একটি আমাজ়়নীয় রূপকথা

অয়নেশ দাস

 

গদ্যকার, কর্মসূত্রে বিজ্ঞাপনজগতে যুক্ত

 

 

 

 

আমরা প্রায় সবাই জানি পৃথিবীর বৃহত্তম নিরক্ষীয় ঘনবর্ষণ অরণ্যখণ্ডটির কী নাম। পৃথিবীর এই জানা শুরু হল যখন ষোড়শ শতকে ঔপনিবেশিক স্পেনীয় ও পর্তুগিজ বাহিনি (Conquistadors)[1], সুবিশাল ঘন অরণ্যবেষ্টিত, অসংখ্য আদিম জনজাতির বাসভূমি এই ভূখণ্ডের দুর্ভেদ্যতার সঙ্গে পরিচিত হয় এবং ক্রমে গ্রিক পুরাণ অবলম্বনে তার নাম হয়ে ওঠে ‘আমাজ়়ন’। সেই থেকে আমাজ়়নের অরণ্য ঘিরে গড়ে উঠেছে সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে সহস্র রোমাঞ্চকর রূপকথা-উপকথা। ষোল হাজার কিলোমিটার দূরে এই আমাদের ছেলেবেলা জুড়েও ছিল সেই আশ্চর্য রূপকথার ঘেরাটোপ। এখনও স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে কোনও মন্থর রক পাইথনের হঠাৎ কুণ্ডলী খুলে যাওয়ার মতো ভেসে ওঠে আদিগন্ত সবুজের বুক চিরে আঁকাবাঁকা এক জাদুবাস্তব রুপোলী জলরেখা। আমাদের এই লেখাটির উপজীব্যও একটি আমাজ়়নীয় রূপকথা। তবে তা আদ্যন্ত সত্যি রূপকথা।

সেই রূপকথার সন্ধানে একবার আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৫২-৫৩ সালের একটি প্রাত্যহিক অতীত-দৃশ্যে। দক্ষিণ-পশ্চিম আমাজ়়নের আক্রে প্রদেশের একটি ছোট্ট জনপদ জ়়াপুরি থেকে বারো-তেরো মাইল অরণ্যের ভিতরে; যেখানে অরণ্য তাকে ঘিরে সমস্ত কিংবদন্তি ছাপিয়ে আরও আদিম ও দুর্ভেদ্য— আমরা যেমন পড়ে-জেনে-শুনে এসেছি— মহাবৃক্ষদের বিস্তার ভেদ করে যেখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না— সেইরকম একটি অবস্থান। তবে সূর্যের আলো প্রবেশ একেবারেই যে করে না তা নয়। গগনচুম্বী রাবার গাছের নিরবিচ্ছিন্ন ডালপালাও ভেদ করে ইতস্তত ঢুকে পড়ে আলোর পেন্সিল। আর সেই তীরের ফলার মত এক আলোকস্তম্ভ থেকে আরেক আলোকস্তম্ভ ছুঁয়ে ধারালো ছুরি হাতে নিপুণ পদক্ষেপে নিরক্ষীয় জোঁকেদের ক্ষিপ্রতা এড়িয়ে এক অকালবৃদ্ধ চক্রপদ[2] প্রৌঢ় তার অষ্টম বর্ষীয় পুত্রকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে কোনও রসালো রাবার গাছের সন্ধানে।

আমাজ়নের রাবার নিষ্কাশন

এই তাদের প্রাত্যহিক কর্ম। একটু পরেই তারা খুঁজে পাবে কোনও রসালো রাবার গাছ। শিল্পীর হাতের কাজের মতোই গাছের বাকলে ফুটে উঠবে ছুরির কাজ। কাণ্ডের অন্তঃস্থল থেকে স্বেদবিন্দুর মতো বেরিয়ে আসবে ধীর রাবারের তরল স্রোত। ছুরি দিয়ে কাণ্ডের গায়ে এঁকে দেওয়া শিরা-উপশিরা বেয়ে টিনের জারিকেনে জমা হবে কয়েক লিটার সাদা দুধের মতো তরল যা হল ল্যাটেক্স। এর পরের ধাপ হল এই রাবারের দুধ জমাট বাঁধানো। তারপর জমাট বাঁধা ল্যাটেক্স নিয়ে পৌঁছতে হবে নদীর ধার ঘেঁষে কোনও সংগ্রহ কেন্দ্রে। সেখানে ফড়ে আর ব্যাপারীর লোকেরা যে দাম ধরিয়ে দেবে তাই নিয়ে ফিরতে হবে বাড়ি। গভীর অরণ্য থেকে ফেরার সময় সৌভাগ্যক্রমে কোনও কোনও দিন টাপির, আর্মাডিলো বা শজারুর মতো শিকার মিলে যায়। ক্ষুধার্ত পরিবার পেয়ে যায় কয়েকদিনের প্রোটিন।

প্রাত্যহিক এই জীবন সংগ্রামের প্রতিটি শিক্ষা নিপুণভাবে শিখে চলেছে সেই অষ্টম বর্ষীয় বালক। আরও অনেক কিছুই শিখে নিতে হবে তাকে এবং অতি দ্রুত। কারণ সে যে রূপকথার জন্ম দিতে চলেছে। রূপকথারা জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে এই গ্রহের বিভিন্ন প্রান্তে। তার আকর ছড়িয়ে থাকে ইতিহাসে— সময়কালের গর্ভে। আর এই আকরের খোঁজে আমাদের পেছিয়ে যেতে হবে আরও একটু পিছনে।

বস্তুত ষোড়শ শতকে যখন থেকে ঔপনিবেশিক দুনিয়ার পা পড়ে আমাজ়়নে তখন থেকেই ৫ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারের (এখন যদিও তা দাঁড়িয়েছে ৩ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটারেরও কমে) বিপুল প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরা এই নিরক্ষীয় ভূখণ্ড সবরকমের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের মুক্ত ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তবুও প্রায় আগের শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরু অবধি ব্রাজ়়িলের ‘আমাজ়়োনিয়া’ মোটামুটি ছিল প্রচলিত নাগরিক সভ্যতা ও উন্নয়নের ধারণা থেকে দূরবর্তী এক আদিম ভূখণ্ড। এখানকার অধিবাসীরা মূলত আমেরিন্ডিয়ান[3] এবং কাবোক্লো[4]। এদের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করত Extractivism বা non-timber বনজ সম্পদের নিষ্কাশন, নদী থেকে মাছ ধরা ও ছোট ছোট ঝুমচাষের ওপর।

উনবিংশ শতকের শেষভাগে আমাজ়নের রাবার নিষ্কাশক

উনবিংশ শতকের শেষভাগে, বিশেষ করে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে ভালকানাইজেশন[5] পদ্ধতির আবিষ্কারের পরে পরেই যখন গোটা পৃথিবীতেই রাবারের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী, তার সঙ্গে তাল রেখে ব্রাজ়়িলের দেশজ রাবার গাছ থেকে উৎকৃষ্ট ‘ল্যাটেক্স’ নিষ্কাশনের ক্ষেত্রটিও লাভজনক হয়ে উঠল। পুরো আমাজ়়োনিয়া জুড়েই, বিশেষত আমাজ়়োনাস, রন্ডোনিয়া ও আক্রে প্রদেশগুলিতে পুঁজিপতিরা ব্যাপকহারে রাবার এস্টেট স্থাপন করতে লাগল। আর উত্তর ব্রাজিলের ব্যাপক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত যে বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্রচাষিরা ক্রমেই উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছিল তারাই হয়ে উঠল এই রাবার এস্টেটগুলির সস্তা শ্রমের ভাণ্ডার। তারাই হয়ে উঠল আমাজ়়নের রাবার নিষ্কাশক (Rubber Tappers) জনগোষ্ঠী।

অন্যদিকে ব্রিটিশ পুঁজি আমাজ়়নের রাবার বীজ নিয়েই তাদের সামগ্রিক রাবার উৎপাদন মালয়ে স্থানান্তরিত করে।[6] ১৯১০-এর পরবর্তীতে এই মালয় রাবারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ব্রাজ়়িলের রাবার অর্থনীতিতে ধস নেমে আসে। একের পর এক এস্টেটের মালিকপক্ষ নিষ্কাশক শ্রমিকদের অন্ধকারের মধ্যে রেখেই এস্টেটগুলিকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। যদিও জমির কোনওরকম মালিকানা রাবার নিষ্কাশকদের ছিল না তবুও অরণ্যের কোনও অনিষ্ট না করে নিজেদের মধ্যে এলাকা ভাগ করে এই অসহায় অবস্থাতেও তারা রাবার নিষ্কাশন চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু পুরো অর্থনীতিটাই এক ধরনের দালালচক্রের হাতে চলে যায়। অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে সামান্য দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্যের বিনিময়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল পরিশোধিত রাবার নদীগুলির বাঁকে বাঁকে অপেক্ষমান ফড়ে ও ভ্রাম্যমান ব্যাপারীদের হাতে তুলে দিতে তারা বাধ্য হয়। বলাই বাহুল্য, দাসত্বের থেকে কোনও অংশে উন্নত ছিল না রাবার নিষ্কাশকদের জীবন।

কিন্তু সীমাহীন দারিদ্র্য, ভয়ঙ্কর অপুষ্টি ও নিয়ত রোগ-ব্যাধির যন্ত্রণা নিয়েও রাবার নিষ্কাশকরা বেঁচে থাকে। এক রূপকথার জন্মের স্বার্থে আমাজ়়োনিয়ার দুর্ভেদ্য কোণগুলিতে তারা বেঁচে থাকে। এই অবর্ণনীয় বাস্তবেই জারিত সেই অতীত দৃশ্য-খণ্ডটির পিতা-পুত্রটিও বেঁচে থাকে, কারণ এখান থেকেই রূপকথার যাত্রা শুরু হয়।

জ়়াপুরির শহর থেকে খানিক দূরে কয়েক ঘর রাবার নিষ্কাশকদের ছোট্ট গ্রাম সেরিংগাল সান্টা ফে-র এক কোণায় ফ্রানসিস্কো মেন্ডেসের একরত্তি কাঠের ঘরে ১৯৪৪ সালের ১৫ই ডিসেম্বর জন্ম নিয়েছিল তার প্রথম সন্তান ফ্রানসিস্কো আলভেজ মেন্ডেস ফিলহো। আমাদের দেখা দৃশ্য-খণ্ডটিতে সেই অষ্টম বর্ষীয় বালকটি, যে পরে হয়ে উঠবে সবার প্রিয় ‘চিকো’ মেন্ডেস, হয়ে উঠবে এক রূপকথার কেন্দ্রীয় চরিত্র। সাত-আট বছরেই যে বাবার হাত ধরে শিখে নিয়েছে গভীর অরণ্যে রসালো রাবার গাছের সন্ধান। শিখে নিয়েছে ছুরির কতটা নিপুণ আঁচড়ে রাবার কাণ্ড থেকে নিষ্কাশিত হতে পারে কতটা তরল রাবার। এমনকি শিখে নিয়েছে সদ্য নিষ্কাশিত রাবার রস শোধন করার পদ্ধতিও।

তবু চিকো আরও অনেক কিছু শিখতে চায়, জানতে চায়। মাথার মধ্যে প্রশ্ন জমে উঠতে থাকে। সে বুঝতে চেষ্টা করে রাবার নিষ্কাশকদের এই অবর্ণনীয় দুরবস্থার আসল কারণগুলি কী। এইভাবে সে বুঝে ফেলে অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে দরিদ্র রাবার নিষ্কাশকদের ওজনে ও হিসাবে কীভাবে ঠকানো হয়। না, কোনওরকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার ছিল না। কেননা রাবার নিষ্কাশকদের জন্য শিক্ষার কোনওরকম উদ্যোগ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এস্টেট মালিকদের ফরমান থেকেই চলে আসছে এই ব্যবস্থা।

মাথার মধ্যে হাজার প্রশ্ন নিয়েই বড় হতে থাকে ‘নিরক্ষর’ চিকো। এই সময়ে এক অসামান্য মানুষের হাত ধরে চিকোর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। জ়়াপুরির এস্টেটে রাবার নিষ্কাশনের কাজে যোগ দেয় বিপ্লবফেরৎ এক কম্যুনিস্ট বিপ্লবী— ইউক্লিডিস ফার্নান্দো তাভোরা।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে গোটা পৃথিবী জুড়ে আদিমতার বিপক্ষে আধুনিকীকরণের একটা বিপুল ঝোঁক দেখা যায়। ব্রাজ়়িলেও ক্ষমতাশীলদের মধ্যে একই ঝোঁক পুরোদস্তুর বজায় ছিল। তখন নয়া উদারবাদী উন্নয়নের ধারণাগুলি ব্রাজ়়িলীয় অর্থনীতির মূলধারায় জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে। সেই নয়া উদারবাদী সংস্কৃতি আমাজ়়নের পরম্পরাগত জনগোষ্ঠীগুলির অস্তিত্বটিকেই যেন হয় চূড়ান্ত অজ্ঞতা নয় তো সরাসরি বৈরিতায় টেনে নিয়ে এল। অ্যান্থনি হলের ভাষায়—

At best they were perceived as vestiges of a bygone age to be tolerated for their exotic value, and at worst as obstacles to modernization who had to be dragged into the twentieth century or, if necessary, eliminated.

এই সংস্কৃতি চূড়ান্ত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে যায় যখন ১৯৬৪ সালে ব্রাজ়়িলে মিলিটারি সরকার ক্ষমতায় আসে। ব্রাজ়়িলের মিলিটারি কলেজ প্রভাবিত অতি-জাতীয়তাবাদী ও সম্প্রসারণবাদী ভাবধারা সহজেই অর্থনীতির কেন্দ্রীভূত ‘Growth Pole’ তত্ত্বটিকে আঁকড়ে ধরে। সরকারি নীতিগুলি সমস্ত স্থানিক অর্থনীতিগুলিকে মূলধারায় মিলিয়ে দেওয়ার অছিলায় আমাজ়়োনিয়ার ভূ-খণ্ডটিতে স্পষ্টতই কতগুলি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে লক্ষ্য স্থির করে। আমাজ়়নের অরণ্য ও অরণ্যসম্পদ তো বটেই, একই সঙ্গে ইন্ডিজেনাস জনজাতিগুলি এবং অরণ্যের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীগুলির ভবিষ্যৎও বিপন্ন হয়ে ওঠে।

একশো ফিট ওপর থেকে চুঁইয়ে নেমে আসা আলোর স্তম্ভে ধাক্কা খেতে খেতে আক্রের বনভূমির এক কোণা থেকে ভেসে আসছে সমাজতন্ত্রের প্রচার। আলো-আঁধারিতে চোখ ধাতস্থ হলে রাবার গাছের ডাল থেকে ঝুলতে থাকা চামড়ার জ্যাকেটে মোড়া পুরনো রেডিও সেটটির ওপর অবধারিতভাবে যে কারও চোখ গিয়ে পড়বে। কিন্তু কী বাজছে তাতে? রেডিও মস্কো। আর রেডিওর দিকে কান খাড়া করে যে আঠারো বছরের যুবকটি একমনে রাবারের রস নিষ্কাশন করে চলেছে, ওই তো চিকো! টিকালো নাকের নীচে ঘন কালো পুরুষ্টু গোঁফজোড়াতে কত বদলে গিয়েছে চিকো। বদলেছে তো আরও অনেক কিছুই!

এখন ফ্রানসিস্কো মেন্ডেসের আর গভীর অরণ্যে যাওয়া হয় না। বয়স তো আর থেমে নেই। তা ছাড়া ক্রমান্বয়ে সতেরোটি সন্তানের জন্ম দিয়ে গৃহিণীও সদ্য গত হয়েছেন। সতেরোটি সন্তানের মধ্যেও মাত্র ছটি বেঁচে রয়েছে যার সবচেয়ে বড়টি হল চিকো। ফলে তাকেই এখন গভীর অরণ্যে গিয়ে রাবার নিষ্কাশনের দায়িত্ব একার ঘাড়ে নিতে হয়েছে। অনেক কিছু বদলালেও হলপ করে বলা যায় একটুও বদলায়নি ফ্রানসিস্কো মেন্ডেসের দারিদ্র এবং একই সঙ্গে রাবার নিষ্কাশকদের দুর্দশার বাস্তব।

কিন্তু সত্যিই অনেক বদলেছে চিকো। আর তাকে বদলে দিয়ে ঠিক যেভাবে এসেছিল পাঁচ বছর পর ঠিক সেইভাবেই উধাও হয়ে গিয়েছে ফেরার বিপ্লবী ইউক্লিডিস ফার্নান্দো তাভোরা। পর্তুগিজ ভাষায় যাকে বলে ‘দেসাপারেসিদো’ (desaparecido) অর্থাৎ উধাও হয়ে যাওয়া মানুষ। আর স্বপ্নদ্রষ্টা তাভোরার এই পাঁচ বছরের জাদুবাস্তব উপস্থিতি চিকোর জীবনে বুনে দিয়ে গিয়েছে হাজার স্বপ্নের রেশম জরি। তার কাছ থেকে চিকো শিখে নিয়েছে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক শিক্ষার যাবতীয় পাঠ। রাতের পর রাত জেগে শুনেছে ইউক্লিডিসের নিজের জীবনের রোমাঞ্চকর আখ্যান। ১৯৩৫ সালের ব্যর্থ কম্যুনিস্ট বিপ্লবের কথা। ফার্নান্দো দি নোরোন্‌হা দ্বীপের[7] বন্দিত্ব থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরে পারা-য় তার গেরিলা জীবনের কথা। আবার বলিভিয়ায় টিনের খনি মজদুরদের ধর্মঘট সংগঠিত করা এবং সেখান থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে এই আক্রের অরণ্যে রাবার নিষ্কাশনের কাজ নেওয়া। এই আশ্চর্য ব্যক্তিগত আখ্যানের সঙ্গে সঙ্গে চিকো গভীরভাবে পরিচিত হয়েছে ব্রাজ়়িলের ইতিহাসের সঙ্গে। এমনকি পরিচিত হয়েছে মার্ক্স ও লেনিনের ভাবধারার সঙ্গেও। ইউক্লিডিস ফার্নান্দো তাভোরা হারিয়ে গেলেও তার স্মৃতি বেঁচে আছে যাওয়ার আগে চিকোকে উপহার দেওয়া চকচকে কালো চামড়ার জ্যাকেটে মোড়া রেডিওখানিতে। বেঁচে আছে চিকোর ভাবনায়, তৈরি হওয়া মননে, ভবিষ্যতের রাজনীতিতে।

কয়েক বছর পর। ১৯৭৭। তাভোরার অনুপ্রেরণায় চিকো গড়ে ফেলল রাবার নিষ্কাশকদের নিজস্ব শ্রমিক ইউনিয়ন, তাদের নিয়ে নিজস্ব সমবায়— প্রোজেতো সেরিংগেরো, যা গত একশো বছরের রাবার নিষ্কাশকদের ইতিহাসে কল্পনা করাও দুঃসাধ্য ছিল।

লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিল। কারণ রূপকথা ততদিনে বাড়তে শুরু করেছে। ফলে রাবার নিষ্কাশকদের দুরবস্থা বদলানোর ছোট ছোট সম্ভাবনা ভেতর থেকেই তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু একদিন যখন আক্রে-র জঙ্গল থেকে ভেসে আসা রেডিও মস্কো-র আওয়াজ কর্কশ যান্ত্রিক করাত, বুলডোজার আর মুহুর্মুহু ভারী বৃক্ষপতনের শব্দে চাপা পড়ে গেল তখন বোঝা গেল যে এবার কিছু নতুন ও আরও মারাত্মক আঘাতের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে এইবার আমাজ়়নের অরণ্যবাসীদের।

সত্তরের দশকের শুরুর বছরগুলিকে ধরা হয় ব্রাজ়়িলের অর্থনৈতিক মির‍্যাকলের বছর হিসাবে। একের পর এক উন্নয়নের নীতি ধেয়ে আসতে লাগল আমাজ়়নকে ঘিরে। এই বৃহৎ ভূ-খণ্ডের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বহুগুণে বর্ধিত রপ্তানি মূল্যের লক্ষ্যে বৃহৎ বাণিজ্যিক লাইভস্টক, লগিং, মাইনিং ও বাণিজ্যিক কৃষিকে আমাজ়়োনিয়ায় অবাধ করে দেওয়া হল। রাবার নিষ্কাশনের মতো তথাকথিত আদিম প্রযুক্তিকে রাষ্ট্র সময়ের অসঙ্গতি মাত্র হিসেবে ধরে নিল। ফলে রাবার নিষ্কাশন, বাদাম কুড়ানো, নদীর ওপর নির্ভরশীল জীবিকাগুলি নীতি-নির্ধারকদের কাছে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ল। বরং আমাজ়়োনিয়ার বিপুল অরণ্য সম্পদ ও ভূগর্ভস্থ সম্পদ খুলে দেওয়া হল আধুনিক ক্ষেত্রগুলির হাতে।

সরকার থেকে অপর্যাপ্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হল বৃহৎ পুঁজিপতিদের দিকে, বিশেষত দক্ষিণ ব্রাজ়়িলের সেইসব রাজনৈতিক জোটবদ্ধ সংস্থাগুলির প্রতি। একইভাবে হাত বাড়িয়ে দেওয়া হল বিদেশি বিভিন্ন বৃহৎ কর্পোরেশনগুলির প্রতিও। যেমন— ফোক্‌স্‌ভাগেন। সরকারের এই হাত কীরকম বাড়ানো ছিল তা বোঝা যাবে একটি উদাহরণ দিলে। ১৯৭১ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত আমাজ়়োনিয়ার বাণিজ্যিক গো-পালকদের (Cattle ranchers) কাছ থেকে প্রাপ্য ৫ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের পাহাড়প্রতিম বকেয়া সরকার এক লপ্তে মকুব করে দিয়েছিল। এছাড়াও ‘Greater Carajás program’-এর নামে বিপুল সরকারি ভর্তুকি প্রযুক্ত হয়েছিল আয়রন ওর, বক্সাইট মাইনিং সংস্থাগুলিকে উৎসাহিত করার জন্য।

অন্যদিকে এক বিপুল জনসংখ্যাকে ব্রাজ়়িল সরকার আমাজ়়নের অভ্যন্তরে পুনর্বাসিত করতে চাইল। উত্তর-পূর্ব ব্রাজ়়িলে বিশাল এক জনসংখ্যা উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছিল বাড়তে থাকা বাণিজ্যিক গো-পালনের জন্য। এস্টেট মালিকদের সঙ্গে কৃষিজীবী যারা জমি হারিয়েছিল তাদের সংঘর্ষ আর এড়ানো সম্ভব হচ্ছিল না। অন্যদিকে দক্ষিণ ব্রাজ়়িলে রপ্তানির জন্য কর্পোরেট বীজ দিয়ে বৃহদাকার যান্ত্রিক পদ্ধতিতে গম ও সোয়ার চাষ শুরু হলে তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বিশাল সংখ্যায় ক্ষুদ্রচাষিরা কর্মচ্যুত এবং ভূমিহীন হয়ে পড়ল। তখন ট্রান্স-আমাজ়়ন হাইওয়ে[8] প্রস্তুত। ব্রাজ়়িল সরকার এই সমস্ত জনসংখ্যাটিকে এই হাইওয়ে সংলগ্ন এলাকাগুলিতে এবং রন্ডোনিয়ায় ‘Polonoroeste program’ নামে ওয়র্ল্ড ব্যাঙ্কের পৃষ্ঠপোষকতায় নেওয়া একটি সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে চালান করে দিতে চাইল।

আমাজ়নে অরণ্যনিধন

এর পরে বিপুল হারে অরণ্য নিধন শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল। সরকারি হিসেবমতো ১৯৭০ সালে যেখানে অরণ্য বিনাশের পরিমাণ ছিল মাত্র ২.৪ শতাংশ, ১৯৯৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১০ শতাংশেরও বেশিতে। এছাড়াও অরণ্যের বিশাল অংশ ছোট ছোট টুকরো বা প্যাচ-এ পরিণত হওয়ার ফলে সংলগ্ন বাস্তুতন্ত্রের উপযোগী অবস্থা না পাওয়ায় বিপুল জীববৈচিত্র্যের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠল। মোটামুটিভাবে এটা স্বীকৃত যে বাণিজ্যিক গো-পালন সরাসরি ৬০ শতাংশ অরণ্যনিধনের জন্য দায়ী। ছোট জোতের চাষ ৩০ শতাংশ এবং লগিং ও মাইনিং বাকি ১০ শতাংশ অরণ্যনিধনের জন্য দায়ী। তাছাড়া আমাজ়়োনিয়ার নরম মাটি দীর্ঘকাল ধরে ভালো মানের চারণভূমির অনুপযুক্ত ছিল। ফলে গো-পালনের ক্ষেত্রে অরণ্যনিধন এক অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ায় এসে দাঁড়িয়েছিল। আর তাই ইন্ডিয়ান জনজাতি, রাবার নিষ্কাশক, বাদাম-কুড়ানি ইত্যাদি আমাজ়়নের অভ্যন্তরের জনগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক গো-পালকদের সোজাসুজি সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল।

ষাট-সত্তর দশকের ব্রাজ়়িলের পরিস্থিতির সঙ্গে নয়ের দশকোত্তর ভারতবর্ষের পরিস্থিতির কী অদ্ভুত মিল। পাতাগুলির রং এখানে ওখানে একটু-আধটু আলাদা হলেও আসলে বই একটাই। শুধু দুটো দশকের এদিক ওদিক। যদিও সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে কর্পোরেট কৃষির সঙ্গে ভারতীয় চাষিদের পরিচয়ের সৌভাগ্য প্রায় একই সময়ে ঘটেছিল! যাই হোক, ব্রাজ়়িলের কথায় ফেরা যাক।

নয়া উদারবাদী ক্ষমতাচক্র পরিবেশ বাস্তুতন্ত্র রক্ষার সামান্যতম দায়ও স্বীকার করে না। সঙ্গে সঙ্গে আমাজ়়োনিয়ার মতো বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ভূ-খণ্ডগুলিতে মানুষের হাজার হাজার বছরের অঙ্গাঙ্গী বসবাসের ইতিহাসকেও অস্বীকার করে। এটাই উন্মুক্ত লুণ্ঠনের ব্যবস্থাপনা।

আবার অপরদিকে, সেই সময়ের পরিবেশ সংরক্ষণবাদীরাও এই চলমান ইতিহাস স্বীকার করে নিতে পারেননি। প্রাকৃতিক অরণ্যের নৃতাত্বিক অস্তিত্বটিকে তারা জানা-বোঝার বাইরে রেখেছিলেন। নিখাদ প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রে মানুষের যেকোনওরকম উপস্থিতি তাঁরা ক্ষতিকর অতএব পরিত্যাজ্য বলে মনে করে এসেছেন। পৃথিবীব্যাপী ন্যাশনাল পার্ক, সংরক্ষণ কেন্দ্রগুলি কতকটা এই ধারণাকে ঘিরেই পরিচালিত হয়।

১৯৬০-৭০ সালে ব্রাজ়়িলের যাবতীয় সংরক্ষণ নীতিও এর বাইরে ছিল না। আইন ছিল শুধুমাত্র নির্বাচিত সংরক্ষণ ক্ষেত্রগুলির সুরক্ষার প্রশ্নে যেখানে মানুষের বসবাস হয় একেবারেই নিষিদ্ধ— যেমন ন্যাশনাল পার্ক ও ইকোলজিক্যাল সেন্টারগুলি, অথবা প্রচণ্ড সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রি্ত— যেমন ন্যাশনাল ফরেস্ট। এখানে স্থানীয় জীবন-জীবিকার অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটির কোনওরকম জায়গাই ছিল না। ফলে রাষ্ট্রের সহায়তায় পরিপুষ্ট বাণিজ্যিক গো-পালকদের আগ্রাসী জমি-খিদের সামনে বাস্তবিক অসহায় রাবার নিষ্কাশকদের বাঁচাতে পারে এমন কোনও আইনি সহায়তা সম্ভব ছিল না।

তবুও আমাজ়়নের রাবার নিষ্কাশকরা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কোন মন্ত্রে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এই হতদরিদ্র, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলি? চিকো দিয়েছিল তাদের সে মন্ত্র। যে মন্ত্রে রূপকথারা আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অরণ্যশীর্ষ থেকে নেমে আসা আলোর পেন্সিলের ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় আবার পল্লবিত হয়ে ওঠে তারা। এ ছিল তাদের অস্তিত্বরক্ষার লড়াই। তাদের ধাত্রী অরণ্য রক্ষা করার লড়াই।

এ তাদের আমাজ়়ন। এ আমাজ়়ন বাদাম-কুড়ানিদের। এ আমাজ়়ন ইন্ডিয়ানদের। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এবং সর্বাধিক জীববৈচিত্র্যে ভরা আদিম অরণ্য যা মাপে গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই-তৃতীয়াংশ— পৃথিবীর তামাম প্রজাতির দশ শতাংশ যেখানকার অধিবাসী, যার বেশিরভাগই এখনও সভ্যতার কাছে অজ্ঞাত— প্রত্যেকদিন যেখানে নতুন নতুন গাছপালা আবিষ্কৃত হয়ে চলেছে— আটলান্টিকের থেকেও যেখানে মাছেদের প্রজাতির সংখ্যা বেশি। এ অরণ্য এই গ্রহের সবচেয়ে বড় ক্যাটফিশেদের, সবচেয়ে বড় আরশোলাদের, পক্ষীখাদক মাকড়সাদের আর তিনশো উনিশ রকমের হামিংবার্ডেদের। এ তাদের অনন্ত আখ্যানময় আমাজ়়ন।

ফ্রানসিস্কো চিকো মেন্ডেস এখন জ়়াপুরি রাবার ট্যাপারস ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। তার নেতৃত্বে আক্রে-র রাবার নিষ্কাশকরা সংগঠিত হচ্ছে। শতাব্দী প্রাচীন চলমান বঞ্চনার বিরুদ্ধে দরদাম করতে শিখছে তারা। অবস্থার যে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে, এমনটা নয়। কিন্তু দুর্দশার কারণগুলিকে অন্তত চিহ্নিত করতে পারছে তারা। সপ্তাহে সপ্তাহে প্রকাশিত হচ্ছে রাবার নিষ্কাশকদের নিজস্ব মুখপত্র ‘ভারাদউরা’ (Varadoura)। তাতে ভরা থাকছে আমাজ়়নের অরণ্য-বিনাশের খতিয়ান। ১৯৭৯ সাল নাগাদ চিকো প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে রাবার নিষ্কাশকদের নিজস্ব অনেকগুলি স্কুল। একই সঙ্গে নতুনতর আক্রমণের ফলে তৈরি হচ্ছে নতুন বিপন্নতাও।

কাজের সময়ে ও ইউনিয়ন অফিসের সামনে চিকো

রাবার গাছের ডাল থেকে ফার্নান্দো তাভোরার উপহার রেডিওটা আজও বাজে। ইথার তরঙ্গে ভেসে আসে রেডিও মস্কো, রেডিও হাভানা। আর রসালো রাবার গাছের সন্ধানে চলতে চলতে চিকো স্বপ্ন দেখে আমাজ়়নের রাবার নিষ্কাশকদের, বাদাম কুড়ানিদের, মৎস্যজীবীদের শোষণমুক্তির— তামাম মানব প্রজাতির শোষণমুক্তির। সে বুঝে নিয়েছে আমাজ়়নকে না বাঁচাতে পারলে রাবার নিষ্কাশকদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। সে বুঝে নিয়েছে অরণ্য আর অরণ্যবাসীর জীবন ও জীবিকার বহুস্তরীয় আন্তঃসম্পর্কের অসামান্য রসায়ন। তাই বাইরের হানাদারদের আগ্রাসী খিদের থেকে আমাজ়়নকে বুক পেতে রক্ষা করাই এখন তাদের প্রধানতম কর্তব্য।

দাবানলের মতো জমি গ্রাস করতে করতে বাণিজ্যিক গো-পালক জোট আমাজ়়নের পূর্ব প্রান্ত থেকে ক্রমশ পশ্চিমে এগিয়ে আসছিল। সম্পূর্ণ সরকারি সহায়তা তাদের সঙ্গে ছিল আর অরণ্যবাসীদের অধিকার সম্পর্কে ছিল চরম উদাসীনতা। আক্রে-র বিভিন্ন প্রান্তে ইতিমধ্যেই গো-পালক বাহিনি জোর করে অরণ্যবাসীদের হঠিয়ে এক একটি এলাকার দখল নিচ্ছিল। এই জোর করার ব্যাপারটা কীরকম? খানিকটা হলিউডের ওয়েস্টার্ন ছবির অ্যাকশন দৃশ্যগুলির মতো। সাও পাওলোর পুঁজি বিনিয়োগকারীরা, যারা এই র‍্যাঞ্চিং এস্টেটগুলোর মালিক, তারা বিপুল সংখ্যায় ভাড়াটে বন্দুকবাজ বা গানম্যান, যাদের স্থানীয়ভাবে ‘পিস্তলেইরো’ (pistoleiros) বলা হত, তাদের এই সব এলাকায় ছড়িয়ে দিয়েছিল। এই ‘পিস্তলেইরো’রা প্রকাশ্যেই টহল দিয়ে বেড়াত ও দরকারে এক একটি পরিবারকে বাধ্য করত এলাকা ছেড়ে চলে যেতে।

এদের সন্ত্রাস কী মাত্রায় ছিল যে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬-এর মধ্যে হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল এই গানম্যানদের হাতে। অসংখ্য ইউনিয়ন লিডারের পাশবিক হত্যা সেই তালিকায় ভরে ছিল। প্রত্যেকদিন ভোর হওয়ার আগেই আক্রে-র রাবার নিষ্কাশক পরিবারগুলির চোখের ঘুম আতঙ্কে উবে যেত যান্ত্রিক করাত, বুলডোজার আর মুহুর্মুহু বৃক্ষপতনের শব্দে। জানলার ফাঁক দিয়ে নজর রাখতে দেখা যেত পিস্তল, লাইট মেশিনগান বা রাইফেল হাতে ‘পিস্তলেইরো’দের। ১৯৭৯তেই চিকোকে প্রথম হত্যার চেষ্টা করা হয়। প্রচণ্ডভাবে প্রহৃত হওয়ার পরে তাকে রিও ব্রাঙ্কোর রাস্তা থেকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরের বছরই চিকোর অগ্রজপ্রতিম কমরেড উইলসন পিনহেইরোকে পিস্তলেইরোরা হত্যা করে।

আমাজ়নের ক্যাট্‌ল্‌ র‍্যাঞ্চার

চিকোর নেতৃত্বে ইউনিয়নের রাবার নিষ্কাশকরা যুঝবার উপায় খুঁজছিল। কিন্তু ব্রাজ়়িল সরকার তাদের বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল। আইনি সহায়তা পাওয়া তো দূরস্থান, কোনওরকম আইনের অস্তিত্বই তখন ছিল না যা তাদের পক্ষে যেতে পারত। তাহলে নিরক্ষীয় ম্যালেরিয়ায় ভোগা, আধপেটা খাওয়া এই সহায়সম্বলহীন, নিরস্ত্র মানুষগুলো রাষ্ট্র ও পুঁজির এই মিলিত সন্ত্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে কীভাবে লড়বে? কীভাবে বাঁচাবে তাদের আমাজ়়ন? কী উপায় বার করবে চিকো?

সে ছিল একটি প্রকৃত ঊষার ভোর। অরণ্যের প্রান্তে তখনও আবছায়া। চারিদিকে লাশ ছিঁড়ে উজিয়ে ওঠা বিভৎস হাড়ের মতো কেটে নেওয়া গাছের গুঁড়ি। তার উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হল্লা করতে করতে দল বেঁধে এগিয়ে আসছে লাইভস্টক ও লগিং এস্টেটগুলির ভাড়া করা শ্রমিক ও ‘পিস্তলেইরো’দের দল। আমাজ়়নের নিরক্ষীয় ঘনবর্ষণ অরণ্যের প্রান্তসীমা প্রতিদিনই দ্রুত সরে যাচ্ছে ভিতরের দিকে। কালকেই আজকের এই প্রান্তসীমা আর থাকবে না। এক বীভৎস লোভে ওদের হাতের যান্ত্রিক করাতের শ্বদন্তগুলি আবছা আলোতেও চকচক করছে। তারপরে বুলডোজারগুলি স্টার্ট করতে করতে ওদের চোখ গিয়ে পড়ল সামনের আকাশছোঁওয়া বৃক্ষশ্রেণিতে।

আবছা আলোতে চোখ ধাতস্থ হলে ওরা গাছেদের থেকে মানুষগুলোকে আলাদা করতে পারল। অসংখ্য মানুষ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাছেদের আড়াল করে। বুলডোজারগুলি থেমে গেল। যান্ত্রিক করাত ধরে থাকা শ্রমিকদের হাতগুলিও নীচে নেমে এলে এর পর ‘পিস্তলেইরো’দের বন্দুকের নলগুলি উঁচিয়ে উঠল। তখন একধাপ এগিয়ে এসে দাঁড়াল শিশু ও নারীরা। হাজার শাসানিতেও একবিন্দু পিছু হঠানো গেল না তাদের। কেননা তাদের পায়ের তলা থেকে তখন রূপকথারা শিকড় ছড়িয়ে দিচ্ছিল। নারী ও পুরুষদের মিলিত স্তবগানে শিহরিত হয়ে বৃক্ষশ্রেণির শীর্ষ থেকে রাবার পাতারা টুপটাপ ঝরে পড়ছিল রূপকথাদের স্বাগত জানাতে। কয়েকটি উত্তেজনাময় দিন-রাতের পরে একটি দিনের আলো যখন নিভু-নিভু, রূপকথারা অবশেষে পারল বন্দুকের নল নীচে নামিয়ে দিতে।

চিকোদের এই শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের কৌশল যার পোশাকি নাম ছিল Empate বা Stand-off, ছড়িয়ে পড়ল আমাজ়়নের কোণে কোণে। রাবার নিষ্কাশকদের এই প্রতিরোধ গোটা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। সব সময়ই যে এই কৌশল ১০০ শতাংশ সফল হয়েছিল তা হয়তো নয়। গো-পালকদের রাজনৈতিক আঁতাতের জোরে মিলিটারি পুলিশ ডাকিয়ে প্রচণ্ড দমন-পীড়ন চালিয়ে কোনও কোনও Empate ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। তবুও অরণ্য রক্ষার ক্ষেত্রে এই কৌশল ভীষণ ভাবে কার্যকরী হতে পেরেছিল। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত, হিসেব করে দেখা গিয়েছে, ৪৫ টি এইরকম Empates প্রায় তিন মিলিয়ন একরেরও বেশি অরণ্যভূমি ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।

গো-পালন এস্টেট মালিকেরা সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিল না। প্রতিঘাতে ১৯৮৫ সালে তারা জোটবদ্ধ হয়ে তৈরি করে UDR (Democratic Ruralist Union)। UDR আরও বেশি করে ঘাতক বাহিনিকে সন্নিবেশিত করতে থাকে। একের পর এক রাবার ট্যাপারস ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয়রা পর্যায়ক্রমে খুন হতে থাকে। কিন্তু রাবার নিষ্কাশকদের আন্দোলনগুলিকে থামানো যায়নি। ১৯৮৫ সালেই চিকোর উদ্যোগে তৈরি হল National Council of Rubber Tappers (CNS) আর এই বছরের শেষের দিকেই সংগঠিত হল প্রথম National Rubber Tappers Congress। রূপকথার পরের ধাপটি লেখা হল এই কংগ্রেসেই।

এখান থেকেই প্রথম Extractive Reserve-এর ধারণা, যা চিকোর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, প্রস্তাবনা আকারে উঠে এল। এমন এক সংরক্ষিত অঞ্চল যেখানে মানুষ আর প্রকৃতির বেঁচে থাকার ঐকতান অবিচ্ছেদ্য। অর্থাৎ কিনা এমন এক অঞ্চল, সাধারণত রাষ্ট্রের মালিকানাধীন, যেখানে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে স্থানীয় মানুষ ও জনগোষ্ঠীর নিবিড় সহাবস্থানের ভিত্তিতে সংলগ্ন পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে রসদ নিষ্কাশন করতে পারবে। এই অঞ্চল ব্যাপকভাবে অরণ্যের বিনাশ ঘটাতে পারে এমন উদ্যোগ যেমন বাণিজ্যিক গো-পালন, বেআইনি লগিং, নদীবাঁধ, আধুনিক রাস্তাঘাট, বৃহৎ নির্মাণ ইত্যাদির আওতার বাইরে থাকবে। এইভাবে দীর্ঘকালব্যাপী বসবাসকারী অরণ্যের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীগুলির যেমন রাবার নিষ্কাশক, বাদাম কুড়ানি, মৎসজীবীদের এবং পরম্পরাগত নৃগোষ্ঠীগুলির অর্থাৎ ইন্ডিয়ান জনজাতিগুলির জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতি সুনিশ্চিত থাকতে পারবে। নৃতাত্বিক কার্লোস টেইক্সেইরা প্রথম এই Extractive Reserve শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন।

ইতিমধ্যে সারা পৃথিবীর নজর আমাজ়়নের উপর এসে পড়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি ততদিনে প্রবলভাবে আলোচনার মধ্যে চলে এসেছে। আর যা কিনা পৃথিবীর ফুসফুস, সেই আমাজ়়নের বিপন্নতাও মানুষের চোখের সামনে চলে এসেছে। পরিবেশকর্মীরা সারা পৃথিবী জুড়েই সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। এদিকে ১৯৮৫ সালে ব্রাজ়়িলে মিলিটারি শাসনের অবসান ঘটে। প্রায় তিন দশক ধরে চলে আসা ব্রাজ়়িল সরকারের আমাজ়়ন উন্নয়নের সরকারি নীতি প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ায় নতুন সরকার বিকল্পের কথা ভাবতে বাধ্য হচ্ছিলেন। অন্যদিকে আমাজ়়নকে ঘিরে জন-আন্দোলনগুলিতে এক অভূতপূর্ব সমীকরন উঠে আসছিল। রাবার নিষ্কাশকদের সঙ্গে ইন্ডিয়ানদের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই ভালো ছিলনা। কিন্তু যখন দুটি পৃথক জনগোষ্ঠীর অধিকারের আন্দোলন একটি সাধারণ ধারায় এসে মিশেছিল তখন ব্রাজ়়িল সরকারের কাছে তা যথেষ্ট চাপের কারণ হয়ে দাঁড়াল।

ততদিনে ফ্রান্সিসকো আলভেজ ‘চিকো’ মেন্ডেস ফিলহোর নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৮৭ সালে চিকো তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে টেড টার্নারের ‘বেটার ওয়র্ল্ড সোসাইটি পুরষ্কার’ ও ইউনাইটেড নেশনস্‌-এর ‘গ্লোবাল ৫০০ এনভায়রনমেন্ট’ পুরস্কারে সম্মানিতও হয়েছে। ঐ বছরেই ইন্টার-আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (IDB)-এর বার্ষিক সভায় চিকোর বক্তৃতায় Extractive Reserve-এর প্রস্তাবনাটি উত্থাপিত হয়। এর কিছুদিন পরেই বিশ্বব্যাঙ্ক ও IDB একসঙ্গে প্রস্তাবনাটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দিতে বাধ্য হয়। এই বিপুল চাপে ব্রাজ়়িল সরকারের কৃষি সংস্কার মন্ত্রক Extractive Reserve-এর প্রস্তাবনাটিকে মাথায় রেখে তৎকালীন ভূমি সংস্কার আইনের মধ্যে Extractive Settlement Project (PAEs) নামে আইনি উপকরণটি তৈরি করে। পরের বছর চিকো ব্রাজ়়িল সরকারের কাছ থেকে ৬১০০০ একর অরণ্যভূমি লগিং-এর আওতার বাইরে রাখার প্রতিশ্রুতি আদায় করতে সমর্থ হয়।

এইসময় বাণিজ্যিক গো-পালকদের UDR কি চুপ করে বসেছিল? একদমই তা নয়। চিকোরা যখন রূপকথা ছড়িয়ে দিচ্ছিল এই গ্রহের কোণায় কোণায় তখন আমাজ়়নের অন্ধকারাচ্ছন্ন কোণগুলিতে চলছিল ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের রাজত্ব। UDR-এর ভাড়াটে ‘পিস্তলেইরো’রা হত্যালীলায় মেতে উঠেছিল। যতই চিকোদের আন্দোলন মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পেতে শুরু করেছিল ততই এরা প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলে উঠছিল। জায়গায় জায়গায় বনবাসীদের উচ্ছেদ ও হত্যা থেমে থাকেনি। আবার চিকোদের ধারাবাহিক Empate-গুলিও থেমে থাকেনি। অরণ্যচ্ছেদন রোধ করতে সরকারের তখনও পর্যন্ত কোনও সক্রিয় অবস্থান ছিল না। ফলে সেই দায়িত্বটা রাবার নিষ্কাশকদেরই বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছিল। কিন্তু ভাড়াটে বাহিনির অত্যাচারে অবস্থাটা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে রাবার নিষ্কাশকরা বিশেষত ইউনিয়নের নেতাদের পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ চালানোই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল।

একটি Empate-এর দৃশ্য

চিকো তখন একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব হলেও তার পক্ষেও স্বাধীনভাবে কাজ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। বেশ কয়েকবার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয় এবং খুব অল্পের জন্য তার সঙ্গে থাকা ইউনিয়ন সাথীদের (companheiros) অসম সাহসিকতায় প্রাণে বেঁচে যায় সে। চিকো নিজেও আশঙ্কা করছিল যে আগামী ক্রিসমাস অবধি তার বাঁচার সম্ভাবনা কম। এই আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, ঐ বছরেই ১৮ জন ইউনিয়ন নেতার হত্যাই তার প্রমাণ। যথারীতি সরকারকে বারবার জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি।

ইতিমধ্যে একজন প্রভাবশালী গো-পালক ডারলি আলভেস দা সিলভা ১৯৮৮-র শুরুর দিকে জ়়াপুরি সংলগ্ন অরণ্যের কিছু অংশ লগিং করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু চিকোদের নাছোড় প্রচেষ্টার ফলে এই ভূ-খণ্ডটিকে ঐ পরিকল্পনা থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়। উপরন্তু অন্য একটি প্রদেশে ডারলির নামে একটি হত্যার যে অভিযোগ আগে থেকেই ছিল তার জন্য চিকো সরকারি পরোয়ানা বার করতেও সমর্থ হয়। চিকোকে হত্যার শেষ কটি চেষ্টাতে সামিল ছিল এই ডারলি নিজেই।

এতকিছুর পরিবর্তন হলেও জ়়াপুরির মেন্ডেসদের একরত্তি কাঠের বাড়িটা প্রায় একইরকম আছে। সেই বাড়িটাতেই কয়েকদিন থেকে প্রায় ঘরবন্দি হয়ে আছে চিকো। অনেক বলাকওয়ার পর ব্রাজ়়িল সরকার দুজন দেহরক্ষী পুলিশ নিয়োগ করেছেন যাদের ঘরের ভিতরে ঘুমানোতেই মনোযোগ ছিল বেশি। বাইরে জানালার ফাঁক দিয়ে সময়ে সময়ে রাইফেল হাতে ঘাতক বাহিনিকে দেখা যায়। একটু সুযোগের খোঁজে তারা বিনিদ্র টহল দিয়ে বেড়ায়। দিন যায় আর প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ বুকে হাপর নিয়ে চিকোর বউ ইলজ়়ামারের দুটি ভয়ার্ত চোখ ঠায় জেগে থাকে ছোপধরা শার্শির এপারে।

চিকো আর ইলজ়া

ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ চিকোর চুয়াল্লিশতম জন্মদিন ছিল। এমনিতেই অনুষ্ঠান কিছু হওয়া সম্ভব ছিল না। তবু চিকো ছিল খুব খুশি। ইলজ়়ামার কিন্তু ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিল। রাতে এক সময়কাতর ইলজ়়ামার চিকোকে বলেই ফেলল, এখানে প্রাণসংশয় করে এখনও কেন সে পড়ে আছে! সে জ়়াপুরি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে না কেন! তখনও শান্ত স্বরে চিকো বলেছিল, কোনওকিছুই তাকে তার সঙ্কল্প থেকে হঠাতে পারবে না। আমাজ়়নকে রক্ষা সে করবেই। যেভাবে Empate-গুলিতে চিকো সবাইকে সাহস যুগিয়ে যেত, ইলজ়়ামারকেও সেই একই ভাষায় বলেছিল— ‘ভয়ের কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।‘ সেদিন রাতে চিকো ইলজ়়ামারের হাত দুটি ধরে অনেকক্ষণ বসে থাকল।

এমনি করেই কেটে গেল আরও কয়েকটি দিন। সেদিন ছিল ২২ তারিখ। আর দুটো দিন পরেই ক্রিসমাস। সারা পৃথিবী আসন্ন উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমনিতে এই সব অঞ্চলে খুব বেশি ঠান্ডা পড়ে না। কিন্তু সেদিনটা বেশ গরম ছিল। কয়েকদিন ধরেই বন্দুকের আনাগোনা চোখে পড়ছিল না। চিকো বাড়িতে বসে থাকার লোক ছিল না। সেদিন সে ইউনিয়নের কাজে কাছের শহর সেনা মাদুরেইরা-তে গিয়েছিল। সন্ধের সময় companheiro-রা তাকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে গেল। বাড়িতে ফিরে সে বেশ খোশমেজাজে ছিল। ইলজ়়ামারের চোখ টিভির ডেইলি সোপে আটকে ছিল। বাচ্চারা ইতিউতি খেলে বেড়াচ্ছিল। দেহরক্ষী পুলিশদুটো তখন রান্নাঘরের টেবিলে ডমিনোস খেলছিল। চিকো তাদের সঙ্গে একহাত খেলে নিল।

কাঁচা বাদামের গন্ধে যখন আশপাশটা মজে আসছিল চিকোর তখন খুব স্নানের ইচ্ছে হয়েছিল। স্নানঘরটা ছিল বাড়ির মূল কাঠামোর বাইরের অংশে যার কাছেই ঝাঁকড়া কোপাইবা গাছটার ডালে ডালে খেলে বেড়াচ্ছিল দুটো হলদে ডানার টিয়া। তাদের দিকে চোখ রেখে এক অনন্ত স্নানের ইচ্ছে নিয়ে চিকো নীল দরজাটা খুলে বাড়ির বাইরে পা রেখেছিল।

একটা বিশগজ পাল্লার শটগানের ফায়ারে যতটা শব্দ হতে পারে ততটা টিয়াদুটোর খেলা থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। হলদে ডানা মেলে তারা উড়তে শুরু করেছিল। সারা রাত তারা উড়ে চলল। ক্রমে সকাল হলে হয়ত তারা পৌঁছবে অরণ্যের সেই সব অংশে যেখানে মহান সেই সব রাবার গাছেদের মাথা ছুঁয়ে নিরক্ষীয় রোদ নেমে আসবে আলোর পেন্সিল হয়ে আমাজ়়নের ভেজা মাটিতে। আর সেই সব জাদু-বাস্তব আলোকস্তম্ভ ছুঁয়ে ছুঁয়ে কোনও অষ্টম বর্ষীয় বালকের চঞ্চল পায়ে পায়ে লেখা হতে থাকবে আবার কোনও নতুন রূপকথা।

২২ ডিসেম্বর, ১৯৮৮। ডারলির ছেলে ডারসির শটগানের গুলিতে নিহত হয় চিকো। চিকোর হত্যাকাণ্ডে সারা পৃথিবীতে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্তর্জাতিক ক্ষোভের চাপে গ্রেপ্তার হয় ডারলি দা সিলভা, ডারসি দা সিলভা এবং ‘পিস্তলেইরো’ জারদেইর পেরেইরা। সুদীর্ঘ একমাস ধরে হত্যার মুহূর্তটির অপেক্ষায় তারা চিকোর বাড়ির উল্টোদিকের জঙ্গলে আত্মগোপন করেছিল।

আমাজ়নের এক্সট্রাক্টিভ রিজার্ভের মানচিত্র

চিকোর মৃত্যুর পরে ব্রাজ়়িল সরকার নড়ে-চড়ে বসে। ১৯৯০ সালে National Centre for the Sustainable Development of Traditional Peoples (CNPT)-এর মাধ্যমে তৈরি হয় আমাজ়়নের প্রথম Extractive Reserve, যার নাম দেওয়া হয় Reserva Extrativista Chico Mendes। ১৯৯০-তেই প্রাথমিকভাবে মোট চারটি ফেডারেল রিজার্ভ গড়ে ওঠে। আক্রে’তে ‘চিকো মেন্ডেস’ ও ‘অলটো জুরুয়া’, রন্ডোনিয়ায় ‘রিও অউরো প্রেতো’ এবং আমাপা প্রদেশে ‘রিও কাজারি’। পরে ২০০২ সাল নাগাদ আরও ১৪টি ফেডারেল রিজার্ভ গড়ে ওঠে।

শুরুতে আমি ভেবেছিলাম আমি রাবার গাছ বাঁচানোর জন্য লড়ছি। পরে ভেবেছিলাম আমি আমাজ়়নের অরণ্য রক্ষার জন্য লড়ছি। শেষে দেখলাম আমি লড়ছি আসলে মানবতার রক্ষার জন্য।

—চিকো মেন্ডেস।

এই মানবতা হল প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বেঁচে থাকার মিথোস্ক্রিয়ায় জারিত মানবতা। শোষিত শ্রেণির প্রতিরোধের সংগ্রাম যেখানে রূপকথা হয়ে ওঠে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে জীবন ও জীবিকার টেকসই আদান-প্রদানের অনন্য আন্তঃসম্পর্ককে ঘিরে। চিকো ছিল এই রূপকথার এক আশ্চর্য কারিগর। টেবিলের উপর বই রেখে কঠিন অঙ্ক কষার সুযোগ সে কোনওদিন পায়নি, তার বদলে রামধনু রঙে ছোপানো টাউকান তার ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে কিভাবে প্যাক্সিউবা পামের বংশবিস্তারে সাহায্য করে তা দুচোখ ভরে দেখে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। আর সেই সুযোগ সে হাতছাড়া করেনি। ‘পরিবেশবাদী’ এই শব্দবন্ধটি কানে শোনার অনেক আগে থেকেই সে যে পরিবেশবাদী ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

আরও এগিয়ে সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন ও পরিবেশরক্ষার আন্দোলনকে এক সুতোয় মিলিয়ে দিতে পেরেছিল চিকো। শ্রেণির প্রশ্নটিকে পরিবেশরক্ষার বিষয়টির মধ্যে গভীরে প্রোথিত করতে পেরেচ্ছিল সে। যে ইন্ডিয়ান জনজাতিগুলি ও রাবার নিষ্কাশকরা ঐতিহাসিকভাবে পরস্পর বৈরী ছিল তাদের শ্রেণির প্রশ্নে এক জায়গায় মেলাতে পেরেছিল সে। চিকোর নিজের কথায়— “Environmentalism without class struggle is just gardening.” এর আগে পরিবেশ ভাবনার বিষয়টিতে শ্রেণির প্রশ্নটি প্রায় অনুপস্থিত ছিল। নিখাদ প্রকৃতিবাদী অথবা নিখাদ মনুষ্য-সভ্যতাবাদী এই বাইনারিতে ভাগ হয়ে ছিল। প্রকৃতির নৃতাত্ত্বিক রূপটিকে অগ্রাহ্য করে প্রকৃতিকে যাবতীয় আধুনিকতাবিরোধী এক আধ্যাত্মিক একক হিসেবে দেখার প্রবল ঝোঁক ছিল। পরিবেশ ও সংরক্ষণবাদী আন্দোলনের ধারাগুলিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। যে ধারাগুলি সামগ্রিকতার বদলে এক বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবেশের বিষয়টিকে পর্যালোচিত করে। যেখানে এই পুঁজিবাদী সমাজব্যাবস্থাটি প্রশ্নের বাইরে থেকে যায়। প্রশ্নের বাইরে থেকে যায় পুঁজিবাদী উৎপাদনের সম্যক চরিত্রটি। যে চরিত্রটি দাঁড়িয়ে থাকে মুনাফার এক দানবীয় পুঞ্জীভবনের উদগ্রতায়। এবং তা সম্ভব হয় প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ এবং একই সঙ্গে চূড়ান্ত অনৈতিক পণ্যায়িতকরণের মাধ্যমে।[9] যেখানে শুধু প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রই বিপন্ন হয় না, সরাসরি বিপন্ন হয় এই গ্রহে বসবাসকারী অধিকাংশ ক্ষমতাহীণ মানুষ। বিপন্ন হয়ে ওঠে তাদের আঞ্চলিক জীবন-জীবিকা। চিকোর রাজনীতিতে উঠে এসেছিল এই বিপন্নতার কথা, বাজারের সর্বগ্রাসী চরিত্রের কথা। সে বুঝেছিল যে প্রকৃতির সঙ্গে মিথোস্ক্রিয়ায় আবদ্ধ, আঞ্চলিক অর্থনীতিই পারে এক টেঁকসই প্রাকৃতিক ভারসাম্য সুনিশ্চিত করতে, কারণ তা মুক্ত বাজার অর্থনীতির বিপ্রতীপে চলে; ফলে উৎপাদন-উপভোক্তার বৃত্তটি ছোট থাকতে পারে। শুধুমাত্র আমাজ়়নের অরণ্য রক্ষার একজন অক্লান্ত সৈনিক হিসেবে চিকোকে জানলে সেই জানা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তার জীবন ছিল এক বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগ্রামের রূপক। পরিবেশরক্ষার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, এক অসামান্য শ্রেণিসংগ্রামের উপাখ্যান। চিকো মেন্ডেস আসলে এক নতুন রূপকথার জন্ম দিয়েছিল।

যে রূপকথা মুখোমুখি পণ্যসভ্যতার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার সংস্কৃতিকে প্রশ্ন করতে বলে যে পুঁজিতান্ত্রিক উন্নয়নের ধারণা ক্রমাগত এক বড় অংশের মানুষ ও প্রকৃতিকে বিযুক্ত করতে করতে চলে, যে সর্বগ্রাসী ধারণা পরিবেশ-প্রকৃতির, পরিবেশ-মানুষের, মানুষে-মানুষের আন্তঃসম্পর্কের পরম্পরাগত রসায়নটিকে ধ্বংস করে এক একরৈখিক পণ্য-মানসিকতার বিকাশকে প্রযুক্ত করে, এই রূপকথা তাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায়।

এই রূপকথারা ছড়িয়ে আছে এই গ্রহের কোণায় কোণায়। আমাজ়়নে, কঙ্গো বেসিনে, ইন্দোনেশিয়ার নিরক্ষীয় অরণ্যে, নিয়মগিরির গাছে গাছে, গন্ধমাদনের ওষধিলতায়, চিপকো নারীদের বাহুবন্ধনে… আরও কত কত কোণায়। Extractive Reserve তৈরি হয়েছে মানেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে, তা একেবারেই নয়। কিন্তু Extractive Reserve চালানোর ক্ষেত্রে কী কী নিজস্ব গঠনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা এখনও রয়েছে বা বলসোনেরো-র আমলে নতুন কী কী অবস্থার মুখোমুখি হতে হচ্ছে অথবা ভারতে ২০০৬-এর অরণ্যের অধিকার আইন (FRA) আজ এই আমলে কীভাবে আক্রান্ত এবং তার ফলে কয়েক লক্ষ অরণ্যবাসীর ভবিষ্যৎ কীভাবে বিপন্ন— সেই আলোচনার পরিসর এই লেখায় নেই।

এই লেখা শুধু চিকোকে ঘিরেই। হয়ত তাও নয়। হয়ত সেই রূপকথাকে ঘিরে— এক অনন্ত জাদুবাস্তব মিথোস্ক্রিয়ায় যার পাঠ শুরু হয়। যেখানে পথের ধারে থোকায় থোকায় ঝোলে বণ্য কাকাউ চকোলেট, যে ভিজে মাটিতে আর্মাডিলোর পায়ের ছাপ ঢেকে গিয়েছে সদ্য কোনও জাগুয়ারের থাবায়, যেখানে অরণ্যের পিতা তোমার কুকুরগুলির প্রাণ ছিনিয়ে নেন যদি তুমি হপ্তায় একটার বেশি হরিণ মারো[10], যেখানে নদীনালাদের মা তোমার নৌকাগুলি ডুবিয়ে দেন যদি তুমি তোমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাছ ধরে ফেলো।[11] সেখান থেকেই পড়া হয় এক অতি সাধারণ অথচ এক অনন্য পাঠ— রাবার গাছেরও দরকার বিশ্রাম। যদি তুমি অতিরিক্ত নিষ্কাশন কর তবে তুমি দুধের বদলে তার কাছ থেকে পাবে জল।

এই জীবনবোধ— যা হয়ে ওঠে অস্তিত্বের কাব্যময় রূপকথা— তাকে কীভাবে আমরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাষ্যে রূপান্তরিত করব তার ওপরেই হয়ত নির্ভর করে থাকবে এই গ্রহের ভাবী অস্তিত্ব।

তথ্যসূত্র:

১। Extractive Reserves: Building Natural Assets in the Brazilian Amazon – Anthony Hall
২। https://biography.yourdictionary.com/chico-mendes
৩। https://nvdatabase.swarthmore.edu/content/brazilian-rubber-tappers-campaign-protest-deforestation-brazilian-rainforest-region-1977-198
৪। https://www.encyclopedia.com/humanities/encyclopedias-almanacs-transcripts-and-maps/extractive-reserves
৫। http://www.wildrubber.com
৬। https://neatnik2009.wordpress.com/tag/ilzamar-gadelha-mendes/
৭। https://www.vanityfair.com/news/1989/04/chico-mendes-murder


  1. Conquistador ইংরেজি Conqueror-এর স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ প্রতিশব্দ। ১৬শ শতকে স্প্যানিশ ও পর্তুগিজরা সারা পৃথিবীতে নতুন নতুন ভূখণ্ড দখলের লক্ষ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বিশষ করে মেক্সিকোতে অ্যাজটেক ও পেরুতে ইনকাদের পরাজিত করার পর এদের নেতৃস্থানীয়দের Conquistadors বলা হতে থাকে।
  2. চক্রপদ বা Clubbed feet একধরনের জন্মগত রোগ। এই রোগে আক্রান্তদের পায়ের পাতা শরীরের ভিতর বা বাইরের দিকে বাঁকা থাকে।
  3. আমেরিন্ডিয়ান: আমেরিকার স্থানীয় ইন্ডিজেনাস জনজাতি— ২০০০-এর সেন্সাস অনুযায়ী যাদের সংখ্যা কমবেশি দুই লক্ষের কাছাকাছি, কনকোয়েস্টের আগে তাদের সংখ্যা ছিল কয়েক মিলিয়ন!
  4. Caboclo: লাতিন আমেরিকার মিশ্র জনসমষ্টি— কয়েক শতাব্দী ধরে ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে ইউরোপীয় শ্বেতকায় ও আফ্রো-ব্রাজিলিয়দের মিশ্রণে সৃষ্ট।
  5. Vulcanization: ১৮৩৯ সালে চার্লস গুডইয়ার আবিষ্কৃত নরম রাবারকে দৃঢ় করবার রাসায়নিক পদ্ধতি।
  6. প্রকৃত ইতিহাস হল ১৮৭৬ সালে হেনরি উইকহ্যাম নামে এক ইংলিশম্যান ব্রাজ়়িল থেকে ‘পারা’ রাবারের ৭০০০০ বীজ ইন্দোনেশিয়ায় স্মাগল করে নিয়ে যায়।
  7. ফার্নান্দো দি নোরন্‌হা দ্বীপপুঞ্জ: উত্তর-পূর্ব ব্রাজিলের আটলান্টিক দ্বীপপুঞ্জ। আন্দামানের সেলুলার জেলের মতোই এই দ্বীপপুঞ্জেও একটি দুর্ভেদ্য কারাগার ছিল। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত এটি ছিল রাজনৈতিক বন্দিদের কারাগার।
  8. ট্রান্স-আমাজোনিয়ান হাইওয়ে বা বিআর ২৩০, ১৯৭২ সালে তৈরি হয়েছিল। আমাজনের বুক চিরে ৪০০০ কিমি দীর্ঘ এই রাস্তাটি ব্রাজিলের তৃতীয় দীর্ঘতম হাইওয়ে।
  9. জন বেলামি ফস্টার এরকম একটি হিসেব দিয়েছিলেন– ঐতিহাসিকভাবে এটা ধরে নেওয়া হয় যে প্রতি বছর পুঁজিবাদী অর্থনীতির ৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি ঘটে থাকে। এই হারে পৃথিবীর অর্থনীতি একশো বছরে বৃদ্ধি পায় ১৬ ভাগ। দুশো বছরে বাড়ে ২৫০ ভাগ ও তিনশো বছরে তা দাঁড়ায় ৪০০০ ভাগে। এই গ্রহের সীমিত জীবমণ্ডলের পক্ষে তা কতটা ধ্বংসাত্মক হয়ে দাঁড়ায় তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়।
  10. আমাজ়্নীয় লোককথা
  11. আমাজ়্নীয় লোককথা
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...