করোনা বৃত্তান্ত— একটি সামাজিক পাঠ

বিষাণ বসু

 




লেখক চিকিৎসক, গদ্যকার, প্রাবন্ধিক।

 

 

কয়েকজন মানুষ। দুজন কি তিনজন হবে। এরকম মানুষজনকে আমরা রোজই দেখি রাস্তাঘাটে – বাজারে যাওয়া বা আসার পথে – হুস করে গাড়ি ছুটিয়ে চলে যাওয়ার মাঝে জানলার কাচ দিয়ে বাইরের দিকে তাকালে। এঁদের আমরা দেখতে পাই রোজ – কিন্তু, লক্ষ্য করি না সেভাবে – চিনি না তো একেবারেই। সকালে চায়ের দোকানে গিয়ে চায়ের আশায় ছিলেন তাঁরা – হ্যাঁ, এই লকডাউনের বাজারেও। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে – এই দুঃসময়ে দেশের কথা না ভেবে – মাস্কহীন তাঁরা দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন।

ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত প্রশ্নের উত্তরে বিস্মিত বাধোবাধো গলায় বলছিলেন— আমরা চা খাব না? খাব না আমরা চা??

আপনিও দেখেছেন হয়ত সেই ছবি। রেগে গিয়েছেন এদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কথা ভেবে – খিল্লি করেছেন এঁদের নিয়ে – শালা, এই বাজারে চা খাবে!! শখ কতো!! সত্যিই তো!! দেশ যখন একজোট হয়ে লড়তে বসেছে, এই মালগুলো সেই লড়াইটা ভেস্তে দিতে চাইছে। এরা বুঝছেও না, ঝুঁকিটা এঁদের শুধু নয় – এদের হাত ধরে অসুখটা ছড়িয়ে পড়তে পারে দিকে দিকে – করোনা সত্যিকারের মহামারী হয়ে যেতে পারে এদের জন্যেই।

হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলছেন— বেশ কিছু মানুষ যদি নিয়ম না মেনে রাস্তায় নেমে পড়েন, তাহলে করোনা মহামারির পর্যায়ে পৌঁছানোর সমূহ সম্ভাবনা। আর সত্যিসত্যিই সেটা হলে— অন্তত এদেশে— গরীব মরবে বড়লোকের চেয়ে বেশিই। অনেক বেশি।

তাহলে, এরা বুঝতে চাইছে না কেন? নিজের ভালো নাকি পাগলেও বোঝে। এরা তাহলে ঠিক কী!!

***

ইদানীং আমাদের চিন্তাভাবনা বড্ডো শিক্ষিত উচ্চমধ্যবিত্ত বয়ানের অনুসারী – প্রচলিত শিক্ষাদীক্ষাও, সুকৌশলে, তেমন করেই ভাবতে শেখায়। দুর্ভাগ্যজনক, যে পেশাটির বিদ্যে বেশি করে জনমুখী হওয়া জরুরি, সেই ডাক্তারি শিক্ষাও এখন সেই পথেই ভাবতে শেখাচ্ছে – এই কারিকুলামে শিক্ষিত হয়ে দেশের সাধারণ মানুষের চাইতে আমরা উচ্চমধ্যবিত্তদের স্বাস্থ্যসমস্যার নিরসনে বেশি দক্ষ –  দেশের চাইতে বিদেশের অসুখ বিষয়ে আমরা বেশি জানি, অন্তত এমডি পরীক্ষায় চান্স পেতে হলে সেরকম না জানলে মুশকিল – বিদেশের পরিকাঠামোজাত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তথ্য অনুসারে দেশের গরীবদের চিকিৎসার ফরমান দিই – দেশের সমস্যার সমাধানের জন্যে বাকি বিবেচনা ছেড়ে বিদেশের ভাবনা কপি-পেস্ট করি। 

আমার ডাক্তারি পড়ার শুরুর দিকে একটি পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম – যতদিন না পর্যন্ত গরিব মানুষের একটি বা দুটি বাচ্চা বেঁচেবর্তে থাকবে শেষমেশ, এই নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে – ততদিন এদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সেভাবে সফল হবে না – অর্থাৎ জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষার প্রসার ঘটলে পরিবার পরিকল্পনা কোনও প্রচারের ঢক্কানিনাদ ছাড়া আপনাআপনিই সম্ভবপর হয়ে যাবে। না, সেই বই, বা সে ধরণের বই, এখন আর তেমন জনপ্রিয় নয়। আউটডোরে দুটি বাচ্চাকে সাথে নিয়ে মা যখন তৃতীয় বা চতুর্থ শিশুটির চিকিৎসার প্রয়োজনে আসেন –  ডাক্তারবাবু আর পাঁচটা শিক্ষিত-উচ্চমধ্যবিত্তের ছাঁচে-ঢালা মানুষের মতো করেই যারপরনাই বিরক্ত হন – বলেন, ঠিক করে খাওয়াতে পারো না, এদিকে বছর বছর বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে ঠিকই!! খাওয়ানোর বন্দোবস্তের ভাবনা না ভেবেই এই যে নিরন্তর বাচ্চা পয়দা করা, এর মধ্যে পশুসুলভ অবাধ ও সংযমহীন যৌনতা বাদ দিয়ে অন্য কারণের কথা শিক্ষিত উচ্চমধ্যবিত্তদের মতোই, খুব কম চিকিৎসকই ভেবে থাকেন – আর, বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের যে পিলপিল করে বাচ্চা হয়, এই বয়ানে এমনকি অনেক ডাক্তারও বিশ্বাস রাখেন। 

না, আমাদের স্বাস্থ্যভাবনা, বা জীবনযাপন ও তজ্জনিত স্বাস্থ্যচিন্তার সাথে যে আর্থসামাজিক অবস্থান বা শিক্ষার কিছু সংযোগ আছে – আর্থিক সিঁড়ির নিচের দিকে থাকা লোকজনের আচার-আচরণ বিষয়ে জাজমেন্টাল হওয়ার মুহূর্তে একথা আমাদের মাথায় থাকে না – অচিকিৎসক শিক্ষিত মানুষের তো থাকেই না, অধিকাংশ চিকিৎসকেরও থাকে না – অবশ্য, কোনও ভাবনাই তো নিজের নিজের শ্রেণি-অবস্থানের বাইরে নয় – তাই না?? 

ক্যানসার নিয়ে লেখাপড়া করার শুরুর দিকে একখানা টেক্সটবই হাতে এসেছিল – সে বই তখনই বাতিলের দিকে – বিশেষ কেউ পড়তও না, বইয়ের সংস্করণও হত না তেমন নিয়মিতভাবে। সেই বইয়ে মুখের ক্যানসার চ্যাপ্টারে ধূমপান বা তামাকজাতীয় দ্রব্য মুখে রাখা থেকে ক্যানসারের ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল – মুখের ক্যানসার সাধারণত আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের হয়। আর তামাকজনিত ঝুঁকির বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াসের মুহূর্তে মাথায় রাখতেই হবে, যে, যতদিন না পর্যন্ত এই মানুষগুলোর সামনে একটা স্বচ্ছন্দ ভবিষ্যতের আভাস দৃশ্যমান হচ্ছে, ততোদিন পর্যন্ত সুদূর ভবিষ্যতে (যে ভবিষ্যতকে তিনি আদৌ চেনেন না) অনিশ্চিত কিছু সুবিধের আশায় মানুষ তাৎক্ষণিক আনন্দ বা আরামটুকু ছেড়ে দেবেন না – অর্থাৎ, ভবিষ্যত বিষয়ে অন্তত কিছুটা বাস্তবসম্মত নিরাপত্তার আশা না থাকলে মানুষ সস্তা নেশার আপাত আনন্দের বদভ্যেস ছাড়েন না (সে নিরাপত্তা থাকলেও সবসময় ছাড়ে এমন নয় – কিন্তু, নিরাপত্তা না থাকলে ছাড়ার সম্ভাবনা আরও কম)। মাথায় রাখা যাক, আমাদের দেশে মুখের ক্যানসার খুব বড় সমস্যা – কিন্তু, তার রিস্ক ফ্যাক্টরগুলোর পেছনে আর্থসামাজিক যুক্তিগুলো নিয়ে আমরা আদৌ ভাবি না। 

আসলে, এমন করে ভাবা ইদানিং ব্যাকডেটেড। ডাক্তারি ছাত্র হোন, বা অন্যান্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনগণ – কেউই এইসব অপ্রাসঙ্গিক ভাবনাচিন্তাকে ভালো চোখে দেখেন না – চলতি বাংলায় এগুলোকে বাজে হ্যাজানো বলে বিবেচনা করাই দস্তুর। ক্যানসার আলোচনায় ঠিক কোন ক্যানসার কতো চমৎকার টেকনোলজি দিয়ে, বিজ্ঞানের কী চমকপ্রদ গবেষণালব্ধ ওষুধ দিয়ে সারিয়ে ফেলা যাবে, নিদেনপক্ষে নিয়ন্ত্রণে রেখে দেওয়া যাবে পাঁচ কি দশ বছর – না, খরচাপাতি নিয়ে না ভাবলেও চলবে – এমন আকর্ষণীয় অ্যাকাডেমিক আলোচনার মুহূর্তে ঠিক কেন কাদের ক্যানসার হচ্ছে এবং তাঁদের মধ্যে কেন বারবার বলা সত্ত্বেও এমন ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা কমানো যাচ্ছে না – সে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক বই কি!!   

অতএব, রিক্সাওয়ালা দিনের রোজগারের টাকাটুকু সন্ধের চোলাইয়ের ঠেকে কেন উড়িয়ে দেন, এই নিয়ে আমাদের মধ্যবিত্ত যাপন বিচলিত হয় – কিন্তু, সেই বিচলিত হওয়ার মধ্যে “ওরা-ওরকমই” বা “এইজন্যেই-ওদের-কিস্যু-হয়-না” গোছের শ্রেণিসন্তুষ্টির বেশি গভীর কোনও অন্বেষণ থাকা সম্ভবপর হয় না। 

***

মানছি, করোনা নিয়ে ঘনঘোর আশঙ্কার মুহূর্তে এসব কথাবার্তা কিঞ্চিৎ অপ্রাসঙ্গিক।

কিন্তু, আপনার সহনাগরিক – হ্যাঁ, সেইসব সহনাগরিক, যাঁরা এতদিন ধরে বাজার অর্থনীতির জাদুবিদ্যায় স্রেফ ভ্যানিশ হয়ে থাকার শেষে করোনার সোনার কাঠির ছোঁয়ায় আচমকা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছেন আপনার সামনে – তাঁদের আচার-আচরণ নিয়ে যারপরনাই বিড়ম্বনায় পড়েছেন আপনি – ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, ঠিক কীভাবে রিয়্যাক্ট করলে আপনি যে দেশের এই দুর্দিনে জাতির কঠিন পরীক্ষায় একজন দাপুটে ইনভিজিলেটর সেও প্রমাণ হতে পারবে, আবার ওদিকে আপনি যে যথেষ্ট সমাজমনস্ক ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জন্যে ভাবনায় আকুল, সেটুকুও বজায় থাকতে পারবে – এককথায়, “ওরা” যেন আপনাদের বাঁচানোর জন্যে যে অদম্য সরকারি প্রয়াস, তাকে ঘেঁটে দিতে না পারে, সেটা খেয়াল রাখা, আবার পাব্লিক আপনাকে যেন না ইনসেনসিটিভ ভেবে বসে, সেটুকুও নিশ্চিত করে রাখা – এই শ্যাম-রাখি-না-কূল-রাখি অবস্থাটা ঘুঁটিয়ে দেখতে চাইলে, আগের কথাগুলো তেমন অবান্তর কি?? 

আবারও নিজের কথা বলি। ছাত্রজীবনে একখানা ছোট পাঠ্যবই পড়েছিলাম – ট্রপিকাল পেডিয়াট্রিক্স – শুরুর দিকে লেখক বলেছিলেন, ট্রপিকাল পেডিয়াট্রিক্সের অর্থ, ট্রপিকাল দেশের বাচ্চাদেরই বিশেষত যে অসুখগুলো হয়, সে নিয়েই আলোচনা  – অর্থাৎ মূলত সংক্রামক অসুখবিসুখ – না, এসব দেশে এই অসুখগুলো হওয়ার পেছনে বিশেষ কোনও ভৌগোলিক কারণ থাকে না – থাকলেও, আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এই দেশগুলো গরিব দেশ – আর দারিদ্র‍্য ও তজ্জনিত শিক্ষার অভাব, জনস্বাস্থ্যের অনুন্নতির জন্যেই এই দেশগুলোর মানুষ সংক্রামক অসুখে বেশি বেশি করে আক্রান্ত হন।

হ্যাঁ, গরিবরাই সংক্রামক অসুখে বেশি আক্রান্ত হন। অতএব, সংক্রামক অসুখ নিয়ে আমরা এতদিন ভাবিনি। অতএব, সংক্রামক অসুখের চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা প্রায় বন্ধ অনেকবছর ধরেই – স্যুগার-প্রেসার-ক্যানসারের দাওয়াইয়ের খোঁজে যে অর্থকরী গবেষণা, তার শেষে টাকা পড়ে থাকলে সেটুকু উচ্ছিষ্ট জোটে এই খাতে। অতএব, এই শতকে নতুন কোনও ক্লাস-এর অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হয়নি, যে কিনা নতুন পদ্ধতিতে জীবাণুকে ঘায়েল করবে। (না, নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হলেও করোনা মোকাবিলায় কার্যকরী হত না – কেননা, করোনা ব্যাকটেরিয়া নয়, ভাইরাস।)  

আজ হঠাৎ করে এক গণতান্ত্রিক শ্রেণি-অচেতন ভাইরাস এসে ধনীদরিদ্রের ব্যবধান ভেঙে দিচ্ছে – ভারত নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, করোনা-যুদ্ধে কে এগিয়ে এমন আশ্চর্য প্রতিযোগিতার জন্ম দিচ্ছে – আর টিভির পর্দায় পাঁচতারা কর্পোরেট হাসপাতালের ততোধিক হাইএন্ড ডাক্তারবাবু অভ্যস্ত চটকদারিত্বের সাথে জীবাণুঘটিত ছোঁয়াচে অসুখবিসুখে ঠিক কী পথে চলা উচিত, সে বিষয়ে চাট্টি নেট-সার্চ করা অনিশ্চিত বিদ্যে জাহির করছেন – টিভির পর্দায় গভীর আলোচনার ফাঁকে ফাঁকেই, তিনি এদেশে জনসচেতনতার কী সাঙ্ঘাতিক অভাব এবং সবাই মিলে আট্টু সচেতন হতে পারলেই আমরা তামাম বিশ্বকে জাস্ট দেখিয়ে দিতে পারি, এমন দেশপ্রেমিক বাণীও মাঝেমধ্যে গুঁজে দিচ্ছেন – অথচ, তিনি নিজেও জানেন, ছোঁয়াচে অসুখের পেশেন্ট এসে পড়লে পত্রপাঠ আইডি হাসপাতালের রাস্তা দেখিয়ে দেওয়াই দস্তুর তাঁর কর্মক্ষেত্র পাঁচতারা হাসপাতালে – এদিকে ইলেকট্রনিক মিডিয়া চট করে পাঁচতারার বাইরে যাঁরা চিকিৎসা করেন, তাঁদের ডাক্তার বলে বিশ্বাস করতে পারেন না – সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের তো নয়ই – করোনা-ই হোক বা করোনারি, নিয়মের বাত্যয় হতে যাবে কেন খামোখা – যা-ই বলুন, ভারতীয় সমাজজীবনে করোনা ভাইরাসের প্রভাব রচনা পরের বার পরীক্ষায় এলে, লিখতে তেমন অসুবিধে হবে না। 

***

একদিনের জনতা কার্ফ্যু। সেদিন সন্ধেবেলায় দেশের আশিটি জেলায় দশদিনের লকডাউনের ঘোষণা। দুদিনের মধ্যেই দেশজোড়া লকডাউন। একেবারে তিন সপ্তাহব্যাপী বনধ।

আচমকা ঘোষণার ঠেলায় এক বড় অংশ দিশেহারা। আরেকটা অংশ মেনে নিচ্ছেন – অসুবিধে সত্ত্বেও মেনে নিচ্ছেন – কেননা, এই পরিস্থিতিতে এছাড়া উপায়ই বা ছিল কী!!

সমস্যা এই, এই দিশেহারা অংশটির অবস্থা অনেকেই বুঝতে পারছেন না, বা বুঝতে চাইছেন না – আরও দুর্ভাগ্যজনক, যাঁরা দিশেহারা, তাঁরাই এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং যাঁরা বুঝতে চাইছেন না, তাঁদের কণ্ঠস্বরটিকেই সমগ্র জাতির কণ্ঠস্বর হিসেবে ধরে নেওয়ার প্রবণতা ইদানিং। 

অতএব, একদিনের জনতা কার্ফ্যুর সন্ধেবেলায় দশদিনের লকডাউন ঘোষিত হলে পরদিন সকালে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পড়ি-কি-মরি তাড়নায় বাসে ভিড় হলে আমরা ভারী বিচলিত হই – একি, সোশ্যাল ডিস্টান্সিং-এর কী হবে তাহলে – আবার পরক্ষণেই জিভ কাটি, স্যরি, বালাই ষাট, সোশ্যাল ডিস্টান্সিং সে আবার কী অলক্ষুণে কথা – ফিজিকাল ডিস্ট্যান্সিং বলুন, প্লীজ।  

বাজারে ভিড়ের ছবি দেখে আপনি ভারী বিচলিত হন – সত্যি, এদেশের যে কী হবে – গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পাব্লিক বাজার করছে – মুদির দোকানে লাইন লাগিয়েছে – ন্যূনতম দূরত্বটুকুও বজায় রাখছে না কেউ – সে ছবি দেখে টিভি স্টুডিওতে বসে থাকা ডাক্তারবাবু একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলছেন, ইরেস্পন্সিবল বিহেভিয়ার – না, বিরক্তি প্রকাশের জন্যে অত শালীন শব্দমালা নিশ্চয়ই আপনি একান্তে ব্যবহার করেন না।

আসলে, কুড়ি কেজি চাল, পাঁচ কেজি ডাল আর চারডজন ডিম – এটুকু আপনি বাড়িতে আগেভাগেই কিনে রেখেছেন কিনা জানি না – কিন্তু, কিনবেন কি কিনবেন না, সেটা আপনার চয়েস – মানে, কেবলমাত্র টাকায় কুলোচ্ছে না বলেই কিনে উঠতে পারেননি, ব্যাপারটা এরকম নয়। সেক্ষেত্রে, দিন-আনি-দিন-খাই মানুষগুলোর কেন পাঁচ টাকার জিরে আর আড়াইশো পটল কেনার জন্যে নিয়মিত দোকানে যাওয়ার অভ্যেস – মাসের শেষে অনেক নিম্ববিত্ত চাকুরিজীবির পক্ষেও কেন এক লফতে বেশি মাল কিনে ফেলা সম্ভব হয় না – এ আপনি বুঝবেন কোত্থেকে!! 

দিনের রোজগার বন্ধ হলে খাওয়াও বন্ধ – দুচারদিন ধারদেনা উঞ্ছবৃত্তি করে চললেও চলতে পারে – বেশীদিন তো চলবে না, বিশেষত অনিশ্চয়তা যখন চারপাশেই – অতএব, চিন্তা করবেন না, এই তো সবে এক সপ্তাহ গেল – লকডাউনের দ্বিতীয় কি তৃতীয় সপ্তাহে বাজারে ভিড় আপনিই কমে যাবে – যদি না পেটের তাগিদে মানুষ লুটপাট করার কথা ভাবে। অবশ্য, শেষেরটি ঘটার সম্ভাবনা কম – মাণিকবাবুর “ছিনিয়ে খায়নি কেন” পড়েননি? – না পড়ে থাকলে, পড়ে নিন, প্লীজ – এই মুহূর্তে ওর চেয়ে প্রাসঙ্গিক গল্প কমই আছে।  

রাস্তার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খেয়েছেন নিশ্চয়ই কখনও না কখনও। আপনি যখন মাটির ভাঁড়ে আয়েশ করে চুমুক দিয়েছেন – খেয়াল করেছেন কি আপনার পাশেই প্রায়-অদৃশ্য কিছু মানুষ চা খান ছোট্ট প্লাস্টিকের কাপে – আপনার মাটির ভাঁড়ে চায়ের দাম পাঁচ টাকা, প্লাস্টিকের কাপে তিন টাকা – আরেকটুক্ষণ দাঁড়ালে দেখতে পেতেন, চায়ের সাথে একখানা দুটাকার নোনতা বিস্কুট খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেও এঁদের অনেকেই কেমন পকেটের খুচরোটুকু গুণে ইচ্ছেটা আবার পকেটেই পুরে নেন।

খেয়াল করেছেন কি, মাঝেমধ্যে, রাস্তার মোড়ে ভিক্ষে করার ফাঁকে, ডাস্টবিন থেকে ময়লা বাছার ফাঁকে দশবছরের বাচ্চা দুবছরের বোনকে কোলে নিয়ে চায়ের দোকান থেকে কেক কিনে খাওয়ানোর বিলাসিতা দেখায় – মাথায় রাখুন, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ যে পিছিয়ে পড়া মানুষ, এরা তাঁদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন।

লকডাউনের দিনগুলোতে এরা কেমন আছেন? আর, যারা রয়েছেন এদের থেকেও নিচে??

***

জানতে চেয়েছেন কখনও?

জানবেনই বা কোত্থেকে!! লকডাউনের আগে এরা ঠিক কেমন করে বেঁচে ছিলেন, সে খবর নেননি কোনওদিন। আজ, বাড়তি টেনশন বা স্ট্রেসের মুহূর্তে সে খবর নেবেন কী করে!!

অথচ, অবস্থাটা এমনই বেয়াড়া, সে খবর না নিলেই নয়। কেননা, এ এমন অসুখ, একা বেঁচে যাওয়া যাবে না কোনোওভাবেই। “ওদের” মধ্যে অসুখ পাইকারি রেটে ছড়াতে থাকলে, সে অসুখ আপনার কাছেও ঠিক পৌঁছে যাবে। “ওরা” তো এমনিও মরে, অমনিও মরবে – এদেশে বছরে দুলাখ মরে টিবিতে, তার চাইতে কিছু বেশি পাতলা পায়খানায়, অপুষ্টিজনিত অসুখে কমবেশি পঁচিশ লাখ – জিজ্ঞেস করে দেখুন, এবছরে করোনায় বাড়তি একলাখ মরলে “ওদের” দিক থেকে তেমন একটা আপত্তি নেই – বিশেষত, যেখানে করোনায় মরার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বিপরীত অপশন নিশ্চিত অনাহার – কিন্তু, আপনি জানেন, “ওরা” যদি একবার করোনায় মরতে শুরু করে, তাহলে আপনার ঘোর বিপদ!!  

অতএব, “ওদের” সুস্থসবল বাঁচিয়ে রাখা দরকার – কিন্তু, আপনার থেকে দূরে। ঠিক যেমনটি হল দমদমে – ফুটপাথ-রেলস্টেশনে গাদাগাদি করে থাকা মানুষগুলোর জন্যে সাময়িক ছাদের বন্দোবস্ত করতে গেলে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন এলাকার আপনারা – অর্থাৎ যাঁরা উচ্চশিক্ষিত, মধ্যবিত্ত কি উচ্চমধ্যবিত্ত, তথাকথিত সচেতন নাগরিক – আপনারা আপত্তি তুললেন – বললেন, “ওরা” এখানে বসে অসুখের ডিপো হয়ে থাকবে, আর বিপদ হবে আমাদের – “ওরা” অন্য কোথাও গিয়ে থাকুক, আমাদের গায়ে গায়ে নয়। 

অবশ্য, এরকম দ্বিচারিতা আপনাদের জীবনের পরতে পরতে। রোববার বিকেলে কাঁসরঘণ্টা খোলকরতাল বাজিয়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি তথাকথিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে বসলেন যাঁরা – সেই তাঁরাই আগের দিনটি পর্যন্ত ট্রেনে-বাসে-পাড়ার চায়ের দোকানে ডাক্তারদের আদ্যশ্রাদ্ধ করছিলেন – আবার রোববারের পরের সোমবারই ডাক্তার-নার্সদের সামাজিক বয়কটের পর্যায়ে ফেলে দিলেন, পাছে তাদের ছোঁয়াচ লেগে আপনারও অসুখ হয়ে যায়!!  

নাঃ, লেখাটা বড্ড এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঠিক কী লিখব বলে শুরু করেছিলাম, আর শেষমেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছি!! না, ঠিক কোথাওই গিয়ে দাঁড়াচ্ছে না লেখাটা— প্রায় অবিন্যস্ত প্রলাপের মতো হাবিজাবি ভাবনার সমষ্টি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

আসলে… কয়েকটা ছবি… কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট দৃশ্য… আপনাদের কিছু কিছু প্রতিক্রিয়া… সব কিছু কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে।

দৃশ্য এক। ওই চায়ের প্রত্যাশায় থাকা উসকোখুসকো লোকগুলোর মুখ।

দৃশ্য দুই। আমার একান্ত পরিচিত সেই ডাক্তার ভাইটির মুখ। লকডাউনের মুহূর্তে যাঁকে বাড়িওয়ালা নোটিশ দিয়েছেন – আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতেই হবে। (কী আশ্চর্য শিক্ষা আপনাদের – ঢাল-তরোয়াল ছাড়া লড়তে পাঠানো হচ্ছে যে স্বাস্থ্যকর্মীদের – আপনারা তাঁদের থেকে নিজেদের সংক্রমণের ভয় পাচ্ছেন – কিন্তু, পাইকারি হারে ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের বড় অংশ অসুস্থ হয়ে পড়লে, আপনি চিকিৎসাটা পাবেন কোন চুলোয়, এই আশঙ্কার কথাটা আপনার মাথায়ই আসছে না!! নিখিল বিশ্বে করোনা-ই একমাত্র অসুখ নয় – ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়া-হার্ট অ্যাটাক-স্ট্রোক সবই হচ্ছে এবং হবেও – তাহলে?? আপনার স্বার্থেই তো চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সুস্থ থাকা দরকার – ভেবেছেন একবারও??) 

দৃশ্য তিন। টিভির পর্দায় গভীর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ – লকডাউন পঞ্চাশ কি ষাটদিন পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া ঠিক কেন জরুরি – না হয় প্রথম ওয়েভটিকে সামলে দেওয়া গেল এযাত্রা – কিন্তু, দ্বিতীয় ঢেউ – আর তারপরে তৃতীয় ঢেউ – পঁয়তাল্লিশ, পঞ্চাশ, নাকি ষাট – কদিন ধরে লকডাউন হলে ব্যাপারটা এক্কেবারে নিশ্চিত – কোন কোন দেশ ছমাস লকডাউন করে ফেলেছে, আমরা পারব না কেন – অঙ্ক আর গ্রাফ দিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। মনে হচ্ছিল, এগুলো জাস্ট সূক্ষ্ম হিসেবের ব্যাপার – এই অঙ্কে কোনও কোল্যাটারাল ড্যামেজ নেই – করোনা নিকেশ করা বাদ দিয়ে মানবজাতির সামনে বৃহত্তর কোনও লক্ষ্য নেই – আঁক কষার মুহূর্তে ভাবার প্রয়োজনই নেই, ঠিক কতো কোটি মানুষ মারা যেতে পারেন অনাহারে – এদিকে কতজনকে করোনা-য় মৃত্যু থেকে বাঁচাবো বনাম কতজনকে নিশ্চিত অনাহারের দিকে ঠেকে দেবো, দাঁড়িপাল্লায় মেপে দেখার ভাবনা-ই নেই।

নাকি, সূক্ষ্ম হিসেবটা তৈরি হয়ে গিয়েছে নিজের মতো করে?

দাঁড়িপাল্লায় মেপে নিয়েছেন, করোনায় মৃতদের মধ্যে আমরা-ওরার বিভাজন কম – ওরা বেশি মরলেও, আমাদেরও কিছু কিছু মরতে হবে – কিন্তু, অনাহারে? সে অসুখের ভ্যাক্সিন তো আমাদের ব্যাঙ্কেই আছে – তাই না??

অতএব, দৃশ্য চার। সারি সারি মানুষ ভিড় করে আছেন বাসস্ট্যান্ডে। শহরে দিনমজুরি বা খুচরো কাজ করে তাঁদের দিনগুজরান হত – সে কাজ বন্ধ। দেশে ফিরলে গ্রামের ভাই-বেরাদররা নিজের থালা থেকে হলেও দুটো রুটি দিতে পারেন – দেশে ফেরার পথ বন্ধ। কে যেন বলেছে, আজ বাস পাওয়া যাবে, তাই…

আর সব দৃশ্য মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে উপরিউক্ত দৃশ্যাবলি বিষয়ে আপনাদের প্রতিক্রিয়ায়।

এক। আপনাদের খিল্লি আর হাসিঠাট্টা। না, আপনারা ওই লোকগুলোর থেকে অন্য গ্রহের বাসিন্দা – একইরকম দেখতে হলেও ওরা ভিন্ন প্রজাতি – ওদের চাওয়া-পাওয়ার সাথে আপনাদের “সচেতন” জীবনযাত্রার ফারাক দুস্তর। 

দুই। আপনাদের সহানুভূতির অভাব – এমনকি, যখন লোকদেখানো আবেগ প্রকাশ করেন, সেটুকুও অসৎ। কর্মজীবনে আন্তরিকতার ভান করতে করতে, উপরে ওঠার মইয়ে প্রতিযোগিতায় অভ্যস্ত হতে হতে আপনাদের পুরোটাই কৃত্রিমতায় ভরে গিয়েছে – আর ভেতরটা প্রকাশিত হয়ে পড়লে, সে বড় পূতিগন্ধময়, যেমনটি বেরিয়ে এল দমদমে – আবাসনের সহবাসিন্দা স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি আচরণে।

তিন। দেশের বাস্তব ভুলে শুধুই তত্ত্বের চোখ দিয়ে দেশটাকে দেখা – নাকি চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতাকে তত্ত্বের পরতে চাপা দিয়ে রাখা।

চার। সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে চাক্ষুষ করতে পারা গেল আপনাদের আশ্চর্য অবজারভেশন। এসময় এদের তো গ্রামে চলে যাওয়ার কথা – শহরে বসে ছিল কেন!! আচ্ছা, সিরিয়াসলি, কয়েক মাস কি কয়েক বছরের আশ্রয়, এমনকি সে আবাস অস্থায়ী ঝুপড়ি হলেও, একদিনের আচমকা ঘোষণায় সপরিবার ফাঁকা করে চলে যাওয়া যায়?? আপনি পারতেন?? এইসব মালেদের জন্যেই এদেশে করোনা ছড়িয়ে পড়বে – লকডাউনটা এফেক্টিভ হবে না এদের জন্যে – আর করোনায় পিলপিল করে মরবে এরাই শেষমেশ!! নাঃ থাক, এই নিয়েই তো এতক্ষণ ধরে বলে চলেছি। 

***

মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে পরেই পড়েছিলাম একখানা আশ্চর্য ছোটগল্প— দ্য আল্টিমেট সাফারি— লেখিকা নাদিন গর্ডিমার।

ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ করার মতো একখানা খুব সাধারণ বিজ্ঞাপন— পত্রিকার পাতায় সেই বিজ্ঞাপনের সারার্থ দাঁড়ায়, আসুন, আফ্রিকান অ্যাডভেঞ্চারে অংশ নিন— আফ্রিকাকে যাঁরা হাতের তালুর মতো করে চেনেন, তাঁদের সঙ্গে সাফারি উপভোগ করুন।

গল্পের শুরুতেই এই ট্র‍্যাভেল অ্যাড উদ্ধৃত করেন লেখিকা।

আর তারপর শোনাতে থাকেন এক আশ্চর্য গল্প। জন্তুজানোয়ারদের সিজনাল মাইগ্রেশনের মতো করেই মানুষের মাইগ্রেশন – হ্যাঁ, সাধারণ মানুষ – আফ্রিকাকে হাতের তালুর মতো করে চেনেন বলে যাঁদের কথা বলা হয়েছে, তাঁরা কি এই মানুষগুলোই?? বিজ্ঞাপন দিয়ে আপনাদের কি আহবান করা হয় এই মানুষগুলোর সহযাত্রী হতেই – ভাগ্যিস, তা নয় সত্যিসত্যি!! 

যুদ্ধবিধ্বস্ত মোজাম্বিক। একটি এগারো বছরের মেয়ে। বাবা যুদ্ধে গিয়ে আর ফেরে না। মা একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেন না। ঠাকুমা-দাদুর সঙ্গে তিন বছরের ভাইকে সঙ্গে নিয়ে আশ্চর্য মাইগ্রেশন। অনাহার সাথী করে জঙ্গল পার হয়ে ভিনদেশে পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশে, হয়ত, আল্টিমেট সাফারি।

মানুষসমান উচ্চতার ঘাসের জঙ্গলের— ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক— তার মধ্যে দিয়ে পথ খুঁজে চলা… প্রতিপদে শ্বাপদের ভয়… এমনই ঘাসের আড়ালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে একদিন ফেরেন না দাদু। অল্প অপেক্ষার পর যাত্রা আবার শুরু মেয়েটির, সঙ্গে অপুষ্টিতে ভোগা ভাই আর ঠাকুমা।

একদিন লক্ষ্যে পৌঁছানো হয়ে যায়— স্বপ্নের উজ্জ্বল দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা— না, তেমন করে ঠাঁই মেলে না। ওই রিফিউজি ক্যাম্প, তাঁবু— এর বেশি আর আশা কতটুকুরই বা। এমনি করেই কেটে যায় দিন। ঠাকুমা ইট ভাঙার কাজ নিয়ে নাতি-নাতনিদের মুখের খাবারটুকু জোটান।

একদিন, সাংবাদিকরা আসেন— দেশবিদেশ থেকে শাদা সাংবাদিকের দল। ঠাকুমাকে প্রশ্ন করতে আসেন তাঁরা। ঠাকুমা খুব একটা গুছিয়ে উত্তর দিতে পারেন না।

–কতদিন ধরে এখানে আছেন?
–এখানে? মানে, এই তাঁবুতে? তা ধরুন, দুবছর এক মাস…
–ভবিষ্যতের জন্যে কী আশা করেন?
–কিছুই না। এখানে আছি… এটুকুই বুঝি।
–দেশে ফিরতে চান না? আপনার দেশ? মোজাম্বিক? অন্তত, যুদ্ধটুদ্ধ থেমে গেলে??
–না। চাই না। আমার কোত্থাও কিচ্ছু নেই। দেশ বা ঘর— কোনওটাই নেই।

মেয়েটা খুব অবাক হয়। কী বলছে ঠাকুমা এসব!! যুদ্ধ থামলেই তো সে তো আবার ঠাকুমাকে নিয়ে সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দেশে ফিরে যাবে। বাবা-মা হয়ত ততদিনে বাড়িতে ফিরে এসেছে। দাদু হয়ত জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেছিল – কাউকে দেখতে না পেয়ে একা একা বাড়ি ফিরে গেছে আর তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।

***

বিশ্বাস করুন, আমি স্রেফ স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম এই গল্প পড়ে। কেঁদে ফেলেছিলাম, রাত্তিরে ঘুমোতে পারিনি। সে বয়সে আমি ওরকমই বোকা বোকা সেন্টিমেন্টাল টাইপের ছিলাম।

আজ করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের মুহূর্তে, আমার দেশের মানুষ হেঁটে চলেছেন… ঠা ঠা রোদ্দুরে শুকনো-মুখ বাচ্চা কোলে… খড়্গপুর থেকে পুরুলিয়া… দিল্লি থেকে কানপুর।

না, এই আল্টিমেট সাফারি চোখের সামনে দেখেও আমরা বিচলিত হচ্ছি না।

আসলে, আমরা ট্যুরিস্টের চোখে দেশকে দেখতে শিখে নিয়েছি।

আমরা যে দেশটিকে ভালোবাসি বলে বিশ্বাস করি, সে আদতে কোনো রক্তমাংসের দেশ নয় – ট্যুরিস্ট ব্রশিওরে দেশের বিজ্ঞাপনমাত্র – সেও তো একরকম বিদেশ ভিন্ন আর কিছু নয়।

আর জানেনই তো—

এই বিদেশে সবই মানায়
পা-চাপা প্যান্ট, জংলা জামা
ধোপদুরস্ত গলার রুমাল, সঙ্গে থাকলে
অশ্বত্থামা
এই বিদেশে সবই মানায়।
ব্রায়ার-পাইপ, তীক্ষ্ণ জুতো
নাকের গোড়ায় কামড়ে-বসা কালো
কাচে রোদের ছুতো
এই বিদেশে সবই মানায়।

(শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এই বিদেশে)

অতএব, আপনাদের শ্লেষ-খিল্লি, বিরক্তি-ঘৃণা, উপেক্ষা-প্যানিক, আচমকা সিদ্ধান্তের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি-অনাহারে মৃত্যু-কোল্যাটারাল ড্যামেজের হিসেব না কষে নির্মোহ গাণিতিক বিশ্লেষণ – বিশ্বাস করুন, আমি বুঝতে পেরে গিয়েছি – এই বিদেশে সবই মানায় – আর বিচলিত হই না – এর বেশি আর কিছু আশাও করি না – আই জাস্ট ডোন্ট মাইন্ড অ্যাট অল!!

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4596 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

9 Comments

  1. চুলচেরা বিশ্লেষণ…
    বাস্তবতার নিরিখে অসাধারণ একটি লেখা।
    চলতে থাকুক আপনার লেখনী

  2. জানিনা চোখে জল আসা উচিত নাকি মাথায় রক্ত চড়ে যাওয়া উচিত। জানিনা সত্যি জানিনা কীভাবে আপনি অসাধারণ কলম আর কলজে পেলেন! কিন্তু শব্দহীন ভাবে নিজের অপদার্থ তা কে ধিক্কার দেওয়া ছাড়া কিচ্ছু করার নেই আমার বিশ্বাস করুন। এই আপাত এলোমেলো লেখার আঘাতে প্রতি মুহূর্তে এফোড় ওফোড় হতে থাকি আমি। এভাবে কজন ভাবে, ভাবতে শেখে। আপনি চিকিৎসকদের মধ্যে একজন এই আমার ভাললাগা। ভালবাসা থাকল। এ কলম যেন না থমকায়।

  3. অত্যন্ত জরুরী ও শক্তিশালী লেখা।

  4. বিষান, নিজেকে দেখতে পেলাম, আমাদের স্বদেশধারণার ভন্ডামি আর স্বার্থপর সুখানুসন্ধান আমাকে কুঁকড়ে দিল। ভয় করছে নিজেকেই।

    • এরকম করে বলবেন না, প্লীজ।

      ভালোবাসা আর প্রণাম রইল।

      ❤❤❤❤

  5. সব ঠিক হয়ে যাবে, করোনা মিলিয়ে যাবে। আবার আমরা নিজের নিজের বৃত্তে ফিরে যাবো। করোনা শুধু আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যাবে, মিথ্যেই বড়াই তোদের। তোরা কীটের অধম, শক্তিতে ও মনোবৃত্তিতে।

Leave a Reply to DEBASHIS CHAKRABARTY Cancel reply