বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে কীভাবে এই ভয়ঙ্কর সহিংসতার বীজ ছড়াতে পারেন?

নূপুর রায়চৌধুরী

 

বিশ্বধর্মের শিক্ষায় নিহিত নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ যাই হোক না কেন, ধর্মগুলো নির্ভরযোগ্যভাবে এই মূল্যবোধগুলিকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় এবং ধর্ম অনুশীলনকারীরা মনুষ্যচরিত্রের বিচিত্রতায় ফিরে যাওয়ার প্রবণতা দেখায়। বৌদ্ধধর্মও এর ব্যতিক্রম নয়। বৌদ্ধ চরমপন্থীরা ইসলামকে একটি "বিপজ্জনক" বা "নৃশংস" ধর্ম হিসাবে গণ্য করে, এবং এই ধারণা পশ্চিমা দেশগুলো থেকেই সরাসরি ধার করা হয়েছে। উইরাথু এবং তাঁর অপরাধী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দল বৌদ্ধ ধর্মকে অনৈতিকভাবে কব্জা করেছিলেন এবং মায়ানমারের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক আলোচনাকে বিষিয়ে তুলেছিলেন। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য মিসেস সু কিও ততদিনে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রতে পরিণত হয়েছিলেন

 

কাউন্টি লাইব্রেরি থেকে সিডি-টা পেয়েছিলাম— “The Venerable W”। একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম। ফরাসি চলচ্চিত্রনির্মাতা বারবেট শ্রোডার ২০১৭ সালে এটা তৈরি করেন। চমকপ্রদ বিষয়বস্তু— উগ্র জাতীয়তাবাদী এক সন্ন্যাসী কীভাবে এক ঐতিহাসিক সহিংসতার বীজ ছড়িয়েছিলেন। কাহিনির মূল চরিত্র গেরুয়া পরিহিত মায়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষু আশিন উইরাথু। ফিল্মটা দেখতে দেখতে হতভম্ব হয়ে গেলাম: ভরা সমাবেশে, হাজার হাজার অনুসারীদের উদ্দেশ্যে উইরাথু দাবি করছেন, রোহিঙ্গারা “একটি সৌদি-সমর্থিত বাংলাদেশি বিদ্রোহী দল যাদের উদ্দেশ্য হল মায়ানমারে অনুপ্রবেশ করা, সেখানকার ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধধর্মকে ধ্বংস করা এবং ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা।” বার্মিজ জনগণকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে, ঘৃণাপূর্ণ, সহিংস জাতিগত নির্মূল অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বুদ্ধের পূজারী এক ত্রিচীবর। আন্তর্জাতিক মিডিয়া তাঁকে চরমপন্থী, ইসলামোফোবিক হিসাবে চিহ্নিত করেছে। আল-কায়দার প্রয়াত কুখ্যাত নেতার কথা মনে আছে? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওসামা বিন লাদেন? ঠিক ধরেছেন। লাদেনের সঙ্গে নাম মিলিয়ে উইরাথুকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে “বৌদ্ধ বিন লাদেন”। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? ভাবছেন গুজব? মোটেই তাই নয়। তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম-বিরোধী লিফলেট বিতরণ, মুসলমানদের উচ্ছেদের বিষয়ে অগণিত ফ্যাসিবাদী ইন্ধনমূলক বক্তব্য প্রচার, আর ধর্মোপদেশের নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর ভুরি ভুরি প্রমাণ জ্বলজ্বল করছে। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে: ২০১৩ সালে এক উপদেশ-সভায় উইরাথু বলেছিলেন: “আপনি দয়া, ভালবাসায় পূর্ণ হতে পারেন, কিন্তু একটা পাগল কুকুরের পাশে আপনি ঘুমাতে পারবেন না। আমি তাদের (মুসলিমদের) সমস্যা সৃষ্টিকারী বলি কারণ তারা সমস্যা সৃষ্টিকারী। আমি একজন উগ্র বৌদ্ধ বলে গর্বিত। আমরা দুর্বল হলে আমাদের দেশ মুসলমানদের হয়ে যাবে।’’ আবার ধরুন গ্লোবাল পোস্ট পত্রিকায় দেওয়া উইরাথুর এই মন্তব্যটা: “মুসলমানরা আফ্রিকান ক্যাটফিশের মতো; তারা অত্যন্ত দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে, দারুণ হিংস্র এবং নিজেরাই নিজেদের খেয়ে ফেলে। যদিও তারা সংখ্যালঘু, তবুও তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, আর তাদের চাপের মুখে পড়ে আমরা শুধু ভুগেই চলেছি।”

আসুন এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিই উইরাথুর জীবনের সময়রেখার উপর। মায়ানমারের মান্দালে শহরে ১০ জুলাই, ১৯৬৮ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন উইরাথু। ১৪ বছর বয়সেই তিনি স্কুল ছেড়ে দেন এবং স্থানীয় একটি মঠে একজন কনিষ্ঠ সন্ন্যাসী হিসেবে ভর্তি হন। উইরাথু প্রথম প্রচারের আলোয় আসেন ২০০১ সালে যখন তিনি ‘’নাইন সিক্স নাইন’’ (969) জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হন। সেই সময় থেকেই উইরাথু বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোর মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করেন, সমস্ত মুসলিম দোকান বর্জন করার জন্য বৌদ্ধদের তিনি আহ্বান জানান। মায়ানমার জুড়ে শুরু হয় মুসলিমবিরোধী সভা সমাবেশ। সেই সব জমায়েতে লিফলেট বিতরণ এবং মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদের বিষয়ে হিংসাত্মক প্রচার চালান উইরাথু। এইসব দুষ্কৃতির জন্য ২০০৩ সালে মায়ানমার সামরিক জান্তা উইরাথুকে ২৫ বছরের জন্য জেলে পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাঁর কারাবাসের মাত্র সাত বছর পরেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট থেইন সেনের সরকার ২০১২ সালের জানুয়ারিতে, সাধারণ ক্ষমার আওতায় (general amnesty) তাঁকে মুক্তি দিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট থেইনের উদ্দেশ্যটা কী ছিল শুনবেন? রোহিঙ্গা মুসলমানদের অন্য দেশে পাঠানোর বিতর্কিত পরিকল্পনার প্রচারকার্যে রক্তলোভী শিকারি কুকুর হিসাবে উইরাথুকে স্রেফ লেলিয়ে দেওয়া। থেইন জানতেন, এর চেয়ে ভাল লোক আর তিনি পাবেন না। হ্যাঁ, সেটাই হল, উইরাথু সোৎসাহে মায়ানমার সফর শুরু করেন এবং প্রতি মাসে পরম নিষ্ঠাভরে, অন্ততপক্ষে ১৫টি করে ধর্মোপদেশ দিয়ে যান। কী ছিল সেই ধর্মোপদেশের বিষয়বস্তু? মুসলমানদের বিরুদ্ধে কেবল তাল তাল ঘৃণা ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়। জুন মাসে বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে প্রথম দাঙ্গাটা বেধে যায়। এরপর ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে, মান্দালেতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের একটি সমাবেশের নেতৃত্ব দেন উইরাথু। উইরাথুর দলপতিত্বে ৯৬৯ আন্দোলনের নৃশংস সহিংসতা বহুগুণ বেড়ে যায়। সমাবেশের ঠিক পরের মাস অক্টবরের ৩০ তারিখে, রাখাইন রাজ্যের ৯০ শতাংশ মুসলিম-অধ্যুষিত মংড়ুতে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে তাদের বাড়িঘর থেকে জন্তুর মতো তাড়া করে বের করে দেওয়া হয়। ২০১২ সালের জুন এবং অক্টোবরে সহিংসতা, প্রতিশোধ এবং দাঙ্গার দুটি তরঙ্গ প্রধান বৌদ্ধ দেশটিতে শতাব্দী-প্রাচীন সংঘাতকে তীব্র করে তোলার পর, এক লক্ষেরও বেশি মুসলিম রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয় এবং শত শত নিহত হয়।

প্রসঙ্গত জেনে নিই যে, ৯৬৯ এই তিনটি সংখ্যা বুদ্ধ, বৌদ্ধ অনুশীলন এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের গুণাবলির প্রতীক। ওদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরা আল্লার উদ্দেশ্যে গুণগান করার জন্য “আল্লাহর নামে, পরম দয়াময়, পরম করুণাময়” এই শব্দবন্ধগুলো ব্যবহার করেন যার সংখ্যাসূচক মান যোগ করলে দাঁড়ায় ৭৮৬। জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মিয়ানমারের সাধারণ জনগণকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উৎক্ষিপ্ত করার জন্যই তাঁদের আন্দোলনের নামটিকে ৯৬৯ সংখ্যাতত্ত্বের মোড়কে জড়িয়ে ধুয়ো তোলেন যে, মহাজাগতিক সাংখ্য বিচারের দিক দিয়ে এটা ৭৮৬-র ঠিক বিপরীত। কেউ কেউ তো এও বিশ্বাস করতে থাকে যে, ২১ শতকে বিশ্বে আধিপত্য অর্জনের জন্য ৭৮৬ সংখ্যাটা রহস্যজনকভাবে এক মুসলিম ষড়যন্ত্রের দিকে ইঙ্গিত করে, যেহেতু ৭+৮+৬ যোগ করলে ২১ হয়। কিন্তু এটা একটা ভুল ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে, বার্মার মুসলমানরা দীর্ঘদিন ধরেই তাদের হালাল রেস্তোরাঁ চিহ্নিত করার জন্য ৭৮৬ প্রতীকটি ব্যবহার করে আসছে।

“নাইন সিক্স নাইন” (969)

২০১৩ সালে মধ্য ও পূর্ব মায়ানমার জুড়ে বিভিন্ন শহরে (মেইকটিলা, ওক্কান, লাশিও, কান্তবালু, থান্ডে) একটি ধারাবাহিক মুসলিম-বিরোধী সংঘর্ষ জারি ছিল। যেদিকে তাকানো যায় শুধু অসহায় মানুষের লাশ, রক্ত আর আগুনের গন্ধে আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। টাইম ম্যাগাজিন তাদের জুলাইয়ের কভারস্টোরিতে উইরাথুকে “বৌদ্ধ সন্ত্রাসের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি” হিসাবে বর্ণনা করে এবং সেপ্টেম্বরে মায়ানমারের বৌদ্ধ ধর্ম পরিচালনাকারী রাষ্ট্রীয় সংস্থা ‘’সঙ্ঘ মহা নায়ক’’ ৯৬৯ আন্দোলনকে নিষিদ্ধ করে। এত কিছু ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট থেইন কিন্তু উইরাথুকে “বুদ্ধের পুত্র” এবং শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ “এক মহান পুরুষ” বলে বর্ণনা করেছিলেন। উইরাথুর প্রতি থেইনের সমর্থনের বহর বুঝতে কারুরই অসুবিধা হয় না।

২০১৪ সালে, উইরাথু কলম্বো-ভিত্তিক সিংহলি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘বোদু বালা সেনা’ (বৌদ্ধশক্তির সেনাবাহিনি/বিবিএস) দ্বারা আয়োজিত একটি সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, ৯৬৯ আন্দোলনের কাজ তিনি অব্যাহত রাখতে চান। এর কিছুদিন পরেই, ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারি, ৯৬৯ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন যে জাতীয়তাবাদী সন্ন্যাসীরা তাঁরাই মায়ানমারের ‘জাতি ও ধর্ম রক্ষা সমিতি’ ওরফে ‘মা বা থা’ গঠন করেন। বলা বাহুল্য, এই গোষ্ঠীর মূল মাথা ছিলেন উইরাথু। বিশ্বব্যাপী কট্টরপন্থী উৎসাহীদের সমর্থন পায় এই সংগঠন, সদস্যসংখ্যাও রাতারাতি হু হু করে বেড়ে যায়। বৌদ্ধ মহিলাদের আন্তঃধর্মীয় বিবাহ এবং ধর্মান্তরকরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার জন্য একটি আইনের প্রস্তাব করে ‘মা বা থা’, আইনটি প্রণয়নের জন্য সরকারের উপর কড়া রাজনৈতিক চাপও সৃষ্টি করতে থাকে তারা। এরই মধ্যে, মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংহি লি তাঁর ১০ দিনের মায়ানমার সফরে আসেন। মায়ানমারে মুসলিম সংখ্যালঘুদের দুর্দশা, ও তাদের প্রতি পদ্ধতিগত বৈষম্যের কথা তিনি জনসমক্ষে তুলে ধরেন। ‘মা বা থা’-র প্রস্তাবিত আইনের খসড়াটিরও তিনি সমালোচনা করেন। ব্যস, আর যায় কোথা! উইরাথু মিসেস লি-কে একজন “বেশ্যা” এবং “কুত্তা” বলে অভিহিত করেন। উইরাথুর ঘৃণ্য মানসিকতা ও নারীবিদ্বেষের আরেক অকাট্য প্রমাণ এই যৌনতাবাদী মন্তব্য। আশ্চর্যের ব্যাপার! ২০১৫-তে মায়ানমারে ওই জাতি এবং ধর্ম সুরক্ষা আইনটি কিন্তু দিব্যি পাশও হয়ে যায়।

‘মা বা থা’-র জঘন্য কীর্তিকলাপের এখানেই শেষ নয়। মায়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের দ্বারা পরিচালিত গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল ‘মা বা থা’। ২০১২ সালে আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের দ্বারা কথিত রাখাইন বৌদ্ধ মহিলা মা থিদা হত্বেকে ধর্ষণ ও হত্যার একটা বাজে প্রচারণা, একটা মিথ্যা ছড়িয়ে দিয়ে বৌদ্ধ ও মুসলিমদের বিভক্ত করেছিল ‘মা বা থা’; রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বার্মিজ জনগণকে তাতিয়ে তুলেছিল। হত্বেকে মোটেই ধর্ষণ করা হয়নি বরং তাকে কেবল হত্যা করা হয়েছিল। যে ডাক্তার তার দেহ পরীক্ষা করেছিলেন তিনি বলেছিলেন যে, তাকে মেডিকেল রিপোর্টে ধর্ষণ হয়েছে বলে মিথ্যে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়েছিল। বলা বাহুল্য এই নৃশংস সহিংসতার ঘৃণ্য কাজে সামরিক সংস্থার পূর্ণ সমর্থন ও সহায়তা ছিল। ধর্ষণের ঘটনাটি সরকারি এজেন্টরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল এবং মায়ানমার জুড়ে রোহিঙ্গা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার তরঙ্গ শুরু করার জন্য এক লঞ্চিং প্যাড হিসাবে এটা ব্যবহৃত হয়েছিল। ২০১৪ সালেও ঠিক একইভাবে, মান্দালেতে একজন বৌদ্ধ মহিলার ধর্ষণের অভিযোগে মুসলিম দোকানদারদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, যার রিপোর্ট ‘মা বা থা’ সদস্যরাই সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিল, ফলস্বরূপ শহরে তিন দিনের মারাত্মক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল।

এরপর ২০১৫-তে অং সান সু কি-র নেতৃত্বে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি/NLD) দেশের শাসনক্ষমতায় আসে। ৯ অক্টোবর ২০১৬, সশস্ত্র ব্যক্তিরা রাখাইন রাজ্যের বেশ কয়েকটি সীমান্ত পুলিশ পোস্টে হামলা চালায় এবং নয়জন পুলিশকর্মীকে হত্যা করে। অস্ত্র ও গোলাবারুদও লুট করা হয়। মূলত মংডু টাউনশিপে এই হামলার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা আগুনে ঘি ঢালার সমানই উত্তেজনা ছড়ায়। চরমপন্থী ভিক্ষু গোষ্ঠী তো রোহিঙ্গাদের সঙ্গে জড়িত একটি বিদ্রোহের সম্ভাবনার কথা অনেক আগেই রটিয়ে দিয়েছেন, এবার আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ফেসবুকে নিহত পুলিশের গ্রাফিক ছবি পোস্ট করতে থাকেন উইরাথু।

‘সঙ্ঘ মহা নায়ক’ ২০১৭ সালের ২৩ মে ‘মা বা থা’-কে নিষিদ্ধ করে, আর উইরাথুকে তো এর আগে মার্চ মাসেই এক বছরের জন্য ধর্মপ্রচার থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছিল তারা। উইরাথু মুখে “এক্স” টেপ আটকে অনলাইনে নিজের ছবি পোস্ট করে এর প্রতিবাদ জানান। তিনি এও অভিযোগ করেন যে সুকির সরকার বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিকে মুসলমান আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সামরিক বাহিনির প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে তুলছেন। ‘মা বা থা’ তড়িঘড়ি আবার তাদের নাম পরিবর্তন করে হয়ে যায় ‘বুদ্ধ ধম্ম চ্যারিটি ফাউন্ডেশন’ এবং পুরানো কার্যক্রমই চালিয়ে যেতে থাকে। আর উইরাথুও ঠিক তেমনই সঙ্ঘের নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে মুসলিমবিরোধী ধর্মোপদেশ প্রদানের জন্য তাঁর দেশজোড়া ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন, এমনকি রাখাইনেও হাজির হয়ে যান, যেখানে এক বৃহৎ সংবেদনশীল মুসলিম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বসবাস করছে।

২০১৭-র ২৫ আগস্ট, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেই ভয়ঙ্করতম জাতিগত নির্মূল অভিযান (যখন প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ রোহিঙ্গাকে জোরপূর্বক প্রতিবেশী বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল) শুরু হওয়ার পরপরই, রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংসতার কেন্দ্রস্থল উত্তর রাখাইনে উইরাথুকে রাষ্ট্র-চালিত মিডিয়া সফরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক দমন-পীড়নকে পুরোদস্তুর সমর্থন করতে দেখা যায়।

এখানেই কি শেষ? ২০১৮ সালে, ইয়াঙ্গুন শহরে একটি সমাবেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দেওয়ার সময় উইরাথু বলেছিলেন, যেদিন মায়ানমারের কর্মকর্তাদের রোহিঙ্গা বিতাড়নের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সামনে আনা হবে, সেইদিন তিনি নিজেই বন্দুক হাতে তুলে নেবেন। ভাবা যায়? শব্দগুলো নির্গত হচ্ছে একজন কথিত অহিংসার পূজারীর মুখ থেকে! এই ধরনের অগণিত ঘৃণাত্মক সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের জন্য ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ফেসবুক তাঁর অ্যাকাউন্টটি মুছে দেয়।

আচ্ছা কী অজুহাত দিয়েছেন উইরাথু তাঁর এই চরমপন্থার, বৌদ্ধধর্মে যা গর্হিত? উইরাথু তাঁর কার্যকলাপের ন্যায্যতা দিয়েছেন এই বলে যে, চরম সময়ের জন্য চরম পদক্ষেপেরই প্রয়োজন।

অতঃপর, ২০১৯ সালের এপ্রিলে উইরাথুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে প্রো-মিলিটারি সমাবেশে, তিনি মায়ানমারের এনএলডি বে-সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী বক্তৃতা প্রদানের মাধ্যমে ঘৃণা ও অবমাননা উস্কে দিচ্ছেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে থাই কর্তৃপক্ষ উইরাথুর দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে এবং পরের মাসে মায়ানমারের একটি আদালত তাঁকে গ্রেফতারের জন্য একটি পরোয়ানাও জারি করেছিল যাতে উইরাথুর তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি এক বছরের জন্য আত্মগোপনে চলে যান। এরপর ২০২০ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

২০২১-এর ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানে সু কি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং জুন্টা সরকার ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে উইরাথুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয় ও উইরাথুকে মুক্তি দেয়, কিন্তু এর পিছনের কোনও কারণ কিন্তু তারা জানায়নি। শুধু বলেছে যে উইরাথু নাকি একটি সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি আছেন। কিন্তু সেই চিকিৎসার অবস্থা কারুরই গোচর হয়নি। সকলের বোধ হয় চমকাবার আরও কিছু বাকি ছিল যখন জানা গেল ২০২২ সালের নভেম্বরে, দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘থিরি পিয়াঞ্চি’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন ভিক্ষু উইরাথু।

সন্দেহ হয় এগুলো সবই কি কাকতালীয় ঘটনা? প্রথমে প্রেসিডেন্ট থেইন, পরে জুন্টা সরকার— সকলেই কোনও এক রহস্যজনক কারণে বিতর্কিত উইরাথুকে রাজনৈতিক অনাক্রম্যতার সুরক্ষা প্রদান করেছেন। তাই, ঘৃণ্যতম অপরাধ করেও বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছেন উইরাথু বারবার। উইরাথুর বর্ণবাদী, ধর্মান্ধ এবং যৌনতাবাদী রটনা এবং অপরাধমূলক উস্কানিকে যদিও অনেক মহলই নিন্দা করেছে, তবু অনেক বৌদ্ধদের কাছেই তিনি খুব জনপ্রিয়, এবং তা শুধু তাঁর জন্মভূমি মায়ানমারে নয়, শ্রীলঙ্কার মতো জায়গাতেও লক্ষণীয়। মান্দালের বৌদ্ধ মঠ মাসোয়েইনে প্রায় ২,৫০০ ভিক্ষুর সভাপতি উইরাথুর ফেসবুক জুড়ে হাজার হাজার অনুসারী ছিল এবং তাঁর ইউটিউব ভিডিওগুলো কয়েক হাজার বার করে দেখা হয়েছে।

দেখুন, বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে বহু মানুষ, বিশেষত পাশ্চাত্যবাসীদের মনের মধ্যে যে সাধারণ ছবিটা আঁকা রয়েছে তা হল: এর অনুগামীরা এতটাই শান্তিপ্রিয়, এতটাই সহনশীল যে, তাঁরা একটা মাছিকেও আঘাত করেন না। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক সক্রিয়তায় সন্ন্যাসীদের অংশগ্রহণের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মায়ানমারে ২০০৭ সালের আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসজুড়ে যে ‘স্যাফরন রেভোলিউশন’ শুরু হয়, তা এর এক আদর্শ উদাহরণ। তদানীন্তন জাতীয় সামরিক সরকারের জ্বালানির বিক্রয়মূল্যের উপর ভর্তুকি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তের কারণে এই বিক্ষোভ দানা বাঁধে। ক্রমে ক্রমে তা সমাজের বিভিন্ন স্তরে উল্কার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এই নাগরিক প্রতিরোধের প্রচারণায় ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, নারী-পুরুষ সকলেই সামিল হয়েছিলেন এবং হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু এতে নেতৃত্ব দেন। এই প্রতিবাদটি অহিংস থাকলেও সাম্প্রতিককালে, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, এবং মায়ানমারের মতো জায়গায় সন্ন্যাসীদের প্রতিরোধ অতি-জাতীয়তাবাদী এবং চরমপন্থী রূপ ধারণ করেছে। আসলে, বিশ্বধর্মের শিক্ষায় নিহিত নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ যাই হোক না কেন, ধর্মগুলো নির্ভরযোগ্যভাবে এই মূল্যবোধগুলিকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় এবং ধর্ম অনুশীলনকারীরা মনুষ্যচরিত্রের বিচিত্রতায় ফিরে যাওয়ার প্রবণতা দেখায়। বৌদ্ধধর্মও এর ব্যতিক্রম নয়। বৌদ্ধ চরমপন্থীরা ইসলামকে একটি “বিপজ্জনক” বা “নৃশংস” ধর্ম হিসাবে গণ্য করে, এবং এই ধারণা পশ্চিমা দেশগুলো থেকেই সরাসরি ধার করা হয়েছে। বৌদ্ধ উগ্রপন্থীদের দ্বারা সঙ্ঘটিত চরম সহিংসতার নজিরের মুখে দাঁড়িয়ে পশ্চিমা সমাজ এখনও বৌদ্ধধর্মকে একটা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ধর্ম হিসেবেই ধরে রেখেছে, অথচ, একই সঙ্গে ইসলামের স্টেরিওটাইপগুলোকে একটি সহিংস ধর্ম হিসাবে মান্যতা দিয়ে চলেছে। মুসলিম-অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দ্বন্দ্বগুলোতে পশ্চিমা হস্তক্ষেপ ব্যাপক অশান্তির সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে সঙ্ঘর্ষের ব্যাপারে তাদের তেমন কোনও অভিজ্ঞতা হয়নি। আরেকটা ব্যাপার হল: দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম অনুশীলন করে। বৌদ্ধধর্মের এই শাখাটি অহিংসা ও শান্তির বিষয়ে বৌদ্ধধর্মের অন্যান্য রূপ থেকে আলাদা। এই অনুশীলনটি বৌদ্ধ ঐতিহ্যের প্রাচীনতম গ্রন্থগুলোকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে মেনে চলে এবং সাধারণত বৌদ্ধধর্মের অন্যান্য (মহাযান এবং বজ্রযান) শাখার তুলনায় আরও কঠোরভাবে সন্ন্যাসবিধির পালনের উপর জোর দেয়; জাতীয়তাবাদী মূল্যবোধ এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মধ্যে সংযোগের সঙ্গেও এটি আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। কিছু থেরবাদ সম্প্রদায় তো অ-বৌদ্ধদেরকে অবমানবিক বা দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ হিসাবেই দেখে। বলে রাখা ভাল: প্রায় ৫৪ মিলিয়নের দেশ মায়ানমারে প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রায় ৯ জন মানুষই বৌদ্ধ, এবং কার্যত তারা সক্কলেই থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম পালন করে।

এতক্ষণের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে উইরাথু এবং তাঁর অপরাধী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দল বৌদ্ধ ধর্মকে অনৈতিকভাবে কব্জা করেছিলেন এবং মায়ানমারের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক আলোচনাকে বিষিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু কেন? সন্ন্যাসীরা বলেছেন যে, তাঁদের ব্যাপক উদ্বেগ এবং ভয়ের কারণ এই যে, মায়ানমারে একটা উগ্র ইসলামের পুনরুত্থান ঘটবে এবং বৌদ্ধ ধর্ম রসাতলে যাবে যেমনটি ঘটেছে শতাব্দী আগে আজকের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায়। এদিকে, মায়ানমারের ২০১৪ সালের আদমসুমারির তথ্যের উপর নজর করলে দেখা যাবে যে, বার্মিজ জনসংখ্যার অধিকাংশই ছিল বৌদ্ধ (৮৯.৯ শতাংশ), মুসলমান ছিল মাত্র ৪.৩ শতাংশ; ৫১৫ লক্ষ মানুষের এই দেশে বৌদ্ধরা যেখানে সংখ্যায় ছিল ৪৫১ লক্ষ, মুসলিমরা ছিল সেখানে মাত্র ১২ লক্ষ। এর মধ্যে রাখাইন রাজ্যের আনুমানিক ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম রাষ্ট্রহীন ছিল কারণ মায়ানমার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এবং তারা আনুষ্ঠানিকভাবে মায়ানমারের আদমসুমারির অন্তর্ভুক্তই ছিল না। সুতরাং এমতাবস্থায় কোনও সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠী কীভাবে একটা প্রভাবশালী ধর্মের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠেছিল, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। আসলে বহুদিন ধরেই, মায়ানমারের বিভিন্ন জাতিগত ও বর্ণগত গোষ্ঠীগুলিকে পরস্পরের প্রতি বিষিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে তারা একে অপরকে ঘৃণা করে, হিংসা করে। শাসনকারী সামরিক বাহিনি যারা শক্তিশালী অস্ত্রকৌশল এবং চরমপন্থী নিয়মনীতি নিয়ে ভগ্ন দেশকে শাসন করছিল সেই সামরিক জুন্টা কখনওই চায়নি যে, দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে কোনও পরিবর্তন আসুক, এনএলডি সরকারের গণতন্ত্র কায়েম হোক। এনএলডি সরকারের সঙ্গে সন্ন্যাসীদের যে বিরোধিতা ছিল, তার পূর্ণ সুবিধা নেওয়ার জন্য দেশের অভ্যন্তরে সবসময় একটা জাতিগত বিভেদ বিভাজনের উত্তেজনাময় আবহাওয়া চালু রাখতে যার-পর-নাই ইচ্ছুক ছিল তাতমাদাও জুন্টা। সংখ্যালঘু মুসলমানদের, বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনগণদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার পরিবেশকে দীর্ঘায়িত করার জন্যই সরকার উইরাথু এবং তাঁরই মতো বিদ্বেষপূর্ণ, জেনোফোবিক সন্ন্যাসীদেরকে ব্যবহার করেছিল, ‘মা বা থা’ গোষ্ঠীর মতো উগ্র বৌদ্ধদের সমর্থন করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ‘মা বা থা’ সেনাবাহিনি দ্বারাই বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। একজন বিশেষজ্ঞ তো এ-কথাও জানিয়েছেন যে, সামরিক শাসকরা ‘মা বা থা’ সদস্যদের ওয়ার্ড প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ করতে অবধি দ্বিধা করেনি। ২০১৫-তে সু কি এবং এনএলডি-র হাত ধরে মায়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী এবং সামরিক বাহিনির রক্ষণশীল নেতৃত্ব— এই দুই শ্রেণির কাছেই উইরাথুর জনপ্রিয়তা ঠিকই বজায় ছিল। আর সেটাই সু কি-র সরকারকে একটা দ্বিধার মধ্যে ফেলে দেয় কারণ বার্মিজ জনসাধারণের বেশিরভাগই উইরাথুর মুসলিম-বিরোধী প্রোপাগান্ডায় আস্থা ও বিশ্বাস সঁপে দিয়েছে, সুতরাং তাদের সমর্থন বজায় রাখা যায় কীভাবে? সারা মায়ানমার জুড়ে ইসলামের প্রতি যে অসীম বিদ্বেষপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছিল উইরাথুর সমর্থকরা, তা প্রতিরোধ করতে যথেষ্ট চেষ্টা করেননি সু কি, চলতি হওয়ার মতোই তিনি তার সঙ্গে সায় দিয়েছেন। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ: ২০১৫ সালের নির্বাচনের সময়ে এনএলডি প্রতিটি মুসলিম প্রার্থীকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, যদিও তাঁদের যোগ্যতার কিছুমাত্র কমতি ছিল না। যদিও ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে যে সামরিক দমন-পীড়ন হয়েছিল তার জন্য সু কি দায়ী ছিলেন না, কিন্তু সু কি-র মুখ থেকে সে-সম্বন্ধে একটিও নিন্দাবাক্য নিঃসৃত হয়নি। বরং সু কি গলা ফুলিয়ে বলেছিলেন যে, সেনাবাহিনির ওই সমস্ত পদক্ষেপগুলো আসলে রোহিঙ্গা মিলিশিয়া বিদ্রোহ দমনের একটা প্রতিক্রিয়ামাত্র ছিল। সু কির ভণ্ডামো এখানেই শেষ হয়নি, গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত জেনারেলদেরকে তিনি “বেশ মিষ্টি” বলেও বর্ণনা করেছেন। আসলে, রোহিঙ্গাদের প্রতি সামান্যতম সহানুভূতিও পোষণ করে না যে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাদের কাছে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্যই “দ্য লেডি” ওরফে মিসেস সু কি ততদিনে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রতে পরিণত হয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র:

  1. Palatino, Mong. The Politics of Numerology: Burma’s 969 vs. 786 and Malaysia’s 505. In SE Asia, some numbers are used for political and religious ends. The Diplomat. May 16, 2013.
  2. Siddiqui, Dr. Habib. Correcting The False Narratives of Ma Ba Tha – OpEd. Eurasia review. Feb 9, 2016.
  3. Rosenthal, Randy. What’s the connection between Buddhism and ethnic cleansing in Myanmar? Lion’s Roar. Sep 10, 2017.
  4. Sumon, Shehab. Ashin Wirathu: The Buddhist bin Laden. Arab News. Jul 30, 2019.
  5. Wirathu: Myanmar military releases firebrand Buddhist monk. BBC. Sep 2021.
  6. Aung San Suu Kyi: Myanmar democracy icon who fell from grace. BBC. Dec 6, 2021
  7. Morada, Noel M. Hate Speech and Incitement in Myanmar before and after the February 2021 Coup. Global Responsibility to Protect, BRILL. Mar 03, 2023.
  8. Khan, Sauid Ahmed. The Unholy Nexus Between the Monks and Military in Myanmar. Australian Institute of International Affairs. Mar 22, 2023.
  9. Chappus, Eva. Buddhist Nationalism: Rising Religious Violence in South Asia. DU Undergraduate Research Journal Archive Vol. 4, Issue 2, Article 1. May 10, 2023.

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...