
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
গত বছরে ২৩ জন কোটা-শিক্ষার্থী প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক প্রত্যাশার বিপুল চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। নিরন্তর সাফল্যের হাতছানি দিয়ে শিক্ষার্থীদের চাগিয়ে রাখতে গিয়ে কোচিং সেন্টারগুলো জীবনের আনন্দ থেকে তাদের বঞ্চিত করছে। আজকের কোটা-বিমুখতা তারই অনিবার্য প্রতিফল
শীর্ষ বিষয়টি নিয়ে সামান্য কিছু লেখালেখি করাটা আমার কাছে নতুন নয়। প্রায় কাছাকাছি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে একাধিক নিবন্ধ লিখেছি। তবুও খুব প্রাসঙ্গিক কোনও বিষয় অন্য সব তাৎক্ষণিক বিষয়ের দাপাদাপিতে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে, এমনটাও হয়। তখন তাকে নিয়েও শুরু হয় দড়ি টানাটানি। এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু অনেকটাই হয়তো সে-রকম।
গ্লোবালাইজেশনের যুগে সবকিছুরই এখন বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসার ঘটেছে। সবকিছুকেই এখন দেখা হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে প্রফিট মেকিং বা লাভালাভের দৃষ্টিকোণ থেকে। চতুর্দিকের বাতাবরণে যখন এমন ভাবের পুষ্টি সাধনের আয়োজন, তখন শিক্ষা কি আর পিছিয়ে থাকতে পারে? না পিছিয়ে থাকাটা সঙ্গত? একটা সময় শিক্ষার সঙ্গে লাভ, মুনাফা ইত্যাদি শব্দকে জুড়ে দেবার কথা চিন্তাতেও ঠাঁই পেয়েছে বলে মনে হয় না। মুনাফা শব্দটির অবশ্য অন্য অর্থব্যঞ্জনা ছিল সেকেলে সমাজে। সকলে না হলেও মাস্টারমশাইদের একটা বড় অংশ মনে করতেন একজন সুন্দর পরিপূর্ণ মানুষের নির্মাণই হল তাঁর ঐকান্তিক জীবনসাধনা, ফল দিয়ে যেমন গাছের পরিচিতি, একজন ছাত্রকে দেখেও সমাজ বুঝতে পারে তাঁর অমন নির্মাণ কোন্ রূপকার শিক্ষকদের নিরলস নিবিড় নির্মাণের ফসল।
পণ্যবাদী বিশ্বায়নের যুগে এমন পরিচিতির বিষয়টি একেবারেই উধাও হয়েছে তা হয়তো নয়। তবে এক্ষেত্রে স্কুলের মাস্টারমশাইদের পেছনের সারিতে ঠেলে দিয়ে সামনে এগিয়ে এসেছেন গৃহশিক্ষকেরা, কোচিং সেন্টারের স্যার ও ম্যামরা। শিরোপা পাওয়া কোনও ছাত্র বা ছাত্রী অবলীলায় ঘোষণা করে— আমার এই সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা অমুক পাবলিশার্স প্রকাশিত সহায়ক পুস্তক ও প্রশ্ন ব্যাঙ্কের। সত্যিই কী বিচিত্র এই দুনিয়া!
কোচিং সেন্টারের কথাই যখন ঘটনাচক্রে উঠে এল তখন দেশের ‘কোচিং হাব’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া কোটা শহরের কথা বাদ যায় কেন? হাল আমলের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সেরা পীঠস্থান নাকি হল রাজস্থানের এই শহর। সাম্প্রতিক নিট পরীক্ষার কেলেঙ্কারির কারণে কিনা জানি না, এই পীঠভূমিতে পাঠগ্রহণে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সংখ্যায় এ-বছর প্রবল ভাঁটার টান লেগেছে। পরিসংখ্যানে জানা গেছে বিগত বছরের তুলনায় এই বছরে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী কম ভর্তি হয়েছে কোটার তথাকথিত মোক্ষদা কোচিং সেন্টারগুলোতে। আর তাই হাহাকারের আর্তনাদে গোটা কোটা শহর শোক আর আশঙ্কায় মুহ্যমান।
এই মুহূর্তে কোটার রাস্তায় রাস্তায় ব্যস্তবাগীশ শিক্ষার্থীদের ভিড় নেই, হরেক কিসিমের দোকানে দোকানে অনর্গল গুলতানিতে মুখরিত কচিকাঁচা মুখগুলোর দেখা নেই, অটোরিকশায় চড়ার জন্য উন্মুখ ছেলেমেয়েদের দীর্ঘ লাইন নেই— সর্বত্রই কেমন একটা ‘সান্নাটা’ ছেয়ে আছে। কোচিং সেন্টারের কর্পোরেট কর্ণধারদের কণ্ঠে শুধু নয়, শিক্ষা বেওসার নানান কৃতকর্মের সঙ্গে যুক্ত বড়-মাঝারি-ছোট, সব শ্রেণির কারবারিরাই আজ খানিকটা বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। ঝানু ব্যবসায়ীরা অবশ্য জানেন যে কারবারে এমন ওঠানামা থাকেই। তাই তাঁদের অনেকেই রীতিমতো গোয়েন্দাসুলভ দৃষ্টিতে পরিস্থিতির জল মাপছেন, কিন্তু কোটার শিক্ষা বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত বহুসংখ্যক ব্যবসায়ীদের কপালের ভাঁজ ক্রমশই চওড়া হতে শুরু করেছে একটু একটু করে। প্রশ্ন জাগছে, তাহলে কি কোটার কোচিং সেন্টার-কেন্দ্রিক শিক্ষা-অর্থনীতির মন্দা শুরু হল?
শিক্ষা বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে একটু খোঁজখবর করা যাক্। ধরুন কোনও এক অপরিচিত, স্বল্পপরিচিত বা পরিচিত স্থানে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হল। এদেশে শ্রদ্ধালু মানুষের জোগানে তো কোনও ঘাটতি নেই; তাই মন্দিরের ঘন্টার আওয়াজ চারপাশের পাঁচজনের কানে পৌঁছতেই মন্দিরের আশেপাশে এসে হাজির হল ফুলের পসারিরা, পুজোর নানারকম দশকর্ম উপকরণ বিক্রেতারা, হাজির হলেন মিষ্টির দোকানের মালিকেরা, মন্দির দর্শনে যেসব ভক্তমানুষেরা আসবেন তাঁদের নানানরকম পরিষেবা দেওয়ার জন্য উপস্থিত হন আরও বেশ কিছু মানুষজন যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ভক্তদের জুতো সামলাবেন, কেউবা সাইকেল বা গাড়ির দেখভাল করবেন; ভক্তরা তো আর খালিপেটে ধম্মো করবেন না, ভক্তিভরে পুজো দিয়ে নিজের ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের খাওয়াদাওয়ার জন্য একাধিক খাবারের দোকান তৈরি হবে, মন্দিরের পরিসর বাড়লে বাড়বে আরও আরও দোকান বা ব্যবসার আয়োজন। মনে রাখবেন এই ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত মানুষজন কিন্তু ওই মন্দিরের ওপরই নির্ভরশীল। এ এক আশ্চর্য শৃঙ্খলা, এক নিগূঢ় সিমবায়োসিস।
কোটা শহরের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনি ঘটেছিল একদম গোড়ার দিকে। চম্বলের তীরবর্তী কোটা শহর একেবারেই অপরিচিত জায়গা, তা কিন্তু মোটেই নয়। একটু ইতিহাস ঘাটলে দেখব এই শহরের একটা গৌরবময় সাংস্কৃতিক পটভূমি রয়েছে। রয়েছে অত্যাধুনিক বয়নশিল্প। তবে এসব ছাপিয়ে মাটির গভীরে থাকা মার্বেল পাথরের উত্তোলন এই শহরের অর্থনীতিকে দ্রুত অন্যখাতে বইয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। অবশ্য তার জন্য বিপুল পরিমাণ পরিবেশগত খেসারত দিতে হয়েছে এই জেলার মানুষজনকে। তবে পরিবেশ নিয়ে এই পোড়া দেশের মানুষদের আর কবে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা প্রকাশ পেয়েছে? সবার মুখেই এই বিষয়ে এক কথা, “গোলি মারো পরিবেশকো”।
এহেন কোটায় সরস্বতী মায়ের আসন পাতা হল ১৯৮৫ সালে ভিকে বনশল মশাইয়ের হাত ধরে। কোটা শহরের JK Synthetics Limited-এ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত এই মানুষটির প্রচেষ্টায় স্থাপিত হল বনশল ক্লাসেস নামের প্রতিষ্ঠানটি যার উদ্দেশ্য ছিল জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার মাধ্যমে সম্ভাব্য IIT যোগদানেচ্ছু শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। কিছুদিনের মধ্যেই বনশল ক্লাসেস প্রাইভেট লিমিটেড নাম নিয়ে তা আত্মপ্রকাশ করলেও ২০০৭ সাল থেকে তাদের নতুন প্রতিষ্ঠানটি ভাইব্রেন্ট নামের মোড়কে নতুন করে ভাইব্রেশন তৈরি করে চলেছে অগণিত শিশিক্ষু (!) ছাত্রছাত্রী ও তাদের মুমুক্ষু অভিভাবকদের হৃদ-দরিয়ায়। বনশল মশাইয়ের উদ্দেশ্য কি ছিল শিক্ষার বিস্তার বা সাধারণ পরিবারের ছেলেমেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য স্বেচ্ছায় প্রস্তুতিতে সাহায্য করা? মোটেই তা নয়। তিনি চেয়েছিলেন বাড়তি কিছু আয়ের সূত্রে সমাজে নিজেকে অন্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। সরস্বতীর আখড়া স্থাপন করে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে। সুতরাং সেকালের বনশল ক্লাসেস বা এ-সময়ের ভাইব্রেন্টের মূল লক্ষ্যই হল প্রশিক্ষণের নামে বেওসা করা। আলো জ্বাললে যেমন কীটপতঙ্গের অভাব হয় না, ঠিক তেমনি বনশল মশাইয়ের ক্লাসের টানে ভিড় করতে শুরু করল মুমুক্ষু শিক্ষার্থীরা। একে একে ভিড় বাড়াল আরও আরও শিক্ষাব্যবসায়ী সংস্থা, নামের ঝলকানি আর বিজ্ঞাপনের মুগ্ধতায় যারা টেনে নিয়ে এল দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানান স্তরের শিক্ষার্থীদের। পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে অভিভাবকরা সন্তানদের কল্যাণার্থে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন কোটা ফ্যাক্টরিতে। এই মুহূর্তে প্রায় ১৫০টির মতো কোচিং প্রতিষ্ঠান স্কুল-কলেজের বাইরে আগামী প্রজন্মের কৃতী শিক্ষার্থীদের জন্য নিবিড় তালিমের আয়োজন করেছে। এজন্য অভিভাবকদের বাড়তি কিছু ব্যয় করতে হচ্ছে বটে, তবে কে না জানে— “বিনিয়োগে বসতে লক্ষ্মী”। আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা উজ্জ্বল আগামীদিনের জন্য যে কৃচ্ছসাধন করছে, তা তো হাজার বছরের তপস্যার সামিল। এ কি সোজা ব্যাপার ভায়া! ইয়ে কোটা কি বাত হ্যায় ভাইয়া। ইয়ে হ্যায়, জিন্দেগি বদলনে কা খেল! ফেলো কড়ি, মিলবে তেল।
আমার এক পরিচিতজনের অভিজ্ঞতার কথা বলি। ভদ্রলোক, ধরা যাক তাঁর নাম গণপতি, একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টস্ বিভাগে কাজ করেন। একটিই ছেলে, সুতরাং গোড়া থেকেই ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভারি তৎপর। ছেলে যখন ক্লাস সেভেনে তখন থেকেই পড়িমরি করে ছেলেকে কোটায় পড়তে পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। ক্লাস এইটে উঠতে না উঠতেই ছেলেকে বগলদাবা করে, বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে নিয়ে কর্তা-গিন্নি সোজা স্বপ্নপুরী কোটার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। আমি একবার নিতান্তই কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম— “শানু ওখানে চলে গেলে এখানকার স্কুলের কী হবে?” “ওসব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। স্কুলে একটা টাকা ধরে দিলেই চলবে। ওরা সব ব্যবস্থা করে নেবে।” গণপতির স্মার্ট জবাব। কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই মিটল তেমন নয়। মাস কয়েক যেতে না যেতেই গণপতির সঙ্গে একদিন বাজারে দেখা। সোৎসাহে ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই কেমন মিইয়ে যাওয়া স্বরে সে উত্তর দেয়— “চলছে, তবে বড্ড খরচ। এমন হবে বুঝতে পারিনি। খরচের বহর সামাল দিতে গিয়ে আমরা তো এদিকে হিমসিম। এবার গিয়ে দেখি, ছেলেটা সবসময় কেমন ভয়ে চুপসে আছে। এ সবই আমার ভুলের ফসল। ভাবছি নিয়ে আসব। চলি দাদা।” বিড়বিড় করতে করতে গণপতি চলে যায়। আমি আর কী জবাব দেব? খালি মনে মনে বললাম, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’
কোটা ক্ষইছে। কমছে তার মনোহারিনী মায়া। এটা শুধু যে কথার কথা নয় তা যেন নতুন করে বুঝতে পারছে কোটার শিক্ষা-বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে জড়িত সমস্ত পক্ষ। এ-বছর প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কম ভর্তি হওয়ায় ঘুম ছুটে গেছে কোটার কোচিং সেন্টারগুলোর ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল সমস্ত সহযোগী ব্যবস্থাপকদের, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত নানান ধরনের কর্মচারী, মেসবাড়ির মালিক, বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসায়ী, খাবারের দোকানের মালিকেরা, স্টেশনারি শপের দোকানদার, ফ্ল্যাটের ব্রোকার, সহযোগী কোচিং ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য মানুষ এবং পরিবহনকর্মী তথা মালিকরা। বেশ কিছু ডাক্তারবাবু ও দাওয়াইখানার মালিকদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ ক্রমশই চওড়া হচ্ছে। মোদ্দা কথাটা হল এই যে, কোটা ফ্যাক্টরিতে মন্দা মানেই হল কোটার শিক্ষা অর্থনীতির মন্দা। এতদিন প্রায় ২০০০০০-এর বেশি ছাত্রছাত্রীদের সংযুক্ত কলতানে মুখরিত কোটা শহরে এবার ভর্তি হয়েছে কমবেশি ১২০০০০ জন। খুব নামডাকওয়ালা কোচিং সেন্টারের তুলনায় মাঝারি মানের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রভর্তির হার খুব কম, প্রায় শূন্যের কোঠায়। এমন ব্যাপক ছাত্র ছাঁটাই ৬০০০ কোটির কোচিং অর্থনীতির ওপর অমাবস্যার আঁধার নামিয়ে এনেছে সহসাই। এই পরজীবী বা প্যারাসাইটিক অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিণতি হয়তো এমনই হওয়া স্বাভাবিক।
কথা হল কোটা কি আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? এ-প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। ঢালের ওপরে থাকা কিছু গড়াতে শুরু করলে তাকে যেমন রোখা সহজ নয়, কোটার এই আকস্মিক পতনকে ঠেকানো খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। এর মধ্যেই কোচিং সেন্টারের ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের সাম্মানিকে প্রায় ৪০ শতাংশের মতো কাটছাঁট করা হয়েছে। নন-টিচিং স্টাফদের অনেকেই চাকরি খুইয়েছে। আগামী দিনে কার ঘাড়ে কতটা কোপ পড়বে তাই ভেবে আতঙ্কিত সকলেই। কোটার কোচিং অর্থনীতির রবরবা দেখে যাঁরা একদা উন্নয়নের ডঙ্কা বাজিয়েছিলেন, আজ তাঁদের অনেকেই বাক্যহীন, বিমর্ষ, বিমূঢ়।
কেন এমন হল? প্রশ্নটা সহজ, তবে এর উত্তর কিন্তু মোটেই সহজ নয়। গত বছরে ২৩ জন কোটা-শিক্ষার্থী প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক প্রত্যাশার বিপুল চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে। পড়ার চাপে নিজেকে শেষ করে দেওয়া কখনওই বাঞ্ছনীয় নয়, অথচ তেমনই ঘটেছে। এমন ঘটনার পেছনে এক শ্রেণির স্বপ্নবিলাসী অভিভাবকের ভূমিকা অত্যন্ত নিন্দনীয়। নিজের ছেলেমেয়েদের কোচিং সেন্টারের হাতে সঁপে দিয়ে তাঁরা ভাবতে শুরু করেন যে আর কোনও দায় নেই তাঁদের। এমনিতেই সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন সাধারণ কোচিং সেন্টার থেকে শুরু করে বড় বড় কর্পোরেট এডু-মাফিয়াদের হাতে চলে গিয়েছে। তার ওপর কোচিং সেন্টারের ওপর ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের দায় সঁপে দেওয়া উদাসী শ্রেণির অভিভাবকদের ওপর বাড়তে থাকে কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থাপকদের চাপ। সেই চাপ গিয়ে পড়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর। জীবনের সমস্ত রং, রস, রূপ, বর্ণ, গন্ধ, আনন্দকে দূরে সরিয়ে রেখে কেবলমাত্র একমুখী পথচলা কখনওই কাম্য হতে পারে না। অথচ কেরিয়ার গড়তে গিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত তাই করে যাচ্ছি বিরামহীনভাবে। এসবের শিকার হয়ে আজ যদি কিছু সংখ্যক মানুষ কোটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এটাই স্বাভাবিক। কী বলছেন অভিভাবকরা কোটার এই বিয়োগান্তক পরিণতি প্রসঙ্গে? আসুন শুনে নেওয়া যাক্।
কোটার অসাধারণত্বের খ্যাতি যা এতদিন সবাইকে একরকম মোহগ্রস্ত করে রেখেছিল তা ঢাকা পড়ে গেছে ধারাবাহিক মৃত্যুর দুঃখজনক খবরের আড়ালে। আমরা আমাদের সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যকে কয়েকটি বাড়তি নম্বরের জন্য আর বাজি রাখতে পারি না।
—সুমতি দাস, কলকাতা
.
আমাদের ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তা ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতভাবেই প্রাথমিকতা পাবে। কোটায় ঘটে যাওয়া পরপর আত্মহত্যার ঘটনায় আমরা সবাই এতটাই মর্মাহত যে ভবিষ্যতে সন্তানদের কোটায় পাঠানোর পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি।
—ভুবন রাই, রৌরকেল্লা
.
কোনও সাফল্যই আমাদের সন্তানদের ভাল থাকার চেয়ে বড় নয়। আমাদের চোখের সামনে অনেক অনেক মূল্যবান জীবনকে কোটাতে ঝরে যেতে দেখেছি অমানুষিক চাপের কাছে, সুতরাং এখন বাড়ির কাছেই সন্তানদের বিকল্প প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে।
—পল্লবী মিশ্র, পাটনা
.
অভিভাবকদের এমন চিন্তাভাবনা কি তাঁদের বিলম্বিত বোধোদয়ের ইঙ্গিতবাহী? জানি না। তবে তাঁদের কেউই কোচিং সেন্টারের বাহুপাশ থেকে সন্তানদের সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করার কথা এখনই ভাবছেন বলে মনে হয় না। নিরন্তর সাফল্যের হাতছানি দিয়ে শিক্ষার্থীদের চাগিয়ে রাখতে গিয়ে কোচিং সেন্টারগুলো জীবনের আনন্দ থেকে তাদের বঞ্চিত করছে। আজকের কোটা-বিমুখতা তারই অনিবার্য প্রতিফল। স্বপ্নবিলাসে মজে থাকতে ভালবাসা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা সহজেই এই ফাঁদে পা দেয়। ঘটিবাটি বিক্রি করে, অনেক আশা নিয়ে তাঁরা সন্তানদের পাঠান কোটার বধ্যভূমিতে। হায় রে জীবন! হায় রে শিক্ষা! এই ভয়ঙ্কর জাল থেকে আমার আপনার আমাদের সন্তানেরা কি কখনও মুক্ত হতে পারবে?
কোটার এই আকস্মিক পতনকে কোন চোখে দেখছেন ওখানকার বিদ্যাব্যবসায়ীরা? কোটার এক পরিচিত কোচিং সেন্টারের কর্ণধার প্রমোদ মাহেশ্বরীর মতে— “একেবারে শুরুতে, যখন কোটায় কোচিং সেন্টারের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা, তখন পড়াশোনা তথা প্রশিক্ষণের বিষয়টাই প্রধান ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোচিং সেন্টারের সংখ্যা যত বেড়েছে ততই বেড়েছে আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক প্রতিযোগিতা, রেষারেষি। ফলে পড়াশোনাকে পেছনে ফেলে, দূরে সরিয়ে সামনে এসেছে অর্থ কামাইয়ের উদগ্র আগ্রহ। কোটার অবনতি শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই।” তবে তাঁদের মনে হচ্ছে এই বিমুখতা সাময়িক। কোটার সুদিন আবার ফিরে আসবে। এজন্য ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ নিতে হবে সংশ্লিষ্ট সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে, কেননা এখনই ব্যবস্থা না নিলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ফাঁকা হতে সময় লাগবে না। তাঁদের অনেকেই মনে করছেন, আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে মিডিয়ায় বাজার গরম করা প্রচার অভিভাবকদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অন্যতম কারণ। কোটা নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরির বিষয়টি দেশের মানুষের কাছে ভুল বার্তা দিয়েছে। এসব কাটিয়ে উঠতে হবে। নাহলে…
কোটার কোচিং ব্যবসার আশ্চর্য উত্থানে প্রাণিত হয়ে রাজস্থানের আরও দুই শহর এই বিদ্যাব্যবসায় নেমে পড়েছে কোমর বেঁধে। এই দুই শহর হল রাজধানী জয়পুর এবং শিকর। সাম্প্রতিক নিট পরীক্ষায় নাকি শিকর শহরের সাফল্য শিহরিত করেছে সকলকে। অতএব কোটা থেকে কেটে উঠে সব পানসির অভিমুখ কি এখন জয়পুর বা শিকরমুখী? নজর রাখতে হবে। অনেকেই হয়তো মনে করেন যে বাতাস এখন ভিন্মুখে বইতে শুরু করায় কপাল কুটছে কোটা। সত্যিই কি বিচিত্র এই দেশ! কারও পৌষমাস, কারও সর্বনাশ!
জয়পুর ও শিকর শহরের কোচিং ব্যবসার জন্য যে ঝাঁ চকচকে পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে, তা দেখলে দেশের তাবৎ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চোখ যে কপালে উঠবে তা আমি হলফ করে বলতে পারি। একটু খুঁজে দেখে নিতে পারেন। শিকরের বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি মেম্বারদের ঠিকুজি-কুলুজি বুকে নিয়ে ঢাউস সাইজের গ্লোসাইন বোর্ডগুলো জ্বলজ্বল করছে রাজসড়কের দুধারে। উদ্দেশ্য অপরিবর্তিত— আলেয়ার আলো দেখিয়ে তাঁবুর ভেতরে লোকজনকে টেনে আনা। এইসব প্রবল পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময় দ্বিগ্বিজয়ী স্যারদের ছাতার নিচে ঠাঁই পেলে মোক্ষলাভ কেবল “দো মিনিট কা খেল্। বাবুয়া! পরখকে দেখো! জয়পুর ও শিকরের দিকে তৃষিত নয়নে এখন শুধুই চেয়ে থাকা।
এইসব ডামাডোলের মধ্যে রাজস্থানের বর্তমান সরকার কোচিং সেন্টারের তথাকথিত প্রচারসর্বস্ব অনৈতিক কাজকর্মে রাশ টানতে একটা বিল আনতে চলেছে। Rajasthan Coaching Centre (Control and Regulation) Bill 2024. এই বিলের মূল লক্ষ্য হল আগাছার মতো গজিয়ে ওঠা তথাকথিত কোচিং হাবগুলোকে কিছু সুনির্দিষ্ট বিধিনিয়মের আওতায় আনা। তবে নতুন আইন আসতে চলেছে জেনে কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থাপকদের পক্ষ থেকে শিক্ষার স্বাধিকার সঙ্কোচনের মতো গুরুগম্ভীর কথাবার্তাও বলা শুরু হয়ে গেছে। জল কতদূর গড়ায় এখন তাই দেখার।
কথায় কথায় অনেক কথাই বলে ফেললাম। আজ শেষ করব কয়েকটি টুকরো মন্তব্য দিয়ে।
প্রিয় ছাত্ররা, দয়া করে এই ফাঁদ থেকে নিজেদের দূরে রাখো… ওখানে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই… জীবন উপভোগ করো… জীবনযাপনের দক্ষতা বাড়িয়ে তোলো… কোচিং সেন্টার ও কোটাকে না বলো।
.
কোচিংমাফিয়া, মেসমালিক, হোস্টেলমালিক ও অটোরিকশাচালকেরা সবাই কামধেনু মনে করে এই সুকুমারমতি শিক্ষার্থীদের দোহন করে গেছে নিজেদের ঘৃণ্য ব্যবসায়িক স্বার্থে। ছি!
.
অবশেষে, অনেক প্রাণের বিনিময়ে ভারতের অভিভাবকদের হুঁশ ফিরছে। তাঁরা কোচিং সেন্টারের কাছে তাঁদের বন্ধক রাখা বিবেক ফিরে পাচ্ছে।
.
মনে রাখবেন জীবন ওই ঘুপচি কোচিং সেন্টারের থেকে অনেক অনেক অনেক বড়।
জীবনের থেকে থেকে বড়ো কিছু নয়। এই সত্যটা বুঝতে পারলে এভাবে কখনোই কোটার প্রতিষ্ঠানগুলোর দুয়ারে মাথা কুটতে হয় না। একেরপর এক মৃত্যু আমাদের সামান্যতম সচেতন করতে পারে নি। আমাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে কোচিং সেন্টারের ব্যবসা। এখন ব্যবসায় মন্দা বলে সবারই হাহুতাশ শুরু হয়েছে।
লেখাটা পড়ে এমন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে মোহভঙ্গ হবে বলে মনে হয়। লেখককে অনেক ধন্যবাদ।
দেরিতে হলেও নিজেদের অপূর্ণ স্বপ্নের ভার সন্তানদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া অভিভাবকদের বোধোদয় হচ্ছে দেখে ভালো লাগলো। শিক্ষা ব্যবসায়ীদের দোষ দেওয়া যায় না। ব্যবসায়ীদের কাজই তো অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে আকাশ কুসুম বিজ্ঞাপনের ফাঁদে খদ্দের ধরা। শেষে যে আশঙ্কা করেছেন, সেই পানসি অন্য শহরের দিকে ঘুরে না গেলেই মঙ্গল!
স্টুডেন্ট কম হয়েছে শুনে আনন্দ পেলাম।লেখককে ধন্যবাদ।