তিলোত্তমার ধর্ষক

রাহুল রায়

 


এই প্রক্রিয়ায় মেয়েদের কি খালি ধর্ষিত হওয়া ও ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ বলে কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কোনও ভূমিকা নেই? অবশ্যই আছে। এর জন্য চাই সমাজের মানসিক পরিবর্তন যা বকলমে পুরুষদের মানসিক পরিবর্তন আনা যে, নারীরা তাদের অধিকারের ও উপভোগের বস্তু নয়। এটা একটা যুদ্ধ। আর এ সহজ যুদ্ধ নয়। আরজিকরের ঘটনা ও তার পরিপ্রেক্ষিতে বয়স, জাতি, ধর্ম-নির্বিশেষে অসংখ্য মেয়েদের প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হওয়া অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু শুধু প্রতিবাদ জানিয়ে এর শেষ হওয়ার কথা নয়। এর জন্য চাই ক্রমাগত প্রচেষ্টা— তা জুডিশিয়াল, লেজিসলেটিভ, ল অ্যান্ড অর্ডার ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যে দিয়েই চালিয়ে যেতে হবে

 

অধিকাংশ লোকই রাজনীতি নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলতে ভালবাসে। ‘না, বাব্বা, আমি পলিটিক্স নিয়ে আলোচনা করতে রাজি নই।’ যেন সেটা বাঘ-ভাল্লুক, খেয়ে ফেলবে। অন্যদিকে আমার রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় ভীষণ উৎসাহ। আমাদের বাড়িতে আমার মা-র কল্যাণে রাজনৈতিক আলোচনা সবসময়ই চলত, তার সঙ্গে চলে আসত সামাজিক অনাচার, অবিচার, কুসংস্কার ইত্যাদির কথা— কেন এটা হবে, ওটা হবে না, এর জন্য কে দায়ী, এটা ঠিক করতে কী করা দরকার— এসব ছিল নিত্য-আলোচনার ব্যাপার। তাই নিয়ে বড় হওয়া। সক্রিয়ভাবে রাজনীতিও করেছি। তারপর আমেরিকায় এসে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সেনেট-কংগ্রেস–প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের জন্য প্রচার করেছি। এমনকি ওবামার জন্য বাড়ি–বাড়ি কড়াও নেড়েছি।

তিলোত্তমা ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে কলকাতায় যে আন্দোলন চলছে এতদিন ধরে, আর এত লোক এতে সামিল হয়েছে তার কোনও উদাহরণ আছে কিনা আমার জানা নেই। প্রফুল্ল সেনকে নির্বাচনে হারিয়ে যখন বামফ্রন্ট প্রথম সরকার গঠন করে তখন আমি খুব ছোট। তখনকার বিশাল উদ্দীপনার কথা মনে আছে। ল্যাম্পপোস্ট থেকে কাঁচকলা (কেন মনে নেই), জুতো এসব ঝোলানো হয়েছিল তা মনে আছে, আর মিছিলের পর মিছিল। তবে সে কদিনের জন্য। তাছাড়া তাতে সবাই যোগ দেয়নি। সুতরাং তিলোত্তমা-আন্দোলনের বিস্তার তার ছিল না। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মাথায় রাখতে হবে যে এখন ফেসবুক ইত্যাদি সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে খবর এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তার কোনও নজির আগে ছিল না। তখন ছিল মুখের খবর বা দেওয়ালের পোস্টার। তাই দেখে বা শুনে লোকে জানতে পারত। আর এখন সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রায় সবার কাছেই খবর পৌঁছে যায় দ্রুত— ছেলে-বুড়ো, রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, সমাজ-চেতনা বা সমাজ-চেতনা ছাড়া সবার কাছে।

মাস দুয়েকের বেশি হতে চলল আন্দোলন চলছে। স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলন-‘ফেটিগ’ শুরু হয়েছে। সবার মনেই একই প্রশ্ন— এর শেষ কোথায়? এর উত্তর মোটেই সহজ নয়।

তিলোত্তমা ধর্ষণ ও হত্যা যদি কোনও একক ব্যাপার হয়, আর হত্যাকারী বা হত্যাকারীদের ধরে, দ্রুত বিচারের পর শাস্তি দেওয়া হয়, যা মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে, তাহলে ব্যাপারটা মিটে যায়। সোজা হিসেব। কিন্তু কয়েক বছর আগে নির্ভয়ার ধর্ষণের অপরাধীদের বিচারের পর ফাঁসি দেওয়ার পরও কি ধর্ষণের ঘটনা কমেছে? তাহলে সমস্যা শুধু বিচার ও তার নির্ধারিত শাস্তি— তা নয়।

পুরোপুরি জানা না গেলেও এটা বোঝা যাচ্ছে যে কেঁচো খুঁড়তে হয়তো সাপ বেরিয়েছে। অর্থাৎ যা প্রথমে মনে হয়েছিল যে শুধু মৃতা ও তার খুনি বা খুনিরা এর মধ্যে জড়িত আছে তা বোধহয় নয়। মৃতা অজান্তেই এক মধুচক্রে ঢিল ছুড়েছে, অর্থাৎ সে এমন কিছু ব্যাপার জানতে পেরেছে যা তার জানার অধিকার ছিল না। শরীরের অঙ্গ, নারীপাচার ইত্যাদির কথা উঠেছে। কথা উঠেছে আরজিকরের সুপারিন্টেন্ডেন্ট, এমনকি বর্তমান তৃণমূল সরকারও এর মধ্যে জড়িত। এ সবই ‘অ্যানেকডোটাল’ যা আইনের মুখে দাঁড়াতে পারে বা নাও পারে। তবে অভিযোগ যদি সত্যি হয় তাহলে দোষীদের বিচার করে শাস্তি দিয়ে, মধুচক্র ভেঙে দিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। পূর্বোক্ত নির্ভয়ার ঘটনায় পুলিশ ও বিচারবিভাগের তৎপরতা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তাতে ধর্ষণ কমে গেছে এমন মনে হয় না। তাহলে সমাধান শুধু ল অ্যান্ড অর্ডার-এর এক্তিয়ারের মধ্যে নেই।

আর অভিযোগ, তা সত্যি বা মিথ্যে যাই হোক না কেন, নানা কারণে বর্তমান সরকারকে ফেলে দিয়ে কেন্দ্র থেকে রাজ্যপালের শাসন আনার দৃষ্টান্ত যথেষ্ট আছে। তারপর অন্য সরকার আসবে। কিন্তু তাতে কি ধর্ষণের ঘটনা কমবে? মনে হয় না। তাহলে সমাধান শুধু লেজিসলেটিভ, তা নয়। অর্থাৎ বিধানসভা, লোকসভায় আইন করে, সরকারি ফতোয়া দিয়ে, এক সরকারের বদলে আর এক সরকার এনে এর সমাধান করা যাবে না।

ধর্ষণের ঘটনা কমাতে গেলে তার কারণ ও তার জন্য আসল দোষী কে তা আগে জানা দরকার। যৌনসঙ্গম জীবজগতের অন্যতম প্রধান ধর্ম, কারণ এ ছাড়া আমরা কেউই এই জীবনের মুখ দেখতাম না। আর যৌনসঙ্গমে আনন্দ পাওয়া সর্বজনবিদিত, এমনকি মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য তা প্রয়োজনীয়— এ বিজ্ঞানস্বীকৃত। কিন্তু যখন এই প্রক্রিয়ায় একজন অপারগ বা অরাজি থাকে তখন তা ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে।

এই পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজই পুরুষ-শাসিত, তাই জোর করে মেয়েদের সঙ্গমে লিপ্ত করার ঘটনা বা ধর্ষণের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি মুষ্টিমেয় পুরুষ-ধর্ষণের চেয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হল সমাজে, বিশেষ করে ভারতীয় সমাজে এটা কী করে পুরুষের অধিকারের পর্যায়ে পড়ল, আর কী করেই বা তা ধর্মীয় রীতি-নীতির আওতায় এসে পড়ল?

ভারতীয় সমাজ আধা-সামন্ততান্ত্রিক, আর তা ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে কঠোরভাবে ঘিরে দেওয়া। সামন্ততন্ত্রের প্রধান কাজ গায়ের জোরে প্রভাব বিস্তার করা অন্য সামন্ত থেকে শুরু করে সাধারণ প্রজার ওপর। আর নিজের ঘরে ও সমাজে তা হল মেয়েদের ওপর— তা নিজের স্ত্রী, মা বা অন্য যে-কেউ। মেয়েরা শারীরিকভাবে পুরুষের চেয়ে খাটো, তাই জোর করে প্রভাব খাটানো সোজা। যে-কোনও যুদ্ধের শেষে বিজয়ী সৈন্যদের বিজিত দলের মেয়েদের কাঁধে করে উপভোগের জন্য নিয়ে যাওয়া একসময় ছিল অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার। আর ছিল গণ-ধর্ষণ। এইজন্যই রাজপুতানায় মেয়েরা জহরব্রত করে আগুনে ঝাঁপ দিত বিধর্মীরা তাদের শরীর স্পর্শ করার আগে।

তাহলে যা সহজলভ্য তাকে অনুশাসন দিয়ে ঘিরে পুরুষের অধিকারের পর্যায়ে আনার কী প্রয়োজন? দু-তিন হাজার বছর আগেও মানুষের সমাজ ছিল অত্যন্ত বর্বর। পাথর ছুড়ে, খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, ক্রশের গায়ে পেরেক মেরে ঝুলিয়ে দিয়ে, মাটিতে পুঁতে গলাটা বাইরে রেখে যাতে জীব-জন্তু খেতে পারে— এসব ছিল শাস্তি দেওয়ার অতি সাধারণ উপায়। যুদ্ধের শেষে বিজিত নৃপতির কাটা মুণ্ড বিজয়ী নৃপতিকে ভেট দেওয়া ছিল আবশ্যিক। তারপর আস্তে আস্তে মানুষের সমাজ ‘সভ্য’ হতে শুরু করল। আর আস্তে আস্তে বিপরীত দিকের, বিপরীত ধর্মের লোকদের আইনিভাবে নিজের পক্ষ-সমর্থন বা ‘ডিফেন্ড’ করার অধিকার স্বীকৃত হতে আরম্ভ করল। আর তাতে মেয়েরাও অন্তর্ভুক্ত হতে শুরু করল। কিন্তু ভারতীয় সমাজে তার প্রতিফলন, অল্প হলেও আসতে সময় নিল আরও কয়েকশো বছর। আর সমাজের ওপরে মাথা হয়ে বসে থাকা পুরুষরা এই পরিবর্তন যে আসছে তা আঁচ করতে শুরু করল। ক্ষমতা কি কেউ ইচ্ছে করে হাতছাড়া করে? তাই মেয়েদের ওপরে নিজেদের অধিকারকে আরও শক্ত ভিতে দাঁড় করাতে পুরুষরা সক্রিয় হল। কিন্তু তার জন্য চাই সামাজিক অনুশাসন ও অনুমোদন।

আর এই অনুমোদনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াল ধর্মীয় অনুশাসন। ভারতের মতো ধর্মীয় সমাজে ধর্মই সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী শক্তি। আর তাই একের পর এক ধর্মের অনুশাসন আসতে লাগল নখ, দাঁত সব নিয়ে। কিশোরী বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে যাতে সে চিরকালের জন্য তার স্বামীর সম্পত্তি হয়ে থাকে, কিন্তু স্বামীর সম্পত্তির ওপর তার কোনও অধিকার থাকবে না, মেয়েদের কোনও ‘ফর্মাল’ শিক্ষা দেওয়া যাবে না, তারা যেন ব্রত-পুজো ইত্যাদি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, কোনও মেয়ের স্বামী মারা গেলে তাকে সাদা কাপড় পরতে হবে, বিধবাদের মাছ-মাংস-পেঁয়াজ-রসুন ইত্যাদি ‘যৌন-উত্তেজক’ খাবার খাওয়া চলবে না, আর কোনওদিন সে পুনর্বিবাহ করতে পারবে না। আর এসবের কোনও ব্যতিক্রম হলে পাপের কোনও শেষ থাকবে না ও নিশ্চিত নরকপ্রাপ্তি।

এইসব ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে ঘিরে ফেলার পরও শান্তি হল না। দেশের দক্ষিণে দেবদাসী প্রথা চালু করে কিছু মেয়েদের পুরোহিতের উপভোগের সামগ্রী করে তোলা হল। আর বাংলাদেশে স্বামীর মৃত্যু হলে সদ্য-বিধবাকে সতী বলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলার প্রথা চালু হল। সুতরাং আস্তে-আস্তে মেয়েদের ওপর নানা অত্যাচার, যার মধ্যে ধর্ষণও আছে, ব্যক্তি থেকে সমষ্টি বা সমাজের হাতে চলে এল।

তাহলে ভারতীয় সমাজই তিলোত্তমার ধর্ষক। এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। আর এই সমাজের পরিবর্তন ছাড়া সমাজের মাথায় থাকা সর্বশক্তিধর পুরুষদের মনোভাবের কোনও পরিবর্তন হবে না। ধর্ষণও সমানভাবে চলবে।

তাহলে এই প্রক্রিয়ায় মেয়েদের কি খালি ধর্ষিত হওয়া ও ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে’ বলে কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কোনও ভূমিকা নেই? অবশ্যই আছে। আগেই বলেছি এর জন্য চাই সমাজের মানসিক পরিবর্তন যা বকলমে পুরুষদের মানসিক পরিবর্তন আনা যে, নারীরা তাদের অধিকারের ও উপভোগের বস্তু নয়।

এটা একটা যুদ্ধ। আর এ সহজ যুদ্ধ নয়। আরজিকরের ঘটনা ও তার পরিপ্রেক্ষিতে বয়স, জাতি, ধর্ম-নির্বিশেষে অসংখ্য মেয়েদের প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হওয়া অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু শুধু প্রতিবাদ জানিয়ে এর শেষ হওয়ার কথা নয়। এর জন্য চাই ক্রমাগত প্রচেষ্টা— তা জুডিশিয়াল, লেজিসলেটিভ, ল অ্যান্ড অর্ডার ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যে দিয়েই চালিয়ে যেতে হবে। যেমন পুলিশের কাজে আরও অনেক বেশি মেয়েদের নিয়োজিত করতে হবে, যাতে কোনও ধর্ষিতা মেয়েকে ‘পুলিশ রিপোর্ট নেবে না’ এরকম পরিস্থিতির সংখ্যা কমে। আর পুলিশ যদি ধর্ষিতাকে নিজে ধর্ষণ করে (যার সংখ্যা কম নয়) তাহলে সেই পুলিশের বিচার ও শাস্তি যেন দ্রুত হয়। ভারতীয় আইন অনুযায়ী আজও কোনও স্বামীর তার স্ত্রীর ওপরে অধিকার পুরোপুরি। আজও আইনের চোখে কোনও স্বামী জোর করে তার স্ত্রীর সঙ্গে যৌনসংসর্গ করলে তা অপরাধ নয়। এ সবই ‘যুদ্ধ’ করে পাল্টাতে হবে।

এ তো গেল সরকারি ও আইনি ব্যাপার। এর পরেও সমস্যা আছে। কোনও ধর্ষিতার দৈহিক ‘ট্রমা’ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক সামাজিক প্রতিফলন কিছু কম হয় না। যেন এর জন্য সেই মেয়েটিই দায়ী। যেমন কয়েক বছর আগে কলকাতার পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে একটি মেয়েকে নৃশংসভাবে গণ-ধর্ষণ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের সদ্য-নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন মেয়েটি অত রাতে ওখানে কী করছিল? তার মানে রাতে মহিলাদের রাস্তায় বেরোনোর অধিকার নেই, আর বেরোলে ধর্ষণ বা খুন হলে তার জন্য সে নিজে দায়ী। সেই মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা। উল্লেখযোগ্য যে তিনিই সাম্প্রতিক তিলোত্তমা ধর্ষণ ও হত্যার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে না হলেও একজন জড়িত এরকম দাবি তোলা হচ্ছে।

এই একাদশ শতাব্দীতেও কোনও মেয়ে নতুন বিয়ে করে এলে তাকে তার বরের পরিবারের পক্ষ থেকে নানান বিরূপতার সম্মুখীন হতে হয়। বেশ কয়েক বছর আগে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সুরূপা গুহ তার স্বামীর পরিবারে, বিশেষ করে শ্বাশুড়ির অত্যাচারে মৃত্যুবরণ করেন। আজও হিন্দু পরিবারে বিয়ের আচার অনুযায়ী বরকে তার মার কাছে গিয়ে বলতে হয়— ‘মা, আমি তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি।’ আরও একটু যদি পিছিয়ে যাই তাহলে দেখতে পাই যে অনেক সময়ে মহিলারাই জোর করে সতীকে আগুনে ঠেলে দিয়েছে। কারণ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল যে মেয়েটি সতী হয়ে স্বর্গে যাবে। কিছুদিন বাদেই কলকাতায় বর্তমানে তিলোত্তমা-আন্দোলনকারী মেয়েদের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ শিবরাত্রি উদযাপন করতে পুরুষ-দেবতা শিবের লিঙ্গপূজা করবে। বর্তমানে ইন্টারনেটের কল্যাণে সাগরমেলায় নাগা সন্ন্যাসীদের উচ্ছ্রিত লিঙ্গের সামনে হাত জোড়-করা মহিলাদের ছবি বহুল-প্রচারিত। প্রবাদ অনুযায়ী গরুর মাংস গরুতেই টানে।

এই প্রসঙ্গে বলা যেতেই পারে যে গত এক শতক ধরে সমাজের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সতীদাহ এখন ঐতিহাসিক ঘটনা ছাড়া কিছু নয়, মহিলাদের সম্পত্তি পাওয়া আইনত স্বীকৃত ও বহুল-প্রচলিত, ‘মা তোমার দাসী আনতে যাচ্ছি’ এখন সামাজিক ‘রেলিক’ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ইত্যাদি। এই যুক্তি নিয়ে কথা বলতে গেলে আলোচনা একটু অন্যদিকে ঘোরাতে হয়। তা হল আরবান ও রুরাল ডিভাইড বা শহর-কেন্দ্রিক ও গ্রাম-কেন্দ্রিক মানসিকতার তফাৎ। তিলোত্তমা-আন্দোলন অধিকাংশটাই কলকাতা শহর-ভিত্তিক। কলকাতার বাইরে গ্রাম ও আধা-গ্রামেও বিক্ষোভ, মিছিল ইত্যাদি হয়েছে, কিন্তু তা মুষ্টিমেয়। আর দু-মাসের পর সেই আন্দোলন কলকাতাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। শহরে কর্মক্ষেত্রের প্রায় সর্বত্র মহিলাদের অবাধ গতি। আর তার ফলে মেয়েদের মানসিকতায়, পোশাকে-আশাকে, রুচিতে, শিক্ষা-দীক্ষায় বিশাল পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে সেই ছাপ সমানভাবে পড়েনি। অর্থাৎ মেয়েদের অগ্রগতি শহর ও গ্রামে সমানভাবে হয়নি। এটা সর্বজনস্বীকৃত যে গ্রামাঞ্চলে ধর্ষণের সংখ্যা শহরের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। আর সেই ঘটনা আদৌ পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয় না। উল্লেখযোগ্য যে এর মধ্যে পারিবারিক ধর্ষণের সংখ্যা কম নয়। তাহলে এই প্রশ্ন কি তোলা যায় যে তিলোত্তমার ধর্ষণ কলকাতা শহরে হয়েছে বলে ও তিনি ডাক্তার ছিলেন বলে এই তুমুল আলোড়ন চলছে?

তাহলে যা আপাতদৃষ্টিতে ‘সোজাসুজি’ ধর্ষণের ব্যাপার বলে মনে হলেও তার প্রতিকার মোটেই সোজা নয়। তাহলে তিলোত্তমাদের কী হবে? উপায় সহজ। পুরুষদের মেয়েদের শরীরের ওপর যথেচ্ছ অধিকারের মনোভাব ছাড়তে হবে। আর মেয়েদের ছাড়তে হবে যুগ-যুগ ধরে প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসন অন্ধভাবে অনুসরণ করা। ভারতীয় সমাজে এ দুটোই দুরূহ কাজ। তাহলে প্রতিকারের উপায় সহজ হলেও তা বাস্তব ক্ষেত্রে আরোপ করা মোটেই সহজ নয়। এমনকি বর্তমানে তা অসম্ভব বলে মনে হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

তবে এই অন্ধকারের মধ্যে একটা রূপালী রেখা আছে। ইউরোপীয় ও আমেরিকান সমাজেও কয়েকশো বছর আগে মেয়েদের কোনও অধিকার ছিল না। ইউরোপীয় নবজাগরণের প্রভাবে তা আস্তে আস্তে পাল্টাতে থাকে। মেয়েরা পড়াশুনো করার অধিকার পায়। সমাজের নানা কাজে তারা যোগ দিতে শুরু করে। আর প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যখন পুরুষরা যুদ্ধে গিয়ে ফিরে আসে না, বা বিকলাঙ্গ হয়ে ফিরে আসে তখন মহিলারা সমাজের সব কাজ–কর্ম সামলাতে সামনে এগিয়ে আসে। শুরু হয় ‘নারী নবজাগরণ’। সেইখান থেকে মেয়েরা আর পিছনের দিকে তাকায়নি। বর্তমান বিশ্বায়নের ফলে হয়তো ভারতীয় সমাজেও নবজাগরণ শুরু হবে। হয়তো মানব-সভ্যতার শুরু থেকে পুরুষদের নারীর শরীরের ওপর অবাধ অধিকারের ধারণা পাল্টাতে শুরু করবে। হয়তো যুগ যুগ ধরে মেয়েদের মেনে নেওয়া সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-বিচারের শিকলও আস্তে আস্তে খসে যেতে শুরু করবে। তখনই তিলোত্তমারা ন্যায়বিচার পাবে।


*হেডারের ছবিটি লেখকের আঁকা

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. রাহুল রায়ের সুচিন্তত ও তথ‍্যবহুল লেখাটির অনেক কথাই নাড়া দেয় । এই রচনাটির মধ‍্যে আলোচনাগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার মতামত...