বেশ্যাবর্জিত পুরুষেরা

অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

 

—কে কে আছে বাড়িতে?
—কে আবার— মা আর আমি।

মেয়েটির নাম শিবানী। বাড়ি ছিল আহিরীটোলায়। গঙ্গার ধারে। এইভাবেই একদিন পরিচয় হল নির্জন স্টেশনটায়। কথা বলতে বলতে নিরঞ্জন অনুভব করে, তার লিঙ্গের মধ্যে একটা সুড়সুড়ানি শুরু হয়েছে।

নিরঞ্জন বলল, মা কী করে?

—লোকের বাড়ি-বাড়ি বাসন মাজে।

দিন পনেরোর মধ্যেই এমন মজে গেল নিরঞ্জন, পাড়ার মন্দিরে বিয়েটা করে ফেলল। বাড়িতে সে একা। বাবা-মা কবেই মারা গেছে। ভাই বউ নিয়ে আলাদা থাকে। নিরঞ্জনের বিয়ে হচ্ছিল না। কেউ দিচ্ছিল না। সেও মেয়ে খুঁজে পাচ্ছিল না।

মেয়েটি নিজের বয়স আঠাশ বলেছিল বটে, কিন্তু তাকে দেখায় যেন পঁয়ত্রিশ। তা হোক, বয়সে কিছু যায় আসে না। বিয়েটা হলেই হল। নিরঞ্জনের নিজের বয়সও কিছু কম হল না। সে এখন বিয়াল্লিশ। তাই বয়সের হিসেবের গোলমালের মধ্যে না পড়াই ভাল। তাছাড়া নিরঞ্জনের একটি চোখ বহুদিন আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। কানাকে কে বিয়ে করবে? মেয়েটি যে রাজি হয়েছে, এই ঢ়ের!

—কী করে হল?
—কী আবার— অ্যাক্সিডেন্ট।
—কী করে হল?
—কেন? লরি টু লরি।
—বুকে কোথাও লাগেনি তো? হাড়গোড় কোথাও ভাঙেনি তো? কবে ঘটল এমনি ঘটনা?
—তিন বছর হয়ে গেছে। সেই থেকে আর লরি চালাতে পারি না।

আলাপের পরে, দিন পনেরোর মধ্যে, বিয়ের আগে— এইসব কথাই হয়েছিল।

বিয়ের পরে খুব খুশি ছিল নিরঞ্জন। বউকে সন্দেহ করার কোনও কারণ ছিল না। সে করতেও চায়নি। এক চোখে লরি চালানো যায় না বলে সে এখন খালাসির কাজ করে। এছাড়া মাল লোডিং-আনলোডিং করতে হয়। ফলে কাজের ঠেলায় রোজ সে ঘরে ফিরতে পারে না। বাইরে বাইরেই কেটে যায় টানা দু-তিন দিন। বউ ঘরে একা রয়ে যায়।

বিয়ের তিনমাস পরে একবার জ্বর হল নিরঞ্জনের। ঘরেই পড়ে রইল একটানা তিনদিন, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না। তখন সে খেয়াল করে দেখল, তার বউয়ের ফোন নাগাড়ে বেজে যাচ্ছে। মিনিটে মিনিটে ফোন আসে। ফোন আসা শুরু হয় দুপুরের পর থেকে। চলে রাত দশটা, এগারোটা অব্দি। একটি ফোন ধরে ছাড়তে না ছাড়তেই আবার টুং টুং করে বেজে যায়।

—কারা কল করে এত?
—আমার বন্ধু-বান্ধব।
—এত বন্ধু তোমার?
—গঙ্গাপাড়ের মেয়ে আমি, বন্ধু থাকবে না?

দিন যায়, রাত যায়। সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে। বাংলা মাস যায়, ইংরেজি মাস যায়। মাঝেমাঝে দেখা যায়, বউ উধাও। এ যেন মাদারির খেল। এই আছে এই নেই! শিবানী কোথা যায়?

—আমি যাই আমার মায়ের কাছে।
—এত ঘনঘন মায়ের কাছে যেতে লাগে কেন?
—মায়ের যে জ্বর! যেমন তোমার হয়েছিল।

হ্যাঁ। ঘাড় নাড়ে নিরঞ্জন। এই জ্বরটা এখন সবার হচ্ছে।

আবার দিন যায়। বউ নানা অজুহাতে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। কিছুতেই যেন তার নাগাল পায় না নিরঞ্জন। একদিন সে বউয়ের অনুপস্থিতিতে ফোন হাতে নেয়। আসা ফোনে ঘুরিয়ে কল করে। প্রতিটি কলেই শোনা যায় কোনও-না-কোনও পুরুষকণ্ঠ।

আরও দিন বয়ে যায়। ক্রমে নিরঞ্জনের মধ্যে এই ধারণা জন্মায় যে, শিবানীর কিছু গোলমেলে ব্যাপার আছে। সে গোপনে শিবানীকে ফলো করতে থাকে। একদিন দেখে, শিবানী বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে একটা সাদা গাড়িতে উঠে পড়ে। কোনওদিন আবার কোনও বাইক এসে শিবানীকে তুলে নিয়ে যায়।

বাইরে গিয়ে সে যে অকাজ-কুকাজ করছে সেটা টের পেয়েছিল নিরঞ্জন তার মুখে মদের গন্ধ পেয়ে। নিরঞ্জন এখন আর মদ খায় না। সে যে মদ কখনও খায়নি, তা নয়। ড্রাইভার হলে মদ খেতেই হয়। নইলে গা-গতরের ব্যথা যায় না। রাত-বিরেতে চালানো যায় না। ঘন্টার পর ঘন্টা ডিউটি করতে হলে মদই হল শেষ ভরসা। যেদিন তার অ্যাক্সিডেন্ট হয় সেদিন সে মদ খেয়েই গাড়ি চালাচ্ছিল। হাইরোডের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লরিতে তার লরি গিয়ে সোজা ধাক্কা মারে আর তার স্টিয়ারিং খুলে এসে লাগল চোখে। চোখ অন্ধকার হয়ে গেল।

সেই থেকে আর মদ ছোঁয় না নিরঞ্জন। কিন্তু মুখ থেকে মদের গন্ধ পেলে সেটা সে বুঝবে না, তা হয় না। শিবানী সেদিন স্বীকার করেনি যে, সে মদ খেয়ে বাড়িতে ঢুকেছিল।

এইখান থেকে তাদের মধ্যে নানান কথাকাটি ও ঝামেলা, ঝগড়ার সূত্রপাত। তারপরে একদিন শিবানী সেই যে বেরোল, আর ফিরল না।

শিবানী চলে যাওয়ার পর তার বাড়িতে নানান বয়সী পুরুষের আনাগোনা বেড়ে গেল।

কেউ জানালা দিয়ে উঁকি দেয়।

কেউ দরজা ঠেলে।

কারও বা উঠোনে ঘোরাঘুরি করা অব্যেস।

অনেকে আবার বাড়ির আমগাছে উঠে বসে থাকে।

আচ্ছা ফ্যাসাদ!

নিরঞ্জন বলে, কী ব্যাপার হে, তোমরা কারা? এমনি করে কেন ঘিরে ফেলো লোকের বাড়ি?

পুরুষেরা বলে, শিবানী আছে?

—শিবানীকে কোথাও পাচ্ছি না।
—শিবানীকে ডেকে দিতে পারো একবার?

আশ্চর্য দাবি এদের। অবাক করা চাহিদা! অভূতপূর্ব তাদের মিলজুল। কখন কারা আসে, বোঝা দায়। একা আসে না দলবেঁধে ঘুরে যায় তার বাড়ি— সেটাও কখনও জানা যায় না। পুরুষের সংখ্যাধিক্য বাড়লে কথা-কাটাকাটি ও মারপিট শুরু হয়; শেষে তারা রক্তাক্ত হয়ে চলে যায়। কিন্তু শিবানীর কোনও খবর নেই।

সে প্রতিটি পুরুষকে ডেকে বলে,

—তোমরা সুস্থ তো?
—এডস নেই তো?
—সিফিলিস?
—লিঙ্গে ঘা?
—এইসব হলে জানবে তা হল শিবানীর সঙ্গে উদ্দাম যৌনজীবন যাপনের আবশ্যিক ফল।  লিঙ্গ খসে যেতেও পারে। কত কিছু হতে পারে তা ভগবানও জানে না। আরও কী কী হতে পারে তা হয়তো বলতে পারে রাক্ষস আর খোক্কস। তাই তোমরা নিজেদের লিঙ্গকে নিয়ন্ত্রনে রেখো।

অমনি তারা সবেগে ঘাড় নাড়ে আর বলে,

—না না না।
—নেই নেই নেই।
—না-হে, না। কিছু নেই।

নিরঞ্জন বেকুব বনে যায়। সে কি তবে হতেছে একেলা? একলা জমির ধুলোমাখা মেঠো ফসল? একলা বয়ে চলা এক ধানমাঠ? নাকি একাকী উড়তে থাকা এক পায়রা? কোনটা?

পুরুষ-রা বলে, মন করো খাঁটি/মিলবে বেশ্যাতলার মাটি।

—আহা আহা—

নিরঞ্জন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। বলে, ব্যাপারটা তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াল?

পুরুষ-রা বলে, দাঁড়াবার কিছু নেই। তোমার দাঁড়ায় না বলে সে দাঁড়িয়ে থাকা লোকের কাছে ছুটে যায়। সবই চুডুৎকলের খেল।

হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নিরঞ্জন বলে, তার মানে?

—মায়া মায়া। চুং-চাং-ফুং।
—আহা, চুড়ুৎ-চুড়ুৎ-চুড়ুৎকল।
—হে সমবেত বেশ্যাপ্রেমীগণ, একত্রে বলো, জয় জয় চুডুৎকলের জয়।

গালে হাত রেখে নিরঞ্জন বলে, তাহলে? এখন আমি কী করব?

—নাচো!
—হ্যাঁ হ্যাঁ, নাচ ছাড়া তোমার এখন কিচ্ছু করার নেই। তাই নাচো আর বগল বাজাও।

সেই সময় একটা লোক এসে তার কাছে বসে। লোকটা রোগা, লম্বা। বয়স বছর পঞ্চান্নর মতন হবে। সঙ্গে একটি লড়ঝড়ে সাইকেল। তার নাম নিতাই কর্মকার। সে বলে, প্রথম যৌবনে আমিও তোমার মতন এক বেশ্যার প্রেমে পড়েছিলাম। তার নাম ছিল কুমারী বিনি হালদার।

—সত্যি নাম?
—সেই সময় সত্যি বলে মনে হয়েছিল। এখন আর কিছু মনে হয় না।
—তারপরে?
—বিনিকে আমি ঘরে নিয়ে আসি।
—তারপরে?
—বিয়ে করিনি।
—কেন?
—একসঙ্গে থাকতাম। আর একসঙ্গে থাকতে গেলে মনের মিল হলেই হল, আর কিছু দেখার দরকার নেই। বিয়েটা বাহুল্যমাত্র।
—বলে যাও।
—বিনি এক বছর পরে ফিরে গেল।
—নিরুদ্দেশ?
—হ্যাঁ।
—শিবানীর মতন! তুমি কি তাকে বকাঝকা করেছিলে?
—কেন করব? আমি তো জানি, সে একজন বেশ্যা।
—কিন্তু আমি তো জানতাম না।
—শিবানীকে দেখে তুমি কিছু বুঝতে পারোনি?
—কী করে বোঝা যায় আমি জানি না। ওকে প্রথম দেখেই লিঙ্গের মধ্যে এক সুড়সুড়ানি অনুভব করেছিলাম। আর সেটাই ওর প্রতি আমার আসক্তির কারণ। কিন্তু বেশ্যা জেনেও তুমি বিনিসুতোকে বিয়ে করেছিলে কেন?

নিতাই বলে, ওই বললাম যে, বিয়েটা সারিনি। তবে নামটা তুমি ভাল দিলে হে, বিনিসুতো। চমৎকার! আমাদের, বেশ্যাসঙ্গপ্রিয়দের জীবন ওই বিনিসুতোয় গাঁথা। আমরা একসঙ্গে ছিলাম; কারণ আমি দেখেছি, বেশ্যাদের মধ্যে আলাদা একটা ব্যাপার আছে। আলাদা একটা গন্ধ আছে তাদের শরীরে। আমার মনে হয়, তোমাকেও আবিল করেছিল বেশ্যা মেয়েটির গায়ের ওই গন্ধ।

—তা বটে! বলে দুলে দুলে ঘাড় নাড়ে নিরঞ্জন। বলে, হ্যাঁ, সেই গন্ধে লিঙ্গের সুড়সুড়ানি বেড়ে যায়। আমি ভেবেছিলুম ওই গন্ধ হল মাটির। গঙ্গামাটির। সে-যে গঙ্গাপাড়ের মেয়ে। কিন্তু সে চলে গেল কেন?
—ওরা অমনিই। চলে যায়, কিন্তু বলে যায় না।
—বিনিকে ফেরানোর চেষ্টা করোনি?
—করিনি বললে ভুল হবে। কতক কতক চেষ্টা করেছি। নানা বেশ্যাপাড়াতে পাক দিয়েছি। প্রত্যহ সাইকেল নিয়ে ঘুরেছি। যদি তার সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। কিন্তু সব ফক্কা! সে বেমালুম উবে গেছে।
—তবে ঘোরো কেন?
—ঘুরলে মনোকষ্ট দূর হয়।
—আর?
—বিষাদ হয়ে যায় মেঘ আর বৃষ্টি।
—আর?
—মনে আলো লাগে।
—কীসের আলো?
—বেশ্যাদ্বারের মাটির আলো।
—তবে আমিও তাই করি। যদি খুঁজে পাই শিবানীকে।
—তাই করো।
—একা যাব?
—আমি যাব বলছ?
—তোমারও তো খোঁজা বাকি। হয়ত বিনিসুতো আজও চাইছে তুমি তাকে খোঁজো।
—হ-হ্যাঁ, জীবনে অনেক কিছু খোঁজা বাকি রয়ে গেছে। দেখো, আমরা হলাম, বেশ্যাবর্জিত দুই পুরুষ। আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। নতুন করে কিছু পাওয়ার নেই, হারাবার নেই। কারণ একজন বেশ্যা যখন তার নিজের জীবন থেকে কাউকে বের করে দেয়, ছুড়ে ফেলে দেয়, ধরে নিতে হবে সে একজন কামনারহিত পুরুষ। চলো, সেই কামনাকে আবার নতুন করে জাগাই আমরা।

গঙ্গাপাড়ের নিকটবর্তী কোনও বেশ্যাপাড়ায় যদি আপনারা কেউ যান, যদি দেখেন দুটি প্রৌঢ় মানুষ কাউকে কিছু না বলে, নীরবে বেশ্যাপাড়ার গলির মধ্যে সাইকেলে চেপে পাক দিয়ে যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে… জানবেন তারা হল যথাক্রমে … এবং …।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...