বস্তুবাদ-বিরোধিতা, পুঁজিবাদ, এবং মানবদেহের বিরুদ্ধে সহিংসতা: কিছু প্রাথমিক মন্তব্য

রাজু দাস

 


পুঁজিবাদ-সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ এবং অন্যান্য চরম আবহাওয়া শ্রমজীবী এবং আধা-শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর শারীরিক সুরক্ষাকে বাকি শ্রেণিগুলোর তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে বিঘ্নিত করে। যদিও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে-কোনও সমাজেই ঘটতে পারে, কিন্তু এইসব বিপর্যয়ে হাজার হাজার মৃত্যু ঘটে মূলত মানুষের বসবাসের সামাজিক পরিস্থিতির কারণে। যেমন, দুর্বল নির্মাণের ঘরবাড়ি যেগুলি দুর্যোগের ধাক্কা সহ্য করতে অক্ষম, অথবা বিপর্যস্ত মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত ও দ্রুত সাহায্যের ব্যবস্থা না থাকা। কারণ, সাধারণ মানুষের ওপর খরচ করা প্রতিটি পয়সাই পুঁজিপতির সম্ভাব্য লাভের ক্ষতি

 

ধনতান্ত্রিক সমাজে দেহ (এবং প্রকৃতি)-র বস্তুগত বাস্তবতার উপর দুটি ধরনের ‘আক্রমণ’ ক্রমাগত চালু রয়েছে। একটি হল ভাষিক বা অনৈবচনিক (discursive) আক্রমণ, যা কিছু কিছু অ্যাকাডেমিক চর্চায় দেখা যায় এবং যার অনুপ্রেরণা মূলত উত্তর-গঠনবাদ (post-structuralism) থেকে এসেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে গভীরভাবে বস্তুগত যেসব সত্তা বা প্রক্রিয়া রয়েছে, সেগুলিকে প্রায় পুরোপুরিই ভাষিক নির্মাণ হিসেবে দেখা হয়। দেহ (এবং প্রকৃতি) সম্পর্কে সাধারণত যা বলা হয় বা যা ভাবা হয়, তার সঙ্গেই সমার্থক করে দেখা হয়।[1] দেহ মূলত একটি সমাজ-সাংস্কৃতিক নির্মাণ, তার বাইরে কিছু নয়। যেমন, ফক্স-এর বক্তব্য— “উত্তর-গঠনবাদের ক্ষেত্রে পাঠ্য (text) এবং পাঠ্যতা-ই বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে ওঠে, আর জৈবিক দেহ যেন বিশ্লেষণের পরিধি থেকে সরে গিয়ে পড়ে উত্তর-গঠনবাদী সমাজবিজ্ঞানীর নজরের বাইরে।”[2]

এর পাশাপাশি রয়েছে আরেকটি বাস্তব, বস্তুনিষ্ঠ এবং বস্তুগত আক্রমণ— যা পুঁজিপতিশ্রেণি এবং তাদের রাষ্ট্রের দ্বারা দেহ (এবং প্রকৃতি)-র উপর চালানো হয়। এই প্রবন্ধে আমি এই আক্রমণ নিয়েই আলোচনা করব।

পুঁজির শাসনে পরিচালিত যে সমাজে আমরা বাস করি, সেখানে কোটি কোটি মানুষ অনাহারে ভুগছে এবং এমন অনেক মৃত্যু হচ্ছে, যেগুলি প্রতিরোধযোগ্য। উৎপাদন ও জীবিকা নির্বাহের উপায় যখন একটি ক্ষুদ্র পুঁজিপতিশ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত, তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিরোধযোগ্য রোগে ভুগছেন— হয় কাজের সময় পঙ্গু হয়ে গিয়ে, নয়তো খাদ্য, বাসস্থান কিংবা স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতার কারণে। উপরন্তু, গোটা মানবজাতি আজ প্রকৃতির বিপুল ও বিধ্বংসী রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে দেহগতভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে।

এটা বিস্ময়কর যে, এই সমস্ত মৌলিক উপাদানগত সমস্যা সত্ত্বেও, শরীর (এবং প্রকৃতি) সম্পর্কিত আলোচনা তারা আসলে যেরকম সে হিসেবে না দেখে, তাদের যেভাবে থাকা উচিত নয় তা ভেবে নিয়ে করা হয়: অনৈবচনিক সত্তা বা প্রক্রিয়া হিসেবে। পুঁজিবাদে, সব কিছু যেন উল্টে গেছে। জীবনের বস্তুগততার ওপর একটা বড় সংখ্যক গবেষকের আক্রমণ তাঁদের ওপর বস্তুগত আক্রমণের পরিপূরক হিসেবে মনে হচ্ছে। এবং এই বিষয়টি বিশেষত গুরুতর যখন জীবনের বস্তুগততার ওপর এই ধরনের আক্রমণ ঘটে উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে, যেখানে বস্তুগত সমস্যা অত্যন্ত স্পষ্ট, যার কারণ হল প্রান্তিক পুঁজিবাদের ‘অনুন্নত’ চরিত্র এবং নতুন ঔপনিবেশিক যান্ত্রিকতার আক্রমণ। আমরা এসব কীভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি? জীবনের বস্তুগততার উপর এই দ্বৈত আক্রমণের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?

 

পুঁজিবাদী উৎপাদন ও দেহের বস্তুগত বাস্তবতা: Capital, Vol. 1 থেকে কিছু মৌলিক ধারণার পুনর্বিন্যাস

পুঁজি মানবদেহ (এবং প্রকৃতি)-র বস্তুগত বাস্তবতার ওপর আক্রমণ চালায়। ফলত পুঁজি মানুষের দেহ ও প্রকৃতির ওপর সহিংসতা চালায়, যে সহিংসতা অপরিহার্য নয়। পুঁজির এই সহিংসতা তিনটি আলাদা রূপে আত্মপ্রকাশ করে।[3]

প্রথমত, প্রতীকী সহিংসতা, যা ভাষার মধ্যেই নিহিত এবং নির্দিষ্ট একটি অর্থবোধক জগৎ বা বয়ানের মাধ্যমে আরোপিত হয়।[4] উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনও পুঁজিবাদী রাষ্ট্র একটি শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মীকে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার পরিপন্থী হিসেবে দেখায় বা বর্ণনা করে, তখন সেটি এক ধরনের প্রতীকী সহিংসতা। এই প্রতীকী সহিংসতা পরবর্তীতে আরও একটি সহিংসতার পথ খুলে দেয়— তা হল বিষয়গত সহিংসতা

দ্বিতীয়ত, বিষয়গত সহিংসতা (subjective violence) হল এমন এক সহিংসতা যা চালায় একটি সুস্পষ্ট ও সনাক্তযোগ্য এজেন্ট বা ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান।[5] এই এজেন্ট হতে পারে কোনও নিয়োগকর্তার নিযুক্ত নিরাপত্তাকর্মী কিংবা ভাড়া করা গুণ্ডা, যারা সরাসরি দমনমূলক ভূমিকা পালন করে।

তৃতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রণালীগত সহিংসতা (systemic violence)। এ হল এমন এক সহিংসতা যা আমাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘সচল ও সাবলীল কাজকর্মের ফলস্বরূপ ঘটে যাওয়া বিপর্যয়কর পরিণতি’।[6] এই সহিংসতাই আসলে আগের দুটি সহিংসতার উৎস ও প্রেরণাদাতা। এই অংশে আমরা এই প্রণালীগত সহিংসতা নিয়েই আলোচনা করব।

পুঁজিবাদী উৎপাদন মানুষের দেহ ও প্রকৃতির ওপর সহিংসতা চালায় এই অর্থে যে, এটি তাদের বস্তুগত অস্তিত্বকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করে। যদিও পুঁজি অনেকভাবে একটি ‘অদৃশ্য’ বা অমূর্ত সত্তা হিসেবে কাজ করে— “এখনও পর্যন্ত কোনও রসায়নবিদ মুক্তো বা হীরায় বিনিময়-মূল্য আবিষ্কার করতে পারেননি,”[7] এবং এরকম আরও অনেক কিছুতেই। তবুও পুঁজি একটি গভীরভাবে বস্তুগত বাস্তবতা। বিনিময়-মূল্যের অস্তিত্ব নির্ভর করে যে ব্যবহার-মূল্যের ওপর, সেগুলো আসলে বস্তুগততা ছাড়া অস্তিত্বশীলই হতে পারে না।[8] ব্যবহার-মূল্য বস্তুগত বলেই তার ব্যবহার রয়েছে। এর পেছনে আছে জিনিসের বস্তুগত বৈশিষ্ট্য— ভৌত, রাসায়নিক, জ্যামিতিক, বৈদ্যুতিক, চৌম্বক ইত্যাদি গুণাবলি। কোনও পণ্যের শারীরিক সত্তাটিই হল তার উপযোগিতার কেন্দ্র। মার্কস Capital–এ (১৯৭৭:১৩৩) লেখেন:

কোট, কাপড় ইত্যাদির মতো বস্তুর ব্যবহার-মূল্যগুলি— সংক্ষেপে বললে, পণ্যের শারীরিক দেহ— প্রকৃতির সরবরাহ করা উপাদান ও মানুষের শ্রম, এই দুইয়ের সংমিশ্রণ।

অর্থাৎ, প্রকৃতি এবং শ্রম— এই দুইয়ে মিলেই গড়ে তোলে পুঁজির বস্তুগত দেহ। বিমূর্ত রূপে ধন অর্জনের অন্তহীন তাড়নায় পুঁজিবাদকে ব্যবহার-মূল্যের উৎপাদনে মনোনিবেশ করতেই হয়। কিন্তু একই সঙ্গে, তার বিনিময়-মূল্যের প্রতি লালসা সেই ব্যবহার-মূল্যের বস্তুগত ভিত্তিকেই ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করে।

পুঁজি প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে মানুষের দেহে আঘাত করে— কারণ প্রকৃতি মানুষের দেহের অস্তিত্বের মৌলিক পূর্বশর্ত। আবার, পুঁজি সরাসরি মানুষের দেহকেও আঘাত করে। পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকৃতিকে দেখা হয় কাঁচামাল, উৎপাদনের উপকরণ, এবং, অবশ্যই, একটি বর্জ্য ফেলার ভ্যাট হিসেবে। পুঁজির অবিরাম উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণের চেষ্টায় প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন বহু ব্যবহারযোগ্য উপাদান (use-value) ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিংবা সেই উপাদানগুলিকে এমনভাবে রূপান্তর করা হয় (যেমন দূষিত জল), যা সহজে ব্যবহারযোগ্য নয়। পরিবেশকে যদি নিছক একটি “ফ্রি প্রোডাক্ট” বা “ফ্রি ভ্যাট” হিসেবে দেখা হয়, এবং প্রকৃতি যতটা দিতে পারে তার চেয়ে বেশি নিংড়ে নেওয়া হতে থাকে, তখন স্বভাবতই পরিবেশ ধ্বংস ও নিঃশেষের পথে এগোয়।[9]

এখানেই শেষ নয়। পুঁজি শ্রম-ক্ষমতার মধ্যেই নিহিত যে ব্যবহার-মূল্য, অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষের দেহ-মনের সমন্বয়ে যে উৎপাদনক্ষম শক্তি রয়েছে, তাকেও ধ্বংস করে বা ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে শ্রমিকের দেহের উপর সরাসরি শারীরিক ও মানসিক আঘাত নেমে আসে।

মার্কস ধারণা করেছিলেন যে, মজুরি শ্রমিকের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বহন করে, কিন্তু তিনি একইসঙ্গে এটাও স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে বাস্তব জীবনে কোটি কোটি শ্রমিক বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি পান না। ১৮৪৭ সালে Wage Labour and Capital গ্রন্থে মার্কস লিখেছিলেন:

একজন শ্রমিক নয়, বরং কোটি কোটি শ্রমিক, এমন মজুরি পান না, যা দিয়ে তাঁরা বেঁচে থাকতে পারেন বা নিজেদের প্রজন্মকে অব্যাহত রাখতে পারেন।[10]

এই অবস্থাই শ্রমিকদের চূড়ান্ত শোষণের চিহ্ন বহন করে। পুঁজি একদিকে যেমন শ্রমিকদের যথোপযুক্ত মজুরি দেয় না, তেমনি অন্যদিকে বিশাল সংখ্যক মানুষকে কাজের বাইরে ঠেলে দেয়, যার ফলে সেই মানুষদের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থটুকুও থাকে না। খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, পরিবহণ— প্রয়োজনীয় সব কিছুর অভাবে দেহগত প্রয়োজন পূরণ সম্ভব হয় না।

আসলে, কর্মক্ষেত্রে শ্রমের উপর পুঁজির নিয়ন্ত্রণ সর্বাধিক স্বেচ্ছাচারী রূপে প্রকাশ পায়। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ পুঁজি শ্রমিককে বাধ্য করে তার উৎপাদিত সম্পদের (লাভের) বিশাল অংশ তাকে সমর্পণ করতে। এই প্রক্রিয়াই পুঁজিবাদের সবচেয়ে সূক্ষ্ম অথচ নৃশংস সহিংসতার উদাহরণ— যার প্রত্যক্ষ ছাপ পড়ে শ্রমজীবী মানুষের দেহে।[11] এই দেহই হয়ে ওঠে পুঁজিসঞ্চয়ের একটি কৌশল (হার্ভে, ১৯৯৮)।[12] Capital, Volume 1-এ মার্কস সে-কথাই বলেছিলেন।[13]

পুঁজিপতি হিসেবে, সে কেবল পুঁজি-ব্যক্ত হয়ে ওঠা এক রূপ। তার আত্মা— পুঁজির আত্মা। আর এই পুঁজির একটাই মূল চালিকাশক্তি— নিজেকে মূল্যায়িত করা, উদ্বৃত্ত মূল্য (surplus-value) সৃষ্টি করা, তার ধ্রুবাংশ, অর্থাৎ উৎপাদনের উপায় (যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রকৃতি থেকে আসে), তা দিয়ে যতটা সম্ভব অতিরিক্ত শ্রম শোষণ করা। পুঁজি হল মৃত শ্রম, যা এক ধরনের ভ্যাম্পায়ারের মতো— জীবিত শ্রম চুষে খেয়ে বেঁচে থাকে। যত বেশি শ্রম সে শুষে নিতে পারে, তত তার আয়ু বৃদ্ধি পায়। সেই সময়কাল, যতক্ষণ একজন শ্রমিক কাজ করে, সেটাই আসলে সেই সময়, যতক্ষণ একজন পুঁজিপতি শ্রমিকের কাছ থেকে কেনা শ্রমশক্তিকে ব্যবহার করে নিজের জীবনবৃদ্ধি ঘটায়।

হাজার হাজার শ্রমিক, যার মধ্যে শিশুশ্রমিকেরাও রয়েছে, কাজের জায়গায় মারধর ও নানারকম সহিংস নির্যাতনের শিকার হন। কলকারাখানার চাকচিক্যের আড়ালে প্রকাশ্যেই দেহের ওপর সহিংসতা প্রয়োগ করে শ্রমিকদের কাছ থেকে আরও বেশি কাজ আদায় করে নেওয়া হয়। মানুষকে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য করা, অত্যধিক পরিশ্রম করানো, নিরাপত্তাহীন পরিবেশে কাজ করানো— এই সবকিছুর মাধ্যমে শ্রমিকের শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভেঙে পড়ে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)-র তথ্য অনুযায়ী:

  • প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একজন শ্রমিক কাজ-সংক্রান্ত দুর্ঘটনা বা রোগের কারণে মারা যান।
  • প্রতি ১৫ সেকেন্ডে ১৫৩ জন শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন।
  • প্রতিদিন ৬,৩০০ জন শ্রমিক পেশাগত দুর্ঘটনা বা কাজ-সংক্রান্ত রোগে মৃত্যুবরণ করেন— বছরে যা দাঁড়ায় ২৩ লক্ষেরও বেশি মৃত্যু।
  • প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ৩১৭ মিলিয়ন কর্মক্ষেত্র-সংক্রান্ত দুর্ঘটনা ঘটে।[14]

মার্কস (১৯৭৭:৩৮০) Capital গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করেছেন যে, পুঁজিবাদী উৎপাদন এমন এক প্রক্রিয়া যা “বামন, স্বল্পায়ু, দ্রুত প্রতিস্থাপনযোগ্য মানব প্রজন্ম” তৈরি করে। পুঁজির দৃষ্টিতে “শ্রমিকের স্বাস্থ্য বা আয়ু কোনও গুরুত্বই পায় না। শ্রমিকের শারীরিক ও মানসিক অবক্ষয়, অকালমৃত্যু, অতিরিক্ত পরিশ্রমজনিত যন্ত্রণা নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে, পুঁজির জবাব সরল: এই যন্ত্রণায় কি আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত, যখন এই যন্ত্রণাই আমাদের আনন্দ (লাভ) বাড়ায়?” এই সহিংসতা শুধুমাত্র এই কারণে ঘটে না যে, পুঁজিপতিরা খারাপ মানুষ। বরং এর শিকড় রয়েছে সেই বাস্তবিকভাবে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়, যা পুঁজিবাদ। মার্কস তাই বলেন: এই শারীরিক সহিংসতা “কোনও ব্যক্তিগত পুঁজিপতির সদিচ্ছা বা কুদৃষ্টির উপর নির্ভর করে না। মুক্ত প্রতিযোগিতার পরিবেশে পুঁজিবাদী উৎপাদনের অন্তর্নিহিত আইনগুলি প্রত্যেক পুঁজিপতির কাছে এক বাহ্যিক বলপ্রয়োগকারী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।”[15]

শ্রমিকদের দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করানো— পুঁজির দ্বারা শ্রমজীবী দেহকে ক্ষতিগ্রস্ত করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতিগুলোর একটি। ধরুন, একজন শ্রমিকের স্বাভাবিক কর্মজীবনের মেয়াদ যদি হয় ৩০ বছর, এবং অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে সেই শ্রমিক যদি স্বাভাবিকের তুলনায় ২০ বছর আগেই মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে তিনি মাত্র ১০ বছরে পুঁজিকে ৩০ বছরের সমপরিমাণ কাজ দিয়ে ফেলেন।

কিন্তু পুঁজি কি তাঁকে তিনগুণ মজুরি দেয়?

না, দেয় না।

পুঁজি আসলে মানুষের জীবনটাই কেড়ে নেয়।

পুঁজিবাদ কীভাবে সহিংসতা চালায়, তা আরও ভালভাবে বোঝা যায় মার্কসের ‘সংরক্ষিত শ্রমিক বাহিনী’র তত্ত্বের ভিত্তিতে। পুঁজির যুক্তিতে শ্রমিকদের উৎপাদনক্ষমতা যত বাড়ে, ততই শ্রমের চাহিদা কমে যায়। আর সেই কারণে যারা কর্মরত, তাঁদের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হয় অত্যধিক শ্রমের ভার।

যদি উৎপাদনের উপায়গুলি ক্রমে কম পরিমাণে শ্রমিক নিয়োগের উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে এই সম্পর্কটিও নতুনভাবে পরিবর্তিত হয়। কারণ, যত বেশি শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়ে, তত দ্রুত পুঁজি শ্রমের জোগান বাড়ায়, কিন্তু শ্রমিকদের চাহিদা সেই অনুপাতে বাড়ে না। কর্মরত শ্রমিক শ্রেণির অতিরিক্ত খাটুনি তাদেরই অব্যবহৃত অংশ বা ‘রিজার্ভ আর্মি’-র সংখ্যাকে বাড়িয়ে তোলে। বিপরীত দিক থেকেও, এই রিজার্ভ বাহিনীর প্রতিযোগিতামূলক চাপ কর্মরত শ্রমিকদের ওপর এমনভাবে প্রভাব ফেলে যে, তারা অতিরিক্ত খাটুনি মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং পুঁজির শর্ত মেনে চলতে থাকে।[16]

কর্মক্ষেত্রে এবং বৃহত্তর সমাজে বিচ্ছিন্নতার (Alienation) অনুভূতি, তার সঙ্গে যুক্ত অপূর্ণ-নিয়োজিত অবস্থা, বেকারত্ব, এবং ন্যূনতম জীবনযাত্রার মান ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব— এই সব মিলিয়ে গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্ম দিচ্ছে, যা নিজেই এক ধরনের সহিংসতা, যা পুঁজির দ্বারা দেহ-মন জটিলতার (body-mind complex) উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক অস্থিরতায় ভোগা অনেক মানুষই অন্যদের হত্যা করছে, আবার নিজেরাও আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।

পুঁজিবাদকে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন অবিরাম পুঁজি সঞ্চয়ের, আর তার জন্য দরকার পণ্যের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়িয়ে চলা— এমনকি সেই পণ্য যদি মানুষের জন্য ক্ষতিকরও হয়। শ্রমিকেরা, ভোক্তা হিসেবে, পুঁজির এই ধ্বংসাত্মক প্রভাবের মুখোমুখি হন, যখন তাঁরা প্রাণ হারান এমন সব অনিরাপদ জিনিস খেয়ে— যেমন তামাকজাত দ্রব্য বা ভেজাল খাদ্য ও পানীয়— যেগুলি অতিমুনাফার লোভে তৈরি হয়, অনেক সময় আইনের তোয়াক্কা না করেই। পুঁজির কাছে এটা জানা বিষয় যে, কোনও জরিমানা দিতে হলেও, তা মোট মুনাফার তুলনায় খুবই সামান্য। ফলে পুঁজি এই জরিমানাকে ব্যবসা চালানোর স্বাভাবিক খরচ হিসেবেই ধরে নেয়।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই মানুষকে দীর্ঘজীবনের সম্ভাবনা এনে দিয়েছে— আজ মানুষ প্রকৌশল, ওষুধ ও প্রযুক্তির উন্নতির ফলে আগেকার সমাজগুলোর তুলনায় অনেক বেশি দিন বাঁচছে। কিন্তু একইসঙ্গে, এই ব্যবস্থাই আবার মুনাফার পেছনে ছুটতে গিয়ে বিভিন্নভাবে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু বা শারীরিক অঙ্গহানির জন্য দায়ী। কেবল তাই নয়, একজন মানুষ কতদিন এবং কত ভালভাবে বাঁচবেন— অর্থাৎ তাঁর বস্তুগত প্রয়োজন কতটা পূর্ণ হবে— তা অনেকাংশেই নির্ধারিত হয় তাঁর সামাজিক-অর্থনৈতিক পটভূমির উপর, যা গড়ে ওঠে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার কার্যপ্রণালির মাধ্যমে।

একজন স্বল্প আয়ের খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের গড় আয়ু একজন ধনী ব্যক্তির তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। বর্তমান প্রযুক্তির সাহায্যে গোটা মানবসমাজ যে পরিমাণ জীবন পেতে পারত, কিন্তু পায়নি, সেই অ-দখলেই থেকে যাওয়া জীবন আসলে বিশ্ব-মানবজীবনের এক বিরাট ধ্বংসের ছবি তুলে ধরে। কারণ একটি এমন সমাজে, যেখানে প্রায় সব কিছুই বিক্রির জন্য তৈরি হয় এবং মুনাফাই মূল চালিকাশক্তি, সেখানে অধিকাংশ মানুষের পক্ষে জীবনের জন্য জরুরি জিনিসগুলি পাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ থাকে না।

যদি আমরা জীবনের মানের ফারাক দেখি— উৎপাদনশীলতা বা স্বাস্থ্য উপভোগ করার ক্ষমতা (যেমন: একজন খেটে খাওয়া শ্রমিক বা ক্ষুদ্র কৃষকের সন্তান, যে নিয়মিত অসুস্থ হয়, তার জীবনে কী পাওয়া সম্ভব, আর তার তুলনায় একটি সচ্ছল পরিবারের শিশুর জীবনে সুযোগ কতটা বেশি)— তাহলে দেখা যায়, সারা বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষ তাঁদের গোটা জীবন জুড়ে যে দুর্ভোগ, বঞ্চনা ও সম্পদের অপচয়ের শিকার হন, তা এক অবিশ্বাস্য মাত্রার সহিংসতার রূপ নেয়।[17] এই সহিংসতা সবচেয়ে প্রকট বিশ্বের দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলিতে এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির সেইসব অঞ্চলে যেখানে বর্ণবৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠী বা নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী শ্রেণি থেকে আগত অভিবাসীরা বসবাস করেন।

ব্যবহারমূল্য তথা বিনিময়মূল্যের বস্তুগত বাহক-এর দিক থেকে পুঁজিবাদের মূল অন্তর্দ্বন্দ্বটি এই যে: একটি সামাজিক সম্পর্ক হিসেবে পুঁজির অস্তিত্ব ও ক্রিয়াকলাপ নির্ভর করে পরিশ্রমী মানবদেহ (এবং প্রকৃতি)-র বস্তুগত বাস্তবতার ওপর। কিন্তু সেই একই পুঁজি, একটি সামাজিক ক্ষমতা হিসেবে, ওই বস্তুগত বাস্তবতাকেই ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই ধ্বংস বা ক্ষতির প্রক্রিয়াটি প্রায়শই যুগপৎ ও আন্তঃসম্পর্কযুক্ত— যদিও সর্বত্র সমান নয়। পুঁজিবাদ কেবল শ্রমদেহ ও প্রকৃতিকে আলাদা-আলাদাভাবে নয়, বরং একত্রেও ধ্বংস করে। আবার এমনও দেখা যায়, কোনও একটি অঞ্চলে পরিবেশ দূষিত হলে, তার সরাসরি প্রভাব পড়ে সেখানকার শ্রমজীবী মানুষের শরীরে— সে ব্যক্তি ওই উৎপাদনস্থলে সরাসরি যুক্ত থাকুন বা না-ই থাকুন। উদাহরণস্বরূপ, কোনও পুঁজিবাদী কারখানার দূষণ কেবল সেখানকার কর্মচারীদের স্বাস্থ্যেরই ক্ষতি করে না, বরং ওই অঞ্চলের অন্যান্য বাসিন্দার শরীরেও তার বিরূপ প্রভাব পড়ে।

পুঁজিবাদ-সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ এবং অন্যান্য চরম আবহাওয়া শ্রমজীবী এবং আধা-শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর শারীরিক সুরক্ষাকে বাকি শ্রেণিগুলোর তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে বিঘ্নিত করে। যদিও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে-কোনও সমাজেই ঘটতে পারে, কিন্তু এইসব বিপর্যয়ে হাজার হাজার মৃত্যু ঘটে মূলত মানুষের বসবাসের সামাজিক পরিস্থিতির কারণে। যেমন, দুর্বল নির্মাণের ঘরবাড়ি যেগুলি দুর্যোগের ধাক্কা সহ্য করতে অক্ষম, অথবা বিপর্যস্ত মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত ও দ্রুত সাহায্যের ব্যবস্থা না থাকা। কারণ, সাধারণ মানুষের ওপর খরচ করা প্রতিটি পয়সাই পুঁজিপতির সম্ভাব্য লাভের ক্ষতি।

পুঁজিবাদী সহিংসতাকে শুধুমাত্র কর্মস্থলের পরিসরে সীমাবদ্ধ করে দেখা ঠিক নয়। অর্থাৎ, এটি কেবলমাত্র শ্রমশক্তিকে ব্যবহারমূল্য (use-value) হিসেবে উৎপাদনে ব্যবহারের ফল নয়। এখানে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে বোঝা জরুরি যে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এই সহিংসতার কারণ নয়। বরং, প্রযুক্তি শ্রমের উৎপাদনক্ষমতা বাড়িয়ে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্যের (surplus value) পরিমাণ বাড়াতে সহায়তা করে। পুঁজিবাদ যেভাবে দেহ ও প্রকৃতির ওপর বস্তুগত/শারীরিক ক্ষতি ঘটায়, সেই সহিংসতাকে কেবল উৎপাদন প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে দেখা উচিত নয়। বরং এটি গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত কার্যপ্রণালির ফল এবং এই ব্যবস্থার ক্রিয়াকলাপ থেকে সৃষ্ট আরও জটিল ও কংক্রিট প্রভাবগুলির ফলাফল।

যখন স্বনিযুক্ত শ্রমিকরা[18] তাঁদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদের (dispossession) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, তখন তাঁদের সহিংসতার মুখোমুখি হতে হয়। ক্ষুদ্র মালিকদের উচ্ছেদের ইতিহাস— যা এক অর্থে ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে অস্বীকার করারই ইতিহাস— “তা মানবজাতির ইতিহাসে রক্ত আর আগুনের অক্ষরে লেখা আছে।” আসলে, “পুঁজির জন্ম হয়েছে মাথা থেকে পা পর্যন্ত, শরীরের প্রতিটি রন্ধ্র থেকে রক্ত আর ময়লা চুঁইয়ে পড়ে।” মার্কস Capital গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে আরও বলেন:

ব্যক্তিগত শ্রমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই একটি দীর্ঘমেয়াদি, সহিংস এবং জটিল প্রক্রিয়া…[19]

ক্ষুদ্র উৎপাদকদের উচ্ছেদের এই সহিংস প্রক্রিয়া আজও চলমান।

যদিও পুঁজিবাদী প্রণালি মজুরি-শ্রমিকদের দেহের প্রতি বিশেষভাবে বৈরী, তা ক্ষুদ্র উৎপাদকদের দেহের প্রতিও শত্রুভাবাপন্ন— অর্থাৎ, সেইসব ব্যক্তি বা পারিবারিক শ্রমের উপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র মালিকদের প্রতিও, যাঁরা নিজের বা পরিবারের (অনেকক্ষেত্রেই নারী-শ্রমের) উপর ভিত্তি করে ছোট পরিসরে উৎপাদনে যুক্ত। পুঁজি এইসব ক্ষুদ্র মালিকদেরকে মূল্যবোধের আইনের আওতায় এনে আত্ম-শোষণে বাধ্য করে, অতিরিক্ত পরিশ্রম করায় এবং নিজেদের দেহের পুনরুৎপাদনের প্রয়োজন উপেক্ষা করতে বাধ্য করে। এর ফলে নারীদের উপর বিশেষ প্রভাব পড়ে— কারণ তাঁদেরকে গৃহস্থালির কাজ, ক্ষেত-খামারের শ্রম এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করতে হয়, এবং পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে নিজেদের দেহগত চাহিদা উপেক্ষা করতে হয়।

ভারতে লক্ষ লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ বাজারব্যবস্থায় বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে দাম নির্ধারণের খেলায় তাঁরা নিজেদের খরচ সামলাতে পারেননি। ক্ষেতমজুরেরাও আত্মহত্যা করছেন, কারণ তাঁদের মজুরি এতটাই কম যে ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোও সম্ভব হচ্ছে না। ভারতে গড়ে প্রতি আধঘণ্টায় একজন কৃষিজীবী আত্মহত্যা করেন। ১৯৯৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৩ লক্ষ ৩০ হাজারেরও বেশি গ্রামবাসী— চাষি ও ক্ষেতমজুর— আত্মহত্যা করেছেন।

এটাই হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার হাতে ক্ষুদ্র মালিক এবং গ্রামীণ শ্রমজীবীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত এক নির্মম সহিংসতা।

একই মূল্য-যুক্তি ক্ষুদ্র মালিকানাধারী উৎপাদককেও বাধ্য করতে পারে তাঁর কৃষিজমি বা খনি-সহ প্রাকৃতিক পরিবেশকে ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে, শুধুমাত্র খরচ কমিয়ে পণ্যের উৎপাদনমূল্য সমাজিক গড় মূল্যের কাছাকাছি আনার জন্য। ক্রমশ বিশ্বায়িত প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে টিকে থাকার লড়াইয়ে, এই চাপ থেকে নিস্তার মেলে না।

 

পুঁজিবাদ, রাষ্ট্র এবং মানবদেহের বিরুদ্ধে সহিংসতা

পুঁজিবাদ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। পুঁজি এবং রাষ্ট্র— এই দুটি উপাদানকে পুঁজিবাদী শ্রেণি-সম্পর্কের দুই বাহু হিসেবে দেখতে হবে, কারণ পুঁজির দ্বারা জনসাধারণের শোষণ এবং সমাজের প্রয়োজনকে লাভের যুক্তির অধীন করে রাখা— এই দুটি প্রক্রিয়াই রাষ্ট্র ছাড়া সম্ভব নয়।[20] রাষ্ট্র পুঁজিবাদকে দুই স্তরে সংযুক্ত করে: সম্পত্তির সম্পর্কের স্তরে এবং পুঁজিসঞ্চয়ের স্তরে। রাষ্ট্র পুঁজির সেই ক্ষমতা রক্ষা করে যার মাধ্যমে অতিরিক্ত মূল্য (surplus value) আহরণ, ক্ষুদ্র উৎপাদকদের উচ্ছেদ এবং সরাসরি উৎপাদকদের কাছ থেকে ভাড়া ও সুদ আদায় সম্ভব হয়। এইভাবে পুঁজিবাদী সম্পত্তির সম্পর্ক রক্ষিত হয়।

তবে শুধুমাত্র পুঁজিবাদী সম্পত্তির অধিকার রক্ষা করাই যথেষ্ট নয়; যদি পুঁজিপতিরা তাদের সম্পদ, বিশেষত শ্রম থেকে আহরিত মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে, তাহলে শুধু সম্পত্তির অধিকারই তাদের ‘সন্তুষ্ট’ করতে পারে না। পুঁজিবাদ একটি বাইসাইকেলের মতো— এটি চলা বন্ধ করলেই পড়ে যায়। তাই সম্পত্তির অধিকার রক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে পুঁজিসঞ্চয়ের ক্ষেত্রেও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হয়। এই সঞ্চয় গঠিত হয় (ক) শ্রম শোষণের মাধ্যমে এবং (খ) ক্ষুদ্র মালিকদের কাছ থেকে সম্পদ কেড়ে নেওয়ার মাধ্যমে। এখন, রাষ্ট্র এই দুটি কাজ যেভাবে করে— অর্থাৎ সম্পত্তির অধিকার রক্ষা এবং পুঁজিসঞ্চয়ে সহায়তা— সেই প্রক্রিয়াগুলিই সহিংসতার ক্ষেত্র তৈরি করে। এই কারণে লেনিন State and Revolution গ্রন্থে রাষ্ট্রকে একটি বিশেষ বলপ্রয়োগকারী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, যা শোষকশ্রেণির দখলে থাকে এবং ব্যবহৃত হয় শোষিতশ্রেণির বিরুদ্ধে। পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ রাজনীতির পরিসরে সহিংসতার মুখোমুখি হয়। এই সহিংসতা বিভিন্ন রূপে আসে।

শুরুতেই বলা যায়, মজুরিভিত্তিক শ্রমিকদের শোষণ এবং ক্ষুদ্র উৎপাদকদের উচ্ছেদ (অথবা প্রাথমিক পুঁজিসঞ্চয়) অবধারিতভাবেই জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে, এবং সেই প্রতিরোধ রাষ্ট্রের দ্বারা সহিংসভাবে দমন করা হয়। যখন মানুষ নিজেদের অবস্থার উন্নতির দাবিতে বা শোষণ ও সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন, তখন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র তাঁদের উপর পাল্টা হামলা চালায়— তাঁদের জেলে পর্যন্ত পাঠানো হয়। ভারতের মারুতি কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলন এই কথার এক বাস্তব সাক্ষ্য।[21] যখন শ্রমিকেরা শ্রেণিসচেতন হয়ে পুঁজিবাদকে উৎখাতের লড়াইয়ে নামেন, তখন তাঁরা নিঃসন্দেহে পুঁজির এবং রাষ্ট্রের ক্রোধের সম্মুখীন হন। শ্রমিকরা যদি শিল্পক্ষেত্রে বা রাজনীতিতে এমন কোনও ‘বাধা’ তৈরি করেন যা পুঁজির দৃষ্টিতে মুক্তবাজার এবং রাষ্ট্রের নির্বিঘ্ন কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটায় তখন রাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে পুঁজি প্রায়ই তাদেরই তৈরি করা ‘লুম্পেন প্রলেতারিয়েত’-দের— অর্থাৎ যাঁরা অনিয়মিতভাবে কাজ পান— ব্যবহার করে সেই শ্রমিকদের শারীরিকভাবে আঘাত করতে। এমনকি যখন জনসাধারণ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল নেতাদের বেছে নিতে চান, তখনও অনেক সময় তাঁদের সহিংসতার মুখোমুখি হতে হয়, যদি তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ কিছু ক্ষমতাশালী পুঁজিপতির অপছন্দ হয়। এগুলি ঘটে বিশেষত পশ্চাৎপদ সমাজে— এবং এই সহিংসতায় রাষ্ট্রও অনেক সময় জড়িত থাকে।

পণ্যের উপর মার্কসের তত্ত্ব পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনসাধারণের বিরুদ্ধে পরিচালিত সহিংসতা বোঝাতে সাহায্য করে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র— সে যদি তথাকথিত গণতান্ত্রিক রূপেও থাকে— যখন জনসাধারণের বিরুদ্ধে সহিংস পদ্ধতি অবলম্বন করে, তখন এই সহিংসতা প্রায়শই তার প্রকৃত স্বরূপে দেখা হয় না। অর্থাৎ, প্রকৃতপক্ষে এটি শাসকশ্রেণির স্বার্থে পরিচালিত একটি শ্রেণি-রাষ্ট্রের দ্বারা জনসাধারণকে দমন করার ব্যবস্থা— যা প্রকৃতিকে লুণ্ঠন করে, ছোট উৎপাদকদের উচ্ছেদ করে এবং শ্রমিকদের (চরমভাবে) শোষণ করে— কিন্তু তা এমনভাবে উপস্থাপিত হয় না।[22] বরং এই সহিংসতাকে এমনভাবে দেখানো হয় যেন এটি শুধুমাত্র একটি ভুল নীতি অনুসরণকারী কোনও রাজনৈতিক দলের কাজ, অথবা এমন কিছু আমলা বা রাজনীতিকের দায় যারা বাস্তব প্রয়োজন সম্পর্কে ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে কাজ করছে। এর ফলে রাষ্ট্রের এই ভূমিকা অনেক সময় ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচিত হয়, যার সমাধান নাকি সম্ভব কেবল শাসকদল, নেতা বা প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গকে পরিবর্তন করার মাধ্যমে।[23]

একইভাবে, বাস্তবে রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত শ্রেণিভিত্তিক বলপ্রয়োগ ও সহিংস সম্পর্ক, যা এক শ্রেণির উপর আরেক শ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, তা ভুল করে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দল, নেতা ও আমলাদের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব বলে ধরে নেওয়া হয়। অথচ এই সম্পর্ক শুধুমাত্র তখনই দূর করা সম্ভব যখন রাষ্ট্রের উপর সরাসরি ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়— যেমনটি ইসাক রুবিন বলেছেন, পণ্যের ‘ফেটিশ’ বা মোহ দূর করা যায় না যতক্ষণ না শ্রমশক্তিকে সরাসরি ও সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রিত করা যায়।[24]

পুঁজিবাদ প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে— এই প্রতিযোগিতা শুধু দেশের ভিতরেই নয়, বরং দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক স্তরেও বিস্তৃত। পুঁজির নানা অংশবিশেষ, যেগুলি নির্দিষ্ট কিছু জাতিরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত, তারা সেই রাষ্ট্রগুলির রাজনৈতিক শক্তিকেও কাজে লাগায়। এখানেই মূলত পুঁজিবাদের একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায়— একদিকে আছে পুঁজির আন্তর্জাতিক বিস্তার (পুঁজিবাদী সঞ্চয় ও বাজারের আন্তর্জাতিকীকরণ), আর অন্যদিকে আছে পুঁজিবাদের জাতিরাষ্ট্র-নির্ভর রাজনৈতিক চরিত্র। এই আন্তর্জাতিক রূপ বনাম জাতিরাষ্ট্রভিত্তিক কাঠামোর দ্বন্দ্ব বহু সময়েই যুদ্ধের মাধ্যমে, কখনও বড় আকারে, কখনও ছোট ছোট সংঘর্ষে, ‘সমাধান’ হয়। যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধের আশঙ্কাকে কাজে লাগিয়েই প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলি দরিদ্র বা তুলনামূলক দুর্বল রাষ্ট্রগুলির ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে, তাদের সম্পদের ওপর অধিকার কায়েম করে।

এই যুদ্ধের মূল্য চোকায় সাধারণ মানুষ। দরিদ্র, কৃষক বা শ্রমজীবী পরিবারের হাজার হাজার তরুণ সেনাবাহিনীতে নাম লেখায়— শুধু এই আশায় যে সেটাই হয়তো তাদের শিক্ষার খরচ জোগানোর একমাত্র রাস্তা, অথবা বয়স্ক পিতা-মাতা ও শিশু সন্তানের মুখে দু-বেলা খাবার তুলে দেওয়ার একমাত্র উপায়।

যখন শ্রমিকশ্রেণি বা অন্যান্য নিপীড়িত গোষ্ঠীগুলি দারিদ্র্য ও পুঁজিবাদসৃষ্ট আর্থিক পশ্চাৎপদতার হাত থেকে মুক্তি পেতে দেশ বা অঞ্চলের সীমান্ত পেরিয়ে পালাতে চায়, তখন বহু ক্ষেত্রেই তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় রাষ্ট্রীয় সহিংসতা। জাতীয় সীমান্তে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর হাতে তারা নানারকম নিষ্ঠুরতার শিকার হয়। সমুদ্রে বা দীর্ঘ ও কঠিন সড়কপথে পারি দিতে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।

পুঁজিবাদী রাষ্ট্র যে সরাসরি উৎপাদকদের ওপর খোলাখুলি সহিংসতা প্রয়োগ করতে পারে, যারা শোষণ ও উচ্ছেদবিরোধী লড়াই করে— এই তথ্যটুকুই যথেষ্ট নয়। জনসাধারণের শক্তিকে দুর্বল করার জন্য তাদের বিভক্ত করাই রাষ্ট্রের একটি মৌলিক উদ্দেশ্য। পুঁজিবাদ এমন এক প্রণালি যা বর্ণ, লিঙ্গ, জাত, ধর্ম ইত্যাদির ভিত্তিতে সামাজিক নিপীড়নের পুনরুৎপাদন ঘটায় এবং এই বিভাজনকে কাজে লাগিয়েই জনসাধারণকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা ও রাজনৈতিক নেতারা যখন এইসব পরিচয়কে ব্যবহার করে জনসমর্থন জোগাড় করেন, তখন রাষ্ট্র নিজেই সামাজিক নিপীড়নের সহচর হয়ে ওঠে— আমরা ‘বর্ণবাদী রাষ্ট্র’, ‘জাতপাত-তান্ত্রিক রাষ্ট্র’, ‘পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ এই কারণেই ব্যবহার করি।

এই সামাজিক নিপীড়ন কেবল অপমান বা বৈষম্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তা শারীরিক নির্যাতনের আকারেও আত্মপ্রকাশ করে। ভারতের নানা অঞ্চলে দেখা যায়, উচ্চবর্ণের মানুষেরা সাবেক ‘অস্পৃশ্য’ সম্প্রদায়ের মানুষদের মূত্রপান করতে বাধ্য করছে, নির্মমভাবে মারধর করছে, অথচ রাষ্ট্র নির্বিকার। কোনও নারী যদি বিয়ের সময় পণ যথাযথভাবে আনতে না পারে, তাকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়, এমনকি পণ না আনার কারণে কনের গায়ে আগুন ধরিয়ে মেরে ফেলার ঘটনাও বিরল নয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরও হয়েছে ধারাবাহিক হামলা— ভারতে যদি কেউ মুসলমান হিসেবে পরিচিত হন এবং তাঁকে গরুর মাংস খাওয়ার সন্দেহে চিহ্নিত করা হয়, তবে তাঁকে জনতা মেরে ফেলছে, আর এই জনতা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে, যার পেছনে রয়েছে বৃহৎ পুঁজির কিছু অংশ ও আত্মসুখে মাতোয়ারা পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণি।

আসলে, ফ্যাসিবাদ যদি হয় পুঁজিপতিদের এক ধরনের অস্ত্রসজ্জিত পন্থা, যার মাধ্যমে তারা সংকটকালে তাদের মুনাফার পরিবেশকে পুনরুৎপাদন করে এবং রাষ্ট্রের ওপর নিজের দখল বজায় রাখে, তবে শোষিত শ্রেণি ও বিরোধিতাকারীদের শরীরে সরাসরি আক্রমণের মধ্যে দিয়ে সেই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বাস্তব প্রকাশ ঘটবেই।[25] এইরকম সহিংসতার বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত জরুরি— তা হতে হবে রাজনৈতিক এবং বৌদ্ধিক, এবং একইসঙ্গে প্রয়োজন সংগঠিত শ্রমিক, ক্ষুদ্র উৎপাদক ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, যাঁরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই সহিংসতা থামাতে উদ্যোগী হবেন। শরীরের ওপর এই ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন ঠেকানো গণতান্ত্রিক আদর্শ রক্ষার লড়াইয়ের একটি অপরিহার্য অংশ।

 

উপসংহার

অত্যন্ত উৎপাদনক্ষম এক প্রণালি হিসেবে প্রশংসিত হলেও, পুঁজিবাদ একইসঙ্গে এক ভয়ানক ধ্বংসাত্মক ব্যবস্থাও বটে। এই ধ্বংসাত্মকতা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সংকটের সময় বিনিময়মূল্যের চক্রাকার অবমূল্যায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। পুঁজিবাদ বস্তুত শারীরিকভাবে ধ্বংস করে তার নিজস্ব দেহকেই— অর্থাৎ শ্রমশক্তির দেহ এবং প্রকৃতি— এই দুই-ই তো মূলত সেই সম্পদের উৎস, যা পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে মুনাফার আকার ধারণ করে।

এ যেন আত্ম-প্রতিরোধী (auto-immune) কোনও ব্যাধিতে আক্রান্ত এক প্রক্রিয়া, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে পরিবেশগত নানা সংকটের মাধ্যমে— যেগুলোর সরাসরি প্রভাব পড়ে মানবদেহের ওপর। এই ব্যাধি প্রকাশিত হয় পুঁজির চূড়ান্ত কর্তৃত্ব ও শোষণমুখী পদ্ধতিতে শ্রমশক্তিকে ব্যবহার-মূল্যে খরচ করার মাধ্যমে মানবদেহের উপর যে ক্ষতি হয়, তার মধ্যেও। পুঁজির ধ্বংসযজ্ঞ কেবল দেহ ও প্রকৃতি সম্পর্কে গঠিত কোনও বয়ান নয়— যদিও এই ধরনের কিছু বয়ানকে পুঁজিবাদ তার স্বার্থে কাজে লাগায়— বরং যা ধ্বংস হয়, তা হল দেহ ও প্রকৃতির বাস্তব বস্তুগত রূপ।

এই পুরো চিত্রপটের দিকে তাকালে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কঠিন নয় যে পুঁজিবাদের ভূদৃশ্য এক মৃত্যুকূপ, এক হত্যাক্ষেত্র, এক সহিংসতার প্রান্তর— শ্রমনিবিড় ও জীবন্ত দেহের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংঘটিত সহিংসতার এক নির্লজ্জ নথি।

যেখানে মজুরি-কর্মী এবং ছোট আকারের উৎপাদকদের একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবন এবং নিরাপদ পরিবেশে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, সেখানে পুঁজি (তথা, তার সবচেয়ে বিমূর্ত রূপে সম্পদ) অর্থ উপার্জন করার অধিকার রাখে। এই দুটি সমান অধিকার মধ্যে, শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় শক্তি। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত পুঁজি ও তার রাষ্ট্র শাসন করে, ততক্ষণ পর্যন্ত পুঁজি এবং তার রাষ্ট্রের শক্তিই কার্যকর হয়। এখানেই পুঁজির সহিংস চরিত্র তার বিমূর্ত স্তরে আসে।

শুধু পুঁজির ইতিহাসই সহিংস নয়, যেমন প্রাথমিক সঞ্চয়ের কাহিনি দেখায়। পুঁজিবাদ ঘটনাটিই একটি সহিংস ঘটনা, এবং পুঁজির সহিংসতা, বার্টেল অলম্যানের ভাষায়, পুঁজির একটি ‘অন্তর্নিহিত সম্পর্ক’।[26] বস্তুগতভাবে, জিনিসগুলির সহিংস ধ্বংসের প্রবণতা পুঁজিবাদের মধ্যেই অন্তর্নিহিত; এর কংক্রিট প্রতিফলন এবং তীব্রতা এক সময় থেকে অন্য সময়ে এবং প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত হতে পারে। পুঁজি প্রকৃতি এবং মানবদেহের ক্ষতিসাধন করে। এই শারীরিক ক্ষতির কারণগুলো উৎপাদনের ক্ষেত্রেই রয়েছে। এবং উৎপাদনের বাইরেও রয়েছে। কারণগুলো অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও রয়েছে। এটি স্বীকার করতে হবে যে পুঁজি দেহ (অথবা দেহ-মন জটিলতা) এবং প্রকৃতির ক্ষতি ঘটায়, তাহলে একে মেনে নিতে হবে যে দেহ এবং প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু গভীরভাবে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, এবং পুঁজিবাদ একটি বাস্তব-অস্তিত্বশীল ব্যবস্থা (কোনও মানসিক কল্পনা নয়)। দেহ এবং প্রকৃতিকে, এবং এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে (যা মূলত বস্তুগত সম্পর্কের একটি সম্মিলন) ভাষাগত বা বাচনিক প্রোডাক্ট হিসেবে গণ্য করা— পুঁজি এবং তার রাষ্ট্রের দ্বারা সৃষ্ট সহিংসতা আসলে প্রকৃত বাস্তবতার প্রতিই সহিংসতা প্রদর্শন করে। যে-কোনও ধরনের চিন্তা একটি বস্তুগত শক্তি হয়ে উঠতে পারে যখন অনেক মানুষ তা বিশ্বাস করে, পুঁজির সহিংসতা থামানোর প্রক্রিয়ার একটি ছোট পদক্ষেপ হল, দেহ এবং প্রকৃতিকে (মাত্র বা প্রধানত) ভাববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা বন্ধ করা।

 


[1] এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটি আংশিকভাবে অ্যাকাডেমিক বামপন্থী পরিসরে গড়ে ওঠা এক বৌদ্ধিক প্রবণতার প্রতিক্রিয়া। তবে, এটি কোনও নির্দিষ্ট গবেষক বা গ্রন্থকে আলাদাভাবে পর্যালোচনার জন্য চিহ্নিত করছে না। বরং, এতে সংক্ষেপে একটি ইতিবাচক মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে— জীবনের বস্তুগত বাস্তবতা এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের জীবনের ওপর সহিংসতার প্রশ্নকে রাজনৈতিক অর্থনীতি ও শ্রেণিসংক্রান্ত সম্পর্কের প্রেক্ষিতে বোঝার প্রয়াস করা হয়েছে।

যাঁরা দেহকে মূলত সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেন, এমন কিছু লেখার সমালোচনামূলক পর্যালোচনার জন্য দেখতে পারেন Fox-এর ২০১৬ সালের প্রবন্ধটি: ‘Health sociology from post-structuralism to the new materialisms’, Health, ২০(১): ৬২–৭৪।
[2] ফক্স। ২০১৬। পৃ. ৬৭।
[3] Zizek, S. Violence. New York: Picador. 2008.
[4] পূর্বোক্ত, পৃ. ১-২।
[5] পূর্বোক্ত, পৃ. ১, ১০।
[6] পূর্বোক্ত, পৃ. ২।
[7] Marx, K. Capital, vol. 1. New York: Vintage. 1977. pp. 177.
[8] পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৬।
[9] Foster, John Bellamy and Burkett, Paul. Marx and nature. New York: St. Martin’s Press. 1999; Foster, J.B. Marx and the environmentMonthly Review, 47(3). 1995. 108-12.
[10] Marx, K. “By what are wages determined?”, Wage Labour and Capital. Marxists.org.
[11] Fracchia, J. ‘The Capitalist Labour-Process and the Body in Pain: The Corporeal Depths of Marx’s Concept of Immiseration’, Historical Materialism, 16(4). 2008. pp. 35-66.
[12] Harvey, D. ‘The Body as an Accumulation Strategy’, Environment and Planning D, Vol. 16:4. 1998. 401-421.
[13] Marx, 1977:342.
[14] ILO. Decent work and the 2030 Agenda for sustainable development: Safety and health at work. accessed February 2018.
[15] Marx, 1977, pp. 380.
[16] Marx, 1977, pp. 789.
[17] এ থেকে বোঝা যায়, পুঁজিবাদী সমাজ-সম্পর্কই উৎপাদনশীল শক্তির বিকাশের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়— যার মধ্যে মানবশ্রমশক্তিই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।
[18] অর্থাৎ ক্ষুদ্র মালিক, যার মধ্যে আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্যরাও পড়েন।
[19] Marx, 1977, pp. 929.
[20] Das, R. Marxist class theory for a skeptical world. Brill, Leiden. 2017.
[21] Krishnan, Kavita. India: Why are Suzuki automobile workers in jail? LINKS. Mar 18, 2017.
[22] Das, 2007:419. Das, R. J. ‘Looking, but not seeing: The state and/as class in rural India’. Journal of Peasant Studies, vol. 34:3. 2007. 408-440.
[23] এই কথাটি মার্কসের ‘বস্তুকেন্দ্রিক মোহ’ (commodity fetishism) তত্ত্বেরই অনুরূপ।
[24] Rubin, I. Essays on Marx’s Theory of Value. Montreal: Blackrose Books. 1973.
[25] ’ফ্যাসিবাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা হল— যখন গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে থেকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা পুঁজিপতিদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে, তখন শ্রমিকশ্রেণিকে নির্মমভাবে দমন করা, তাদের সংগঠন গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ করা।’ Trotsky, L. 1944. Fascism: What It Is and How to Fight It, Marxist Internet Archive.
[26] Ollman, B. Dance of the dialectics: Steps in Marx’s method. University of Illinois Press, Urbana-Champaign. 2003.


*লেখক টরন্টোর ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অফ এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড আরবান চেঞ্জ-এ অধ্যাপনা করেন। তিনি মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থনীতি, বিশ্ব অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন, রাষ্ট্র-সমাজ সম্পর্ক এবং সামাজিক সংগ্রাম নিয়ে পাঠদান করেন। তাঁর গবেষণার মূল বিষয় পুঁজিবাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত দিকগুলি, বিশেষত ভারতের প্রেক্ষাপটে। অধ্যাপক দাস বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনার লেখক, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল Marxist Class Theory for a Skeptical World এবং Critical Reflections on Economy and Politics in India: A Class Theory Perspective.

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5044 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...