কিন্নৌরের বিপর্যয় কীসের পূর্বাভাস?

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 



প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র ও গবেষক

 

 

 

 

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ এবং ৫ মে ২০২১— বারবার তিনবার উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলি নিয়ে এই চার নম্বর প্ল্যাটফর্মেই কলম ধরেছিলেন বিশিষ্ট গদ্যকার ও প্রাবন্ধিক সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। আমাদের আজকের এই আলোচনাপর্বে তাঁর সেই বক্তব্যগুলিকেই পুনরুক্তির আকারে আপনাদের সামনে উল্লেখ করতে চাইব, কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে যেটা চাইব— আমাদের ভিতরকার রাগটুকুকে, ক্ষোভটুকুকে এই আলোচনার পরিসরে উসকিয়ে দিতে।

প্রকৃতির প্রতিশোধের ইতিবৃত্তকে যখন বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করেও মানুষের চিরকালীন অভ্যাসকে কোনওভাবেই পালটানো যাচ্ছে না, তখন একেকটা সময় সরাসরি নিজের মনের মধ্যেকার আগুনটুকু, অথবা অন্ধকারটুকু সকলের সামনেটায় একবারে উন্মোচিত করে দেওয়া উচিত। হিমালয়ের একেকটি দুর্ঘটনা যে একেক সময়ে কেবল সংখ্যার নিরিখে প্রাণহরণ করেছে এমনটা তো নয়— একেকটি হিমালয়‘প্রমাণ’ দুর্ঘটনাতে একেকটি পরিবার হারিয়ে গিয়েছে। একেকটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। একেকটি প্রজন্ম এক মুহূর্তের চেয়েও কম সময়ে কোনও এক ভয়াল, অনিশ্চিত, অন্ধকার ভবিষ্যতের সুমুখে, সবকিছুকে হারিয়ে এসে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে। যে সমস্ত জওয়ানেরা উদ্ধারকার্যে গিয়ে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন, অথবা হিমাচল প্রদেশের কিন্নৌরে যে নিরীহ বাসচালক অথবা নির্বিবাদী খালাসি ভদ্দরলোক আজ চাঁই চাঁই গুঁড়োমাটি, পাথর, অথবা বোল্ডারের নীচে অসহায়ভাবে চাপা পড়তে পড়তে কালরূপী অনন্তের বুকে চিরতরে হারিয়ে গেলেন— খবরের কাগজ অথবা প্রশাসনের কাছে তাঁরা শুধুমাত্র আঁকড়ি-বুঁকড়ি সংখ্যার হিসেব হলেও, তাঁদের পরিবারের কাছে, নিকটস্থ মানুষজনেদের কাছে তাঁদের যে একটা আগাগোড়া মানবিক, জৈবিক, এবং অর্থনৈতিক অস্তিত্ব আছে, আমরা কি সেটা ভুলে যেতে বসেছি? আমাদের কি এত কিছুতেও চেতনা হবে না? প্রকৃতির বিপরীতে আমাদের লোভ, আমাদের লুঠতরাজের মাসুল দিতে হচ্ছে এমনই একেকজন সাধারণ মানুষকে, এতবারের পরেও— এরপরেও কি আমাদের লজ্জা হবে না? প্রশাসনের লজ্জা হবে না? সুবুদ্ধি জাগবে না? আমরা জোরকদমে হিমালয়ের ধ্বংসকার্যকেই কি আমাদের কাজের মাধ্যমে আরও আরও ত্বরান্বিত করব?

হিমাচল প্রদেশের কিন্নৌরে পাহাড়ে ধসের কারণে বোল্ডারের নীচে তলিয়ে যাওয়া বাস-দুর্ঘটনার অভিঘাতে মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবেই ৫০ ছুঁয়ে ফেলতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিপুল পরিমাণ ওই মাটি-পাথর-বোল্ডারের ধ্বংসাবশেষের তলায় কত মানুষ যে চাপা পড়ে রয়েছেন সেই বিষয়ে এখনও নিশ্চিত করে কোনও কিছুই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু তার চেয়েও বড় খবর হল ওই রাজ্যেরই লাহৌল-স্পিতি জেলায় জুন্দা গ্রামের কাছে আরও একটি বিপুলাকৃতি ধসের কারণে চন্দ্রভাগা নদীর স্বাভাবিক গতিপথটি সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ১৩টি গ্রামের অন্তত ২০০০ জন বাসিন্দাকে প্রশাসনের তরফে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা আশঙ্কা করছেন নদীর জলের তোড়ে, ধসের কারণে সৃষ্টি হওয়া এই প্রাকৃতিক বাঁধটি যে কোনও সময়েই প্রবল শক্তিতে ফেটে পড়তে পারে এবং সেক্ষেত্রে আরও ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকছে। হিমাচল প্রদেশ-উত্তরাখণ্ড-সহ হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভূমিরূপ আজ অশান্ত হয়ে উঠেছে, আর এই অশান্তির কারণ হয়েছি আমরাই।

পাহাড়ের বয়সের দিক থেকে দেখতে গেলে হিমালয় নবীন। এই বরফের রাজত্বে বহুযুগের প্রাচীন ঋষি-মুনিদের অনেক কথা শুনে এলেও ভূমিরূপের দিক থেকে হিমালয়ের বেড়ে ওঠা বেশিদিনের নয়। স্বভাবতই তার ভাঙাগড়ার প্রক্রিয়াটি এখনও শেষ হতে পারেনি। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে হিমালয়ের তলদেশে একাধিক চ্যুতিরেখা এখনও সক্রিয়ভাবেই অবস্থান করছে, যেগুলি কিনা যে কোনও সময়েই ভয়াবহ একেকটি ভূমিকম্পের অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে। এর আগে ১৯৯১তে উত্তরকাশীর ভূকম্পন এবং ১৯৯৯তে চামোলির ভূমিকম্পে আমরা সেই ভয়াবহতার কিছু কিছু নজির দেখেছি। তবু সেই ক্ষতির পরিমাণকে কীভাবে একটি সীমার ভিতরেও অন্তত বাঁধা যেতে পারে, কীভাবে প্রকৃতির এই প্রগলভতার সঙ্গেও মানুষ পায়ে পা মিলিয়ে চলতে পারে, অনেক কাল পূর্বে এই চামোলি জেলা থেকেই কিন্তু একজন মানুষ সেই বিষয়ে দিগনির্দেশ করেছিলেন। যদিও সম্প্রতি আমরা তাঁকে হারিয়েছি— এতদসত্ত্বেও, ভুলে গেলে চলবে না উত্তরাখণ্ডের এই চামোলি থেকেই আমরা পেয়েছিলাম সুন্দরলাল বহুগুণার চিপকো আন্দোলনকে। হিমাচলের বিস্তীর্ণ বনভূমিকে সংরক্ষণ করতে তাঁর সেই আন্দোলন আজ সারা পৃথিবীর পরিবেশ আন্দোলনের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও আমরা সেই ইতিহাসকে বিস্মৃত হয়েছি।

একদিকে বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলতে শুরু করেছে। হিমবাহগুলির আচার-আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অন্যদিকে এরই সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে, পর্যটন এবং অর্থনৈতিক প্রগতির অজুহাতে নির্বিচারে সম্পন্ন হয়ে চলেছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর নিধন-অভিযান। চারধাম প্রকল্পের নামে হিমালয়ের উপরে অতখানি উচ্চতায় তৈরি হবে ৭১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১০ মিটার অবধি প্রশস্ত, এ্যাসফল্টে মোড়া একেকটি অভাবনীয় রাজপথ। তৈরি হবে হেলিপ্যাড, অসংখ্য বাইপাস, সেতু ও সুড়ঙ্গব্যবস্থা। যে গাছগুলির শিকড়ে মাটি আঁকড়ে থাকত, ভূগোল বইতে যে গাছগুলির বিষয়ে জানতে গিয়ে আমরা পড়তাম ভূমিক্ষয় রোধের বিষয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসমূহ— সেই গাছগুলিকে একেকটি মাত্র কলমের আঁচড়ে নির্বিচারে কেটে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে বাঁধ দেওয়া হবে সদ্যোজাত, পাহাড় থেকে নেমে আসা উচ্ছল স্রোতের বেগবতী, প্রগলভা, চঞ্চলা একেকটি নদীরই উপর। তাদের স্বাভাবিক গতিপথকে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো রুদ্ধ করে দিয়ে, পরিবর্তন করে দিয়ে আমরা খোদার চেয়েও বড় খোদা হয়ে উঠতে চেষ্টা করব… এবং তার প্রতিফল গুনবে সেই ‘১৩টি গ্রামের ২০০০ জন মানুষ’।

অনেক রাত্তিরে যাদেরকে আধঘন্টার নোটিশে প্রশাসনের তরফ থেকে সরে যেতে বলা হবে। ত্রাণশিবিরের খিচুড়ি খেতে খেতে যারা ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মোবাইল-আলোতে দেখবে কেমন করে তাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা চিরপরিচিত সেই শান্ত নদীটি আজ হঠাৎ যেন কোন কুমন্ত্রের প্রবাহে কূলভাসী হয়ে উঠে তাদের শেষ সম্বলটুকুকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অথবা কপাল যদি তাদের নিতান্তই আরও মন্দ হয়, তাহলে কোনও একদিন ভোরে হঠাৎ– কোনও পূর্বাভাস ছাড়াই গ্রামশুদ্ধ সকলেই তলিয়ে যাবে বিশালাকৃতি একেকটা বোল্ডার অথবা দুকূল ছাপিয়ে ধেয়ে আসা হড়পা বানের জলস্রোতের আড়ালে। আমরা মোমবাতি জ্বালাব।

এই চারধাম প্রকল্পকে নিয়েই আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে এই সূত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মেরই একটি আলোচনায়, গত ৫ মার্চ ২০২১ তারিখের একটি প্রবন্ধে সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য সেই বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন। তা থেকে জানা যাচ্ছে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ১০০ কিলোমিটারের চেয়ে দীর্ঘতর কোনও সড়ক প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করতে গেলে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপরে তার প্রভাব সম্পর্কে একটি বিস্তারিত আলোচনা করা জরুরি। আইনি পরিভাষাতে একে বলা হয় এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট এ্যাসেসমেন্ট বা সংক্ষেপে ইআইএ সমীক্ষণ। চারধাম প্রকল্পের ক্ষেত্রে এই সমীক্ষাপর্বকে যাতে এড়িয়ে যাওয়া যায়, সেই লক্ষ্যে আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার চারধাম প্রকল্পটিকে কমবেশি ৩৫টি ভাগে বিভক্ত করে সম্পূর্ণ প্রকল্পটির রূপরেখা তৈরি করেছে। যাতে কিনা সড়কপথের কোনও অংশেরই দৈর্ঘ্য ১০০ কিলোমিটার না ছাড়ায় এবং এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশগত সমীক্ষার বিষয়টিকেও স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যাওয়া চলে।

আমরা এক অন্ধকার ভবিষ্যৎকেই ক্রমশ ত্বরান্বিত করেছি। করেই চলেছি। নদী, মাটি, বনভূমি ও তার বৃক্ষরাজিকে আমরা এতটাকাল অস্বীকার করে এসেছি। যার ফলে বিশ্ব-উষ্ণায়নের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের উপর। ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’ অথবা ‘আবহাওয়া শরণার্থী’র মতো একেকটি শব্দবন্ধ তৈরি হতে পেরেছে। জীবন-জীবিকা-নিরাপত্তা, সবকিছুকে পরিত্যাগ করে আজ— মানবতা তার অস্তিত্বের সত্যিকারের এক ভয়াবহ সঙ্কটের দিকেই এগিয়ে চলেছে।

হিমাচল-উত্তরাখণ্ড সহ হিমালয়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আকস্মিক ধসের প্রবণতা এখন কয়েকগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। একেকটি ধসের কারণে নদী বা অন্যান্য প্রাকৃতিক জলধারার স্বাভাবিক গতিপথে দীর্ঘমেয়াদি বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। যা কিনা ফলস্বরূপ আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে আরও আরও বৃহদাকারের একেকটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের। তবুও থেমে থাকছে না বিদ্যুৎ উৎপাদনের চিন্তা। অপরিকল্পিত নদী বাঁধের প্রতিফল যে কতখানি ভয়াবহ হতে পারে সেই নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিরন্তর সাবধানবাণী শুনিয়ে চলেছেন। কিন্তু এই প্রশাসন শুনলে তো! ঋষিগঙ্গা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপর্যয়ের পরেও আধিকারিক বা প্রশাসনের তরফে তেমন একটা হেলদোলের লক্ষণ দেখছি না। ১৯৯১ থেকে ২০২১ সাল অবধি এই দুর্গম পার্বত্যভূমিতে সড়কনির্মাণ ও অন্যান্য ‘উন্নয়নমূলক’ কাজের প্রয়োজনে ৫৮৬৮৪ হেক্টর পরিমাণ জমির অরণ্যসম্পদকে সমূলে বিনষ্ট করা হয়েছে। এবারে প্রকৃতির আত্মরক্ষার সময়।

হিমালয়ের ভূমিরূপগুলির মৌলিক ভারসাম্যটুকুই আজ সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। আমরা সেই সূত্রে সুন্দরলাল বহুগুণার কথা বলেছি। সবশেষে বরং গুরুদাস অগ্রবালের কথা দিয়ে শেষ করি।

১১ অক্টোবর, ২০১৮। অনশনের ১১১তম দিনে অবশেষে উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা গুরুদাস অগ্রবালের জীবনদীপ নির্বাপিত হয়েছিল। এর আগে সেই বছরের ২২ জুন তারিখ থেকে হরিদ্বারে, ১১০ দিনের টানা অনশন আন্দোলন চালিয়ে এসেছিলেন পেশায় সিভিল এঞ্জিনিয়র এই গুরুদাস অগ্রবাল। গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উত্তরকাশী অবধি ভাগীরথীর ১২৫ কিলোমিটার প্রবাহ-পথে ভারত সরকারের শক্তি-মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞেরা ইতিমধ্যেই ৬টি বাঁধ তথা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয়ে চূড়ান্ত ছাড়পত্র দিয়েছিলেন। এই বাঁধগুলির বিরুদ্ধেই ২০০৯ থেকে লাগাতার আন্দোলন করে এসেছেন গুরুদাস। তারই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ২২ জুন তারিখে তিনি আমরণ অনশনে বসেন এবং, ১১ অক্টোবর, ২০১৮ তারিখে তিনি প্রাণত্যাগ করেন। প্রশাসন থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম অবধিও এই প্রয়াণ বা তাঁর এই আন্দোলনের বিষয়ে অধিক সময় অথবা নিউজপ্রিন্ট খরচা করেনি। হয়তো বা এমনটাই দস্তুর এখানে। হয়তো বা সবখানেই।

বিজ্ঞানীদের মতে, অপরিকল্পিত এমন সমস্ত নদীবাঁধ হিমালয়ের মতো চঞ্চল ভূমিরূপের একেকটি জায়গাতে চরম বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। বিশ্ব-উষ্ণায়ন বা প্রাকৃতিক কারণে এই অঞ্চলে লাগামছাড়া বৃষ্টি, হড়পা বান অথবা হিমবাহের হুড়মুড়িয়ে নেমে আসা এখন আর মোটেই অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়। পাহাড় ফাটিয়ে বিকাশপুরুষের উন্নয়ন-যাত্রা একদিকে যেমন হিমবাহ-সহ অন্যান্য সমস্ত ভূমিরূপগুলিকে আরও অস্থির করে তুলছে, তেমনই বিশ্ব-উষ্ণায়নের কারণে অনিয়মিত এবং অভূতপূর্ব বৃষ্টিপাত অথবা তুষারপাতের সম্মুখীন হচ্ছে এই সমগ্র অঞ্চল। এই সময় নদীতে প্রায় কোনও পূর্বাভাস ছাড়াই জলস্ফীতির ঘটনা নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেই পরিস্থিতিতে এমন একেকটি বাঁধ বা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উপস্থিতি বিপর্যয়ের মাত্রাকেই আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলছে।

কানপুর আইআইটির প্রাক্তন অধ্যাপক, কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন সদস্য, গুরুদাস অগ্রবাল অনশন মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লেখা শেষ চিঠিতে তাঁকে ভাই সম্বোধন করে বলেছিলেন,

গত চারবছরে যে সব পদক্ষেপ আপনার সরকার নিয়েছে, তাতে গঙ্গাজির কোনও উপকারই হয়নি। তার বদলে লাভ হয়েছে কেবল কর্পোরেট সেক্টর আর বেশ কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের। এখনও পর্যন্ত আপনি গঙ্গাজির থেকে কেবল লাভ আদায়ের কথাই ভেবেছেন। …

(অনুবাদ সৌজন্য: চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য)

আজ আমরা পরিবেশগতভাবে হিমালয়ের উপরকার পার্বত্য অঞ্চলগুলিতে আক্ষরিক অর্থেই খাদের কিনারাতে এসে দাঁড়িয়েছি। এমন একেকটি মৃত্যুও যদিও আমাদের বিবেককে সেই দিক থেকে স্পর্শ করতে না পারে, বোল্ডারের দেওয়ালে অবরুদ্ধ হয়ে ফুঁসতে থাকা চন্দ্রভাগা নদীর অন্তরালে ক্রমশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও ভয়ানক হয়ে বেড়ে উঠতে থাকা, আরও বড় সেই বিপর্যয়ের আশঙ্কাটিও যদি আমাদের মনে ভয় বা আতঙ্ককে জাগ্রত করতে না পারে— সতর্ক হতে না শেখায়, তাহলে আগামী দিনগুলিতে আরও ভয়াবহ সময় যে আসতে চলেছে সে কথা বলাই বাহুল্য। প্রকৃতি, তার উপরে নিয়ত হয়ে চলা— এতদিনকার অত্যাচারের সময়োচিত প্রতিশোধ হিসেবে সামান্য কিছু সংশোধনী-মার্কা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে কেবল।

আমরা যদি এখন থেকেই সতর্ক না হই, পুরনো ভুলগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন আরও ভুলগুলির আবৃত্তি ও পুনরাবৃত্তির পথ থেকে যদি সরে না আসি— তাহলে এমন আরও অনেক বিপর্যয়ের জন্যই আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে। কোন পথটিকে আমরা শেষ অবধি বেছে নিলাম, সময়ই তার হিসেব রাখবে। এখন, এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা একেকজনে কেবল আলোচনাটুকুই করতে পারি। আমাদের সীমিত ক্ষমতাও যে কেবল এইটুকুই।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...