
আশিস গুপ্ত
পহেলগাঁওয়ের বাইসরান তৃণভূমিতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলা প্রশাসনিক অদক্ষতার নির্মম ফল। সরকার স্বীকার করেছে যে পর্যটনকেন্দ্রটি খুলে দেওয়ার আগে পুলিশের অনুমতি নেওয়া হয়নি। অথচ, সরকারি টিকিট ব্যবস্থার মাধ্যমে জনপ্রতি ৩৫ টাকা আদায় চলছিল, যা স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে কেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা না নিয়ে বিপুল সংখ্যক পর্যটককে দুর্গম অঞ্চলে পাঠানো সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক। সরকার পরিস্থিতিকে 'স্বাভাবিক' দেখাতে ন্যূনতম নিরাপত্তা ছাড়াই পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দিয়েছিল। এ-ধরনের আত্মতুষ্টি সরাসরি সাধারণ মানুষের প্রাণনাশের জন্য দায়ী
২২ এপ্রিল ২০২৫, জম্মু ও কাশ্মিরের পহেলগাঁওয়ে বাইসরান তৃণভূমিতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় ২৫ জন নিরীহ পর্যটক ও একজন স্থানীয় যুবক প্রাণ হারান। এই ঘটনা শুধু সন্ত্রাসবাদের নির্মমতা নয়, বরং প্রশাসনিক গাফিলতি, গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার চূড়ান্ত ভাঙনের নগ্ন প্রকাশ। হামলার পরে প্রশাসনের দিক থেকে অনুমতি সংক্রান্ত বিভ্রান্তি এবং পর্যটনকেন্দ্রের সুরক্ষার অভাব এই ঘটনার গভীর ব্যর্থতাকে স্পষ্ট করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে দায় এড়ানোর প্রয়াস, দেশপ্রেমের নামে জনসাধারণকে দোষারোপ এবং ধর্মভিত্তিক বৈষম্যমূলক প্রতিক্রিয়া জাতীয় নিরাপত্তা ও আইনের শাসনের প্রতি মারাত্মক অবজ্ঞার ইঙ্গিত দেয়। অতীত অভিজ্ঞতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে শিক্ষা না নিয়ে বারবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে গভীর প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
পহেলগাঁওয়ের বাইসরান তৃণভূমিতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলা প্রশাসনিক অদক্ষতার নির্মম ফল। সরকার স্বীকার করেছে যে পর্যটনকেন্দ্রটি খুলে দেওয়ার আগে পুলিশের অনুমতি নেওয়া হয়নি। অথচ, সরকারি টিকিট ব্যবস্থার মাধ্যমে জনপ্রতি ৩৫ টাকা আদায় চলছিল, যা স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে কেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা না নিয়ে বিপুল সংখ্যক পর্যটককে দুর্গম অঞ্চলে পাঠানো সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক। সরকার পরিস্থিতিকে ‘স্বাভাবিক’ দেখাতে ন্যূনতম নিরাপত্তা ছাড়াই পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দিয়েছিল। এ-ধরনের আত্মতুষ্টি সরাসরি সাধারণ মানুষের প্রাণনাশের জন্য দায়ী।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্টে (২৪ এপ্রিল ২০২৫) বলা হয়েছে, “বাইসরানে গুলির শব্দ শোনা যাওয়ার সময় আশেপাশে কোনও পুলিশ বা নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন ছিলেন না। বেঁচে ফেরা প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামলা শুরুর প্রায় এক ঘণ্টা পর নিরাপত্তাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।” দ্য হিন্দু পত্রিকা (২৩ এপ্রিল ২০২৫) একই সুরে লিখেছে, “বাইসরান তৃণভূমিতে বাস্তবসম্মত নজরদারি বজায় রাখতে স্থানীয় প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছিল। বেঁচে ফেরা মানুষজন প্রায় এক ঘণ্টা ধরে অসহায়ভাবে উদ্ধারকারী বাহিনীর পৌঁছানোর জন্য অপেক্ষা করেছিলেন।” নিহত পর্যটকদের পরিবারগুলোর ক্ষোভও স্পষ্ট— গুজরাতের নিহত পর্যটক শৈলেশ কালাথিয়ার স্ত্রী শীতল কালাথিয়া বলেছেন, “টাকা নেওয়া হয়েছে, টিকিট কাটা হয়েছে, কিন্তু কোনও নিরাপত্তা ছিল না। এটা ক্ষমার অযোগ্য অবহেলা।”
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত সরকার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে। এই সিদ্ধান্তের পরে কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করেছিল যে, এর ফলে ‘সন্ত্রাসবাদ কার্যত নির্মূল হবে’, ‘শান্তি ফিরে আসবে’ এবং ‘কাশ্মিরের উন্নয়ন’ দ্রুত ঘটবে। পরবর্তী সময়ে সরকারের তরফে পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানো হয়েছিল যে ২০১৯-২০২১ সময়কালে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা কিছুটা কমেছে এবং বিদেশি জঙ্গিদের অনুপ্রবেশের হার হ্রাস পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালের আগস্টের পরে সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে যেখানে প্রায় ৬১৪টি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছিল, ২০১৯-এ তা নেমে আসে প্রায় ৫৯৪-তে এবং ২০২০-তে আরও কমে ২৪৪-এ। একথা ঠিক যে খোলামেলা সংঘর্ষ এবং বড় সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা সাময়িকভাবে কমেছিল। তবে, এই সংখ্যাগত সাফল্য বাস্তব পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণকে আড়াল করে রেখেছিল।
প্রথমত, সরকারি বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি এবং দমনমূলক ব্যবস্থা (যেমন দীর্ঘমেয়াদি কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ, স্থানীয় রাজনীতিকদের আটক) পরিস্থিতিকে দৃশ্যত শান্ত রাখলেও সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও বঞ্চনার মনস্তত্ত্ব ভেতরে ভেতরে চাপা ছিল। বহু স্বাধীন বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন, যেমন জম্মু ও কাশ্মির কোয়ালিশন অব সিভিল সোসাইটি (জেকেসিসিএস), সতর্ক করেছিল যে এই ‘শান্তি’ আসলে চাপা ক্ষোভের একটি অস্থায়ী আবরণ মাত্র।
দ্বিতীয়ত, গোয়েন্দা ব্যর্থতার একটি প্রকট উদাহরণ হল ২০২৩ সালের রাজৌরিতে একের পর এক হামলা, যেখানে ‘ভুল তথ্য’ এবং ‘ঝুঁকি মূল্যায়নের অভাব’-এর কারণে নিরাপত্তা বাহিনী সাধারণ জনগণকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এ ছাড়া ২০২৪-২৫ সালে দেখা গেছে, কাশ্মিরের দক্ষিণ অংশে বিশেষ করে অনন্তনাগ, পুলওয়ামা, কুপওয়ারা, রাজৌরি এবং পুঞ্চে তথাকথিত ‘hybrid militant’— যারা বেসামরিক পেশার আড়ালে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালায় — তাদের সক্রিয়তা বাড়ছে। এরা নিয়মিতভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর টহলদারি এবং সাধারণ বাসিন্দাদের লক্ষ্যবস্তু করছে।
তৃতীয়ত, সন্ত্রাসের ধরন পাল্টে যাওয়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এখন বড় আকারের সংঘর্ষ বা উচ্চ পর্যায়ের আত্মঘাতী হামলার বদলে ছোট ছোট টার্গেটেড হামলা, গেরিলা আক্রমণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক বিস্তারের দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে। একে ‘low-intensity, high-frequency conflict’ বলা হয়। এই ধরনের সন্ত্রাসকে খুঁজে বের করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন এবং এটি গোয়েন্দা সংস্থাগুলির জন্য নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
চতুর্থত, আন্তর্জাতিক সীমান্ত এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC)-র ওপারে অবস্থিত সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলি সম্পূর্ণ নির্মূল হয়নি। ভারতীয় সেনা এবং গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০২৫ সালের শুরু পর্যন্ত অন্তত ২৫-৩০টি সক্রিয় লঞ্চপ্যাড পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মিরে সক্রিয় রয়েছে, যেখান থেকে সন্ত্রাসীরা অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হল, সরকার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বদলে কেবল বাহ্যিক উন্নয়নমূলক প্রকল্প (যেমন রাস্তাঘাট নির্মাণ, নতুন পর্যটন কেন্দ্রের উদ্বোধন) দিয়ে কৃত্রিম স্বাভাবিকতার চিত্র তুলে ধরতে ব্যস্ত থেকেছে। কিন্তু স্থানীয় জনগণের রাজনৈতিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, আস্থা গড়ে তোলা এবং ন্যায়বিচারের পরিবেশ তৈরি করার মতো গভীর সমস্যাগুলি উপেক্ষিত থেকেছে। এর ফলেই সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ জমেছে, যা আত্মগোপনকারী সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কগুলির শক্তিবৃদ্ধিতে প্রতিফলিত হয়েছে।
সুতরাং, সরকার যেভাবে ‘সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ’ এবং ‘উন্নয়ন’-কে প্রচার করেছে, বাস্তবে তা ছিল একটি অসম্পূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর চিত্র। গোয়েন্দা ব্যর্থতা, মাটির নিচে সক্রিয় ক্ষোভের বিস্তার এবং সন্ত্রাসী সংগঠনের কৌশলগত অভিযোজন মিলে জম্মু ও কাশ্মিরকে আবারও মারাত্মক অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আত্মতুষ্টি এবং শুধুমাত্র বাহ্যিক উন্নয়নের প্রচেষ্টার মাধ্যমে ‘স্বাভাবিকতার’ ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করার সরকারি কৌশল সাধারণ নাগরিকদের জীবনকে আরও বেশি বিপন্ন করে তুলেছে। প্রকৃত শান্তি অর্জনের জন্য চাই রাজনৈতিক সমাধান, জনগণের আস্থা ফেরানো এবং গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সার্বিক সংস্কার।
সরকার নিজেদের ব্যর্থতার দায় এড়াতে দুটি পথ নিয়েছে— প্রথমত, জনগণের দেশপ্রেমের অভাবকে দায়ী করা এবং দ্বিতীয়ত, কাশ্মিরি জনগণের বিরুদ্ধে ‘সমষ্টিগত শাস্তি’ প্রয়োগ করা। কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল মন্তব্য করেছেন যে যতদিন না ১৪০ কোটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ‘পরম ধর্ম’ হিসেবে মেনে নেবে, ততদিন এ-ধরনের হামলা চলতেই থাকবে। জনগণের দেশপ্রেমের অভাবকে দোষারোপ করে সরকারের নিজস্ব দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার এই প্রচেষ্টা নীতিগতভাবে ভ্রান্ত। ইজরায়েলি কৌশল নকল করে কাশ্মিরি পরিবারগুলির বাড়িঘর ভাঙা হচ্ছে। অভিযুক্তদের বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে এমনকি বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই— যা ভারতের সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার সরাসরি লঙ্ঘন।
সন্দেহভাজনদের বাড়িঘর ধ্বংস করে সরকার সংবিধানের মৌলিক নীতিমালাকে লঙ্ঘন করেছে, যেখানে বিচারবহির্ভূত শাস্তি নিষিদ্ধ। এই আচরণ ধর্মভিত্তিক বৈষম্যের আরও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এমন কোনও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, বরং তাদের রাজনৈতিকভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। অন্যদিকে কাশ্মিরের সন্দেহভাজনদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত কঠোর ও অবৈধ। পহেলগামের হামলা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি গভীর অবহেলার প্রমাণ। শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ বা জনতাকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা দিয়ে আসল সমস্যাগুলির সমাধান সম্ভব নয়। প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা, গোয়েন্দা তথ্যের অপ্রতুলতা এবং ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বের মতো কাঠামোগত ব্যর্থতা সমাধান না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে বাধ্য।
যা করা দরকার
- বাইসরান তৃণভূমি এবং অন্যান্য দুর্গম পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে পর্যটক প্রবেশের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা মূল্যায়ন এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করতে হবে।
- সমস্ত অনুমতি পদ্ধতিতে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
- গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা এবং নিয়মিত ঝুঁকি মূল্যায়ন চালু করতে হবে।
- অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার আগে পর্যন্ত কোনও বিচারবহির্ভূত শাস্তি (যেমন বাড়ি ভাঙা) দেওয়া চলবে না।
- ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করে সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া অভিযুক্তের ধর্মের ভিত্তিতে বদলে না যায়।
- সরকারি ব্যর্থতার বিষয়ে জনগণের সামনে সৎ ও স্বচ্ছ ব্যাখ্যা দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক সংস্কার গ্রহণ করা এখন জরুরি।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল অতীতের বিচারহীনতার ঘটনাগুলি নতুন করে তদন্ত করে যথাযথ দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির পরে সরকার যে ‘নতুন কাশ্মির’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার জন্য কেবল উন্নয়ন প্রকল্প নয়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে ‘অপরাধের সময়কাল’ অগ্রাহ্যযোগ্য। অতএব, পুরনো ঘটনার বিচার নতুন প্রেক্ষাপটে করাই উচিত। দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে দায়বদ্ধতা বাড়বে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ফিরবে। জম্মু-কাশ্মিরে চলমান সংকটের এক মূল কারণ হল অতীতের বিচারহীনতার সংস্কৃতি। মানবাধিকার লঙ্ঘন, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, বেআইনি আটক, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড—এসব গুরুতর অভিযোগের অনেকগুলোতেই কোনও নিরপেক্ষ বা কার্যকর তদন্ত হয়নি। বরং বছরের পর বছর এসব ঘটনা উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে, ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা মারাত্মকভাবে কমেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯০-এর দশকে কাশ্মির উপত্যকায় বিশেষ করে সেনাবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী এবং পুলিশবাহিনীর বিরুদ্ধে বহু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। ২০১১ সালে প্রকাশিত মানবাধিকার সংগঠন Association of Parents of Disappeared Persons (APDP) এবং International People’s Tribunal on Human Rights and Justice in Kashmir (IPTK)-এর যৌথ রিপোর্ট অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মিরের ৩৮টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে প্রায় ২,৯৪৩টি অজ্ঞাত মৃতদেহ পাওয়া যায়।[1] এই সমস্ত ঘটনায় কোনও স্বাধীন, নিরপেক্ষ বিচার হয়নি। এছাড়াও, যেমন ২০০০ সালের পাথরিবাল ভুয়া সংঘর্ষে মৃত্যু, যেখানে সেনাবাহিনী পাঁচজন নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে, “জঙ্গি” সাজিয়ে হত্যা করে। সিবিআই তদন্তে স্পষ্ট প্রমাণ মিললেও কোনো অভিযুক্ত সেনাকর্মীর বিচার হয়নি। সিবিআই ২০০৬ সালে চার্জশিট জমা দেয়, যেখানে সেনাবাহিনীর পাঁচজন অফিসারকে হত্যার ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী করা হয়। অভিযুক্ত সেনাকর্মীরা হলেন, ব্রিগেডিয়ার অজয় সাক্সেনা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ব্রজেন্দ্র প্রকাশ, মেজর সৌরভ কালী, মেজর ভীষ্ম সিং এবং সুবেদার মনোজ কুমার। সেনাবাহিনী নিজস্ব আইনি সুরক্ষা দাবি করে (AFSPA – Armed Forces Special Powers Act অনুযায়ী)। সেনাবাহিনী সিবিআই চার্জশিটের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করে এবং সামরিক আদালতের অধীনে বিষয়টি নিষ্পত্তি চায়। শেষ পর্যন্ত সামরিক আদালত প্রমাণের অভাবে অভিযুক্ত সেনাকর্মীদের মুক্ত করে দেয়।[2] ২০০২ সালে সোপিয়ান জেলার গ্রীসাবাল গ্রামে তিনজন নিরীহ শ্রমিককে জঙ্গি বলে ঘোষণা করে মেরে ফেলা হয়। পরে তাদের বেসামরিক পরিচয় প্রকাশ পায়, কিন্তু বিচারের কোনও অগ্রগতি হয়নি। ২০১০ সালে সেনাবাহিনী কুপওয়ারা জেলার মাচিলে তিন বেসামরিক নাগরিককে “অনুপ্রবেশকারী জঙ্গি” হিসেবে মেরে ফেলে। এই ঘটনা কাশ্মিরে ব্যাপক প্রতিবাদের জন্ম দেয়। প্রথমদিকে কিছু অভিযুক্তের সাজা হলেও পরে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে সেটিও নাকচ হয়ে যায়।[3] ২০০৯ সালে দুই কাশ্মিরি নারীর (আসিয়া ও নিলোফার) রহস্যজনক মৃত্যু হয়। প্রথমে বলা হয় ডুবে মারা গেছে, পরে ফরেনসিক রিপোর্টে ধর্ষণ ও হত্যার ইঙ্গিত মেলে। কিন্তু চূড়ান্ত তদন্ত ধামাচাপা পড়ে যায়।[4]
এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি দুইটি মারাত্মক ফল বয়ে এনেছে। এক, জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাবাহিনীর প্রতি গভীর অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। দুই, বিচারের অভাবে নির্যাতিত পরিবারগুলি ক্ষোভ ও হতাশার বোধ নিয়ে সমাজে দীর্ঘমেয়াদি উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে, যা পরোক্ষে বিচ্ছিন্নতাবাদী অনুভূতিকে উস্কে দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে, যদি সরকার সত্যিই কাশ্মিরে স্থায়ী শান্তি ও রাজনৈতিক পুনর্মিলন চায়, তবে অতীতের এই বিচারহীনতার ঘটনা নতুন করে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য।
[1] Chatterji, Angana P et al. Buried Evidence: Unknown, Unmarked, and Mass Graves in Indian-administered Kashmir: a preliminary report. International People’s Tribunal on Human Rights and Justice in Indian-administered Kashmir.
[2] Kaur, Surangya. Pathribal: A timeline of 18 years of injustice. Newsclick. Mar 26, 2018.
[3] Ahmad, Mudasir. As Institutions Fail Kashmiris, Machil Fake Encounter Victims’ Families Vow to Keep Fighting. The Wire. Jul 29, 2017.
[4] MILITARIZATION WITH IMPUNITY: A Brief on Rape and Murder in Shopian, Kashmir. IPTK.
*মতামত ব্যক্তিগত