শ্রমজীবী শ্রেণির উপর তাপের প্রভাব: আমাদের পরিকল্পনা কোথায়?

সৌম্য দত্ত

 


ভারতের প্রায় ১৪৬ কোটি (১.৪৬ বিলিয়ন) মানুষের মধ্যে ৪০ কোটিরও বেশি মানুষ এমন দরিদ্র শ্রমজীবী শ্রেণিভুক্ত, যাঁরা চরম আবহাওয়ার/জলবায়ু পরিস্থিতিতেও ন্যূনতম জীবনধারণ করতে শারীরিকভাবে শ্রম করতে বাধ্য হন। এর মধ্যে রয়েছে নির্মাণশ্রমিক, রাস্তার দোকানদার, কৃষিশ্রমিক, খালাসি, রিকশাচালক, ক্ষুদ্র মৎস্যবিক্রেতা, গিগ কর্মী, গৃহশ্রমিক, স্যানিটেশন কর্মী...। চরম জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই মানুষগুলিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি, কারণ পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝবার মতো রসদ তাঁদেরই সবচেয়ে কম

 

বিশ্ব-উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংকট এখন মানবতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং এর থেকে কোনও মুক্তির সম্ভাবনাও দেখ যাচ্ছে না। কারণ প্রায় সব সরকার এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলি গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ অত্যন্ত কমিয়ে আনার বিষয়ে যা সব পদক্ষেপ নিচ্ছে, প্রয়োজনের তুলনায় তাকে অপ্রতুল বললে কিছুই বল হয় না। ফলে যা হয়— সবচেয়ে আশঙ্কার মুখোমুখি বিশ্বব্যাপী সকল দুর্বল সম্প্রদায়ের মানুষজন। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সরকারগুলির প্রতিশ্রুতি এতটাই দুর্বল যে আশঙ্কা করা হচ্ছে পৃথিবী ২.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে শতাব্দীর শেষের দিকে পৌঁছাতে চলেছে।[1] ‘রেকর্ড ভাঙা গরম বছর’-এর মিছিলে সামিল হয়েছে সমস্ত সাম্প্রতিক বছরগুলোই— ২০২৩ এবং ২০২৪ সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছে। ২০২৪ সালটি ছিল প্রাক-শিল্প বিপ্লবের গড় তাপমাত্রার (১৮৫০-১৯০০ সালের মধ্যে গড়) চেয়ে প্রায় ১.৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণ।[2] দুঃখজনকভাবে, এরকম একটি জলবায়ু বিপর্যয় তীব্র গতিতে এগিয়ে এলেও, গ্লোবাল গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ২০১৫ সালের বহুল প্রচারিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তি (পিএ)-র পরও বেড়েই চলেছে।

ভারতের প্রায় ১৪৬ কোটি (১.৪৬ বিলিয়ন) মানুষের মধ্যে ৪০ কোটিরও বেশি মানুষ এমন দরিদ্র শ্রমজীবী শ্রেণিভুক্ত, যাঁরা চরম আবহাওয়ার/জলবায়ু পরিস্থিতিতেও ন্যূনতম জীবনধারণ করতে শারীরিকভাবে শ্রম করতে বাধ্য হন। এর মধ্যে রয়েছে নির্মাণশ্রমিক, রাস্তার দোকানদার, কৃষিশ্রমিক, খালাসি, রিকশাচালক, ক্ষুদ্র মৎস্যবিক্রেতা, গিগ কর্মী, গৃহশ্রমিক, স্যানিটেশন কর্মী…। চরম জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই মানুষগুলিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি, কারণ পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝবার মতো রসদ তাঁদেরই সবচেয়ে কম। জলবায়ু পরিবর্তনের দ্রুত বাড়তে থাকা প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি হল তাপ-তরঙ্গ এবং তাপসূচকের বৃদ্ধি এবং একই সঙ্গে বাতাসের তাপমাত্রা এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা বৃদ্ধির প্রভাব।

 

তাপ-তরঙ্গ এবং তাপসূচক এক প্রধান হুমকি

গত কয়েক বছরে, তাপ-তরঙ্গ (এবং কম প্রচারিত কিন্তু আরও মারাত্মক— তাপসূচক) গঙ্গানদী অববাহিকা, উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু অংশে ক্রমাগতভাবে মানুষের ক্ষতি করছে এবং এমনকি প্রাণহানি ঘটাচ্ছে। এ-বিষয়ে কিছু গবেষণা করা হয়েছে, এবং বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রকাশনা এই আশঙ্কার ভয়াবহতা তুলে ধরেছে। তাপ-তরঙ্গের দিন বৃদ্ধি এবং তাপ-তরঙ্গ (তাপসূচক-সহ) থেকে মৃত্যু বৃদ্ধি নিয়ে এরকমই একটি সুপরিচিত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল “Science Advances” জার্নালে।[3]

 

ভারতের গ্রীষ্মকালের একটি সাধারণ ও বিস্তৃত তাপ-তরঙ্গ পরিস্থিতির মানচিত্র উপরের মতোই দেখায়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, যেসব অঞ্চল সবচেয়ে বেশি তাপপ্রবাহের শিকার, সেগুলির অনেকগুলিতেই জনঘনত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি এবং সেখানে শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষও সংখ্যায় অনেক বেশি।

আজকের পৃথিবীতে বিশ্বের প্রায় ৫৬ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে, এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির শহরগুলিতে বসবাসকারী মানুষের একটি বড় অংশই গরিব/শ্রমজীবী শ্রেণির অন্তর্গত। জলবায়ু পরিবর্তনের নানা প্রভাবের মধ্যে শহুরে গরিব মানুষরা তাপ-তরঙ্গের দ্রুত বৃদ্ধি, বিপজ্জনক তাপসূচক এবং শহুরে বন্যার মতো ঘটনার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

আর যখন গড় তাপমাত্রা বেড়ে যায়, তখন শহরগুলো আরও বেশি গরমে পুড়ে যায়— তার একটি প্রধান কারণ হল ‘আর্বান হিট-আইল্যান্ড এফেক্ট’, যা শহরের তাপমাত্রাকে আশপাশের খোলা জায়গার তুলনায় প্রায় ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি করে তোলে। আর্বান হিট আইল্যান্ড প্রভাব বা শহুরে তাপদ্বীপ প্রভাব দেখা দেয় মূলত শহরজুড়ে স্টিল, কংক্রিট, কাচ ইত্যাদির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে, সঙ্গে রয়েছে পিচঢালা ও কংক্রিটের রাস্তা— যা তাপ শোষণ করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে তা ধরে রাখে।

কিছু হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভারতের প্রায় ৫৫ কোটিরও বেশি মানুষ, অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৭–৩৮ শতাংশ, শহর বা শহরসংলগ্ন অঞ্চলে বাস করছিলেন।[4] এই সংখ্যাটা যে-কোনও বিচারে অত্যন্ত বড়। এই ৫৫ কোটির বেশি মানুষ— ধনী হোক বা দরিদ্র (সম্প্রতি বেঙ্গালুরুর বিধ্বংসী বন্যা একটি দৃষ্টান্তমাত্র)— তাঁরা প্রত্যেকেই ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে শ্রমজীবী ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষেরা এসব প্রভাবের মুখে অনেক বেশি অসহায়, কারণ তাঁদের তা মোকাবেলার সামর্থ্য ও প্রস্তুতি তুলনায় অনেক কম।

বিশ্বজুড়ে গড় তাপমাত্রা বাড়ার ফলে যেমন তাপপ্রবাহের ঘটনা বাড়ছে, তেমনি বেড়ে চলেছে অতিভারী বৃষ্টিপাত ও বন্যার ঘটনা। কিছু ‘এক্সট্রিম ইভেন্ট অ্যাট্রিবিউশন’ গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে ভারতে ও পাকিস্তানে যে চরম তাপপ্রবাহ দেখা দিয়েছিল, তা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৩০ গুণ বেশি সম্ভব হয়ে উঠেছিল। এটি আবার ‘লা নিনা’ বছরের ঘটনা— যে বছর সাধারণত তুলনায় শীতল হওয়ার কথা।

এই প্রেক্ষাপটে ২০২৩–২৪ সাল আমাদের জন্য কী নিয়ে হাজির হবে, সে নিয়ে আমরা আশঙ্কায় ছিলাম। বিশেষ করে, যখন জুন–জুলাই ২০২৩ থেকে ‘এল নিনো’ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল— যা বায়ুমণ্ডলে আরও তাপ ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমাদের আশঙ্কা সত্য হতে শুরু করেছিল ফেব্রুয়ারি থেকেই, যখন ফেব্রুয়ারির অকাল গরমে ফসলের ক্ষতি, জলসম্পদের তীব্র সংকট ইত্যাদি ঘটনা ঘটতে শুরু করেছিল।[5]

 

হিটওয়েভ বা তাপতরঙ্গ কী?

ভারতে, কোনও অঞ্চলে কবে থেকে এবং কখন হিটওয়েভ (তাপপ্রবাহ) পরিস্থিতি শুরু হয়েছে, তা নির্ধারণ ও ঘোষণা করে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (India Meteorological Department – IMD)। হিটওয়েভ কবে ঘোষণা করা হয়?

আইএমডি মূলত সর্বাধিক তাপমাত্রা (Maximum Temperature) কত উঠেছে, তার ভিত্তিতে হিটওয়েভ নির্ধারণ করে— সমতলভূমিতে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, উপকূলীয় অঞ্চলে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং পাহাড়ি এলাকায় ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রা কমপক্ষে দুই দিন ধরে বজায় থাকলে, এবং তা সংশ্লিষ্ট সময়ের স্বাভাবিক তাপমাত্রার তুলনায় কমপক্ষে ৪.৫ ডিগ্রি বেশি হলে, সেই অঞ্চলকে হিটওয়েভ আক্রান্ত ঘোষণা করা হয়।

এই নিরিখে, হিটওয়েভ সংক্রান্ত নির্ধারিত শর্তগুলি হল:

  • নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রম করা: যদি কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলে সর্বাধিক তাপমাত্রা সমতলে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, পাহাড়ি এলাকায় ৩০ ডিগ্রি, বা উপকূলীয় এলাকায় ৩৭ ডিগ্রি ছুঁয়ে বা অতিক্রম করে, তাহলে তা হিটওয়েভ হিসেবে ধরা হয়।
  • স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে বিচ্যুতি: যদি সর্বাধিক তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি হয় এবং সেই স্বাভাবিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কমপক্ষে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তাহলেও হিটওয়েভ বলে বিবেচিত হয়।
  • তীব্র তাপপ্রবাহ: যদি স্বাভাবিক তাপমাত্রার তুলনায় বিচ্যুতি আরও বেশি হয় (৫–৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়েও বেশি), অথবা সর্বাধিক তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়ে যায় বা তার বেশি হয়, তখন তা ‘সিভিয়ার হিটওয়েভ’ বা তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে গণ্য করা হয়।

ভারতের পৃথিবী বিজ্ঞান মন্ত্রক (Ministry of Earth Sciences) ২০২০ সালে ভারতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রবণতা নিয়ে একটি বিস্তৃত মূল্যায়ন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে সামনের কয়েক দশকে ভারতে চরম বৃষ্টিপাত এবং চরম তাপদাহ— উভয়েরই উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির ভয়াবহ পূর্বাভাস তুলে ধরা হয়েছে (নিচে মাঝের ও ডানদিকের নিচের লেখচিত্র দ্রষ্টব্য)। এর পাশাপাশি, উপকূলবর্তী শহর ও জনপদগুলি এখন আরও ঘন ঘন এবং আরও তীব্র ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক ঝড়ের সম্মুখীন হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার ফলে এই প্রবণতা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা (নিচের বাঁদিকের লেখচিত্র)।

 

ভারতে এই উষ্ণায়নের প্রবণতা সম্পর্কিত প্রচুর বাস্তব তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। নিচের গ্রাফটিতে ১৯৬৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে স্থলভাগের পৃষ্ঠতাপমাত্রার ধারালো বৃদ্ধির চিত্র স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। পাশাপাশি, শহুরে তাপ-দ্বীপ (Urban Heat Island) প্রভাবও ক্রমশ বাড়ছে— যার মূল কারণ হল কংক্রিটের দ্রুত বৃদ্ধি ও খোলা সবুজ জায়গার ক্রমহ্রাস। আবারও, এই পরিস্থিতিতেও সবচেয়ে বেশি ভুগছেন শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষজন, যাঁরা অতিরিক্ত ঠাসা ও অনিরাপদ আবাসনে বাস করেন এবং যাঁদের খোলা প্রকৃতির মধ্যে, তীব্র আবহাওয়ার মধ্যেই কাজ করতে বাধ্য হতে হয়।

 

শ্রমজীবী মানুষের উপর প্রভাব

আগে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের যে তিনটি প্রভাব সরাসরি এবং ক্রমবর্ধমানভাবে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষদের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়ছে— বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, তবে গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র কর্মীরাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত— সেগুলি হল:

  • দীর্ঘস্থায়ী ও আরও তীব্র তাপপ্রবাহ,
  • ক্রমবর্ধমান তাপসূচক (যেখানে উচ্চ তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতা একত্র হয়ে প্রাণঘাতী পরিস্থিতি তৈরি করে),
  • হঠাৎ ভারী বর্ষণ ও বন্যা (পাহাড়ি অঞ্চলে এর সঙ্গে ভূমিধসও যুক্ত হয়)।

এই প্রভাবগুলি তাঁদের কর্মস্থলে যেমন দেখা দিচ্ছে, তেমনি অনিরাপদ আবাসস্থলেও ভয়াবহভাবে অনুভূত হচ্ছে।

  • “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের তাপপ্রবাহের সংস্পর্শে আসার হার ক্রমাগত বাড়ছে এবং এই প্রবণতা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। বিশ্বজুড়ে চরম তাপমাত্রাজনিত ঘটনাগুলির মাত্রা, সময়কাল ও তীব্রতা বেড়েই চলেছে। ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তাপপ্রবাহের সংস্পর্শে আসা মানুষের সংখ্যা প্রায় ১২.৫ কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু ২০১৫ সালেই, গড় বছরের তুলনায় অতিরিক্ত ১৭.৫ কোটি মানুষ তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হয়েছেন।”
  • “উচ্চ পরিবেশগত তাপমাত্রা সকল জনগোষ্ঠীর ওপর প্রভাব ফেলে। তবে কিছু জনগোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে এর বেশি সংস্পর্শে আসে অথবা শারীরিক ও সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে শারীরিক চাপ, রোগের তীব্রতা এবং মৃত্যুঝুঁকির প্রতি অধিক সংবেদনশীল হয়। এর মধ্যে রয়েছেন— বয়স্ক মানুষ, শিশু ও নবজাতক, গর্ভবতী নারী, খোলা আকাশের নীচে শারীরিক শ্রমে নিয়োজিত কর্মী, ক্রীড়াবিদ এবং দরিদ্র জনগণ। তাপের সংস্পর্শে আসার ক্ষেত্রে লিঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।”[6]

মানবদেহ স্বাভাবিকভাবে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি পরিবেশগত তাপমাত্রা সহজে সহ্য করতে পারে না। ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৪০ শতাংশের বেশি আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিস্থিতিতে— বিশেষ করে দীর্ঘসময় শারীরিক পরিশ্রম বা উন্মুক্ত পরিবেশে থাকলে— সুস্থ ব্যক্তিরাও তাপজনিত চাপ (heat stress)-এর শিকার হতে পারেন। অথচ জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বহু শ্রমজীবী মানুষ বাধ্য হন এই পরিবেশে কাজ করতে।

তাপজনিত চাপ থেকে ক্লান্তি, মাথাব্যথা ও মাংসপেশির খিঁচুনি দেখা দিতে পারে; আর তাপঘাত (heat stroke) মারাত্মক হয়ে মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে, এমনকি একেবারে সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রেও।

ফুটপাথের হকার, নির্মাণশ্রমিক, কুলি, রিকশাচালক প্রভৃতি অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষ, এবং যাঁদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা কিডনি সমস্যার মতো দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যসমস্যা রয়েছে— তাঁদের ক্ষেত্রে তাপপ্রবাহ বা উচ্চ ‘তাপসূচক’-এর সময়ে তাপজনিত চাপ ও হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়, যা মৃত্যুও ঘটাতে পারে।

 

আইএমডি-র তথ্য, ঘোষণা ও পরামর্শ যথেষ্ট নয়

ফুটপাথের হকার, নির্মাণশ্রমিক, কুলি, রিকশাচালক, সাফাইকর্মী, গিগ-শ্রমিক— এই সমস্ত শারীরিক পরিশ্রমনির্ভর শ্রমজীবীরা— দিনের দীর্ঘ সময় কাটান শহরের সবচেয়ে গরম অঞ্চলগুলিতে। কালো পিচঢালা রাস্তাঘাট ও কংক্রিটের ফুটপাতের তাপমাত্রা বাস্তবে অনেক বেশি হয়। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর (IMD) ২ মিটার উচ্চতায় বাতাসের তাপমাত্রা মাপে, রাস্তা বা ফুটপাথ সারফেসের নয়। ফলে, তাঁরা তাপপ্রবাহ এবং তাপসূচক-এর প্রভাবে আরও তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। কষ্ট এখানেই শেষ হয় না। গোটা দিন অতিরিক্ত গরমে ক্লান্তিকর পরিশ্রমের পর তাঁরা যখন বাড়ি ফেরেন, তখন সেখানেও স্বস্তি বা পুনরুজ্জীবনের সুযোগ পান না— কারণ তাঁদের ঠাসাঠাসি করে বসবাস করা খারাপ বায়ুচলাচলের ঘরবাড়িগুলিও হয়ে ওঠে গরম ও আর্দ্রতার একেকটি কুণ্ড।

সুতরাং, শহরের বহু এলাকায়— যেখানে মানুষ শারীরিক পরিশ্রম করেন— সেখানে হিট স্ট্রেস পরিস্থিতি এমনকি কখনও কখনও তীব্র তাপপ্রবাহের মতো অবস্থাও তৈরি হয়ে যায়, কিন্তু সবচেয়ে নিকটবর্তী আইএমডি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটিও সেই মুহূর্তে তাপপ্রবাহের অবস্থা টের না-ও পেতে পারে। এর একটি প্রধান কারণ হল শহুরে তাপদ্বীপ প্রভাব (Urban Heat Island Effect)। অতিরিক্ত মানুষের ভিড়, সরাসরি রোদের সংস্পর্শ, নীচে গাঢ় রঙের ও তাপ শোষণকারী পৃষ্ঠ— এসব মিলিয়ে ছোট কোনও কর্মক্ষেত্রে তাপপ্রবাহের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যেতে পারে, যা আইএমডি-র অফিসিয়াল তথ্যে তখনও ধরা পড়েনি। তার সঙ্গে যুক্ত হয় গরম ও আর্দ্রতার জমাট বাঁধা পরিবেশ— যা এক গভীর ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করে।

 

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রাজ্য সরকার এবং নগরের স্থানীয় সংস্থাগুলির তৈরি করা বহু তাপপ্রতিক্রিয়া কর্মপরিকল্পনা (Heat Action Plan) এই বাস্তব বিষয়গুলিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না। উদাহরণস্বরূপ, আবহাওয়া দপ্তরের রেকর্ড করা তাপমাত্রা ও রাস্তাঘাটের প্রকৃত তাপমাত্রা বা ভূমিতলের সরাসরি সংস্পর্শের বায়ু-তাপমাত্রার মাঝে যে বড় ফারাক থাকে, কিংবা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় স্থানিক তাপদ্বীপ প্রভাব যে কতটা প্রবল হতে পারে— এসব অনেকক্ষেত্রেই উপেক্ষিত থেকে যায়। তা ছাড়াও, যে এলাকাগুলিতে এই শ্রমজীবী মানুষরা কাজ করেন, সেইসব ক্ষুদ্র ভৌগোলিক পরিসরে তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণের কোনও কার্যকর ব্যবস্থাও নেই। অধিকাংশ রেকর্ডিং স্টেশনই স্থাপন করা হয় খোলা জায়গায়, ছায়াযুক্ত স্থানে— ফলে এসব জায়গা শ্রমজীবী মানুষের কর্মক্ষেত্রের প্রকৃত অবস্থা প্রতিফলিত করে না।

এই সমস্ত কারণে সময়মতো সতর্কতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। এমনকি কোনও শহরের কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলে যদি খোলা আকাশের নীচে কাজ করা প্রচুর সংখ্যক মানুষের জন্য বিপজ্জনক মাত্রায় তাপমাত্রা বা আর্দ্রতা পৌঁছায়, তবু আবহাওয়া দপ্তর হয়তো সেই পরিস্থিতিকে “তাপপ্রবাহ” হিসেবে ঘোষণা করে না— বা করতে চায় না।

আবহাওয়া দপ্তর (IMD) যখন তাপপ্রবাহ পরিস্থিতি ঘোষণা করে, তখন সরকার যে পরামর্শগুলি জারি করে, তা এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলার জন্য পর্যাপ্ত নয়।

প্রথমত— “এই কদিন বাইরে না গিয়ে কাজ বন্ধ রাখুন” জাতীয় পরামর্শ খেটেখাওয়া মানুষদের ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক চাপে ফেলে। তাঁদের জীবিকা এই দৈনন্দিন কাজের ওপর নির্ভরশীল, এবং তাঁরা কোনওভাবেই বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী নন, অথচ এর সর্বাধিক কুফল ভোগ করছেন। অতএব, এই কাজ বন্ধের দিনগুলির জন্য তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।

দ্বিতীয়ত— যদি পরিস্থিতি হয় উচ্চ তাপমাত্রা + উচ্চ আর্দ্রতা, তাহলে “অনেক জল পান করুন”— এই পরামর্শ শরীর ঠান্ডা করার পক্ষে যথেষ্ট নয়, কারণ এরকম অবস্থায় ত্বক থেকে ঘামের বাষ্পীভবনের হার খুব কমে যায়, ফলে ত্বক-ভিত্তিক ঠান্ডা হওয়ার প্রক্রিয়া কার্যত ব্যর্থ হয়। এরকম অবস্থায় শরীরে প্রচণ্ড চাপ পড়ে, বিশেষ করে হৃদযন্ত্র ও কিডনির ওপর। যদি কেউ এমন চরম তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে তাঁকে বাইরের উৎস থেকে ঠান্ডা করা জরুরি— শুধু প্রচুর জল খাওয়ালেই পরিস্থিতির মোকাবিলা হয় না।

 

সম্ভাব্য গণ-উদ্যোগ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত দিকনির্দেশ

উপরে যেমন বলা হয়েছে, অনেক সময় রাস্তার খেটে খাওয়া মানুষের কর্মস্থলে বিপজ্জনক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার অবস্থার কথা আবহাওয়া দপ্তরের নজরে আসে না।

  • স্থানীয় কর্মক্ষেত্রগুলিতে তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা স্থানীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা খুব জরুরি। এতে সময়মতো পদক্ষেপ নিয়ে জীবন এবং স্বাস্থ্যহানি রোধ করা যায়। এবং এটি সহজে ব্যবহারযোগ্য, বোধগম্য ও কম খরচের যন্ত্র দিয়েই করা সম্ভব।
  • শ্রমিক সংগঠন ও ইউনিয়নগুলির নিয়োগকর্তা ও সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসা প্রয়োজন, যাতে তারা এই আশঙ্কাগুলি ও এর পেছনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে ভাল করে বোঝে।
  • তাপপ্রবাহ ও অন্যান্য চরম আবহাওয়ার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার দিনগুলির জন্য ক্ষতিপূরণের দাবি ও তার বিধান থাকা দরকার।
  • তাপজনিত অসুস্থতা, হিট স্ট্রোক বা হিট ইনডেক্সের কারণে আক্রান্ত মানুষদের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে দ্রুত সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাও জরুরি।
  • “ইমারজেন্সি কুলিং রুম” (ECR)— যেমন বড় বাজার, মান্ডি, রেল ও বাস স্টেশন ইত্যাদি শ্রমজীবী এলাকায়— গড়ে তোলা উচিত, যাতে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা ও ঠান্ডা পরিবেশ দেওয়া সম্ভব হয়। এর জন্য স্থানীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি নীতিতেও এ-ধরনের ECR-এর বিধান রাখা প্রয়োজন।
  • দ্রুত বাড়তে থাকা এই তাপপ্রবাহ পরিস্থিতিকে গুরুত্ব দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে তাপপ্রবাহকে একটি নোটিফায়েড দুর্যোগ” হিসেবে ঘোষণা করার জন্য দাবি ও গণআন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি। কারণ যতক্ষণ না এটা আইনত দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরকারি ত্রাণ ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা চালু হয় না। রাজ্য সরকারগুলিও অনেক ক্ষেত্রে এখনও তা করেনি।

এই সব কিছুর বাস্তবায়নের জন্য শুধু দায়িত্বশীল শাসন, তথ্যনির্ভর নীতি ও কর্মপরিকল্পনাই যথেষ্ট নয়— অত্যন্ত জরুরি হল ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর স্থানীয় স্তরে সক্ষমতা গড়ে তোলা।


[1] Nations must go further than current Paris pledges or face global warming of 2.5-2.9°C. Press Release. UNEP. Nov 20, 2023.
[2] 2024 is the first year to exceed 1.5°C above pre-industrial level. Copernicus. Jan 10, 2025.
[3] Mazdiyasni, Omid. et al. Increasing probability of mortality during Indian heat waves. Science Advances. Jun 7, 2017.
[4] India Urban Population 1960-2025. Macrotrends.
[5] Climate change made heatwaves in India and Pakistan “30 times more likely”. WMO.
[6] Heat and Health. WHO.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5044 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...