অরণ্যকন্যা সোনালি

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 

কাজিরাঙ্গা— বিপন্ন একশৃঙ্গ গণ্ডারের অন্যতম বাসভূমি। সম্প্রতি এই জাতীয় উদ্যান আবারও আলোচনায় এসেছে, কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের ফিল্ড ডিরেক্টর ডঃ সোনালি ঘোষের অসাধারণ কর্মকাণ্ডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সূত্র ধরে। সোনালি ঘোষ হলেন WCPA–Kenton Miller Award প্রাপক প্রথম ভারতীয়।

পৃথিবীজুড়ে প্রকৃতি, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (সংক্ষেপে IUCN)-এর গুরুত্ব অপরিসীম। গত ১০ অক্টোবর আবুধাবিতে ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন কংগ্রেস-এর অধিবেশন মঞ্চ থেকে এই ঘোষণা করা হয়। ওয়ার্ল্ড কমিশন অন প্রোটেক্টেড এরিয়াজ (WCPA) হল একটি বৈশ্বিক সংস্থা, যাঁরা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত আধিকারিকদের উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি হিসেবে এই বিশেষ পুরস্কারে সম্মানিত করেন। এ বছর ভারতের বনকন্যা সোনালি ঘোষ হলেন সেই বিরল সম্মানের অধিকারী। IUCN-এর প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল এবং অগ্রণী সংরক্ষণবাদী ডঃ কেন্টন আর মিলার-এর স্মৃতিকে স্মরণে রেখেই এই পুরস্কার প্রদান করা হয়।

বঙ্গদুহিতা সোনালির পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গৌরবময় পরম্পরার ইতিহাস। ছোটবেলা থেকেই খোলামেলা প্রকৃতির মাঝে বড় হয়েছেন তিনি। ক্যান্টনমেন্ট এলাকার নিরিবিলি, শান্ত পরিবেশে থাকার সুবাদে বন ও বন্যপ্রাণীর সঙ্গে এক নিবিড়, ঐকান্তিক সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ সোনালি ছোটবেলা থেকেই পেয়েছেন। ২০১৫ সালে স্যাংচুয়ারি নেচার ফাউন্ডেশন-এর এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন—

সেনানী পরিবারের সদস্যা হিসেবে আমি অন্যদের তুলনায় অনেক খোলামেলা পরিবেশে বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। ক্যান্টনমেন্টের সুরক্ষিত পরিবেশ আমাকে ঘরের বাইরের মুক্ত, উদার প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানোর সুযোগ করে দিয়েছে। প্রকৃতিপ্রেমিক হয়ে ওঠার পেছনে আমার একান্ত মেয়েবেলার বড় ভূমিকা রয়েছে। তবে প্রকৃতির অপার রহস্যময়তার মধ্যে নিজেকে একাত্ম করার সুযোগ এল এমএসসি পড়ার সময়, ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া-য় হাতে-কলমে কাজ করার পর্বে। মাঠে-ময়দানে না নেমে কি প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জন্মায়! এই পর্বের কাজকর্মই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।

কৃতী ছাত্রী সোনালি ২০০০-২০০৩ সালের ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস ব্যাচের সেরা ক্যাডেট হিসেবে ফরেস্ট্রি ও ওয়াইল্ডলাইফ নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ন্যাশনাল ল স্কুল থেকে অর্জন করেন এনভায়রনমেন্টাল আইন বিষয়ে বিশেষ ডিপ্লোমা। এর পাশাপাশি সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট নিয়েও পাঠ গ্রহণ করেন তিনি। এই সব ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা অর্জনের মাধ্যমে সোনালি তিলতিল করে নিজেকে পরবর্তী কর্মজীবনের জন্য ধৈর্য ধরে গড়ে তুলেছেন। আজকের এই সফলতা তাঁর সেই নিমগ্ন প্রস্তুতিরই ফসল।

একজন সফল বনপালিকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পথে তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস ছিল আবদ্ধ পরিবেশে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা ক্লাউডেড লেপার্ড শাবকদের পুনরায় তাদের প্রাকৃতিক বিচরণক্ষেত্রে ফিরিয়ে দেওয়া। বন্যেরা বনে সুন্দর— এই আপ্তবাক্য স্মরণে রেখেই সোনালির এমন সাহসী উদ্যোগ, যা পরবর্তীতে প্রাণীসম্পদ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দেয়। এই প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত— বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণে প্রচলিত ক্যাপটিভ ব্রিডিং ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। দেশের জু গার্ডেনগুলোকে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজে আরও সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করতে হবে। স্বাভাবিক আরণ্যক পরিবেশেই প্রাণীদের প্রজননের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আর এই কাজে আমরা তখনই সফল হব, যখন অরণ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভারসাম্যকে শতভাগ নিরাপদ রাখতে পারব। সোনালির বিশ্বাস, অভিজ্ঞ পশুরক্ষক ও পশুচিকিৎসকের সহায়তায় এভাবে বন্যপ্রাণীর প্রজননের মাধ্যমে সংরক্ষণ সম্ভব। এই কাজে সফলতা ও ব্যর্থতা— দুই-ই আসতে পারে, তবে হাল ছাড়া চলবে না।

সোনালি কখনওই আধিকারিকের নিয়মতান্ত্রিকতায় নিজেকে আটকে রাখতে চাননি; বরং নিত্যনতুন ভাবনা ও কর্মে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেই ভালোবাসেন তিনি। কাজিরাঙ্গা কেবল তাঁর কর্মক্ষেত্র নয়, এই বনাঞ্চলই তাঁর গবেষণার পীঠভূমি। বন্যপ্রাণীদের কাছে বনভূমি হল পরমাকাঙ্ক্ষিত আশ্রয়। তাই সোনালি বিশ্বাস করেন, আহত বা অসুস্থ পশুদের চিকিৎসার পর তাদের বনে ফিরিয়ে দেওয়াই উচিত— তবে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলার পরই। এ জন্য বনদপ্তরের অধীনে পশুচিকিৎসার সর্বাধুনিক উপকরণ-সহ একদল সুসংগঠিত ভেটেরিনারি চিকিৎসকদলকে সবসময় প্রস্তুত রাখতে হবে।

অরণ্যেও বন্যপ্রাণীরা সুরক্ষিত নয়। চোরাশিকারিদের পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হয়েছে অত্যুৎসাহী পর্যটকেরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও অনেক বন্যপ্রাণী বিপর্যয়ের মুখে পড়ে বিপন্নতার শিকার হয়। এদের উপযুক্ত সময়ে উদ্ধার করে সেবা-শুশ্রূষার মাধ্যমে সুস্থ করে তুলে, আবার তাদের প্রাকৃতিক বিচরণক্ষেত্রে ফিরিয়ে দেওয়া এক বড় চ্যালেঞ্জ। এই ব্যবস্থা কায়েম করা জরুরি, কারণ এটি আধুনিক অরণ্য সংরক্ষণের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অনিবার্য। নতুন ব্যবস্থা কায়েম করতে প্রয়োজন আধুনিক, গতিশীল মনোভাবের মানুষের। সোনালি তাঁর নবীন মন ও চিন্তা নিয়ে আরও বহুদূর পথ পাড়ি দেবেন— এই আশাই করছি আমরা সবাই।

এই মুহূর্তে পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে অজস্র শুভেচ্ছাবার্তা এসে ভরিয়ে দিচ্ছে সোনালির মেলবক্স। আমরাও আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানালাম তাঁকে।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. এমন ব্যক্তিত্বদের কথা আরও বেশি করে আলোচনায় উঠে আসুক। সরকারি নিয়মবিধির মধ্যে থেকেও এঁরা অনন্যা হয়ে উঠতে পারেন। লেখককেও ধন্যবাদ জানাই এমন সব মানুষীদের কথা ধারাবাহিক ভাবে প্ল্যাটফর্মের পাতায় তুলে আনার জন্য।

  2. লেখক এর লেখনীর মাধ্যমেই ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলির কথা জানতে পারি। অসংখ্য ধন্যবাদ।

  3. আমাদের দুর্ভাগ্য যে এমন সব কৃতীদের নিয়ে সাধারণ্যে তেমন আলোচনা হয় না। চলতি সংবাদ মাধ্যমগুলো এই বিষয়ে আলোকপাত করতে কুণ্ঠিত। একাজে আমাদের এগিয়ে আসা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

Leave a Reply to Soumen Roy Cancel reply