সভ্যতার বর্জ্য থেকে ফিরে দেখা এক দশক: একটি আইনি খোঁজ

অহনা গাঙ্গুলী

 


এই মানুষ-মারা প্রথার সম্পূর্ণ অবসান ঘটাতে ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আমাদের দেশে একটি আইন পাশ হয়। তবু চিত্রপট পাল্টায়নি; ২০১৩-র আইনটি পাশ হওয়ার পরবর্তী ৫ বছরে (২০১৪-২০১৯) সরকারি হিসেবে ম্যানহোলের নিচে বিষাক্ত গ্যাসে মৃত্যু হয়েছে ৯৪১ জনের। শুধুমাত্র ২০২২ সালে ম্যানহোলে নেমে ২৩৩টি মৃত্যু সরকারিভাবে নথিবদ্ধ হয়েছে, অথচ আইনের আওতায় কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি

 

টিনের তলোয়ার নাটকে মেথরের চরিত্রটি বলেছিলেন— “আমরা কলকাতার তলায় থাকি।” সমাজের এই সত্যিটাকে নাট্যরূপের ভিতর দিয়ে ঠাহর করতে চেয়েছিলেন উৎপল দত্ত। সারা দেহে একরাশ বিষ্ঠা নিয়ে বড় বড় শহরের তলা থেকে উঠে আসা মানুষের চিত্রপট আজও ভারতবর্ষের বুকে বাস্তব। আজও ম্যানহোলের তলায় শ্বাসরূদ্ধ হয়ে মারা যান সাফাইকর্মী, মৃত্যু হয় আধুনিক সভ্যতার, বিজ্ঞানের, সমাজের। অথচ এই মানুষ-মারা প্রথার সম্পূর্ণ অবসান ঘটাতে ২০১৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আমাদের দেশে একটি আইন পাশ হয়— The Prohibition of Employment of Manual Scavengers and Their Rehabilitation Act, 2013. তবু চিত্রপট পাল্টায়নি; ২০১৩-র আইনটি পাশ হওয়ার পরবর্তী ৫ বছরে (২০১৪-২০১৯) সরকারি হিসেবে ম্যানহোলের নিচে বিষাক্ত গ্যাসে মৃত্যু হয়েছে ৯৪১ জনের। শুধুমাত্র ২০২২ সালে ম্যানহোলে নেমে ২৩৩টি মৃত্যু সরকারিভাবে নথিবদ্ধ হয়েছে, অথচ আইনের আওতায় কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। এই আইনি পদক্ষেপের এক দশক পূর্তিতে দাঁড়িয়ে আমার লেখাটি বোঝার চেষ্টা করবে, ঠিক কী কারণে আমাদের সমাজ ঝুঁকিপূর্ণ সাফাইয়ের কাজগুলির সঙ্গে মানুষের শরীর, স্বাস্থ্য, জাতের পরিচয়, এবং দারিদ্র্যের সরাসরি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না।

 

আইনের আয়নায় স্ক্যাভেঞ্জিং

The Prohibition of Employment of Manual Scavengers and Their Rehabilitation Act, 2013— এই আইনটি নিষ্পন্ন করার স্বার্থে The Prohibition of Employment of Manual Scavengers and Their Rehabilitation Rules, 2013 নামে একটি বিধিও পাশ হয়। সুদীর্ঘ নিয়মগুলির মধ্যে দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪ এবং ৫ নং ধারায় যথাক্রমে ৩৪টি এবং ১৪টি সুরক্ষাবর্ম এবং সাফাইযন্ত্রের নাম তালিকাবদ্ধ করা আছে। অথচ সংজ্ঞা বলছে, এই আইন অনুযায়ী কোনও ব্যক্তি যদি বিধিতে উল্লিখিত একটিও যন্ত্র অথবা সুরক্ষাবর্ম ব্যবহার করেন এবং সেই অবস্থায় ম্যানহোলে নামেন অথবা কোনও ঝুঁকিপূর্ণ সাফাইয়ের কাজ করেন, তবে ওই কাজটিকে আর ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং বলা যাবে না। এদিকে গবেষণাসূত্রে দিল্লি এবং কলকাতা শহরে সাফাইয়ের কাজে যুক্ত ৯২ জনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তাঁরা গড়ে ৮-৯টি এমন যন্ত্র বা বর্ম চোখে দেখেছেন এবং ব্যবহার করেছেন, যার মধ্যে কোমরে বাঁধার দড়ি, হেলমেট, কোভিডকালে সকলের সঙ্গী মাস্কও পড়ে। অর্থাৎ আইন অনুসারে, এঁরা ‘স্ক্যাভেঞ্জার’ হলেও, মাস্ক পরে, কোমরে দড়ি বেঁধে ম্যানহোলে নামার সময়ে এঁরা কেউই “ম্যানুয়াল” স্ক্যাভেঞ্জার থাকেন না। অতএব, ম্যানহোলে নেমে জীবন বিপন্ন করে সাফাইয়ের রীতি নিষিদ্ধ তো হয়ইনি, উপরন্তু “শর্তাবলি” পালন করে আইনত এই কাজে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এদিকে, গ্রামভারতের সুপ্রাচীন চর্চা— গ্রামের সবচেয়ে নিচুজাতের মহিলারা পরম্পরা মেনে সকলের বাড়ির পায়খানা সাফ করবেন, মানুষের বিষ্ঠা মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাবেন— এর কোনও উল্লেখ অথবা এটি বন্ধ করার কোনও বিধান আইনে নেই।

অন্যদিকে শহরগুলিতে জনসংখ্যা ও জীবনযাত্রার আতিশয্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। The Energy and Resource Institute (TERI)-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতবর্ষের শহরগুলিতে প্রতি বছর ৬২ মিলিয়ন টন বর্জ্য তৈরি হয়, তার মধ্যে ৪৩ মিলিয়ন টন বর্জ্য মানুষের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়। অতএব, বর্জ্য সাফাইয়ের কাজ শুধুমাত্র ম্যানহোলের গর্তে বা গ্রামের খাটা পায়খানায় আটকে নেই। স্বাস্থ্যক্ষেত্র, জনগণের সুলভ শৌচাগার, রাস্তাঘাট, জঞ্জালের স্তূপ— সাফাইয়ের কাজ চলছে আরও অগণিত ক্ষেত্রে। এর মধ্যে একটি ক্ষেত্রেরও উল্লেখ নেই আইনে। এগুলি লিখতে বসে আমার চোখের সামনে দিল্লির রাস্তার বাস্তবিক ছবিটা ফুটে উঠছে, ছবির মাঝখানে একটা লম্বা ঝাঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে রামবতী। বছর ৪৫-এর এই শ্রমিক, দলিত পরিবারে জন্ম এবং বিবাহ। স্বামী মারা যাওয়ার পরে তাঁর জায়গায় মিউনিসিপ্যালিটির ঠিকা শ্রমিক হিসেবে সাফাইয়ের কাজে যুক্ত হয়েছেন। প্রতিদিন ৫-৬ ঘন্টা টানা রাস্তা ঝাঁট দেন রামবতী, মাঝে আধঘন্টা বিশ্রাম করেন। কুকুর-বিড়ালের মৃতদেহ, স্যানিটারি ন্যাপকিন, বাড়ির পোষ্যের মল— সাফ করতে হয় সবই। ক্রনিক কাশি এবং শ্বাসকষ্টের রুগী হয়ে গেছেন গত ৬ বছরের টানা রাস্তা ঝাঁট দেওয়ার কাজ করে। রোজ খালি হাতে রাস্তার ধুলো-ময়লা পরিষ্কার করতে করতে স্থায়ী চর্মরোগ হয়েছে হাতের তালু জুড়ে। ওঁর জন্য দেশে কোনও আইন নেই। একইরকম জীবন কলকাতার নামী সরকারি হাসপাতালের সাফাইকর্মী সবিতাদি-র। গাইনি ওয়ার্ডের রক্তমাখা তুলো পরিষ্কার করতে গিয়ে হাতে একটি ব্যবহার করা সিরিঞ্জ গেঁথে গিয়েছিল, আমার চোখের সামনে। ছোটাছুটি করে ডাক্তারের পরামর্শে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার পরীক্ষা করাতে বাধ্য হলেন সবিতাদি। যে কোনও দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার হতে পারেন যে কোনওদিন, এভাবেই। রামবতী বা সবিতা, এঁদের কারও জন্য আইন নেই, পুনর্বাসনের প্রশ্ন নেই, মেডিক্যাল নেই, মাত্র ৮-৯ হাজার টাকা মাইনেতে শরীর-স্বাস্থ্য-জীবন বিপন্ন করে শুধুই সাফাই করে যাওয়ার “ডিউটি”-র খাতাতেই কেবল এঁদের নাম আছে। এঁরা দুজনেই সরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত হলেও, নিযুক্ত হয়েছেন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে।

ঐতিহাসিক আইনের দশ বছর পূর্ণ হওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণে এমন হাজারো সাফাইকর্মী আইনি স্বীকৃতির বাইরে থেকে যাচ্ছেন, যাঁদের মধ্যে একটা বিরাট অংশ মহিলা, আর্থ-সামাজিকভাবে প্রান্তিক।

 

সাফাইকর্মী: একটি বিকল্প সামাজিক ও আইনগত বিকল্পনা

ভারতের সামাজিক বিন্যাসের বৃত্তাকার যুক্তিতে, ময়লা পরিষ্কারের কাজগুলি ‘অশুদ্ধ’ কেননা সেগুলি দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ করে থাকেন; আবার দলিতরা সমাজে ‘অশুদ্ধ’ হয়ে থেকে যান, কারণ তাঁরা এই “দূষিত” কাজগুলি সম্পাদন করেন। ফলস্বরূপ দেখা যায়, এই পেশায় নিয়োজিত ৯৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৯৯ শতাংশ মহিলা সাফাইকর্মীই দলিত। অর্থাৎ, “মেথরের কাজ, একটি সামাজিকভাবে দূষিত কাজ”— নিগূঢ়ভাবে বিছিয়ে থাকা এমন সব বিশ্বাস আইনের মাধ্যমে বিধ্বস্ত করার প্রথম শর্ত, সমাজতাত্ত্বিক চিন্তন দিয়ে একে অনুধাবন করা। এই কারণেই জাতপাতের বিভেদ-দুষ্ট মেথরের কাজ ও তার রাজনৈতিক অর্থনীতি বুঝতে আইনপ্রণেতাদের মধ্যে সামাজিক প্রকৌশলগুলি চিনতে পারার ক্ষমতা থাকা জরুরি। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এই অপ্রতুলতার প্রাথমিক পরিণতি হিসেবে সাফাইকর্মী বা মেথরদের যাপনের অভিজ্ঞতাকে কেউ গুরুত্ব দেন না এবং আর্থ-সামাজিক, দ্বিস্তরীয় (মহিলাদের ক্ষেত্রে ত্রিস্তরীয়) শোষণের চাকায় সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে এই প্রান্তীয়করণের শিকার শ্রমজীবীরা ঠিক কীভাবে, কোথায় অবস্থান করছেন, সেকথা বোঝার চেষ্টাটুকুও আইনজ্ঞরা করেন না। তাই এই ধরনের আইনগুলির আক্ষরিক বিষয়বস্তু নিয়ে সমালোচনা করাই একমাত্র সমাধানের পথ নয়। আমাদের আরও সূক্ষ্মভাবে খুঁজে দেখতে হবে, আইনের মান নির্ণায়ক ধারাগুলিতে শ্রেণি, জাতপাত ও লিঙ্গের সামাজিক সমীকরণ, প্রতিদিনকার শ্রমের অভিজ্ঞতা কতখানি প্রতিভাত হচ্ছে। কেননা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এই জটিল অক্ষদণ্ডগুলিই একটি নির্দিষ্ট অংশের মানুষের উপরে বংশপরম্পরায় একটি বিশেষ পেশার বরাত চাপিয়ে রেখেছে; কোনও সরলীকৃত, অগভীর আইন ও বিধান এত জটিল সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে পারে না। বাস্তবেও তাই হচ্ছে, ঠেকানো যাচ্ছে না মৃত্যুমিছিল। তদুপরি, বর্তমানে ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতায় আসীন শক্তিটি তাদের হিন্দুত্বপন্থী, ব্রাহ্মণ্যবাদী মতধারায় ‘দলিত’-‘মহিলা’-‘মেথর’— এই বিশেষ সামাজিক সমাহারকে ঐতিহাসিকভাবে অদৃশ্য করে রাখে। এই অননুমোদন সংসদেও প্রতিফলিত হয় শ্রমদপ্তরের ঘোষণায়: ‘দেশে কোনও ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জার নেই’।

তবু এই তীব্র অস্বীকৃতির মাঝে, এই অমানবিক পেশার উপস্থিতি আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। সেই বিশ্লেষণের মাধ্যমেই শ্রেণি-লিঙ্গ-জাতপাত-এর প্রতি সংবেদনশীল চিন্তন নির্মিত হবে। ম্যানহোল থেকে জঞ্জালের স্তূপ— ছড়িয়ে থাকা সাফাইকর্মীদের উপর হয়ে চলা সামাজিক অস্পৃশ্যতা, অন্তরণ, বঞ্চনা, এবং মৃত্যু— বন্ধ করার উদ্দেশ্য নিয়ে সর্বস্তরের আন্দোলন জোরদার হোক। এতেই আগামী দশক একটু কম বৈষম্যময় হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. মানুষ একটু দরদ দিয়ে ভাবতে শিখুক এই প্রান্তিক মানুষগুলোর জন্য, এঁদের বাদ দিয়ে সমাজ অচল, তাই এঁদের বাঁচার লড়াইয়ে আমাদের সকলকে সাথ দিতে হবে।
    এরকম লেখা আরও আসুক, অনেক কৃতজ্ঞতা লেখিকার প্রতি, পত্রিকার প্রতি।

আপনার মতামত...