চাদর

চাদর -- আনসারউদ্দিন

আনসারউদ্দিন

 

 

মাঝে মাঝে এমন কতগুলো প্রাকৃতিক ব্যাপার ঘটে যায়, যার কোনও তুলনা হয় না। যেমন, বেশ কয়েক বছর আগে যে প্রচণ্ড খরা হয়েছিল, তা নাকি সরকারি হিসেব অনুযায়ী পঞ্চাশ বছরে হয়নি। দু হাজার সালের প্রচণ্ড বর্ষণকে চিহ্নিত করা হল একশো বছরের রেকর্ড। আর এমন বর্ষণে বন্যা কেমন হতে পারে তা কাউকে বুঝিয়ে বলতে যাওয়া মানে দারুণ বোকামি। এর ঠিক দুবছর পরে যে শীত, অভূতপূর্ব। আমি জোয়ান-যুবক থেকে শুরু করে গাঁয়ের বুড়ো-হাবরা লোকেদের জনে জনে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা এমন শীত কখনও দেখেছে কিনা। তারা প্রত্যেকে মাথা নেড়েছে। গাঁয়ের সবথেকে প্রাচীন মানুষটিকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ কালীপদর মা। বিলাসীবুড়ি। কমবেশি একশো বছর বয়স। শীত গ্রীষ্ম বর্ষার প্রকোপে প্রকোপে থ্যাঁতলানো শরীর। একটা ঘুপচি ঘরে দেহের হাড়হাড্ডি আগলে বসে আছে। দাঁত নেই, চুল উঠে গিয়ে মাথাটা কতবেল। শ্রবণশক্তি হারানোয় আমার প্রশ্ন তাকে পৌঁছে দিতে পারিনি। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি। মুখের আকার অবিকল ব্যাঙের মতো। বার বার বাড়ির লোকজনদের উদ্দেশ্যে বলছিল— আমাকে লেপ দে, নয়তো চিতায় দে।

বিলাসীবুড়ির বিলাপে সে দিন সত্যিই চমকে উঠেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম শীতের তীব্রতা কত অসহনীয় হলে মানুষ লেপের বিকল্প চিতা ভাবতে পারে। আমার এ যাবৎকালের অভিজ্ঞতার নিরিখে গতবারের শীতকে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক মনে হয়েছে। হ্যাঁ গতবারের শীত। সেই শীতেই বিলাসীবুড়ি চিতায় উঠেছিল এটাও সত্যি।

আমাদের বাড়ি একেবারে গাঁয়ের উত্তরে। এর পর আর কোনও বাড়ি নেই। কেবল ধেনো জমি। এই জমি গড়াতে গড়াতে কমলিখালি বিলের জলে সেঁদিয়ে গেছে। যতসব বাড়ি গাঁয়ের দখিনে। ও-পাড়ার মানুষজন গরমকালে দখিনের মৃদুমন্দ বাতাসে স্বস্তি পায়। আমাদের নসিবে তা কখনও হয়ে ওঠেনি। ওদের শ্বাস-প্রশ্বাসের এঁটোকে দখিনের মিঠে বাতাস ভেবে ভ্যাপসা গরমে দগ্ধ হয়েছি কেবল। অবশ্য শীতকালে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। উত্তর থেকে দখিনে৷ গাঁয়ের উত্তরে বাড়ি বলে শীতের স্পর্শ আমরাই প্রথম টের পাই। গতবারের শীত যে এতটাই তীব্র হতে পারে তা হয়তো টের পেয়েছিল খাজুরি গাঁয়ের ‘ভাষা সংস্কৃতি’-র সংগঠকেরা। ওরা আমাকে গ্রামীণ গল্পকার হিসাবে একটা চাদর দিয়ে সম্মানিত করেছিল। তখন অবশ্য তেমন শীত পড়েনি৷ সবে কার্তিক মাস। সকালে ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশির জমতে দেখি। সূর্য উঠলেই সেইসব শিশিরবিন্দু ক্রমাগত মূর্চ্ছা যায়।

এভাবেই একের পর এক দিন বদল হয়। লক্ষ-কোটি শিশিরবিন্দুর খেলা দেখতে দেখতে শীত আসে। আমরা সংসারে চারটি প্রাণী৷ দু হাজার সালের বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে তার টাল এখনও সামলাতে পারিনি। পুরনো লেপ-কাঁথার যা দৃশ্য, মনে হয় শেয়ালে-কুকুরে খাবলে খেয়েছে। সকালবেলা বিছানা ছাড়লে দুই ছেলে মাথায় গুচ্ছেক তুলো নিয়ে ওঠে। বন্যায় মাটির বাড়ির ধ্বংসস্তূপের উপর দরমার বেড়ার ঘর। পুরনো টালির ছাউনি। উত্তরের হিমেল বাতাস কাতরাতে কাতরাতে বেড়ার গায়ে গা ঘষটায়। বেড়ার সূচিছিদ্র ফাঁক দিয়ে সেই হিমেল বাতাস রাতে ঘরের ভিতর নিঃশ্বাস নেয়। এতে শীতের মাত্রা বেড়ে যায় আরও। লেপ-কাঁথা-বালিশ এত ঠান্ডা হয়ে যায় যে, মনে হয় গায়ের উপর কেউ জল ঢেলে দিয়েছে। আমার বড় ছেলে দোলাবীরের আবার সর্দিকাশির ধাত। বেচারি কাশতে থাকলে বাপ-মা বলারও ফুরসত পায় না। শহরের ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, রক্ত পরীক্ষা করাবেন। কাশিটা কমে গিয়েছিল বলে ওসব আর করানো হয়নি। আমাদের সংসারে যা অভাব তাতে রোগের-দায়ে রক্ত পরীক্ষা দুরূহ ব্যাপার। ওই রক্ত পরীক্ষার টাকা বাঁচিয়ে সে বার বটতলার হাট থেকে দুই ছেলের জন্য সস্তার সোয়েটার কিনে এনেছিলাম। তার ছটা আমাদের ঘরে এসে পড়লে মনে হত, আগুন ঝলসে উঠেছে। নতুন সোয়েটার পেয়ে দু ভাই যদি সারাদিন গায়ে ঝুলিয়ে ময়লা ধরায় তার জন্য আমি কী করতে পারি? সুশীলা কলপাড়ে কাচতে কাচতে কঁকিয়ে উঠলে— টাকা দিয়ে এ কী নিয়ে এসেছ, অ্যাঁ!

বললাম, ও সব তো আমি গায়ে দিইনি। যারা দিয়েছে তাদের বল।

আহা, সে কথা কে বলছে। কাচতে গিয়ে তো মনে হচ্ছে, ফোরাত নদীর কূলে কারবালার যুদ্ধ দেখছি।

কারবালার যুদ্ধ, ফোরাত নদী! এ তো মধ্যযুগের ইতিহাস। দামাস্কাসের শাসনকর্তা মোয়ারিয়ার পুত্র এজিদের সঙ্গে হজরত মহম্মদের দৌহিত্র ইমাম হোসেনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ওই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মহরম। মীর মোশারফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’-তে এর পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা পড়েছি। কলপাড়ে গিয়ে সত্যি চমকে উঠেছিলাম। গোটা কলপাড় জুড়ে লাল রং নয়, যেন রক্তে ভেসে যাচ্ছে৷ সুশীলার হাত দুটো খপ করে চেপে ধরে কাচা-কাচিতে বাধা দিয়েছিলাম। আমার কেন জানি মনে হয়েছিল, ছেলে দুটোকে এই শীতের সকালে কোরবানি দিয়ে ফেলেছি।

ছোটবেলায় শীতকালে আগুন পোহানো নিত্যিকার উৎসবের মতো ছিল। গাঁয়ের সব বাড়িতেই আগুনের কুণ্ডলী জ্বলে উঠত। তখন গাঁয়ের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। চাদর তো চাদর, সামান্য গায়ের গেঞ্জিও জুটত না সকলের। আমাদের বাড়ির সামনে ছিল আম-কাঁঠাল-বাঁশবন। সকালে যখন শীতে কাঁপতে থাকতাম, তখন ওইসব গাছ-গাছালি আমাদের অসহায় অবস্থার কথা ভেবে বার বার তাদের শুকনো পাতা ঝরিয়ে দিত। আমরা বাল-বাচ্চার দল ওই শুকনো পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতাম। আমরা ক ভাইবোন বাবা-মা সমেত বাড়ির প্রত্যেকে বৃত্ত রচনা করে বসে যেতাম। আগুন যত নিভে আসত তত আমরা পরস্পরের কাছাকাছি আসতাম। তার পর এক সময় মৃত আগুনের কুণ্ডলী সামনে রেখে সমস্ত মাথাগুলো এক হয়ে যেত। গভীর নিবিষ্টতায় বসে থাকতে থাকতে আগুনের শেষ স্ফুলিঙ্গের কাছ থেকে বাঁচার মন্ত্র নিয়ে একে একে উঠে আসতাম।

এখন অবশ্য সময় পালটেছে। শাল, সোয়েটার, জ্যাকেট এসব আরামদায়ক শীতের পোশাক অনেকের গায়ের ওপর চড়ে বসেছে। আমার দুর্ভাগ্য, পরিবারের কারও জন্য তেমন শীতের পোশাক জোগাড় করতে পারিনি। ছেলেদুটোকে বার বার বলেছি— অ্যাই দোলাবীর মহাবীর এখন উঠিস না। ঠান্ডা লাগবে, সর্দিকাশি হবে। শীতের সকালে প্রতিদিন আমার একই কথা মান্য করতে করতে বোধহয় ওদের শিরদাঁড়ায় ব্যথা হয়ে গেছে। বিছানায় অনেকক্ষণ ধরে কাতরাতে কাতরাতে উঠে বসেছে। ওদের গায়ে গতবারের লাল সোয়েটার। লাল নয়, এক বছরের কাচাকাচিতে সমস্ত রং উঠে গিয়ে যাচ্ছেতাই ফ্যাকাসে। শীতের কামড় খেয়ে ঘন ঘন কেঁপে উঠছে ওরা। ওদের উন্মুক্ত হাত ও পায়ের লোমগুলো হিমেল বাতাসকে খুঁচিয়ে দূরে সরাতে চাইছিল, না শীতের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে উড়ে পালাতে চাইছিল, কে জানে! আমি ওদের অসহায় অবস্থা না দেখার ভান করে বাইরে তাকাই। শিশির সিক্ত ফাঁকা উঠোন। এক পাশে ডাঁই করা পোয়ালগাদা, পাটকাঠির গাদা। ওগুলো সম্বচ্ছরের জ্বালানি হিসাবে কাজে লাগবে। ইচ্ছে হল, দেশলাই জ্বেলে আগুনের কুণ্ড করি। কিন্তু ভয়, আমাদের বাড়ি গাঁয়ের উত্তরে, আগুন জ্বাললেই তার সাদা-কালো ধোঁয়ার বিস্তার উত্তরের হিমেল বাতাসের টানে দখিনপাড়া পেরিয়ে আকাশের তলপেট ছুঁয়ে উড়ে যাবে দূরে। সবাই জেনে যাবে উত্তরপাড়ার কোনও এক দুঃস্থ মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে আগুন জ্বেলেছে। এ যে কী কেলেঙ্কারি, কী লজ্জার! আমি আকাশের দিকে তাকাই। দেখি কোনও ধোঁয়ার স্রোত আকাশে উড়ে যাচ্ছে কি না। তেমন দু-পাঁচটা ধোঁয়া আকাশে দেখতে পেলে আমিও উঠোনে আগুন জ্বেলে নিজেকে আড়াল করতে পারতাম। অবশ্য এখন চারপাশে হালকা কুয়াশা। একটু বেলা বাড়লেই সকালের নরম রোদ আমাদের উঠোনে এসে গড়ানি খাবে। সুশীলা আমাকে বলল, ভাষা সংস্কৃতির চাদরটা গায়ে দিলেও তো পারো।

আমার গায়ে সাদা গেঞ্জি। তার উপর একটা হাফ হাতা জামা। শীতে আমিও কাঁপছিলাম। বললাম, চাদরটা ওরা স্মৃতি হিসাবে দিয়েছে। গায়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?

হবে না কেন, গায়ের লোক দেখুক লেখালেখি করে তুমি একটা চাদর পুরস্কার হিসাবে পেয়েছ।

সুশীলার কথামোতাবেক বাক্সের ভেতর থেকে চাদরটা বের করে গায়ে দেওয়া মাত্র বেশ উষ্ণতা অনুভব করলাম। ছেলেদুটোকে কড়কে বললাম, হাবা কাঠের বাবা হয়ে বসে আছিস কেন? পড়াশুনো কর। ওরা সভয়ে আমার পানে তাকিয়ে বই খুলে বসে৷ দোলাবীর কাঁপতে কাঁপতে ‘ভারতের গ্রীষ্ণকালীন জলবায়ু’-র কথা পড়ছিল। মহাবীর মুখস্থ করছিল, ‘একটি গ্রীষ্মের দুপুর’। পরিবেশটা হঠাৎই যেন অন্যরকম হয়ে উঠছিল। আমি একটা আধখ্যাঁচড়া লেখায় মনোযোগী হই। সত্যি বলতে কী, শীতকালে আমার লেখালেখির ব্যাপারে আড়ষ্টতা আসে৷ ঠান্ডায় অসংযত কলমের খোঁচায় লেখার পাতা ক্ষতবিক্ষত হয়ে ওঠে। অগত্যা বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের কবজি চেপে কিছুটা শাসনে আনার চেষ্টা করি। এখন অবশ্য আমার লেখা এগিয়ে চলেছে। একটি চাদরের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে ধাতব কলমে, লেখার পাতায়। হঠাৎ এক ফালি উজ্জ্বল আলোর আভা ঘরের মধ্যে হামলে পড়ে। আমি বাইরে তাকাই। রোদ উঠেছে। দূরে কমলিখালির বিল থেকে উড়ে আসা বাতাসের গায়েও রোদের পরশ। চাদরটা গা থেকে খুলে দোলাবীরের দিকে বাড়িয়ে দিতেই সুশীলা বলে উঠল— ছেলের উপর খুব দরদ দেখাচ্ছ দেখছি!.

–হ্যাঁ, ওর একটু সর্দিকাশির ধার, বুঝলে?
–এখন দেবে বই কী, রোদ উঠেছে কিনা। গায়ে আর বুঝি সহ্য হচ্ছে না।

সুশীলার শেষ কথাটা শিয়াকুল কাঁটার খোঁচার মতো গাঁয়ে বিঁধল। এটা ঠিক যে, চাদরটা গায়ে দেওয়ার পর অন্যের শীতের আঁচ তেমন অনুভব করতে পারিনি। এই একটা চাদর নিয়ে হয়েছে যত জ্বালা। কেন যে ওরা আমাকে এটা দিতে গেল! এর চেয়ে ওরা অন্য কিছু দিতে পারত।

অন্য কিছু, অন্য কিছু… কী দেবে? ওরা কী করে জানবে, তোমার এই হতচ্ছাড়া সংসারে একটাও চাদর নেই? সুশীলা যেন আমার ভাবনার প্রতিবাদ করে উঠল৷ আমার যে কোনও চাদর নেই তা অন্য কাউকেও জানতে দিইনি। বাইরে কোথাও গেলে সূর্যাস্তের আগে বাড়ি ফেরার তাগিদ অনুভব করি। যে তাগিদে পাখিরা বাসায় ফেরে। সাঁঝরাতে পাড়া থেকে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকতেই দোলাবীর মহাবীর এমনকি সুশীলাও চমকে উঠল। কী ব্যাপার? বললাম— ভয়ানক শীত পড়েছে। বিহারের অনেক জায়গায়, গোটা উত্তর ভারত জুড়ে শৈত্যপ্রবাহ চলছে। এ পর্যন্ত দুশো মানুষ মারা গিয়েছে। টিভির খবর।

আমার কথা শুনে ছেলেদুটো বড় চোখ করে তাকাল। সেই চোখে উদ্বেগ আর ভয় ফুটে বেরিয়ে আসছিল। বললাম— মনে রাখবি, চার ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায় জলের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি হয়। আমাদের এখানে এখন ছয়। পৃথিবীর শীতলতম স্থানের নাম জানা আছে তোদের?

আমার বেয়াড়া কথাবার্তা শুনে সুশীলার বোধহয় মেজাজ খিঁচড়ে গেল। থাক থাক, ছেলেদুটোকে ঘুনশিজাল কিনে দিয়ে দেশ-দুনিয়ার শীতের গল্প আর না-ই বা শোনালে।

আমি প্রতিবাদে অনেক কিছু বলতে পারতাম। ঘরময় একটা নৈঃশব্দ্য। নৈঃশব্দ্যের আলাদা যে শক্তি আছে তাতে আমি অপমানিত হই। এক বছরের পুরনো সোয়েটারের যদি রং উঠে যায়, জ্বলে যায়, তার জন্য কী করার আছে। কথাগুলো অনুচ্চারে বলে সুশীলার দিকে তাকাই। গায়ে সামান্য ব্লাউজ আর পরনের শাড়িতে কুঁকড়ে আছে৷ এই মুহূর্তে ওর প্রতি আমার কোনও মায়া নেই। পুরুষমানুষের মুখের ওপর যেসব মেয়েছেলে কথা বলে তাদের এমন শাস্তিই প্রাপ্য। লম্ফর নিরুত্তাপ আলোয় দোলাবীর মহাবীরের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ওদেরকে বলে উঠি— কাল থেকে আশেপাশের ইস্কুল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকছে৷ সাইবেরিয়ার ঠান্ডা বাতাস উত্তর ভারত পেরিয়ে পশ্চিমবাংলায় ঢুকে পড়েছে এ বার।

রাতে শীতের আঁচ ভীষণভাবে টের পেলাম। বাইরের গাছগাছালির পাতা বেয়ে ঝরঝর করে শিশির ভেঙে পড়ছে। সাইবেরিয়ার বরফ ছুঁয়ে উড়ুক্কু বাতাস যেন সর্বাঙ্গে ক্ষুর চালিয়ে দিচ্ছে৷ প্রতিটি কম্পমান মাংসপেশী খুলে পড়তে চাইছে। এই ভয়েই বুঝি আমরা চার-চারটি প্রাণি নিজের নিজের শরীরে কুঁকড়ে মিশে যেতে চাইছিলাম। হারিয়ে যেতে চাইছিলাম। অথচ গরমকালে এত গরম পড়ে যে, দেহের ছাল-বাকলা খুলে ফেলতে ইচ্ছে করে। কী অদ্ভুত প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য!

শীতকালে সকালের রোদটুকু আমাদের উঠোনে বুঝি ভুল করে এসে পড়ে। এর পর যতই বেলা বাড়ে একটু একটু করে দখিন আকাশের গায়ে গা ঘষতে ঘষতে সূর্যটা হারিয়ে যায়। আমার এক একদিন সকালে মনে হয়, রোদের কানি ধরে উঠোন থেকে উপড়ে ফেলি। গাঁয়ের উত্তরে বাড়ি হওয়া কত যে হাজার চল্লিশ হ্যাপা সে আমি বুঝি। এক চিলতে উঠোনে দিনের বেশিরভাগ সময়েই ছায়া ঘুমিয়ে থাকে। দোলাবীরের আবার নতুন করে নাক হ্যাঁচাচ্ছে৷ মহাবীরের মুখের দুপাশে কষ ফাটতে শুরু করেছে৷ এক গ্রাস ভাত যে বাছা জুতসই মুখে তুলবে সে উপায় নেই। সুশীলা বললে— হ্যাঁ গো, এ কদিন চাদরটা আর গায়ে দিচ্ছ না কেন?

–কী করে দিই? একটা চাদর, চারজন মানুষ আমরা।
–তবুও তো একজনের প্রাণ বাঁচবে।

সুশীলা বলল বটে, তবে অতখানি নিষ্ঠুর আমি এখনও হতে পারিনি। লক্ষ করেছি, গায়ে চাদর জড়ালে দোলাবীর মহাবীর আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। সেই মুহূর্তে আমার বুকের মধ্যে সাঙ্ঘাতিক পীড়ন শুরু হয়। চাদরটা বড় ছেলে দোলাবীরের গায়ে জড়িয়ে দিই। সে তার গন্ধ শোঁকে, ওম নেয়। কৃতজ্ঞতায় দুচোখে উজ্জ্বলতা ফুটে ওঠে। কিছুক্ষণ গায়ে দেওয়ার পর তারও অস্বস্তি হয়। পাশে ছোটভাই মহাবীর ঘন ঘন মাড়ি কাঁপিয়ে কেঁপে উঠছে। দোলাবীর চাদরটা মহাবীরের দিকে এগিয়ে দেয়। মহাবীর গায়ে দিয়ে একবার ঘর, একবার উঠোনে দাঁড়িয়ে চাদরের শীত নিবারণ ক্ষমতা পরখ করতে থাকে। সুশীলা চাদরের আঁচলে হাত বুলোতে বুলোতে বলে— কী রে, খুব ওম?

মহাবীর অনিচ্ছাসত্ত্বেও মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেয় চাদরটা।

সারাদিনে চাদরটা এই ভাবে একের পর এক হাত বদল হয়। আমি ক্রমাগত দেখতে থাকি, আর সাইবেরিয়ার হিমেল বাতাসে কাঁপতে থাকি। সুশীলা খুব অল্প সময়ের জন্য গায়ে দিয়ে আমাকে বলে, নাও।

–না না, গায়ে দাও না তুমি।
–আমি মেয়েমানুষ, আমাকে কি এসবে মানায়? বলে সে আমার দিকে ছুঁড়ে দিল। চার চারটে মানুষের উষ্ণতা পেয়ে চাদরটি যেন অসম্ভব গরম হয়ে উঠেছে। বললাম, আজকের আমার তেমন শীত করছে না। দোলাবীর তুই গায়ে দে।

দোলাবীর এই শীতেও নিজের বুকে ফুঁ দিয়ে, খুব স্বাভাবিক হাত পা নেড়ে বোঝাতে চাইল, চাদরটা গায়ে দিলে তার অস্বস্তি বাড়বে। গরম লাগবে।

দোলাবীর থেকে মহাবীর, সুশীলা ও আমার মধ্যে চাদর ছুঁড়ে দেওয়ার খেলা শুরু হল। আমাদের প্রত্যেকের কাছে চাদরটা যেন অপ্রয়োজনীয়, অসার বস্তু। এই ছোঁড়াছুড়ির মধ্যে অপমানিত লাঞ্ছিত চাদর পড়ে থাকে উঠোনের মাঝে৷ সুশীলা দোলাবীর মহাবীর কেউই সেটা কুড়িয়ে নেওয়ার তাগিদ অনুভব করল না। অবশেষে নিরুপায় আমি ধুলো ঝেড়ে উঠোনের তার ওপর ঝুলিয়ে রাখি। সকালবেলা উঠে দেখি, লাঞ্ছিত সেই চাদরের প্রান্ত বেয়ে সারারাতের শিশির অজস্র কান্না হয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...