১৮৩০-৪০-এর দশকের কলকাতা— বরফের বাণিজ্য, মেডিসিনে বরফের ব্যবহার

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

 



সুদূর আমেরিকা থেকে রফতানি করা বরফ কলকাতায় পৌঁছে চিকিৎসা এবং পাবলিক হেলথ তথা জনস্বাস্থ্যের একটি কার্যকরী হাতিয়ার হয়ে উঠল ১৮৩৩ থেকে ১৮৫২ সালের মধ্যে। এ এক কম জানা, চিত্তাকর্ষক ইতিহাস

 

 

আজ এ-কথা ভাবতে বেশ আকর্ষণীয় লাগে যে, গ্ল্যাডউইন নামে এক সাহেব ১৭৮৮ সালে এক মুসলিম লেখকের লেখা অনুবাদ করেছিলেন। সে-লেখার দু-একটি জায়গা নজর কাড়ে— (১) “নবাব মুর্শিদকুলি খান সমস্তরকমের বিলাসিতা— সে পোশাকআশাকেই হোক বা খাবার ব্যাপারে— পরিহার করে চলতেন”; (২) “কিন্তু তাঁর খাবারের টেবিলে ক্রিম বা জমানো শরবত পছন্দের না হলেও বরফ ছিল খাদ্যতালিকার একেবারে প্রথমে”; এবং (৩) আরও মজার— “শীতের সময়ে মুর্শিদকুলি খানের গোমস্তা খিজির খানকে রাজমহল পর্বত থেকে সারা বছরের বরফ সংগ্রহের জন্য প্রতিবছর পাঠানো হত। শীতের সময়ে সংগ্রহ করা এ বরফ সারা বছর ধরে ব্যবহার করা হত। বরফ সংগ্রহ এবং নিয়ে আসার ব্যয় বহন করত স্থানীয় জমিদারেরা।”[1]

অর্থাৎ ব্রিটিশ রাজপুরুষ এবং ডাক্তারদের হাত ধরে কলকাতায় বরফের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আগেই, অন্তত ৫০ বছর আগে, মুর্শিদকুলি খানের মতো মুসলিম শাসকদের দরবারেও বরফের জনপ্রিয়তা ছিল। এবং এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে সে-সময়ে রাজমহল পাহাড়ে সারা বছরের জন্য সংগ্রহ করে রাখার মতো যথেষ্ট পরিমাণ বরফ জমত। মানুষের আক্রমণে প্রকৃতি তখনও এরকম ধ্বস্ত হয়ে যায়নি, ইতিহাস সে সাক্ষ্য দিচ্ছে।

 

কলকাতার সংবাদ

উনিশ শতকের বিখ্যাত সমাচার দর্পণ পত্রিকায় ১৮ মাঘ, ১২৪২ তথা ৩০ জানুয়ারি, ১৮৩৬-এ একটি ছোট্ট সংবাদ প্রকাশিত হয় “চুঁচুড়ায় বরফ” শিরোনামে। সে-সংবাদে বলা হয়—

“স্কট সাহেবের গেজেটে প্রকাশিত এক পত্রে দৃষ্ট হইতেছে যে জানুআরি মাসের প্রথম ২০ দিবস পর্য্যন্ত চুঁচুড়ায় বরফকুণ্ডে ২১৮৬ মোন বরফ উৎপন্ন হইয়াছে এবং ঐ বরফ মোন করা ১০ টাকা অবধি ১৩ টাকা পর্য্যন্ত বিক্রয় হইয়াছে।”[2]

স্থানীয় পদ্ধতিতে কীভাবে তৈরি হত বরফ? প্রায় ১২০ ফিট লম্বা, ২০ ফিট চওড়া এবং গভীরতায় ২ ফিট একটি গর্ত খোঁড়া হত। গর্তটির ভেতরে এবং চারপাশ যতদূর সম্ভব মসৃণ করা হত। সূর্যের তাপে যখন মাটি শুকিয়ে যেত তখন খড় দিয়ে ঠেসে ১ ফুট ভরে দেওয়া হত। এর উপরে আরও ৬ ইঞ্চি আলগা খড় দিয়ে তার ওপরে ছোট কড়াইয়ের মতো যে পাত্রগুলিতে বরফ তৈরি করা হবে সেগুলো পরপর বসানো হত। এর ওপরে আবার খড় দেওয়া হত। এভাবে কয়েকদিন রেখে দিলে বরফ তৈরি হত।[3]

কৌতূহলী পাঠকেরা জানতে চাইবেন— হঠাৎ ১৮৩৬ সালে চুঁচুড়ায় বরফ তৈরি এবং বিক্রির খবর সমাচার দর্পণ-এ প্রকাশিত হচ্ছে কেন? ১৮৩৬-এ খবর হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার অর্থ হল আরও কিছুদিন আগে থেকে এর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। কেন? এজন্য ১৮৩০-এর দশকের কলকাতার এক ইতিহাস আমাদের জেনে নিতে হবে। কৌতূহলোদ্দীপক সে ইতিহাস।

প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বরফের সরবরাহ নির্ভর করত “হুগলির কিছু ফাটকাবাজ বরফ সরবরাহকারীর খেয়ালখুশির ওপরে, যারা যতটুকু তাদের জন্য লাভজনক ততটুকুই উৎপাদন করত এবং আবহাওয়া যতটুকু সাহায্য করত সেটাও একটা ব্যাপার ছিল।”[4]

আমেরিকান ব্যবসায়ী তথা উদ্যোগপতি ফ্রেডেরিক টিউডরের[5] রফতানি করা বরফ কলকাতায় আসার আগে অব্দি চুঁচুড়ায় তৈরি বরফই কলকাতার বরফের একমাত্র সরবরাহ ছিল। প্রথমদিকে এই বরফের প্রধান ব্যবহার ছিল ব্রিটিশ রাজপুরুষ এবং বাঙালি বাবুদের “claret wine” ঠান্ডা রাখার কাজে। ফ্রেডেরিক টিউডর দুটি নিষ্প্রয়োজনীয় বস্তু যেমন বস্টনের পুকুরে জমা বরফ এবং মাইন (Maine) অঞ্চলের কাঠের মিহি গুঁড়োকে জুড়ে “নিউ ইংল্যান্ডে একটি বড়োসড়ো ইনডাস্ট্রি তৈরি হয়েছিল যা বহুল পরিমাণে রপ্তানি করা হত।”[6]

ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল পত্রিকায়[7] প্রকাশিত হল একটি বিশেষ সংবাদ “আমেরিকান আইস” শিরোনামে। এ-সংবাদে বলা হল, আমেরিকার বস্টন শহরের ব্যবসায়ী ফ্রেডেরিক টিউডর (Frederick Tudor) কলকাতা শহরে বরফ রফতানি করতে চান। এ-ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী হয়েছিলেন কলকাতার তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের নামী ব্যারিস্টার Lonouville Clarke। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, ১৭৭৪ সালে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। ১৮৬২ পর্যন্ত এর কাজ চলে। ১৮৬২ সালে হাইকোর্ট তৈরি হলে সুপ্রিম কোর্টের অবলুপ্তি ঘটে। ১৭৭৪-এ সুপ্রিম কোর্টের প্রথম বিচারপতি ছিলেন ইলাইজা ইম্পে (Elijah Impey) এবং শেষ বিচারপতি বার্নেস পিকক (Barnes Peacock), যিনি ১৮৬২ সালে কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি হন। মধ্যবর্তী সময়ে উইলিয়াম জোনস থেকে এডওয়ার্ড রায়ানের মতো ব্যক্তিত্বরা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব সামলেছেন। এখানে এ-কথাও জানানো প্রয়োজন, আলোচিত মিটিংয়ে হাভানাতে যে দীর্ঘদিন ধরে নিরুপদ্রবে বরফের সরবরাহ চলছে এ-নিয়ে মতবিনিময় হয়।

আমরা আগের সংবাদে ফিরি। Lonouville Clarke-এর উদ্যোগে ১৮৩৬ সালে “আমেরিকান আইস কমিটি” তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আমেরিকা থেকে (বস্টন শহর) নিয়ে আসা বিপুল পরিমাণ বরফ রাখার স্থানের সঙ্কুলান ছিল না কলকাতায়। একটি ছোট ice house ছিল বটে— সম্ভবত ১৮৩২ সালে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এর আয়তন বৃদ্ধি না করলে কলকাতা শহরে বরফের চাহিদা এবং রফতানি করা বরফকে ঠিকমতো সংরক্ষণ করা যাবে না, এই ছিল ক্লার্কের মূল প্রতিপাদ্য— “যদি আইস হাউসের আয়তন বাড়ানো না হয় সারা বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত সরবরাহের নিশ্চয়তা থাকবে না।”[8]

লুইভিল ক্লার্ক-এর চিঠি

এ-সংবাদটি ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৭-এর। এর আগে টিউডরের একটি চিঠি ক্লার্ককে লেখা হয়। সে-চিঠিতে টিউডর লেখেন— “বরফের নিয়মিত সরবরাহ প্রতিষ্ঠিত হবে এমনটা আশা করা যায় না, যদি-না বরফের ব্যবহার বাড়ে এবং আইস হাউস-কে অনেক বড় আকৃতির বানানো না হয়।”[9] এর পরে “Ice Meeting”-এ সর্বসম্মতিক্রমে বরফঘরের আয়তন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৮৩৩ সালে তৈরি কলকাতার “আইস হাউস”-এর চিত্র। ছবিটি সম্ভবত পরবর্তী সময়ের। সৌজন্যে, পুরনো কলকাতা

টাউন হলের মিটিংয়ে (১২ ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৭) সর্বসম্মতিক্রমে আইস হাউসের আয়তন বৃদ্ধির প্রস্তাব পাশ হওয়ার পরে সরকারের তরফে গঙ্গার ধারে জমি দেওয়া হয়, এবং কলকাতাবাসীরা ২৫,০০০ টাকা চাঁদা তোলে। একটি কমিটিও গড়া হয়— আগেই উল্লিখিত “আমেরিকান আইস কমিটি”। এতে পূর্বোল্লিখিত Lonouville Clarke ছাড়াও প্রেসিডেন্ট হিসেবে ছিলেন ১৮৩৩-১৮৪৩ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এডওয়ার্ড রায়ান, ইঞ্জিনিয়ার জেনারেল ফোর্বস, কলকাতা টাঁকশালের ডেপুটি অ্যাসে মাস্টার জেমস প্রিন্সেপ প্রমুখ। এঁদের মধ্যে জেমস প্রিন্সেপ কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন এবং খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মী লিপির পাঠোদ্ধার করার মতো ঐতিহাসিক কাজ করেন।

 

বরফের বাণিজ্য

Kathleen Blechynden-এর পুস্তক প্রকাশের ২ বছর পরে প্রকাশিত হয় পূর্বোল্লেখিত Cotton-এর Calcutta Old and New[10]। এ-বইয়ে তিনি জানিয়েছেন, কলকাতায় যে প্রথম “আইস হাউস” তৈরি হয় তার ওপরে বড় বড় করে লেখা ছিল— “to cool”। তাঁর বর্ণনায় “আইস হাউস”-এর অবস্থান ছিল— “হেয়ার স্ট্রিটের বিপরীতে, ছোট Small Cause Court বিল্ডিং-এর পশ্চিমে, চোখ গিয়ে পড়তে বাধ্য আইস হাউসের বিসদৃশ এবং হোঁতকা চেহারার ওপরে।”[11]

এ-প্রসঙ্গে তিনি কলকাতা এবং মাদ্রাজের মধ্যে তুলনা করেন। যেখানে ১৮৮২ সালে কলকাতার এই “আইস হাউস” গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সেখানে ১৯০৫ সালেও তিনি মাদ্রাজে সমসাময়িক কালে তৈরি “আইস হাউস” সুরক্ষিত অবস্থায় আছে দেখতে পেয়েছেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য— “কলকাতা একটু বেশি পরিমাণে iconoclastic, এবং পরিচিত কাঠামোটির একখানি টুকরোও অবশিষ্ট নেই, যেখানে প্রায় ৫০ বছর ধরে Wentham Lake থেকে আহরিত কলকাতার মূল্যবান বরফের চাঙ্গরকে রাখা হয়েছে।”[12]

ইতিহাসকে ভালবাসতে না-শেখা এবং প্রাচীন স্থাপত্যগুলোকে ভেঙে ফেলার ও কুদৃশ নতুন কাঠামো তৈরি করার এ-ঐতিহ্য কলকাতা এখনও বহন করে চলেছে— হয়তো আরও শক্তিশালীভাবে।

বরফ আনার এবং রাখার ঝক্কি নেহাত কম ছিল না। প্রায় ১৩০ দিন সময় লাগত সমগ্র পথ অতিক্রম করতে। প্রায় ২০,০০০ মাইল সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে বস্টন থেকে কলকাতায় আসার যাত্রায় জাহাজে ১৮০ টন বরফ ভরা হলে যাত্রাপথে ৬০ টনের বেশি নষ্ট হয়ে যেত, অর্থাৎ গলে যেত। এবং সাগর থেকে কলকাতা বন্দরে আসতে আরও ২০ টন নষ্ট হত।[13] ভারতে যে বরফ তৈরি হত তার ১ পাউন্ডের দাম পড়ত ৬ পেনি। কিন্তু আমদানি করা বরফের দাম ছিল ৩ পেনিতে ১ পাউন্ড।[14]

Henry Spry তাঁর Modern India (Vol. 1, 1837) গ্রন্থে জানাচ্ছেন যে ১৮৩২ সালের শরৎকালে হুগলি নদীতে প্রথম বরফবাহী জাহাজ এসে নোঙর করে।[15] আইস হাউস প্রতিদিন ভোর ৩টের সময় খুলে যেত। যদি বস্টন থেকে ৩০০ টন বরফ পাঠানো হত তাহলে কলকাতায় এসে “of good serviceable ice” পৌঁছত ২৩৬ টন।

এখানে টিউডরের বরফ-বাণিজ্যের কথা সংক্ষেপে বলে নেওয়া যায়। ফ্রেডেরিক টিউডর তাঁর ডায়ারিতে লিখেছিলেন যে তাঁর দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল ভারতে বরফ রফতানি করা। পরে তাঁর সঙ্গে বাণিজ্যিক পার্টনার হিসেবে অস্টিন এবং উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। সফল হয় ভারতে বরফ রফতানি করার স্বপ্ন। অবশেষে Tuscany জাহাজে ভারতের জন্য প্রথম বরফভর্তি জাহাজ পাঠানো হল।[16] Weightman জানিয়েছিলেন— “Frederick’s ice was a sensation in Calcutta.”[17]

নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রে (১ জুলাই, ১৯২৮) J. Milo Curci একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন “FIRST ICE KING’S” ROUGH SLEDDING; Frederick Tudor, a Century Ago, Worked Thirty Years Against Ridicule to Introduce “Yankee Coldness” A Surprise for Dickens. Start of Ice Business. Tropics Shrank From Ice. Cargoes Went to Far East” শিরোনামে। তিনি এ-প্রবন্ধে বলেন— “অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বাণিজ্যেও জনতাকে নতুন পণ্যের ব্যবহারে শিক্ষিত করে তুলতে হয়। পৃথিবীকে চিউয়িং গাম চিবোতে কিংবা ধূমপান করতে শেখাতে হয়েছে … অন্তত তিন দশক পরিশ্রম করার পরে তাঁর খ্যাতি কলকাতায় পৌছেছিল।”[18]

যদিও হেনরি স্প্রাই বলেছেন, ১৮৩২-এর শরৎকালে প্রথম বরফবাহী জাহাজ এসে পৌঁছয়। কিন্তু গেভিন ওয়েটম্যান জানাচ্ছেন— “কলকাতার ব্রিটিশ সমাজে সমস্ত আগ্রহ এবং সমস্ত উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছিল যখন জাহাজে করে এই ঐতিহাসিক পণ্য গঙ্গার বদ্বীপে সেপ্টেম্বর ১৮৩৩-এ এসে পৌঁছয়।”[19] ওয়েটম্যান আরও জানাচ্ছেন— “The British in Calcutta were quite obsessed with keeping cool. Houses were sometimes built with underground sitting rooms, and with raised terraces where advantage could be taken of cool breezes. Wetted cloths were hung over windows to provide a crude form of air conditioning, and the air was stirred constantly by punkahs.”[20]

যেদিন বরফের জাহাজ হুগলি নদীর মুখে এসে পৌঁছয় তখন তাপমাত্রা ছিল ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের আশেপাশে। বরফ কী করে গলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচানো হবে এটাই ছিল প্রধান দুশ্চিন্তার কারণ। ইন্ডিয়া গেজেট পত্রিকায় বরফের ব্যবহার সম্পর্কে লেখা হয়েছিল— “যদি প্রয়োজনীয় কিংবা বিলাসিতার সামগ্রীও হয়, বরফের ব্যবহার কেবলমাত্র খাবার টেবিলে সীমাবদ্ধ নয়। একে অতিক্রম করে এর প্রবেশ ঘটেছে মেডিকেল প্র্যাকটিসে, চিকিৎসার সহায়ক হিসেবে, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বহু ধরনের জ্বরের চিকিৎসার ক্ষেত্রে মূল চিকিৎসা হিসেবে কার্যকরী হয়েছে। এমনকি গরমের দেশের কিছু অ্যাকিউট রোগের ক্ষেত্রেও এটা কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে।”[21]

উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ২২ নভেম্বর, ১৮৩৩-এ যারা জাহাজে করে বরফ নিয়ে এসেছিল তাদের নেতৃত্ব রজার্সকে রুপোর গিলটি করা কাপ দিয়েছিলেন।

টিউডর কলকাতায় প্রতি পাউন্ড বরফ ২.৫ সেন্ট মূল্যে বিক্রি করতেন। ১৮৩৪ সালে বরফ বিক্রি থেকে মুনাফা হয় “$13,552 in 1834 (worth in 2010 US $353,000) from which freight charges needed to be subtracted.”[22] এমনকি ১৮৫৫ সালের আগস্ট মাসে টিউডর হাওড়ায় গঙ্গার ধারে ৫,৮০০ টাকা মূল্যে জমিও কিনেছিলেন ব্যবসার সুবিধের জন্য।[23]

ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল-এর আরেকটি সংখ্যায় বরফের দাম কমানো এবং সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য সরকারের কাছে “remission of port duties”-এর আবেদন করা হয়।[24]

 

মেডিসিনে বরফের ব্যবহার

কিন্তু শুধু স্বাচ্ছন্দ্য এবং বিলাসিতার দ্রব্য হিসেবে বরফের ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকলে বাণিজ্যিক দিক থেকে সেটা নিতান্তই অলাভজনক হবে। ফলে বরফের ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল মেডিসিন, যাতে ব্যবহারের ব্যাপ্তি এবং উপযোগিতা দুটোই বৃদ্ধি পায়।

উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, এস নিকলসন নামে এক ডাক্তারের চিঠি থেকে ভিন্নধর্মী একটি বিষয় জানা যায়— “আমি এ-বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে জানি যে, বরফ নিয়ে যে বাণিজ্য জাহাজ কলকাতায় এসে পৌঁছয় তার বেশিরভাগ খদ্দের ছিল dirges (দর্জি, ভৃত্য বা নিম্নশ্রেণির মানুষ অর্থে ব্যবহৃত) যারা বরফ সংগ্রহের জন্য প্রতিদিন বিকেলে আইস হাউসে এসে ভিড় করত যাতে এক খণ্ড বরফ সংগ্রহ করতে পারে ৭ মাইল হেঁটে ফেরত যাওয়ার আগে।”[25]

সহজ কথায় বললে, দর্জি, ভৃত্য বা নিম্নশ্রেণির মানুষ ৭ মাইল পথ হেঁটে এসে প্রতিদিন বিকেলবেলায় আইস হাউসে বরফ কেনার জন্য লাইন দিত। এখানে সঙ্গত প্রশ্ন আসবে— কেন দিত? বরফ এদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল কেন— বিশেষত ১৮৩৬-৩৮-এর কলকাতা শহরে? এ-উত্তর আমার কাছে অজানা। হয়তো পুরনো কলকাতার বিশেষজ্ঞরা এর সমাধান করতে পারবেন। ভাল উত্তর দিতে পারবেন।

কটন-এর পূর্বোক্ত পুস্তক থেকে জানা যাচ্ছে— “কলকাতার ২২ জন মেডিকেল প্র্যাক্টিশনার সরকারকে (বরফের ব্যবহারের উপযগিতার স্বপক্ষে জোরালো সওয়াল করে) ২২টি আলাদা আলাদা সার্টিফিকেট পাঠান।” তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল— “হাসপাতালের প্রথম চিকিৎসাগুলোর মধ্যে ছিল বরফের ব্যবহার।”[26]

“American Ice” শিরোনামে বেশ বড় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ক্যালকাটা মন্থলি জার্নাল-এ[27]। এর আগেই বলেছি, কলকাতায় “আমেরিকান আইস কমিটি” তৈরি হয়েছিল, যার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন Lonouville Clarke। পরবর্তীতে চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। এই কমিটির ১৮৩৭-এর জুলাই মাসের সভায় ৩টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল— সরকার যদি “remission of port duties” করে (যেমনটা হাভানায় হয়েছে) তাহলে বরফের চাহিদা আরও বাড়বে।

দ্বিতীয়টি হল— মেডিকেল পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বরফের “vast importance to the public health, especially in cases of fever so incidental to this climate”-এর কথা বলেছেন।

তৃতীয় সিদ্ধান্ত— কলকাতা শহরের বেশ কিছু সংখ্যক প্রথমসারির চিকিৎসক পাবলিক হেলথের ক্ষেত্রে বরফের বিপুল গুরুত্বের কথা লিখিতভাবে কমিটিকে জানিয়েছেন। এবং তাঁদের চিঠিগুলো কমিটির মিটিংয়ে পেশ করা হয়েছিল।

পূর্বোল্লেখিত মোট ২২ জন খ্যাতনামা এবং উচ্চপদস্থ চিকিৎসকের চিঠি কমিটির মিটিংয়ে পেশ করা হয়। এঁরা হলেন—

  1. জন গ্র্যান্ট, যিনি ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিকেল সায়েন্স-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন।[28]
  2. প্রেসিডেন্সি সার্জেন আলেকজান্ডার হ্যালিডে।
  3. জেনারেল হাসপাতালের সার্জেন এস নিকলসন।
  4. গ্যারিসন সার্জেন ফ্রেডেরিক করবিন (Frederick Corbyn), যিনি ভারতের প্রথম মেডিকেল এবং ফিজিকাল সায়েন্সের জার্নাল The India Journal of Medical and Physical Science (1836)-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
  5. আলেকজান্ডার গার্ডেন।
  6. মেরিন সার্জেন H. S. Mercks.
  7. জেমস রানাল্ড মার্টিন, যাঁর দুটি বিখ্যাত পুস্তক Notes on the medical topography of Calcutta (১৮৩৭) এবং The Influence of tropical climates on European constitutions (১৮৫৬)।
  8. প্রেসিডেন্সি সার্জেন উইলিয়াম ক্যামেরন।
  9. Officiating Army Hospital Corps আলেকজান্ডার রাসেল জ্যাকসন।
  10. চব্বিশ পরগনার সিভিল সার্জেন Francis Pemble Strong.[29]
  11. চার্লস সি এগার্টন, যিনি পরে ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজের সার্জারি এবং ক্লিনিকাল সার্জারির প্রফেসর হয়েছিলেন।
  12. সার্জেন জর্জ ক্রেইগ।
  13. ডানকান স্টুয়ার্ট, পরে মেডিকেল কলেজের ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের প্রধান এবং অধ্যাপক হয়েছিলেন এবং মেডিক্যাল কলেজে প্রথম ক্লোরোফর্মের ব্যবহার শুরু করেন প্রসবের ক্ষেত্রে।
  14. ফ্রেডেরিক হ্যারিংটন ব্রেট, যাঁর সুবিদিত গ্রন্থ হচ্ছে A practical essay on some of the principal surgical diseases of India (১৮৪০)।
  15. অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন জেটি প্যাটারসন।
  16. জেনারেল হাসপাতালের ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন ওয়াল্টার র‍্যালে।
  17. মেডিকেল কলেজের প্রফেসর অফ অ্যানাটমি অ্যান্ড মেডিসিন হেনরি গুডিভ।
  18. মেডিকেল কলেজের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক, কলেরার চিকিৎসায় ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন ইঞ্জেকশনের যুগান্তকারী আবিষ্কারক এবং গাঁজা তথা ক্যানাবিসের মেডিকেল ব্যবহারের উদ্ভাবক উইলিয়াম ব্রুক ও’শনেসি।
  19. ২৬ নম্বর রেজিমেন্টের সার্জেন উইলিয়াম বেল।
  20. উইলিয়াম গ্রাহাম।
  21. সার্জেন জে ম্যাক্সটন। সার্জন, ক্যালকাটা পুলিশ এবং কলকাতার মিন্ট ও কাস্টমস হাউসের ভারপ্রাপ্ত মেডিকেল অফিসার।[30] এবং
  22. রিচার্ড ও’শনেসি, মেডিকেল কলেজের শিক্ষক এবং যাঁর বিখ্যাত পুস্তক On Diseases of the Jaws, with a brief outline of their surgical anatomy (১৮৪৪)।

এঁদের লেখা কয়েকটি চিঠির ছবি দিচ্ছি।

 

এঁদের মেডিসিনে বরফ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রধান যুক্তিগুলো ছিল এরকম—

  1. জ্বর কমাতে বিশেষ সাহায্যকারী, বিশেষ করে মস্তিষ্কের রক্তচলাচল যখন বেড়ে যায় তখন সেটা কমাতে সাহায্য করে।
  2. শিশুদের দাঁত ওঠার সময়ের জ্বরে কার্যকরী।
  3. “internal inflammation”-এর ক্ষেত্রে ফলদায়ক।
  4. “soothes the sense of rending pain in the brain”.
  5. “strangulated hernia”.
  6. “in various disorders, both surgical and medical”.
  7. “most valuable in certain cases of mania … in cases of uterine hemorrhage”.
  8. উইলিয়াম ব্রুক ও’শনেসির মতো গবেষকের অভিমত এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য— “বরফকে পূর্ণত মেডিকেল সাবস্ট্যান্স হিসেবে বিবেচনা করলে, আমি মনে করি আমরা যে চিঠিপত্র লিখেছি এবং আপনারা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন তাতে বলা যায় এর আমদানি বাড়াতে উৎসাহ দিতে হবে যাতে সস্তায় জ্বরের চিকিৎসা করা যায়।”[31]

১৮৫২ সালে মেডিকেল কলেজের কৃতী ছাত্র সূর্য গুডিভ চক্রবর্তী এপিলেপসি নিয়ে তাঁর একটি গবেষণাপত্রে বলেন— “আমি এটুকু কেবল আশা করি যে আমি যে রিপোর্ট পেশ করেছি সেটা আমার মেডিকেল বন্ধুরা পাঠ করে সমধর্মী ক্ষেত্রে বরফের যথাযথ ব্যবহারের ইতিবাচক ফলাফল প্রত্যক্ষ করবেন।”[32] তিনি নিজে এপিলেপসির ক্ষেত্রে বরফের ব্যবহার করে ইতিবাচক ফল পেয়েছিলেন। ফলে অন্যান্যদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন তাঁদের অভিজ্ঞতা কী জানায়।

একেবারে সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণা দেখিয়েছে— “বিলাসদ্রব্যের যে-কোনও আইটেমের চেয়ে বরফকে বেশি বোঝা হয়েছিল ঔপনিবেশিক দেহকে রক্ষা করার একটি আয়ুধ হিসেবে। বরফের মাঝে ছিল একটি প্রতিশ্রুতি— গরমের দেশে জাতিগত দীর্ঘস্থায়িত্ব রক্ষা করার সম্ভাবনা এবং ঔপনিবেশিক কর্তাব্যক্তিদের স্বাস্থ্যরক্ষা করার উপাদান।”[33]

এভাবে সুদূর আমেরিকা থেকে রফতানি করা বরফ কলকাতায় পৌঁছে চিকিৎসা এবং পাবলিক হেলথ তথা জনস্বাস্থ্যের একটি কার্যকরী হাতিয়ার হয়ে উঠল ১৮৩৩ থেকে ১৮৫২ সালের মধ্যে। এ এক কম জানা, চিত্তাকর্ষক ইতিহাস।

ফ্রেডেরিক টিউডর

 


[1] Blechynden, Kathleen. Calcutta Past and Present. W. Thacker. London. 1905. পৃঃ ৩৪-৩৫।
[2] বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ। সংবাদপত্রে সেকালের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড। ১৮৩০-১৮৪০। পৃঃ ৩৫৭।
[3] Ice-Making in Bengal. Penny Magazine of the Society for Diffusion of Useful Knowledge. May 27, 1837. পৃঃ ১৯৮।
[4] Cotton, H.E.A. Calcutta Old and New: A Historical & Descriptive Handbook to the City. 1907. পৃঃ ১৮৭। আমি এই তথ্যসূত্রের জন্য আমার বন্ধু ঐতিহাসিক ইন্দিরা চৌধুরীর কাছে ঋণী।
[5] Cotton-এর তথ্য অনুযায়ী, টিউডর একজন apothecary-ও ছিলেন।
[6] Herold, Marc W. Ice in the Tropics: the Export of ‘Crystal Blocks of Yankee Coldness’ to India and Brazil. Revista Espaco Academico, No. 142. Mar 2012. পৃঃ ১৬২-১৭৭।
[7] No. XXVII, 1st May, 1837.
[8] Calcutta Monthly Journal, No. XXVII. 1st May, 1837. পৃঃ ১১৮।
[9] পূর্বোক্ত, পৃঃ ১১৯।
[10] Calcutta: W. Newman & Co., 1907.
[11] Cotton. Calcutta Old and New. পৃঃ ১৮৬।
[12] পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৯০।
[13] দ্রষ্টব্য, টীকা ৩। পৃঃ ১৯৯।
[14] পূর্বোক্ত।
[15] পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৯২।
[16] Weightman, Gavin. The Frozen Water Trade: how the ice from New England lakes kept the world cool. “A Cool Cargo for Calcutta”, Chapter 8. 2003.
[17] পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৩৯।
[18] দ্রষ্টব্য, টীকা ১১। পৃঃ ১৯২।
[19] দ্রষ্টব্য, টীকা ১৬।
[20] পূর্বোক্ত।
[21] পূর্বোক্ত।
[22] দ্রষ্টব্য, টীকা ৬। পৃঃ ১৬৬।
[23] Dickason, David G. “The Nineteenth-Century Indo-American Ice Trade: An Hyperborean Epic”. Modern Asian Studies, Volume 25,‌ Issue 01. Feb 1991. pp. 53-89. পৃঃ ৬৩।
[24] American Ice. Calcutta Monthly Journal, Third Series, Vol. IV. 1838. পৃঃ ১১৮।
[25] Calcutta Monthly Journal, Third Series: Vol. IV. 1838. পৃঃ ২৭১।
[26] দ্রষ্টব্য টীকা ১১, ice was among the first of remedies in the hospitals. পৃঃ ১৮৯-১৯০।
[27] Calcutta Monthly Journal, Third Series: Vol. IV. 1838. পৃঃ ২৭০-২৭৫।
[28] Crawford, D. G. Roll of the Indian Medical Service: 1615-1930, Vol. 1. 1930. পৃঃ ৭।
[29] পূর্বোক্ত, পৃঃ ৬৮।
[30] পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৪০।
[31] Calcutta Monthly Journal, Third Series: Vol. IV. 1838. পৃঃ ২৭৪।
[32] “A Singular Case of Epilepsy”. Medical Times and Gazette, 5 (New Series, 1852). pp. 406-408, পৃঃ ৪০৮।
[33] আশুতোষ, ইশান। “Frozen modernity: the US-India ice trade and the cultures of colonialism”. Cultural Geographies 2023, 30 (3): 413-328।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...