জলবায়ু পরিবর্তন ও ভারতের জনস্বাস্থ্য— অষ্টম বর্ষ, সপ্তম যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

… আমরা এই সংখ্যার মাধ্যমে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই— জলবায়ু পরিবর্তনের এই মহাসংকট কোনও বিচ্ছিন্ন ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ নয়, এটি বর্তমান বিশ্বজুড়ে আধিপত্যকারী পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ও তার লাগামছাড়া মুনাফাকেন্দ্রিক দর্শনের অনিবার্য পরিণতি। মুনাফার লোভে নির্বিচার শিল্পায়ন, অরণ্যে ধ্বংসযজ্ঞ, খনিজ সম্পদের অবাধ লুঠ, এবং পরিকল্পনাহীন শহরায়নের অরাজক বিস্তার— এসবই এই মহাসংকটকে তিলে তিলে তৈরি ও প্রতিনিয়ত ত্বরান্বিত করে চলেছে।

একইসঙ্গে, এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই আমাদের রাষ্ট্রগুলিকে এমন এক নিও-লিবারেল পথে চালিত করেছে যেখানে ‘কল্যাণরাষ্ট্রের’ ধারণাটি কেবল একটি নীতিগত অতীত বা কাগুজে ঘোষণায় পর্যবসিত হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খাদ্যের মতো মানুষের মৌলিক প্রয়োজনগুলি পূরণের দায়ভার ক্রমশ রাষ্ট্রের হাত থেকে বাজারের অদৃশ্য বা দৃশ্যমান হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে, জনস্বাস্থ্য রক্ষার লড়াই এবং জলবায়ু ন্যায্যতার জন্য লড়াই আসলে এক ও অভিন্ন সংগ্রাম— যা শুধুমাত্র কিছু নীতি পরিবর্তন নয়, বরং শোষণহীন এক বিকল্প সমাজকাঠামোর দাবি জানায়।…

 

জলবায়ু পরিবর্তনের বিধ্বংসী অভিঘাত আজ আর কোনও দূর ভবিষ্যতের আশঙ্কা নয়— বরং আমাদের শরীর, সমাজ এবং রাষ্ট্রকাঠামোকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করা এক কঠিন বাস্তবতা। তবুও, এই সংকটের সবচেয়ে ভয়াবহ অথচ উপেক্ষিত দিক— জনস্বাস্থ্যের উপর তার প্রত্যক্ষ প্রভাব— মূলধারার আলোচনার পরিসর থেকে প্রায় ব্রাত্যই রয়ে গেছে।

কেন এই নীরবতা? কারণ এই প্রভাব যখন প্রতিদিনের শারীরিক কষ্ট, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা, ক্রমবর্ধমান পুষ্টিহীনতা বা গভীর মনস্তাত্ত্বিক অবসাদের রূপে প্রকাশ পায়, তখনও সেগুলিকে জলবায়ু সংকটের অনিবার্য ফল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না। বরং, আমাদের রাজনৈতিক অগ্রাধিকার, প্রশাসনিক উদাসীনতা এবং জনপরিসরের আলোচনার ধরনই একে সচেতনভাবে দৃষ্টির আড়ালে ঠেলে দিয়েছে।

The Lancet Countdown 2023 রিপোর্ট স্পষ্টভাবে প্রমাণ হাজির করেছে, কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ভারতে জীবাণুবাহিত রোগের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তুলছে। ১৯৫১-৬০ থেকে ২০১৩-২২ সময়কালের তুলনামূলক বিচারে, ডেঙ্গুর বাহক Aedes aegypti মশার সংক্রমণ বিস্তারের উপযোগিতা প্রতি বছর গড়ে ১.৬৯ শতাংশ হারে বেড়েছে; Aedes albopictus-এর ক্ষেত্রেও এই বার্ষিক বৃদ্ধির হার ১.৩৬ শতাংশ। এর সরাসরি অর্থ হল, রোগের প্রকোপের সময়কাল দীর্ঘতর হচ্ছে এবং পূর্বে নিরাপদ থাকা নতুন ভৌগোলিক অঞ্চলেও সংক্রমণের আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে।

ভারত সামগ্রিকভাবে ম্যালেরিয়া দমনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেলেও, Indian Council of Medical Research (ICMR) এবং Malaria Journal-এর মতো প্রতিষ্ঠিত গবেষণাসূত্রে প্রাপ্ত তথ্য উদ্বেগজনক ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তিত ধরন ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহক মশার বেঁচে থাকার পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে নতুন নতুন অঞ্চলে, এমনকি হিমালয়ের তুলনামূলকভাবে শীতল উচ্চ পার্বত্য এলাকাতেও, যা পূর্বে ভাবা যেত না।

লাগামছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ প্রভাবও অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। Lancet Countdown 2023 রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০০-২০০৪ সালের তুলনায় ২০১৮-২০২২ সালে ভারতে ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে প্রবীণ নাগরিকদের মধ্যে তীব্র গরমজনিত কারণে মৃত্যুহার বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে, প্রায় ৫৫ শতাংশ। শুধু ২০২২ সালেই, অসহনীয় তাপমাত্রা এবং তা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে ভারত প্রায় ১৬৭.২ বিলিয়ন সম্ভাব্য শ্রমঘণ্টা হারিয়েছে— যার সিংহভাগ কোপ পড়েছে কৃষি ও নির্মাণক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষদের উপর, যাঁরা খোলা আকাশের নীচে কাজ করতে বাধ্য হন। India Meteorological Department (IMD)-এর তথ্যও প্রমাণ করে, সাম্প্রতিক দশকগুলিতে ভারত জুড়ে তাপপ্রবাহের সংখ্যা এবং স্থায়িত্ব— দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ভয়াবহ হিটওয়েভে মৃতের সংখ্যা ছিল ২৩০০-রও বেশি।

চরম বৃষ্টিপাত ও তার ফলে সৃষ্ট বিধ্বংসী বন্যার (যেমন কেরল ২০১৮ বা আসামের বারংবার বন্যা পরিস্থিতি) পরবর্তী সময়ে পানীয় জলের উৎস দূষিত হওয়ার কারণে ডায়ারিয়া, টাইফয়েড, এবং লেপটোস্পাইরোসিসের মতো জলবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পায়। Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)-সহ একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে এই চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক চিহ্নিত করা হয়েছে। একইভাবে, উপকূলবর্তী অঞ্চলে সমুদ্রের জল উষ্ণ হওয়ার ফলে Vibrio গোত্রের ব্যাকটেরিয়ার (যা কলেরা এবং অন্যান্য মারাত্মক সংক্রমণ ঘটাতে পারে) বিস্তার ঘটছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে।

শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত রোগের ক্ষেত্রেও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব সুস্পষ্ট। উচ্চ তাপমাত্রা ও সূর্যালোকের প্রভাবে ভূ-সংলগ্ন ওজোন গ্যাসের গঠন বৃদ্ধি এবং ধোঁয়াশা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনেও জলবায়ু পরিবর্তনের পরোক্ষ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যার ফলে হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রকোপ ও তীব্রতা দুই-ই বাড়ছে।

সবশেষে বলতে হয় খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টিহীনতার সংকটের কথা— যা জনস্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকার উপর এক পরোক্ষ অথচ সুদূরপ্রসারী ও গভীরতর আঘাত নিয়ে আসছে। আমাদের ইকনমিক সার্ভে-র সমীক্ষা অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে দেশের গড় কৃষি আয় ১৫ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেচের সুবিধা থেকে বঞ্চিত, মূলত বর্ষানির্ভর কৃষিক্ষেত্রগুলিতে এই ক্ষতির পরিমাণ ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্তও হতে পারে। ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হলে অনিবার্যভাবে বাড়বে খাদ্যদ্রব্যের দাম— যার চরম ফল ভোগ করতে হবে দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারগুলিকে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের, অপুষ্টি এমনিতেই যাদের নিত্যসঙ্গী।

 

এই সমস্ত পরিসংখ্যান, তথ্য ও প্রবণতা একসঙ্গে মিলে এক ভয়াবহ, অথচ পরিকল্পিতভাবে অস্বীকৃত বা লঘু করে দেখানো গভীর সংকটের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম’-এর এই মূল ভাবনা কেবল কিছু তথ্য পরিবেশনের রুটিন প্রয়াস নয়— এটি একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, একটি জরুরি গণতান্ত্রিক দাবি— যে দাবি বলে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ একে অপরের পরিপূরক শুধু নয়, এরা অবিচ্ছেদ্য, একে অপরের অপরিহার্য সহচর।

আমরা এই সংখ্যার মাধ্যমে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই— জলবায়ু পরিবর্তনের এই মহাসংকট কোনও বিচ্ছিন্ন ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ নয়, এটি বর্তমান বিশ্বজুড়ে আধিপত্যকারী পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ও তার লাগামছাড়া মুনাফাকেন্দ্রিক দর্শনের অনিবার্য পরিণতি। মুনাফার লোভে নির্বিচার শিল্পায়ন, অরণ্যে ধ্বংসযজ্ঞ, খনিজ সম্পদের অবাধ লুঠ, এবং পরিকল্পনাহীন শহরায়নের অরাজক বিস্তার— এসবই এই মহাসংকটকে তিলে তিলে তৈরি ও প্রতিনিয়ত ত্বরান্বিত করে চলেছে।

একইসঙ্গে, এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই আমাদের রাষ্ট্রগুলিকে এমন এক নিও-লিবারেল পথে চালিত করেছে যেখানে ‘কল্যাণরাষ্ট্রের’ ধারণাটি কেবল একটি নীতিগত অতীত বা কাগুজে ঘোষণায় পর্যবসিত হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খাদ্যের মতো মানুষের মৌলিক প্রয়োজনগুলি পূরণের দায়ভার ক্রমশ রাষ্ট্রের হাত থেকে বাজারের অদৃশ্য বা দৃশ্যমান হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে, জনস্বাস্থ্য রক্ষার লড়াই এবং জলবায়ু ন্যায্যতার জন্য লড়াই আসলে এক ও অভিন্ন সংগ্রাম— যা শুধুমাত্র কিছু নীতি পরিবর্তন নয়, বরং শোষণহীন এক বিকল্প সমাজকাঠামোর দাবি জানায়।

আমরা এই সংখ্যা নির্মাণে মূল্যবান লেখা ও ভাবনার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই আশিস গুপ্ত, জয়ন্ত ভট্টাচার্য, মৃণাল মুখোপাধ্যায়, রাজু দাস, সৌম্য দত্ত, সুমিত মজুমদারসুবর্ণ গোস্বামী–র প্রতি। তাঁদের প্রতিটি লেখা পাঠকদের এই জটিল বিষয়ে এক গভীরতর, প্রেক্ষিতনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণাত্মক বোধ জোগাবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

এই সংখ্যা কেবল পাঠের জন্য নয়, বরং প্রতিরোধ গড়ে তোলার আলোচনা, বিকল্প নীতি পরিকল্পনা এবং সামগ্রিক সামাজিক পরিবর্তনের লড়াইয়ে একটি কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠুক— এই আমাদের আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা ও রাজনৈতিক প্রত্যয়।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5044 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...