অব‍্যয়

মনোজ কুমার গোস্বামী

 


মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ: বাসুদেব দাস

 

 

 

১৯৬২ সনে অসমের নগাঁও জেলায় গল্পকার, লেখক, সাংবাদিক মনোজ গোস্বামীর জন্ম হয়। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র শ্রীগোস্বামী অসমের প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র ‘নতুন দৈনিক’, ‘আজির বাতরি’, ‘আমার অসম’, ‘দৈনিক জনসাধারণ’ ইত্যাদি পত্রপত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে ‘আমার অসম’ পত্রিকার মুখ্য সম্পাদক। ‘সমীরণ বরুয়া আহি আছে’, ‘মই রাজেন বরুয়াক সমর্থন করো’, ’অ্যালুমিনিয়ামের অঙ্গুলি’ লেখকের অন্যতম গল্প সঙ্কলন। ‘ভুল সত্য’ গল্প সঙ্কলনের জন্য ২০২২ সনে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

 

রাত ঠিক এগারোটা বেজে পাঁচ মিনিটে কলিংবেলটা বেজে উঠল। বিছানাটাতে দুটো বালিশ চাপিয়ে খুব আরামে হেলান দিয়ে বসে অনাদি হাতে রিমোটটা নিয়ে টেলিভিশনের চ্যানেলগুলি উল্টেপাল্টে দেখছিল। হয়তো মাঝেমাঝে চোখ দুটি বুজে আসছিল। সেই সময় কলিংবেলটা সজোরে বেজে উঠল।

এই অসময়ে কে এল? দ্রুত একটা শার্ট গায়ে দিয়ে পায়জামাটা ঠিকঠাক করে সামনের দরজা খুলে একেবারে হতবাক হয়ে গেল অনাদি।

—নমস্তে দত্তসাহেব। বাধাই হো। ম্যায় অমিতাভ বচ্চন আপকে লিয়ে লায়া হু য়াহ তোফা!

অনাদি তখন বাকরুদ্ধ। অবিশ্বাস এবং বিস্ময়ে তার মুখটা প্রায় হা হয়ে গেছে। স্বপ্ন নয় তো? তার সামনে ছয় ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটা, হাতে একটা প্রকাণ্ড স‍্যুটকেস।

সেই পরিচিত ব্যারিটোন কণ্ঠ। দীর্ঘ ঋজু শরীর। আধপাকা চুলে অভিজাত মুখ। অন্তর্ভেদী চোখ দুটো অনাদির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

—য়ে হ্যায় আপকে লিয়ে এক করোড় রুপিয়া।
—মানে, আপনার ভুল হয়নি তো? আপনি ভুল ঠিকানায় আসেননি তো? কোনওরকমে অনাদির মুখে কথা ফুটল। আমার নাম অনাদি দত্ত। প্রথম কথা আমি কোনও রিয়েলিটি শোতে অংশ নিইনি। দ্বিতীয়ত এত টাকা পাওয়ার মতো আমি কোনও কাজ করিনি।
—মালুম হ্যায়, দত্তসাহেব। চলিয়ে হামলোগ এক গেম খেলতে হ‍্যায়। য়ে হ‍্যায় আপকা এক করোড় রুপেয়া। গিন লিজিয়ে। স‍্যুটকেসটা অনাদির দিকে এগিয়ে দিয়ে অমিতাভ বলে উঠল— আভি ১১-১৫ বাজে হ‍্যায়। আপকো অগলে চব্বিশ ঘন্টা মেঁ এসব রুপেয়া খরচা করনা হ‍্যায়। কাল ম্যা ঠিক ইসি সময় ফির আউঙ্গা। আউর লে জাউঙ্গা য়ে খালি স‍্যুটকেস। লেকিন…

অবাক দৃষ্টিতে দরজার মুখে দাড়িয়ে অনাদি তাকিয়ে থাকে অমিতাভ বচ্চনের দিকে। হাত থেকে কাজল রঙের স‍্যুটকেসটা তিনি মেঝেতে রেখেছেন। মুখে সেই পরিচিত হাসি…

—লেকিন হা। আপকো মাননা হোগা তিন বহুত আসান শর্ত…
—শর্ত মানে বচ্চন মহাশয়। আপনার সব সময়ে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নের মতো নয়? শর্ত, কন্ডিশন?

অমিতাভ তার সেই ট্রেডমার্ক গম্ভীর হাসিটা হাসলেন, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। তারপরে তিনি অনাদিকে তিনটি শর্ত গেয়ে শোনালেন। (১) এই এক কোটি টাকা অনাদিকে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে খরচ করতে হবে। (২) যার প্রাপ্য তাকে অনাদি টাকা দিতে পারবে, কিন্তু কাউকে দান করতে পারবে না। (৩) এই সুযোগ মাত্র একবারের জন্য। অনাদির আর কোনও সেকেন্ড চান্স থাকবে না।

অভিভাবকের মতো কিন্তু মার্জিত ভাষা এবং শব্দচয়নে অমিতাভ বচ্চন কথাটা বুঝিয়ে দিলেন।

—কিন্তু আমি কেন? আশ্চর্য হয়ে অনাদি পুনরায় জিজ্ঞেস করে। হোয়াই মি?
—ঠিক চওবিশ ঘন্টা বাদ কাল ম্যায় আপকা পাস আউঙ্গা, ঠিক ইসি সময়। অনাদির প্রশ্নকে গুরুত্ব না দিয়ে একেবারে টেলিভিশনে বলার মতো পরিচিত ভঙ্গিতে অমিতাভ বলে উঠলেন— তো দত্তজি মেরি শুভকামনায়েঁ। অ্যান্ড ইওর টাইম স্টার্টস নাউ।

এই বলে কোন মুহূর্তে অমিতাভ বচ্চন অদৃশ্য হয়ে গেল অনাদি বুঝতেই পারল না। দরজাটা বন্ধ করে অনাদি কিছুক্ষণ বসে রইল।

স্বপ্ন নাকি? কী একটা অবাস্তব ঘটনা। হয়তো স্বপ্নই। দুপুরবেলা অনাদি ব্যাঙ্কের লোনগুলি হিসাব করছিল। অনেককে ব্যক্তিগতভাবেও অনেক টাকা ধার শোধ করার আছে। গত দু-মাসের ঘরভাড়াও দেওয়া হয়নি। অনাদির সত্যিই অনেক টাকার দরকার। সন্ধেবেলা টেলিভিশনের চ্যানেলগুলি বদলানোর সময় অমিতাভ বচ্চনের কৌন বনেগা করোড়পতি না কিছু একটা নামের শো দেখছিল। কিছু প্রশ্নের উত্তর চাওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত উত্তর দিতে পারলে দেওয়া হবে এক কোটি টাকা। আচ্ছা এখন অনাদি এই স্বপ্নটির রহস্য বুঝতে পারল। তার মগজে ঘটা নিশ্চয়তা এবং আকাঙ্ক্ষার রসায়ন এই হাস্যকর স্বপ্নটির উৎস। এক ধরনের হ্যালুসিনেশন। হাঃহাঃঃহাঃ…

কিন্তু অনাদির বসার ঘরে এই কাজল রঙের স্যুটকেসটা তাহলে এল কোথা থেকে? পুনরায় একবার চমকে উঠল অনাদি। স্পর্শ করে দেখল না বিভ্রম নয়। তারপরে স্যুটকেসটা খুলে দেখে অনাদির সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। এক হাজার টাকার একশোটা বান্ডিল সারি সারি করে সাজানো। এক কোটি টাকা। না কোনও জাল নকল টাকা নয়। গান্ধিজির মুখে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সিলমোহর মারা. একেবারে খাঁটি নোট।

স্যুটকেসটা যথেষ্ট ভারী। তুলে বেডরুমে আনতেই অনাদির কোমরের ব্যথাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বাপরে! তারপরে বিছানায় বিমূঢ়ের মতো বসে থাকে। অনাদির আশ্চর্য লাগে। এক কোটি টাকা! কীভাবে তার এই ছোট ভাড়া ফ্ল্যাটটিতে এসে ঢুকল! ইওর টাইম স্টার্টস নাউ। অনাদি দুহাতে রঙিন টাকাগুলি তুলে নেয়। দেরি করে হলেও এসেছ লক্ষী মা। কতদিন কত সময় যে অনাদি কিছু টাকার জন্য হাহাকার করেছে। বৌ অলিকে আরও ভাল চিকিৎসা করালে হয়তো বাঁচানো যেত বলে অনাদির আজও আফসোস হয়। ছেলেটি তখন ব্যাঙ্গালোরে পড়ছিল, তার পড়ার খরচ দিতে হত। অফিসে সময় কাটালে রোগী বৌকে দেখার লোক নেই।

দুপুরবেলা অনাদি আসলে সেইসব হিসাব করছিল। শুকনো একটা কুয়োর মতো অবস্থা তার। ছেলেটির জন্য ব্যাঙ্ক থেকে স্টাডি লোন নেওয়া হয়েছিল। ইনসুরেন্সের প্রিমিয়াম বাকি। ব্যাঙ্কের অন্যান্য দেনা প্রায় চার লক্ষ টাকা হয়েছে। অলির অসুখের সময় কিছু ব্যক্তিগত লোনও থেকে গিয়েছিল।

রঙিন টাকাগুলি নিয়ে অনাদি নিজের গালে লাগিয়ে আদর করার মতো কিছুক্ষণ ধরে রইল। মা লক্ষ্মী, তুমি এসেছ! ধারদেনা করে করে অনাদির আত্মবিশ্বাস কমে গিয়েছিল। নিজেকে তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছিল ধীরে ধীরে। তার আত্মসম্মানবোধ ছিল সাঙ্ঘাতিক। পরিস্থিতি বাধ্য না করলে সে সহজে কারও কাছে হাত পাতা ধরনের মানুষ নয়। ধারদেনার কথা ভেবে ভেবে তার ঘুমোতে না পারার মতো অবস্থা হয়েছিল। আজ খুব তৃপ্ত এবং আশ্বস্ত হয়ে অনাদির ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে এল।

সকালবেলা তাড়াতাড়ি জেগে উঠে অনাদি পুনরায় একবার স্যুটকেসটা ছুঁয়ে দেখল, ঠিকই আছে। তাহলে স্বপ্ন নয় এটা। এক কোটি টাকা তার সামনে পড়ে আছে। এক কাপ চা ঢেলে নিয়ে অনাদি মোটামুটি একটা হিসাব করে নিল সারাদিন কোথায় কোথায় যাবে। জরুরি ভিত্তিতে কার কার ধার শোধ করতে হবে। তারপরে অনাদি নিজের জন্যেও কিছু একটা করবে। অনেকদিন অনাদি নিজের দিকে ভালভাবে তাকাতে পারেনি।

কোনওরকমে স্যুটকেসটা লিফটে নামিয়ে অনাদি মারুতি গাড়িটার পেছনের সিটে রাখল। গাড়িটা অনেকদিন পরিষ্কার করা হয়নি। ধুলোর আবরণ মাখন রঙের পুরনো গাড়িটা ঢেকে ফেলেছে। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কিছু দূর গিয়ে তার নিয়মিত সিগারেট কেনার একটি দোকান আছে। পান সুপারি সিগারেটের ছোট গুমটিঘর। তাতে বসে থাকে শিবপ্রসাদ নামের মানুষটি। অনাদিকে দেখেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিবপ্রসাদ সিগারেট এগিয়ে দিল।

—আমার কত পয়সা হয়েছে শিউপ্রসাদ? হিসাব করে দাও আর পাঁচ প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক দাও।

শিউপ্রসাদ কিছুটা আশ্চর্য হয়েই তার দিকে তাকাল। সাধারণত অনাদি সিগারেট একটা নিয়ে দোকানের সামনে টেনে নেয়। কখনও এক প্যাকেট সিগারেট সে কেনে না। অভ্যাসটা বেড়ে যাওয়ার ভয়।

—আপনার একশো কুড়ি টাকা বাকি আছে দত্তজি। আজ এত সিগারেট নিচ্ছেন যে?

অনাদি এক হাজার টাকার একটা নোট শিউপ্রসাদের দিকে এগিয়ে দিল।

—রাম রাম দত্তজি। আমার বিক্রি ভাল হয়নি। খুচরো নেই যদি ফিরে যাওয়ার সময় দিয়ে দেবেন।

সিগারেটের প্যাকেটগুলি নিয়ে অনাদি গাড়িতে বসল। লাল লাইট জ্বলছে না যদিও ফুয়েলের কাঁটা নিচে, বেশি তেল নেই। কাছের ডিপোটাতে ট্যাঙ্কিটা একেবারে ভর্তি করে নেওয়া যেতে পারে। ডিপোর সামনে উপস্থিত হয়ে সে বুঝতে পারল আজ পেট্রোলিয়াম কোম্পানিগুলির স্ট্রাইক। চব্বিশ ঘন্টা ডিপো বন্ধ। হয়ে যাবে, যা তেল আছে তাই দিয়ে কিছুদূর যাওয়া যাবে।

আহমেদের বাড়ি বেশি দূরে নয়। তিনি অনাদির থাকা অ্যাপার্টমেন্টটার মালিক। দুমাসের ভাড়া বাকি আছে। একেবারে কয়েক মাসের অ্যাডভান্সও সে দিয়ে যাবে। আহমেদ ভদ্রলোক। ভাড়ার জন্য বেশি তাগাদা দেয় না।

উপপথটার সামনে আহমেদের সুন্দর ডুপ্লেক্স বাড়িটা। সামনে কয়েকটি দেবদারুগাছ। পরিষ্কার করে রাখা এক টুকরো ঘাসের আচ্ছাদন। গেটে নেপালি চৌকিদার।

—আহমেদ আছে?
—নেই, স্যার বাইরে গেছেন।
—দিদিকে একটু ডেকে দাও। বলবে অনাদি দত্ত এসেছে।
—নেই স্যার। দিদিমণিরা গোয়া বেড়াতে গেছে। পুরো ফ্যামিলি গিয়েছে। আপনি বুধবার এলে পেয়ে যাবেন।
—আচ্ছা।

অনাদি গাড়িতে বসে কিছুক্ষণ ভাবল। ব্যাঙ্ক? না সত্য মহন্তের বাড়ি? মহন্তের বাড়িতে যাওয়াই ভাল হবে। অলির অসুখের সময় মহন্ত তাকে দুই লাখ টাকা ধার দিয়েছিল। তা থেকে মাত্র ষাট হাজার টাকা আজ পর্যন্ত অনাদি ফিরিয়ে দিয়েছে। মহন্ত বেশ সচ্ছল মানুষ। ট্রেডিং-এর কারবার করে। ছেলে দুটি ভাল। মহন্তের বক্তব্য অনুসারে ওরা দিল্লিতে মেডিকেল ইকুইপমেন্টের বিজনেসে নেমেছে।

রাস্তায় ট্রাফিক আরম্ভ হয়েছে। সারা দিনের জন্য বেরিয়ে এসেছে কর্মমুখী মানুষ। গাড়ি-মোটরের ভিড় কোলাহল আরম্ভ হয়ে গেছে। চার-পাঁচ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে অনাদি মহন্তের বাড়িতে পৌঁছাল।

গেটের সামনে মহন্তের এক ছেলের সঙ্গে দেখা হল। সে অবশ্য অনাদিকে ভালভাবে চিনতে পারল না।

—বাবা হাসপাতালে আছে। পরশুদিন স্ট্রোক হওয়ার মতো হল। ডাক্তার অবশ্য বলেছে আউট অফ ডেঞ্জার। এখনও আইসিইউতে আছে।

মহন্তের ছেলে হাসপাতালে যাচ্ছিল। অনাদিও তাকে অনুসরণ করে সেখানে গেল। মহন্ত তার পুরনো পরিচিত। বহুবছর আগে অনাদির অফিসে মহন্ত তার ব্যবসা সংক্রান্ত কোনও একটা ফাইলের জন্য দৌড়াদৌড়ি করছিল। অনাদি কিছু সাহায্য করে দেয়, কাজটা সহজে হয়ে যায়। তখন থেকে প্রায়ই মহন্ত অনাদির খোঁজখবর নেয়।

আইসিইউতে দূর থেকে সে মহন্তের দিকে তাকায়। হাতেমুখে কিছু প্লাস্টিকের পাইপ লাগানো ডিফিব্রিলেটর ইসিজি বিপবিপ করছে। কিছু দুর্বোধ্য গ্রাফ মনিটরে খেলা করছে।

লবির দিকে অনাদি মহন্তের ছেলের সঙ্গে দেখা করল। সে মোবাইল ফোনে ব্যস্ত ছিল। অনাদি তার জন্য অপেক্ষা করল।

—আমার তোমার বাবাকে কিছু টাকা দেওয়ার ছিল। পুরনো ধার। তোমার হাতে দিয়ে যাব কি?
—কত টাকা?
—দেড় লাখের মতো হবে।

মহন্তের ছেলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। দেখুন কাকাবাবু, বাবা আশা করছি খুব শীঘ্রই ভাল হয়ে যাবে। ডাক্তার আজও বলেছে যথেষ্ট ইমপ্রুভ হয়েছে। আমার মনে হয় টাকাটা আপনি পরে বাবার হাতে দেওয়াই ভাল হবে।

হ্যাঁ, সেটাই যুক্তিসঙ্গত। ব্যস্ত ট্রাফিকের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে অনাদিও ভেবে দেখল, মারুতিটার পেছনের সিটে এখনও বিরাজ করছে কাজল রঙের স্যুটকেসটা। অমিতাভ বচ্চন একসময়ের অ্যাংরি ইয়ংম্যান, আজ ভিজে হৃদয়বান অভিভাবকের মতো হয়ে গেলেন তিনি। অনাদি ভাবল। ফেরিওয়ালার মতো যে তিনি এই এক কোটি টাকা নিয়ে গতরাতে অনাদির দরজার সামনে হাজির হলেন কেউ তা বিশ্বাস করবে কি? ইস, অনাদির অন্তত তাকে এক কাপ চা অফার করা উচিত ছিল।

আজ এত ভিড় কিসের? রাস্তায় গাড়ির সারি লেগেছে। ফুয়েলের কাঁটাও অবনমিত। পেট্রোলিয়াম কোম্পানিগুলিকে মনে মনে গালি দিল অনাদি। মুনাফা লুটছে শালারা…

—গাড়ি সাইড করুন। সাইড করুন। হঠাৎ কঠিন কণ্ঠস্বর শুনে অনাদি চমকে উঠল। ওহো এখানে তো দেখছি পুলিশের চেকিং চলছে। বন্দুকধারী অনেক জোয়ান, কয়েকজন ইন্সপেক্টর জাতীয় অফিসার গাড়িগুলি দাঁড় করিয়ে তল্লাশি করছে।

অনাদি মনে মনে প্রমাদ গুনল। এই কয়েকদিন সে খবরের কাগজ, টেলিভিশনে দেখেছে আল কায়দা সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্য হয়ে পড়েছে নাকি শহরটি। ঝামেলা পাকাতে পারে, বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। তবে এখন যদি পুলিশ তার গাড়ি তল্লাশি করে স্যুটকেসটা খুলে দেখে কী হবে? এক কোটি টাকার ধনভাণ্ডারের ব্যাখ্যা সে কীভাবে দেবে? আশীর্বাদের মতো আসা এই এক কোটি টাকা এখন অনাদির জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে না তো? দেখা যাক ভাগ্যে কী আছে!

—কোথায় যাবেন আঙ্কেল? একজন অফিসার গাড়ির জানালা দিয়ে অনাদির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। একজন যুবক ছেলে, খাকি পোশাকে তাকে খুব স্মার্ট দেখাচ্ছে।
—ব্যাঙ্কে, আস্তে করে বলল অনাদি।
—এই আঙ্কেলকে যেতে দে।

চুলে রূপালি রং লেগেছে। ষাট স্পর্শ করবে। এই বয়সে মানুষ সন্ত্রাসবাদী হতে পারে নাকি? অনাদির চেহারায় সেই আত্মবিশ্বাস বা কঠোরতা নেই।

ব্যাঙ্কে ঢুকে অনাদি পরিচিত অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের টেবিলে এল।

—গুড আফটারনুন দত্ত।
—গুড আফটারনুন। তখনই অনাদি ঘড়ির দিকে তাকাল। একটা বাজতে চলেছে। আমার স্ট্যাটাসটা দেখে দেবেন কি? আসলে আমি আজ পুরোটা পেমেন্ট করে যাব বলে ভাবছি।
—ইনস্টলমেন্ট?
—না পুরো লোনটাই শোধ করে দেব।
—ভেরি গুড। ম্যানেজার এবার আড়চোখে অনাদির দিকে তাকাল। এতদিনে তার কয়েকটি ইনস্টলমেন্ট দেওয়ার হয়েছিল।
—আপনাকে আমাকে দশ মিনিট সময় দিতে হবে।

ইন্টারকমে কাউকে নির্দেশ দিয়ে ম্যানেজার কম্পিউটারের কিবোর্ডে আঙুলগুলি বোলাতে লাগলেন।

—ওয়েল মিস্টার দত্ত, আপনার মোট চার লাখ আটত্রিশ হাজার ছয়শো টাকা বাকি আছে। ঠিক আট মিনিট পরে ম্যানেজারটি অনাদিকে জানাল। এই পেমেন্ট দিয়ে দিলে আপনার দুটো লোন অ্যাকাউন্ট সেটল হয়ে যাবে।
—আমি এখনই দিতে চাইছি। অনাদি গম্ভীরভাবে বলল।
—ইন দ্যাট কেস মিস্টার দত্ত আপনাকে সোমবার আসতে হবে। সরি, আজ শনিবার তো। আমাদের ক্যাশ কাউন্টার ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।

ম্যানেজার সেলসম্যানসুলভ হাসি হাসলেন। অবশ্য আপনি যদি চেক দিতে চান আমি রেখে দিতে পারি। কিন্তু ক‍্যাশ আই অ্যাম সরি ফর টুডে।

কী হচ্ছে এসব? এতক্ষণ পর্যন্ত অনাদি এক কোটি থেকে এক টাকাও খরচ করতে পারেনি। বেতালের গল্পের মতো কেবল এই অক্ষয় ধনভাণ্ডারের ভার বহন করে চলেছে। ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে অনাদি শহরের সবচেয়ে অভিজাত রেস্টুরেন্টটিতে  ঢুকল। ইটস লাঞ্চটাইম। অকৃপণভাবে সে লাঞ্চের অর্ডার দিল। টাই পরা, এক্সিকিউটিভ বলে মনে হওয়া দুজন করে ওয়েটার তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রেস্তোরাঁটি নিরিবিলি। খুব সুন্দর ইন্টেরিয়র। লাঞ্চ এল, একেবারে এলাহি কারবার।

আসলে এরকম দামি রেস্তোরায় অনাদি আগে কখনও আসেনি। এখানে একবেলা মধ্যাহ্নভোজনের দাম কত হতে পারে— দুই হাজার, চার হাজার? রেস্তোরাঁটির আভিজাত্য সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করে অনাদি হাতে রুপোর চামচ তুলে নিল। ভেরি গুড ফুড, আহা।

—কী খবর দত্তদা? একজন যুবক এসে তাকে ডাকল। পরিচিত মুখ, অনাদি ঠিক মনে করতে পারছে না। দত্তদা, আমি রাজীব মিশ্র। আপনার সঙ্গে দুই বছরের মতো কাজ করেছিলাম। যুবকটির সঙ্গে একজন সঙ্গী। অনাদির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। দত্তদা রিটায়ারমেন্ট নেওয়ার সময় আমার চাকরির দুই বছর হয়েছিল, কিন্তু দাদার কাছ থেকে অনেক শিখেছিলাম। ইন ফ্যাক্ট অফিসে দত্তদা ছিলেন আমাদের ফ্রেন্ড ফিলোজফার এবং গাইড।

প্রশংসা শুনে অনাদির ভাল লাগল। বিশেষ করে কোনও পুরনো সতীর্থের মুখ থেকে— যার কথা ইতিমধ্যে তিনি ভুলে গেছেন। অনাদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজন কাউন্টারের দিকে গেল। তাদের খাওয়া শেষ হয়েছে। যাকে বলে উদরপূর্তি করে ভোজন করা, অনাদি উদরপূর্তি করে ভোজন করল। এক কাপ ভাল কফিও খেল। অনেকদিন এই ধরনের সুস্বাদু, এরকম গুরুভোজন সে করেনি।

—বিল প্লিজ। কয়েকটি মুখশুদ্ধি হাতে নিয়ে সন্তুষ্টির সঙ্গে সে উঠতে গেল।
—স্যার আপনার বিল পেমেন্ট হয়ে গেছে।
—হয়ে গেছে? কে করেছে পেমেন্ট? অনাদি সত্যিই অবাক হল।
—সেই যে আপনার বন্ধুটি। আপনি কথা বলছিলেন। তিনি করে গেলেন।

পুরনো মারুতিটার স্টিয়ারিঙে এক হাত রেখে নীরবে যেতে থাকে অনাদি। হাতের পুরনো ঘড়িটাতে সময় দেখে— টাইম ফ্লাইজ। অনাদি ঠিক করল সে এবার প্রতীক জৈনের কাছে যাবে। না তার আর কোনও সঙ্কোচ নেই। অনাদির শত্রু বিশেষ নেই। জীবনকে সে দার্শনিকভাবে নিয়েছে। কিন্তু প্রতীক জৈনের সঙ্গে তার একটা হিসাবনিকাশ মেলানোর আছে। বহু বছর আগে অনাদি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টসে কাজ করত। কোম্পানির মালিক প্রতীক জৈন। সেপ্টেম্বরের কোনও একটি দিনে জৈনের অফিস এবং গুদামে অতর্কিতে ট্যাক্স রেইড হয়। অনেক নথিপত্র বাজেয়াপ্ত হয়। প্রথম চাকরি। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছিল অনাদি। তার টেবিল থেকে ট্যাক্সের লোকজন সিজ করে কোম্পানির এক নম্বর হিসাবপত্রগুলি। সতেরো লাখ টাকা পেনাল্টি ভরতে হয় জৈন কোম্পানিকে।

একদিন জৈন অনাদিকে ডেকে পাঠাল।

—দত্ত ট্যাক্স রেড হওয়াটা বড় কথা নয়। সতেরো লাখ টাকা পেনাল্টি দেওয়াটাও আমার কাছে বড় কথা নয়। কিন্তু আমি জানি কোম্পানির ভেতরের তথ্য ট্যাক্সের লোকেদের হাতে কেউ দিয়েছে।
—মানে? জৈনের কথার মর্মার্থ বুঝতে অনাদির কিছুটা সময় লাগল। সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।
—মানে একবার যদি কারও ওপরে বিশ্বাস হারিয়ে যায় সেই মানুষ থাকলে কোম্পানির জন্য খারাপ, তার নিজের জন্যও ভাল নয়, জৈন পুনরায় বলল।

তিরিশে অক্টোবর অনাদি চাকরিটা ছেড়ে দিল। তার মাথায় বিশ্বাসঘাতকতা, অবমাননা আর দায়িত্বহীনতার বোঝা। প্রতীক জৈন তার শত্রু নয় কিন্তু তার জীবনের অন্যতম খলনায়ক। এত বছর পরেও সেই অপমান অনাদি ভুলতে পারেনি। আজ সে জৈনকে সতেরো লাখ টাকা ফিরিয়ে দেবে। দায় মুক্তি।

আগের চেয়ে বিস্তারিত হলেও জৈনের অট্টালিকাটা খুঁজে পেতে দত্তের অসুবিধা হল না। ওপরে একটা-দুটো তলা বেড়েছে। বাড়ির রঙের পরিবর্তন হয়েছে। প্রায় পঁচিশ বছর পরে অনাদি পুনরায় জৈনের এলাকায় প্রবেশ করল।

—জৈনজি আছে কি?
—কোন জৈন? বারান্দার সোফায় একজন বয়স্ক মহিলা। জৈনের পত্নী না মেয়ে?—কোন জৈনকে চাইছেন? মহিলাটি অনুচ্চকন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।
—প্রতীক জৈন। আমি প্রতীক জৈনের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

মহিলাটি অনাদির দিকে তাকালেন। তার চোখের মণি স্থির, অচঞ্চল।

—তিনি নেই মারা গেছেন। মহিলাটি করুণ কণ্ঠে বললেন।
—কীভাবে? কখন? তড়িদাহতের মতো অনাদি কেঁপে ওঠে।
—অনেক আগেই সুইসাইড করেছেন তিনি। আজ চার বছর হল।

মহিলাটি খুব অভিমানের সঙ্গে শব্দগুলি উচ্চারণ করে সোফা থেকে উঠে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলেন। ফিরে এসে মারুতিটাতে বসে স্তব্ধ হয়ে রইল অনাদি। চোখে জল আসতে চায়, বুকের ভেতর কিছু একটা গুমড়ে উঠে। প্রতীক জৈন আত্মহত্যা করল। নিজেকে ক্লান্ত পরাস্ত অসহায় বলে মনে হয় তার। কিছুক্ষণ স্টিয়ারিঙে মাথাটা রেখে পড়ে থাকে অনাদি।

বিকেল হয়ে এসেছে। ম্লান হয়ে এসেছে সূর্যের তেজ এবং উত্তাপ। ধীরে ধীরে রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন ছবি পার হয়ে যায়। সিনেমার পোস্টার, হোর্ডিং, বিজ্ঞাপন, দেওয়া্‌ল, ধূসর বিপণির সারি। ফুটপাথে বসে থাকা সারি সারি ভিখারির দল। ট্রাফিক সিগনালে অনাদি গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে রাখে। তেল কম আছে।

—বাবু, বাচ্চা খায়নি, বাবু কিছু পয়সা দিন।

কোলে বাচ্চা নিয়ে একজন মহিলা অনাদির দিকে জানালা দিয়ে হাত মেলে দিয়েছে। কম বয়সের স্ত্রীলোক, স্বাস্থ্যহীন। অযত্নে গালমুখ ভাঙা। কোলে বাচ্চাটা গভীর ঘুমে। মাথাটা মায়ের কাঁধে হেলে পড়েছে।

সেই করুণ দৃশ্য সহ্য হয় না অনাদির। স্যুটকেসে হাত ভরিয়ে একগাদা টাকা বের করে আনতে চেয়েও সে থেমে গেল। এই টাকা দান করা যাবে না। কিন্তু অনাদির প্রবল ইচ্ছা হল চলন্ত মারুতির জানালা দিয়ে সে এই হাজার হাজার টাকার নোট ছুড়ে দেবে, বাতাসে উড়িয়ে দেবে, টাকা ভিখারির দল কুড়িয়ে নেবে। ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যাল ছেড়ে দৌড় লাগাবে, পথিক দৌড়াবে, সমস্ত শহরে হাহাকার পড়ে যাবে।

কিন্তু অনাদি সেসব করতে পারবে না। জীবনে কত যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তার মধ্যে অমিতাভ বচ্চনও চাপিয়ে দিয়েছেন কয়েকটি শর্ত।

ঘড়ির শোরুমটার সামনে অনাদির মারুতি এসে দাঁড়াল। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আশ্চর্য, সময় কীভাবে পার হয়ে গেল। কাউন্টারে থাকা শাড়ি-পরিহিতা একটি সুন্দরী মেয়ে তাকে ঘড়ি দেখাল। কী সুদৃশ্য অভিজাত অলঙ্কৃত ঘড়িগুলি। কী সুন্দরভাবে সেকেন্ডের কাঁটা লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যেন খুব খারাপ খারাপ দিনগুলিও এই ঘড়িগুলিতে ভাল সময় হয়ে যাবে।

—এটার দাম কত? একটা রোলেক্স ঘড়ি হাতে নিয়ে অনাদি জিজ্ঞেস করল।
—টুয়েন্টি এইট থাউজেন্ড প্লাস ট্যাক্স স্যার। খুব ভাল ঘড়ি পছন্দ করেছেন আপনি।

সত্যিই অনাদির হাতে ঘড়িটা খুব মানিয়েছে। দাম দিতে গিয়েও সে থেমে গেল। পুরনো এইচএমটি ঘড়িটার দিকে তাকাল। গত কুড়ি বছর এই ঘড়িটি নীরবে তার সঙ্গী হয়ে রয়েছে। একটি ছোট দোকান থেকে একদিন অলি এবং সে ঘড়িটা কিনে এনেছিল। দুই বছরের গ্যারান্টি ছিল। আজ কুড়ি বছর সে গভীর আনুগত্য এবং বিশ্বাসের সঙ্গে অনাদিকে সময় দেখিয়ে চলেছে। কখনও থেমে যায়নি। এই ঘড়িটা কী দোষ করেছে? এত স্মৃতি বহন করে বেড়ানো ঘড়িটা আজ অব্যবহৃত করে ফেলার কোনও যুক্তি আছে কি? কোনও যুক্তি নেই। ঘড়ি না কিনে অনাদি শোরুম থেকে বেরিয়ে এল। স্ট্রিটলাইট-গ্লোসাইনে আলোকিত শহর। দূরের ট্রাফিক পয়েন্টে সবুজ লাইট জ্বলছে। অনাদির মারুতি সেদিকে দৌড়ে গেল। আজ গোপাল বৈশ্য স্যারের সঙ্গে দেখা করতে হবে। কয়েক বছর আগে অনাদির খোঁজে বাড়িতে এসেছিল।

বৈশ্য স্যার কলেজে পড়াতেন। অনাদি ছিল তাঁর প্রিয় ছাত্র। কলেজ থেকে বেরোনোর পরেও অনাদি বৈশ্য সারের খবরাখবর রাখত। স্যারের মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেটি আলাদা থাকে। স্যার এবং দিদিমণি একা। একদিন সকালবেলা বৈশ্য স্যার অনাদির বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। অনাদি তুমি আমাকে দুই মাসের জন্য ত্রিশ হাজার টাকা ধার দিতে পারবে কি? অকিঞ্চনের মতো স্যার জিজ্ঞেস করলেন। স্যারের নিশ্চয় টাকাটা খুব দরকার পড়েছে। না হলে এরকম অনুরোধ করেন না স্যার।

সেই সময়ে অনাদির একেবারে নিঃস্ব অবস্থা। অলি হাসপাতালে, ছেলের জন্য টাকা পাঠাতে হয়। এমনকি ঘরভাড়া দেওয়া হয়নি। অনাদি স্যারকে সাহায্য করতে পারল না। আমাকে কিছুদিন সময় দিন স্যার, চেষ্টা করে দেখব, বলে এক কাপ চা খাইয়ে স্যারকে বিদায় দিল। আশাহত হয়ে ফিরে যাওয়া স্যারের ছবি এখনও তার চোখে ভাসছে।

স্যার বাড়িতে নেই। প্রতিদিনের মতো সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে গেছেন। ততক্ষণে অনাদি এক কাপ চা খেল। দিদিমণির সঙ্গে এটা ওটা নিয়ে কথা বলল। আধঘন্টা পরে স্যার ফিরে এলেন।

—ও অনাদি। অনেকদিন পরে এলে। চা খেয়েছ?

কিছুক্ষণ পরে বৈশ্য স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিতে দরজার সামনে গিয়ে অনাদি আস্তে করে বলল— স্যার, অনেক দেরি হয়ে গেল কিন্তু আপনার জিনিসটা আমি নিয়ে এসেছি।

—কী জিনিস?
—ত্রিশ হাজার টাকা। আপনার যদি প্রয়োজন হয় আজ পঞ্চাশ হাজারও দিতে পারব। অনাদি অনুচ্চ স্বরে বলল।
—লটারি পেয়েছ নাকি হে? বৈশ্য স্যার  হাসলেন। লাগবে না অনাদি। আমার টাকার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। ওটা তো তিন বছর আগের কথা নাকি?
—স্যার আপনি আমার উপর খারাপ পাননি তো? সেদিন আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারলাম না।
—না অনাদি, সত্যিই সেই সময় তোমার এত বিপদ, আমার চাওয়াটা উচিত হয়নি। পরে বুঝতে পেরেছিলাম। স্যার স্বাভাবিকভাবে বলে গেলেন। জীবনে কিছু মুহূর্তের জন্য কিছু জিনিসের দরকার হয়। তারপরে সেইসব হয়ে পড়ে অপ্রয়োজনীয়। কেবল টাকাই নয় অনাদি, প্রেম ঘৃণা ভালবাসার প্রয়োজনীয়তাও অ্যাবসলিউট নয়।

ফুয়েল মিটারে বিপজ্জনকভাবে লাল লাইট জ্বলছে। ইন্ধন শেষ হয়ে এসেছে। ক্লান্তি এবং অবসন্নতা ঘিরে ধরছে অনাদিকে। রাত হয়ে আসছে। বাড়িতে ফিরে যাওয়াই ভাল হবে। টাকাটা সেই বিক্রম বেতালের পুরনো গল্পের মতো। এক কোটি টাকার ভার অনাদির কাঁধ থেকে নামতে চায় না। তুমি আমাকে কী অক্ষয় ভাণ্ডার দিলে অমিতাভ বচ্চন?

শহরের প্রান্তে এক উৎসবমুখর পরিবেশ দেখে অনাদির গতি শ্লথ হয়ে গেল। রাস্তার দুপাশের গলিগুলিতে মানুষের ভিড়। পেট্রোম্যাক্স লাইটের আলোতে সারিসারি জুয়ার বোর্ড বসেছে। ডাইছবোর্ড তাস চাকরি কত যে জুয়ো চলছে। যে-সমস্ত মানুষ খেলতে এসেছে তার বেশিরভাগ শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত প্রান্তিক মানুষ। ভাঙা মুখ, অপরিচ্ছন্ন পোশা্‌ক, স্বাস্থ্যহীন শরীর, চোখের তারা ধূসর। গাড়িতে বসে জানালার আয়না দিয়ে অনাদিক সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরে স্যুটকেস থেকে এক খাবলা নোট নিয়ে গলিটাতে ঢুকে গেল।

কয়েকটা মাতব্বর জাতীয় মানুষের খেলা চলছে। কয়েকজন প্রাণপণে চিৎকার করে মানুষ ডাকছে। বাহ এটাই তো দরিদ্রের ক্যাসিনো। চক্র ঘুরছে, ডাইস ছুঁড়ে দেওয়ার শব্দ। চারপাশে অনেক উৎসুক মুখ। কেউ প্রাপ্তির আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। কেউ হারানোর দুঃখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একজনের যদি জিতে গিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেড়েছে অন্য দুজন সর্বস্বান্ত হয়েছে সেই একই সময়ে। অনাদি জানে আসলে কেউ জেতে না। এই খেলা আসলে পরাজয়ের উৎসব। তথাপি খেলে দেখায় অনাদির সমস্যা নেই। সে তো হারার জন্যই খেলবে। জীবনে প্রথমবারের জন্য জুয়ার বোর্ডে নিজের দান দিতে যেতেই  অনাদি দেখতে পেল হঠাৎ এক আলোড়ন। ধুপধাপ করে মানুষগুলি দৌড়াচ্ছে, দ্রুত জুয়ার আলো বন্ধ করছে সবাই। কী হল?

—পুলিশ, পুলিশ। পালা পালা।

একদল খাকি পোশাকধারী গলিটাতে প্রবেশ করল। পেট্রোম্যাক্সগুলি নিভে গেল। অন্ধকারে কেবল পদশব্দ এবং চিৎকার।

অনাদি এসে গাড়িতে বসল। স্টার্ট  দিল। অনেক রাত হল। দিনের শ্রান্তি এবং হতাশা শরীরকে ক্লান্ত করে ফেলেছে। তারপরে ভূতের ওপরে দানোর মতো তার প্রাচীন মারুতিটা কিছু সময় চলে এসে এক জায়গায় থেমে গেল। কী হল? কিছু খারাপ হল নাকি? ওহো তেল শেষ হয়েছে। অনাদি যে ভয় করছিল সেটাই হল। অনেক ঠেলা ধাক্কা দিয়ে সে গাড়িটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করাল। ব‍্যস এখানেই থাকুক। এই মান্ধাতাযুগের গাড়ি কে আর নেবে।

ভাগ্য ভাল যে এখান থেকে অনাদির অ্যাপার্টমেন্ট আধ কিলোমিটারও হবে না। সে স্যুটকেসটা নামিয়ে হাতে নিল। গাড়িটা ভালভাবে লক করল। তারপরে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করল।

স্যুটকেসটা সত্যিই ভারী হয়ে পড়েছে। হাতটা টনটন করছে। কোমরের ব্যথাটাও মাথাচাড়া দিচ্ছে। এটা দেখছি সত্যি সত্যি সেই বিক্রমাদিত্যের কাঁধে ওঠা বেতালের গল্পের মতো হল। সারাদিন চেষ্টার পরেও অনাদি ভারমুক্ত হল না।

দূর থেকে একটি রিক্সা আসার শব্দ শুনতে পেল অনাদি। রক্ষা! রিক্সাটার কেরোসিন ল্যাম্পের আলোতে দাঁড়িয়ে সে বলল মুঝে থোরি দূর ছোড় দো ভাই। চারপাশে শূন্যতা। দুই-একজন পথচারী। মাঝেমধ্যে দ্রুত দু-একটা গাড়ি পার হয়ে যাচ্ছে। বাকি সব বন্ধ। এমনকি শিউপ্রসাদের পানদোকানটাও বন্ধ হয়ে গেছে। সাড়ে দশটা বাজতে চলল।

স্ট্রিটলাইটের ম্লান আলোতে জর্জর রিক্সাটা অনাদি দত্তকে নিয়ে যেতে থাকে। তার দু-পায়ের মাঝখানে কালো রঙের ভারী স্যুটকেসটা। রিক্সাটা থেকে বিচিত্র কিছু ধাতব শব্দ বের হচ্ছে। রিক্সাওয়ালাটা একটি পালোয়ান যুবক। মলিন গেঞ্জির মধ্যে দিয়ে আসা তার ঘামের গন্ধ পেল অনাদি। সে আপন মনে একটি ভোজপুরি গান গুনগুন করছে। তার বাহু, কাঁধ এবং পিঠের মাংসপেশী শিলাময় রাস্তায় রিক্সা টানতে গিয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে। অনাদির কিছুটা অস্বস্তি হতে লাগল। খবরের কাগজ, টেলিভিশনে সে দেখেছে, এই ধরনের বহু সফল যুবক চুরি-ডাকাতি-অপরাধী কার্যকলাপে জড়িত থাকে। ছদ্মবেশের জন্য রিক্সা ঠেলা চালায়, শ্রমিকের কাজ করে। তার মাংসপেশীগুলি দেখেছ কি? এখন রাস্তা-ঘাট শূন্য, সিটি বাসগুলোও দেখা যাচ্ছে না, দোকান-পাট বন্ধ, শহরটির প্রত্যন্ত এইদিকে জনসমাগম এমনিতেও কম। এই বিহারি মানুষটি যদি জানতে পারে যে তার এই নিরীহ যাত্রীর সঙ্গে এক কোটি টাকা আছে, সে কি এমনিতেই অনাদিকে ছেড়ে দেবে? হঠাৎ এখন যদি মানুষটি ভয়ঙ্কর রূপ নেয়, অনাদি কীভাবে আত্মরক্ষা করবে?… টাকাটা রক্ষা করবে? একটা বিড়ম্বনা হবে না কি? পরিস্থিতিটা সহজ করার জন্য অনাদি নিজেকে বলার মতো করে বলল, বহুত গরমি হ্যায় না আজ!

—হা জি বহুত গরমি হায়। দিনভর বহুত ধূপ ভি থা। রিক্সাওয়ালাটাও অস্ফুটভাবে বলল, থক গায়া হু!

বেশি দূরত্ব ছিল না। অনাদি ঘরে পৌঁছে গেল। রুক-কে। ভারী স‍্যুটকেসটা নামিয়ে লিফটের কাছে আসায় রিক্সাওলাটা সাহায্য করল।

—ম্যায় তো বাস পাস মেঁ হি রহতা হু। উস বস্তি মেঁ। ঘর্মাক্ত রিক্সাওয়ালাটা অন্ধকারের দিকে আঙুল দেখিয়ে দিল।
—কিতনা হুয়া ভাড়া?
—বাস দে দিজিয়ে সাহেব, ম্যায় ঘর হি আ রাহা থা। দে দিজিয়ে ৫-১০ রুপেয়া।

অনাদি এক হাজার টাকার নোটটা তার হাতে দিল— রখ লো।

—খুলা নহি হোগা সাহাব। ইতনি তো মেরি মহিনা ভর কি কমাই ভি নহি হোগি… রিক্সার সামনের ল্যাম্পে নোটটা ভাল করে দেখে মানুষটা হাসল। অন্ধকারে কেবল তার দাঁতগুলি দেখা গেল।
—রখ লো।
—নহি সাহাব। পরিশ্রান্ত রিক্সাওয়ালার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। মেহনত করকে কামাতা হুঁ, ভিখ নেহি লুঙ্গা।

তার ঘুরিয়ে দেওয়া এক হাজার টাকার নোটটা হাতে নিয়ে অনাদি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। অন্ধকার এবং নিঃশব্দতায় স্থানুর মতো দুটি মানুষ। কেউ কাউকে ভালভাবে দেখছে না।

—ম্যায় পাস মেঁ হি রাহতা হু সাহাব। রিক্সাওয়ালাটা যেন সান্ত্বনার সুরে অনাদিকে বলল। লে লুঙ্গা কভি!

প্রাচীন ছোট লিফটটাতে ধীরে ধীরে ওপরে উঠে গেল অনাদি। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা স্পর্শ করছে। অনাদি বাথরুমে ভালভাবে মুখ হাত ধুয়ে এল। তাড়াতাড়ি করে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে সোফায় বসল। পাশে কাজল রঙের স্যুটকেসটা।

সময় হয়ে এসেছে। অনাদি প্রস্তুত। পরম আশীর্বাদের মতো এক কোটি টাকা তার হাতে এসেছিল। স্বপ্ন নয়, জালিয়াতি নয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মোহর থাকা এক হাজার টাকার নোটের পরিষ্কার একশোটা বান্ডিল। যে অভাব, ঋণ মধ্যবিত্তীয় নৈরাশ্য তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল এই বিশাল ধনরাশি সেই সমস্ত কিছু থেকে সহজে পরিত্রাণ করতে পারত অনাদিকে।

ঠিক এগারোটা বেজে পনেরো মিনিটের সময় কলিংবেল বেজে উঠল। অনাদি প্রস্তুত ছিল। সে দরজাটা খুলে দিল।

হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন অমিতাভ বচ্চন। স্নেহশীল অভিভাবকের মতো।

—শুভ সন্ধ্যা দত্তজি!
—শুভ সন্ধ্যা বচ্চন মহাশয়। ভারী স্যুটকেসটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে অনাদি বলল— আই অ্যাম সরি। আমি এর একটি নোটও খরচ করতে পারলাম না। অনেক চেষ্টা করেছিলাম। পারলাম না। পুরো এক কোটি টাকা এখানে অক্ষত রয়েছে। আই অ্যাম সরি।

অমিতাভ বচ্চন এক মুহূর্তের জন্য স্থির দৃষ্টিতে অনাদির দিকে তাকিয়ে থাকেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফুটে উঠল অমিতাভ বচ্চনের— মুঝে মালুম নেহি দত্তসাহাব আপ খেলনা নেহি চাহতে হ্যায়, ইয়া ফির খেল নেহি পায়ে।

অনাদি নিঃশব্দে হাসল। কোনও উত্তর দিল না!

—এক কাপ চা খাবেন?

অমিতাভ বচ্চনের ব্যস্ততা ছিল। ব্যস্ত সেলিব্রেটি তিনি। অনাদির এতটা করার জন্য তিনি এসেছেন। স্যুটকেসটা হাতে তুলে নিয়ে তিনি লিফটের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। গভীরভাবে চিন্তিত। যেন ব্যর্থ সন্তানের জন্য উদ্বিগ্ন এক অভিভাবক। লিফতের ঠিক কাছে গিয়ে তিনি অনাদির দিকে ফিরে তাকালেন।

—আপকো কুছ কহনা হ্যায়? অভিজাত মুখ, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চুলের ওপরে রুপোলি স্পর্শ, সমগ্র চেহারায় সযত্নে লালিত এক ধরনের মার্জিত কর্তৃত্ব। কুছ কহেঙ্গে আপ দত্তসাহাব?
—থ্যাঙ্কস ফর এভরিথিং বচ্চন মহাশয়। অনাদি ঈষৎ হেসে বলল। গত চব্বিশ ঘন্টায় আমার উপলব্ধি হয়েছে জীবনের কোনও প্রয়োজনই অ্যাবসলিউট নয়। প্রেম, ঘৃণা, ভালবাসা, এমনকি এই বৈভব, এই কোটি টাকাও কখনও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়তে পারে। আপনি কী বলেন মিঃ বচ্চন?

উত্তরে অমিতাভ বচ্চন অনাদির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। সেই হাসির অর্থ হ্যাঁ বা না দুটোই হতে পারে। টুং করে শব্দ হল, লিফট এসে গেছে। দরজাটা খুলে গেল।

—গড ব্লেস ইউ দত্তসাহেব। ডানহাতটা তার দিকে সামান্য তুলে ধরলেন বচ্চন— শুভরাত্রি।

তারপরে স্যুটকেসটার সঙ্গে্ লিফটে উঠে অমিতাভ বচ্চন অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

—শুভরাত্রি।

অনাদি দরজাটা বন্ধ করে দিল।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...