ধনতান্ত্রিক জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় বাড়ছে অপুষ্টি

সুবর্ণ গোস্বামী

 


জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের উপর শস্যের পরিমাণ ও গুণমান দুটোই নির্ভর করে। উষ্ণায়িত বিশ্ব খাদ্যনিশ্চয়তার এই সব কটি শর্তকেই লঙ্ঘন করছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। এই ধনতান্ত্রিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশেই সর্বাধিক। এই দেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। খরা-বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝার বাড়বাড়ন্ত, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত তো আছেই, তার সঙ্গে বর্ধিত তাপমাত্রার ফলে পঙ্গপাল-সহ নানা পোকামাকড়ের উপদ্রব, ফসলের রোগ ইত্যাদিতে পণ্ড হচ্ছে কৃষিকাজ, জেরবার হচ্ছেন কৃষক। ফলে মাথাপিছু খাদ্যের লভ্যতা কমে আসছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন গরিব শ্রমজীবী মানুষ, বেকার, কর্মসংস্থানবিহীন জনতা

 

অপুষ্টি বলতে আমরা যা বুঝি, তার মধ্যে অপর্যাপ্ত খাদ্যগ্রহণজনিত ক্ষয়, বামনত্ব, ওজন কমে যাওয়া, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের অভাব যেমন পড়ে, আবার ওজন বেড়ে যাওয়া, স্থূলতা এবং খাদ্যজনিত অসংক্রামক রোগ-ব্যাধিও পড়ে। খাদ্যগ্রহণের ফলে আমাদের শরীর যে শক্তি ও পরিপোষক পায়, তার ঘাটতি, অতিরিক্ততা বা ভারসাম্যহীনতা— যে কোনও একটি ঘটলেই অপুষ্টি দেখা দেয়। সুতরাং, অপুষ্টির বর্ণচ্ছটাকে মোটামুটি তিনটি বড় ভাগে ভাগ করা যায়—

এক. ঊনপুষ্টি— এর মধ্যে আবার বয়স, ওজন ও উচ্চতার পারস্পরিক সম্পর্ক অনুযায়ী তিনটি আলাদা ধরন হয়—

(ক) যাঁদের পেশি ক্ষয়প্রাপ্ত, অর্থাৎ উচ্চতার নিরিখে যাঁদের ওজন কম,
(খ) বামনত্ব, অর্থাৎ যাঁদের বয়স অনুপাতে উচ্চতা খুবই কম,
(গ) যাঁদের বয়স অনুপাতে ওজন কম।

পেশি-ক্ষয় হয় কেবলমাত্র তাৎক্ষণিক ও তীব্র ঊনপুষ্টির কারণে, আর দীর্ঘমেয়াদি ধারাবাহিক ঊনপুষ্টির পরিণাম হল বামনত্ব।

দুই. মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট অপুষ্টি— অর্থাৎ ভিটামিন বা খনিজ পদার্থ অথবা উভয়েরই হয় অভাব, নয় আধিক্য। এটি আলাদাভাবেও দেখা দিতে পারে, আবার ঊনপুষ্টি ও অধিকপুষ্টি— উভয় ক্ষেত্রেই এই অভাব বা আধিক্য দেখা দিতে পারে।

তিন. অধিকপুষ্টি— বেশি ওজন, স্থূলতা এবং খাদ্য-সম্পর্কিত অসংক্রামক রোগবালাই— যেমন হার্টের রোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস ইত্যাদি ও কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্যান্সার।

গ্লোবাল সাউথ-এর দেশগুলিতে একই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঊনপুষ্টি ও স্থূলতা— উভয়েরই দেখা মিলছে। ১৯৯০-এর আগে ভারতে এমন চিত্র দেখা যেত না। গত তিন দশকে মুক্ত বাণিজ্য, স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম, মুনাফাসর্বস্ব উদার অর্থনীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অপুষ্টির এই জোড়া ফলা ক্রমেই প্রকট হয়েছে।

 

রাষ্ট্রপুঞ্জের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম-এর তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতি দশজনের একজন রাতে ঘুমাতে যান পেটে খিদে নিয়ে। দেড়শো কোটি মানুষ তাঁদের ন্যূনতম পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ক্রয় করতে পারেন না। পাঁচ বছরের কম বয়সি পনেরো কোটি শিশু বামনত্বে ভুগছে, সাড়ে চার কোটি শিশু ক্ষীণপেশি, এবং চার কোটি শিশু মেদবাহুল্যে আক্রান্ত।[1]

এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা মিলিয়ে প্রতি বছর খরা ও বন্যার মতো চরম আবহাওয়াজনিত কারণে প্রায় তিন কোটি মানুষকে বাসস্থান পরিবর্তন করতে হচ্ছে, যার মধ্যে দেড় কোটি মানুষ খাদ্যসংকটে ভুগছেন। বিশ বছর আগের তুলনায় এখন ৪২ শতাংশ বেশি দেশ চরম আবহাওয়াজনিত দুর্যোগের ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে।

যদিও সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ছিল, ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গ্যানাইজেশন-এর হিসেবে বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বর্তমান ৬৯ কোটি থেকে বেড়ে ৮৪ কোটিতে পৌঁছাবে।

ক্ষুধা থেকে গেলে পুষ্টি আর আসবে কোত্থেকে!

 

ভারতের জাতীয় পুষ্টি সমীক্ষা ২০১৬–১৮-র তথ্য অনুযায়ী, অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ বামনত্বে এবং ১৭ শতাংশ পেশি-ক্ষয়ে ভুগছে। ২০১৯–২০ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্টে উঠে এসেছে— ভারতীয় মহিলা ও শিশুদের অর্ধেকের বেশি অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতায় ভুগছেন। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সমীক্ষা চালানো ২২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে ১৫টিতেই— অর্থাৎ কেরল ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি বাদ দিলে দেশের প্রায় সর্বত্রই এই চিত্র দেখা যাচ্ছে। লাদাখ, জম্মু-কাশ্মির, গুজরাত ও পশ্চিমবঙ্গে অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। লাদাখে ৯২.৫ শতাংশ শিশু ও ৯২.৮ শতাংশ মহিলা এবং হিমাচলের লাউল-স্পিতি জেলায় ৯১ শতাংশ শিশু ও ৮২ শতাংশ মহিলা রক্তাল্পতায় আক্রান্ত।

এই দেশে শিশু, মহিলা ও পুরুষ— সব ক্ষেত্রেই রক্তাল্পতার প্রধান কারণ হল আয়রন ও ভিটামিন বি১২-এর অভাব; কিছু ক্ষেত্রে ফলিক অ্যাসিডের ঘাটতিও এর জন্য দায়ী।

বামন শিশুদের স্বাস্থ্য দুর্বল হয়, স্বাভাবিক বয়সোচিত শারীরিক ও মানসিক বিকাশ দেরিতে আসে, স্কুলে ভর্তিতে দেরি হয়, বোঝা ও শেখার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়, হাতের লেখা, আঁকা-সহ সবরকম সূক্ষ্ম হাতের কাজে এরা দুর্বল হয়, সামাজিক পরিমণ্ডলে মেলামেশা করতে, খাপ খাইয়ে নিতে এদের বেশ বেগ পেতে হয়। ফলে প্রাপ্তবয়সে সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এদের অংশগ্রহণ কম থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, এরা বড় হয়ে স্বাভাবিক বৃদ্ধিসম্পন্ন শিশুদের তুলনায় অন্তত সাত শতাংশ কম রোজগার করতে পারে সারাজীবনে।

যেসব মায়েরা গর্ভাবস্থায় বা তার আগে থেকেই অপুষ্টি বা ঊনপুষ্টিতে ভোগেন, তাঁদের সন্তানদের গর্ভকালীন বৃদ্ধি কম হয়, কিংবা তারা গর্ভকালীন বয়সের তুলনায় কম ওজন নিয়ে জন্মায়, পূর্ণগর্ভের আগেই জন্মায়, জন্মের সময় বা তার অব্যবহিত পরে নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয় বা শেষতক মারা যায়। মায়েদের গর্ভকালীন ঊনপুষ্টির ফলে আনুমানিক ৮ লক্ষ নবজাতক প্রতি বছর মারা যায় জন্মের এক মাসের মধ্যে। আর যারা বেঁচে যায়, তাদের একটি বড় অংশ বামনত্বে ভোগে। অপুষ্ট শিশুদের একাংশের আবার বড় হয়ে স্থূলতা ও তজ্জনিত নানা জটিল রোগে ভোগার ঝুঁকি থাকে।

অপুষ্টির সবচেয়ে বড় কারণ হল খাদ্যগ্রহণের অভাবে অপর্যাপ্ত ক্যালরি-লভ্যতা। খাদ্য-নিশ্চয়তার চারটি জরুরি শর্ত রয়েছে—

  • খাদ্যের সহজলভ্যতা— খাদ্য উৎপাদন, বণ্টন, বাণিজ্য, ভর্তুকি, পোষণ, সহায়তা সবকিছু মিলে খাবার সহজলভ্য কিনা,
  • খাদ্য-স্থিতিশীলতা— অর্থাৎ চাহিদা ও যোগানে সামঞ্জস্য এবং ভারসাম্য রয়েছে কিনা,
  • অধিগম্যতা— পুষ্টিকর, নিরাপদ এবং সংস্কৃতি-গ্রাহ্য, উপযুক্ত যে খাদ্যে একটি জনগোষ্ঠী অভ্যস্ত, সেই খাদ্য তাদের হাতের নাগালে, আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যে, সস্তায় লভ্য কিনা,
  • সদ্ব্যবহার— খাদ্যবৈচিত্র্য, শিশু প্রতিপালনের রীতি ও প্রথা, স্বাস্থ্যবিধান, সংক্রামক রোগবালাইয়ের প্রকোপ বছরে কতবার আসে— এই সবকিছু।

 

জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তন, খরা-বন্যার উপর শস্যের পরিমাণ ও গুণমান দুটোই নির্ভর করে। উষ্ণায়িত বিশ্ব খাদ্যনিশ্চয়তার এই সব কটি শর্তকেই লঙ্ঘন করছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। এই ধনতান্ত্রিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশেই সর্বাধিক। এই দেশগুলোর এক-তৃতীয়াংশ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পুঁজিনিবিড় কর্পোরেট কৃষিক্ষেত্র নানান উন্নত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে কিছুটা সামলে নিলেও, ছোট জোতের মালিক, ক্ষুদ্র কৃষক, ভাগচাষি, বর্গাদার যে ফসল ফলান, সেখানে, অর্থাৎ শ্রমনিবিড় ও বৃষ্টিনির্ভর কৃষিক্ষেত্রে কোপ পড়ছে সবচেয়ে বেশি। খরা-বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝার বাড়বাড়ন্ত, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত তো আছেই, তার সঙ্গে বর্ধিত তাপমাত্রার ফলে পঙ্গপাল-সহ নানা পোকামাকড়ের উপদ্রব, ফসলের রোগ ইত্যাদিতে পণ্ড হচ্ছে কৃষিকাজ, জেরবার হচ্ছেন কৃষক। দাবদাহ, অসময়ে অতিবৃষ্টি বা বন্যা, ঝড়-ঝাপটার কারণে তাঁরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গোলায় তোলা সোনার ফসল বাজারজাতও করতে পারছেন না সঠিক সময়ে। ফলে মাথাপিছু খাদ্যের লভ্যতা কমে আসছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন গরিব শ্রমজীবী মানুষ, বেকার, কর্মসংস্থানবিহীন জনতা।

খাদ্যাভাবে ক্ষুধাক্লিষ্ট মানুষ তো অপুষ্টিতে ভুগছেই, কিন্তু সমাজের যে অংশে সেই অর্থে ক্ষুধার সমস্যা নেই, তাদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে লুক্কায়িত ক্ষুধা বা পুষ্টির অভাব। সম্প্রতি বেশ কয়েকটা গবেষণায় জানা গেছে, বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধির ফলে ধান, গম, যব ও বিভিন্ন ডালশস্যে জিঙ্ক, আয়রন ও প্রোটিনের ঘনত্ব কমে গেছে। সারা দুনিয়ার অপুষ্ট শিশুদের বাস যেখানে, সাহারা মরুভূমির নীচের সেই দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চাষবাস ভীষণরকমের ক্ষতির মুখে পড়লেও, আফ্রিকার অধিবাসীদের প্রধান খাদ্যশস্য জোয়ারে অবশ্য এগুলো তেমনভাবে কমেনি। কিন্তু ভারত-সহ যেসব দেশে ভাত-রুটি প্রধান খাদ্য এবং ডাল গরিব মানুষের প্রোটিনের প্রধান উৎস, সেসব দেশে এর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ভিটামিন, খনিজ পদার্থের মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাব মহামারির আকার নিয়েছে, এর ফলে রক্তাল্পতা ও বন্ধ্যাত্ব বাড়ছে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধিও বাড়ছে, তার জন্য আবার ঊনপুষ্টি বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে। সারা বিশ্বে ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া ও শ্বাসনালীর নীচের দিকের সংক্রমণ যত হয় তার ১৩ শতাংশ, যত ম্যালেরিয়া হয় তার ২০ শতাংশ, ডায়রিয়ার ৮ শতাংশের পিছনে দায়ী জিঙ্কের অভাব। আয়রনের অভাবে দুনিয়ার ২৭ শতাংশ শিশু (পাঁচ বছরের কমবয়সি) রক্তাল্পতায় ভুগছে। অনেক দেশেই গ্রামাঞ্চলে ফসল ওঠার আগে ও ফসল ফুরিয়ে যাওয়ার পরে মরশুমি পেশি-ক্ষয় দেখা যায় শিশু ভোলানাথদের। নবান্নে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের দানা পেটে পড়লে কিছুটা পুষ্ট হয় কৃষকের ঘরের শিশুরা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজাত অপুষ্ট শস্যদানায় পেট যদিও বা ভরে, স্ফীতোদর শিশুদের লিকলিকে হাত-পায়ে মাস গজাচ্ছে না।

 

গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো পশ্চিমি সুপারমার্কেট ও ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিগুলোর হাতে পুষ্টিসংক্রান্ত সমস্ত তথ্য ও ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত এবং তারা তাদের বাণিজ্য-সাম্রাজ্য প্রসারের লক্ষ্যে সেই সাম্রাজ্যবাদী পুষ্টি-জ্ঞান বিতরণের মাধ্যমে দক্ষিণ গোলার্ধের খাদ্য উৎপাদকদের কর্মপন্থাকে প্রভাবিত করছে। পুষ্টিবিজ্ঞানকে সমাজবিজ্ঞান থেকে ছিন্ন করে, রাজনৈতিক অর্থনীতি থেকে দূরে সরিয়ে, একটা স্বতন্ত্র বায়োমেডিকেল প্রযুক্তিগত বিষয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। পুষ্টির দায়, অপুষ্টির দায় সবকিছুকেই ব্যক্তিগত বলে হাজির করানো হচ্ছে। হ্যাঁ, ব্যক্তিরও দায়িত্ব আছে, তবে ব্যক্তির জৈবিক প্রয়োজন ও তার সামাজিক জোগানের আন্তঃসম্পর্কই আমাদের স্বাস্থ্যের প্রধান নিয়ামক। এই দুটোর কোনটাকে আলোচনার কেন্দ্রে রাখব আমরা— ব্যক্তিকে, নাকি যে সমাজব্যবস্থায় সে বসবাস করে, তাকে? সমাজ, অর্থনীতি, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে সরিয়ে রেখে শুধুমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক পুষ্টি-অপুষ্টির ন্যারেটিভ খাড়া করবার চেষ্টা করছে কর্পোরেট দুনিয়া তথা ধনতন্ত্র।

অবশ্য এই চেষ্টা আজকের নয়, ১৯৩০-এর দশকে বিশ্ব পুঁজিবাদ যখন চরম সংকটে পড়েছিল, অর্থাৎ ‘দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন’-এর সময়, একদিকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনে বাজার সম্পৃক্ত, অন্যদিকে ভোক্তাদের তা কিনে খাওয়ার সঙ্গতি নেই— এই ব্যবধান কেন হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে লিগ অব নেশনস্ হেলথ অর্গানাইজেশন মাঠে নামে। তাদের সমীক্ষায় উঠে আসে ধনতান্ত্রিক আর্থসামাজিক রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে ক্ষুধা ও অপুষ্টির সরাসরি, প্রত্যক্ষ যোগসূত্রের অকাট্য প্রমাণ। তাদের রাজনৈতিক প্রভুদের চাপে সেই রিপোর্ট তড়িঘড়ি বদলে ফেলে অপুষ্টির কারণ হিসেবে ব্যক্তিমানুষের ভ্রান্ত খাদ্যাভ্যাসকে দায়ী করে নতুন রিপোর্ট পেশ করতে বাধ্য হয় তারা। এভাবেই খাদ্য ও পুষ্টির দ্বিখণ্ডিতকরণ ক্ষুধার বাস্তব কাঠামোগত নির্ধারকগুলোকেই অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে করে দিতে শুরু করে।

 

এর সূত্রপাত তারও আগে থেকে, ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের সময় থেকেই। শিল্পপুঁজির রমরমা ব্রিটিশ কৃষিব্যবস্থাকেও বদলে দিল সে-সময়। ধনীরা উন্নত প্রাণিজ প্রোটিন খাবে বলে পশুপালন বেড়ে গেল, আর খাদ্যযোগ্য শস্য, সবজি, ফল ইত্যাদির চাষ কমিয়ে পশুখাদ্যের চাষ বাড়িয়ে দেওয়া হল। ধনীদের রুটি বানানোর জন্য সবচেয়ে ভালো গুণমানের গম, ময়দা, আটা সরিয়ে রেখে যে অবশেষ পড়ে থাকত, তা দিয়ে তৈরি পাঁউরুটি গরিবের পাতে পড়ত। পাঁউরুটি ছাড়া বিশেষ কিছু কিনে খাওয়ার মতো মজুরি তারা পেত না। সবুজ শাকসবজি ও ফলের চাষ কম হওয়ায় তা মহার্ঘ্য হল। দুধ ও ডেয়ারি প্রোডাক্টেরও দাম বেড়ে গেল। নিম্নমানের আটা-ময়দায় তৈরি পাঁউরুটি, অর্থাৎ কার্বোহাইড্রেট। লীলা মজুমদারের ‘টং লিং’-এ কালো মাস্টার বলেছেন, “কে বলেছে পাঁউরুটি আটা-ময়দার তৈরি? পষ্ট দেখতে পাচ্ছি শুধু কতকগুলো ফুটো দিয়ে তৈরি। ময়দা দিয়ে কতকগুলো ফুটো একসঙ্গে জুড়ে দিয়েছে, সে কখনও খাওয়া যায়?”

মার্কস তাঁর ক্যাপিটাল গ্রন্থে লিখেছেন—

এর উপর যোগ হল আরেক বিপদ। কৃষিকাজে পুঁজি প্রবেশ করায় প্রযুক্তি উন্নত হল ঠিকই, পাশাপাশি বহু মানুষ চাষের কাজ হারিয়ে, কৃষি থেকে মুক্ত হয়ে শিল্পের মজুত বাহিনীতে যুক্ত হল। ফলে তার আর পেট ভরানোর মতো পাঁউরুটিও জুটল না। অন্যদিকে, পুঁজিবাদ কৃষিতে পা দিয়ে সর্বাধিক মুনাফার জন্য একই জমিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে বছরে তিন-চারবার ফসল তুলতে থাকায় মাটি ক্রমশ দুর্বল, কৃপণ হতে শুরু করল। পুঁজির মালিকও ছাড়ার পাত্র নয়, তার আরও আরও মুনাফা চাই, ফলে সে চাষের জমি বাড়াতে গিয়ে বনভূমি ধ্বংস করতে থাকল।

পরিবেশ, জলবায়ু— সবকিছুই মুনাফার জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করল এই সময় থেকে। জলবায়ু বিজ্ঞানে এই সময় থেকেই অ্যান্থ্রোপোসিনের শুরু ধরা হয়। আসলে তা ক্যাপিটালোসিন। অর্থাৎ, পরিবেশ ও জলবায়ুর উপর পুঁজির খোদকারি।

 

হাজার হাজার বছর ধরে মানবজাতি প্রায় ছ-হাজার প্রজাতির উদ্ভিজ্জ খাদ্যের চাষ করে আসছে। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট বানিয়াদের আধিপত্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে মাত্র নয়টি ফসলের চাষ হচ্ছে মোট কৃষি উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশ। ৯০ শতাংশ মানুষের খাদ্যতালিকায় ঘোরাফেরা করে ১২ থেকে ২০টি প্রজাতির উদ্ভিজ্জ ফসল। মানুষের ৬০ শতাংশ ক্যালরি আসে তিনটি মাত্র শস্য থেকে— চাল, গম এবং ভুট্টা। বর্ধিত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে অ্যাসিড বৃষ্টি বাড়ছে, বৃষ্টিপাত কমছে, মাটির উর্বরতা কমছে, বর্ধিত দাবদাহের ফলে কৃষক মরছে, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে মানুষ, প্রাণী এবং গাছপালার রোগভোগ বাড়ছে— এই সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে গত চার দশকে বিশ্বে কৃষি উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ, খাদ্যশৃঙ্খল বিশ্বায়িত হয়েছে।[2] নিরামিষাশী হওয়ার চল ক্রমবর্ধমান হওয়া সত্ত্বেও, এশিয়া এবং আফ্রিকায় ১৯৬৪ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে মাথাপিছু মাংস খাওয়া বেড়েছে বছরে ২০ কেজি হিসেবে।[3] তারপরেও দুনিয়াজুড়ে বাড়ছে ক্ষুধা, বাড়ছে অপুষ্টি। তাহলে কি ‘খাচ্ছে, কিন্তু গিলছে না?’ তা নয়। এখানেই আসছে বৈষম্যের প্রশ্ন। ধনী দেশগুলির বাসিন্দারা গরিব দেশগুলির বাসিন্দাদের তুলনায় ছয়গুণ বেশি দুগ্ধজাত খাবার এবং নয়গুণ বেশি ডিম খাচ্ছে।[4]

 

একদিকে ধনতান্ত্রিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্যাভাব, অপুষ্টি বাড়ছে, অন্যদিকে পুঁজিবাদী খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া শুধু বর্ধিত মাত্রায় অধিক ক্যালরিযুক্ত খাদ্যসামগ্রীই উৎপাদিত করছে না, সেই সামগ্রীর চাহিদা ও ক্রমবর্ধমান বাজারও তৈরি করছে। সেই বাজারে প্রয়োজনের ভিত্তিতে নয়, ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ঠিক হয় কে কী খেতে পাবে, কতটা খেতে পাবে। খাদ্য ক্রমশ বেশি বেশি মুনাফা লোটার বস্তু হয়ে উঠছে, বাজার ধরার জন্য দেশি-বিদেশি পুঁজির কারবারীরা আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। সংগঠিত বৃহৎ শিল্পক্ষেত্রের হাতে বাজারের দখল চলে যাওয়ার ফলে অসংগঠিত, ছোট-মাঝারি উৎপাদক ও ব্যবসাদাররা ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে। ব্র্যান্ডেড প্যাকেটজাত, প্রক্রিয়াকৃত খাদ্যের প্রতি শহুরে ও গ্রামীণ উভয় ধরনের ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করতে একদিকে ব্র্যান্ডগুলো পৌঁছে যাচ্ছে শহরের বস্তি, মফস্বলের অলিগলি ও প্রত্যন্ত গ্রামের চায়ের দোকানেও, অন্যদিকে অবৈজ্ঞানিক দাবি-সহ বর্ণময় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্র্যান্ড-সচেতনতা নির্মাণ। এই দুই আগ্রাসী বিপণন কৌশল নিয়েছে কর্পোরেট হাউসগুলো। এর ফলে একদিকে এই প্রোডাক্টগুলো সেইসব খাদ্যবস্তুকে প্রতিস্থাপিত করছে, যেগুলো এ-যাবৎকাল অব্দি সস্তা, সহজলভ্য ও পুষ্টিকর ছিল, অন্যদিকে কৃষিক্ষেত্রে বেসরকারি থাবা পড়ায় সেইসব পুষ্টিকর খাদ্যবস্তুও আর সস্তা, সহজলভ্য থাকছে না। একদিকে অল্পবয়সিদের রঙিন, চকচকে ফুড প্রোডাক্ট, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ফুড পার্কে আকৃষ্ট করবার কৌশল, অন্যদিকে বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে কাজের ন্যূনতম সময় ১০-১২ ঘন্টা, কখনও তারও বেশি হওয়ার ফলে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির হাতে সবজি কেটে, মশলা বেটে রান্না করবার সময় ও কর্মশক্তি অবশিষ্ট থাকছে না। ফলে তাদের অনলাইনে ফাস্ট ফুড, প্রসেসড ফুড, রেডি-টু-ইট খাবার আনিয়ে খেতে কার্যত বাধ্য করা হচ্ছে। এই দুই কৌশলে বাজার বাড়িয়ে মুনাফা লুটছে ধনতন্ত্র। ভারতে অনলাইন এফএমসিজির বাজার ২০১৭-তে ছিল ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের, ২০২০-তে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে[5], এ-বছর তা ১০০ বিলিয়নে পৌঁছবে।[6] একদিকে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, অসাম্য, বেকারত্ব, মজুরি ও বেতনে কোপ, অন্যদিকে কৃষি ও খাদ্য সরবরাহকে লাভের ক্ষেত্রে পরিণত করায় দিন দিন, বেশি বেশি মানুষ যথেষ্ট পরিমাণে উন্নত গুণমানের পুষ্টিকর খাবার কিনতে না পেরে ঊনপুষ্টিতে ভুগছেন। ফাস্ট ফুড, এনার্জি ড্রিঙ্ক, হেলথ ড্রিঙ্ক, প্রসেসড্ ফুড, প্যাকেজড্ ফুড, রিফাইন্ড ফুড, হাই-ক্যালরি ফুডে অভ্যস্ত করিয়ে দিয়ে স্থূলত্ব ও তজ্জনিত উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ, কিডনির রোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সারের কবলে ফেলা হচ্ছে বেশি বেশি মানুষকে। সুতরাং এ-কথা অত্যুক্তি হবে না যে, যে অপুষ্টির প্রশস্ত বর্ণচ্ছটার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, স্পষ্টতই মুনাফাসর্বস্ব ধনতন্ত্র ও আগ্রাসী উদার অর্থনীতিতে চলা রাষ্ট্রের তথা সরকারের অবদান।

 

কার্ল মার্কস তাঁর Grundrisse: Foundations of the Critique of Political Economy গ্রন্থে আদিম মানব থেকে আধুনিক মানুষের উৎপাদন পদ্ধতির ঐতিহাসিক বিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে খাদ্যগ্রহণের রীতির বিবর্তনের তুলনা টেনে লিখেছেন—

যে খিদের নিবৃত্তি হয় ছুরি ও কাঁটাচামচ সহযোগে রান্না করা সুস্বাদু মাংস দিয়ে, আর যে খিদেতে কোনওমতে নখ, হাত আর দাঁত দিয়ে কাঁচা মাংস ছিঁড়ে গবগব করে গলাধঃকরণ করতে হয়— দুটো কিছুতেই এক নয়। উৎপাদন কেবল সামগ্রীই উৎপন্ন করে না, তা ভোগের রীতিও নির্ধারণ করে— শুধু বস্তুগতভাবে নয়, বিষয়ীগতভাবেও। এইভাবে উৎপাদন নিজেই ভোক্তার জন্ম দেয়। উৎপাদন কেবল প্রয়োজনের সামগ্রীই নয়, প্রয়োজনকেও সৃষ্টি করে।


[1] পাঠক আরও বিস্তারিত তথ্যের জন্য WFP-র Ending Hunger পৃষ্ঠাটি পরিদর্শন করতে পারেন।
[2] Niles et al, 2017; Van Braun et al, 2018.
[3] Vermeulen et al, 2020.
[4] Herforth et al, 2019.
[5] 40% of FMCG purchases in India to go online as segment approaches $45 billion. Consultancy.in.
[6] FMCG in India. Wikipedia.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5044 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...