পিএলএ-র যু্দ্ধ ঘোষণা করার আর তেমন আগ্রহ নেই। ওদিকে বাইডেন জানিয়ে দিয়েছেন, তাইওয়ানকে আক্রমণ আমেরিকার গায়ে হাত দেওয়া হিসেবেই দেখা হবে। সুতরাং পিএলএ-র এত বড় ঝুঁকি নেওয়া স্বাভাবিক নয়। বরং দরকার পড়লে শি জিনপিংকেই ক্ষমতা থেকে সরাতে চাইবে তারা। আর সেই কারণেই শি চিন্তাধারার অন্যতম স্তম্ভ হল সেনাবাহিনির উপর পার্টির চূড়ান্ত কর্তৃত্ব। 

কিন্তু তা বলে আমেরিকার নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই। এটা আজ পরিষ্কার যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়েছে। এক নতুন জোটের জন্ম হচ্ছে। দুটি পূর্বতন কম্যুনিস্ট দেশ আর সঙ্গে ইরান আজ ন্যাটো জোটের প্রতিযোগী হয়ে উঠছে।

রুশি সাম্রাজ্যবাদ

কমরেড লেনিন সাম্রাজ্যবাদের যে পাঁচটি লক্ষণের কথা বলেছিলেন আজ তার সব কটিই রাশিয়া এবং চিনের ক্ষেত্রে কমবেশি সত্যি বলে দেখা যাচ্ছে। যেখানে আমেরিকার মাথাপিছু জিডিপি ৬৯০০০ ডলার সেখানে চিনে মাথাপিছু জিডিপি যদিও এখনও মাত্র ১২০০০ ডলার। কিন্তু তা সত্ত্বেও সামগ্রিক অর্থনীতির নিরিখে চিন আমেরিকাকে ছুঁতে চলেছে। বিশ্বব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী যেখানে ১৯৬০ সালে চিনের অর্থনীতির আকার আমেরিকার মাত্র ১১ শতাংশ ছিল, সেটাই ২০১৯ সালে ৬৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যেখানে ইউএসএ এবং চিনের অর্থনীতির মধ্যে ফারাক ২০১৯ সালে ৭.৩ লাখ কোটি ডলার ছিল সেটাই ২০২১-এ ৫.২ লাখ কোটি ডলারে নেমে গেছে। অর্থাৎ, এটা পরিষ্কার যে চিনের এত জনসংখ্যা সত্ত্বেও জিডিপি মাথাপিছুতে এই উন্নতি ঘটতে পারত না যদি না চিনের একচেটিয়া পুঁজি রোজ একটু একটু করে ফুলে ফেঁপে উঠত। অন্যদিকে রাশিয়া এখনও পর্যন্ত অস্ত্র, তেল আর গ্যাস ব্যবসায় আধিপত্য ধরে রেখেছে। রাশিয়ার ফিন্যান্স পুঁজি যে মার্কিন পুঁজির সঙ্গে জোর টক্কর দিচ্ছে তা আরও ভালভাবে পরিষ্কার হল ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাশিয়ার ব্যাঙ্কগুলোর উপর মার্কিনি নিষেধাজ্ঞা দেখে। রাশিয়ার বিশাল গ্যাস কোম্পানি গ্যাজপ্রোম, ১৯৯০ সালে গ্যাজপ্রোমব্যাঙ্ক গঠন করে। ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী সেই গ্যাজপ্রোমব্যাঙ্কের সম্পত্তি প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার। মস্কো স্টক এক্সচেঞ্জের আরেকটি ব্যাঙ্ক ভিটিবি-র উপর নিষেধাজ্ঞা লাগানোর সময় ইউএসএ-র ট্রেজারি সেক্রেটারি বলেছিলেন যে এর মধ্যে দিয়ে রাশিয়ার ব্যাঙ্কিং বিনিয়োগ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধমনীকে কেটে দেওয়া হল। ২০১৮ সালে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করা এবং রাশিয়ার অস্ত্রব্যবসায় বিপুল বিনিয়োগ করা গ্যাজপ্রোমব্যাঙ্কের উপর খুব স্বাভাবিকভাবেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর সঙ্গে আবার বেশ কিছু ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দিচ্ছে। কীভাবে গ্যাজপ্রোমের যে ৬ জন সিনিয়র অফিসার ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার ব্যাপারে গররাজি ছিলেন তাঁরা অথবা রাশিয়ান তেলব্যবসার কোটিপতি লুকৈল, যিনি ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নিজের সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, তাঁর দুই অফিসার একের পর এক বিচিত্র ও সন্দেহজনক দুর্ঘটনায় মারা যান?

চিনের সাম্রাজ্যবাদী নকশা

২০১৪ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য চিন সরকার সিল্ক রোড ফান্ড এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাঙ্ক ঘোষণা করার পরও বেশিরভাগ বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনায় সরাসরি চিনা ব্যাঙ্কগুলি, যেমন, চাইনিজ ডেভলপমেন্ট ব্যাঙ্ক বা এক্সিম ব্যাঙ্ক অফ চায়না বিনিয়োগ করে চলেছে। তাই এবার যদি পুঁজির রপ্তানির লক্ষণ দিয়ে বিচার করি তাহলে গোটা পৃথিবীই আজ ভয় পায় চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড পরিকল্পনাকে, যা ইতিমধ্যেই ঋণজালের কূটনীতি হিসেবে যথেষ্ট কুখ্যাত হয়েছে। লেনিন ঠিক এইরকমভাবে এই লক্ষণগুলিকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন একশো বছরেরও আগে, “…. to the numerous old motives of colonial policy finance capital had added the struggle for the sources of raw materials, for the export of capital, for spheres of influence, that is, for spheres of profitable deals, and finally for economic territory under control in general.” সাম্রাজ্যবাদের সব লক্ষণগুলির ষোলকলা পূরণ হল যখন ২০০৭ সালে চিন আফ্রিকার জিবুতিতে প্রথম সেনাঘাঁটি বানাল। এমনকি নিজের পুঁজিকে ‘রক্ষা’ করার জন্য চিন দক্ষিণ সুদান আর মালির মধ্যে চলা সংঘর্ষের মধ্যে সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করেছে। ঋণ শোধ করতে না পারলে আফ্রিকার কিছু দেশের কাছ থেকে ঋণ শোধের অঙ্গ হিসাবে তাদের জঙ্গল, পাহাড়, খনি, হ্রদ, ইত্যাদি দখল করে নিচ্ছে চিন। ২০২০ সালে আফ্রিকার সঙ্গে ব্যবসায় আমেরিকাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে তারা। এলটিটিইকে দমনের নাম করে কীভাবে চিন শ্রীলঙ্কায় সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হয়ে যাওয়া, পাকিস্তানের যে কোনও মুহূর্তে দেউলিয়া হওয়ার পরিস্থিতি, ইউরোপে রুশ যুদ্ধ, ২০১৮ সালে আইএমএফ-কে আমেরিকার হুমকি[1], ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৫০বার বিদেশ ঘোরা[2], পদ্মা সেতু চিন বানায়নি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনার এহেন বিবৃতি— এই রাজনৈতিক অভিব্যক্তিগুলিকে কি এক সূত্রে গাঁথা বলা যায়? নিশ্চিতভাবেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। সাম্রাজ্যবাদের সমীকরণ বদলাচ্ছে। রাশিয়া এতকাল ছিল যুদ্ধরপ্তানিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ। চিনও সেইদিকে বেশ কিছুদিন যাবত অনেকটাই এগিয়েছে।

চিন যে বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে তা বোঝা গেল যখন আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত আইএমএফ পর্যন্ত সেই প্রকল্পের পার্টনার হয় গেল। China-IMF Capacity Development Center (CICDC) is a new IMF center funded by the Chinese government to provide training and other capacity development events for China and other IMF member countries, including those participating in the BRI। এই যৌথ সম্মেলনের আলোচনায় চিনের মহানুভবতার জয়গান করা হল। কীভাবে এই প্রকল্প অসংখ্য দেশকে চিনের সম্পদ ব্যবহার করার সুযোগ এনে দেবে, এরকম আলোচনা হল। এটুকু বোঝা গেল যে ঝুঁকিসম্পন্ন এই প্রকল্পের দায়ভার গ্রহণ করতে আইএমএফ প্রস্তুত। ঋণজালে ফেঁসে যাবে দেশগুলি, একথা স্পষ্টই আলোচনা হয়েছিল। Fiscal management will be critical to minimize debt sustainability risks. For China, it will be important to monitor credit risk exposure, both in direct lending (government) and indirect (stateowned banks and funds).

অর্থাৎ আইএমএফও মার্কিন কর্তৃত্বের একাধিপত্য থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে এমন ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট।

এশিয়ায় ঋণ-ফাঁদের নবতম উৎস হল চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, এককথায় বিআরআই। মার্শাল পরিকল্পনার টাকার বর্তমান মূল্যের প্রায় আটগুণ টাকা নিয়ে চিন নেমেছে এই প্রকল্পে, ৪ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার। বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তারা আন্তর্জাতিক আইনকানুনের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই ঋণজালে ফাঁসিয়ে ফেলছে দেশগুলিকে। বিরাট পরিমাণ পরিমাঠামোগত নির্মাণকার্য চলছে দেশগুলিতে। যার মধ্যে দিয়ে আশু কোনও ফায়দা নেই সেই দেশের সরকারগুলির। রাজস্ব উঠবে না। বিরাট বড় বড় বন্দর, সেতু এয়ারপোর্ট, রাস্তা, লজিস্টিক হাব। সাদা চোখে দেখলে ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পের বিকাশ হবে। আবার বহু শ্রমদিবসও তৈরি হবে। কিন্তু যে দেশগলির সঙ্গে চিন চুক্তিবদ্ধ হচ্ছ তাদের ক্ষমতা নেই এই সব নির্মাণ করা। তাদের দেশের সিমেন্ট বা ইস্পাত শিল্পের উপর নির্ভর করে নির্মাণ হবে না। এইসব প্রকল্পের মূল্য ঋণগ্রহীতাদের জাতীয় আয়ের অর্ধেক, কারও এক-তৃতীয়াংশ। সুতরাং ঋণ বাধ্যতামূলক। অতি উচ্চহারে সুদে ঋণের ফাঁদে তারা পড়ে যাচ্ছে।

শ্রীলঙ্কা এই ৭০টি দেশের মধ্যে একটি।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে যুদ্ধ বা যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির সম্পর্ক ছাড়া স্রেফ বিআরআই বিনিয়োগ দিয়ে চিনের আগ্রাসনকারী ভূমিকা বোঝা অসম্ভব। ২০০৬-২০০৯-এর এলটিটিই নিকেশকারী মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনকারী শেষ যুদ্ধ ছাড়া শ্রীলঙ্কার এই পতন হত না। এলটিটিই-র সমস্ত ক্রূরতাকে ছাপিয়ে গেছিল সেই সরকারি গণহত্যা। নিকেশ করে দেওয়া হয়েছিল এলটিটিই-র শেষ চিহ্ন। সিংহলি উগ্রজাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটানোর জন্য শ্রীলঙ্কার সরকারের দোসর এবং একমাত্র বন্ধু ছিল চিন। এই যুদ্ধের মধ্যে দিয়েই শ্রীলঙ্কার ওপর থেকে ইউরোপ, আমেরিকার প্রভাব কমিয়ে চিন সেই জায়গা দখল করেছিল। সেদিন থেকেই তারা শ্রীলঙ্কাকে অস্ত্র, আধুনিক বন্দুক ইত্যাদি জোগান দিয়েছিল। বিরাট পরিমাণ ঋণ দিতে শুরু করেছিল। রাষ্ট্রসঙ্ঘে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অ্যাজেন্ডাই যাতে না ওঠে তাই ভেটো দিয়েছিল চিন। আন্তর্জাতিক স্তরের সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি, একমাত্র চিন ছিল এই পদক্ষেপের পক্ষে। সেই যুদ্ধে অভূতপূর্ব খরচ করেছিল শ্রীলঙ্কার সরকার এবং সেটার মধ্যে দিয়ে চিনের প্রতি নির্ভরশীলতা প্রতিষ্ঠিত হল। ৭০ কোটি ডলার সাহায্য করা হল যুদ্ধবাজ শ্রীলঙ্কা সরকারকে। ৬টা এফ-৭ ফাইটার জেট বিমান বিনা পয়সায় উপহার দেওয়া হল শ্রীলঙ্কার এয়ারফোর্সকে। পাকিস্তানকে উৎসাহ দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে বেশ কিছু অস্ত্র বিক্রি করতে সেই সময় পরামর্শ দিয়েছিল চিন। শুধু তাই নয়, নতুন ফাইটার বিমানগুলো যাতে অনভিজ্ঞ পাইলটরা চালাতে পারে তাই পাকিস্তান শ্রীলঙ্কার পাইলটদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। আজ শ্রীলঙ্কার এই দৈন্যের অন্যতম কারণ সেই যুদ্ধ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী তাদের খরচ হয়েছিল ২৫০০০ কোটি রুপি, আর অন্য তথ্য বলছে খরচ হয়েছিল প্রায় ৭০০০০ কোটি রুপি।

এর মধ্যে দিয়েই জাপান আর ভারতকে টপকে শ্রীলঙ্কার আমদানির উৎস হিসেবে প্রধান দেশ হয়ে দাঁড়াল চিন ২০১৪ সালের মধ্যেই, আর তারপরেই শ্রীলঙ্কা চিনের এই আধুনিক সিল্ক রুট তৈরির মহাযজ্ঞের অংশীদার হল।

এদিকে এশীয় পরিকাঠামো বিনিয়োগ ব্যঙ্ক খোলার পিছনে চিনের তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত, আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আন্তর্জাতিক কিছু চুক্তি মানার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। চিনের স্লোগান হল তারা নাকি অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা ঘামায় না। তাই আমেরিকার জনগণের চাপে তাদের সরকার যখন অজুহাত বানাতে ব্যস্ত, চিন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অনায়াসে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের যুক্তিকে সামনে রেখে ২০০৭ সালে আমেরিকা তাদের সামরিক সাহায্য প্রত্যাহার করে নিল, আর সেই স্থানে চিন অতি উৎসাহে প্রবেশ করল।

সমীকরণ বদলানোর অর্থনৈতিক বহিঃপ্রকাশ

চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর সিপিইসি, ২০১৩ সালে সম্পন্ন হল। পাকিস্তানে চিনা বিনিয়োগ হল ৬২ বিলিয়ন ডলার, যা পাকিস্তানের জিডিপির এক-পঞ্চমাংশ। ইমরান খানের মত একজন আন্তর্জাতিক পেশাদার খেলোয়ার কীভাবে ক্রমেই স্বৈরতন্ত্রের পক্ষে সওয়াল করে যাচ্ছিলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। খোলাখুলি বলেছেন যে ট্রাম্পের সময় আমেরিকা বেশি ভাল ছিল। চিনের একদলীয় ব্যবস্থা, ভোটহীন ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করেছেন তিনি।

আফগানিস্তানে কাপড়েচোপড়ে হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়াটা যে শুধুমাত্র তালিবানদের কাছে আমেরিকার যুদ্ধে হেরে যাওয়া নয়, বরং এক উঠতি সাম্রাজ্যবাদী জোটশক্তির কাছে আমেরিকার পরাজয়— তা যে কোনও পর্যবেক্ষকের কাছেই ধরা পড়বে। যে শক্তির মধ্যে আবার ফ্যাসিবাদের সমস্ত লক্ষণ স্পষ্ট। তবে এক্ষেত্রে ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্ব অবশ্য বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে।

তবে পুতিন ঠিক যেমন ভেবেছিলেন, কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি ইউক্রেন বাগিয়ে নেবেন, সেরকমই যদি হত তবে দুনিয়াটা আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াত ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। ইউক্রেনের কৃষি সম্পদের উপর দখলদারি কায়েম হলে পুতিন নিজেদের যুদ্ধ-অর্থনীতিকে নিশ্চিন্তে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু ইউক্রেন সে গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছে। ইউক্রেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুতিন তা এখনও দখল করতে পারেননি। বিদেশের সাহায্য নিয়ে, ন্যাটোর সাহায্য নিয়ে ইউক্রেনের জনগণ যে এভাবে প্রতিরোধ করে দেবে তা কল্পনাও করেননি বোধহয় যুদ্ধবাজ পুতিন। যার ফলে তাঁদের এখন সস্তায় তেল বিক্রির চেষ্টা করতে হচ্ছে। সমস্ত নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে যাতে ভারতের মত দেশগুলি তেল কিনতে পারে, তার জন্য সচেষ্ট হতে হচ্ছে। আমেরিকা যদিও ভারতকে হুমকি দিয়ে রেখেছে, রাশিয়ার সঙ্গে তেল কেনাবেচায় রুবল ব্যবহার করলে তারা ব্যবস্থা নেবে। যে কোনও দেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক নিশ্চয়ই স্থির হবে সেই দেশের স্বার্থ অনুযায়ী। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি যে এখনও রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনও কথা বললেন না বা রাষ্ট্রসঙ্ঘে মধ্যপন্থী অবস্থান নিলেন, সেটা কি দেশের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে? মোটেই তা নয়। কারণ মোদি রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বললে কি রাশিয়া ভারতকে তেল বিক্রি করত না? এখনও ইউরোপের দেশগুলিকে রাশিয়া তেল বেচতে বাধ্য হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমীকরণে, বা এককথায় বললে সাম্রাজ্যবাদী সমীকরণে যে বদল আসছে তাকে বুঝতে এবং মোকাবিলা করতে আমরা কমিউনিস্টরা প্রস্তুত তো? নাকি আবারও পিছিয়ে পড়ছি আমরা? নাকি আমেরিকা কতটা যুদ্ধবাজ, তারা ইউক্রেনকে কত সামরিক সাহায্য করেছে, ইউক্রেন কেন ন্যাটোতে যুক্ত হতে চায়, এই লিস্ট সাজিয়ে আমরা এখনও রুশ আগ্রাসনকে সমর্থন করে যাব? আমাদের প্রথমেই হাস্যকর ‘সেটিং’ তত্ত্ব বাতিল করা দরকার। মানে এই যুদ্ধের ফলে আমেরিকার যুদ্ধশিল্পের লাভ হচ্ছে, এখন আমেরিকা ও ইউরোপ প্রতিরক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে, তাদের পরমাণু শক্তিকেন্দ্রগুলো আবার খুলছে। এগুলো সবই সত্যি। ঘোলা জলে নিশ্চয়ই তারা মাছ ধরবে, কিন্তু তার মানে এটা নয় যে মার্কিন রাষ্ট্রের কাছে এই যুদ্ধ লাভজনক। কারণ ইউক্রেনকে তারা হাজার হাজার কোটি ডলার সামরিক এবং বেসামরিক সাহায্য ইতিমধ্যেই করেছে, যা ইউক্রেন পুতিনের হাতে চলে গেলে উদ্ধার করা যাবে না আর।

ডলার-সাম্রাজ্যকে এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে রুবল-ইউয়ান সাম্রাজ্য। পেট্রোডলারের একাধিপত্য যে আর থাকবে না বোঝা যাচ্ছে। দুই মাস আগেই আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা SWIFT থেকে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সহ আরও কিছু রুশ ব্যাঙ্ককে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু তার ফলে রুবল-ইউয়ানের কাছাকাছি আসা ত্বরান্বিত হয়েছে। তাছাড়া আরব দেশগুলিও রুবলের মাধ্যমে তেল বিক্রির কথা ভাবছে। সিরিয়া এই ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। সিরিয়া আরবের বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে কথা চালাচ্ছে। আফ্রিকার কিছু দেশ, লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ আর এশিয়াতে ভারত যদি রাজি হয়ে যায় ইরান-রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায়, রুবলে বা ডলার ছাড়া অন্য কোনও মুদ্রায় তেল এবং অন্যান্য শক্তি কেনাবেচা করতে, তবে ইউরোপ ও আমেরিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সর্বনাশ, বলাই বাহুল্য। তেল ও তেলজাত শক্তির রপ্তানি করে মূলত এরাই। ওপেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তেল উৎপাদন কমানোর। আর উৎপাদিত অন্যান্য পণ্য সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে চিন। সুতরাং চিনও প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের বিরাট ক্রেতা। তাছাড়া মার্চ থেকেই পুতিন গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছে। রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ৫০০০ রুবল দিয়ে এক গ্রাম সোনা কিনছে, অন্যান্য রুশ ব্যাঙ্ক থেকে। প্রাকৃতিক গ্যাসের পয়লা নম্বর রপ্তানিকর্তা, তেল রপ্তানিতে তৃতীয় স্থান যার, সেই রাশিয়া যদি কাল থেকে সোনার বিনিময়ে তেল বিক্রি করে, এবং ডলারের সাপেক্ষে নিজেদের রুবলকে স্থির রাখে তবে আমেরিকার কিছুই করার থাকবে না।

কম্যুনিস্ট সহ গণতান্ত্রিক শক্তি গত অর্ধশতক ধরে ডলার-সাম্রাজ্যের পতন চেয়ে এসেছে। কম্যুনিস্টরা সরকারি কর্মসূচি হিসেবে বৈদেশিক বাণিজ্য টাকায় করার দাবি জানিয়ে এসেছে প্রথম থেকে। গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ফিরিয়ে আনার দাবিও জানিয়ে এসেছে অনেকে। সাদ্দাম হুসেন ও গদ্দাফির মৃত্যুর পর এই দাবি যেন অবাস্তব হয়ে উঠেছিল। ফলে আজ বামপন্থীদের খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু ডলার-সাম্রাজ্যের এই পতন আশার নয়, আশঙ্কার। আরও এক বড় বিপদের দিকে মানবসভ্যতাকে ঠেলে দিয়েছে এই পরিস্থিতি। গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডকে ফ্যাসিস্টরা ফিরিয়ে আনছে, কিন্তু সেই সুযোগ নেওয়ার মত অবস্থায় কতটা ভারত থাকবে তা পরিষ্কার নয়। এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে প্রতিটা দেশের নিজ নিজ দেশের মুদ্রাকে স্থিতিশীল রাখার অধিকার আছে, এবং সেটা সোনার সাপেক্ষে, কিন্তু রুবলের স্থিতিশীলতা যে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ-অর্থনীতিকে প্রতিষ্ঠা করবে তা সামলানোর ক্ষমতা কি থাকবে মানবসভ্যতার? কম্যুনিস্ট আন্দোলনের আজ কোনও অজুহাতেই রাশিয়া-চিনের পক্ষে থাকা চলে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে পাউন্ড-সাম্রাজ্যের পতনের পক্ষে বা ডয়েচমার্কের উত্থানের পক্ষে যেমন থাকা সম্ভব ছিল না আমাদের।

সমীকরণ বদলের রাজনৈতিক প্রতিফলন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিন নিজের আসন ২০৩৬ পর্যন্ত পাকা করেছেন, রুশ সংবিধানে বদল এনে। অন্যদিকে চিনা কম্যুনিস্ট পার্টির সংবিধানে রদবদল এনে সেখানে পার্টি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শি জিংপিং-এর পদ আমৃত্যু পাকা!! শুধু পুতিন বা শি জিংপিং নয়, ট্রাম্পও নাকি মার্কিন সংবিধানের ২২ নং ধারা বদলানোর চেষ্টা করেছেন। যদিও সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান অনুযায়ী প্রায় অসম্ভব। এদিকে বিশ্বের বহু দেশে এখন এই ধরনের স্বৈরতন্ত্রের শাসন চলছে। মোদি চেষ্টা করছেন, সংবিধান বদলে নিজেদের আসন পাকা করার। ইরান, সিরিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যে বা আফগানিস্তানে, আফ্রিকার বহু দেশে কমবেশি, বাস্তবে বা মুখোশের আড়ালে চলে মিলিটারি শাসন। ইরানে ইতিমধ্যেই প্রায় দুশোজনকে হত্যা করা হয়েছে, পোশাকের স্বাধীনতা চাওয়ার জন্য, গণতন্ত্র চাওয়ার জন্য। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, ন্যাটো বিরোধী যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মাথা তুলছে তারা মূলত এই কদর্য শক্তি। যারা অন্য দেশ দখল করে, হত্যা তো করেই, নিজের দেশেও কোনও গণতন্ত্র দেয় না। একতরফাভাবে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি প্রত্যাহার করার ফলে আমেরিকাতে মামলা চলেছে বিভিন্ন পর্যায়ে, যেটা এই উদীয়মান বর্বররা নিজেদের দেশে অনুমোদন করবেই না। বুশের ইরাক আক্রমণের বিরুদ্ধে আমেরিকা সরব হয়েছিল। ২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ যখন Anti-Ballistic Missile (ABM) চুক্তি থেকে একতরফা নাম প্রত্যাহার করল, তখন আদালতে গিয়েছিল বিরোধীরা, কুচিনিচ বনাম বুশ মামলার মধ্যে দিয়ে। আবার আইএনএফ বাতিল করার পরও আদালতে যায় একাংশ। কিন্তু কলম্বিয়া আদালত সেই আপিলকে বাতিল করেছে। কংগ্রেসের স্পষ্ট অবস্থানের বিরুদ্ধে তেমন কোনও শক্তিশালী যুক্তি হাজির করতে পারেনি বিরোধীরা, এমনটাই মত আদালতের। জিমি কার্টার ১৯৭৪ সালে একতরফাভাবে যে চুক্তি প্রত্যাহার করেছিলেন, সেটা নিয়েও মামলা হয়, যা গোল্ডওয়াটার বনাম কার্টার হিসেবে খ্যাত। আবার ১৯৫৪ সালে তাইওয়ানের সঙ্গে মার্কিন সরকারের একতরফা চুক্তি বাতিলের বিরুদ্ধেও মামলা হয়। এইরকমভাবে সরকারের নীতি বা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলন তো দূরের কথা, মামলা করতেও দেবে কি এই নয়া সাম্রাজ্যবাদীরা? মার্কিন বা ইউরোপীয় ওয়েস্টমিনিস্টার ব্যবস্থা যার মধ্যে দিয়ে বিরোধীপক্ষের অস্তিত্ব শক্তিশালী থাকে, তা এই নতুন শক্তি ঘৃণাভরে শুধু প্রত্যাখ্যান করবে।

দ্বিতীয়ত, এতকালের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশেষত্ব হল তারা মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকা, এশিয়াতে হানা দেয়, থাবা বসায়, হত্যা করে। কিন্তু ইউরোপকে সুরক্ষিত রাখে। এবার নতুন সমীকরণে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশে মিলিটারি বেস বানিয়ে পুতিনের সাধ মিটবে না। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া দখল করেই পুতিনের চলবে না। ইজরায়েলের মতো গাজা দখল করেও মিটবে না। তাকে ইউরোপ দখল করতে হবে। পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিটি অঞ্চলকে তাকে দখল করতে হবে। তাকে আণবিক যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে সেগুলি দখল করতে  হবে। প্রয়োজনে আণবিক যুদ্ধ করতেও সে হয়ত পিছুপা হবে না। ইউরোপ এখনও যুদ্ধকাতর, যুদ্ধবিরোধী। সেই মেজাজকে ধ্বংস করতে উদ্যত পুতিন।

কেউ কেউ অবশ্য বলতে চান যে মধ্যপ্রাচ্যে কি মানুষ থাকে না? গাজা বা আফগানিস্তানে কি থাকে না? যে সেই সব দেশ দখল করলে কম অপরাধ হবে? বিষয়টা আসলে ঠিক এরকম সেন্টিমেন্টের নয়। বিষয়টা হল সমাজের যারা এলিট, বা আসলে যারা শাসকদেরই অংশ তাদের উপর আক্রমণ নামানোর গুরুত্ব অপরিসীম। এটাই ফ্যাসিবাদ আর সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে মূল পার্থক্য। স্বৈরতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদে, শাসকদেরই প্রভাবশালী অংশকে হত্যা করা হয়, বা জেলবন্দি করা হয়। গরিব শ্রমিক ছাঁটাই হয় সবসময়। কিন্তু যখন ম্যানেজাররাও ছাঁটাই হতে শুরু করে তখনই সমাজে ন্যূনতম গণতন্ত্র থাকে না, শ্রমিকদের ন্যূনতম কাজের নিশ্চয়তা থাকে না। আদিবাসী মেয়েরা সর্বদাই ধর্ষিতা হয়্‌, কিন্তু যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বা জেএনইউ–র মেয়েরা যৌননির্যাতনের শিকার হয় তখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে বলে ধরে নিতে হয়। কম্যুনিস্টদের সবসময়ই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু যখন আন্দোলন করার জন্য রাহুল গান্ধির জেল হয় তখন বুঝতে হয় পরিস্থিতি অতি সঙ্কটে।

ইউক্রেন অজুহাত মাত্র

সাধারণভাবে কয়েকটি কথা বলে নেওয়াই ভাল। ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান তাকে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। পোল্যান্ড বা আফগানিস্তানের মতোই। শুধু রাশিয়ার কাছেই নয়, প্রতিটি সাম্রাজ্যবাদী দেশের কাছেই। অন্যদিকে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলির সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের তালিকার সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না এতকালের রুশ বা চিনা বৈদেশিক নীতির। এমনকি ১৯৯৭ থেকে ২০২১, এই ২৫ বছরেই ন্যাটো ১৫টি থেকে ২৮টি দেশে সামরিক ঘাঁটি বিস্তার করেছে। এই পর্যায়েই সে আইসিসের মতো জঙ্গি বর্বর দলকে ট্রেনিং দিয়েছে। আমেরিকা ট্রাম্পের নেতৃত্বে রাশিয়া-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি বাতিল করেছে, ২০১৭ সালে। এবং তারপরেই রুমানিয়া আর পোল্যান্ডের মাটিকে ব্যবহার করে তারা এমকে ৪১ লঞ্চার মোতায়েন করেছে। সেই লঞ্চার থেকে ‘টমাহক’ আণবিক মিশাইল ছোঁড়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু সেই সব অগুনতি অপরাধের জন্য পুতিনের এই যুদ্ধ অপরাধে কোনও ঘাটতি হয় না। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের নতুন সমীকণের কথা মাথায় রাখলে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিঃশর্ত বিরোধিতা করতে হবে। মানবসভ্যতাকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে হয়।

ইউক্রেন অজুহাত মাত্র। এই আগ্রাসন দিয়েই পুতিনের যুদ্ধ শুরু। এর পর সে একে একে পুরনো সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলিকে দখল করবে। কাজাখস্তান, মলদোভা, পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া এবং এস্তোনিয়া— এই নামগুলি পুতিন ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন।

পুতিনের বক্তব্য পূর্ব ইউক্রেনের মানুষ রাশিয়াতে যেতে চাইছে অতএব তাদের যেতে দিতে হবে। যেমন পাকিস্তান দাবি করছে কাশ্মিরের বিরাট অংশের মানুষ এখন পাকিস্তানে যেতে চাইছে। আবার শ্রীলঙ্কার তামিলদের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। পুতিনের পূর্ব ইউক্রেন সম্পর্কে একই মতামত। ক্রিমিয়া গণভোটে রায় দিয়েছেন রাশিয়ার দিকে থাকবে, আর তাই পুতিন দখল করতে নেমেছিলেন। কাশ্মিরে গণভোট হোক, কবে থেকেই চাইছে পাকিস্তান। কিন্তু গণভোট না হলে কি পাকিস্তানের কাশ্মির দখল করার অধিকার জন্মে যায়??

মার্কিন ভোট আর বদলাতে থাকা সমীকরণ

২০১৬ সালে ট্রাম্পকে জেতানোর জন্য পুতিনের চেষ্টা সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। ট্রাম্পকে জেতানোর জন্য পুতিন বিরাট অঙ্কের টাকা ঢেলেছিলেন। আমরা সকলেই জানি, ২০১৬ থেকেই পুতিন আগ্রাসী যুদ্ধে নেমেছেন, ক্রিমিয়া দখলের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ২০১৬ সালের মার্কিন ভোটেই পুতিন থেমে থাকেননি। ২০২১ সালে এসে আবার পুতিন ট্রাম্পকে জেতানোর চেষ্টা করেছেন। ট্রাম্পের জেতা কেন দরকার ছিল পুতিনের? কী বললেন পিফার, ইউক্রেনে নিযুক্ত প্রাক্তন মার্কিন দূত? তাঁর বক্তব্য হল, একবার যদি আমেরিকা চুক্তি প্রত্যাহার করে তবে আর পুতিনকে চুক্তি মানার ন্যূনতম অভিনয়টিও করতে হবে না। মস্কো ইচ্ছেমতো ৯এম৭২৯ ক্রুজ মিসাইল, একটি মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল মোতায়েন করতে পারবে। লাগামহীনভাবে, কারণ আমেরিকার অভিযোগ যে রাশিয়া তার এসএসসি-৮ বা ৯এম৭২৯ ভূমিস্থিত, মাঝারি পাল্লার ক্রুজ মিসাইল ধ্বংস করেনি। আবার ফেডারেশন অফ অ্যাটমিক সায়েন্টিস্ট-দের অভিযোগ অনুযায়ী, দশকের পর দশক ধরে চলা একটি অধ্যায়কে শেষ করে, ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রথম নতুন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির যুগ শুরু হবে। এবং নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি বাতিলের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অভিযোগ ছিল রাশিয়ার আর চিনের বিরুদ্ধে। তাঁর বক্তব্য ছিল, রাশিয়া ২০১৪ সাল থেকেই ধারাবাহিকভাবে ক্ষেপণাস্ত্র রাখছে, ছুড়ছে, জমা করছে। অথচ চুক্তি মেনে আমেরিকা কিছু তৈরি করছে না। তাছাড়া চিন যেহেতু চুক্তির অন্তর্গত নয় অতএব লোকসান হচ্ছে আমেরিকার। চিনের সৈন্যবাহিনির হাতে যে মিসাইল আছে তার মধ্যে ৯৫ শতাংশই হল মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল!

ওবামা একসময় বলেন যে রুশ-মার্কিন ছাড়াও অন্য দেশের এই চুক্তির অন্তর্গত হওয়া উচিত। ট্রাম্প জন বল্টনকে ন্যাশানাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার হিসেবে নিয়োগ করলেন। যে বল্টনের সঙ্গে রুশ যোগাযোগ, এমনকি রুশ চরের যোগাযোগ প্রমাণিত। যে বল্টন প্রথম থেকেই নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি বাতিলের প্রবক্তা। বারাক ওবামা এবং দিমিত্রি মেদভেদেভ স্বাক্ষরিত চুক্তির মেয়াদ ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল, এবং নতুন করে স্বাক্ষরের দাবি উঠে এসেছিল মূলত ডেমোক্র্যটদের তরফ থেকে। কিন্তু বল্টন তা বাতিল করে দেন। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছিলেন যে তাদের দেশের অধিকার আছে আণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে ক্রিমিয়াকে রক্ষা করার। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তির পরে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন যে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতেই তারা আণবিক বাহিনি (নিউক্লিয়ার ফোর্সেস)-কে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলেন। ওই একই সময়ে বিদেশ দপ্তরের আর এক আধিকারিক জানালেন যে ইউক্রেনের পেনিনসুলাতে তারা আণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতেই পারেন। জেফরি লিউইস, যিনি পূর্ব এশিয়ার নিরস্ত্রীকরণ কর্মযজ্ঞের অধিকর্তা, মন্টেরি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে বললেন যে আমেরিকার এ এক বিরাট ভুল, পুতিন করালেন আর ট্রাম্প দায় নিলেন— “This is a colossal mistake. Russia gets to violate the treaty and Trump takes the blame.” তার সঙ্গে এটাও বললেন যে এই নিরস্ত্রীকরণ বাতিল করে আমেরিকা মোটেই ফায়দা তুলতে পারবে না। কারণ নতুন করে নিষিদ্ধ অস্ত্রকে মোতায়েন করতে আমেরিকা কতটা পারবে তা নিয়ে সংশয় থাকছে। কিন্তু রাশিয়া সেগুলি করেই ফেলেছে, তারা ঝাঁপিয়ে নামবে। “I doubt very much that the US will deploy much that would have been prohibited by the treaty. Russia, though, will go gangbusters.”

বলাই বাহুল্য, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ট্রাম্পের নেতৃত্বেই হয়েছিল।

বিশ্বজুড়ে এক অন্ধকার সময় নামতে চলেছে, যার নেতা হতে চলেছেন পুতিন, শি জিংপিং, তালিবান, ইরানের খোমেইনি, হয়তো-বা মোদি তার জুনিয়র পার্টনার। একদিকে খোমেইনি-তালিবানি বর্বরতা আর একদিকে রুশ-চিনের বর্বরতার অধীনে চলে আসছে বিশ্ব।

পুতিনের মিথ্যাচার

নিজের দেশের সমস্ত গণতন্ত্র কেড়ে নেওয়া পুতিন এখন সাম্রাজ্যবাদী ঘরানার বর্বরতম খেলোয়ার হতে চলেছেন। বাকিদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে নেমেছেন তিনি, যেমন নেমেছিল হিটলার। সেই উদ্দেশ্যেই গুছিয়ে মিথ্যে বলে যাচ্ছেন পুতিন।

ইউক্রেনের সরকার নয়া-নাৎসিবাদকে প্রশ্রয় নিশ্চয়ই দেয়, যে কোনও দক্ষিণপন্থী দল, সরকারই তা দেয়। ভারতেও কংগ্রেস প্রশ্রয় দিয়েছে। রুশ-বিরোধী স্লাভ জঙ্গি মৌলবাদ এবং মৌলবাদীদের নিশ্চয়ই ইউক্রেনীয় সরকার প্রশ্রয়/আশ্রয় দেয়। কিন্তু পুতিন যে নিজে নয়া-নাৎসিদের প্রশ্রয়দাতা, মদতদাতা সেটা তো তিনি নিজেও অস্বীকার করেননি। পূর্ব ইউক্রেনে, বিশেষত দনভাস অঞ্চলে নয়া নাৎসি রুশ উগ্র জাতীয়তাবাদীদের প্রভাব সৃষ্টিতে পুতিন আজও প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে যাচ্ছেন। রুশ মৌলবাদীদের নির্মূল করার প্রক্রিয়া গ্রহণ শুরু করার ফলেই শেষে চুক্তি করতে বাধ্য হয় রুশ সরকার। ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, যেদিন মিনস্ক্‌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হল, সেইদিনই রুশ মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত ছিল ইউক্রেনীয় সৈন্যরা। মিলচাকভ বলে এক রুশ মৌলবাদী ভিডিও পোস্ট করে। খবরে প্রকাশ যে সেখানে দেখা যায় তারা বন্দিদের কান কেটে নিচ্ছে। যদিও ইউটিউব থেকে এই সব নৃশংস ভিডিও সরিয়ে নেওয়া হয়। রুশ মিডিয়া আবার গদগদ চিত্তে এই উগ্র মৌলবাদীদের সাক্ষাৎকার নেয়। এরা খুব স্পষ্ট করেই সেই স্কাইপ সাক্ষাৎকারে নিজেদের নোংরা রাজনীতির কথা বলেছেন। মিলচাকভের কথা অনুযায়ী, “mightiest potential lies in Russians” and that “Ukrainians’ fight for freedom runs counter to the interests of his people.” অন্য জন, অর্থাৎ, পেত্রভস্কি, বলেন যে তাদের উদ্দেশ্য হল “building a Russian national ‘Chechnya’ where everything will be only for the Russian people.”

আবার যে ইউক্রেন ১৯৯৪ সালেই তাদের আণবিক কাঠামো বেচে দিয়েছে রাশিয়াকে সেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আণবিক অস্ত্র রাখার যে অভিযোগ করেছেন পুতিন সবই ভবিষ্যত অর্থে, ‘করবে’ বা ‘করতে পারে’। পুতিন বলেছেন যে ইউক্রেনের এখন আণবিক অস্ত্র না থাকলেও ভবিষ্যতে থাকার সম্ভাবনা আছে। তাদের হাতে প্রযুক্তি না থাকলেও, থাকতে কতক্ষণ!! অর্থাৎ ঘুরিয়ে পুতিনও স্বীকার করেছেন যে ইউক্রেনের হাতে অস্ত্র নেই। তাছাড়া ইউক্রেনের যে এখনও আণবিক অস্ত্র নেই তা বোঝা যায় পুতিনের আগ্রাসন চালানোর দুঃসাহস দেখে। তাছাড়া ২০২১ সালের ১৫ এপ্রিল ইউক্রেনের জার্মান রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই মেলনিস্ক জার্মান রেডিওতে বললেন যে ইউক্রেনকে যদি ন্যাটো সদস্য হতে দেওয়া না হয় তবে তারা নতুন করে নিজেদের আণবিক শক্তিধর করবেন কি না তা ভাবার সময় এসেছে। আবার ২২ ফেব্রুয়ারি, পুতিনের আগ্রাসনের ঠিক মুখে জেলেন্সকি জানালেন যে ইউক্রেনের বুদাপেস্ট চুক্তিকে বাতিল করার সময় এসেছে, যেহেতু তাদের সুরক্ষার দিকে কেউই ধ্যান দিচ্ছে না। বলে রাখা ভাল, ইউক্রেনের মাত্র তিনটি রাজনৈতিক দল সরাসরি আণবিক শক্তিকে নতুন করে তৈরি করার পক্ষে মত দিয়েছে, স্পোবোদা পার্টি,  Radical Party of Oleh Liashko, আর The National Corps।

রুশ প্রেসিডেন্টের মিথ্যার আরও কিছু নজির দেওয়া যাক। তিনি বার বার বলেছেন যে ইউক্রেনে ১৪০০০ নাগরিককে দনভাস অঞ্চলে হত্যা করেছে জেলেন্সকি সরকার। ইউক্রেনীয় নাৎসিদের সাহায্যে। কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্ঘ এবং এমনকি দনভাসের রুশপন্থী সরকারও সংখ্যাটা এরকম বলেনি। বরং দনভাসের স্বঘোষিত সরকারের হিসেব রাষ্ট্রসঙ্ঘের থেকেও কম। “Commissioner for Human Rights in the Donetsk People’s Republic”-এর ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী Donetsk People’s Republic (DPR)-এর হিসেব হল মৃতের সংখ্যা ৪৯৫৯; অফিসিয়াল তথ্য এটি। রাষ্ট্রসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী সবথেকে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২০১৪-১৫ সালে— ২০১৪ সালে ২৫৪৬ আর ২০১৫ সালে ১৩৯৫। ২০১৬ সালে ৩৪৮ জন নিহত। ২০১৭ সালে ২৭৮, ২০১৮ সালে ১৫৪, আর ২০১৯ সালে তা ১৬০ জন। ২০২০ সালে ৪৪ জন। আর রুশ আগ্রাসনের ফলে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেড় কোটি শিশু গৃহহীন, দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। মার্চ ২০১৯ পর্যন্ত ১১২ শিশু নিহত। ১৪০ জন আহত। আর রুশপন্থী সরকার বলছে, ২০১৭ সালে নিহত ৩২, ২০১৮ সালে ১৯, ২০১৯ সালে ৯ আর ২০২০ সালে ৫।

ভারত কী করবে?

ইউক্রেনের নিজের অখণ্ডতা নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই, অনেকে বলছেন। তাঁদের কথাটা পুরো মিথ্যেও নয়। ইউক্রেন ন্যাটোর জো হুজুর হিসেবে ইরাক, লিবিয়া, সোমালিয়া, আফগানিস্তানে সেনা পাঠিয়েছিল। তখন তাদের ওই দেশগুলির অখণ্ডতার কথা মনে হয়নি। ঠিকই। আজ তারা ইউক্রেনীয় কম্যুনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে শান্তিকামী শক্তি নিশ্চয়ই সেই অজুহাতে আত্মহত্যা করবেন না!

ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে দু-চার কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন।

পুতিনের যুক্তি যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে মোদিদের যুক্তিও সঠিক বলে গণ্য হবে। পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলো মানেনি। লিয়াকত-নেহরু চুক্তি অনুযায়ী বালুচ মানুষদের প্রতি যত্নশীল হওয়ার কথা ছিল তাদের। হয়নি তারা। আবার সিমলা চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মিরে প্রবেশ চলে না, তারা শোনেনি। তাছাড়া কাশ্মিরে অস্থিরতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে তারা। ফলে মোদির যুক্তি অনুযায়ী কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করে বিজেপি ঠিকই করেছে। তাছাড়া ভারতের যদি ক্ষমতা থাকত তবে পাকিস্তানকে আক্রমণ করাও সমীচিন ছিল। অন্তত কাশ্মিরকে বুটের তলায় রাখার মধ্যে অন্যায় নেই। বালুচ মানুষদের মধ্যে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানে অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টা ভারতের নেওয়াই উচিত। কারণ হুবহু এইসব যুক্তিই পুতিন দিচ্ছেন। ক্রিমিয়া সম্পর্কে, ইউক্রেনের চুক্তি না মানা সম্পর্কে, নিও নাৎসি সম্পর্কেও। অর্থাৎ মোদির যুক্তি কতটা ঠিক আর কতটা ভুল, পুতিনের যুক্তি কতটা সত্য আর কতটা অসত্য, এই আলোচনায় প্রবেশের আগে এটুকুই বলার যে পুতিনের কথা বা অভিযোগ যদি ১০০ শতাংশ সত্যও হয়, তবুও যুদ্ধ চলে না। যদি পুতিন যুদ্ধ করতে পারেন, তবে মোদিও পারেন। তার ক্ষমতা নেই তাই তিনি করছেন না।

এশিয়াতে চিন তৈরি হচ্ছে। তাদেরও অনেক অঞ্চল, দেশ দখল করতে হবে। মোদি সেটা মাথায় রেখেছেন তো? রাশিয়া বাঁচাতে আসবে তো তখন তাকে? নাকি দেশ ছেড়ে পালানোর মতলব মোদিদের?

এবার দুচার কথা বলতে চাই বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের প্রসঙ্গে।

এই বছর, ২৫ শে জুন বাংলাদেশের বহু আকাঙ্খিত পদ্মা সেতু উদ্বোধন হল। সরকার জানিয়ে দিল যে পদ্মা সেতু আদপেই চিনা বিআরআই প্রকল্পের অন্তর্গত নয়। যদিও এটাও সকলেই জানে যে এই সেতু নির্মাণকারী সংস্থা চিনা ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থা। এবং আইএমএফ ধার না দেওয়ার ফলে বাংলাদেশ সরকার নিজেই করচ করেছে ৯৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু আসল কথা হল পাকিস্তানের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানি করে যে দেশ সেটা হল বাংলাদেশ। যুদ্ধব্যবসায় নির্ভরশীলতা ছাড়া শুধু ঋণ ফাঁদ দিয়ে কিছুই বোঝা যাবে না।

পাকিস্তানে কোনও নির্বাচিত রাষ্ট্রনায়ক নিজের সময় শেষ করতে পারেননি। পাঁচ বছরের আগেই হয় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে নতুবা তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সামরিক অভ্যুত্থান করে। ইমরানের আগে মাত্র দুইজন প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, বেনজির ভুট্টো আর শওকত আজিজ। কিন্তু দুটো প্রচেষ্টাই সফল হয়নি, তাদের সরকার টিঁকে গেছিল। যদিও পরের ভোটের আগে দুইজনকেই অসংসদীয় পথে সরিয়ে দেওয়া হয়। অনেক প্রধানমন্ত্রীকে, যেমন নওয়াজ শরিফ বা মুশারফ, বিদেশে নির্বাসনে থাকতে হয়েছে। অন্যদিকে সামরিক প্রধানদের কপালেও জুটেছে ‘দুর্ঘটনায়’ মৃত্যু। ইমরানকে সেই তুলনায় অনেক ভদ্রভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম মেনে। ইমরানের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোনও খুন, রাহাজানির অভিযোগ এনে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়নি। তবে পাকিস্তানের যা পরিস্থিতি তাতে এর থেকে বেশি স্পর্ধা দেখানোর ক্ষমতা বোধহয় নেই নতুন প্রধানমন্ত্রীর। ঋণজালে ফেঁসে গেছে পাকিস্তান। শ্রীলঙ্কার পর এবার পাকিস্তানের পালা। পাকিস্তান দেউলিয়া হয়েই গেছে, স্রেফ ঘোষণাটাই বাকি।

জুন মাসের হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানের আর দুই মাস আমদানি করার মতো বিদেশি মুদা আছে। আর্থিক সংস্থাগুলোও এখন সরকারকে ঋণ দিতে চাইছে না। জনগণের ব্যবহার্য বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্য পাকিস্তান বিদেশ থেকে আমদানি করে। ফলে বিদেশি মুদ্রা না থাকলে দেশের জাতীয় জীবন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে। ওদিকে অতিমারির সময় রাজস্ব আদায় হয়নি। সাধারণভাবে পুঁজিবাদে হয়ও না। সঙ্কটে সরকার ব্যবসায়ীদের উপর রাজস্ব চাপায়। বিদেশিরা শেয়ারবাজার থেকে প্রত্যাহার করে বিদেশে পালায়। দেশিরাও শেয়ারবাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। গোটা অর্থনীতি ধ্বসে পড়ে। পাকিস্তানে বিদেশি মুদ্রার জোগান সচল রাখতে আবার এক দফা আইএমএফ-এর কাছ থেকে ধার নেওয়া হয়েছে। তাদের এবারের শর্ত আরও কড়া। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব কর ছাড় বলবৎ ছিল সেগুলি প্রত্যাহার করার শর্ত। তাছাড়া প্যানডেমিকের সময়ে যে ঋণ পাকিস্তান সরকার পেয়েছিল তার অডিট চাওয়া হয়েছে। পেট্রোপণ্যের উপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, এই সব শর্ত তো আছেই। প্যানডেমিক চলাকালীন ব্যাপক হারে পাকিস্তানে সরকার ক্যাশ ট্রান্সফার কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। তাছাড়া সর্বজনীন টিকাকরণ, বৃহদ উৎপাদনে সরকারি সাহায্য, সব মিলিয়ে সরকার ক্রমেই দুর্বল হয়েছে। উৎপাদন বাড়েনি, করদাতার সংখ্যা বাড়েনি, ভারতের মতোই যারা কর দিতে পারে তাদের তোয়াজ করে রাখা হয়েছে। ফলে পুঁজিবাদের নিয়মে কোষাগার ভরেনি। সব চলে গেছে রাঘববোয়ালের পেটে। এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক টালমাটাল পরিস্থিতির ফলে রপ্তানি কমেছে। বিনিয়োগ বাড়বে এরকম আশা করা হয়েছিল গত বছর এই সময়ে। ভারী মেশিনের আমদানি প্রচুর বেড়ে গেছিল। সেই কারণে এই আশা। অথচ ২০২২ সালে এসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৯০ কোটি ডলার। বছরের শুরুতেই আইএমএফ, সৌদি আরব ও ইউরোপ থেকে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ এসেছে। এদিকে পাক টাকার দাম আরও কমেছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এশিয়া জুড়ে দেউলিয়া হওয়ার যে ঢল নেমেছে তা কি স্রেফ ইউক্রেন যুদ্ধ, আর দেশের অভ্যন্তরে আমদানিনির্ভর অর্থনীতির ব্যাখ্যা দিয়েই যথেষ্ট হবে? আমরা দেখেছি যে ইতিহাসে ঋণ-ফাঁদ একটি বদল এনে দিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী সমীকরণে বদল। ১৯৩০-এর দশক আর ১৯৮০-র দশক দেখেছে ঋণ-ফাঁদের ঢল। সাম্রাজ্যবাদী সমীকরণের পরিবর্তনও দেখেছে মানব-ইতিহাস, ওই দুই দশকে। আজ আবার এশিয়া জুড়ে ঋণ-ফাঁদের ঢল। এই প্রসঙ্গে ভারত চিন আমদানি রপ্তানি সম্পর্কটিকেও এক নজরে দেখে নেওয়া যেতে পারে, জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত চিন ভারত বৈদেশিক বাণিজ্যের খবর হল, আগের বছরের তুলনায় চিন থেকে ভারতের আমদানি বেড়েছে ৩০% আর ভারত থেকে চিনের রপ্তানি কমেছে ৩৭%!! বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৩৯ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের তুলনায় ৬৩% বেশি। চিনের বাণিজ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে ভারতে চীনের বিনিয়োগ ছিল ২০ কোটি ডলার, আর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই বিনিয়োগ লাফিয়ে বেড়ে যায় ৫৫০ কোটি ডলারে।

একটা ফাঁদ কি নিঃশব্দে হিমালয়ের ওপার থেকে এপারেও এগিয়ে আসছে বলে সন্দেহ হচ্ছে না?

পুঁজিবাদের আর্থিক সঙ্কটে জেরবার প্রতিটা দেশ। বেরোনোর কূলকিনারা পাচ্ছে না। চিন রাশিয়া পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হিসেবে এখন অন্য দেশ দখল করায় মন দিচ্ছে। চিন, রাশিয়া নিজেদের ইতিহাস, নিজেদের নেতাদের কথা ভুলে গেছে। ভুলে গেছে যে তাঁরা কান ধরে শিখিয়ে গেছেন, পুঁজিবাদী সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় হল সমাজতন্ত্রের পথেই অগ্রসর হওয়া।

পাকিস্তানের পরিস্থিতি, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি দেখে ভারতের দিকে নজর ঘোরাতেই হচ্ছে। যেখানে এখনও সংসদীয় গণতন্ত্র টিঁকে আছে, কিন্তু ইডি-সিবিআইদের স্বৈরতন্ত্র ন্যূনতম গণতন্ত্রকে ধ্বংস করছে। বিরোধীরাও সিবিআইয়ের হস্তক্ষেপ দাবি করছেন। সব রাখালের এক রা।

দেখাও যাচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির এই দুর্দিনেও আমাদের দেশের সেই সব রাখালের একই রা। চিন ও রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শুধু যে মোদি নীরব তাই নয়, রাহুল, মমতা, অখিলেশ, কিংবা ইয়েচুরিও নিশ্চুপ।

 

সিপিসি কংগ্রেস ও চিনের চেয়ারম্যান

‘চিনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান’, এই স্লোগান এতদিনে সার্থক হল। সম্প্রতি চিনের কম্যুনিস্ট পার্টির ২০শ কংগ্রেস উপলক্ষে চেয়ারম্যানের ভাষণের পর। বিশেষত ‘চোর ধরো জেল ভরো’ স্লোগান যখন তাঁদের শিলমোহর পেয়ে গেল। পাওয়া গেল চিন থেকে হেমন্তের বজ্রনির্ঘোষ— চোর ধরো শূলে তোলো।

ভাষণে শি কী বলেছেন? চিনের কম্যুনিস্ট পার্টি কীভাবে বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করবে, বা এশিয়াতে কীভাবে সমাজতন্ত্রের প্রচার প্রসার ঘটাবে, তেমন কোনও দিক নির্দেশ দিয়েছে? যে সর্বহারা গণতন্ত্রের কথা আমরা প্যারি কম্যুন থেকে জেনেছি, রাষ্ট্র ও বিপ্লব পড়ে বুঝেছি, কিন্তু সেটা বাস্তবে ঠিক কীরকম এখনও পুরোটা বুঝিনি, ভাষণে কি সেই ব্যাপক গণতন্ত্রের হদিস আছে?  না নেই। বদলে রয়েছে চিন কত শক্তিশালী হয়েছে তার ফিরিস্তি। একটা প্রামাণ্য সাম্রাজ্যবাদী দেশের যে কোনও নেতা যা বলে থাকেন, হুবহু তাই।

শি-র ‘চিন্তাধারা’ এখন চিনের কম্যুনিস্ট পার্টি স্বীকৃত। ইস্কুলের পাঠক্রমে এখন শি চিন্তাধারা পড়ানো হয়। আলিবাবা নাকি একটা অ্যাপ বানিয়ে দিয়েছিল শি-চিন্তাধারা পড়ার জন্য। চিনে এখন শি-এর স্থান মাওসেতুং-এর সমান, এছাড়া উপায়ও নেই। গর্দান চলে যাবে। কিন্তু এদেশেও দেখছি কেউ কেউ শি-কে মাও-এর সাথে তুলনা করছেন। মাও নাকি শি-এর মতোই স্বৈরতান্ত্রিক ছিলেন। তাঁর আমলেও নাকি বিরোধী মতের অস্তিত্ব ছিল না।

চিনে বিপ্লবের পরদিন থেকেই, কীভাবে দেশকে গড়ে তোলা যায় এই প্রশ্নে পার্টির মধ্যে ছিল হাজার মত বিরোধ। সোভিয়েত ইউনিয়ন যতদিন চিনের পাশে ছিল, সমস্যা ছিল কম। কিন্তু যে মুহূর্তে মাও-কে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভরতা কমাতে হল, অমনি দলে বিরোধ পেকে উঠল। তিক্ত দলীয় দুই লাইনের সংগ্রাম ছিল পদে পদে। গ্রেট লিপের পর তিনি কার্যত আলংকারিক পদাধিকারী। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তিনি আবার ক্ষমতা ফিরে পেলেন, সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ায় নতুন বন্ধু বাছতে হয়েছিল তাঁকে, দলের মধ্যেও আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিক্ত সংগ্রাম করতে হয়েছিল। তথাপি, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে লিউ শাও চি-র পতন হলেও তারপরও মাও যুগের স্বৈরাচারের মধ্যেই দেং শিয়াও-পিং প্রমুখ দিব্যি পার্টিতে টিকে রইলেন, নেতৃত্ব ফিরে পেলেন এবং অচিরেই ক্ষমতায় চলে এলেন।

স্বৈরাচার তো বটেই!

মাও একটি দরিদ্র, অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া দেশকে নিজের পায়ে দাঁড় করালেন। তিনি নিশ্চয় কল্পনাও করেননি যে সেই হাতে পাওয়া চোদ্দ আনা নিয়ে দেং আর শি মিলে দেশটাকে সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত করবে। দলে যে বিরাট সংগ্রাম মাও-কে করতে হয়েছিল নেতৃত্ব রাখতে্‌, আপাতত সেটুকু শি করে দেখান, জবরদস্তি নিজের পদ পাকা না করে।

যদিও আমলাতন্ত্র বিরোধী যুদ্ধ সাংস্কৃতিক বিপ্লবে সফল হয়নি, আর মাও-র মৃত্যুর পরে কয়েক বছর ঘাপটি মেরে থেকে সুকৌশলে দেং ক্ষমতায় এলেন। এসেই বললেন, পুঁজিবাদই ভবিষ্যৎ। অবশ্য তার নাম দিলেন, সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। লেনিনের মত কয়েক বছরের অন্তর্বর্তীকালীন নয়া আর্থিক নীতি নয়। এটাই নাকি চিনের পাকাপাকি ব্যবস্থা। তবে তফাত একটাই। আমেরিকাত, ইংল্যন্ডে, ফ্রান্সে রয়েছে বহুদলীয় পুঁজিবাদ। আর চিনে সেটা হবে কম্যুনিস্ট পার্টির একদলীয় পুঁজিবাদ।

কিন্তু দেং-কে শি-এর মতো নার্সিসিস্ট আচরণ করতে হয়নি। কারণ তখনও চিন আজকের মত একটি আক্রমণাত্মক সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত হয়নি। প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বলা যায়। আজকের মত সেদিন চিন অন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশ থেকে বাজার কেড়ে নেওয়ার জন্য শোষণ আর অত্যাচারের নানা কল তৈরি করতে পারেনি। একদিকে ঋণ কুটনীতি আর সাথে মিলিটারি আক্রমণের ফন্দি বের করতে পারেনি।

নিজেদের দেশে গণতন্ত্র দিতে শি রাজি নয়, তার ভাষ্যে গণতন্ত্র আর উন্নয়ন নাকি পরস্পর বিরোধী। আমাদের দেশে অজিত দোভাল বিপিন রাওয়াত (তাঁর আত্মারশান্তি হোক!!) প্রমুখ মোদির মুখপাত্ররাও তাই বলছেন। তাই নিজের আসন চিরকালের জন্য পাকা করেছেন তিনি। এই মডেল ট্রাম্পের পছন্দ ছিল, মোদির আর খোমেনির তো বটেই।

শি চিন্তাধারাকে নাকি চোদ্দটি পয়েন্টেই বোঝা যায়। যার মধ্যে মাত্র চারটি ছাড়া বাকি দশটাই যুগে যুগে সব রাজনৈতিক নেতারাই বলে থাকেন, জুমলা স্টাইলে দেশের দশের ভালো করার প্রতিশ্রুতি। শি চিন্তাধারাকে তার মানে মাত্র চারটি পয়েন্টে জানা যায়। অমোঘ চারটি বাক্য!!

এক, মিলিটারির উপর দলীয় কব্জা চূড়ান্ত করা হবে, অর্থাৎ এখনও নেই। মিলিটারি বনাম পার্টির মধ্যে বিরোধ আছে আন্দাজ করা যাচ্ছে। মহান চিন্তাধারা বটে।

দ্বিতীয় মহান ভাবনা, তাইওয়ান দখল।

তৃতীয় চিন্তা হল, মতাদর্শে জোর। দেং প্রমাণ করার চেষ্টা করেননি যে তাঁর ভাবনাটাই মার্ক্সবাদ। তিনি বরং বলতে চেয়েছিলেন, মার্ক্সবাদ না হলেও ক্ষতি নেই। যদি তা (ইঁদুর ধরা বেড়ালের মতো) কাজের হয়। আর শি বলছেন, তাঁর এই সাম্রাজ্যবাদী একনায়কতন্ত্রই হল মার্ক্সবাদ।

চার নম্বর চিন্তাটি আরও ভয়ানক। যা প্রমাণ করে, চিন নিছক সাম্রাজ্যবাদী নয়, ফ্যাসিস্টও বটে। দেশ জুড়ে নাকি পার্টি অনুশাসন প্রযুক্ত হবে!!! পার্টির অনুশাসন, সে তো গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা!! অর্থাৎ, সংখ্যাগুরু যা বলবে সেটাই সংখ্যালঘুকে পালন করতে হবে— কী সাংঘাতিক। এতো পুরো হিটলার!!! মোদিও এত বড় কথা এখনও বলে উঠতে পারেননি, যদিও বাস্তবে তাই করছেন।

শি জিনপিং আঠারো সালে দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব আজীবন পাকা করেছেন। দলের মধ্যে তো করেননি, সুতরাং দল চাইলে তাঁকে সরিয়ে দিতে পারে, এমনই সব আষাঢ়ে গপ্প ফাঁদছেন চিনের চেয়ারম্যানকে যাঁরা নিজেদের ভাবেন।

সর্বহারার একনায়কতন্ত্র আজ এদের মুখে মুখে। পুঁজিবাদী সর্বহারা একনায়কতন্ত্র। তারা বহুদলীয় গণতন্ত্রের চরম শত্রু। পুঁজিবাদ থাকবে অথচ বহুদল থাকবে না, এর চেয়ে ভয়ংকর আর কী-ই বা হতে পারে?

পুঁজিবাদ মানেই চুরি, ঘুষ। বহুজাতিক কোম্পানি মানেই তাদের নানা কায়দায় চুরি। নেতাদের ঘুষ দিয়ে সুবিধা আদায়। সেই চুরির বিরুদ্ধে নাকি শি যুদ্ধ করছেন, নেতা, আমলা চুরি করলেই মৃত্যুদণ্ড!! অথচ বহুজাতিকদের অস্তিত্ব তিনি মেনে নিচ্ছেন হাসিমুখে। পুঁজিবাদ থাকবে অথচ চোর থাকবে না, এ যেহেতু অবাস্তব, সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ঘুষের ভাগ চান না শি। শি কংগ্রেসের আগেই চোর ধরতে বেরোলেন। নিজের প্রতিপক্ষদের দুর্নীতির অভিযোগে ধরলেন, হাজতে পাঠালেন। শোনা যাচ্ছে, প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন মন্ত্রীরাও। যারা শি বিরোধী লবির মুখ। যেমন, সুন লিযুন, বা ফু জেনহুয়া। প্রাক্তন পার্টি সেক্রেটারি হু জিনতাও-কে কংগ্রেস মঞ্চ থেকে ঘাড় ধাক্কা দেওয়ার দৃশ্য সকলেই দেখেছে।

চোর ধরো, জেলে ভরো, বা শূলে তোলো– আজ বিশ্বজুড়েই ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার স্লোগান দেখা যাচ্ছে।

রাষ্ট্রের অধীনে অর্থনীতি ভারতে ছিল। এখনও বহুল পরিমাণেই আছে। রিজার্ভ ব্যংক নীতি নির্ধারণ করে। আবার বহুজাতিকও আছে। মিশ্র। কিন্তু সেটাকে শি সমাজতন্ত্র বলবেন না। কারণ বহুদল আছে। হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে গেলে, সব বিরোধী নেতারা চুরি করে জেলে গেলেও কি শি ভারতকে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি বলবেন? না। কারণ দলের নাম বিজেপি। তার বদলে কম্যুনিস্ট পার্টির একদলীয় শাসন হলেই ভারত হয়ে যেত সমাজতান্ত্রিক দেশ!!!!

কিন্তু হায়! নরেন্দ্র মোদি বা মোহন ভাগবত কি দলের নাম বদলাতে রাজি হবেন?

 

তথ্য সংযোগ সমূহ (আংশিক)

  1. https://www.bbc.com/news/world-europe-62817563
  2. https://www.bstdb.org/Overview_of_the_fin_sector_RUSSIA.pdf
  3. https://en.wikipedia.org/wiki/Belt_and_Road_Initiative
  4. https://en.wikipedia.org/wiki/Sri_Lankan_Civil_War
  5. https://statisticstimes.com/economy/united-states-vs-china-economy.php#:~:text=The%20economy%20of%20China%20is,in%202019%20it%20is%2067%25.
  6. https://www.cetri.be/Winners-and-losers-in-Sri-Lanka-s

[1] “Make no mistake, we will be watching what the IMF does,” Pompeo stated in an interview to CNBC.
[2] আহ্বান। নবম সংখ্যা।

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...