
সুমিত মজুমদার
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে জটিল স্বাস্থ্যসংকট তৈরি হয়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি সুসংহত ও বহুস্তরীয় পদক্ষেপ, যেখানে নীতি নির্ধারণ এবং অর্থায়নের মধ্যে নিবিড় সমন্বয় অপরিহার্য। শুধু বাজেট-বরাদ্দ বাড়ালেই চলবে না; এই অতিরিক্ত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা এবং প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের জন্য সুস্পষ্টভাবে বরাদ্দ করতে হবে
এপ্রিল পড়তে পড়তেই রঞ্জন কুমারদের রোজনামচা গিয়েছে আমূল বদলে। উত্তর বিহারের সুপৌল জেলা থেকে বছর দশেক আগে কাজের খোঁজে গাজিয়াবাদের আজাদ কলোনিতে এসে ঘাঁটি গেড়েছিল সাতজনের একটি দল। বৈশালী, রাজনগর এক্সটেনশন ইত্যাদি নানা জায়গায় নির্মীয়মাণ বহুতলগুলিতে টাইলস বসানো ও রঙের কাজের সঙ্গে তারা জুড়ে গিয়েছিল কোভিডের আগেই। সেই ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তার দিনগুলো কোনওরকমে কাটিয়ে ওঠার পর থেকেই আবার এক নতুন সমস্যার সূত্রপাত।
মার্চের শেষ থেকে জুলাইয়ের গোড়া অবধি সকাল আটটা থেকেই ঘোলাটে আকাশটা থেকে যে হলকা নামে, তাতে কংক্রিটের স্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাজ করাই দুষ্কর হয়ে ওঠে। তবুও খররোদে মাঠেঘাটে কাজ করার প্রাচীন জিনস্মৃতি নিয়ে চলা রঞ্জন, ইসমাইল, পরবেশরা প্রথম প্রথম অতটা গা করেনি— ভিজে গামছা পেঁচিয়ে সামলে নেওয়ার কথাই ভেবেছিল।
কিন্তু বিপদ কখন, কীভাবে আসে, তা বলা মুশকিল। দু-বছর আগে যেদিন তিন নম্বর টাওয়ারের তেরো তলার বাইরের দেওয়ালে প্রাইমার লাগাতে লাগাতে ইসমাইলের উনিশ বছরের ভাইপোটা হিট স্ট্রোকে ধপ করে উলটে পড়ে কেউ কিছু বোঝার আগেই চিরঘুমে চলে যায়— সেদিন থেকেই আতঙ্কটা যেন একটু একটু করে চেপে বসেছে।
আপাতত ওদের সাইটটার মতো আরও বেশ কিছু জায়গায় শুরু হয়েছে দুই শিফটের নতুন রুটিন— ভোর চারটে থেকে সকাল নটা, আবার বিকেল চারটে থেকে রাত নটা। মাঝের সময়টা কাটে বেসমেন্টের সুপারভাইজারের ঘরের সামনে কুলার চালিয়ে বসে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে, বলা মুশকিল।
গতবছর শাকিল আর মনোজ রাম তো কদিনেই এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে এক সপ্তাহের জন্য দেশে গিয়ে আর ফিরতেই পারেনি। যেটুকু সামান্য রোজগার তারা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পেরেছিল, তার প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে গিয়েছিল স্থানীয় ডাক্তারের ফি আর ওষুধপত্রে।
বিস্তৃত হচ্ছে বিপদের ছায়া
ওপরের ঘটনাটার কিছু নামধাম কাল্পনিক হলেও বাকিটার সত্যতা নিয়ে আজ আর প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। ডাউন টু আর্থ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের হিসেব অনুযায়ী, এ-যাবৎকালের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গত বছরে ভারতে মোট ৩২২ দিন দেশের কোথাও না কোথাও বিপজ্জনক আবহাওয়া বা চরম আবহাওয়ার ঘটনা (extreme weather events) দেখা গিয়েছে। গত তিন বছরে এই ধরনের বিরূপ আবহাওয়া কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে প্রাণহানির ঘটনা একলাফে বেড়ে গিয়েছে ১৫ শতাংশ।[1]
বিশ্ব-জনস্বাস্থ্যের ওপর গবেষণার জন্য স্বীকৃত অন্যতম শ্রেষ্ঠ পত্রিকা ল্যান্সেট-এ গত বছর অক্টোবরে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, জলবায়ুর এই খামখেয়ালিপনার বিপদ দুনিয়াজোড়া হলেও ভারতের ক্ষেত্রে এর চরিত্র এবং বিশেষ করে জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব অনেক বেশি আতঙ্কজনক। ২০২৩ সালে একজন গড়পড়তা ভারতীয় বছরে প্রায় ২৪০০ ঘণ্টা— অর্থাৎ ১০০ দিনের মতো— এমন তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হয়েছেন[2], যখন সাধারণ দৈনন্দিন কাজ, যেমন বাজারে যাওয়া বা বাইরে হাঁটাচলাও স্বাস্থ্যের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল ইসমাইলের ভাইপোর বা মনোজের ক্ষেত্রে।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু তাপপ্রবাহেই সীমাবদ্ধ নয়। অসময়ে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপও বেড়েই চলেছে। এর ফলে কেবল পরিকাঠামোর ক্ষতি বা কৃষিক্ষেত্রে সংকটই তৈরি হচ্ছে না, জনস্বাস্থ্যের ওপরও নেমে আসছে একের পর এক আঘাত।
বন্যার পর জলবাহিত রোগ— যেমন কলেরা, টাইফয়েড, ডায়রিয়া— এর প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার, পরিবর্তিত তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের ধরনে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়ার মতো ভেক্টর-বাহিত রোগের বাহক মশা ও অন্যান্য কীটদের বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, ফলে এই রোগগুলির ভৌগোলিক বিস্তার ও প্রাদুর্ভাব— দুই-ই বাড়ছে।
শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণের সমস্যা তো ছিলই, তার সঙ্গে দাবানলের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মরশুমি ধুলোঝড় পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভোগা মানুষের ওপর।
পরোক্ষভাবে, কৃষিতে ক্ষতির ফলে খাদ্যসুরক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে, বাড়ছে অপুষ্টিজনিত সমস্যা— বিশেষত শিশু ও মহিলাদের মধ্যে। এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগে শিকার হওয়া, ভিটেমাটি হারানো কিংবা জীবিকা হারানোর মানসিক চাপ থেকেও উদ্বেগ, অবসাদের মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার হার বেড়ে চলেছে।
রঞ্জন কুমারদের কপালে দুশ্চিন্তার ছায়াও তাই ক্রমাগত চওড়া হতে থাকে।
স্বাস্থ্য-পরিকাঠামো ও অর্থনীতির ওপর চাপ
যে-দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে, জীবিকার প্রয়োজনে যাঁদের দিনের অধিকাংশ সময় কাটে রোদ-ঝড়-জল মাথায় করে খোলা আকাশের নীচে, সেখানে এই বিপদ আর কেবল স্বাস্থ্যের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই।
বিভিন্ন গবেষণা দেখাচ্ছে, শুধুমাত্র তাপপ্রবাহের কারণেই গত কয়েক বছরে ভারতে বার্ষিক গড়ে প্রায় ২৫০ কোটি শ্রমদিবস নষ্ট হয়েছে, যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক দেড় লক্ষ কোটি টাকা।[3] জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য প্রভাবগুলিও যদি এতে যুক্ত করা যায়, তাহলে এই সামগ্রিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (জিডিপি)-র প্রায় ৫ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছতে পারে বলে বিভিন্ন রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
দেশের অর্থনীতির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব আজ আর কোনও অলীক কল্পনা নয়, বরং এক কঠোর বাস্তবতা।
এই বহুমুখী স্বাস্থ্য-সংকট ভারতের ইতিমধ্যেই সীমিত স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে। একদিকে যেমন রোগের প্রকোপ বাড়ছে, তেমনই চরম আবহাওয়ার ঘটনায় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিরও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বাড়ছে। দেশের প্রায় দু-লক্ষ চিকিৎসাকেন্দ্র এমন এলাকায় অবস্থিত, যেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যে কোনও সময় ব্যাহত হতে পারে স্বাভাবিক পরিষেবা, এবং সাধারণ প্রয়োজনে বিপদে পড়তে পারেন সেই সব অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক মানুষ।[4] ইউনিসেফ এবং একটি আন্তর্জাতিক অসরকারি সংস্থার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেশের প্রায় চল্লিশ শতাংশ জেলার স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির নিরিখে ‘অসুরক্ষিত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।[5]
জনস্বাস্থ্যের এই অনিশ্চিত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, এখন সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন দেশের স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর আমূল সংস্কার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার অর্থ হবে— স্বাস্থ্যনীতি ও পরিকল্পনার অভিমুখ সম্পূর্ণভাবে পাল্টে ফেলা।
এর জন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত সম্পদ, প্রশিক্ষিত কর্মী এবং মজবুত পরিকাঠামো— যার প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারত এখনও অনেকটা পিছিয়ে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় ভারতের জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির ২ শতাংশেরও কম (২০২৪ অর্থবর্ষের বাজেট অনুযায়ী[6]), যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা ৫ শতাংশের তুলনায় অনেকটাই কম। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে দেশের অর্থনীতিতেই যে বড় ধাক্কা লাগতে চলেছে, তার পূর্বাভাস তো ইতিমধ্যেই মিলতে শুরু করেছে। সেই প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন উঠছে— এই ভাঁড়ারে যে আরও টান পড়বে না, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়?
স্বাস্থ্য অর্থায়নের গোলকধাঁধা
এখানেই এসে হাজির হচ্ছে স্বাস্থ্য অর্থায়নের (Health Financing) জটিল প্রশ্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপর যে বহুমাত্রিক প্রভাব পড়ছে, তা মোকাবিলার জন্য ঠিক কত পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন? সেই অর্থ আসবে কোথা থেকে? এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ— তা কীভাবে এবং কোথায় খরচ হবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা অত্যন্ত জরুরি।
ভারতের মতো বিশাল ও বহুধাবিভক্ত দেশে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের অপ্রতুলতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বটে, তবে সেটাই একমাত্র বিচার্য বিষয় কিন্তু নয়। আজও স্বাস্থ্যপরিষেবার বিভিন্ন খাতে যে পদ্ধতিতে অর্থ বন্টন হয়, মান্ধাতা আমলের সেই ব্যবস্থারও আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রচলিত মাথাভারী বাজেটব্যবস্থায় বরাদ্দের সিংহভাগই চলে যায় বড় হাসপাতালগুলির দিকে। অথচ, জলবায়ু সংবেদনশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে দরকার একটি জেলাভিত্তিক, প্রাথমিক চিকিৎসা-কেন্দ্রিক জনস্বাস্থ্য বাস্তুতন্ত্র। এবং সেই অনুযায়ী আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও আরও বেশি করে বিকেন্দ্রীকরণ করে স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাতে ছেড়ে রাখার সপক্ষে চিন্তাভাবনা করার সময় কিন্তু এখনই।
বর্তমানে ভারতের স্বাস্থ্য অর্থায়নের মডেল মূলত রোগ নিরাময়কেন্দ্রিক (curative care)। অর্থাৎ, কোনও ব্যক্তি অসুস্থ হওয়ার পর তাঁর চিকিৎসা খরচ বহনের দিকেই বেশি জোর দেওয়া হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান বাস্তবতায় এখন প্রয়োজন তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস ও সতর্কতা জারি, নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা, ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বিস্তার, জলবায়ু সহিষ্ণু স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলা— এই সব প্রতিরোধমূলক (preventive) ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
এমন কার্যকর প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে চাই ধারাবাহিক ও লক্ষ্যভিত্তিক আর্থিক সংস্থান। এই স্বাস্থ্য পরিষেবা ও প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাগুলিকে এমন একটি সংবেদনশীল, দ্রুত সাড়া দিতে সক্ষম কাঠামোর মধ্যে না আনতে পারলে— এবং তদনুযায়ী পর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দ নিশ্চিত না করা গেলে— জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্রমবর্ধমান সংকটের হাত থেকে জনস্বাস্থ্যকে যেমন রক্ষা করা যাবে না, তেমনই সামাজিক শান্তি ও সহাবস্থান রক্ষাও হয়ে উঠবে দুঃসাধ্য।
‘প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা’ (PM-JAY)-র মতো স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পগুলি নিঃসন্দেহে দরিদ্র মানুষের হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ কমাতে কিছুটা সহায়ক হয়েছে। তবে এই প্রকল্পের সীমাবদ্ধতাও স্পষ্ট।
প্রথমত, এটি মূলত হাসপাতালে ভর্তির খরচই কভার করে; আউটডোর চিকিৎসা বা প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা প্রায় নেই বললেই চলে।
দ্বিতীয়ত, রঞ্জন কুমারদের মতো বহু অভিবাসী শ্রমিক বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী আজও এই প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে ধরনের পরোক্ষ স্বাস্থ্যসংকট তৈরি হচ্ছে— যেমন অপুষ্টিজনিত সমস্যা, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অবসাদ বা উদ্বেগ— এই প্রকল্প তাদের কোনও কভারেজ দেয় না।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হল— জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার জন্য জাতীয় বা রাজ্যস্তরে এখনও কোনও সুনির্দিষ্ট বাজেট-বরাদ্দ বা স্বতন্ত্র আর্থিক পরিকল্পনা চোখে পড়ে না। স্বাস্থ্য ও জলবায়ু— এই দুটি ক্ষেত্রের বাজেট সাধারণত আলাদা খাতে বরাদ্দ হয়, এবং তাদের মধ্যে প্রায় কোনও সমন্বয় থাকে না। ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ‘ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স’— অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সহ্য করার ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য যেসব বিনিয়োগ জরুরি, তা কার্যত অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে।
এগিয়ে যাওয়ার পথ: নীতি ও অর্থায়নের সমন্বয়
এই জটিল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন একটি সুসংহত ও বহুস্তরীয় পদক্ষেপ, যেখানে নীতি নির্ধারণ এবং অর্থায়নের মধ্যে নিবিড় সমন্বয় অপরিহার্য। প্রথমত, স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা জরুরি— এক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা হওয়া উচিত মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (GDP) অন্তত পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছনো। তবে শুধু বাজেট-বরাদ্দ বাড়ালেই চলবে না; এই অতিরিক্ত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা এবং প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমের জন্য সুস্পষ্টভাবে বরাদ্দ করতে হবে।
একইসঙ্গে, জাতীয় ও রাজ্যস্তরের জলবায়ু পরিবর্তন অ্যাকশন প্ল্যানগুলিতে (SAPCC) জনস্বাস্থ্যের প্রসঙ্গটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থান নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। অন্যদিকে, স্বাস্থ্য নীতিমালার প্রতিটি স্তরে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনায় রেখে প্রতিরোধ ও অভিযোজনের (adaptation) কৌশল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিনিয়োগের মূল অভিমুখ হওয়া উচিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার দিকে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির সক্ষমতা বৃদ্ধি, রোগ নজরদারি ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও বিস্তার, নিরাপদ পানীয় জলের সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিসর বাড়ানো এবং তাপপ্রবাহ বা অন্যান্য চরম আবহাওয়া সংক্রান্ত জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা জরুরি।
পাশাপাশি, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকেও জলবায়ুর অভিঘাত-সহনশীল করে তোলার প্রয়োজনীয়তা ক্রমবর্ধমান। নতুন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ অথবা পুরনো পরিকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে ডিজাইনের পর্যায় থেকেই সেগুলিকে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ ইত্যাদি চরম আবহাওয়ার জন্য উপযোগী করে তোলার ভাবনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর জন্য পরিকাঠামো খাতে অতিরিক্ত, তবে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করা দরকার।
অর্থায়নের উৎসকেও বহুমুখী করে তুলতে হবে। শুধু জাতীয় বা রাজ্য বাজেটের উপর নির্ভর না করে, আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল— যেমন Green Climate Fund— থেকে স্বাস্থ্য অভিযোজনের জন্য অর্থ সংগ্রহে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি, কার্বন ট্যাক্স বা পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট সারচার্জ থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের একটি অংশ জনস্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করার সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা যেতে পারে। কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা (CSR) প্রকল্পের মাধ্যমে এই খাতে অধিকতর অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা জরুরি।
কার্যকর পরিকল্পনা ও মোকাবিলার জন্য চাই সঠিক তথ্য ও জ্ঞান। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের স্থানীয় স্বাস্থ্য-প্রভাব আরও গভীরভাবে বুঝতে এবং প্রেক্ষিত অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট সমাধান খুঁজে পেতে গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহে পর্যাপ্ত বরাদ্দ জরুরি।
সর্বোপরি, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী— যেমন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, প্রান্তিক কৃষক, মৎস্যজীবী এবং অন্যান্য দুর্বল শ্রেণি— তাঁদের জন্য একটি শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা বলয় গড়ে তুলতে হবে। সেইসঙ্গে, তাঁদের জন্য সহজলভ্য স্বাস্থ্যবিমা পরিষেবা নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।
শেষের কথা
রঞ্জন কুমার বা ইসমাইলের ভাইপোর মতো ঘটনাগুলি নিছক পরিসংখ্যান নয়— এগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের কঠোর বাস্তবের প্রতিচ্ছবি, যা ভারতের জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কেবল পরিবেশগত পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়; স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে মজবুত করা এবং বিশেষত স্বাস্থ্য অর্থায়নের কাঠামোকে আমূল বদলে ফেলা এখন সময়ের দাবি।
জলবায়ু পরিবর্তনের স্বাস্থ্যগত প্রভাবগুলিকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে স্বীকার করে, নীতি ও অর্থায়নের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি সুস্থ ও সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে এগিয়ে যাওয়াই এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই লড়াইয়ে আর এক মুহূর্ত বিলম্বের কোনও অবকাশ নেই।
[1] Basu, Jayanta. India suffered record breaking health impacts due to climate change during last decade: Lancet report. Down to Earth. Oct 31, 2024.
[2] The 2024 Global Report of the Lancet Countdown. LANCET.
[3] দ্রষ্টব্য, টীকা ২।
[4] দ্রষ্টব্য, টীকা ১।
[5] Wadhawan, Shreya; Bajpai, Aryan; Pandey, Vanya and Chitale, Dr Vishwas. How Can India Make its Health Sector Climate Resilient? CEEW. Feb 20, 2025.
[6] প্রেস বিজ্ঞপ্তি। অর্থমন্ত্রক, ভারত সরকার। জুলাই ২২, ২০২৪।
*লেখক ইংল্যান্ডের ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর হেল্থ ইকনমিক্সে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্মরত