বন্যা

সাধন দাস

 

টেবিলে ভাত বেড়ে পাশে দাঁড়িয়েছে পিয়া। কিছু বলবে। অফিস বেরুবার মুখে কিছু না কিছু বায়না থাকবেই।

—ক-দিন থেকেই ঘরের মেঝেটা খুব ঘামছে।

মাথায় ফ্যান পাঁচে ঘুরছে। আগজ্বলন্ত ভাত। ফুঁ দিচ্ছি। উত্তর দেওয়ার সময় নেই।

ফের বলল— ঘর-দোরে খুব পিঁপড়ে উঠছে।

ওর হাতে ভাঁজ করা খবরের কাগজ। বাতাস করছে।

গলা গলিয়ে ভাত গলগল বেগে ঢোকাবার চেষ্টা করছি। আর উশ্‌ আশ্‌ করছি।

—এ বছর বন্যা হবে।

কান তুচ্ছ, একমাত্র মুখগহ্বর ছাড়া শরীরের কোনও ছিদ্রই কাজ করছে না।

—মাসখানেকের মতো চাল, ডাল, তেল, নুন কিনে রাখা দরকার…

একথালা ধোঁয়া ওঠা ভাত, একশো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে মাছের ঝোল সাড়ে সাত মিনিট তিপ্পান্ন সেকেন্ড সময়। বউ সামলাব না গলার আগুন? নইলে বাস টা-টা। অফিসের ব্যাগ এখনও অগোছালো। আজ রেমিট্যান্স আছে। মানে বহরমপুর ক্যাশ সেন্টার থেকে ক্যাশ আনা কিংবা পৌঁছে দেওয়া। হেডক্যাশিয়ারবাবু পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, রেমিট্যান্স করতে পারবেন না। শেখবাগানে ডাকাতের মাঠ পেরিয়ে জান হাতে আসা-যাওয়া করতে রাজি নন।

খাদ্যঠাসা কণ্ঠনালী পেরিয়ে বৌ ঠেকানো হুম, হাম শব্দ অভ্যাসমতো বেরিয়ে আসছে। যার কিছুই মানে হয় না। বিরক্ত পিয়া বেরুবার মুখে ফর্দখানা বুকপকেটে গুঁজে দিয়ে বললে— দয়া করে মুদিখানায় এটা দিয়ে যেও।

ব্যাঙ্কে ঢুকতে না ঢুকতে মাস্টারমশাইরা দল বেঁধে হাহাকারের মতো ঢুকে পড়বেন। স্ট্রংরুমে সেফ (টাকা রাখার সিন্দুক) খালি। এর বেশি বলতে হলে বৌকে অফিসের ‘মে আই হেল্প য়ু’ কাউন্টারে এসে দাঁড়াতে হবে। ছেলেদুটো বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাবা চলে যাচ্ছে, টা টা দেবে। ছেলে দুটোর জন্যে হাতনাড়াটা বরাদ্দ। ব্যাগের ভিতর একহাত ঢুকিয়ে চাবির হিসাব মেলাতে মেলাতে অন্যহাত বাতাসে তুলে নাড়তে নাড়তে রিকশায় উঠে বসলুম। টা টা।

পারিবারিক বিচ্ছেদবেদনা হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকল বাড়ির সামনের রাস্তায়। রোজই থাকে।

বিশ্বকর্মাপুজোর ঢাক আর মেঘের যুগলবন্দি শুরু হয়েছে সকাল থেকে। শারদীয়ার আগমনী। ঢাকের কাঠির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কালো কালো মোষের মতো মেঘ, ঈশান থেকে পশ্চিমে আসা যাওয়া করছে। ডাকও কেমন অচেনা। গুরুগম্ভীর। গুরু গুরু গুর গুর গুড়ি গুড়ি হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। বিরাম দিচ্ছে না। মাঝে মাঝে ভয় পাওয়ানো হুঙ্কার। একসময় ঢাকের কাঠি থামিয়ে মেঘের আওয়াজ জিতে গেল। শুরু হল বৃষ্টি। হাওয়া নেই। দমবন্ধ চরাচর। মেঘে মেঘে আকাশ কালো ত্রিপলের মতো চেপে ধরেছে। টানা দু-দিন বৃষ্টির পর তৃতীয় দিনেও যখন কামাই হল না, বোঝা গেল মুর্শিদাবাদের আকাশে বন্যার ঘনঘটা।

তৃতীয় দিন বেলা তিনটে নাগাদ অফিসে খবর এল সিঁড়ির ঘরে জল ঢুকছে। বাড়িতে বারো এবং আট বছরের  দুজন পুরুষমানুষ আর তাদের স্নেহার্দ্র মাতাঠাকুরানি! সাবক্যাশবুকের পাতায় দস্তখত দাঁড়িয়ে গেল। ম্যানেজারবাবুর বাড়ি নদিয়া। মুর্শিদাবাদের ঘনঘটায় তাঁর ভ্রূকুঞ্চন তখন ধনুকের আকার ধারণ করছে।

বন্যার সঙ্গে বঙ্গভূমির বছরকিয়া চুক্তি। বন্যার জলে চোখের জল মিশিয়ে ভাত ভিজিয়ে খাওয়া বঙ্গবাসীর অভ্যেস। বছর দু-তিন হল, বর্ষার অনটন। এবার মনে হচ্ছে পুষিয়ে দেবে। তৃতীয় দিনেও বৃষ্টি মহানন্দে খেলে বেড়াচ্ছে স্থলে জলে বনতলে। চতুর্থ দিনে জল থৈ থৈ, একতলার ঘরে গলায় গলায় জল। সংসারের পাতালপ্রবেশ ঘটে গেল। ডুবসাঁতার, চিৎসাঁতারের কসরতে খাট বিছানা হাঁড়ি খুন্তি গ্যাসওভেন সঙ্গে নিয়ে ত্রিপল টাঙানো ছাদে উঠে আসতে পেরেছি।

বাড়ি থেকে নামলেই ডুবজল ডুবজল।

বৃষ্টির তিন নম্বর রাত্রি থেকে ঘরবন্দি। অফিস যেতে পারিনি। গলি, পথ, রাস্তা, জলপ্রান্তর হয়ে ঢেউ খেলছে। জল জল জ্বলুনি, জলের মাথায় চালুনি, চালের মাথায় ঘরণী। বলতে পারলে বলো, না পারলে কেরানি। কবে যেন শিখেছিলুম। জল ধাঁধা। জলে জলাকার। বকেয়া উসুল করে ট্রিপল বন্যা। চতুর্দিকে বাস, টেম্পো, লরি, ট্রেনচলাচল স্তব্ধ। তিনদিন অফিস যেতে পারলাম না। ব্যোমভোলে কামাই। এমন হাত পা বেঁধে মার খাওয়া কামাই, কতকাল খাইনি। আহা! কী মজা। অফিস না যাওয়ার আগে ফ্যানাভাত খাওয়ার ছড়াছড়ি সময়। গলায় আটকে আটকে দম নিয়ে নিয়ে আরাম করে করে নামছে। আহা! সাত রাজার ধন এক মানিক ছুটি। ছাদে ত্রিপল টাঙানো ঘরে শুয়ে বসে খাচ্ছি।

আশঙ্কাকে ধন্যবাদ, অফিসের চাবি-ছোড়ান অলিখিত ছেড়ে এসেছিলুম ম্যানেজারবাবুর জিম্মায়! বৃষ্টি আর জলস্রোতে এমন তাণ্ডব, লঙ্গরখানার নৌকো ভিড়তে পারেনি। পাড়ায় এসেছিল। ফিরে গেছে। সার বাঁধা পাকা ঘরের কাঁধে কাঁধে ঢেউ। হালদারপাড়ায় দরমার কুঁড়েগুলো একে একে হেঁটমুণ্ডে ভেসে চলেছে। ঘরে থাকার জ্বালা, গরিব বৌয়ের হাজার কথা দিনরাত বাসি হচ্ছে। যত বাসি হচ্ছে তত দামি হচ্ছে। অফিসের ভারমুগ্ধ চাপে ভবিষ্যদ্বাণীর সেই চাল ডাল তেল নুন অফিস-কয়েদির ঘরে ঢোকেনি। ভুলে গেছি। ফর্দ পকেটে থেকে থেকে যথাপূর্বং ভিজেপুড়ে হারিয়ে গেছে। ফিরে পেতে থানায় ডাইরি লেখানোর উপায়ও নেই। শহরখানা ডুবুডুবু, থানা ভেসে যায়। হাফপেট খেয়ে, টেনেটুনে আর দু-তিন সাঁঝ চলবে, অতঃপর হরিমটর! মা পিয়ার শূন্যভাণ্ড!! প্রসাদ কণিকা মাত্র, যত পারো বন্যার থৈ থৈ জল।

এ মতো দুর্যোগে দোলায়মান নৌকো চড়ে বাড়িতে পুলিশ হাজ়ির। জেলাব্যাপী দুর্ভিক্ষ, হাহাকার, নৈরাজ্য চলছে; হরিপাড়ার ডেপুটি ম্যানেজারের ঘরে থাকা মানায় না। জরুরিভিত্তিতে অফিসে জয়েন করতে হবে। কন্ট্রোলিং অফিসের অর্ডার। স্কুলশিক্ষকদের মাইনে, বৃদ্ধদের পেনশান, বন্যার্ত মানুষের পঞ্চায়েত ফান্ড দিতেই হবে। অধমের বিনীত প্রশ্ন ছিল— ম্যানেজারবাবু তো আছেন?

উত্তর— এখন পাঁচজন ম্যানেজারেও অবস্থা সামাল দিতে পারছে না।

মরিয়া হয়ে বলে উঠলুম— ঘরে চাল, ডাল, তেল, গ্যাস বাড়ন্ত। অনাহার শুরু হয়েছে। শর্ত দিলুম— হপ্তা দুয়েকের আহার্য ঘরে পৌঁছে দিলে যেতে পারি। মানে নিয়ে যেতে হবে।

পুলিশের কোনও এক বাবু বলে উঠলেন— পৌঁছে যাবে।

পুলিশের কথা না তো ব্যাঙের মাথা। কলজে নিংড়ানো রস তখন চোখের গোড়ায় এসে জমেছে। দম বন্ধ করে বললুম—

—পৌঁছে দিলে কিংবা জোগাড় দিয়ে তবে যাব।
—পৌঁছে যাবে।

এর বেশি কিছু শুনতে পেলুম না। আমাকে তুলে নেওয়া হল নৌকোয়। অকূল জল-যাত্রা! এক ত্রিপল খাটানো দ্বীপে তণ্ডুলশূন্য তিন প্রাণীকে ফেলে চললুম। কচি কচি চারখানা উদ্বাহু হাত, ছ-চোখে জলোচ্ছ্বাস, বন্যার চেয়ে কোনও অংশে কম তীব্র ছিল না। একমাত্র গৃহস্বামীকে বিসর্জনে পাঠানো চারখানা কচি আর মুখ চাপা দেওয়া একখানা আঁচলে ঢাকা দুখানা কোমল হাত তখন চোখগুলি মুছতে ব্যস্ত। ভেসে চললুম জলমগ্ন ভারতবর্ষের দুর্গতি মোচনে। দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে, পাকখাওয়া নৌকোয় দাঁড়িয়ে, মনে পড়ল, ছেলেদুটোর জন্যে বরাদ্দ হাতখানা নাড়াতে ভুলে গেছি। ভুল সংশোধন করার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে শূন্য বাতাসে হাত নেড়েই চললাম— টা টা টা টা…

জলবিদ্ধ ঘরসংসার, দুটো ছেলে, বউ তখন বন্যার আড়ালে হারিয়ে গেছে।

জলের তোড়ে দাঁড়ের তড়পানিতে বন্যার জল এসে পড়েছে চোখে, নাকি অন্য কিছু!

শহরের তাবড় সমাজসেবী পুলিশেরা আমাকে কদমফুলির কূলে নামিয়ে নৌকো নিয়ে চম্পট দিল। চলল, হয়তো আবার কোনও ডেপুটির বাড়ি, মহান উদ্দেশ্যে! এতক্ষণ বৃষ্টি বন্ধ ছিল। আবার শুরু হল টিপটিপিয়ে। জলভেদী রাস্তা কাদাময়, দুর্দান্ত পিছল। অফিস-মুগ্ধ মানুষের প্রতিমুহূর্তে আছাড় খাওয়ার ফাঁদ। চোখদুটো পায়ের আগায় লাগিয়ে ছাতা খুললুম। পিছনে অথৈ জল। সামনে জলের বিভীষিকা।

অফিসে ঢোকার মুখে সিঁড়িতে, ঘরের মেঝেতে, কাউন্টারে মানুষ ঠাসাঠাসি। সবাই টাকা নেবে। টাকা চায়, টাকা! ম্যানেজারবাবু চেম্বার বন্ধ করে বসে আছেন। ভয়ে চোখ বন্ধ। শেয়ালের কুমিরছানা দেখানোর মতো সবাইকে ডেপুটি ম্যানেজার দেখিয়ে থামিয়ে রেখেছেন। জল ভেঙে এসে আগুনের মধ্যে পড়লুম। টাকা নেই। ক্যাশের খাঁচা ফাঁকা। ক্যাশিয়ারবাবু ফুড়ুত। তিনি যুদ্ধের শেষে আর ভোজনের আগে ওস্তাদ। তাঁর আওয়াজ পাচ্ছি ক্যান্টিনঘরে। কাজ নেই তো খইয়ের বদলে বন্যার সস্তা মাছ ভাজার তদারকিতে ব্যস্ত। ভল্ট শূন্য। কাস্টমার সার্ভিস সসেমিরা। টাকা দেওয়া ছাড়া এখন কোনও কাম হচ্ছে না। রাস্তা ভেসে গেছে। গাড়িঘোড়া বন্ধ। রেমিট্যান্স সম্ভব নয়। স্টাফ নেই। যার বাড়ি হাওড়া, বন্যাবিধ্বস্ত এলাকা থেকে তিনশো কিলোমিটার দূরে, সেও চলে গেছে ঘরবাড়ি রক্ষার দায়ে। যার বাড়ি দার্জিলিং পাহাড়ের উপরে, সেও চলে গেছে। বারোজন স্টাফের সবেধন নীলমণি তিনজন পড়ে আছে। লাগে টাকা দেবে এই গৌরী সেন।

আর আছে হীনগতি খোঁড়া ক্যাশপিয়ন গৌর। বাড়ি হরিপাড়াতেই। নিরুপায় খুঁটোয় বাঁধা। বেচারি! সে আর যাবে কোন চুলোয়? অগত্যা গৌরকে সঙ্গী করেই বেরুতে হবে অধম এই গৌরী সেনকে।

ম্যানেজারবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন— আপনি ডেপুটি ম্যানেজার। অফিস-বস। আপনি কোথায় বেরুবেন? এই জরুরি অবস্থায় আপনার বেরুনো চলবে না। যে-কোনও মুহূর্তে ব্যাঙ্ক লুটপাট হয়ে যেতে পারে। কোথায় যেতে হবে বলেন, আমি যাচ্ছি।

ম্যানেজারবাবু বেরুলে ফল কী হবে আন্দাজ করে, ফোন করলুম পুলিশে। ফোন বিকল। কাছেই থানা। অগত্যা ক্যাশিয়ারবাবু এবং গৌরের সাহায্যে মেন গেট বন্ধ করে দিলুম। ম্যানেজারবাবু সার্কুলার রেফারেন্স দিয়ে জানালেন, কাস্টমার আওয়ার্সে গেট বন্ধ করা বেআইনি।

বললুম— আমিই বেরুব। আপনার নিরাপত্তার জন্যে এই বে-অফিসি ব্যবস্থা।

কোনও উত্তর নেই। লুটপাটের দায় এড়াতে, তিনি বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন।

ম্যানেজারবাবুর থোঁতা মুখ ভোঁতা। বসের আদেশ অমান্য করে ছাতা মাথায় এবং খোঁড়া গৌরকে সঙ্গী করে বেরুলাম। প্রথমেই থানা অভিযান। বড়বাবুর হাতেপায়ে পড়ে দুজন বন্দুকধারী, একজন লাঠিয়াল পেয়ে গেলুম। বন্দুকধারী দুজনকে ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে, লাঠিয়ালকে পেছনে জুড়ে ছাতা মাথায় চললুম তিনজন। পিটপিটে বৃষ্টিও চলেছে আমাদের সঙ্গে। হরিপাড়ায় যদু সিংহরায় লোকাল টাটা, রাম বিশ্বাস গোয়েঙ্কা, এবং ইসমাইলসাহেব বিড়লা। তাঁদের বাড়ি বাড়ি চলেছি। বিনয়ের অবতার সেজে, ঘাড় হেঁট করে, হাতজোড় করে ওঁদের কাছে ভিক্ষে চাইতে। ভিক্ষে চাওয়া অভ্যেস আমাদের। ওঁদের যে কেউ একজন তুড়ি মেরে দু-একদিন ব্যাঙ্ক চালিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। সরকারি মাথা টাটা-বিড়লার কাছে মুড়িয়ে দেব, এ নতুন কিছু নয়, লজ্জারও নয়। তবে এই দুঃসময়ে তাঁদের পোয়াবারো। টাকায় টাকা আসবে। আমাদের দেবেন কেন? অতএব প্রথমে গেলাম জেসিআই ম্যানেজারের কাছে। তাঁর কাছেও অসময়ে টাকা পেয়েছি। এদের সবার কাছে কাকুতিমিনতি করে যা পেলাম হিসেব করে পেমেন্ট দিলে দিন দুয়েক চলে যাবে।

অফিসে ফিরে দেখি, ম্যানেজারবাবু নেই। উঁকি মেরে ক্যাশিয়ারবাবুকে পাওয়া গেল সেই ক্যান্টিনঘরে। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এক মিনিটের পথ ক্যাশের খাঁচায় এলেন পনেরো মিনিট হেঁটে। এবং দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত ক্যাশিয়ারবাবু জানালেন, ব্যাগে কাগজপত্র গুছিয়ে ম্যানেজারবাবু নদিয়া চলে গেছেন। এইমাত্র খবর এসেছে ওনার ফ্যামিলি বিপদগ্রস্ত।

বুঝলাম, রেডি হয়েই ছিলেন। ফাঁক পেয়ে য পলায়তি স জীবতি।

থম মেরে দাঁড়িয়ে গেলাম জানালার রড ধরে। বৃষ্টি থামেনি। হারাধনের চারটি ছেলে, রইল বাকি তিন! কিন্তু দিনমান উজ্জ্বল হচ্ছে। বাতাসও হালকা লাগছে। চাপধরা মেঘও ভেঙে টুকরো। আকাশ পরিষ্কার হওয়ার লক্ষণ। আকাশের দিকে তাকিয়ে সবাই শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে, আর মানাচোনা করছে— আর না দিয়া, ধরন দাও।

আকাশের সঙ্গে গুমোট ধরা মানুষের মনও শুকোতে চাইছে। টাকার সংস্থান কিছু হয়েছে। ব্যাঙ্কে পুলিশ মোতায়েন করা গেছে। এমন সময় স্যারের চলে যাওয়াটা ভীষণই শত্রুতা মনে হল। কিছুতেই ভুলতে পারছিনে, বিডিও, পুলিশ, পঞ্চায়েত প্রধানের সাহায্য নিয়ে তিনি বিপদসঙ্কুল হরিপাড়া থেকে নিজেকে উদ্ধার করার জন্যে ডেপুটি ম্যানেজারকে বন্যার স্রোতে ধাক্কা মেরে ফেলে গেলেন। ছাগলের শিং-এ পা রেখে ধূর্ত ম্যানেজারের দ্রুত পলায়ন। খানিক বিমূঢ় বিস্ময়ে হতবাক। গায়ে গু মাখলে যমে ছাড়বে না। বিমূঢ় হওয়ার সময় নেই। দেওয়ালে নোটিস ঝুলিয়ে দিলাম— দু-হাজারের বেশি টাকা কাউকেই দেওয়া হবে না। সন্ধে, রাত যাই হোক, টাকা থাকলে, বেলা দুটো পর্যন্ত যারা লাইনে দাঁড়াবেন প্রত্যেককেই দেওয়া হবে।

ক্যাশিয়ারবাবুর কাউন্টারের সামনে থেকে লাইন দাঁড়িয়ে গেল হরিপাড়া বাজার ছাড়িয়ে ‘রানু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ পর্যন্ত। বিনি পয়সায় সুখেনের মিষ্টি খেয়ে গোঁফ মুচড়ে পুলিশ লেগে গেল লাইন তদারকিতে।

লোকাল জোগানের টাকা দু-দিনেই ফুড়ুৎ। আবার কোলাপসিবল গেট বন্ধ। বিকেল, সন্ধে, মাঝরাতেও বেজে উঠছে কোলাপসিবলের ঝনঝন শব্দ, টাকা চাই, টাকা।

—টাঙুন থিকা টাকা আনা করান।

করান তো বটে, যাবে কে? কোন পথে? টাঙুনে যাওয়ার একটাই রাস্তা, বন্ধ। আসার সময় দেখেছি চরের মতো জেগে থাকা পথে পলিথিন তাঁবু ছড়াছড়ি। বন্যার্ত মানুষেরা পেটে গামছা বেঁধে উবু হয়ে বসে আছে খোলা আকাশের নিচে। শূন্য ভাগাড়ে ঝাঁক ঝাঁক শকুনের মতো মানুষে মানুষে ছয়লাপ।

—উপায়, ক্যাশিয়ারবাবু?
—কী হবে গৌর?

আমরা তিনজন, তিনজন থানার সেপাই, ব্যাঙ্কবন্দি, নজরবন্দি, জলবন্দি। ছ-জন প্রাণী, মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। উপায়?

বন্ধ কোলাপসিবল বাজছে, ঝনঝন ঝনঝন। টাকা চাই, টাকা।

টাকা নাই, টাকা নাই। পালাবারও পথ নাই, নাই রে…..

রেমিট্যান্স সেন্টারে টাকা পাঠাবার আর্জি জানালাম। বহরমপুর খবর পাঠাল, বিপদসঙ্কুল পথ, যে-কোনও জায়গায় লুটপাট হয়ে যেতে পারে (হতে পারে না, খবর পাচ্ছি হচ্ছে)। তারা কেউ টাকা দিতে আসবে না, নিজের দায়িত্বে আনতে হবে। প্রথমদিন টাকা পাওয়ার লাইনে দেখেছি, আশা সত্যি হলে, ক্ষুধার্ত মানুষও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। অ্যাকাউন্টে হাজার হাজার টাকা থাকলেও প্রতিবেশীর কথা ভেবে দু-হাজার টাকা সমবণ্টনে রাজি হয়। এই সব মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ আমি। তাঁদের কাছে দেওয়া কথা রাখার জন্য অগত্যা আমাকেই রেমিট্যান্সে যেতে হবে। একান্ত নিজের নিরাপত্তার কারণে। বুভুক্ষু এই সব মানুষের কাছে চুনকালি মাখার কোনও মানে হয় না। জানি, পথে বুভুক্ষু, মরণমুখী বেপরোয়া মানুষেরা। শেখবাগানের ডাকাতেরা উঁচুপোঁতায় কদমফুলির কাছাকাছি উঠে এসেছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা, জেলে যাওয়ার ভয়, এমনকি জীবন যাওয়ার সামনে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে গেল কয়েকটা কথা যার শক্তি এ সবকিছুর চেয়েও বেশি। সে আমার নিজেরই উচ্চারণ— কেউ হতাশ হবেন না। শনিবার বারোটা, অন্যদিন বেলা দুটো পর্যন্ত লাইনে যতবার দাঁড়াবেন দু-হাজার করে পাবেন। সন্ধে হোক, রাত্রি হোক, টাকা পাবেন।

লঙ্গরখানা থেকে খিচুড়ি এসেছিল, খেয়েছি। ঘুম আসছে না। অফিসঘরে টেবিল জোড়া দিয়ে শুয়ে আছি, মাত্র দুজন। আমি চিৎ। পাশে ক্যাশিয়ারবাবু কাত। বিদ্যুৎ এখনও বিপর্যস্ত। শুনশান অন্ধকার। আর কেউ নেই। তবু যেন কারা সঙ্গে আছে। টের পাচ্ছি। তিনজন পুলিশের মায়া পড়ে গেছে আমাদের উপর। সময়ের হিসেব চুলোয় দিয়ে কাল ভোরেই ডিউটিতে হাজির হয়ে যাবে। ক্যাশপিয়ন খোঁড়াগৌর লেংচে লেংচে সর্বক্ষণ পিছন পিছন ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুর্যোগে জটিল মানুষ ক্যাশিয়ারবাবুও সরল নরম হয়ে গেছেন। সমস্ত ঝক্কিঝামেলা সহ্য করে বিশ্বস্ত সৈনিকের মতো হরিপাড়ার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে গেছেন। উনিও যে কোনও মুহূর্তে কোনও না কোনও কৌশলে ধূর্ত শেয়াল হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু হননি! মানুষের বিপদে মানুষই বোধহয় এমন বদলে যেতে পারে। তিনিও জেগে আছেন।

পাশ ফিরে বললেন— স্যার, আপনি রেমিট্যান্সে যাবেন না। রাস্তার অবস্থা একদম ভালো না। কাল নোটিস দিন একশো লোককে দেওয়া হবে। একশো লোককে দেওয়ার মতো টাকা ভল্টে আছে। বিকেলে না হয় আর একবার টাটাবিড়লাদের কাছে যাবেন।

কটকট কটকট…

বললুম— সে হবে না। মানুষের গলা শুকিয়ে কাঠ। থুতু দিয়ে চিঁড়ে ভেজানো যাবে না।

অফিসের পিছনে বাঁশঝাড়। ওদিক থেকে বিশ্রী একটা আওয়াজ আসছে। বেশ কিছুক্ষণ অন্তর শব্দটা হচ্ছে। দিনেরবেলাতেও শুনেছি। মনে হয়েছিল বাতাসে বাঁশঝাড়ের কারসাজি। বিশেষ কিছু মনে হয়নি। এখন শুনশান রাত্রি। কানে বড্ড বাজছে। যেন কিছুর আর্তনাদ। কেউ যন্ত্রণা দাঁতে দাঁত চেপেও ঢেকে রাখতে পারছে না। শব্দ হচ্ছে— কটকট কটকট…

—ক্যাশিয়ারবাবু, ওটা কীসের শব্দ?
—কে জানে? ক্যাশিয়ারবাবু বললেন— সবচে ভয় কদমফুলির চরে। ডাকাতগুলো খেতে না পেয়ে হন্যে হয়ে আছে।

বললুম— আপনি গেট বন্ধ করে ভিতরে থেকে যাবেন। আমি একটা প্ল্যান এঁটে ফেলেছি। সিংহরায়বাবুর গ্যারেজে জল ঢুকে ওনার এ্যাম্বাসাডর বিকল। ছ-চাকার লরিখানা দিতে রাজি হয়েছেন। লরি থাকবে কদমফুলির এপারে। ওপারে আটকে থাকা রামবাবুর ম্যাটাডোরখানা পেয়ে যাব।

ভজহরিবাবুর ডানহাত সোনা ঘোষ থাকছে সঙ্গে। ভজহরিবাবুই পাঠাতে রাজি হয়েছেন। সোনা ঘোষ একাই একশো। সে থাকলে, হরিপাড়া থেকে বহরমপুর যেখানে খুশি বিশ-পঞ্চাশ মানুষ হাজির করে দেবে।

জলপথটুকু ঘুরে ঘুরে নৌকোয় মেরে দেব। জলে ডাকাতির খবর এখনও পাওয়া যায়নি। বহরমপুর ব্রাঞ্চ বলেছে দুজন পুলিশের ব্যবস্থা করে দেবে। ভজহরিবাবু, রাম বিশ্বাস, সোনা ঘোষ এক-একজন এক-একটা রাজনৈতিক চাঁই। সবাই মিলে যখন সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন, আশা করি, পলিটিক্যাল হ্যাজার্ড থাকবে না।

ক্যাশিয়ারবাবুর গলায় ঘুম জড়িয়ে আসছে। বললেন— সোনা ঘোষ লোকটাকে আমার ঠিক পছন্দ নয়। দেখবেন স্যার, চাকরি নিয়ে টানাটানি না হয়…

—রাম বিশ্বাস চেয়েছিলেন, এলাকার চার রাজনৈতিক দলেরই ফ্ল্যাগ টাঙিয়ে কাজটা সারতে। রাজি হইনি।
—ভুলে যাবেন না স্যার, আপনার একটা সংসার আছে। দুটো বাচ্চা আছে। বড্ড রিস্ক নিচ্ছেন। কিছু হলে বৌদি…

কটকট কটকট… শব্দটা রাতেরবেলা বাড়ছে।

অফিসের পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় চোখে পড়েছিল, বাঁশঝাড়ের গোড়ায় ডোবাটা ভেসে গেছে। পাশে একটা মাটির ঘর, খড়ের চাল। ওটাতে জল ঢুকে পড়েছে। ঘরে-বাইরে বন্যার সোঁত বইছে। শক্ত হলুদ টনটনে দেওয়াল ভিজে গাঢ় কালো। দুটো কচি বাচ্চা নিয়ে একজন ভিখিরি মা, এই ঘরে থাকে। দেখেই বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করে উঠল। যেন বুকের ভিতরে বন্যার স্রোত ঢুকে পড়ল। ভিতে জল বসে ঘরখানা একদিকে কাত হয়ে গেছে। যে কোনও মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। ওরা নিশ্চয় জল ঢোকার রাতে পালিয়ে যেতে পেরেছিল! বন্যার জলে ভেসে গেলে খবর পেতাম। শূন্য ঘর পড়ে আছে। কটকট কটকট…

শব্দটা ওই ঘরের ভিতর থেকে আসছে। মা না থাকলে যখন খিদে পেত, হাতধরাধরি করে ভিখিরির বাচ্চাদুটো মাঝেমাঝেই হত্যে দিত অফিসে। ওদের চিনি। আমার ছেলেদুটোর বয়সী হবে। দশ পয়সা বিশ পয়সা কেউ দিত, কেউ দিত না। হাতের কলম তুলে কেউ ছেই ছেই করত। পাশের কলিগকে কানকি মেরে কেউ আমার টেবিলে ঠেলে দিত। আমি নাকি অফিসের বাবা।

আদুল গা। বড়টা নেংটি পরা, ছোটটা ল্যাংটো। মুখ দুখানা খিদের হাসিতে ভরা। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকত চুপচাপ। কিছু চাইত না। নিজের ছেলেদুটোর মুখ মনে পড়ে গেল।

রেমিট্যান্সে যাচ্ছি, মন শক্ত রাখা দরকার। এসব আজেবাজে ভাবলে চলবে না। অসময়ে বুকের ভিতর একগাদা ফালতু জল ঢুকে পড়ল। হৃদপিণ্ডের চারপাশ স্যাঁতসেঁতে লাগছে। এখন সচেতন থাকতে হবে। চারদিকে অভাব অভাব। অভাবে-স্বভাব-নষ্ট মানুষের ছড়াছড়ি। কোথায় কী বিপদ ওঁত পেতে আছে। প্রতিটা পা মাপতে মাপতে যাওয়া উচিত। বহরমপুরের দিকেই যাচ্ছি। মনে পড়ে গেল বাড়ির কথা। সেই অকূল জল-যাত্রা! বুকের ভিতর স্রোত পাক খেয়ে উঠল। ত্রিপল খাটানো দ্বীপে ফেলে এসেছি, তণ্ডুলশূন্য তিনটি প্রাণী…। কচি কচি দুটো হাতের উলটো তালুতে ঢাকা মুখ। আঁচলের খুঁট দাঁতে চেপে দাঁড়িয়ে থাকা আর এক অসহায় নারী। নৌকো ভেসে যাচ্ছে। বেয়াড়া ভাবনা, রেহাই দেয় না। ট্রেনিং-এ আমাদের শেখানো হয়, সবসময় ব্যাঙ্কম্যানদের এক পা অফিসে আর এক পা জেলে। সংসারে রাখার মতো পা নেই। রাখতে চাইছিও না। মাসের বাজার হয়নি। ঘরে চাল নেই। ডাল নেই। বন্যা ভেজা আলসেয় কাঁকড়াবিছে, কালীবিছে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখলেই, বউ দু-হাত তুলে আর্তনাদ করে। ছোটছেলেটা খিদে একদম সহ্য করতে পারে না। ছটফট করে। কাঁদে। বড়ছেলেটা সহ্য করতে শিখেছে। আঁচল দিয়ে মা-র কান্না মুছিয়ে দেয়। অফিস চলাকালীন এমন ভাবা বেআইনি। তবু মাথার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। ভাবনা খুব বেয়াদব। বুকের ভিতর ব্যথা কটকট করে উঠছে।

হরিপাড়া বাজারে বুড়ো ফেকুদর্জি বলেছিল— বন্যায় জল বসে ভেঙে পড়ার আগে মাটির ঘরের বাঁধন সব কাঁদতে থাকে। তখন কটকট শব্দ হয়। ঘরের আড়ায় বাঁশ, চটা, খুঁটিতে যত বাঁধন আছে, আলগা হতে থাকে। বাঁধন কাটতে না পেরে দু-একটা বাঁশের খুঁটি ফাটতে থাকে। দু-তিনদিন এমন কি পাঁচ-সাতদিন এইরকম আর্তনাদ হয়। তারপর একদিন ধুপ করে ভেঙে পড়ে। নাও পড়তে পারে। পড়তে পড়তে বেঁকেচুরে ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েও যায়। সে ঘর কোনওদিন সোজা হয় না। ভেঙে ফেলতে হয়। মনে হল বাঁধন তো নয়, মায়ার বাঁধন। কাটছে। চোখে, কানে, বুকের ভিতরও জলের সোঁত বইছে। ঘরখানা আর একবার শব্দ করে উঠল। কটকট কটকট…

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। টাকা নিয়ে কদমফুলি পর্যন্ত জল, ঢেউ, দিক, সময়ের সঙ্গে লড়তে লড়তে ফিরেছি। নৌকো থেকে মালকড়ি নির্বিঘ্নে লরিতে উঠে গেছে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে গিয়ে দুম করে আটকে গেল বুকে। কদমফুলি থেকে স্টার্ট নেওয়ার সময় লরি নড়ছে না। সর্বনাশ! লরিতে টাকার ডাঁই। ছোট পেমেন্ট দেওয়ার জন্য ছোট ডিনোমিনেশানস নিয়েছি। সিটের উপরে নিচে বাক্সভর্তি টাকা। বসার জায়গা নেই। পাশেই কদমফুলির চর। ক্যাশিয়ারবাবুর কথা মনে পড়ে গেল। বুভুক্ষু ডাকাতদের আস্তানা। বুক কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বুকের খাঁচা, কলজে সমেত মেরামত করে ফেললাম। অস্থির হলে চলবে না। অনেক লড়তে লড়তে আসছি। দমও ধরে রেখেছি। আর কয়েক মাইল, ঠিক পৌঁছে যাব। তবু মনে হচ্ছে সাহসের গোড়াটা আগের মতো জমাট নেই। কদমফুলির চর এখন ভয়ঙ্কর এলাকা।

দূরে একটা আমবাগান দেখা যাচ্ছে। ওখানে মাটি জেগে আছে। অগুন্তি কালো কালো পলিথিনতাঁবু। পিলপিল করছে মানুষ। ওটাই সেই চর। একটা লঙ্গরখানা। খাওয়াদাওয়া চলছে। মনে হচ্ছে, ভালো মানুষদের ভিড়ে তেনারা ওখানেই আস্তানা গেড়েছেন। বিডিও সাহেব, থানার বড়বাবু খুব ভালো করেই জানেন, লঙ্গর খাইয়ে ওদের পেট ঠান্ডা না রাখলে হরিপাড়া, অরূপপুর, জামতলা ডাকাতিতে লোপাট হয়ে যাবে। টাটাবিড়লারাও রেহাই পাবেন না। রামদা, ভজহরিবাবুরা এটা ভালোই বোঝেন। শুনেছি, নিজেদের বাঁচার তাগিদে মহাপুরুষ হয়ে নিজেরাই লঙ্গরখানা চালাচ্ছেন।

সোনাদা খুব স্বার্থপর। এই সব মানুষের উপর নির্ভর করা বোকামি। কোথায় পাশে পাশে থেকে ভরসা দেবে, তা নয়। কিছু না বলেই টাকাভর্তি লরি ফেলে চলে গেল লঙ্গরখানার দিকে। ডাকাতদের, নাকি নিজের পেটসেবা করতে, কে জানে? দুজন পুলিশ আর আমি পড়ে রইলাম। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। ভিজছি। ভয়ে নাকি ঠান্ডায় কেন যে কাঁপছি— জানি না। ড্রাইভার লরির নীচে কাদায় শুয়ে শুয়ে অনন্তকাল ধরে খুটুরখুটুর করেই চলেছে। টাকা ছেড়ে নড়তেও পারছিনে। এই বুঝি লুট হয়ে গেল। মাথা কাজ করছে না। সোনা ঘোষ লোক পাঠিয়ে যখন ড্রাইভারকে ডেকে নিতে এল, বুকের বাঁ দিক চিনচিন করে উঠল। লরির নীচ থেকে বেরিয়ে এল দশাসই ড্রাইভার। হাতে একখানা লোহার রড। মনে হয়েছিল, দু-পাঁচটা ডাকাতের মহড়া নিতে পারবে। ওকেও সরিয়ে নিল। যদি কিছু হয়, সোনাহারামির জন্যেই হবে। কাঠির মাথায় আলুরদমের মতো পুলিশ দুটো বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ঘুমুচ্ছে। কেউ যদি চোখ মোটা করে তাকায়, ল্যাংপেঙে পুলিশ বন্দুকসুদ্দু পেচ্ছাপ করে ফেলবে। মাথায় বাক্স নিয়ে চোখের সামনে দিয়ে ডাকাতরা ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবে। খুন করে গেলেও কেউ দেখার নেই। পলিটিক্যাল নেতাদের ভরসায় রিস্ক নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। কাজটা যেমন বেআইনি, সাদা চোখে তেমনই আহাম্মুকি। তবে যত বড় জোয়ানমদ্দই হোক দু-চারজনের পক্ষে টাকা নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাক্সদুটো চেন তালা দিয়ে আচ্ছা করে লরির গ্রিলে আটকানো। চাবি আমার কাছে। মরে গেলেও দিচ্ছি না। দরকার হলে কদমফুলির জলে ফেলে দেব।

কিন্তু এখন উপায়?

কোত্থেকে এক এঁচোড়েপাকা ছোকরা এসে কিনা বলে— ম্যানেজারবাবু, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, হাতে মুখে জল দিয়ে চাড্ডি খেয়ে নিন।

ইয়ার্কি হচ্ছে? কণ্ঠায় প্রাণ এসে ঠেকে আছে। কলাগাছকেও ডাকাত ভাবছি। খাওয়ানোর নাম করে ডাকাতির সুলুক নিতে এসেছে। টিকটিকি কোথাকার! হুঙ্কার দিয়ে উঠলাম— কে? কী চাই? ভাগো হিঁয়াসে।

ছেলেটি আমতা আমতা করে বললে— সোনা ঘোষ আমাকে পাঠালে।

দলের ম্যাড়া রামদা পই পই করে দিব্যি দিয়ে পাঠিয়েছে, রাস্তায় উলটোপালটা কিছু হলে যেন বেগোরবাঁই না করি। সোনা ঘোষ যেমন বলবে, অক্ষরে অক্ষরে তেমন চলতে হবে। মহা মুশকিলে পড়া গেল। খিদে-ফিদে কিছু নেই। টাকা ছেড়ে নড়া যায় না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তিনজন শালপাতায় খিচুড়ি নিয়ে এসেছে। দু-চার গ্রাস খেয়ে নিলাম। খিচুড়ি গলায় আটকে রইল। পেট পর্যন্ত নামল না।

পালাতে পারলে বাঁচি। ছোকরা সরেজমিনে কী তদন্ত করে গেল, সে-ই জানে। শেষ পর্যন্ত সোনা ঘোষ, ড্রাইভার ডাকাতদের দলে ভিড়ে গেল না তো?

লঙ্গরখানার দিক থেকে একদল ডাকাত হা রে রে রে ছুটে আসছে। যাঃ, সব শেষ হয়ে গেল। রামদা, সিংহরায়বাবু— তোমাদের মনে এই ছিল? আনাড়ির বাচ্চা আমি। কী করি! ধুকপুকটুকু ছিঁড়ে না নিলেও আতঙ্কে বুক ফেটে যাবে। চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠলুম— ফায়ার।

কোথায় পুলিশ! স্বধর্মে লুকিয়ে পড়েছে কোথাও! যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, হাওয়া খেলা করছে। কপাল ভালো, গলা শুকিয়ে কাঠ। মুখ দিয়ে কোনও স্বর বেরোয়নি। ভাগ্যিস, পুলিশরা পালাতে জানে। নইলে খুনের দায়ে পড়ে যেতাম।

হাড়জিড়জিড়ে কতগুলো না খেতে পাওয়া মানুষ, কুঁজো, পরনে ত্যানা, বুকের হাড় কলজেতে ঠেকেছে, এসেছে লরি ঠেলতে। একদল খেতে না পাওয়া মানুষ এসেছে আর একদল না খেতে পাওয়া মানুষের টাকা পৌঁছে দিতে। বন্যা বন্যা ভাই ভাই।

ও, হরি! এদেরকে আমরা ডাকাত বলি! মানুষ চিনতে এত ভুল! আর একটু হলে কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে ফেলেছিলুম। একদল বন্যার্ত মানুষ হাত লাগাল লরির পিছনে।

—হেঁইয়ো মারি কলের গাড়ি
—কল চলেছে তাড়াতাড়ি
—শ্বশুরবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি।

লরি চলতে শুরু করল। বুকে হাত রাখলাম। নিঃশ্বাস বইতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, এ যাত্রা বেঁচে গেলুম। এই সেই মানুষেরা যাদের ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে আসছিল। মাটির ভিতর পুঁতে যাচ্ছিলুম।

-হরিপাড়াব্যাঙ্ক মাই কী?
—জয়।

বৃষ্টি ধরন দিলেও চারদিকের জল ঠেল ধরেছে। হরিপাড়ার এ-জায়গাটা নিচু। জল বাড়ছে। যাওয়ার সময় পায়ের গোছ পর্যন্ত জল পার হয়ে লরিতে উঠেছিলুম। এখন হাঁটুজল। পাক্কা দু-মাইল রাস্তা বন্যার্ত মানুষের হাতে ঠেলা খেয়ে বাক্স ভর্তি টাকা পৌঁছে গেল, ব্যাঙ্কের নীচে। এই বে-আইনি জয়ের কথা উপরতলার কাউকে বলতে পারব না। তবু জয়। ন্যায়ের জন্য জয়। বাঁশবাগানের নীচে কুঁড়েঘরখানায় জানালার খুপরি পর্যন্ত জল উঠে গেছে। পার হয়ে ব্যাঙ্কে ঢুকে পড়লাম। দু-হাত কপালে তুলে হাঁফ ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠলুম— জয় বন্যার্ত মানুষের জয়।

কটকট কটকট… হুড়মুড়, বিকট শব্দ। জলচ্ছ্বাস কাঁপিয়ে দিল ব্যাঙ্ক। ভেঙে পড়ল কুঁড়েঘরখানা। ছ-দিন ধরে ভেঙে পড়তে পড়তে আজ জলসাৎ হয়ে গেল। শরীরের ভিতর কেমন পাক দিয়ে উঠল। একটা চোঁয়াঢেকুর মেঘের মতো ডাক ছাড়ল। গলা বুক জ্বলছে। খিচুড়ি খাওয়ার পর জল খাওয়া হয়নি। কুঁড়েঘরখানা ঘাড়ে এসে পড়ল, নাকি মাথা ঘুরে গেল! চারপাশের হাওয়া, বাতাস, ছবি ঝাপসা হয়ে এল। কচি কচি দুখানা হাত বাতাসে দুলছে। কারা যেন ডাকছে— বাবা..আ… বাবা আআআআ….

কেউ শুনতে পেল না। সবাই জয়ধবনি দিচ্ছে— জয় বন্যার্ত মানুষের জয়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...