সংশয়ে মিলায় সত্য?

অতনু কুমার

 


ফেলুদার গল্পে অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত বিষয়ের অবতারণা পাঠকের সংশয়ী মনে প্রশ্ন তোলে। মুকুল কি সত্যিই জাতিস্মর ছিল? সিদ্ধেশ্বর মল্লিক কি সত্যিই ফাঁসি হয়ে যাওয়া আসামিদের সঙ্গে কথা বলতেন? নয়নের আশ্চর্য ক্ষমতার কি কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকা সম্ভব? ফেলুদার ষাট বছরে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার উদ্দেশ্যেই এই লেখা

 

“আমি মনের জানালাগুলো খুলে দিয়ে বসে আছি, যাতে আলো আর বাতাস ঢুকে মনটাকে তাজা রাখে। তুমি গোয়েন্দাগিরি করছ, … নিজের মনটাকে অন্ধকার হতে দিও না ফেলু…”— সোনার কেল্লা ছবিতে সিধুজ্যাঠার উপদেশ। পাঠকের মনেও আলো-বাতাসের কমতি যেন না হয়, সে চেষ্টা করেছে তোপসে। এক সাক্ষাৎকারে ফেলুদা প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “শুধু গল্প নয়, প্লট নয়, তার বাইরে বায়োলজি, অ্যাস্ট্রোনমি, আর্কিটেকচার ইত্যাদি নানা বিষয়ে যতরকম ইনফরমেশন দেওয়া যায়, দেওয়ার চেষ্টা করি। সেটা অবশ্যই গল্পের রস বা গতিকে ব্যাহত না করে।” তবু ফেলুদার গল্পে অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত বিষয়ের অবতারণা পাঠকের সংশয়ী মনে প্রশ্ন তোলে। মুকুল কি সত্যিই জাতিস্মর ছিল? সিদ্ধেশ্বর মল্লিক কি সত্যিই ফাঁসি হয়ে যাওয়া আসামিদের সঙ্গে কথা বলতেন? নয়নের আশ্চর্য ক্ষমতার কি কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকা সম্ভব? ফেলুদার ষাট বছরে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার উদ্দেশ্যেই এই লেখা।

ফেলুদার গল্পে যে অতিপ্রাকৃতিক বিষয়টা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় তা হল প্ল্যানচেট। ফেলুদার কথায়: “প্ল্যানচেট, স্পিরিচুয়ালিজম ইত্যাদি সম্বন্ধে আমি অনেক পড়েছি। পরলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যে সম্ভব সেটা বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি বলে গেছেন; সেক্ষেত্রে প্ল্যানচেট সম্বন্ধে অবজ্ঞা প্রকাশ করার কোনও মানে হয় না। তবে যেমন সবকিছুর মধ্যেই থাকে, তেমনই এর মধ্যেও ধাপ্পাবাজি চলে। আসলে মিডিয়ম যদি খাঁটি হয় তা হলেই ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।” এই “বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি”র মধ্যে আছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি প্ল্যানচেটে উৎসাহী ছিলেন এবং সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মার সঙ্গে আলাপ করতেন বলেও শোনা যায়। ফেলুদার গল্পে আমরা চারজন মিডিয়মের দেখা পাই— ডঃ বৈদ্য (গ্যাংটকে গণ্ডগোল), আত্মারাম মৃগেন ভট্টাচার্য (গোঁসাইপুর সরগরম), অ্যারাকিস সাহেব (গোরস্থানে সাবধান), ডাঃ হরিনাথ মজুমদার (ভূস্বর্গ ভয়ংকর)। নটেগাছটি মুড়োলে বেরোয় বৈদ্য, আত্মারাম আর অ্যারাকিস তিনজনেই ভণ্ড আর অপরাধী। ডাঃ মজুমদার অপরাধী নন। কিন্তু তিনি কি সত্যিই আত্মা নামাতেন?

জ্যোতিষ, ভাগ্যগণনা, নানা রং-এর বাবাজিদের অলৌকিক ক্ষমতায় আজও বহু শিক্ষিত ব্যক্তি আস্থা রাখেন, সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে এইসব বাবাজিদের মহিমা সদর্পে প্রচারিত হয়। তোপসে লিখেছে, “ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলে বলে ও পামিস্ট্রিতে বিশ্বাস করে না, অথচ পামিস্ট্রির বই ওর আছে, আর সে বই ওকে পড়তেও দেখেছি।” বৈদ্য আর আত্মারাম ছাড়াও ফেলুদাকে যেসব বাবাজি বা জ্যোতিষীদের মুখোমুখি হতে হয়েছে তারা হল মছলিবাবা (জয়বাবা ফেলুনাথ), গণৎকার লক্ষণ ভট্টাচার্য (হত্যাপুরী) এবং সংখ্যাতাত্ত্বিক ভবেশ ভট্টাচার্য (টিনটোরেটোর যিশু)। মছলিবাবা আর লক্ষণ ভট্টাচার্যের মুখোশ ফেলুদাই ফর্দাফাঁই করে। মূল গল্পে ভবেশবাবুর কোনও ভূমিকা নেই। বইএর কাটতি বাড়াতে জটায়ু সংখ্যাতাত্ত্বিকের পরামর্শ নিতে যান। সে পরামর্শ কাজে দিয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি। সুতরাং ফেলুদার গল্পে প্রাপ্তবয়স্ক যে-সমস্ত ব্যক্তি নিজেদের অলৌকিক ক্ষমতাধারী বলে দাবী করেছেন তাঁদের মধ্যে ভবেশবাবু এবং ডাঃ মজুমদার বাদে সকলেই প্রতারক এবং অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন। এঁরা ছাড়াও দুজন বিস্ময়বালককে আমরা পাই, মুকুল (সোনার কেল্লা) আর নয়ন (নয়ন রহস্য)। অন্যভাবে বলতে গেলে ফেলুদার তিনটি কাহিনিতে আমরা তথাকথিত “অলৌকিক” ঘটনার দেখা পাই: সোনার কেল্লা, ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর এবং নয়ন রহস্য। আমরা দেখার চেষ্টা করব এই তিনটি গল্পের ঘটনাক্রমের কোনও বিজ্ঞানভিত্তিক, যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা থাকা সম্ভব কি না।

সোনার কেল্লায় মুকুল বালি, কেল্লা, হাতি, ঘোড়া নিয়ে নানা অচেনা জায়গার কথা বলে, ছবি আঁকে। কনুই-এর কাছের একটা জন্মদাগকে দেখিয়ে বলে ময়ূরের ঠোকরের দাগ। মুকুল পূর্বজন্মের কথা বলছে বুঝে প্যারাসাইকোলজিস্ট ডঃ হেমাঙ্গ হাজরা জাতিস্মর সংক্রান্ত গবেষণার কেস স্টাডি করতে তাকে নিয়ে রাজস্থান রওনা হন। দুই শয়তানও গুপ্তধনের লোভে তাঁদের ধাওয়া করে। ক্রমে বোঝা যায় সোনার কেল্লা আসলে জয়সলমিরের দুর্গ। গল্পের ক্লাইম্যাক্সে সবাই জয়সলমিরে উপস্থিত হয়, গুপ্তধনের জায়গাটায় দেখা যায় ময়ূরের বাসা। এখন প্রশ্ন মুকুল যদি জাতিস্মর না হয়ে থাকে তাহলে প্রাচীন রাজপুতানার বর্ণনা ও ছবি সে আঁকল কীভাবে? সোনালী রঙের দুর্গের কথা এবং সেটা যে জয়সলমিরে তা সে জানল কোথা থেকে? মুকুলের বাবাকে ফেলুদা বলে, “বইটই-এর মধ্যে এমন কোনও জায়গার ছবি সে দেখে থাকতে পারে না? আপনার তো বইয়ের দোকান আছে?” সুধীরবাবু জবাবে বলেন, “তা অবশ্যি পারে। কিন্তু ছবির বই তো অনেক ছেলেই দেখে— তাই বলে কি তারা অষ্টপ্রহর এইভাবে কথা বলে?…” অর্থাৎ দোকানে যে বালি, যুদ্ধ, কেল্লার ছবিওয়ালা বই আছে এবং সেই বই মুকুল দেখে থাকতে পারে সেই সম্ভাবনা সুধীরবাবু বাতিল করলেন না। কিন্তু এ-কথাও ঠিক যে ছবির বই দেখলেই তো একজন আট বছরের বালক নিজেকে জাতিস্মর বলে দাবি করে না। নিজের দৈনন্দিন জীবন, পরিবার, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে অন্য জগতে চলে যায় না। বাবা-মাকে ছেড়ে একজন অচেনা মানুষের সঙ্গে বেরিয়ে পড়তে পারে না। কোনও সাধারণ বালক না পারলেও স্কিজোফ্রেনিয়া জাতীয় কোনও মানসিক রোগাক্রান্ত বালকের পক্ষে এই ধরনের আচরণ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মুকুল যদি বই-এর ছবি দেখেই সেগুলো নিজের পূর্বজীবনের গল্প বলে ধারণা করেও থাকে তবু জয়সলমির শহরের নাম সে জানল কীভাবে? একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ডাকবাংলোতে কফির আড্ডায় ডঃ হাজরার জবানবন্দি থেকে। ডঃ হাজরা বলেন, “আমি নিজে আঁচ করেছিলাম জয়সলমিরই আসল জায়গা, এখন খালি অপেক্ষা…” হাওড়া থেকে ট্রেনে চাপার পর ডঃ হাজরা কি তাঁর অনুমানের কথা মুকুলকে বলেছিলেন? মুকুল সত্যিই জাতিস্মর ছিল কি না সেই উত্তর স্রষ্টা দেননি, সম্ভবত সচেতনভাবেই। নাহলে কেনই বা ডঃ হাজরা গুপ্তধনের সত্যতা যাচাই করতে অতটা নিরাসক্ত হবেন? তিনি তো এসেইছিলেন কেস স্টাডি করতে। উপন্যাসের আভাস আরও স্পষ্ট হয় চলচ্চিত্রে। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ডঃ হাজরা বলেন, “মুকুল সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক— এর বেশি আর কিছুই চাই না।” কেল্লায় যাওয়ার কোনও আগ্রহও তাঁর দেখা গেল না। আর “সুস্থ  হয়ে” মানে কী? তিনি কি শুধু ভবানন্দর খপ্পর থেকে মুকুলকে সুস্থভাবে মুক্ত করে আনার কথা বললেন? না কি তিনিও বুঝেছিলেন, মুকুল মানসিকভাবে অসুস্থ? সোনার কেল্লায় পাল্টা কোনও মানসিক শক তাকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করবে এই আশা কি তাঁর ছিল? বাড়ির জন্য মনকেমন করা, যুদ্ধ, কেল্লা বাদ দিয়ে ফেলুদা আর তোপসেদার হাত ধরে হাঁটার ছবি আঁকাই কি সেই সুস্থতার ইঙ্গিত? ছবির ক্লাইম্যাক্সে ফেলুদা ভবানন্দর দিকে রিভলভার উঁচিয়ে বলে, “গুপ্তধন নেই— পূর্বজন্ম থাকলেও নেই, না থাকলেও নেই…।” পূর্বজন্ম বলে সত্যিই কিছু আছে কি না সে বিচারের ভার ফেলুদা ও তার স্রষ্টা পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলেন। একটাই আক্ষেপ, ডঃ হাজরার সঙ্গে ফেলুদার মোলাকাৎ গল্পের শেষপর্বে। জাতিস্মর আর পূর্বজন্ম নিয়ে দুজনের আলাপ শোনার সুযোগ হল না।

 

“ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর”-এ অবসরপ্রাপ্ত বিচারক সিদ্ধেশ্বর মল্লিক অনুশচনায় ভোগেন যে তাঁর ভুলে অনেক নির্দোষ ব্যক্তি হয়ত ফাঁসিকাঠে ঝুলেছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আত্মা নামিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেন। তাঁর মিডিয়ম পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ মজুমদার। কাশ্মিরে এরকম কয়েকটা প্ল্যানচেটে অংশ নেয় ফেলুদারা। বিহারি কিশোর রামস্বরূপ রাউতের আত্মা জানায় সে খুন করেনি, খুন করেছিল ছেদিলাল। কাশ্মিরি মনোহর সপ্রুর আত্মা বলে সেও নির্দোষ, খুনির নাম হরিদাস ভগত। দুজনেই সিদ্ধেশ্বরবাবুকে ক্ষমা করে দিলেও জানিয়ে দেয় যে তাদের আত্মীয়স্বজনরা ক্ষমা করবে না। রামস্বরূপ রাউতের বাবা সিদ্ধেশ্বরবাবুর ছেলেকে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়ে জজসাহেবকে পুত্রশোক দেওয়ার চেষ্টা করে। আর মনোহর সপ্রুর ছেলে প্রতিশোধ নিতে সিদ্ধেশ্বরবাবুকেই হত্যা করে। ভূতকে দূরে সরিয়ে রেখে এই গল্পের কী ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে? বৈদ্য বা আত্মারামের মতো হরিনাথবাবু অপরাধী নন। তাহলে আত্মা নামানোর নাটক করার পেছনে তাঁর কী স্বার্থ? ছেদিলাল আর হরিদাসের নামই বা তিনি জানলেন কোথা থেকে? স্পষ্ট জবাব না থাকলেও একটা ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে হরিনাথবাবুর পরিচয়ের মধ্যেই। তিনি পনেরো বছর ধরে জজসাহেবের পারিবারিক চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। লালমোহনবাবুর কথায় “এদিকে ডাক্তার, তার উপর আবার আত্মা নামাচ্ছে। কম্বিনেশনটা অদ্ভুত লাগছে।” মিথ্যাচার তো মানুষ সবসময় অসৎ উদ্দেশ্যে করে না। ডাক্তারবাবু জানতেন জজসাহেব মানসিক অশান্তিতে ভুগছেন। প্রাণদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা যদি ক্ষমা করে যায় তাহলে তিনি শান্তি পাবেন। সেক্ষেত্রে আত্মা নামানোর নাটকটা চিকিৎসারই একটা অঙ্গ। সিদ্ধেশ্বরবাবু এক কথায় দুদিনের পরিচিত প্রদোষ মিত্রর হাতে নিজের ডায়েরিগুলো তুলে দিয়েছিলেন। তাহলে হরিনাথবাবুর মতো বিশ্বাসভাজন ব্যক্তিকেই বা পড়তে দেবেন না কেন? ডাঃ মজুমদার হয়তো ডায়েরি থেকেই ফাঁসির কেস ডিটেলস পড়েছিলেন এবং সেখান থেকেই সম্ভাব্য অপরাধীর নাম পেয়েছিলেন। মরুভুমির মতো ভূস্বর্গেও প্রাকৃত আর অতিপ্রাকৃতর দ্বন্দ্বের স্পষ্ট সমাধান মেলেনি, স্রষ্টা পাঠককেই মাথা খাটানোর হোমটাস্ক দিয়ে রেখেছেন। তবে অতীন্দ্রিয়ের অস্তিত্ব খারিজ না করলেও ফেলুদা নিজের কাজের জন্য পঞ্চেন্দ্রিয়ের ওপরই ভরসা রেখেছে। “শৈলরহস্য”-তে নিহতের আত্মা ব্যোমকেশের কাছে খুনির ঠিকানা পৌঁছে দিয়েছিল। সোনার কেল্লার ঠিকানা বের করতে ফেলুদা কিন্তু মুকুলকে হিপনোটাইজড করেনি, খুনির পরিচয় জানতে জজসাহেবের আত্মাকে ডাকতেও বসেনি।

 

“নয়ন রহস্য”র নামভূমিকায় মুকুলের মতোই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বালক নয়ন। সে যে-কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, যদি সে উত্তর সংখ্যায় হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নয়নের এই অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার কোনও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যাখ্যা গল্প থেকে মেলেনি। সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের গাড়ির নম্বর, তার সিন্দুকে কত টাকা আছে সেটা নয়ন কীভাবে জানতে পারল তার কোনও ইঙ্গিত স্রষ্টা দিয়ে যাননি। এখানে নয়ন ফেলুদাকে একটা ছোট্ট সাহায্যও করেছে। নয়নের বলা গাড়ির নম্বরের সূত্র ধরেই ফেলুদা হিঙ্গোরানিকে নয়নের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে চিহ্নিত করে। “নয়ন রহস্য” যে-বছর লেখা হয়, সেই বছরেই মুক্তি পায় “গণশত্রু”, আর শুটিং শুরু হয় “আগন্তুক”-এর। জীবনের শেষপ্রান্তের এই দুটো ছবিই তো ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সত্যজিতের সবচেয়ে জোরালো ঘোষণা ছিল। তার মাঝে নয়নের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ স্রষ্টা দিলেন না কেন, সে-ও এক রহস্য।

 

প্রোফেসর শঙ্কু ডায়েরিতে লিখেছিলেন: “ভূতপ্রেত প্ল্যানচেট টেলিপ্যাথি ক্লেয়ারভয়েন্স— এ সবই যে একদিন না একদিন বিজ্ঞানের আওতায় এসে পড়বে, এ বিশ্বাস আমার অনেকদিন থেকেই আছে।” শঙ্কুর বিশ্বাস আসলে সত্যজিতেরই মনের কথা। অ্যান্ড্রু রবিনসনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন: “I don’t think everything can be explained by science at this stage, but a lot of things will come under science eventually.” কিন্তু এই বিশ্বাস অন্ধবিশ্বাস নয়। ফেলুদা শিখিয়েছে, “প্রমাণ ছাড়া কোনও জিনিস বিশ্বাস করা বা না করাটা বোকামো। মনটা খোলা না রাখলে যে মানুষকে বোকা বনতে হয় তার প্রমাণ ইতিহাসে অজস্র আছে।” অপবিজ্ঞান, কুসংস্কার, গোঁড়ামির সঙ্গে বিজ্ঞান, যুক্তিবাদের যে দ্বন্দ্ব মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে সেই দ্বন্দ্বের ছাপ পড়েছে ফেলুদার রহস্যযাত্রায়। কখনও এ-দ্বন্দ্বের সমাধান হয়েছে ফেলুদার হাতে অপরাধীর ভণ্ডামি ধরা পড়ার মধ্যে দিয়ে, কখনও প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ভার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে পাঠকের বিচারবুদ্ধির ওপর। এই দ্বন্দ্বের আরেক রূপ ধরা পড়ে জয়বাবা ফেলুনাথ গল্পে। আড়াই ইঞ্চির গণেশ ঘোষালবংশের ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছে— পুত্র উমানাথের অন্ধবিশ্বাস নস্যাৎ করে বৃদ্ধ অম্বিকা ঘোষাল ঘোষণা করেন: “ইট ওয়জ আ ওয়র্ক অফ আর্ট। এসব লাকটাক আমি বিশ্বাস করি না।” দ্বন্দ্বের সমাধান সম্ভব নয় সংশয় ছাড়া। গোয়েন্দার কাজ যেমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে সন্দেহ করা, মানুষের ধর্মও সেরকম প্রতিটা স্বতঃসিদ্ধ সম্বন্ধে সংশয়ী হওয়া। সংশয়ই তো সত্যে পৌঁছানোর প্রথম ধাপ।

 

তথ্যসূত্র:

  • রায়, সত্যজিৎ। “ফেলুদা সমগ্র ১ ও ২” এবং “শঙ্কুসমগ্র”। আনন্দ পাবলিশার্স।
  • সেন, মঞ্জিল। “অদ্বিতীয় সত্যজিৎ”। বুকফার্ম।
  • “ফেলুদা ৩০”। সন্দেশ। ডিসেম্বর ১৯৯৫।
  • “সত্যজিৎ ১০০”। বিচিত্রপত্র‌। মে-জুলাই ২০২১।
  • বাগচী, অরুণ (সাক্ষাৎকার)। “শিশুসাহিত্য ও সত্যজিৎ”। সন্দেশ। শারদীয়া ২০০০।
  • Chatterjee, Prabirendra. “The Supernormal World of Satyajit Ray”. the Space Ink. June 3, 2021.

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখা। লেখককে ধন্যবাদ৷ এই লেখাটি পাঠকের চিন্তার রসদ হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে।

    সেই সূত্র ধরেই সামান্য কটি কথা বলার চেষ্টা করি।

    অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সত্যজিৎ পূর্বজন্ম বা অলৌকিক বলে কিছু আছে কিনা তা বিচারের ভার তাঁর পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন৷ এখানে তাঁর প্রতি আমার অভিযোগ- যেখানে ফেলুদা কাহিনির ভোক্তা মূলত শিশু ও কিশোর, যেখানে সত্যজিৎ নিজেই তাঁর ছোট্ট পাঠকদের যথাসম্ভব ইনফরমেশন দেওয়ার কথা বলছেন, সেখানে লৌকিক-অলৌকিকের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বৌদ্ধিক বিষয়ে অস্পষ্টতা রেখে যাওয়া অর্থহীন এবং শিশুমনের পক্ষে প্রচণ্ড ক্ষতিকর। বস্তুত, ‘সোনার কেল্লা’ প্রথমবার দেখার মধ্যে দিয়ে আমাদের প্রজন্মের অনেকেই পূর্বজন্ম ও জাতিস্মর বিষয়ে এক ধরনের বৈধতা খুঁজে পেয়েছিলাম।

    এই বিষয়ে সত্যজিতের আসল সমস্যাটা কী? এই প্রশ্নের উত্তর লেখক নিজেই এই প্রবন্ধেই দিয়েছেন৷ সত্যজিৎ বিশ্বাস করতেন, যা কিছু আজ অলৌকিক বলে ঘোষিত, তা নিশ্চয়ই একদিন বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যার আওতায় আসবে৷ ভুলটা এখানেই। আসলে সত্যজিৎ সমাজের বিজ্ঞান-নির্ভর অগ্রগমনে বিশ্বাসী ও কুসংস্কার- ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতায় পুরোপুরি আন্তরিক হলেও বিজ্ঞানের পদ্ধতীতন্ত্র সম্বন্ধে সম্যক অবগত ছিলেন না। অবশ্যই বিজ্ঞান এখনও মহাবিশ্বের সব বিষয়ে সর্বজ্ঞানী নয়, কিন্তু তা হলেও কোন বিষয়টি আগামীতে বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার আওতায় আসতেও পারে, আর কোন জিনিশ পুরোপুরি মিথ্যে, লোক-ঠকানো- তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা আগে থেকেই করা সম্ভব।

    উদাহরণস্বরূপ, শুধুমাত্র চোখের দৃষ্টি দিয়ে চামচ বেঁকিয়ে দেওয়ার গল্প (ইউরি গেলার) আমরা অনেকেই শুনেছি। এটা কোনও অলৌকিক ঘটনা নয়, নিছক ম্যাজিক। কারণ যার মানসিক শক্তি যতই হোক না কেন, তা দিয়ে চামচ বেঁকানো যাবে না, তা করতে কোনও ফিজিকাল ফোর্সই লাগবেই লাগবে৷ অতএব মানসিক শক্তির এই ‘অলৌকিক’ ঘটনা কোনওদিন বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার আওতায় আসবে না। পদার্থবিদ্যায় বল বা ফোর্স নিয়ে যারা প্রাথমিক ধারণা রাখেন, তারা প্রথম থেকেই এটা বুঝবেন। একই কথা আত্মা, পরলোক, পূর্বজন্মের পক্ষে প্রযোজ্য। এগুলি প্রচারের মধ্যে আবার ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শের একটা কুশলী ও ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, তা আপাতত এই আলোচনার বাইরে রাখছি।

    সত্যজিৎ এখানেই ভুলটা করেছেন। বিজ্ঞানের আধিপত্যে তিনি বিশ্বাস করতেন, খারাপের বিরুদ্ধে ভালোর জয় তিনি কিশোর কাহিনিগুলিতে বারবার দেখিয়েছেন, মানবিক হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন (উপযুক্ত পারিশ্রমিকের চেয়ে একটি শিশুর প্রাণরক্ষার বিষয়টি যে অনেক বড়, সোনার কেল্লা-য় নিজের খরচে রাজস্থান যাত্রার আগে ফেলুদা বলছে তোপসেকে), ছোট থেকেই ইতিহাস ও পুরাতত্ত্বের মূল্য বুঝতে শিখিয়েছেন আমাদের, কিন্তু বিজ্ঞান কীভাবে কাজ করে তা তিনি জানতেন না। তাই ফেলুদার কয়েকটি গল্পে তিনি ভুল করেছেন তো বটেই, এমনকি গিরিডির বিজ্ঞানী প্রফেসর শঙ্কুর কাহিনিগুলি কোনওটিই প্রায় কল্পবিজ্ঞানের গল্প হয়ে উঠতে পারেনি, বিজ্ঞান-সুবাসিত অলীক ফ্যান্টাসির গল্প হয়ে রয়ে গেছে। আশা করি, এই প্রবন্ধের লেখক ভবিষ্যতে তা নিয়ে লিখবেন।

    সুলিখিত প্রবন্ধটির জন্য লেখককে আরেকবার ধন্যবাদ জানাই।

আপনার মতামত...