ভারতের ‘শ্বেত-বিপ্লবে’ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শ্যেনদৃষ্টি

দেবাশিস মিথিয়া

 


ডঃ কুরিয়েনের “অপারেশন ফ্লাড”-এর হাত ধরে ভারতের দুগ্ধখাতে বিশাল সাফল্য এসেছে। কিন্তু দুধের বাজার অবাধে খুলে গেলে গ্রামীণ অর্থনীতি বিপদে পড়বে, স্বনির্ভর দুগ্ধশিল্পের স্বপ্নও শেষ হয়ে যাবে। তাই, ভারতের দুগ্ধজাত পণ্যকে ‘এফটিএ’ থেকে দূরে রাখতে পারলে কয়েক কোটি মানুষের জীবিকা রক্ষা পাবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে


​ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক দুগ্ধজাত পণ্যের শুল্ক নিয়ে তীব্র টানাপোড়েন চলছে। নিজেদের কৃষিবাজারকে সুরক্ষিত রাখতে ভারত নির্দিষ্ট কিছু কৃষি ও দুগ্ধজাত পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক বসিয়ে রেখেছে। আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে এই শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানালেও, ভারত তাতে রাজি হয়নি। এর জেরে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে উত্তেজনা বাড়ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি (বিটিএ) চূড়ান্ত করার জন্য কয়েক বছর ধরে আলোচনা চলছে। দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে বাণিজ্যের পরিমাণ কমবেশি ১৯০ বিলিয়ন ডলার। উভয় দেশই ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। তবে, এই লক্ষ্যের পথে কৃষি ও দুগ্ধ খাত প্রধান বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। সম্প্রতি, এই বাণিজ্য আলোচনা এক নজিরবিহীন জটে আটকেছে। আগস্ট ২০২৫-এ নয়াদিল্লিতে নির্ধারিত বিটিএ-র ষষ্ঠ দফার আলোচনা হঠাৎ বাতিল হয়। এই টানাপোড়েনের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর করেছে যার মধ্যে ইলেকট্রনিক্স, গাড়ির যন্ত্রাংশ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার অন্যতম। একই সঙ্গে, রাশিয়া থেকে খনিজ তেল আমদানি করার শাস্তিস্বরূপ ভারতের ওপর আরও ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়েছে (মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক)। এই উচ্চ শুল্ক ভারতীয় অতি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ (এমএসএমপি)-এর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং বস্ত্র, ইলেকট্রনিক্স এবং রত্ন-গহনার রপ্তানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

 

দুই মডেলের ভিন্নতা

​২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ‘BL Agritech and Commodity’ সামিটে আমুলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জয়েন মেহতা দুগ্ধপণ্যের ক্ষেত্রে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির (এফটিএ) বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ভারতে দুধের আমদানি শুল্ক কমানো উচিত নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রশ্ন ওঠে, উত্তর আমেরিকার তুলনায় ভারতীয় দুগ্ধজাত পণ্য সস্তা হওয়া সত্ত্বেও কেন আমুল আমাদের দুগ্ধখাতকে মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির (এফটিএ) আওতায় আনতে এত ভয় পাচ্ছে? এক কথায় উত্তর হল, দুটি দেশের দুগ্ধ উৎপাদনের মডেলের মধ্যে বিস্তর ফারাক।

​ভারতের দুগ্ধখাতের বিশাল সাফল্যের পেছনে রয়েছে ডঃ ভার্গিস কুরিয়েনের “অপারেশন ফ্লাড”, যা ‘আনন্দ মডেল’-এর ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি সমবায়ের মাধ্যমে গ্রামের ক্ষুদ্র চাষিদের (যাঁদের ২-৩টির বেশি গরু নেই) ক্ষমতায়নের ওপর জোর দিয়েছে। এই মডেল গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড। যেখানে ৮ কোটিরও বেশি চাষি প্রতিদিন তাজা দুধ সরবরাহ করে জীবিকানির্বাহ করেন এবং দেশের জিডিপি-তে প্রায় ৫ শতাংশ অবদান করে। এই মডেল মূলত প্রান্তিক চাষি-নিয়ন্ত্রিত ক্ষুদ্র আকারের ঘরোয়া উৎপাদন দ্বারাই পরিচালিত।

​এর ঠিক উল্টো ছবি দেখা যায় মার্কিন দুগ্ধশিল্পে। সেখানে খামারগুলি যান্ত্রিক, কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত এবং বৃহদায়তনের। প্রতি গরুর দুধের ফলন ভারতের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি (বছরে প্রায় ৭,৪০০ লিটার)। উন্নত প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের মোট দুধের প্রায় ৯৪ শতাংশ ব্যবহার করে গুঁড়ো দুধ, পনির, মাখন ও অন্যান্য উচ্চ-মূল্যের দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি করে। এই প্রক্রিয়াজাত দুগ্ধপণ্যের সাহায্যে তারা বিশ্ববাজারে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করে।

 

মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিপদ

​এই তফাত জানার পরও কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, ভারত যদি আসিয়ানভুক্ত দেশগুলির জন্য দুগ্ধবাজার উন্মুক্ত করতে পারে, তবে কেন আমেরিকার জন্য নয়? এর উত্তর হল, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলির দুগ্ধ-উৎপাদনকারীদের এমন ক্ষমতা নেই যা দিয়ে তারা ভারতীয় দুধব্যবসায়ীদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট-পরিচালিত, ভর্তুকিপ্রাপ্ত, বৃহৎ আকারের দুগ্ধ উৎপাদন ব্যবস্থা ভারতের প্রান্তিক চাষি-নিয়ন্ত্রিত দুগ্ধশিল্পকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি অনেক ক্ষেত্রেই উপকারী, কিন্তু দুগ্ধখাতে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা সমান নয়। পশ্চিমি দেশগুলি তাদের দুগ্ধশিল্পকে বাঁচাতে ও বিশ্ববাজার দখলে রাখতে করদাতাদের টাকায় বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দেয়, যা তাদের উৎপাদন খরচ কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেয়। মার্কিন সরকার ২০২৫ সালে সরকারি কৃষি সহায়তা ৯.৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৪২.৪ বিলিয়ন ডলার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু দুগ্ধক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য রয়েছে ডেয়ারি মার্জিন কভারেজ প্রোগ্রাম। দুগ্ধক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির কারণে মার্কিন উৎপাদকরা তাদের পণ্য কম দামে বিশ্ববাজারে বিক্রি করতে পারে।

​বর্তমানে ভারতীয় দুগ্ধপণ্যের ওপর ৩০-৬০ শতাংশ আমদানি শুল্ক থাকায় দেশের বাজারে বিদেশি দুগ্ধপণ্যের দাম বেশি যা দেশীয় দুগ্ধচাষিদের সুরক্ষা দেয়। কিন্তু যদি এই শুল্ক কমানো হয় বা সম্পূর্ণ তুলে নেওয়া হয়, তাহলে বিদেশি দুগ্ধপণ্যের দাম নাটকীয়ভাবে কমে যাবে। এর ফলে বেকারি, হোটেল এবং রেস্টুরেন্টের মতো ফুডসার্ভিসে আমদানিকৃত দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা বাড়বে, কারণ তারা খরচ কমানোর জন্য আমদানিকৃত সস্তা পণ্যের দিকে ঝুঁকবে। এতে স্থানীয় তাজা দুধের চাহিদা কমবে এবং দামও কমে যাবে, যা ভারতের প্রান্তিক দুগ্ধচাষিদের জীবিকাকে সংকটে ফেলবে। কারণ এই কৃষকদের রুটিরুজি প্রতিদিনের দুধ বিক্রির ওপর নির্ভরশীল।

 

কৌশলগত জিএসটি হ্রাস

​ডঃ কুরিয়েনের “অপারেশন ফ্লাড”-এর হাত ধরে ভারতের দুগ্ধখাতে বিশাল সাফল্য এসেছে। কিন্তু দুধের বাজার অবাধে খুলে গেলে গ্রামীণ অর্থনীতি বিপদে পড়বে, স্বনির্ভর দুগ্ধশিল্পের স্বপ্নও শেষ হয়ে যাবে। তাই, ভারতের দুগ্ধজাত পণ্যকে ‘এফটিএ’ থেকে দূরে রাখতে পারলে কয়েক কোটি মানুষের জীবিকা রক্ষা পাবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।

তবে মুক্ত বাণিজ্যের যুগে কোনও দেশই তার কোনও ক্ষেত্রকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখতে পারে না। তাই ভারতকে তার দুগ্ধক্ষেত্রের বাজার উন্মুক্ত করার জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। সেই কথা মাথায় রেখে দেশের সরকারের নতুন পদক্ষেপ দুগ্ধখাতে জিএসটি কমানো। এটি শুধুই কর সংস্কার নয়, বরং একটি কৌশলগত পদক্ষেপ, যার উদ্দেশ্য হল দুগ্ধখাতকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করা।

 

প্রতিযোগিতা তৈরি

​জিএসটি কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ থেকে বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য যেমন ইউএইচটি দুধ, পনির, মাখন, চিজ এবং আইসক্রিমের ওপর থেকে জিএসটি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। এর ফলে পুরো সরবরাহ শৃঙ্খল জুড়ে উৎপাদন ব্যয় কমবে। ভারতীয় দুগ্ধজাত পণ্য ক্রেতাদের জন্য আরও সাশ্রয়ী হয়ে উঠবে, যার ফলে বাজারে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা বাড়বে। এই বর্ধিত চাহিদা কাঁচা দুধের জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করবে, যেখানে প্রক্রিয়াকারী কোম্পানিগুলো কৃষকদের আরও ভালো দাম দিতে বাধ্য হবে।

​এই সংস্কারগুলো ভারতের দুগ্ধখাতের অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাতেও সহায়ক হবে। এটি একদিকে দুধের দামের প্রতিযোগিতা বাড়াবে এবং অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ দক্ষতা বৃদ্ধি করবে, যা ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুগ্ধখাতের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে দেবে। কম করের কারণে ভারতীয় দুগ্ধজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে, এবং ভর্তুকিপ্রাপ্ত মার্কিন পণ্যের দামের সঙ্গে সমানে পাল্লা দেবে। একইসঙ্গে, কর কমার ফলে দুগ্ধপ্রক্রিয়াকারীদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে। কর ছাড়ের এই অতিরিক্ত অর্থ তাঁরা পশুখাদ্য, উন্নত প্রজনন এবং পশুচিকিৎসা পরিষেবা খাতে বিনিয়োগ করবে, এটি ক্ষুদ্র দুগ্ধচাষিদের উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। এর ফলে পণ্যের সহজলভ্যতা এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা উভয়ই বাড়বে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।

​সংক্ষেপে, ভারত এখন শুধু উচ্চ আমদানি শুল্কের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং দুগ্ধশিল্পের অভ্যন্তরীণ ভিত্তিকেই মজবুত করছে। এই কৌশলটি সুরক্ষাবাদ থেকে সরে এসে একটি শক্তিশালী ও স্বনির্ভর দুগ্ধশিল্প গড়ে তোলার উপর জোর দিচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম।

 

স্থায়ী সমাধানের উপায়

​দুধের বাজারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতা সমানে সমানে টক্কর দিতে হলে, জিএসটি কমানোর পাশাপাশি আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, যা হল:

  • ভারতের উচিত আন্তর্জাতিক ফোরামে (ডবলুটিও) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক দুগ্ধ-ভর্তুকি নিয়ে প্রশ্ন তোলা। যদি মার্কিন সরকার ভর্তুকি কমায়, তবে বিশ্ববাজারে তাদের পণ্যের দাম স্বাভাবিক হবে এবং ভারতীয় শিল্পগুলির জন্য প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
  • ভারত রাতারাতি মার্কিন দুগ্ধপণ্যে শুল্ক না কমিয়ে, ৫-১০ বছর সময় ধরে ধাপে ধাপে কমানোর প্রস্তাব দিতে পারে। ততদিনে ভারতীয় দুগ্ধশিল্প নিজেদের আধুনিকীকরণ ও উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হতে পারবে।
  • ​নির্দিষ্ট পরিমাণ দুগ্ধজাত পণ্য কম শুল্কে আমদানি করা যাবে, কিন্তু সেই সীমা ছাড়ালে উচ্চ শুল্ক বহাল থাকবে। এতে দেশীয় শিল্প ‘ডাম্পিং’-এর ধাক্কা থেকে রক্ষা পাবে।
  • ভারত সরকারের উচিত দুধের ক্ষেত্রে সমবায় মডেলকে আরও শক্তিশালী করতে প্রযুক্তিগত সহায়তা, উন্নত জাতের পশু ও আধুনিক প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করা। এটি দীর্ঘমেয়াদে ভারতীয় দুগ্ধখাতকে অভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালী ও আন্তর্জাতিকভাবে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে।

এই সমাধানগুলো বাস্তবায়ন সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন গভীর রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ এবং কূটনৈতিক আলোচনা। তবে এই পথ ধরে এগোলে ভারত তার গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড, অর্থাৎ দুগ্ধখাত এবং তাতে যুক্ত ক্ষুদ্র দুগ্ধচাষিদের জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে— তা জোর দিয়ে বলাই যায়।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...