
জয়ন্ত ভট্টাচার্য
আমরা HWC চাই না, চাই উপযুক্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং এক জীবন্ত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা— যা ১৯৪৮ সালে "ভোর কমিটি"-র রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিল, এবং সাম্প্রতিক কালে শ্রীনাথ রেড্ডির নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন প্রতিবেদনে যার ওপর আবার জোর দেওয়া হয়েছে। এতদিন ধরে বনজ, খনিজ এবং বিপুল জীববৈচিত্র্যসম্পন্ন অঞ্চলগুলোকে জনজাতি সম্প্রদায় রক্ষা করে এসেছে। এখন তাঁদের উন্মূল ও নির্মূল করে কর্পোরেট দুনিয়ার সবকিছু দখল করে সমস্ত কিছু আমূল ধ্বংস করে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আরও নতুন রোগের উদ্ভব হবে
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন রোগের উদ্ভব নিয়ে কথা বলা মানে কার্যত একটি বা একাধিক ইকোসিস্টেম নিয়ে আলোচনা করা— আমাদের অস্তিত্বকে ঘিরে থাকা প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ছে, আর তার অভিঘাত এসে পড়ছে আমাদের দেহের অভ্যন্তরীণ ইকোসিস্টেমেও।
এর বাইরেও সামাজিক-রাজনৈতিক ‘ইকোসিস্টেম’ থাকে, যেখানে ন্যায়, সুবিচার, সামাজিক সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা ইত্যাদি সুনিশ্চিত থাকা একটি তথাকথিত কল্যাণকামী রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্যকর্মের মধ্যে পড়ে। কিন্তু ‘লিগালাইজড ললেসনেস’ (আইনসিদ্ধ আইনহীনতা) এবং সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে সিদ্ধ সীমাহীন চুরি-চামারি, ঘুষ ও দুর্নীতির শিকার আগামী প্রজন্ম গড়ার কারিগর চাকরিচ্যুত শিক্ষকেরা বিচার চাইতে গেলে যখন পুলিশের তরফে সপাটে লাথি, লাঠি, ঘুষি জোটে— তখন বিলক্ষণ মনে হয়, আমাদের চারপাশের ইকোসিস্টেমে গভীরতর, নিরাময়-অযোগ্য ক্ষত হয়ে গেছে। হয়তো এই ক্ষতের নিরাময়ে আরও এক প্রজন্ম কিংবা তার বেশি সময় লেগে যাবে। এ-প্রেক্ষিতে বর্তমান প্রবন্ধের পরিসর নিয়েই নিজের মনেই সংশয় জাগে।

শুরুর কথা
চরক সংহিতার সূত্রস্থানের ষষ্ঠ অধ্যায় (স্তস্যাশিতীয় অধ্যায়)-এ বলা হয়েছে—
ভিন্ন ঋতুর উপযোগী ব্যবহার ও খাদ্য তথা আহারের ব্যাপারে যে ব্যক্তি অবগত, তাঁর সে ধরনের আহারের গুণে বল ও গাত্রবর্ণ বৃদ্ধি পায়। (সূঃ ৬.৩)
এর পরে বলা হয়েছে—
ঋতু অনুযায়ী ভাগ করলে, সমগ্র বছরকে ছয় ঋতুতে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে শিশির, বসন্ত ও গ্রীষ্ম— এই তিন ঋতু সূর্যের উত্তরায়ণ ও আদানকাল। আর বর্ষা, শরৎ ও হেমন্ত— এই তিন ঋতু সূর্যের দক্ষিণায়ণ ও বিসর্গকাল। আদানকালে সূর্য পৃথিবী থেকে বিভিন্ন গুণ বা রস গ্রহণ করেন এবং বিসর্গকালে পৃথিবীতে বিভিন্ন রস বিসর্জন করেন। (সূঃ ৬.৪)
একেবারে শেষে, ঋতু অনুযায়ী ব্যবহার, চেষ্টা (শারীরিক পরিশ্রম) এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে জানানো হয়েছে। (সূঃ ৬.৪৯–৫১)
এই সামগ্রিক বিষয় থেকে সহজেই বোঝা যায়, এটি মহাবিশ্বের ঋতুচক্রের সঙ্গে জীবনের অভ্যাসকে ভারসাম্যে রাখার এক প্রয়াস। মহাবিশ্ব (macrocosm) ও অণুবিশ্বের (microcosm) মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে আমাদের জীবনচক্রকে ধারণ করার ভাবনা শুধু আয়ুর্বেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়— পৃথিবীর প্রায় সমস্ত প্রাচীন সভ্যতার চিকিৎসাদর্শের ভিত্তিই এই ভারসাম্য রক্ষা।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, পৃথিবীর প্রাচীন থেকে প্রাচীনতম উপজাতি ও জনজাতির জীবনদর্শনের মাঝেও প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জীবন পরিচালনার এই ধারণা গভীরভাবে প্রোথিত। প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রাণীহত্যা না করা, গাছ কাটলে তার বদলে নতুন গাছ লাগানো— অরণ্যের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এমন নানা প্রজন্মবাহিত রীতিই বহুকাল ধরে তারা অনুসরণ করে এসেছে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল— আয়ুর্বেদ কেবল মানুষের আয়ু বা হিত-অহিত নিয়েই চিন্তা করেনি, বরং প্রাণীকুলও এর অন্তর্ভুক্ত। এর উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় হস্তী-আয়ুর্বেদ ও অশ্ব-আয়ুর্বেদের মতো শাস্ত্রকে।
প্রকৃতি ও মানুষের ভারসাম্য ভেঙে যাওয়ার গোড়ার কথা
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থে দুটি শিল্পবিপ্লবের কথা বলেছেন। প্রথমটি শুরু হয় অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং উনবিংশ শতকের প্রায় পুরো সময়কাল জুড়ে বিস্তৃত। এই প্রসঙ্গে তাঁর একটি পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ—
The Industrial Revolution, beginning in the United Kingdom at the end of the eighteenth century and spreading throughout Europe over the course of the nineteenth century, was fuelled by the large-scale extraction of raw materials (especially cotton) and of energy sources (particularly wood) from the rest of the world, all within the framework of a coercive and colonialist organizational scheme.[1]
তিনি আরও বলেন—
The enrichment of the West since the Industrial Revolution could not have occurred without the global division of labor and the frenetic exploitation of the planet’s natural and human resources. In general, the rich countries would not exist without the poor countries and without the resources of the rest of the world.[2]
পিকেটির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব এরকম—
The second industrial revolution, which unfolded between 1880 and 1940 in chemical industries, the steel industry, the production of electricity, the automobile industry, and the manufacture of household appliances, required much more job training. During the first industrial revolution, and particularly in the textile and coal industries, one could get along with a relatively mechanized workforce, overseen by foremen and a few engineers. During the second industrial revolution, it became essential that an increasingly large part of the labor force be capable of mastering manufacturing processes that required technical and digital education, and the ability to understand detailed equipment manuals.[3]
প্রথম শিল্পবিপ্লবের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ দেওয়া যাক। সে সময়ে অতিরিক্ত চাষাবাদের ফলে ইউরোপের বহু জমির উর্বরাশক্তি হ্রাস পায়। ১৮২০–৩০-এর দশক থেকেই বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় মাটির এই জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে জমিতে সার প্রয়োগের চাহিদা বিপুলভাবে বেড়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, ১৮২৩ সালে ইংল্যান্ডে হাড়ের আমদানির পরিমাণ ছিল ১৪,৪০০ পাউন্ড, যা ১৮৩৭ সালের মধ্যে বেড়ে দাঁড়ায় ২৪,৬০০ পাউন্ডে (£)। এই সময়েই নাইট্রোজেনসমৃদ্ধ সার হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন সামুদ্রিক পাখির মল (guano)-এর চাহিদাও দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৮৪১ সালে লিভারপুল বন্দরে গুয়ানোর আমদানি ছিল ১,৭০০ টন, যা ১৮৪৭ সালের মধ্যে লাফিয়ে বেড়ে দাঁড়ায় ২,২০,০০০ টনে। গুয়ানোর অবাধ সরবরাহ বজায় রাখতে আমেরিকা ১৮৫৬ সালে শিল্পপতিদের চাপের মুখে কংগ্রেসে Guano Islands Act পাশ করে। এই আইনের আওতায় ১৮৫৬ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে আমেরিকা ৯৪টি দ্বীপ ও পাহাড় দখল করে নেয়, যদিও সরকারিভাবে স্বীকার করা হয় ৬৬টির কথা। ২০২২ সালেও আমেরিকার দখলে থাকা এরকম দ্বীপের সংখ্যা ৯টি।[4]
২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর Nature-এর মতো খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় একটি বিশেষ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়— “Landscape of fear forces Brazilian rainforest researchers into anonymity”। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রাজিলের রেইনফরেস্ট বা বৃষ্টিবনে কাজ করা পরিবেশ গবেষকরা কর্পোরেট দস্যু ও বনদস্যুদের ভয়ে নিজেদের নামে গবেষণা প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেন।
এখানে আরেকটি প্রসঙ্গ আলোচনা করা যেতে পারে। ১৯৯১ সালের ১২ ডিসেম্বর, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের তৎকালীন প্রধান অর্থনীতিবিদ লরেন্স সামার্স একটি গোপন নোট তৈরি করে তা সহকর্মীদের মধ্যে বিলি করেন এবং তাঁদের মতামত চান। এই নোট ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিখ্যাত পত্রিকা The Economist প্রকাশ করে, একটি তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গাত্মক শিরোনাম দিয়ে— “Let them eat pollution”।
নোটটির মোদ্দা কথা ছিল— ধনী বিশ্বের পরিবেশকে বিশুদ্ধ রাখার জন্য ওখানে শিল্পজাত সমস্ত প্রাণঘাতী, দূষিত আবর্জনা আফ্রিকা তথা কম উন্নত দেশগুলোতে পাচার করতে হবে। এর জন্য একটি “স্বাস্থ্যের যুক্তি”-ও দিয়েছিলেন সামার্স। তাঁর বক্তব্য ছিল, আমেরিকার মতো দেশে প্রতি ১,০০,০০০ জনে ১ জনেরও যদি দূষিত বর্জ্যের কারণে প্রোস্টেট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলেও আফ্রিকার মতো দেশগুলো, যেখানে ৫ বছরের নীচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি ১,০০০ জনে ২০০ জন, সেখানে এই ক্যান্সার অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ— তাই সেইসব দেশেই এই বিষাক্ত বর্জ্য পাচার করা উচিত।
এই ধরনের মনোভাবপূর্ণ কর্মকাণ্ডের পুরস্কার হিসেবে লরেন্স সামার্স ক্লিন্টন প্রশাসনে টানা ৭ বছর ইউএস ট্রেজারি সেক্রেটারি পদে বহাল ছিলেন। সে মেয়াদ শেষ হলে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট পদেও অধিষ্ঠিত হন।
আমরা যদি স্বাস্থ্যের চোখ দিয়ে দেখি, তাহলে বুঝতে পারি— স্বাস্থ্যের জগতে দু-ধরনের নাগরিকত্ব, বা ‘হেলথ সিটিজেনশিপ’[5] তৈরি হয়েছে। একটি পূর্ণ রাশি, আরেকটি শূন্য রাশি।
কর্পোরেট তাণ্ডবের ইঙ্গিত
আমেরিকার ১৮তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন ফ্র্যাঙ্কলিন পিয়ার্স (Franklin Pierce)— ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত। তাঁকে ১২ জানুয়ারি, ১৮৫৪ (ভিন্ন মতানুসারে ১৮৫৫) সালে রেড ইন্ডিয়ানদের সুয়ামিশ (Suwamish) এবং ডুওয়ামিশ (Duwamish) ট্রাইবের নেতা চিফ সিয়াটল (Chief Seattle) একটি চিঠি লেখেন বলে জানা যায়। ৪ জুন, ১৯৭৬ সালে The Irish Times পত্রিকায় এই চিঠি প্রকাশিত হয়। যদিও গবেষকমহলে এই চিঠির প্রামাণ্যতা নিয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে, তবু চিঠিটির অন্তর্বস্তু আমাদের গোচরে আসা দরকার— বিশেষ করে বর্তমান সময়ে। চিঠিটির বিভিন্ন সংস্করণ পাওয়া যায় (যদিও মূল মর্মার্থ সর্বত্রই এক), এবং চিফ সিয়াটলের কথাবার্তা উদ্ধৃত হয়েছে এলবার্ট ফার্টওয়্যাংলার-এর Answering Chief Seattle[6] এবং ক্লারেন্স বি ব্যাগলি-র History of the Progress of King County, Washington[7] গ্রন্থে। “Chief Seattle, as seen by Dr. H. A. Smith, 1887” ছাপা হয় History Progress of King County, Washington পুস্তকে। স্মিথ লিখেছেন—
In the early days of Seattle old Chief Seattle ruled the destiny of the tribe. In later years the descendants of his followers have become divided and separated until they are but wandering tribes, eking out a livelihood by fishing, hunting and berry picking.
প্রায় ১৭০ বছর পরেও চিফ সিয়াটলের সেই চিঠি আজও প্রাসঙ্গিক। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সে-সময়ে আমেরিকার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে (বর্তমানে যেটি ওয়াশিংটন) Suwamish এবং Duwamish জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে ২০,০০,০০০ একর জমি জোর করে কিনে নিতে চেয়েছিলেন। তারই জবাবে চিফ সিয়াটলের এই চিঠি।
বর্তমানে যেটি বহুল প্রচলিত চিঠি, সেটির খানিক পরিবর্তিত রূপ নীচে অনুবাদ করা হল।[8]
সে ছিল এক দিন আমাদের (There Was A Time)
এক সময়ে আমাদের লোকেরা এই সমগ্র অঞ্চলে পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকত, যেমন বায়ু-তাড়িত সমুদ্রের ঢেউ ঝিনুকের খোল-বাঁধানো মেঝে ঢেকে রাখে। কিন্তু সে সময় বহু আগে হারিয়ে গেছে, যেমন হারিয়ে গেছে আমাদের গোষ্ঠীর মহানুভবতার স্মৃতি। তবু আমি আমাদের অসময়ে মৃত্যুর জন্য বিলাপ করব না। আর একে ত্বরান্বিত করার জন্য আমাদের ফ্যাকাশে-মুখ ভাইদেরও তিরষ্কার করব না। হয়তো আমাদের নিজেদেরও এর জন্য খানিকটা দায় স্বীকার করতে হবে।
যখন আমাদের যুবকেরা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে কোনও বাস্তব বা কল্পিত ভুলের জন্য, আর মুখে কালি মেখে বিকৃত চেহারা ধারণ করে, তখন তাদের হৃদয়ও কালো ও বিকৃত হয়ে যায়। সে সময়ে তাদের নিষ্ঠুরতা আর বাধ মানে না— তারা হয়ে ওঠে নির্দয় ও অপ্রতিরোধ্য।
তবু আমাদের আশাবাদী হওয়া উচিত—লাল মানুষ আর তাদের ফ্যাকাশে-মুখ ভাইদের মধ্যে যেন আর কোনও শত্রুতা না ফিরে আসে। আমাদের আছে কেবল হারানোর মতো জিনিস, জয়ের কিছুই নেই।
এটা সত্য, আমাদের তরুণ যোদ্ধারা প্রতিশোধকে, এমনকি নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েও, এক ধরনের জয় হিসেবে দেখে। কিন্তু যেসব বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা ঘরে বসে যুদ্ধের সংবাদ শোনেন, আর যাঁদের সন্তানেরা সেই যুদ্ধে হারিয়ে যায়— তাঁরাই আসলে জানেন, এই লাভের আড়ালে কতটা ক্ষতি লুকিয়ে থাকে।
কিন্তু এমনটা কি কখনও হতে পারে?
তোমাদের ভগবান তোমাদের ভালোবাসেন আর আমাদের ঘৃণা করেন। তাঁর শক্ত বাহু দিয়ে তিনি তোমাদের জড়িয়ে ধরেন, যেমন বাবারা তাদের সন্তানকে কোলে তুলে নেন। কিন্তু তিনি তাঁর লাল সন্তানদের পরিত্যাগ করেছেন। প্রতিদিন তিনি তোমাদের আরও শক্তিশালী করে তুলছেন, আর খুব শীঘ্রই তোমরাই হবে সর্বত্র— আর আমরা হারিয়ে যাব দূরের সাগরের মতো, ঢেউয়ের মতো সরে যাব, আর কোনওদিন ফিরে আসব না।
সাদা মানুষের ভগবান তাঁর লাল সন্তানদের ভালোবাসতে পারেন না। রক্ষা তো দূরের কথা।
আমরা যেন অনাথ, যারা কোথাও থেকে কোনও সাহায্যের আশাও করতে পারে না।
কীভাবে আমরা পরস্পরের ভাই হতে পারি? কী করে তোমাদের পিতা আমাদের পিতা হবেন এবং আমাদের সমৃদ্ধি এনে দেবেন? কী করে আমাদের স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তুলবেন আমাদের মহান গুণাবলি-সহ?
তোমাদের ঈশ্বরকে পক্ষপাতদুষ্ট মনে হয়। তিনি সাদা মানুষদের কাছে এসেছেন। কিন্তু আমরা তাঁকে কখনও দেখিনি, কখনও কণ্ঠস্বরও শুনিনি।
তিনি সাদা মানুষদের আইনকানুন দিয়েছেন। কিন্তু যে লক্ষ কোটি লাল সন্তানেরা এই সুবিস্তীর্ণ মহাদেশ ছেয়ে ছিল, যেমন তারারা গগনতল ভরিয়ে রাখে, তাদের জন্য তাঁর কোনও শব্দ নেই।
না, আমরা দুটি স্বতন্ত্র জাতি এবং চিরকাল এমনটাই থাকব। আমাদের মাঝে “common” কিছু নেই। আমাদের পিতৃপুরুষদের ভস্ম পবিত্র এবং তাঁদের চিরঘুমের স্থানটিও পবিত্র ভূমি। কিন্তু তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষের সমাধিক্ষেত্র থেকে দূরে, আরও দূরে চলে যাও, কোনও অনুশোচনা ছাড়াই।
ওয়াশিংটন থেকে আমেরিকার মহান প্রধান (Great Chief) আমাদের খবর পাঠিয়েছেন যে তিনি আমাদের জমি কিনতে চান। তিনি আমাদের প্রতি বন্ধুত্ব ও শুভেচ্ছার বার্তা পাঠিয়েছেন— এটা তাঁর মহানুভবতা, কারণ আমরা জানি, আমাদের বন্ধুত্ব তাঁর খুব বেশি প্রয়োজন নেই। তবু আমরা তাঁর প্রস্তাব বিবেচনা করব, কারণ যদি না করি, তাহলে সাদা মানুষেরা বন্দুক হাতে এসে আমাদের জমি দখল করে নিতে পারে।
চিফ সিয়াটল আপনাদের জানাচ্ছে— আমাদের কথাকে আপনারা গুরুত্ব দিতে পারেন, ঠিক যেমন সাদা মানুষরা ঋতুচক্রের নিয়ম মেনে দেখে। ওই যে আকাশ— যা আমাদের পিতৃপুরুষদের ওপরে অগণিত শতাব্দী ধরে সমবেদনার অশ্রু ঝরিয়েছে— আজ যেটি আমাদের শাশ্বত বলে মনে হয়, সেটাও বদলে যেতে পারে। আজ তা নির্মল, কাল মেঘে ঢেকে যেতে পারে। আমার কথা তারাদের মতো— কখনও নিভে যায় না।
কীভাবে তোমরা আকাশকে, জমির উষ্ণতাকে কিনতে বা বেচতে পারো? এ ধারণা আমাদের কাছে আজব ঠেকছে। আমরা সতেজ বাতাস কিংবা জলের লহরীকে নিজস্ব বলে ভাবি না। যেগুলো আমাদের অধিকারে নেই সেগুলোকে তোমরা আমাদের কাছ থেকে কিনবে কী করে?
এই ধরিত্রী আমাদের সবার কাছে পবিত্র। প্রতিটি ঝকমকে পাইনগাছের চুড়ো, প্রতিটি বালুকাময় বেলাভূমি, ঘন জঙ্গলের প্রতি কণা কুয়াশা, প্রতিটি গান গাওয়া পতঙ্গ আমাদের স্মৃতিতে পবিত্র, আমাদের মানুষদের অভিজ্ঞতায় অপাপবিদ্ধ। বৃক্ষের মধ্যে দিয়ে যে রস সঞ্চালিত হয় তা আমাদের লাল-চামড়ার লোকেদের স্মৃতি বহন করে।
সাদাদের মধ্যে মৃত মানুষেরা যখন তারাদের মাঝে হেঁটে যাওয়ার জন্য রওনা দেয় তখন তারা তাদের জন্মভূমির কথা ভুলে যায়। আমাদের মৃতরা কখনও তাদের অপরূপ জন্মভূমিকে ভুলে যায় না, কারণ এই পৃথ্বী লাল মানুষদের মাতা। আমরা পৃথ্বীর একটি অংশ এবং পৃথ্বী আমাদের একটি অংশ।
মধুগন্ধময় ফুলেরা আমাদের বোন, শিংওয়ালা জন্তুরা, অশ্বের দল, রাজকীয় ঈগল— এরা সবাই আমাদের ভাই। শস্যপ্রান্তর, মানুষ এবং শাবকদের উষ্ণ দেহ— এরা সবাই এক পরিবারে বাস করে।
এ-জন্য, যখন ওয়াশিংটনের গ্রেট চিফ আমাদের বার্তা পাঠান যে তিনি আমাদের জমি কিনে নিতে চান, তিনি বড় কারবার করতে চাইছেন। তিনি আমাদের বার্তা পাঠিয়েছেন যে আমাদের বসবাসের জন্য একটি স্থান সংরক্ষিত করে রাখবেন যেখানে আমরা সবাই আরামে একে অন্যের সঙ্গে বসবাস করতে পারব। তিনি আমাদের পিতা হবেন, আর আমরা হব তাঁর সন্তান।
এই কারণেই, তোমাদের জমি কেনার প্রস্তাব আমরা আবার বিবেচনা করব। কিন্তু এটা সহজ হবে না— এই জমি আমাদের কাছে পবিত্র। নদীর বুক চিরে যে জল বয়ে চলে, তার ঝিলিমিলি কেবল জল নয়— তা আমাদের পূর্বপুরুষদের শোনিতবিন্দু।
আমরা যদি এই জমি বিক্রি করে দিই তাহলে তোমরা অবশ্যই মনে রাখবে মৃত্তিকা পবিত্র, এবং সন্তানদের শেখাবে যে তারা নিজেরা এবং হ্রদের পরিষ্কার জলে তাদের প্রতিটি প্রতিবিম্ব আমাদের মানুষদের জীবন ও স্মৃতির কথা বলে। জলের কলকলধ্বনি আমাদের পিতার এবং তাঁর পিতার কণ্ঠস্বর বয়ে নিয়ে আসে।
নদীরা আমাদের বোন, এবং তৃষ্ণা মেটায়। আমাদের ডিঙিনৌকোগুলোকে বয়ে নিয়ে যায়, আমাদের সন্তানদের খাদ্য জোগায় এই নদীরা।
যদি আমরা আমাদের জমি বিক্রি করে দিই তাহলে তোমাদের অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে এবং তোমাদের সন্ততিদের শেখাতে হবে এই নদীরা আমাদের এবং তোমাদের আত্মার আত্মীয়। এ-জন্য এরপর থেকে যেভাবে তোমরা তোমাদের ভাইবোনদের শুভকামী হয়ে দেখাশোনা করো, সেভাবে নদীগুলোকেও দেখাশোনা করবে।
আমরা জানি যে সাদা মানুষেরা আমাদের ভাবনার পথ বুঝতে পারে না। জমির একেক খণ্ড ওদের কাছে একইরকম। কারণ ওরা হচ্ছে আগন্তুক, যারা রাতের বেলা আসে এবং নিজেদের যা প্রয়োজন সে-সব জমির কাছ থেকে নিয়ে চলে যায়।
এই পৃথিবী তার ভাই নয়, বরং শত্রু। যখন সে জমি দখল করে জয়ী হয় তখন কেবল এগোতে থাকে। তার বাবার কবরস্থান আর সন্তানের জন্মগত অধিকার পেছনে ফেলে যায়। কোনও তোয়াক্কা না করে তার পিতার সমাধিক্ষেত্রকে ভুলে যায় আর সন্তানদের কাছ থেকে জমিকে ছিনিয়ে নেয়। সে তার মা, এই পৃথিবী, নিজের ভাই আর গগনমণ্ডলকে এমনভাবে দেখে যেন এগুলো কেনাবেচার সামগ্রী, এগুলোকে লুণ্ঠন করা যায়, বেচে দেওয়া যায়, যেন এরা ভেড়ার পালের মতো বা কাঁচের জপমালার মতো। তার অপ্রশমনীয় খিদে পৃথিবীকে গিলে খাবে এবং পেছনে পড়ে থাকবে এক মরুভূমি।
আমি তোমাদের বুঝতে পারি না। তোমাদের পথের থেকে আমাদের পথ আলাদা।
তোমাদের শহরের দৃশ্য লাল মানুষদের চোখকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করে। হয়তো এ কারণে যে লাল মানুষেরা বর্বর এবং এসব বোঝে না। সাদা মানুষদের শহরে কোনও শান্ত নীরবতার জায়গা নেই।
কোনও জায়গা নেই যেখানে বসন্তে পাতার আওয়াজ কিংবা পতঙ্গের পাখা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যায়। যেহেতু আমি একজন বর্বর এবং ভালো বুঝি না— শহরের হট্টগোল আমাদের কানকে পীড়া দেয়। জীবনের আর কী অর্থ থাকতে পারে যখন রাতচরা পাখির কর্কশ ডাক কিংবা পুকুরধারে ব্যাঙেদের তর্ক-বিতর্ক না শোনা যায়? আমি একজন লাল মানুষ, আমি এগুলো বুঝতে পারি না।
ইন্ডিয়ানরা মধ্যবেলার বৃষ্টিধোয়া বাতাসের নরম আওয়াজ কিংবা খাটো পাইনগাছের সুগন্ধ পছন্দ করে।
লাল মানুষদের কাছে বাতাস বড় মূল্যবান। কারণ পৃথিবীর সমস্ত জীবনকণা— পশু, বৃক্ষ, এবং মানুষ— একে ভাগ করে নেয়। সাদা মানুষেরা যে শ্বাস নেয় তা তো অনুভবই করতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরে মারা যাচ্ছে এমন একজন মানুষের মতো দুর্গন্ধেও সে অসাড় হয়ে থাকে।
যদি আমরা আমাদের জমি বিক্রি করে দিই, তাহলে তুমি অবশ্যই মনে রাখবে— বাতাস আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান, এবং সমস্ত জীবনকে সে ধারণ করে রেখেছে। যদি তোমরা সেই জমি কিনে নাও, তাহলে তাকে সযত্নে সংরক্ষণ করবে এবং পবিত্র রাখবে।
সে পবিত্র ভূমিখণ্ডে এমনকি সাদা মানুষেরাও যাবে ফুল আর তৃণভূমির সুগন্ধে মধুর বাতাসের স্বাদ নিতে।
যদি তোমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করি, তাহলে আমি একটি শর্ত দেব— সাদা মানুষদের এ-প্রান্তরের প্রতিটি পশুকে নিজেদের ভাই হিসেবে দেখতে হবে।
আমি একজন বর্বর, এবং আমি অন্যভাবে ভাবতেও পারি না। আমি দেখেছি প্রেইরির তৃণভূমিতে হাজার হাজার মোষ মরে পচছে— সাদা মানুষ এদের ফেলে গেছে, ট্রেন থেকে ছুটে যেতে যেতে নিছক মজা করার জন্য গুলি করে মেরেছে।
আমি একজন বর্বর। আমি সত্যিই বুঝি না— ধোঁয়া-ওগরানো ঘোড়া (চলন্ত ট্রেন) কী করে মোষের চেয়েও মূল্যবান হয়! আমরা তো কেবল বেঁচে থাকার জন্য মোষ শিকার করি। পশু ছাড়া মানুষের বাঁচাই বা কীভাবে সম্ভব?
যদি সমস্ত পশু চলে যায় তাহলে মানুষও মরে যাবে মহাবিশ্বে অসীম নিঃসঙ্গতার মধ্যে। পশুদের ক্ষেত্রে যা ঘটে, মানুষের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটে। সবাই পরস্পর-সংযুক্ত। পৃথিবীর বুকে যা নেমে আসবে ধরিত্রীমাতার সন্তানদের ওপরেও নেমে আসবে সে দুর্দৈব।
তোমাদের সন্তানদের তোমরা শেখাবে যে তাদের পায়ের নীচের মৃত্তিকাতে তাদের প্রপিতামহদের ভস্ম রয়েছে। তারা যাতে মাটিকে শ্রদ্ধা করতে পারে সেজন্য তাদের শেখাও পৃথিবী আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন দিয়ে পূর্ণ। তোমরা আমাদের যা শিখিয়েছ, সন্তানদেরও সেটাই শেখাও— এই পৃথিবী হচ্ছে মা। যা কিছু পৃথিবীকে আঘাত দেয়, আহত করে সে সবকিছুই পৃথিবীর সন্তানদেরও আঘাত দেয়। যখন মানুষ মাটিতে থুতু ফেলে সে নিজের ওপরেই থুতু ফেলে।
আমরা জানি— পৃথিবী মানুষের অধিকারে নয়, মানুষই পৃথিবীর অধিকারে। মানুষ জীবনের জাল বোনেনি; সে তো এই জালের মাত্র একটি সুতোর মতো। পৃথিবীর বুকে যা ঘটে, তা পৃথিবীর সন্তানদের ওপরেও ঘটে— আমরা এটা জানি। সবকিছু একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, যেমন রক্তের বন্ধনে পরিবার বাঁধা থাকে।
এমনকি সাদা মানুষেরাও, ঈশ্বর যাদের সঙ্গে হাঁটেন এবং কথা বলেন, একটি সাধারণ নিয়তিকে এড়াতে পারবে না। আমরাও হয়তো সবশেষে পরস্পরের ভাই হতে পারি। আমরা জানি যে হয়তো একদিন সাদা মানুষেরাও বুঝবে যে পৃথিবী তাদের কাছে মূল্যবান। এবং পৃথিবীর ক্ষতি করা আসলে পৃথিবীর স্রষ্টার প্রতি ঘৃণাকে স্তুপীকৃত করে তোলা। কোনও এক রাতে হয়তো দেখবে তোমরা যে শয্যাকে অপবিত্র করছ সে শয্যায় তোমরা বর্জ্য পদার্থে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছ।
কিন্তু হয়তো তোমাদের শেষ মুহূর্তে তোমরা এমন এক ধারণায় উদ্ভাসিত হবে যে ঈশ্বরই তোমাদেরকে এই প্রান্তরে এনেছেন— এবং তোমাদের জন্য একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেছেন: এই জমির দখল নেওয়া এবং লাল মানুষদের ওপরে আধিপত্য স্থাপন করা।
যখন সমস্ত মোষকে জবাই করে ফেলবে, সব বুনো ঘোড়াকে পোষ মানিয়ে ফেলবে, অরণ্যের গহীনতা মানুষের গন্ধে ভারী হয়ে উঠবে, আর ফলবান পাহাড়ের চূড়াগুলি ঢেকে যাবে কথা-বলা তারের জালে— তখন কোথায় পাবে সেই ঘন বনজঙ্গল? সেগুলো তো বিদায় নিয়েছে।
ঈগলগুলো কোথায়? এরাও তো বিদায় নিয়েছে।
আর এটা কেমন হবে, যদি দ্রুত উড়ে চলা পাখিদের বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে তাদেরই শিকার করে ফেলো? তখনই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে— শুরু হবে কেবলমাত্র টিকে থাকার সংগ্রাম।
আমরা হয়তো সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাওয়ার আগে সামান্য কয়েকটা দিন বাঁচব। যখন পৃথিবী থেকে শেষ লাল মানুষটিও অদৃশ্য হয়ে যাবে, আর আমাদের স্মৃতি কেবল প্রেইরির তৃণভূমির ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘ হয়ে থাকবে, তখনও তটভূমি আর অরণ্য আমাদের আত্মাকে ধরে রাখবে। কারণ তারা এই পৃথিবীকে ভালোবাসে— যেমন একজন নবজাতক ভালোবাসে মায়ের হৃদস্পন্দন।
এই পৃথিবীর যত্ন নিও, যেমন যত্ন আমরা এতদিন নিয়েছি। যেভাবে জমির কাছ থেকে গ্রহণ করছ, সেইভাবেই জমিকে ফিরিয়ে দিও— এই কথাটা মনে রেখো। তোমাদের সমস্ত শক্তি, সমস্ত হৃদয় আর সমস্ত সাহস দিয়ে একে রক্ষা কোরো— তোমাদের সন্ততিদের জন্য। ঈশ্বর যেমন আমাদের সকলকে ভালোবাসেন, তেমন করেই ভালোবাসো এই ধরাতলকে। এই ধরাতল ঈশ্বরের কাছে অমূল্য। এমনকি সাদা মানুষেরাও নিজেদের সাধারণ নিয়তির হাত থেকে রেহাই পাবে না।
কৃষির রূপান্তর— দুর্ভিক্ষ— নতুন রোগ
ওপরে আমেরিকার মুনাফার উদগ্র বাসনা থেকে গুয়ানো দ্বীপসমূহ দখলের প্রসঙ্গে স্বল্প কথা বলেছিলাম। সাম্রাজ্যবাদের জন্য বলি হওয়া দ্বীপগুলোর চেহারা কেমন হতে পারে, তার আর একটি খণ্ডচিত্র দেখা যাক— একটি ছোট দ্বীপ, নাউরু (Nauru)। ১৮৮৮ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত দ্বীপটি ছিল জার্মানদের দখলে। এর পরে কিছুদিন অস্ট্রেলিয়ার দখলেও ছিল।
ওরকম প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটি সবুজ দ্বীপের কী পরিণতি হতে পারে, তা নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটি প্রতিবেদনের ভাষায় ধরা যাক—
প্রতি ইঞ্চি হিসেবে বিচার করলে, নাউরু পৃথিবীর সবচেয়ে পরিবেশধ্বস্ত দেশ। প্রায় ৯০ বছর আগে শুরু হওয়া খোলা খননের ফলে দ্বীপটির এতখানি অংশ ধ্বংস হয়েছে যে, এখন নাউরুর মানুষদের নিজেদের ক্লান্ত, নিঃশেষিত আবাসভূমি ছেড়ে চলে যাওয়ার সম্ভাবনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে… কয়েক প্রজন্ম ধরে চলা খননকার্যের কারণে নাউরুর পরিবেশগত ধ্বংস প্রায় সম্পূর্ণ। দ্বীপটির চার-পঞ্চমাংশ ইতিমধ্যেই খুঁড়ে ফেলা হয়েছে, আর তার বদলে রয়ে গেছে ছেঁড়া-ফাটা এক মৃত, ভূতুড়ে চাঁদের ভূপ্রকৃতি— ধূসর চুনাপাথরের খাঁজখোঁজ আর উঁচু খুঁটির জঙ্গল, যেগুলোর কোনওটির উচ্চতা ৭৫ ফুট পর্যন্ত। বসবাসযোগ্য একমাত্র জায়গা একটি সরু উপকূলীয় অঞ্চল, নারকেলগাছের ছায়ায় ঢাকা। খননের কারণে আবহাওয়াও বদলে গেছে। খোঁড়াখুঁড়ির পরিত্যক্ত মালভূমি থেকে তাপতরঙ্গ উঠতে থাকে, যা বৃষ্টির মেঘ তাড়িয়ে দেয়, আর দ্বীপটি রয়ে যায় রোদেপোড়া এক খরায় পীড়িত ভূমি হিসেবে… পরিবেশবিদদের মতে, এই জমিতে আর কখনও যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হবে না।[9]
নাউরুর পরিণতি ছিল একাধিক সাম্রাজ্যবাদের সরাসরি ও ধারাবাহিক লুণ্ঠনের ফল। কিন্তু ইতিহাসবিখ্যাত ‘আইরিশ আলু দুর্ভিক্ষ’-এর পেছনেও ছিল একই ধরনের একমুখী মুনাফাভিত্তিক কৃষিব্যবস্থা— একই ফসলকে (monoculture) বছরের পর বছর ধরে একই জমিতে ফলানোর পরিণতি।
অভিজ্ঞ কৃষকদের বহুবিধ ফসল পর্যায়ক্রমে চাষ করার (rotational cropping) যে অভ্যাস ছিল, যার মাধ্যমে জমির উর্বরতা বজায় রাখা সম্ভব হত— সেই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিক পুঁজির কাছে কোনও মূল্য পায়নি।
এরই একটি ভয়াবহ পরিণতি হল কুখ্যাত “আইরিশ পোট্যাটো ফেমিন”। এই দুর্ভিক্ষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল তথাকথিত “পটেটো ওয়েজ”-এর অর্থনৈতিক কৌশল। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকদের জীবিকা এমন এক ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছিল, যেখানে তারা শুধু আলু খেয়ে বেঁচে থাকতে পারত— যা ছিল শ্রম থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদন আদায় করার বিনিময়ে ন্যূনতম খরচে শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদনের এক কৌশল।
এই সময়ে কৃষিজমিগুলিতে টানা একফসলি চাষ (monoculture) চলতে থাকে, মূলত অর্থনৈতিক লাভের জন্য। আর তখনই আঘাত হানে এক বিপর্যয়— Phytophthora infestans নামের এক ক্ষুদ্র ছত্রাকজাত জীবাণু (সম্ভবত আমেরিকা মহাদেশ থেকে আগত) ছড়িয়ে পড়ে। একই জাতের আলু দিয়ে গড়া বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র ছিল এই জীবাণুর জন্য আদর্শ পরিবেশ। ফলস্বরূপ, বিশাল ক্ষেতজুড়ে এবং খাদ্যভাণ্ডারে আলু পচে যেতে শুরু করে।[10]
ডাবলিন শহরে এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে মৃত হতদরিদ্র কৃষিশ্রমিকদের স্মরণে রওয়ান গিলেসপির এক হৃদয়স্পর্শী ভাস্কর্য রয়েছে।

নীচের ডায়াগ্রাম থেকে বোঝা যাবে, কীভাবে চিফ সিয়াটলের মতো ভূমির অন্তর্নিহিত আত্মার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত কৃষকের ভালোবাসা-উপজাত উৎপাদন সর্বোচ্চ লাভকেন্দ্রিক ‘মনোকালচার’ কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই রূপান্তর চলছে প্রায় সমগ্র বিশ্বজুড়ে।
কৃষি উৎপাদনের চরিত্রে এই পরিবর্তন নতুন রোগের ‘প্যান্ডোরার বাক্স’-এর দরজা খুলে দিয়েছে। যেমন, “তেলপাম, রবার চাষ ও ধানক্ষেতের মতো একফসলি চাষ পদ্ধতি প্রাথমিক ও গৌণ বনভূমির তুলনায় প্রজাতির বৈচিত্র্য কমিয়ে দিয়েছে। এই একফসলি জমিগুলি প্রাকৃতিক বনভূমির তুলনায় কাঠামোগতভাবে অনেক কম জটিল— এগুলিতে সাধারণত বয়স কাঠামো প্রায় একরকম, ছায়া কম বা একেবারেই নেই, নিচু স্তরের উদ্ভিদবৃন্দ খুব কম, মাইক্রোক্লাইমেট তুলনায় অস্থির ও চরম স্বভাবের, এবং মানবিক হস্তক্ষেপ ও উপস্থিতি অনেক বেশি। প্রমাণ বলছে, ভূদৃশ্যের এই ধরনের শারীরিক পরিবর্তন অথবা জীববৈচিত্র্যের ক্ষয় রোগবাহী প্রাণী বা সংক্রমণবাহী বাহকের বিস্তারকে সহজতর করতে পারে, কিংবা যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের মধ্যে সংক্রমণের হার বাড়িয়ে তুলতে পারে— এই ক্ষেত্রেও যেমন মানুষের ক্ষেত্রে ঘটছে।”[11]
করোনা অতিমারির পরবর্তী সময়ে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে: “উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য বহিঃপ্রকাশ— যেমন বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন, কোথাও অতিবৃষ্টি ও বন্যা, আবার কোথাও খরা— এসবের প্রভাব পতঙ্গবাহিত রোগের ওপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এগুলি জীবাণু, বাহক ও বাহক-বাহিত সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের ওপর যেমন প্রভাব ফেলে, তেমনি রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ক্ষমতার ওপরও প্রভাব ফেলছে।”[12]
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বলা হয়েছে: “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গড় তাপমাত্রা, তাপপ্রবাহের ঘনঘট, স্থায়িত্ব ও তীব্রতা— সব কিছুই বাড়ছে। এর ফলে একাধিক ক্ষতিকর স্বাস্থ্য-পরিণতি দেখা দিচ্ছে। এই প্রভাব সমানভাবে সকলের ওপর পড়ছে না— কিছু ব্যক্তি ও কিছু জনগোষ্ঠী এর মারাত্মক শিকার হচ্ছেন। এই বহুবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে অঞ্চলভিত্তিক ও জনসংখ্যাভিত্তিক হস্তক্ষেপমূলক কৌশল ও নীতি গ্রহণ করা জরুরি।”[13]
এবোলার ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা প্রযোজ্য। ২০১৩ সালে এবোলা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর Did Ebola Emerge in West Africa by a Policy-Driven Phase Change in Agroecology? Ebola’s Social Context শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।[14] এতে দেখানো হয়েছে, ব্রিটিশ পরিচালিত নেভাডাভিত্তিক কোম্পানি Farmland of Guinea Ltd. গিনিতে ৯,০০০ হেক্টর জমি ৯৯ বছরের জন্য লিজ নেয়— ভুট্টা ও সয়াবিন চাষের উদ্দেশ্যে। পরে সেই জমিতে পামতেল উৎপাদন শুরু হয়। এর পরপরই সেখানে প্রবেশ করে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য বহুজাতিক সংস্থা।
পাম তেল বেশ কিছুদিন ধরে একটি অত্যন্ত লাভজনক আন্তর্জাতিক ব্যবসা হয়ে উঠেছে। দানবীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলি দুইভাবে এর উৎপাদন বৃদ্ধি করে: (১) সরাসরি বিভিন্ন দেশের ওপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক চাপ সৃষ্টি করে, হাজার হাজার হেক্টর জমিতে এর ফলন ঘটানো হয়, অথবা (২) দরিদ্র বা মধ্য কৃষকদের নগদ মুনাফার লোভ দেখিয়ে জমিতে চাষের ধরন পরিবর্তন করে। যেভাবেই হোক, শেষ পর্যন্ত বহুজাতিক কোম্পানির বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা হয়। অন্যদিকে, কৃষির চরিত্র বদলে যায় এবং কৃষকের সামাজিক মানসিকতায়ও পরিবর্তন আসে।
ফলাফল? নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ “গ্লোবালাইজেশন, ক্লাইমেট চেঞ্জ, অ্যান্ড হিউম্যান হেলথ” (এপ্রিল ৪, ২০১৩, পৃষ্ঠা ১৩৩৫-১৩৪২) শিরোনামের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর পরবর্তী সংস্করণ হিসেবে “Wildfires, Global Climate Change, and Human Health” শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়।[15]
২০১৪ সালে কয়েকজন গবেষক EcoHealth জার্নালে (২৩ মে ২০১৪, পৃষ্ঠা ৬১৯–৬৩২) “Anthropogenic Land Use Change and Infectious Diseases: A Review of the Evidence” শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
এই প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে— “জমি ব্যবহারে যে anthropogenic বা মানবসৃষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে, তার ক্ষমতা রয়েছে সংক্রামক রোগের dynamics-কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বদলে দেওয়ার। জমির প্রসারণের ফলে আরও বেশি অণুজীব মানববসতির মধ্যে প্রবেশ করছে। জমির ব্যবহার বদলানোর কারণে জনসংখ্যার বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটছে, তাদের জীবনের চরিত্র বদলাচ্ছে, দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতায় (ইমিউনিটি) প্রতিক্রিয়ার ধরন বদলাচ্ছে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— রোগবাহক ভেক্টর, মানুষ ও রোগবাহকদের পারস্পরিক সংযোগ ও সম্পর্কেও পরিবর্তন আসছে।”
খুব সহজ এক প্রশ্ন ওঠে— জমি ব্যবহারে এই পরিবর্তন (ল্যান্ড ইউজ চেঞ্জ) কারা ঘটিয়েছে? কী উদ্দেশ্যে ঘটিয়েছে? যে উদ্দেশ্যে খনিজ ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সম্পদের জন্য ব্রাজিলের রেইন ফরেস্টের প্রায় ২৫ শতাংশ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, সেই একই উদ্দেশ্যে?
শিল্পবিপ্লবের পর, বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, এবং ক্রমে যখন নিওলিবারাল অর্থনীতি প্রায় একমাত্র নিয়ামক হয়ে ওঠে, তখন থেকেই প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব কায়েম এবং পুঁজির প্রয়োজনে তার যথেচ্ছ ব্যবহারের বিষময় পরিণতি আমরা ভোগ করছি।
২০১৯ সালের ১১ জুন Nature পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিভিউ প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল “Emerging human infectious diseases and the links to global food production”। এই প্রবন্ধে ২০২০ সালের মধ্যে পৃথিবীর অনুমানিক ১১০০ কোটি মানুষের জন্য জুনোটিক রোগ কী ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছিল।
বিবিসি নিউজে প্রকাশিত (১০ সেপ্টেম্বর ২০২০) একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: “Wildlife in ‘catastrophic decline’ due to human destruction, scientists warn”। এই রিপোর্টে স্পষ্ট করে বলা হয়—
আমরা আমাদের পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলছি— যে জায়গাটিকে আমরা ‘বাড়ি’ বলে ডাকি— ফলে আমাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং পৃথিবীতে টিকে থাকার ঝুঁকি বাড়ছে। এখন ধরিত্রী আমাদের কাছে মরিয়া হয়ে SOS পাঠাচ্ছে, আর আমাদের সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
আরও বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে—
নতুন ধরনের কম্পিউটার মডেল থেকে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, আমরা এখনও এই ধ্বংসকে ঠেকাতে পারি—এমনকি বাসস্থান হারানোর প্রবণতাকেও বিপরীতমুখী করতে পারি— যদি আমরা অবিলম্বে সংরক্ষণের জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করি এবং যেভাবে আমরা খাদ্য উৎপাদন ও ভোগ করি তা বদলাই।
এরও আগে, ৬ মে ২০১৯-এ বিবিসি নিউজেই প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: “Nature crisis: Humans threaten 1m species with extinction”। এই রিপোর্টে স্পষ্ট ভাষায় জানানো হয়েছিল—
১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকায় ১০ কোটি হেক্টর ট্রপিক্যাল ফরেস্ট ধ্বংস হয়ে গেছে পশুখাদ্যের জন্য পশুচারণের জমি তৈরি করতে গিয়ে, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাম অয়েল উৎপাদনের জন্য গাছ লাগানোর কারণে। বনের চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জলাভূমি— ১৭০০ সালে যে পরিমাণ ছিল, ২০০০ সালে তা এসে ঠেকেছে মাত্র ১৩ শতাংশে।
সর্বগ্রাসী নিওলিবারাল অর্থনীতি ও কর্পোরেট পুঁজি আজ সমস্ত অণুজীবের প্রাকৃতিক বাসস্থান কেড়ে নিয়েছে। এখন তাদের নতুন আশ্রয় হয়ে উঠছে মানুষের শরীর।
Mark Hamilton Lytle তাঁর The Gentle Subversive (২০০৭) গ্রন্থে র্যাচেল কারসনের দুনিয়া কাঁপানো বই Silent Spring নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন—
কারসন সামাজিক আন্দোলনকারীদের নজর পরিবেশের দিকে ফেরানোর কাজে সহায়তা করেছিলেন। র্যাচেলের পেস্টিসাইড-বিরোধী অবস্থানের মধ্যে এই অ্যাক্টিভিস্টরা আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছিলেন কর্পোরেট পুঁজিবাদের নানারকম শয়তানি। তাঁদের মতে, লাভের জন্য উদগ্র বাসনা কোনও জনহিতকর কাজ নয়, বরং তা কেমিক্যাল কোম্পানিগুলোকে আরও বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করতে উৎসাহিত করেছিল, যা পৃথিবীর উপর অধিকতর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন-চালিত কুহকজালে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কী ভয়াবহ মূল্য চোকাতে হচ্ছে, তা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। সমধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই বিদ্রোহীরা কারসনের বিশ্বাসকে আরও প্রসারিত করেছিলেন— ‘জনগণের অধিকার আছে সেসব সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার, যেগুলো তাঁদের জীবনের জন্য ক্ষতিকর।’ (পৃঃ ২০৭)
র্যাচেল কারসন তাঁর Silent Spring (২০০২) গ্রন্থে গুরুত্ব দিয়ে কেঁচোর কথা উল্লেখ করেছিলেন— ডারউইনের The Formation of Vegetable Mould, through the Action of Worms, with Observations on Their Habits গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে। তিনি লিখেছিলেন, কেঁচোরা জমির স্তর ইঞ্চি ইঞ্চি করে গড়ে তোলে এবং জমির উর্বরাশক্তি রক্ষা করে।
কিন্তু এখন প্রশ্ন—কোথায় গেল কেঁচোরা?
অনেকটা “Where have all the flowers gone?”-এর মতো।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটি দীর্ঘপ্রবন্ধ “How Humanity Unleashed a Flood of New Diseases”[16]-এ জানানো হয়েছে, মানুষের শরীরে যে রোগগুলি দেখা দেয়, তার ৬০ থেকে ৭৫ শতাংশই প্রাণীজগত থেকে আসে। লেখক লিখেছেন—
যে সমস্ত অণুজীব আমাদের দেহে রোগ সৃষ্টি করে (zoonotic pathogens), তারা আমাদের খুঁজে বের করে না কিংবা কাকতালীয়ভাবে হোঁচট খেয়ে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে না। বরং যখন প্রাণীদের দেহ থেকে মানুষের শরীরে রোগ প্রবেশ করে, কিংবা উল্টোটা ঘটে, তখন তার পেছনে মূলত এই কারণটি কাজ করে যে— আমরা আমাদের ‘shared ecosystem’-কে নতুন করে এমনভাবে গড়ে নিচ্ছি, যা এই পারস্পরিক সংক্রমণ (transition)-কে অনেক বেশি সম্ভাব্য করে তোলে। অরণ্য নিধন, খনি খনন, নিবিড় কৃষিচর্চা এবং শহরের লাগামহীন সম্প্রসারণ— সব মিলিয়ে জীবজগতের স্বাভাবিক বাসস্থান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে বনের প্রাণীদের বাধ্য হয়ে মানুষের পরিবেশে প্রবেশ করতে হচ্ছে।
কৃষি ও পশু ফার্মিং-এর নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত নিদর্শন আমরা পাই ইয়ুভাল হারারির স্যাপিয়েন্স গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে—
দুগ্ধখামারে পশুদের ব্যবহার হয় এক ভিন্নধর্মী, নিষ্ঠুর উপায়ে। সাধারণভাবে গাভী, ছাগী বা ভেড়ী কেবল তখনই দুধ দেয়, যখন তারা সন্তান প্রসব করে— তাও যতদিন না তাদের বাচ্চাদের সেই দুধ প্রয়োজন হয়। কিন্তু খামারে দুধের জোগান অব্যাহত রাখতে যেটা করা হয় তা হল, বাছুর, ছাগল বা ভেড়ার বাচ্চাদের জন্মের পরপরই মেরে ফেলা হয়। এরপর যতদিন সম্ভব, মায়ের কাছ থেকে দুধ দোয়ানো হয়। এরপর ফের তাদের গর্ভবতী করা হয়। এটি এখনও বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি। আধুনিক অনেক দুগ্ধখামারে একটি দুধদাতা গাভী গড়ে পাঁচ বছর বাঁচে— এই সময়ের প্রায় পুরোটা জুড়েই সে গর্ভবতী থাকে। তাকে প্রতি ৬০ থেকে ১২০ দিন অন্তর কৃত্রিমভাবে নিষিক্ত করা হয়, যাতে সর্বোচ্চ দুধ উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়। তার বাচ্চাকে জন্মের পরপরই মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। গাভীগুলোকে প্রস্তুত করা হয় ভবিষ্যতের দুধ উৎপাদক হিসেবে, আর ষাঁড়গুলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মাংসের খামারে।[17]
এরপর আর নতুন করে বলার কিছু থাকে না। সমস্যাকে আদ্যোপান্ত হৃদয়ঙ্গম করা, গভীরে ভাবা এবং সমাজজুড়ে এক গাঢ় সংলাপ শুরু করা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা আছে বলে মনে হয় না। পরবর্তী প্রজন্ম যদি হৃদয় ও বৌদ্ধিক জগতে এক সম্পূর্ণ রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে না যায়, যদি তারা প্রকৃতিবিনাশী কোনও প্রাণীতে পরিণত না হয়, তাহলে তারা অবধারিতভাবে আমাদের দিকে তাকাবে সন্দিগ্ধ চোখে— আমরা, যারা অন্তত ৩০০ বছর ধরে চলা এই অপরাধসমূহের প্রজন্মগত সাক্ষী এবং নীরব মদতদাতা।
বিশ্বব্যাংকের তরফে ২০০৯ সালে একটি সুবৃহৎ পুস্তক প্রকাশিত হয়— Awakening Africa’s Sleeping Giant: Prospects for Commercial Agriculture in the Guinea Savannah Zone and Beyond। বইটির শেষের দিকে বলা হয়েছে:
এটা বিস্ময়কর নয় যে সফল বাণিজ্যিক কৃষির বিকাশে প্রধান পরিচালন-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ হল— কীভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পরিষেবা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমন্বয় ঘটানো যাবে। এ সমন্বয় সাধন করতে হবে একাধিক স্তরে— বিভিন্ন দপ্তরের বিনিয়োগ এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় একেবারে শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন, যিনি নিশ্চয়তা দেবেন যে কোনও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের কৃষির বিকাশকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে— যেমনটা ব্রাজিল ও থাইল্যান্ডের উদাহরণ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। (পৃঃ ১৯২)
এরকম “প্রয়োজনীয়” রাজনৈতিক নেতৃত্বের চেহারা আমরা আমাদের দেশে দেখতে পেয়েছি “Forest (Conservation) Rules, 2022”-এর মধ্যে দিয়ে। এই নতুন নিয়মে বলা হয়েছে— অরণ্য অঞ্চলের অধিবাসীদের আগাম অনুমতি ছাড়াই, যারা প্রাইভেট পুঁজি বিনিয়োগ করবে তারা নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন করতে পারবে।
PLoS One জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে (৩ জুন, ২০২২) “State-led agricultural subsidies drive monoculture cultivar cashew expansion in northern Western Ghats, India” শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র। এই গবেষণাপত্রের সিদ্ধান্ত ছিল—
আমাদের গবেষণা সরকার-প্রণোদিত কৃষি ভর্তুকি কীভাবে চাষিদের কাজু চাষে উৎসাহিত করছে, সেই সঙ্গে চাষপদ্ধতির ধরন এবং এই সব উপাদান কীভাবে রাজ্য ও খামারস্তরে বন উজাড় ঘটাচ্ছে— তা আরও গভীরভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করে।
এর পরে বিচারের ভার যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের হাতে। সমাজকর্মীদের হাতে— এমনকি চিকিৎসকদের হাতেও, যেমনটা আমরা The Lancet, Science, ও New England Journal of Medicine-এর মতো জার্নালগুলির আলোচনায় দেখেছি।
শেষ কথা
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বিকল্প কোনওভাবেই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত Health and Wellness Centre (HWC) হতে পারে না। জনস্বাস্থ্যের আঁতুরঘর হল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখানে সাপে কাটার চিকিৎসা হয়, চিকিৎসা হয় মাল্টি-ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগীর, এবং আরও অনেক অবহেলিত রোগেরও। Do We Care গ্রন্থের সুপরিচিত বিশেষজ্ঞ লেখিকা সুজাতা রাও বলেন—
একটি হার্ট সার্জারি, কানের একেবারে অন্তর্ভাগে ইমপ্ল্যান্ট বসানো কিংবা সিজারিয়ান সেকশনের জন্য অর্থ পাওয়া সহজলভ্য, কিন্তু সহজলভ্য নয়— প্রয়োজনীয় এবং একেবারে প্রাথমিক ডায়াগ্নোসিসের জন্য, কীভাবে রোগ প্রতিরোধ করা যায় সে শিক্ষার জন্য, রোগ থেকে সেরে ওঠার পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য, বৃদ্ধদের দেখভাল ও যত্নের জন্য, স্কুলে স্বাস্থ্যরক্ষা এবং বয়ঃসন্ধিকালের যত্নের জন্য, অথবা communicable (যেমন ডায়ারিয়া, টিবি, শ্বাসকষ্টের রোগ) এবং non-communicable (যেমন ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক) রোগগুলোর যে সরাসরি কারণ (যেমন দূষিত পানীয় জল, দূষিত পরিবেশ বা বায়ু) সেগুলোকে আয়ত্তে আনার জন্য। অর্থ নেই অ্যাক্সিডেন্টের চিকিৎসার জন্য, অর্থ নেই সামান্য জ্বরের চিকিৎসার জন্য, অর্থ নেই সাপে কাটা রোগীর জন্য— অথচ এই বিষয়গুলোই দরিদ্র মানুষের জন্য নিতান্ত গুরুত্বপূর্ণ। (পৃঃ ২৪–২৫)
ভারতের জনস্বাস্থ্যের সরকারি ধারণা এখানে নিরুত্তর। আমরা HWC চাই না, চাই উপযুক্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং এক জীবন্ত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা— যা ১৯৪৮ সালে “ভোর কমিটি”-র রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছিল, এবং সাম্প্রতিক কালে শ্রীনাথ রেড্ডির নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন প্রতিবেদনে যার ওপর আবার জোর দেওয়া হয়েছে।
যখন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বলদর্পী কণ্ঠে ঘোষণা করা হয়— “২০২৬ সালের মধ্যে মাওবাদীদের নির্মূল করা হবে” (পড়ুন: জনজাতি সম্প্রদায়ের একাংশকে), তখন সত্যিই ভয় জাগে।
এতদিন ধরে বনজ, খনিজ এবং বিপুল জীববৈচিত্র্যসম্পন্ন অঞ্চলগুলোকে জনজাতি সম্প্রদায় রক্ষা করে এসেছে। এখন তাঁদের উন্মূল ও নির্মূল করে কর্পোরেট দুনিয়ার আদানিদের জন্য সবকিছু দখল করে (প্রথম শিল্প বিপ্লবের সময়ের মতো) সমস্ত কিছু আমূল ধ্বংস করে দেওয়ার প্রস্তুতি কি চলছে? আরও নতুন রোগের উদ্ভব হবে। ভারতের জনস্বাস্থ্য চেতনা সচেতনভাবে সরকারি স্তরে এবং অসচেতনভাবে গণমানসে সম্পূর্ণত অনুপস্থিত, অবহেলিত এবং প্রায়-অনুপস্থিত একটি বিষয় হিসেবে পরিগণিত।
[1] Piketty, Thomas. A Brief History of Equality. 2022. p. 49.
[2] প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৬।
[3] প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৫।
[4] Hungry for Profit: The Agrobusiness Threat to Farmers, Food, and The Environment, ed. Magdoff, Fred; Foster, John Bellamy and Buttel, Frederick H. 2000. পৃঃ ৪৪-৪৫।
[5] অন্যদিক থেকে দেখলে, পরিবেশগত বা ‘এনভায়রনমেন্টাল’ নাগরিকত্বও বটে।
[6] Seattle: University of Washington Press, 1997, পৃঃ ১০–১৭।
[7] Hutchinson, Charles J. 1916.
[8] উৎস: Crowley, Walt. Chief Seattle’s Speech. Historylink.org. প্রবেশ তারিখ: ৮ আগস্ট, ২০২২।
[9] Shenon, Philip. A Pacific Island Nation Is Stripped of Everything. নিউ ইয়র্ক টাইমস। ডিসেম্বর ১০, ১৯৯৫। পৃঃ ৩।
[10] Vandermeer, John H. The Ecology of Agroecosystems. 2011. পৃঃ ৫।
[11] Shah, Hiral A, Huxley, Paul, Elmes, Jocelyn & Murray, Kris A. Agricultural land-uses consistently exacerbate infectious disease risks in Southeast Asia. Nature. Sep 20, 2019. pp. 1-13, পৃঃ ৭।
[12] Thomson, Madeleine C. and Strawberry, Lawrence R. Climate Change and Vectorborne Diseases. New England Journal of Medicine. 2022, (387): 1969-1978.
[13] Bell, Michelle L. et al. Climate Change, Extreme Heat and Health. New England Journal of Medicine. 2024, (390): 1793-1801.
[14] Environment and Planning A 2014, volume 46, pages 2533-2542.
[15] নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন, নভেম্বর ২৬, ২০২০, পৃষ্ঠা ২১৭৩-২১৮১।
[16] ফেরিস জাবর, ২৫ জুন ২০২০।
[17] অনুবাদ: মোস্তাক আহমেদ, শুভ্র সরকার, সুফিয়ান লতিফ ও রাগিব হাসান। বাংলাদেশ সংস্করণ। পৃষ্ঠা ৯০।